রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৯০
অনাহারে থাকা, কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপন করা, অল্প পানাহার, অল্প পোশাক ও অল্প ভোগে পরিতুষ্ট থাকা এবং চাহিদা ত্যাগের ফযীলত

অনাহারে থাকা মানে ক্ষুধা না লাগা পর্যন্ত খাওয়া হতে বিরত থাকা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুধার কষ্ট অনুভব না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে থাকা বোঝানো উদ্দেশ্য। একেবারেই না খাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এমনিভাবে অল্প পোশাক বলতেও এমন অল্প বোঝানো উদ্দেশ্য নয়, যা দ্বারা পুরোপুরি সতর ঢাকে না কিংবা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মাত্র একটা পোশাক রাখা, যদ্দরুন ময়লা হওয়ার পর সেটি ধুয়ে না শুকানো পর্যন্ত খালিগায়ে থাকতে হয়। ফলে জুমু'আ ও জামাতে যেতে বিলম্ব হয় কিংবা মেহমানের সঙ্গে সাক্ষাত ও অন্যান্য জরুরি কাজ বিঘ্নিত হয়।
কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপনের অর্থ হচ্ছে পানাহার, পোশাক-আশাক ইত্যাদিতে পরিমিত মাত্রা রক্ষা করা। বিলাসিতা করাও নয়, আবার এমন অল্পে সন্তুষ্ট থাকাও নয়, যা স্বাস্থ্যহানি বা অন্যান্য পেরেশানির কারণ হয়ে যায়।
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের চাহিদা। এ চাহিদা পূরণের গুরুত্ব যেমন সর্বাপেক্ষা বেশি, তেমনি চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি । কেননা লাগামহীনভাবে এ চাহিদা পূরণ করার দ্বারা মানুষের পাশব প্রবৃত্তি বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। পাশব প্রবৃত্তি বলীয়ান হওয়ার দ্বারা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহংকার অহমিকা প্রভৃতি অসৎগুণ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এসব অসৎগুণের বহিঃপ্রকাশ দ্বারা মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়। মানুষ পশুর কাতারে চলে যায়। তাই এ চাহিদার নিয়ন্ত্রণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মাঝেমধ্যে ক্ষুধার্ত থাকা এবং ক্ষুধার কষ্ট অনুভব না হওয়া পর্যন্ত পানাহার হতে বিরত থাকা এটা নফসের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সহায়ক।
ইবরাহীম ইবন আদহাম রহ. বলেন, ক্ষুধা মানুষের মন নরম করে। ফুযায়ল ইবন ইয়ায রহ. বলেন, দুটি খাসলাত অন্তর শক্ত করে বেশি ঘুম ও বেশি খাওয়া।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে হযরত আবু জুহাইফা রাযি. ঢেকুর দিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সতর্ক করে বললেন-
كُفْ عَنَّا جُشَاءَكَ، فَإِنَّ أَكْثَرَهُمْ شِبَعًا فِي الدُّنْيَا أَطْوَلُهُمْ جُوْعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“আমাদের সামনে তোমার ঢেকুর সংযত করো। যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় বেশি বেশি পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাবে, আখিরাতে সে অধিকতর ক্ষুধার্ত থাকবে। "
আবু সুলায়মান দারানী রহ. বলতেন, সারারাত জেগে থেকে ভোর পর্যন্ত নামাযে রত থাকা অপেক্ষা রাতে এক লোকমা কম খাওয়া আমার বেশি পসন্দ।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. বলতেন, ওই ব্যক্তিই বেশি সুখী, যে সকাল-সন্ধ্যায় ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর বিধানে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।
বিখ্যাত বুযুর্গ সাহল তুসতারী রহ. বলেন, আল্লাহওয়ালাদের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে ক্ষুধা অপেক্ষা দুনিয়াবী ও পরকালীন কল্যাণকর বিষয় আর কিছু নেই এবং ভুরিভোজন অপেক্ষা পরকালীন ক্ষতিকর বস্তুও আর কিছু নেই।
ইমাম গাযালী রহ. ক্ষুধার বিভিন্ন উপকারিতা বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ-
এক. ক্ষুধার কষ্টভোগ দ্বারা আত্মা স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত হয়। অপরপক্ষে ভরপেট খাওয়ার দ্বারা আত্মা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় ও স্মরণশক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
দুই. ক্ষুধায় মন কোমল হয়। তাতে যিকর ও দু'আর আস্বাদ অনুভব করা যায়। উদর পরিপূর্ণ থাকার দ্বারা মন কঠিন হয়ে পড়ে। তাতে যিকরের স্বাদ অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না।
তিন. ক্ষুধার দ্বারা অহংকার ও গাফলাত দূর হয়।
চার. সদাসর্বদা উদরপূর্ণ অবস্থায় থাকলে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কষ্ট অনুভব করা যায় না। ফলে তাদের প্রতি দয়ামায়া প্রকাশেরও অবকাশ আসে না। এরূপ লোক এমনকি আখিরাতের আযাবের কথাও ভুলে যায়।
পাঁচ. ক্ষুধার্ত থাকার দ্বারা প্রবৃত্তি দমন সহজ হয়। যুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, আমি যখনই তৃপ্তির সাথে খাবার খেয়েছি, তখনই আমার অন্তরে কোনও না কোনও পাপের বাসনা জাগ্রত হয়েছে।
ছয়. অতি আহারে অতি নিদ্রা হয়। তা দেহে আলস্য আনে। ফলে ইবাদত-বন্দেগী বিঘ্নিত হয়। অল্প আহারে শরীর-মন তাজা থাকে। তাতে ইবাদত-বন্দেগী সহজ হয়।
সাত. অল্প আহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। বেশি আহারে নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়।
আট. যে ব্যক্তি কম খায়, তার খরচও কম। তার বেশি টাকা-পয়সার দরকার হয় না। মানুষের যত বিপদ-আপদ ও অশান্তি, বেশি টাকা-পয়সা কামাই করার দৌড়ঝাপই তার বড় কারণ। তাছাড়া খাদ্যের পেছনে খরচ কম হওয়ায় আল্লাহর পথে খরচ করা সহজ হয় (কীমিয়ায়ে সা'আদাত থেকে সংগৃহীত)।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে এমন কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন, যা দ্বারা আলোচ্য বিষয়সমূহ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমরা সেগুলোর বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।

অনাহারে থাকা, কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপন করা ... এর ফযীলত সম্পর্কিত কিছু আয়াত

• এক নং আয়াত
قَالَ الله تَعَالَى: {فَخَلَفَ منْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا إِلاَّ مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلاَ يُظْلَمُونَ شَيْئًا} [مريم: 59 - 60]
অর্থ : 'তারপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হল এমন নিকৃষ্ট উত্তরসূরীগণ, যারা নামায নষ্ট করল এবং ইন্দ্রিয়চাহিদার অনুগামী হল। সুতরাং তারা অচিরেই তাদের পথভ্রষ্টতার সাক্ষাত পাবে। অবশ্য যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।

ব্যাখ্যা
এর আগে আল্লাহ তা'আলা বেশ কয়েকজন নবী-রাসূলের জীবনাদর্শ বর্ণনা করেছেন। তারপর এ আয়াতে জানাচ্ছেন যে, তাদের যারা উত্তরসূরী হয়েছিল তারা তাদের সে জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলেনি। এমনকি তারা যথাযথভাবে নামাযও আদায় করেনি। তারা তাদের মহান পূর্বসূরীদের দেখানো পথে না চলে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত চলেছে। ইন্দ্রিয়পরবশ হয়ে থেকেছে।
ইন্দ্রিয়পরবশ হয়ে চলা পাপের পথে চলারই নামান্তর। ইন্দ্রিয়ের যথেচ্ছ চাহিদা কখনও সৎপথে পূরণ করা যায় না। তা পূরণ করতে গেলে অন্যায় অসৎ পন্থাই অবলম্বন করতে হয়। এরূপ ব্যক্তিকে শরী'আত বিসর্জন দিয়ে নিজ খেয়াল-খুশির দাসত্ব করতে হয়। ফলে সে আল্লাহর বান্দা না হয়ে নিজ খেয়াল-খুশির বান্দা হয়ে যায়। খেয়াল-খুশি তাকে দিয়ে সর্বপ্রকার অন্যায়-অনাচার করিয়ে নেয়। ফলে তার পরিণাম হয় জাহান্নামের শাস্তি। আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করছেন-
فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
(সুতরাং তারা অচিরেই তাদের পথভ্রষ্টতার সাক্ষাত পাবে)। غي এর এক অর্থ পথভ্রষ্টতা। পথভ্রষ্টতার সাক্ষাত পাবে মানে এর শাস্তির সাক্ষাত পাবে। এর জন্য জাহান্নামে যে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা ভোগ করবে। অনেকের মতে غي হচ্ছে জাহান্নামের একটি উপত্যকা, যা অত্যন্ত গভীর, অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত এবং তার উত্তাপও অনেক বেশি।
তারপর আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِلاَّ مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا
(অবশ্য যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে)। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়পরবশতা ও নামায পরিত্যাগ করার অপরাধ থেকে তাওবা করেছে, কুফর পরিত্যাগ করে ঈমান এনেছে বা ঈমানী দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে পরিপক্ক ঈমানের অধিকারী হয়েছে এবং ঈমানের দাবি অনুসারে পাপাচারের পথ পরিত্যাগ করে সৎকর্মের পথ অবলম্বন করেছে, তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে না। আল্লাহ বলেন-
فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلاَ يُظْلَمُونَ شَيْئًا
(তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না)। তারা যদি কুফর পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তবে তো ইসলাম দ্বারা বিগত সব গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন, ইসলাম তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মিটিয়ে দেয়। আর যদি আগে থেকে মুসলিম থাকে, কিন্তু ইসলামের দাবি অনুযায়ী না চলে, তারপর খাঁটি মনে তাওবা করে নেয়, তবে তাওবা দ্বারাও তার অতীতের গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। সুতরাং ঈমান আনয়নকারী ও প্রকৃত তাওবাকারীকে তাদের অতীতের গুনাহের জন্য শাস্তি পেতে হবে না এবং জাহান্নামেও যেতে হবে না। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং অনন্তকাল সুখ-শান্তির ভেতর জীবন কাটাতে থাকবে।

• দুই নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ في زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُريدُونَ الحَيَاةَ الدُّنْيَا يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا العِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَواب اللهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا} [القصص: 79 - 80]
অর্থ : 'অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত। বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদের। (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়!

ব্যাখ্যা
কারুন হযরত মুসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের লোক ছিল। কোনও কোনও বর্ণনায় প্রকাশ, সে ছিল হযরত মূসা আলাইহিস সালামের চাচাতো ভাই এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াত লাভের আগে ফিরআউন তাকে বনী ইসরাঈলের নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নবুওয়াত লাভ করলেন আর হযরত হারুন আলাইহিস সালামকে তাঁর নায়েব বানানো হল, তখন কারুনের মনে ঈর্ষা দেখা দিল। কোনও কোনও বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে দাবি জানিয়েছিল, তাকে যেন কোনও পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনও পদ দেওয়া হোক এটা আল্লাহ তাআলার পসন্দ ছিল না। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম অপারগতা প্রকাশ করলেন। এতে তার হিংসার আগুন আরও তীব্র হয়ে উঠল এবং তা চরিতার্থ করার জন্য মুনাফিকীর পন্থা অবলম্বন করল (তাওযীহুল কুরআন) ।
পেছনের আয়াতসমূহে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে প্রচুর ধন- সম্পদ দিয়েছিলেন। তার ধনভাণ্ডারসমূহের চাবি বহন করতেই শক্ত-সমর্থ একদল লোকের প্রয়োজন হতো। এ বিপুল ধন-সম্পদের কারণে সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে ওঠে। সে একে আল্লাহর দান মনে করত না। মনে করত নিজ বিদ্যা-বুদ্ধির বলেই সে তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই সে এর জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করত না এবং এর হক আদায়ের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করত না। সে এর দ্বারা মানুষের কোনও সেবা তো করতই না, উল্টো তাদের মধ্যে দর্প করে বেড়াত। তার সে দর্পিত চাল-চলনের একটা চিত্র আলোচ্য আয়াতে আঁকা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ في زِينَتِهِ
"অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল। অর্থাৎ শানদার পোশাক ও দামি বাহনে সজ্জিত হয়ে নিজ ভূত্য-অনুচরদের বড়সড় একটি দল নিয়ে লোকজনের মধ্যে বের হয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে তার জৌলুস ও ডাটফাট দেখানো। এটাই দুনিয়াদার শ্রেণীর চিরাচরিত স্বভাব। জনমানুষের সামনে নিজেদের জাঁকজমক জাহির না করা পর্যন্ত তারা মনে শান্তি পায় না। মানুষের মধ্যে নিজেদের বড়ত্ব ফলাও করতে পারার ভেতর তারা এক রকম তৃপ্তি বোধ করে। কারুনের মতো মহাধনী এর ব্যতিক্রম হয় কিভাবে? সুতরাং সে তার শান-শওকত প্রদর্শনের জন্য এভাবে বের হয়ে পড়ল। তার সে শোভাযাত্রা দুনিয়াদার শ্রেণীকে আকৃষ্টও করল। আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
قَالَ الَّذِينَ يُريدُونَ الحَيَاةَ الدُّنْيَا يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِي
'যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত। বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান'। অর্থাৎ যাদের ঈমান তেমন শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি, তারা কারুনের এ শান-শৌকত দেখে অভিভূত হয়ে গেল। তারা মনে করল দুনিয়ার এতকিছু যার অর্জিত হয়ে গেছে সে তো একজন ভাগ্যবানই বটে। সে একজন সফল ব্যক্তি। তাই তারা নিজেদের অনুরূপ সুখ-সম্ভার না থাকার দরুন আক্ষেপ করছিল।
বস্তুত ঈমানী দুর্বলতার কারণে তার জাঁকজমক তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। ফলে এর গভীরে তাদের দৃষ্টি পৌঁছাতে পারেনি। এসব যে নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী, তা তারা চিন্তা করতে পারেনি। তারা ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিল যে, আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন এবং জান্নাতের অফুরন্ত সুখ-সম্ভারের বিপরীতে কারূনের সম্পদ তো বটেই, সমগ্র জগতের ধন-সম্পদও নিতান্তই তুচ্ছ। তবে তাদের মধ্যে সত্যিকার আখিরাতমুখী কিছু লোকও ছিল। তাদের কাছে পার্থিব ধন-ঐশ্বর্যের হাকীকত স্পষ্ট ছিল। তারা এই দুর্বলদের সতর্ক করে দিল। তারা কী বলেছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জানাচ্ছেন-
وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا العِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَواب اللهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا'আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে। (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহপ্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়। আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই। অর্থাৎ যাদের কাছে আসমানী ইলম ছিল, সে ইলমের আলোয় তাদের চিন্তা-চেতনাও আলোকিত ছিল এবং সে অনুযায়ী জীবনও গঠন করেছিল, তারা ওই দুর্বলচিত্তদের সতর্ক করল যে, ছি। তোমরা এসব কী বলছ? এই নশ্বর সুখসামগ্রী দেখে এমনই আত্মহারা হয়ে গেলে যে, আখিরাতের মহা নি'আমত সম্পর্কে পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে গেছ। আল্লাহ তা'আলা নেককার মুমিনদের জন্য আখিরাতে যে আরাম আয়েশের ব্যবস্থা রেখেছেন, তার সামনে এসবের কোনও মূল্য আছে কি? সে নি'আমত লাভ করতে হলে তোমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে হবে। অন্যের সম্পদ দেখে আত্মহারা হয়ে গেলে চলবে না। নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সকল প্রলোভন উপেক্ষা করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ পালনে অবিচল থাকতে হবে। দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আখিরাত, জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।

তিন নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {ثُمَّ لًتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ} [التكاثر: 8]
অর্থ : 'অতঃপর সেদিন তোমাদেরকে নি'আমতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছো?)

ব্যখ্যা:
অর্থাৎ মানুষ ইহজীবনে যা-কিছু ভোগ করে, তার কৃতজ্ঞতা কে কতটুকু আদায় করেছে কিংবা আদৌ করেছে কি না সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা জিজ্ঞাসা করা হবে মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলকেই।
কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে দেওয়া স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে, এর কী শোকর তারা আদায় করেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, শারীরিক সুস্থতা, চোখ ও কান সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞেস করবেন বান্দা এগুলো কী কাজে ব্যবহার করেছিল?
ইমাম ইবনে কাছীর রহ, ইবন আবী হাতিমের বরাতে উদ্ধৃত করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- এ আয়াতে যে নি'আমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে বলে জানানো হয়েছে, তা হল পেটের পরিতৃপ্তি, ঠাণ্ডা পানি, বাসগৃহের ছায়া, শারীরিক সুস্থতা ও ঘুমের মজা। এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তা'আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাকে ঘোড়া ও উটে আরোহণ করাইনি! তোমাকে নারী বিবাহ করাইনি? তোমাকে পানাহার করাইনি? মানুষের উপর নেতৃত্ব দিইনি? তুমি এর কী শোকর আদায় করেছ?
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা এমন কী নি'আমত ভোগ করছি? আমরা তো সামান্য যবের রুটি খেয়েই দিন কাটাচ্ছি! উত্তরে বলা হল, তোমরা কি জুতা পায়ে দাও না এবং ঠাণ্ডা পানি পান কর না? এটাও নি'আমতের অন্তর্ভুক্ত। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়ছাম রাযি.-এর বাড়িতে যান। তিনি তাদের খেজুর ও গোশত খাওয়ান এবং ঠান্ডা পানি পান করান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এটাই সে নি'আমত, যে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إن أول ما يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَعْنِي الْعَبْدَ مِنَ النَّعِيمِ، أَنْ يُقَالَ لَهُ: أَلَمْ نُصح
لك جِسْمَكَ، وَتُرْوِيَكَ مِنَ الْمَاءِ الْبَارِدِ
“কিয়ামতের দিন বান্দাকে যেসব নিআমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তার মধ্যে সর্বপ্রথম হবে এই যে, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি এবং ঠাণ্ডা পানি দ্বারা তোমার পিপাসা নিবারণ করিনি?
মানুষের জ্ঞানও অনেক বড় নি'আমত। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হবে। এমনকি জিজ্ঞেস করা হবে মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে। তাছাড়া জিজ্ঞেস করা হবে আয়ু ও যৌবনকাল সম্পর্কেও। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس، عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم.
"কিয়ামতের দিন নিজ প্রতিপালকের সম্মুখ থেকে আদম সন্তানের পা সরতে পারবে না, যাবৎ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। জিজ্ঞেস করা হবে তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কিসে নিঃশেষ করেছে; তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে জরাজীর্ণ করেছে; তার অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে; আর সে যা জানত সে অনুযায়ী কী আমল করেছে।
অবশ্য আল্লাহ তা'আলার এমন অনেক বান্দাও আছে, যারা বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করবে। তাদেরকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল করে নিন। আমীন।

চার নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {مَنْ كَانَ يُريدُ العَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُريدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا} [الإسراء: 18]
অর্থ : 'কেউ দুনিয়ার নগদ লাভ কামনা করলে আমি যাকে ইচ্ছা, যতটুকু ইচ্ছা, এখানেই তাকে তা নগদ দিয়ে দেই। তারপর আমি তার জন্য জাহান্নাম রেখে দিয়েছি, যাতে সে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িতরূপে প্রবেশ করবে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুনিয়ার উন্নতিকেই নিজ জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নিয়েছে, আখিরাতকে সে হয় বিশ্বাসই করে না অথবা বিশ্বাস থাকলেও তা নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই, সে নির্বিকার। এরূপ লোক সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা যে দুনিয়ায় তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। হাঁ, তাদের মধ্যে আমি যাকে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু দেওয়া সমীচীন মনে করি এবং যে পরিমাণ দেওয়া সমীচীন মনে করি, তা দুনিয়ায় দিয়ে দিই। কিন্তু আখিরাতে তাদের ঠিকানা অবশ্যই জাহান্নাম।
প্রকাশ থাকে যে, এমন সব ব্যক্তিও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত, যারা সৎকাজ করে বটে, কিন্তু তা করে কেবলই অর্থ-সম্পদ বা সুনাম-সুখ্যাতি লাভের জন্য, আল্লাহ তাআলাকে রাজি করার জন্য নয়। তারা তাদের সৎকাজের বিনিময়ে যা কামনা করে তা পেলেও পেতে পারে, কিন্তু আখিরাতে এর বিনিময়ে কিছুই পাবে না। সেখানে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা। তাই সৎকাজের ক্ষেত্রেও ইখলাস অতীব জরুরি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে ইখলাসের সঙ্গে সৎকর্মে নিয়োজিত থাকার তাওফীক দিন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারে কেমন খাবার খাওয়া হতো
হাদীছ নং : ৪৯০

হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি আাসাল্লামের পরিবার তাঁর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত কোনওদিন পরপর দু'দিন পেট ভরে যবের রুটিও খেতে পায়নি - বুখারী ও মুসলিম ।
অপর এক বর্ণনায় আছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন থেকে ইন্তিকাল পর্যন্ত তাঁর পরিবারের লোকজন টানা তিন দিন পেট ভরে গমের রুটি খেতে পায়নি।
56 - باب فضل الجوع وخشونة العيش والاقتصار على القليل من المأكول والمشروب والملبوس وغيرها من حظوظ النفس وترك الشهوات
قال الله تعالى: {فخلف من بعدهم خلف أضاعوا الصلاة واتبعوا الشهوات فسوف يلقون غيا إلا من تاب وآمن وعمل صالحا فأولئك يدخلون الجنة ولا يظلمون شيئا} [مريم: 59 - 60]، وقال تعالى: {فخرج على قومه في زينته قال الذين يريدون الحياة الدنيا يا ليت لنا مثل ما أوتي قارون إنه لذو حظ عظيم وقال الذين أوتوا العلم ويلكم ثواب الله خير لمن آمن وعمل صالحا} [القصص: 79 - 80]، وقال تعالى: {ثم لتسألن يومئذ عن النعيم} [التكاثر: 8]، وقال تعالى: {من كان يريد العاجلة عجلنا له فيها ما نشاء لمن نريد ثم جعلنا له جهنم يصلاها مذموما مدحورا} [الإسراء: 18]. والآيات في الباب كثيرة معلومة.
490 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: مَا شَبعَ آلُ مُحَمّد - صلى الله عليه وسلم - مِنْ خُبْزِ شَعِيرٍ يَوْمَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ حَتَّى قُبِضَ. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وفي رواية: مَا شَبعَ آلُ محَمّد - صلى الله عليه وسلم - مُنْذُ قَدِمَ المَدِينَةَ مِنْ طَعَامِ البُرِّ ثَلاثَ لَيَالٍ تِبَاعًا حَتَّى قُبِضَ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে একই হাদীছের দু'টি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম বর্ণনায় বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পর্যন্ত পরপর দু'দিন যবের রুটি খেতে পাননি। দ্বিতীয় বর্ণনায় গমের রুটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মদীনায় আসার পর থেকে ওফাত পর্যন্ত কখনও একটানা তিন দিন তা খেতে পাননি। মদীনা মুনাওয়ারায় আগমনের পর ওফাত পর্যন্ত তাঁর সময়কাল ছিল দশ বছর। অর্থাৎ এ দশ বছরে কখনও তিনি একটানা তিন দিন গমের রুটি খেতে পাননি। দুই বর্ণনাকে মেলালে ফল দাঁড়ায় পরপর তিন দিন তো নয়ই, এমনকি দু'দিনও যব বা গম কোনও কিছুরই রুটি তাঁর খাওয়া হয়নি।

এ হাদীছটির সঙ্গে অপর একটি বর্ণনাকে সাংঘর্ষিক মনে হয়। তাতে বলা হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারবর্গকে এক বছরের খাবার একসঙ্গে দিয়ে দিতেন। সে হিসেবে তো তাদের উপোস থাকার কথা নয়। অথচ এ হাদীছে বলা হয়েছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পর্যন্ত কখনও পরপর দু'দিন যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি?

প্রকৃতপক্ষে উভয়ের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা বনূ নাযীর ও খায়বারের সম্পত্তি হাতে আসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারবর্গের এক বছরের খাবার দিয়ে দিতেন বটে, কিন্তু তা যে এক বছর জমা থাকত এমন নয়। কেননা যখনই কোনও মেহমান আসত কিংবা অন্য কোনও জরুরত দেখা দিত, তখন তা থেকেই খরচ করতেন। আর মেহমান তো নিয়মিতই তাঁর কাছে আসত। বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিবর্গ দলে দলেই তাঁর কাছে আসতে থাকত। তাদেরকে খাওয়ানো ছাড়াও বিদায়কালে তাদের পাথেয়ও দিয়ে দিতেন। তাতে দেখা যেত এক বছরের খাবার অল্প দিনেই শেষ হয়ে যেত। আর সে কারণেই তাদেরকে প্রায়ই অনাহারে দিন কাটাতে হতো।

বস্তুত তাঁর এ কৃচ্ছতা ছিল ইচ্ছাজনিত। আল্লাহ তা'আলা তো তাঁকে এই এখতিয়ার দিয়েওছিলেন যে, তিনি চাইলে মক্কার পাহাড়গুলোকে তাঁর জন্য সোনায় পরিণত করে দেওয়া হবে এবং তিনি যখন যেখানে যাবেন তা তার সঙ্গে চলতে থাকবে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। দারিদ্র্যকেই বেছে নিয়েছেন। তারপরও যখন যা হাতে আসত তাতে অন্যদের প্রাধান্য দিতেন।

তাঁর এ কর্মপন্থার মূল কারণ ছিল দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি। তাঁর চোখে দুনিয়া ছিল অতি তুচ্ছ। দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় আসবাব-উপকরণ তাঁর কাছে এমনকিছু মূল্যবান ছিল না, যার আকাঙ্ক্ষা করা যেতে পারে। এ জীবনপদ্ধতি দ্বারা তিনি উম্মতকেও দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাকার উৎসাহ যুগিয়েছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অভাব-অনটনে কাতর হতে নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো অভাবের জীবনই বেছে নিয়েছিলেন।

খ. আমরা যে নিয়মিত দু'বেলা খাবার পাচ্ছি, সেজন্য প্রাণভরে শোকর আদায় করা উচিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গ অনাহারের কত কষ্টই না সহ্য করেছেন!
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)