আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৬- দুআ - যিকরের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৩০৭
৩৩৪৬. দিনে ও রাতে নবী (ﷺ) এর ইস্তিগফার করা।
৫৮৬৮। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহর কসম! আমি প্রত্যহ আল্লাহর কাছে সত্তরবারেরও বেশী ইস্তিগফার ও তাওবা করে থাকি।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

তাওবা কাকে বলে
'তাওবা'-এর আভিধানিক অর্থ ফেরা ও অভিমুখী হওয়া। তাওবাকারী ব্যক্তি মন্দ অবস্থা থেকে ভালো অবস্থার দিকে এবং আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে তাঁর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে। যখন সে গুনাহ করেছিল, তখন আল্লাহর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। ফলে তাঁর রহমত থেকে দূরে সরে গিয়েছিল এবং তাঁর সংগে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাওবার মাধ্যমে সে সেই উদাসীনতা ছেড়ে আল্লাহর অভিমুখী হয়। তাঁর রহমতের দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং তাঁর সংগে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে।
শরীআতের পরিভাষায় পাপকর্ম থেকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসাকে তাওবা বলে। কিংবা বলা যায়, গুনাহের কারণে আল্লাহ হতে দূরে সরে যাওয়ার পর লজ্জা ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে পুনরায় তাঁর নৈকট্যের দিকে ফিরে আসার নাম তাওবা।

পাপের স্তরভেদে তাওবারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। সর্বাপেক্ষা কঠিন গুনাহ হল কুফরীকর্ম, যেমন আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা, আল্লাহর সংগে কাউকে শরীক করা, দীনের কোনও বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা ইত্যাদি। তার পরবর্তী স্তরের গুনাহ এমনসব মহাপাপ, যা কুফরীর স্তরের নয়, যেমন চুরি করা, মিথ্যা বলা, গীবত করা ইত্যাদি। সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে সগীরা গুনাহ। যে সকল কাজ সুন্নতে মুআক্কাদা, তাতে গাফলাত করলে সগীরা গুনাহ হয়, যেমন মিসওয়াক না করা, যোহরের আগের ও পরের সুন্নত না পড়া, সালাম না দেওয়া ইত্যাদি।

প্রকাশ থাকে যে, কোনও সগীরা গুনাহ বার বার করতে থাকলে তা আর সগীরা থাকে না; বরং কবীরা গুনাহে পরিণত হয়ে যায়। এমনিভাবে সগীরা গুনাহকে তাচ্ছিল্য করলে বা ঔদ্ধত্যের সাথে তাতে লিপ্ত হলেও তা কবীরা গুনাহ হয়ে যায়।

গুনাহের এই প্রকারভেদ হিসেবে তাওবার প্রথম স্তর হল, কুফর থেকে তাওবা করে ঈমান আনা। অর্থাৎ কেউ যদি কোনও কুফরী কর্মে লিপ্ত থাকে, অতঃপর বুঝতে পারে যে, তার দ্বারা অমুক কুফরী কাজটি হয়ে গেছে, অথবা আগে থেকেই সে কাফেরদের দলভুক্ত থাকে এবং নাস্তিক, ইহুদী, খৃষ্টান, পৌত্তলিক ইত্যাদি ঘরানার লোক হয়ে থাকে, তবে তার কর্তব্য এই কুফরী অবস্থা পরিত্যাগ করে খাঁটি মনে ঈমান আনা ও মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া।

দ্বিতীয় স্তরের তাওবা হল, কবীরা গুনাহ পরিহার করে শরীআতের বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অর্থাৎ কোনও মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা কুফরের নিম্নপর্যায়ের কোনও অবাধ্যতা ও নাফরমানী হয়ে গেলে তার কর্তব্য তৎক্ষণাৎ তা পরিহার করে আল্লাহর অভিমুখী হওয়া ও একজন বাধ্য অনুগত বান্দায় পরিণত হয়ে যাওয়া।

তৃতীয় স্তরের তাওবা হল, সমস্ত সগীরা গুনাহ ছেড়ে দিয়ে সুন্নতসম্মত জীবনযাপন করা। অর্থাৎ শরী'আতের অনুগত কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি সর্বদা তাকওয়ার সাথে চলতে সচেষ্ট থাকে, কখনও কোনও কবীরা গুনাহে লিপ্ত না হয়, কিন্তু অসতর্কতাবশত কোনও সগীরা গুনাহ তার দ্বারা হয়ে যায়, তবে সে ব্যাপারেও তার উচিত খাঁটি মনে তাওবা করা এবং সেই সগীরা গুনাহ ছেড়ে দিয়ে তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া।

উলামায়ে কিরাম বলেন, প্রতিটি গুনাহ থেকে তাওবা করা অবশ্যকর্তব্য। গুনাহ যদি আল্লাহর হক সংক্রান্ত হয়, কোনও মানুষের হক তার সংগে সম্পৃক্ত না থাকে, তবে তার জন্য তিনটা শর্ত- (ক) গুনাহের কাজটি ছেড়ে দেওয়া; (খ) তা করে ফেলার পর তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং (গ) আর কখনও তাতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। এই তিনটি শর্তের কোনও একটি পূরণ না হলে তাওবা সঠিক হয় না।

গুনাহ যদি বান্দার হক সংক্রান্ত হয়, তবে তার জন্য শর্ত চারটি- উপরের তিনটি আর চতুর্থ শর্ত হল, সেই হকের ব্যাপারে পাওনাদারের পক্ষ হতে দায়মুক্ত হওয়া। দায়মুক্ত হওয়ার উপায় একেক অবস্থায় একেক রকম, যেমন সে হক যদি অর্থ-সম্পদ জাতীয় হয়, তবে তা তাকে ফেরত দেওয়া। যদি কারও প্রতি অপবাদ দিয়ে থাকে, তবে সেই অপবাদের শাস্তি আরোপের সুযোগ করে দেওয়া অথবা তার কাছ থেকে সরাসরি মাফ চেয়ে নেওয়া। যদি গীবত হয়ে থাকে, তবে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া।
সমস্ত গুনাহ থেকে তাওবা করা জরুরি। যদি সব গুনাহ থেকে তাওবা না করে বিশেষ কোনোটির ব্যাপারে করে থাকে, তবে হকপন্থীদের মতে সেই গুনাহের ব্যাপারে তাওবা সহীহ হবে বটে, কিন্তু অন্যসব গুনাহ তার উপর থেকে যাবে।

তাওবা করা যে অবশ্যকর্তব্য, এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহে প্রচুর দলীল আছে এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও সংঘটিত হয়ে আছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
قَالَ الله تَعَالَى: {وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ} [النور: 31]
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন কর।- নূরঃ ৩১
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
وَقالَ تَعَالَى: {وَأَنِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ} [هود: 3]
অর্থ : এবং এই (পথনির্দেশ দেয়) যে, তোমাদের প্রতিপালকের কাছে গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁর অভিমুখী হও।- হুদঃ ০৩
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحا} [التحريم: 8]
অর্থ : হে মুমিনগণ! আল্লাহর কাছে খাঁটি তাওবা কর।- তাহরীমঃ ০৮
অবশ্য বান্দা যখনই তাওবা করবে, তখন এ গুনাহের স্তরভেদ অনুযায়ী আলাদা আলাদা তাওবা না করে একইসংগে সর্বপ্রকার পাপ থেকে তাওবা করা উচিত।
ব্যাখ্যা: এ তিন আয়াতেও আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদেরকে তাঁর কাছে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও তাওবা করার হুকুম দিয়েছেন। সুতরাং তাওবা করা প্রত্যেক মু'মিনের জন্য ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।

তাওবা কবুলের শর্তসমূহঃ
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ ও বান্দার সাথে সম্পর্ক হিসেবে গুনাহ দুই প্রকার- এক. আল্লাহর হক নষ্ট করা সম্পর্কিত গুনাহ, যেমন নামায না পড়া, রোযা না রাখা ইত্যাদি।
দুই. বান্দার হক নষ্ট করা সম্পর্কিত গুনাহ, যেমন কারও সম্পদ আত্মসাৎ করা, কারও গীবত করা, অপবাদ দেওয়া ইত্যাদি।

ইমাম নববী রহ. প্রথম প্রকারের গুনাহ থেকে তাওবার জন্য তিনটা শর্ত বলেছেন-
ক. গুনাহ পরিত্যাগ করা। এর মানে যেই গুনাহের ব্যাপারে তাওবা করছে, প্রথমে সেই গুনাহটি ছাড়তে হবে, যেমন নামায না পড়ার গুনাহ থেকে তাওবা করতে হলে প্রথমে নামায না পড়ার অপরাধ থেকে ফিরে আসতে হবে অর্থাৎ নামায পড়া শুরু করে দিতে হবে। গুনাহ না ছেড়ে তাওবা করলে সেই তাওবার কোনও সার্থকতা নেই। গুনাহ করতে থাকলাম আবার তাওবাও করলাম, এটা একটা তামাশা। অনেকে আছে মুখে তাওবা তাওবা বলে, তাওবা বলে দুই গালে দুই থাপ্পর মারে, আবার কৃত গুনাহ যথারীতি চালিয়েও যায়। এটা তাওবার নামে তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। বরং এ হিসেবে এটাও এক গুরুতর পাপ। কেননা তাওবা করা মানে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। আল্লাহর দিকে রুজু তো পাপকর্ম ছেড়ে দিয়েই করতে হয়। নয়তো সেই রুজু একটা ধৃষ্টতা। যেন সে পাপকর্মকে প্রকৃতপক্ষে কোনও অপরাধই মনে করে না। এরূপ তাওবার জন্য নতুন করে আবার তাওবা করা উচিত।

খ. তিনি দ্বিতীয় শর্ত বলেছেন, মনে মনে অনুতপ্ত হওয়া। এটা তাওবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অনুতপ্ত হওয়ার অর্থ অন্তরে এই ভাব জন্মানো যে, আমার দ্বারা নিতান্তই ভুল হয়ে গেছে। এই কাজ করা আমার পক্ষে কিছুতেই উচিত হয়নি। আল্লাহ ক্ষমা না করলে তো আমাকে এজন্যে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অন্তরে এই অনুভূতি জন্মালে তবেই সে তাওবা খাঁটি তাওবা হয় এবং প্রমাণ হয় যে, সে ইখলাসের সংগেই তাওবা করেছে। তাওবা তো একটি আমলই বটে। এটা কবুল হওয়ার জন্যও ইখলাস জরুরি। তাওবার ক্ষেত্রে ওই অনুভূতি থাকাটাই ইখলাসের পরিচায়ক। নয়তো এটা একটা লোকদেখানো ভড়ং মাত্র হয়ে যায়, আল্লাহ তা'আলার কাছে যার কোনও মূল্য নেই। এজন্যই এক হাদীছে আছে, الندم التوبة “অনুতাপ-অনুশোচনাই তাওবা”।

গ. তৃতীয় শর্ত ভবিষ্যতে সেই গুনাহে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করা। তাওবা করার সময় যদি মনে এই ধারণা থাকে যে, সুযোগ হলে আবারও সে এই কাজ করবে, তবে তা আদৌ তাওবা বলে বিবেচ্য হবে না এবং আল্লাহর কাছে তা কবুলও হবে না। হ্যাঁ এটা সম্ভব যে, ভবিষ্যতে সেই গুনাহ আর না করার অঙ্গীকারেই সে তাওবা করেছে, পরবর্তীকালে নফস ও শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে পুনরায় সে একই গুনাহ করে ফেলেছে। এটা তাওবার পরিপন্থী নয়। এরূপ ক্ষেত্রে কর্তব্য আবারও তাওবা করা। এভাবে পুনরায় গুনাহ না করার প্রতিশ্রুতিতে যদি বার বার তাওবা করা হয় এবং প্রতিবারই তাওবার পরে ফের একই গুনাহ হয়ে যায়, তবে এর দ্বারা তার তাওবা নিরর্থক গণ্য হবে না। বরং আন্তরিক অনুশোচনার সংগে বার বার এরকম তাওবা করা তার আল্লাহ অভিমুখিতারই পরিচায়ক সাব্যস্ত হবে।

তাওবা করতে বিলম্ব করা উচিত নয়
প্রকাশ থাকে যে, গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করতে বিলম্ব করা উচিত নয়। তাওবা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই তা কবুলের পক্ষে সহায়ক হয়। বরং প্রকৃত মুমিনের পরিচয় তো এটাই যে, এক তো সে কোনও গুনাহ পরিকল্পিতভাবে করবে না, বরং তার দ্বারা কোনও গুনাহ হলে তা হবে আকস্মিক দুর্ঘটনাবশত, ঠিক পিচ্ছিল পথে আছড়ে পড়ার মত। কেউ পরিকল্পিতভাবে আছাড় খায় না। অসতর্কতাবশত পড়ে যায় মাত্র। অসতর্কতাবশত যে ব্যক্তি পড়ে যায়, সে যেমন চটজলদি উঠে কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে ফেলে, ঠিক তেমনি মু'মিন ব্যক্তি দ্বারা কোনও গুনাহ হয়ে গেলে সেও চটজলদি তাওবা করে সাফসুতরা হয়ে যাবে। এ কথাই কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে যে-
{إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا} [النساء: 17]
অর্থ : আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের তাওবা কবুল করেন, যারা অজ্ঞতাবশত কোনও গুনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়।- নিসাঃ ১৭

গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করতে গড়িমসি করা কোনও মু'মিনের পক্ষে শোভনীয় নয়। এটা হল আছাড় খেয়ে পড়ে থাকার মত। কোনও বুদ্ধিমান লোক ওরকম পড়ে থাকেনা। ঠিক তেমনি প্রকৃত কোনও মু'মিন ব্যক্তিও গুনাহ নিয়ে বসে থাকতে পারে না। তার মনে ভয় থাকবে- নাজানি কখন মৃত্যু এসে যায় আর এই গুনাহের ময়লা নিয়েই কবরে চলে যেতে হয়। তা যাতে না হয়, তাই অবিলম্বেই সে তাওবা করে পাকসাফ হয়ে যাবে। তাছাড়া এই ভয়ও তো আছে যে, দেরি করতে করতে একদম মৃত্যুর কাছাকাছি সময় চলে আসবে এবং মালাকুল মাওতের কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। যখন মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়, তখন তাওবা করলে সে তাওবা কবুল হয় না। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
{وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا} [النساء: 18]
অর্থ : তাওবা কবুল তাদের প্রাপ্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে, পরিশেষে তাদের কারও যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন সে বলে, এখন আমি তাওবা করলাম।- নিসাঃ ১৮

বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষমালাভও জরুরি
ইমাম নববী রহ. বান্দার হক সম্পর্কিত গুনাহ থেকে তাওবার জন্য চতুর্থ শর্ত বলেছেন, বান্দার পক্ষ থেকে দায়মুক্ত হওয়া। বস্তুত বান্দার হকের ব্যাপারটি খুবই কঠিন। আল্লাহ তা'আলা তো বেনিয়াজ এবং তিনি অমর, অক্ষয়। একে তো তার কোনও ঠেকা ও অভাব নেই। তিনি চাইলেই যেকোনও গুনাহ মাফ করতে পারেন, এমনকি চাইলে বিনা তাওবায়ও মাফ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত যেকোনো সময়ই তার কাছে তাওবা করার সুযোগ আছে। বান্দার যতদিন হায়াত আছে, ততদিন আল্লাহর কাছে তাওবার দুয়ার অবারিত। কিন্তু বান্দার ব্যাপারটা এমন নয়। বান্দা ধনী হোক, তারপরও অভাবগ্রস্ত এবং সে মরণশীলও বটে। কাজেই কারো কোনো হক নষ্ট করলে বান্দা তা মাফ নাও করতে পারে। আবার এমনও হতে পারে মাফ চাওয়ার সুযোগই হল না, তার আগেই সে মারা গেল। এ কারণেই বান্দার হকের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি, যাতে কখনোই তা নষ্ট করা না হয়। কখনও কোনও বান্দার হক নষ্ট করে ফেললে যথাশীঘ্র তা আদায় করে দেওয়া উচিত বা ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত।
ইমাম নববী রহ. বলেছেন, যদি মাল-সম্পদ জাতীয় জিনিস হয়, তবে তাকে তা ফেরত দিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে যদি না পাওয়া যায় তখন কী করণীয়? যেমন হয়ত মারা গেছে, কিংবা কোথায় আছে তার ঠিকানা জানা নেই, কিংবা পাওনাদারের সংখ্যা অতি বিপুল, যাদের প্রত্যেকের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়, যেমন সরকারি সম্পদে তসরুফ করলে তার পাওনাদার হয়ে যায় গোটা দেশবাসী। এরূপ ক্ষেত্রে উপায় কী?

এর উত্তর হল, পাওনাদার যদি মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। যদি নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে এবং তার কোনও ওয়ারিশ না পাওয়া যায়। তবে তার নামে তা সদকা করে দিতে হবে। সরকারি সম্পদ হয়ে থাকলে সরকারের কোনও ফান্ডে তা জমা দিতে হবে। এর বিস্তারিত খুটিনাটি আলেমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত।

আর যদি মাল-সম্পদ জাতীয় জিনিস না হয়, বরং কারও অন্য কোনও রকমের হক নষ্ট করা হয়ে থাকে, যেমন কাউকে অন্যায়ভাবে মারধর করা হল। এতে তার জানের হক নষ্ট করা হয়েছে। অথবা কাউকে গাল দেওয়া হয়েছে, তার নামে, অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। এর দ্বারা তার ইজ্জতের হক নষ্ট হয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে কর্তব্য তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। আর যদি সে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করা, যেন আল্লাহ তা'আলা তার পাপরাশি মাফ করে দেন। তার প্রতি রহমত করেন, তাকে কবরে শান্তিতে রাখেন, তাকে জান্নাতবাসী করেন ইত্যাদি। এরূপ দু'আ করতে থাকলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ হতে ক্ষমার ব্যবস্থা করে দেবেন।

প্রকৃতপক্ষে এ হাদীছ দ্বারা উম্মতকে তাওবা ও ইস্তিগফারের প্রতি উৎসাহ দান করা উদ্দেশ্য। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো মাসূম ছিলেন। তিনি নবী ও রাসূলগণেরও শ্রেষ্ঠতম। তাঁর দ্বারা কোনও রকমের গুনাহ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তা সত্ত্বেও তিনি যখন এতবেশি পরিমাণে তাওবা করতেন, তখন তাঁর উম্মতের প্রত্যেকের তো আরও বেশি পরিমাণে তাওবা করা উচিত। প্রশ্ন হতে পারে, তাঁর যখন কোনও গুনাহ ছিল না, তখন তিনি কিসের থেকে তাওবা করতেন? উত্তর, আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও বন্দেগীর সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত থাকার কারণে তাঁর বিনয়ভাব অতি প্রবল ছিল। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও মা'রিফাত সর্বাপেক্ষা বেশি থাকার কারণে তাঁর অন্তরে আল্লাহর ভয়ও ছিল সবচে' বেশি। তো ওই বিনয় ও ভীতির অবস্থান থেকে তাঁর বিশ্বাস ছিল, মহিয়ান-গরিয়ান আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্য যে পর্যায়ে হওয়া উচিত, তাঁর দ্বারা ঠিক সেইরকম হচ্ছে না। আল্লাহ তা'আলার ইবাদতের হক তাঁর দ্বারা যেন ঠিক আদায় হচ্ছে না। বস্তুত কারও পক্ষে তা আদায় করা সম্ভবও নয়। তিনি এটাকে নিজের একরকম কমতি ও ত্রুটি মনে করতেন। তার এত অধিক সংখ্যক তাওবা ছিল সেই অনুভূতি থেকেই।
প্রশ্ন হতে পারে, অন্য হাদীছে তো তাঁর তাওবার সংখ্যা বলা হয়েছে সত্তর, অথচ এ হাদীছে তিনি রোজ একশ' বার তাওবা করতেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে? এ দুই বর্ণনার মধ্যে কোনটা সঠিক?
উত্তর, উভয়টিই সঠিক। এর মানে তিনি কোনওদিন সত্তরবার তাওবা করতেন এবং কোনওদিন একশ'বার। এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়, বরং বোঝানো উদ্দেশ্য যে, তিনি খুব বেশি বেশি তাওবা করতেন। যেমন, আমরা বলে থাকি, আমি তোমাকে এ কথা একশ'বার বলেছি। তার মানে বহুবার বলেছি। একশ' দ্বারা আমরা সুনির্দিষ্ট একশ' সংখ্যা বোঝাই না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বিনয় ছিল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। আমাদেরও এ গুণ অর্জন করা উচিত।

খ. আল্লাহ সম্পর্কে জানা থেকে আল্লাহ্ভীতির জন্ম হয়। তাই অন্তরে আল্লাহ্ভীতি জন্মানোর লক্ষ্যে আল্লাহ্ সম্পর্কে যতবেশি সম্ভব জ্ঞান লাভ করা উচিত। সেই সঙ্গে বাস্তবিকপক্ষে যাতে অন্তরে আল্লাহ্ভীতি জন্মায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত।

গ. বেশি বেশি তাওবা করার পেছনে আল্লাহ্ভীতির যথেষ্ট ভূমিকা আছে। তার অন্তরে আল্লাহ্ভীতি জন্মানোর সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করা একান্ত কর্তব্য।

ঘ. নিয়মিত বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফারে রত থাকা প্রত্যেক মু'মিনের অবশ্যকর্তব্য।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন