রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৩৮
ভূমিকা অধ্যায়
নিজ হাতে পরিশ্রম করে খাওয়া এবং অন্যের কাছে প্রার্থনা করা বা দান গ্রহণের জন্য নিজেকে সম্মুখবর্তী করা হতে সংযত রাখার প্রতি উৎসাহদান

মানুষকে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-বন্দেগীর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে প্রাণে বেঁচে থাকলে এবং সুস্থ-সবল থাকলেই ইবাদত-বন্দেগী করা সম্ভব। তাই বেঁচে থাকা ও সুস্থ থাকার জন্য যা-কিছু প্রয়োজন, সেগুলো করাও শরী'আতের হুকুম। সেগুলো আঞ্জাম দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য যদি হয় ইবাদত-বন্দেগী, তবে পরোক্ষভাবে তাও ইবাদত-বন্দেগীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এর জন্য দরকার হয় আয়-রোজগার করার। তাই কুরআন-হাদীছে আয়-রোজগার করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এমনকি একে 'ফরয' শব্দেও ব্যক্ত করা হয়েছে।
উপার্জনের লক্ষ্য যেহেতু ইবাদত-বন্দেগী এবং এ কারণে উপার্জনের মধ্যে ইবাদতের মহিমা রয়েছে, তাই উপার্জন করতে হবে হালাল ও বৈধ পন্থায়, তাতে সে পন্থা যত কষ্টসাধ্যই হোক না কেন। যেমন কামার-কুমার, জেলে, সুতার, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি পেশাজীবীর কাজ। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম প্রমুখ নবীগণও কঠিন শ্রমসাধ্য কাজের বিনিময়ে রোজগার করেছেন। উপার্জনের ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের আদর্শ।
ভিক্ষা করে বা অন্যের সাহায্য নিয়েও জীবন নির্বাহ করা যায় বটে, কিন্তু এটা সম্মানজনক নয়। এর দ্বারা মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। তাই নিতান্ত ঠেকা না হলে এরূপ করাকে জায়েয রাখা হয়নি। ভিক্ষা করাকে পেশা বানানো তো নয়ই, এমনকি চাওয়ার ভান পর্যন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যেন নিজ অভাবের কথা গোপন রাখে, অন্যের কাছে তা প্রকাশ না করে।
অনেক সময় মানুষ আয়-রোজগার করতে অপারগ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে অন্যদের কর্তব্য তাকে সাহায্য করা। সাহায্য করা না হলে এরূপ লোকের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। তাই ইসলাম এরূপ লোককে খুঁজে খুঁজে সাহায্য করতে উৎসাহ দিয়েছে।
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে এসব বিষয় সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন।

‘নিজ হাতে পরিশ্রম করে খাওয়া…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
অর্থ: 'অতঃপর নামায শেষ হয়ে গেলে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো।(সূরা জুমু'আ (৬২), আয়াত ১০)

ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতে জুমু'আর নামাযের আযান হওয়ার পর বেচাকেনা, কাজ- কারবার বন্ধ করে নামাযের জন্য মসজিদে চলে যাওয়ার হুকুম করা হয়েছে। এ আয়াতে জানানো হয়েছে, কাজ-কারবারের নিষিদ্ধতা ছিল সাময়িকভাবে কেবল নামায আদায়ের জন্য। নামায যখন আদায় হয়ে গেল, তখন আর উপার্জনের কাজে লিপ্ত হতে কোনও দোষ নেই। কাজেই নামাযের পর তোমরা আয়-রোজগারের জন্য কর্মক্ষেত্রসমূহে ছড়িয়ে পড়তে পার।
বর্ণিত আছে, ইহুদীদের জন্য তাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন শনিবারে আয়- রোজগারে লিপ্ত হওয়া নিষেধ ছিল। এ আয়াত জানাচ্ছে যে, মুসলিম উম্মাহর জন্য তাদের সাপ্তাহিক দিবসে তা নিষিদ্ধ নয়।
فَضْل الله (আল্লাহর অনুগ্রহ)-এর দ্বারা জীবিকা বোঝানো হয়েছে। বোঝা গেল জীবিকার সন্ধান খারাপ কিছু নয়। জীবিকা যেহেতু আল্লাহর অনুগ্রহ, তাই বৈধ পন্থায় এর সন্ধান তাঁর সন্তুষ্টিমূলক কাজ বলেই গণ্য হবে। এক হাদীছে বলা হয়েছে-
طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ.
‘হালাল উপার্জনের সন্ধান অন্যান্য ফরযের পর আরেকটি ফরয।’(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৬৯৫; শু'আবুল ঈমান : ৮৩৬৭)

আয়াতটিতে এর পর আছে- وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (এবং বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করো, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার)। অর্থাৎ আল্লাহর যিকির ও স্মরণ কেবল নামাযের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখো না; বরং নামাযের বাইরেও মুখে ও অন্তরে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো।
আয়-রোজগারে আল্লাহকে স্মরণ করার একটা বিশেষ দিক হল শরী'আতের অনুসরণ করা। অর্থাৎ অবৈধ পন্থা পরিহার করে বৈধ পন্থায় বৈধ সম্পদ উপার্জন করা। বস্তুত শরী'আতের অনুসরণ করা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যিকির। বিখ্যাত তাবি'ঈ সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলেন, আল্লাহর যিকির হচ্ছে তাঁর আনুগত্য করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল, সেই আল্লাহর যিকির করল। আর যে ব্যক্তি তাঁর আনুগত্য করে না, সে যিকিরকারী নয়, তাতে সে যত বেশিই তাসবীহ পড়ুক না কেন। তবে মৌখিক যিকিরও গুরুত্ব রাখে। তাই এ বিষয়েও উদাসীন হওয়া ঠিক নয়। মাসনূন দু'আও উল্লেখযোগ্য যিকির। উপার্জনের উদ্দেশ্যে হাটে-বাজারে গেলে তাও পড়া চাই। এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ دَخَلَ السُّوقَ فَقَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ حَيٌّ لَا يَمُوتُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ أَلْفَ أَلْفَ حَسَنَةٍ وَمَحَا عَنْهُ أَلْفَ أَلْفَ سَيِّئَةٍ وَرَفَعَ لَهُ أَلْفَ أَلْفَ دَرَجَةٍ
‘যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশকালে পাঠ করবে-
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ حَيٌّ لَا يَمُوتُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
- আল্লাহ তার জন্য দশ লাখ নেকী লিখবেন, দশ লাখ গুনাহ মাফ করবেন এবং তার মর্যাদা দশ লাখ স্তর উন্নীত করবেন।’(জামে তিরমিযী: ৩৪২৮; আল-আহাদীছুল মুখতারাহ: ১৮৭; সুনানে দারিমী: ২৭৩৪)
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে প্রবেশকালে নিম্নোল্লিখিত দু'আটি পাঠ করতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ هذَا السُّوْقِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفُسُوْقِ.
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে চাই এই বাজারের কল্যাণ এবং তোমার আশ্রয় গ্রহণ করি কুফর ও নাফরমানি থেকে।’(তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ৫৫৮৯; আদ-দু'আ : ৭৯৪
(فيه محمد بن أبان بن صالح الجعفي، قال ابن عدي في الكامل: ومع ضعفه يكتب حديثه. (المحرر)

আয়াতটিতে আল্লাহ তা'আলার বেশি বেশি যিকির করাকে সফলতার উপায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ মনে মনে ও মুখে মুখে তাঁর যিকির করার মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা নিহিত। কেননা অন্তরে ও মুখে আল্লাহর স্মরণ থাকলে পাপকর্ম থেকে বাঁচা ও শরী'আতের অনুসরণ করা সহজ হয়। আর দোজাহানের সফলতা তো এর দ্বারাই অর্জিত হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে প্রকৃত যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. জুমু'আর নামাযের আযান হয়ে গেলে সব কাজকর্ম ছেড়ে নামাযের প্রস্তুতি নিতে হবে।
খ. পার্থিব কাজকর্ম যেন নামায আদায়ে ব্যাঘাত না ঘটায়, সেদিকে লক্ষ রাখা চাই।
গ. আয়-রোজগারের কাজ নিন্দনীয় নয়; বরং কুরআন-হাদীছ এতে উৎসাহ যোগায়।
ঘ. পার্থিব কাজ সম্পাদনকালে আল্লাহকে স্মরণ রাখা চাই।
ঙ. আল্লাহর যিকির ও স্মরণই প্রকৃত সফলতার চাবিকাঠি।
খেটে খাওয়াই উত্তম, তা যত কষ্টসাধ্যই হোক
হাদীছ নং: ৫৩৮

হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ নিজ রশি নিয়ে পাহাড়ে চলে যাবে, তারপর নিজ পিঠে করে কাঠের বোঝা বয়ে এনে তা বাজারে বিক্রি করবে আর এভাবে আল্লাহ তা'আলা তা দ্বারা তার চেহারাকে (অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়ার বেইজ্জতি থেকে) রক্ষা করবেন, এটা তার পক্ষে মানুষের কাছে প্রার্থনা করা অপেক্ষা উত্তম, যারা তাকে দিতেও পারে কিংবা নাও দিতে পারে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২০৭৫; সহীহ মুসলিম: ১০৪২; জামে তিরমিযী: ৬৮০; মুসনাদে আহমাদ: ১৪২৯; সুনানে ইবন মাজাহ ১৮৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ১০৬৭৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২৫০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১১৬৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬১৭)
مقدمة الامام النووي
59 - باب الحث عَلَى الأكل من عمل يده والتعفف به عن السؤال والتعرض للإعطاء
قَالَ الله تَعَالَى: {فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاةُ فَانْتَشِرُوا في الأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ الله} [الجمعة: 10].
538 - وعن أَبي عبد الله الزبير بن العَوَّام - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لأَنْ يَأخُذَ أحَدُكُمْ أُحبُلَهُ ثُمَّ يَأتِيَ الجَبَلَ، فَيَأْتِيَ بحُزمَةٍ مِنْ حَطَب عَلَى ظَهْرِهِ فَيَبِيعَهَا، فَيكُفّ اللهُ بِهَا وَجْهَهُ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْألَ النَّاسَ، أعْطَوْهُ أَوْ مَنَعُوهُ». رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে অন্যের কাছে চেয়ে খাওয়ার উপর পরিশ্রম করে খাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তাতে সে পরিশ্রম যত কঠোরই হোক না কেন। বন-জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনা এমনিই কঠিন কাজ। তা যদি হয় পাহাড়ের উপর, তবে কষ্ট আরও বেড়ে যায়। তার উপর আবার যদি সে কাঠ নিজের পিঠে করে টেনে আনতে হয়, তবে তা কত কষ্টসাধ্য বলাই বাহুল্য। এতদসত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যের কাছে হাত না পেতে এরূপ কষ্টসাধ্য কাজ করে খেতে বলেছেন।

কাঠ কুড়ানোর কাজটিকে সমাজচোখে নিম্নস্তরের মনে করা হয়। হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল সওয়াল করে খাওয়া তারচে'ও নিম্নস্তরের। বরং পরিশ্রম করে খাওয়াকে মানুষ যে চোখেই দেখুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাতে লজ্জার কিছু নেই। চেয়ে খাওয়াই মূলত লজ্জার বিষয়। তাতে ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হয়। হাদীসে আছে- فَيَكُفَّ اللَّهُ بِهَا وَجْهَهُ 'এভাবে আল্লাহ তা'আলা তা দ্বারা তার চেহারাকে (অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়ার বেইজ্জতি থেকে) রক্ষা করবেন'। অর্থাৎ মানুষের কাছে চাওয়ার দ্বারা মান-সম্মান নষ্ট হয়। কামাই-রোজগার করার দ্বারা মান-সম্মান রক্ষা পায়। বোঝা গেল মানুষের মান-সম্মান অনেক মূল্যবান। কিছুতেই তা নষ্ট হতে দিতে নেই। কামাই-রোজগারের কাজ যত কঠিনই হোক না কেন, তা দ্বারা যেহেতু মান-সম্মানের হেফাজত হয়, তাই সওয়াল না করে এতেই লিপ্ত হওয়া উচিত। তাছাড়া কামাই-রোজগার করলে অনেক সময় দান-খয়রাতও করা যায়, যা বড়ই নেকীর কাজ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে ভিক্ষা করা বা অন্যের কাছে হাত পাতা উচিত নয় কিছুতেই।

খ. যত কষ্টসাধ্যই হোক না কেন, কামাই-রোজগার করেই খাওয়া উচিত।

গ. উপার্জনের পন্থাটি যদি বৈধ হয়, তবে সমাজচোখে তা যতই নিম্নস্তরের হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাতে লজ্জার কিছু নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)