রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫৮
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
সম্পদ জমা না করে নেককাজে খরচ করার প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ৫৫৮

হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, থলির মুখ বন্ধ করে রেখো না, তাহলে তোমার প্রতি (আল্লাহর দান) বন্ধ করে রাখা হবে।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তুমি খরচ করো বা দান করো বা ছড়িয়ে দাও। হিসাব করো না, তাহলে তোমার প্রতিও আল্লাহ হিসাব করে দেবেন। উদ্বৃত্ত সম্পদ আটকে রেখো না, তাহলে আল্লাহও তোমার থেকে আটকে রাখবেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ১৪৩৩; সহীহ মুসলিম : ১০২৯; জামে তিরমিযী: ১৯৬০; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ৯১৪৮; মুসনাদে আহমাদ: ২৬৯২২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ২৪৮)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
558 - وعن أسماء بنت أَبي بكرٍ الصديق رضي الله عنهما، قالت: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ تُوكِي فَيُوكى عَلَيْكِ (1)».
وفي رواية: «أنفقي أَوِ انْفَحِي، أَوْ انْضَحِي، وَلاَ تُحصي فَيُحْصِي اللهُ عَلَيْكِ، وَلاَ تُوعي فَيُوعي اللهُ عَلَيْكِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (2)
وَ «انْفَحِي» بالحاء المهملة، وَهُوَ بمعنى «أنفقي» وكذلك «انْضحي».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আসমা রাযি. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর বড় মেয়ে এবং উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর বড় বোন। তাঁর স্বামীর নাম হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি., যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফুফাতো ভাই এবং আশারায়ে মুবাশশারার একজন। হযরত আসমা রাযি. দান-খয়রাত করার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ছিলেন অত্যন্ত গরীব। হযরত যুবায়র রাযি. নিজেও খুব গরীব ছিলেন, যদিও পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এ হাদীছটির সম্পর্ক তাঁর প্রথম জীবনের সঙ্গে, যখন তাঁর জীবনযাপন ছিল খুবই কৃচ্ছতার সঙ্গে। পারিবারিক খরচার জন্য তিনি হযরত আসমা রাযি.-এর হাতে যা দিতেন তার পরিমাণ হতো খুবই সামান্য। ওদিকে হযরত আসমা রাযি.-এর তো দান-খয়রাতের প্রতি খুবই আগ্রহ। কাজেই এ অবস্থায় তিনি, যেমন কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেন যে, খরচা হিসেবে যুবায়র রাযি. তাঁকে সামান্য যে মাল দিয়ে থাকেন, তা থেকে তিনি দান-খয়রাত করতে পারবেন কি? দান-খয়রাত করলে গুনাহ হবে না তো? এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাছ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تُوكي فيوكَى عليكِ ‘থলির মুখ বন্ধ করে রেখো না, তাহলে তোমার প্রতি (আল্লাহর দান) বন্ধ করে রাখা হবে'। অর্থাৎ নিজের কাছে যাই আছে তা থেকেই দান-খয়রাত করতে থাকো। দান-খয়রাত করা হতে বিরত থেকে তা নিজের কাছে জমা করে রেখো না। তা যদি কর, তবে আল্লাহ তা'আলাও তোমার প্রতি তাঁর দানের দুয়ার বন্ধ করে দেবেন। আর যদি দান করতে থাক, তবে তিনি তোমার প্রতিও তাঁর দান অবারিত রাখবেন। সারকথা তুমি যেমন কর্ম করবে, তেমনি ফল ভোগ করবে।

অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন- أَنْفِقِي، أَو انْفَحِي، أَو انْضِحِي (তুমি খরচ করো বা দান করো বা ছড়িয়ে দাও)। এখানে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থ কাছাকাছি। أَنْفِقِي অর্থ খরচ করো। انْفَحِي অর্থ দান করো। আর انْضِحِي অর্থ ছড়িয়ে দাও। এ শব্দটির মধ্যে দান বেশি করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ সামনে, পেছনে, ডানে ও বামে সবদিকে দান-খয়রাত করো। বর্ণনাকারী 'অথবা' 'অথবা' বলে এ শব্দ তিনটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বোঝাচ্ছেন যে, হাদীছের প্রকৃত শব্দ কোনটি, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে তিনটির যে-কোনও একটি হবে। যেটিই হোক না কেন, উদ্দেশ্যে এ কথা বোঝানো যে, তুমি তোমার প্রয়োজনের বেশি সম্পদ জমা না করে আল্লাহর পথে খরচ করতে থাকো।

وَلَا تُحْصِي فَيُحْصِيَ اللَّهُ عَلَيْكِ (হিসাব করো না, তাহলে তোমার প্রতিও আল্লাহ হিসাব করবেন)। অর্থাৎ এমন যেন না হয় যে, দান-খয়রাত না করে নিজের কাছে জমা রাখছ আর রোজ হিসাব করে দেখছ কী পরিমাণ জমল। শব্দটির মূল হল الاحْصَاء। এর অর্থ আয়ত্ত করা, পরিবেষ্টন করা। বোঝানো হচ্ছে, দান-খয়রাত না করে সবটা নিজ আয়ত্তাধীন করে রেখো না। তা করলে আল্লাহ তা'আলাও তাঁর সম্পদ তোমাকে না দিয়ে নিজ আয়ত্তে রেখে দেবেন। অর্থাৎ তোমার প্রতি তাঁর দানের দরজা বন্ধ করে রাখবেন। শব্দটি 'হিসাব করা' অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে ব্যাখ্যা হবে, তুমি যদি নিজের কাছে জমা করে হিসাব করতে থাক যে, কী পরিমাণ জমল, তবে আল্লাহ তা'আলাও তোমাকে হিসাব করে করে দেবেন। অর্থাৎ তোমার প্রতি তাঁর দান সংকুচিত করে দেবেন। আরেক ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে, তিনি আখিরাতে তোমার সম্পদের পুরোপুরি হিসাব নেবেন, কোনও প্রকার ছাড় দেবেন না। সে ক্ষেত্রে তোমাকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা যার পুরোপুরি হিসাব নেবেন, তার পক্ষে হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া কখনও সম্ভব হবে না। এক হাদীছে আছে-
مَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ عُذِّبَ
যার হিসাব নেওয়া হবে কঠিনভাবে, সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।(সহীহ বুখারী: ৬৫৩৬; সহীহ মুসলিম: ২৮৭৬; সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৩; জামে তিরমিযী: ২৪২৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৩৪৩৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ২৪২০০; সহীহ ইবন হিব্বান: ৭৩৭০; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ৮৫৯৫; শুআবুল ঈমান: ২৬৫; শারহুস সুন্নাহ: ৪৩১৯)

কাজেই শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া তথা কঠিন হিসাব থেকে বাঁচার লক্ষ্যে তোমার যাই আছে তা থেকে যতটুকু সম্ভব আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করো।

وَلَا تُوْعِيْ فَيُوْعِيَ اللَّهُ عَلَيْكَ (উদ্বৃত্ত সম্পদ আটকে রেখো না, তাহলে আল্লাহও তোমার থেকে আটকে রাখবেন)। অর্থাৎ তোমার প্রয়োজনীয় খরচের পর যা বেঁচে থাকে তা নিজের কাছে আটকে না রেখে যারা অভাবগ্রস্ত তাদেরকে দিয়ে দাও। অন্যথায় আল্লাহ তা'আলা তোমার প্রতি তাঁর দানের দুয়ার বন্ধ করে রাখবেন। কিংবা এর অর্থ আল্লাহ তা'আলা আখিরাতে তোমার থেকে তোমার সম্পদের হিসাব নেবেন কঠিনভাবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ বাবদ যে খরচা দিয়ে থাকে, স্ত্রী তা থেকে দান-খয়রাত করতে পারবে।

খ. স্বামী উপার্জন করে যা ঘরে নিয়ে আসে, স্ত্রী তা থেকেও দান-খয়রাত করতে পারবে, যদি অনুমতি আছে বলে বোঝা যায়।

গ. স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে দান-খয়রাতের অনুমতি দিয়ে রাখা চাই।

ঘ. প্রয়োজনীয় খরচের পর যা উদ্বৃত্ত থাকে, তা জমা করা অপেক্ষা দান-খয়রাত করাই শ্রেয়।

ঙ. বিলাসিতায় অভ্যস্ত না হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করা উচিত, যাতে বাড়তি অর্থ নেককাজে খরচ করা যায়।

চ. আল্লাহর পথে খরচ করা আর্থিক সচ্ছলতা লাভের এক প্রকৃষ্ট উপায়।

ছ. নেককাজে খরচ না করে কেবল সঞ্চয়ের ফিকিরে থাকলে আখিরাতে কঠিন হিসাবের ভয় আছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)