রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫৫
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৬০ উদারতা ও দানশীলতা প্রসঙ্গ এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে কল্যাণকর খাতসমূহে অর্থব্যয় করার ফযীলত
তিনটি মহৎ গুণ ও তার সুফল
হাদীছ নং: ৫৫৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দান-খয়রাত সম্পদ কমায় না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা বান্দার ইজ্জত-সম্মানই বৃদ্ধি করেন। যে-কেউ আল্লাহ তা'আলার জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তা'আলা তার মর্যাদা উঁচু করেন। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৫৮৮; জামে তিরমিযী: ৯০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ৯০০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৯৮১৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৩২৪৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১২১৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮১৭; শুআবুল ঈমান : ৩১৩৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৩৪)
مقدمة الامام النووي
60 - باب الكرم والجود والإنفاق في وجوه الخير ثقةً بالله تعالى
555 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَال، وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا، وَمَا تَواضَعَ أحَدٌ لله إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ - عز وجل». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে তিনটি মহৎ গুণের সুফল বর্ণনা করা হয়েছে। গুণ তিনটি হল- দানশীলতা, ক্ষমাশীলতা ও বিনয়। সর্বপ্রথম দানশীলতা সম্পর্কে বলা হয়েছে-
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ (দান-খয়রাত সম্পদ কমায় না)। কমায় তো না-ই; বরং বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন আয়াত ও হাদীছ দ্বারা তা জানা যায়। এটা হয় দুই রকমে। দুনিয়া ও আখিরাতে। দুনিয়ায় হয় এভাবে যে, দান করলে সম্পদে বরকত হয়, বাহ্যিকভাবেও যা দান করা হয়েছে তারচে' আরও বেশি পাওয়া যায় এবং তার বিনিময়ে নানা বিপদ- আপদ ও কষ্ট-ক্লেশ থেকে আত্মরক্ষা হয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।’(সূরা সাবা' (৩৪), আয়াত ৩৯)
দান করলে যে আরও বেশি পাওয়া যায়, এটা একটা পরীক্ষিত বিষয়। ইমাম ফাকিহানী রহ. বলেন, বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, তিনি বিশ দিরহাম থেকে এক দিরহাম দান করে দিয়েছিলেন। পরে ওজন করে দেখেন তা থেকে একটুও কমেনি। আমার নিজেরও এরকম হয়েছে। বস্তুত এরকম অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। যারা দান-খয়রাত করে অভ্যস্ত, তারা এটা ভালোভাবেই জানে।

প্রকাশ থাকে যে, এখানে যদি ফরয দান-সদাকা বোঝানো হয়, তবে তা দ্বারা কমে না এ কারণে যে, যা দেওয়া হয় সেটা তো দাতার উপর দেনা ছিল। তা অন্যের হক, যা কার সম্পদের মধ্যে মিশ্রিত ছিল। তা দিয়ে দেওয়ার দ্বারা দায় শোধ হয়েছে এবং তার সম্পদ অন্যের হক থেকে মুক্ত হয়েছে। কাজেই কমার কোনও প্রশ্ন নেই।

হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্য হচ্ছে ক্ষমাশীলতা সম্পর্কে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَمَا زَادَ اللَّهُ عَبْدًا بِعَفْو إِلَّا عِزًا (ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা বান্দার ইজ্জত-সম্মানই বৃদ্ধি করেন)। ক্ষমাশীলতা একটি মহৎ গুণ। কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার কাছে নিজ গুনাহের ক্ষমা পাওয়ার জন্য এটা এক প্রকৃষ্ট উপায়। আল্লাহ তা'আলা হুকুম দেন-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)
‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।’(সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯)

আখিরাতে যারা আল্লাহ তা'আলার কাছে মাগফিরাত ও জান্নাত লাভ করবে, তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বিশেষভাবে যেসকল গুণ উল্লেখ করেছেন, ক্ষমাশীলতা তার অন্যতম। বলা হয়েছে- وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ (এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত)।(সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪)

আলোচ্য হাদীছে ক্ষমাশীলতার সুফল বলা হয়েছে এই যে, যে ব্যক্তি অন্যকে ক্ষমা করে, তার ইজ্জত-সম্মান বৃদ্ধি করা হয়। এটা করা হয় দুনিয়ায়ও এবং আখিরাতেও। যে ব্যক্তি ক্ষমাশীলরূপে পরিচিত হয়, মানুষের অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মায় এবং তারা তাকে বিশেষ মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি তারা তাকে নেতৃত্বের আসনেও বসায়। আর আখিরাতের ইজ্জত হল ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলাও ক্ষমা করেন। এরূপ ব্যক্তি সহজে জান্নাত লাভ করতে পারবে এবং জান্নাতে উচ্চমর্যাদার অধিকারী হবে।

হাদীছটিতে বর্ণিত তৃতীয় গুণ হচ্ছে বিনয়। বিনয়ের সুফল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ (যে-কেউ আল্লাহ তা'আলার জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তা'আলা তার মর্যাদা উঁচু করেন)। এটাও দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই হয়। আল্লাহর জন্য নিজেকে ছোট করা, আল্লাহ তা'আলার একজন সাধারণ বান্দারূপে জীবনযাপন করা, তাঁর বন্দেগী করা তথা তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করাকে নিজের কর্তব্য জ্ঞান করা, নিজ চাল-চলন, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে বন্দেগীসুলভ পন্থা অবলম্বন করা, কখনও আত্মমুগ্ধতায় না ভোগা, অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা, পদমর্যাদায় বা বয়সে যে নিচের তারও সত্য কথা মানতে কুণ্ঠা না দেখানো, অন্যের অপরাধ সহজে ক্ষমা করতে পারা, অপরের মূল্যায়ন করা, কারও শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ না করা- এসব বিষয় বিনয়ের আলামত। এগুলো যার মধ্যে আছে, সে বিনয়ী। আল্লাহ তা'আলা দুনিয়া ও আখিরাতে এরূপ ব্যক্তির মর্যাদা উঁচু করেন। দুনিয়ায় মানুষের অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মায় ও তার ইজ্জত-সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়। আখিরাতে এরূপ ব্যক্তিকে জান্নাতের উঁচু মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হবে।

উল্লেখ্য, বিনয়ের এ সুফল কেবল তখনই লাভ হতে পারে, যখন এটা কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই অবলম্বন করা হবে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। দুনিয়াবী স্বার্থে যে বিনয় অবলম্বন করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা বিনয় নয়; বরং আত্মাবমাননা, যা কিছুতেই কাম্য নয়। মানুষের ইজ্জত-সম্মান আল্লাহ তা'আলার একটি বড় নি'আমত। পার্থিব স্বার্থে এ নি'আমত জলাঞ্জলি দেওয়া লজ্জাস্কর কাজ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দান-খয়রাত দ্বারা সম্পদ কমে না। তাই কমে যাওয়ার আশঙ্কায় দান-খয়রাত থেকে পিছিয়ে থাকা উচিত নয়।

খ. ক্ষমাশীলতা একটি মহৎ গুণ। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণার্থে আমাদেরকে এ গুণ অবলম্বন করতে হবে।

গ. আমাদেরকে কেবলই আল্লাহ তা'আলার জন্য বিনয় অবলম্বন করতে হবে। তা করতে পারলে আমরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে উঁচু মর্যাদার অধিকারী হতে পারব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)