রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৩৪
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায় : ৫৭ অল্পেতুষ্টি, অন্যের কাছে চাওয়া বা আশা করা হতে নিজেকে রক্ষা করা, জীবনযাত্রায় মধ্যপন্থা ও মিতব্যয়ের প্রতি উৎসাহদান এবং অপ্রয়োজনে মানুষের কাছে চাওয়ার নিন্দা
কোনও মাখলুকের কাছে কিছু না চাওয়ার প্রতিদানে জান্নাতের ওয়াদা
হাদীছ নং: ৫৩৪

হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কে আমার পক্ষে এই দায়িত্ব গ্রহণ করবে যে, সে মানুষের কাছে কিছু চাবে না আর আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হব? আমি বললাম, আমি। (বর্ণনাকারী বলেন,) এরপর থেকে তিনি কারও কাছে কিছু চাইতেন না। -আবু দাউদ
(সুনানে আবু দাউদ : ১৬৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ২২৩৭৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ১৪৪৩ বয়হাকী শু'আবল ঈমান ৩২৪৫)
مقدمة الامام النووي
57 - باب القناعة والعَفاف والاقتصاد في المعيشة والإنفاق وذم السؤال من غير ضرورة
534 - وعن ثوبان - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ تَكَفَّلَ لِي أَنْ لاَ يَسْأَلَ النَّاسَ شَيْئًا، وَأَتَكَفَّلُ لَهُ بِالْجَنَّةِ؟» فقلتُ: أنَا، فَكَانَ لاَ يَسْأَلُ أحَدًا شَيْئًا. رواه أَبُو داود بإسناد صحيح. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কারও কাছে কিছু না চাওয়ার দায়িত্বগ্রহণ দ্বারা না চাওয়ার ওয়াদা করা ও সে ওয়াদা রক্ষায় যত্নবান থাকার কথা বোঝানো হয়েছে। মানুষের কাছে চাওয়া বা হাত পাতা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। বান্দার কর্তব্য পুরোপুরিভাবে আল্লাহ তা'আলার উপর তাওয়াক্কুল ও ভরসা করা। আল্লাহ তা'আলার উপর পুরোপুরি তাওয়াক্কুল করতে পারলে আল্লাহ তা'আলাই বান্দার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার (প্রয়োজন পূরণের জন্য) তিনিই যথেষ্ট হয়ে যান।(সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৩) অর্থাৎ সকল প্রয়োজনে আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করেন।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত থাকে। আল্লাহ তা'আলা তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দেন। এরূপ ব্যক্তি মানুষের মর্জিমতো চলতে বাধ্য হয়ে যায়। ফলে সে শরী'আতের সীমারেখা রক্ষা করতে পারে না। তার দ্বারা নানারকম গুনাহ হয়ে যায়। পরিণতিতে তা তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন যে, কোনও ব্যক্তি মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকলে তিনি তার জান্নাতে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। অর্থাৎ তিনি তার পক্ষে সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তা'আলা কখনও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ উপেক্ষা করবেন না। সুতরাং এ ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যাবে।

প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতে যাওয়া ঈমানের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে, কেবল সেই জান্নাত লাভ করবে। এ হাদীছে যখন মানুষের কাছে না চাওয়ার বিনিময়ে জান্নাতের ওয়াদা দেওয়া হয়েছে, তখন বোঝা যাচ্ছে এরূপ ব্যক্তির ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হবে। সুতরাং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুর আশা যে ব্যক্তি রাখে, তার একান্ত কর্তব্য মানুষের কাছে হাত পাতা হতে বিরত থাকা।

উল্লেখ্য, কারও কাছে কিছু না চাওয়ার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারলে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে, তা দ্বারা এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, জান্নাত লাভের জন্য অন্য কোনও আমলের প্রয়োজন নেই। জান্নাতে যাওয়ার জন্য প্রকৃত মুমিন হওয়া ও ফরয আমলসমূহ পালনে যত্নবান থাকা অপরিহার্য। এ হাদীছে সেগুলোর আবশ্যিকতা অস্বীকার করা হয়নি। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য অন্যের কাছে না চাওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে অবগত করা। অন্যান্য ফরয আমলসমূহ তো পালন করতেই হবে। সাহাবায়ে কেরাম তা পালন করতেনও। তারপরও অনেক সময় বান্দার দ্বারা বিভিন্ন রকম গুনাহ হয়ে যায়। গুনাহ শিরক ও কুফরের পর্যায়ে না হলে তা স্থায়ী জাহান্নামবাসের কারণ হয় না বটে, তবে প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয়ে যায়। ফলে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে শুরুতে কিছুকাল জাহান্নামের শাস্তিভোগ অবধারিত হয়ে যায়। কোনও কোনও নেক আমল এমন আছে, যার অসিলায় বান্দা সেই শাস্তিভোগ হতে রেহাই পায়। সে রেহাই পাওয়াটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ক্ষমা পাওয়ার মাধ্যমেও হতে পারে, আবার তাঁর পক্ষ হতে গুনাহ থেকে হেফাজতের মাধ্যমেও হতে পারে। কারও কাছে না চাওয়ার আমলটি সেরকমই। যে ব্যক্তি গুরুত্বের সঙ্গে এ আমল করবে, অর্থাৎ সে তার যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহ তা'আলার কাছেই তুলে ধরবে এবং তাঁর উপর ভরসা করে অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকবে, সে তো অবশ্যই ফরয ও ওয়াজিব আমলসমূহ অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে পালন করবে। এরূপ ব্যক্তি পদে পদে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য লাভ করবে। তিনি তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি তাকে গুনাহ থেকেও হেফাজত করবেন।

এ হাদীছটিতে বলা হয়েছে, ছাওবান রাযি. কারও কাছে কিছু না চাওয়া সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি সে ওয়াদা রক্ষাও করেছিলেন। তিনি কখনও কারও কাছে বড় কোনও জিনিস তো নয়ই, তুচ্ছ বিষয়ও চাইতেন না। এটা সকল সাহাবীরই বৈশিষ্ট্য। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যখন যে ওয়াদা করতেন, মৃত্যু পর্যন্ত তা রক্ষা করে চলতেন। তাদের অনুসরণে আমাদেরও আপন আপন ওয়াদা রক্ষায় যত্নবান থাকা উচিত।

ওয়াদাটি যদিও মহান সাহাবীদের থেকে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এর ভাষা ব্যাপক। কাজেই হাদীছটির বক্তব্য আমাদের জন্যও প্রযোজ্য। কিয়ামত পর্যন্ত যে-কেউ মাখলুকের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকবে, সে অবশ্যই জান্নাতলাভের এ সুসংবাদের আওতাভুক্ত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমলের তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যে-কোনও অভাব-অনটন ও কষ্ট-ক্লেশে আল্লাহ তা'আলার উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখা চাই।

খ. জান্নাত লাভের আশাবাদী ব্যক্তির কর্তব্য মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া হতে বিরত থাকা।

গ. কোনও বিষয়ে ওয়াদাবদ্ধ হলে সে ওয়াদা কিছুতেই ভঙ্গ করতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান