রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৮৩
অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
নবীপ্রেমিকের মানসিক প্রস্তুতি
হাদীছ নং: ৪৮৩

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফফাল রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি। তিনি বললেন, লক্ষ করে দেখ কী বলছ? সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি। সে তিনবার এ কথা বলল। তিনি বললেন, তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাক, তবে দারিদ্র্যের জন্য প্রস্তুত কর মোটা কাপড়। কেননা যে আমাকে ভালোবাসে, দারিদ্র্য তার দিকে ধেয়ে আসে ঢলের পানি যে গতিতে তার গন্তব্যের দিকে ছুটে যায় তারচে'ও দ্রুতগতিতে - তিরমিযী।
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
483 - وعن عبدِ الله بن مُغَفَّل - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رجل للنبي - صلى الله عليه وسلم:
يَا رسولَ الله، وَاللهِ إنِّي لأُحِبُّكَ، فَقَالَ: «انْظُرْ مَاذَا تَقُولُ؟» قَالَ: وَاللهِ إنِّي لأُحِبُّكَ، ثَلاَثَ مَرَّات، فَقَالَ: [ص:168] «إنْ كُنْتَ تُحِبُّنِي فَأَعِدَّ لِلْفَقْرِ تِجْفَافًا، فإنَّ الفَقْرَ أسْرَعُ إِلَى مَنْ يُحِبُّني مِنَ السَّيْلِ إِلَى مُنْتَهَاهُ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».
«التجفافُ» بكسرِ التاءِ المثناةِ فوقُ وَإسكانِ الجيمِ وبالفاءِ المكررة: وَهُوَ شَيْءٌ يُلْبَسُهُ الفَرَسُ، لِيُتَّقَى بِهِ الأَذَى، وَقَدْ يَلْبَسُهُ الإنْسَانُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

“ইয়া রাসূলাল্লাহ, নিশ্চয়ই আমি আপনাকে ভালোবাসি" এমনিতে তো এ কথাটি ছিল প্রত্যেক সাহাবীরই প্রাণের উচ্চারণ। তবে এখানে এ কথাটি কোন সাহাবী বলেছিলেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। কোনও কোনও ইশারা দ্বারা অনুমান করা যায় তিনি ছিলেন হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবৃ সাঈদ খুদরী রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিজ অভাব-অনটনের কথা ব্যক্ত করলে তিনি ইরশাদ করেছিলেন-
اصْبِرْ أَبا سَعِيدٍ، فَإِنَّ الْفَقْرَ إلى مَنْ يُحِبُّنِي أَسْرَعُ مِنَ السَّيْلِ مِنْ أَعْلَى الْوَادِي أَوْ مِنْ أَعْلَى الْجَبَلِ إِلَى أَسْفَلِهِ.
“হে আবু সাঈদ, ধৈর্য ধরো। নিশ্চয়ই আমাকে যে ভালোবাসে, তার দিকে দারিদ্র্য উপত্যকার উচ্চস্থান বা পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসা ঢলের পানির চেয়েও বেশি দ্রুতগামী হয়ে থাকে।"

আশ-শিফা গ্রন্থে এ হাদীছটি উল্লেখ করার পরপরই হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফ্ফাল রাযি. বর্ণিত হাদীছটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। ইমাম সুয়ূতী রহ. আশ-শিফা গ্রন্থের হাদীছের তাখরীজে (উৎস সন্ধানে) নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলেছেন যে, আবু সা'ঈদ খুদরী রাযি.-এর হাদীছ হযরত ইবন মুগাফফাল রাযি. বর্ণিত হাদীছেরই অংশবিশেষ। তাঁর এ মন্তব্য এ ধারণা সমর্থন করে যে, আলোচ্য হাদীছে যে সাহাবীর নাম অব্যক্ত রাখা হয়েছে তিনি মূলত হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি.-ই।

যা হোক সাহাবী যখন এ কথাটি বললেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ অবশ্যই। আমি আপনাকে ভালোবাসি, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- انْظُرْ مَاذَا تَقُوْلُ؟ (লক্ষ করে দেখ কী বলছ?)। অর্থাৎ তুমি কী বলেছ ভালোভাবে চিন্তা করে দেখো। কেননা তুমি যা বলেছ সে বিষয়টি খুব সহজ নয়। সেজন্য অনেক মূল্য দিতে হয়। অনেক কঠোর-কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তুমি নানা বিপদ-আপদ ও কষ্ট-ক্লেশের লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাবে। তুমি তার জন্য কতটুকু প্রস্তুত? কিন্তু সাহাবীর একই কথা-
وَاللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ (আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি)। তিনি এ কথাটি তিন-তিনবার বললেন। বোঝাতে চাইলেন আমার ভালোবাসায় কোনও খাদ নেই। আমি মনেপ্রাণেই আপনাকে ভালোবাসি। আমি এর জন্য যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত। হাসিমুখে প্রাণও দিয়ে দিতে পারি।

নিশ্চয়ই সাহাবায়ে কেরাম প্রাণ দিয়েও দিতে পারতেন। কত সাহাবীই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ে যাতে একটা আঁচড়ও না লাগে, সেজন্য নিজ প্রাণ উৎসর্গ করে দিয়েছেন। সাহাবীদের মধ্যে সেরকম ত্যাগের ঘটনা দু'-চারি নয়; সকল সাহাবীই এরকম ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাদের নারী-পুরুষের মধ্যেও কোন পার্থক্য ছিল না।

বলার অপেক্ষা রাখে না সে সাহাবীর জযবায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আস্থা ছিল। তারপরও তাঁর অন্তরে বাড়তি শক্তি যোগানোর লক্ষ্যে তিনি বললেন-
فَقَالَ: «إِنْ كُنْتَ تُحِبُّنِي فأعد للقفر تِجْفَافًا (তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাক, তবে দারিদ্র্যের জন্য প্রস্তুত করো মোটা কাপড়)। অর্থাৎ দুনিয়ার মোহ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করো। কষ্ট-ক্লেশের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাও। মোটা পোশাক ও মোটা খাবার বেছে নাও। গরীবানা হালে জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। কেন তাঁকে এরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে? পরবর্তী বাক্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
فَإِنَّ الْفَقْرَ أَسْرَعُ إِلى مَنْ يُحِبُّنِي مِنَ السَّيْلِ إِلَى مُنْتَهَاه (কেননা যে আমাকে ভালোবাসে, দারিদ্র্য তার দিকে ধেয়ে আসে ঢলের পানি যে গতিতে তার গন্তব্যের দিকে ছুটে যায় তারচে'ও দ্রুতগতিতে)। কেননা আমি স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যের জীবন বেছে নিয়েছি। কাজেই আমাকে যে ভালোবাসবে, স্বাভাবিকভাবেই তাকেও দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হবে। ভালোবাসার দাবি হল ভালোবাসার জনের পূর্ণ অনুসরণ, পরিপূর্ণ আনুগত্য। আমি যেমন স্বেচ্ছায় দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত থাকছি, দু'হাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করছি, কোনওরকম কার্পণ্য আমাকে স্পর্শ করছে না, নিজ ঘর দুনিয়ার স্পর্শ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখছি, আমার খাঁটি প্রেমিকও তো এ রকমেরই হবে। সে যখন আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে, তখন অনিবার্যভাবে অভাব-অনটন তাকে ঘিরে ধরবে। আর তা যে খুব ধীরে আসবে তা না: দ্রুতগতিতে আসবে। সে দ্রুততা স্পষ্ট করার জন্য তিনি পাহাড়ি ঢলের তুলনা সামনে নিয়ে এসেছেন।

যারা পাহাড়ি এলাকায় বাস করে তারা তো ভালোভাবেই জানে, আর যারা বৃষ্টির দিনে কখনও পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছে তারাও দেখেছে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির স্রোতে উপত্যকায় কী বেগবান ঢলের সৃষ্টি হয়। ঠিক এই রকমই নবীপ্রেমিকের দিকে অভাব-অনটনের ঢল ধেয়ে আসে। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবধান করেছেন যে, ভেবেচিন্তে দেখো তুমি কী বলছ। তুমি অনেক বড় একটা বিষয়ের দাবি করে বসেছ। যে-কোনও দাবির পক্ষে দলীল চাই। এ দাবি সত্যি হওয়ার দলীল অভাব-অনটনে ধৈর্যধারণ। আমাকে যে ভালোবাসবে, তাকে যেহেতু অভাব-অনটনের সম্মুখীন হতে হবে, তাই প্রস্তুতি দরকার। যাতে অভাব-অনটনে ধৈর্য ধারণ করা সম্ভব হয়। সে প্রস্তুতি হল মোটা কাপড় তথা কষ্ট-ক্লেশে অভ্যস্ত হওয়া। মোটা কাপড় ঢালস্বরূপ। তা দ্বারা অনিষ্টকর জিনিস থেকে দেহ রক্ষা করা হয়।

মূলতঃ تجْفَاف বলা হয় ওই মোটা কাপড়কে, যা দ্বারা ঘোড়ার শরীর ঢাকা হয়, যাতে ক্ষতিকর জিনিস থেকে তাকে রক্ষা করা যায়। মানুষ ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য যে পোশাক পরে, তার জন্যও শব্দটির ব্যবহার আছে। হাদীছে কষ্ট-ক্লেশের অভ্যাসকে তাই تجْفَاف শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ ওইরকম পোশাক দ্বারা যেমন শরীর হেফাজত করা হয়, তেমনি কষ্ট-ক্লেশের অভ্যাস দ্বারাও বিপদ-আপদ ও অভাব-অনটনে অস্থির ও অধৈর্য হয়ে পড়া থেকে আত্মরক্ষা করা হয়।

তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, অভাব-অনটনে ধৈর্যের অভ্যাস গড়া জরুরি। কারণ আমাকে যে ভালোবাসবে, স্বাভাবিকভাবেই আখিরাতে সে আমার সঙ্গেই থাকবে। আমার সঙ্গেই জান্নাত হবে তার ঠিকানা। জান্নাত মহামূল্যবান নি'আমত। তা পাওয়ার জন্য অনেক মূল্য দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সে মূল্য দেওয়ার জন্য দরকার কঠিন সবরের। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
{ أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ } [آل عمران: 142]
'নাকি তোমরা মনে কর, তোমরা (এমনিতেই) জান্নাতে পৌঁছে যাবে, অথচ আল্লাহ এখনও পর্যন্ত তোমাদের মধ্য হতে সেই সকল লোককে যাচাই করে দেখেননি, যারা জিহাদ করবে এবং তাদেরকেও যাচাই করে দেখেননি, যারা অবিচল থাকবে।'

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক নবীপ্রেমিককে অবশ্যই অভাব-অনটনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

খ. দীনদার ব্যক্তির অভাব-অনটন নবীপ্রেমিক হওয়ার আলামত।

গ. অভাব-অনটনে ধৈর্যশীল হওয়ার জন্য আগে থেকেই কষ্ট-ক্লেশের অভ্যাস গড়ে তোলা চাই।

ঘ. অভাব-অনটন নবীর ভূষণ। তাই নবীপ্রেমিকেরও একে ভূষণ মনে করতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান