রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৪৫৬
দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য
যুহদ অর্থ ত্যাগ করা। তুলনামূলক বেশি লাভজনক বা বেশি আগ্রহের বস্তু পাওয়ার লক্ষ্যে তদপেক্ষা নিম্নস্তরের বস্তু ছেড়ে দেওয়াকে যুহদ বলে। এককথায় একে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি বা নির্মোহ শব্দে ব্যক্ত করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছে বিষয়টি এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
الزهادة في الدُّنْيَا لَيْسَتْ بِتَحْرِيمُ الْحَلالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنَّ الزَّهَادَةَ فِي الدُّنْيَا أَن لا تَكُونَ بِمَا فِي يَدَبَّكَ أَوْثَقَ مِمَّا فِي يَدِ اللهِ، وَأَنْ تَكُونَ فِي ثَوَابِ الْمُصِيَّة إِذا أنتَ أصِبْتَ بها أرغب فيها أو أنها أبقيت لك.
"দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া এবং কোনও মুসিবত দেখা দিলে তা দূর হওয়া অপেক্ষা সে মসিবতের ছাওয়াবের প্রতি বেশি আগ্রহ থাকা।
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. এ হাদীছের আলোকে বলেন, যুহদ হচ্ছে আত্মার একটি গুণ। এ হাদীছে তার আলামত বলে দেওয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা যুহদ সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা শুধরে দেওয়া হয়েছে।
অধিকাংশ আমলোক নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করে যাহিদ হল সেই লোক, যে দুনিয়ার যাবতীয় আনন্দ ও স্বাদের বস্তু পরিহার করে চলে যেমন হারাম বস্তু পরিহার করা হয়। এবং তাদের কাছে যা-কিছু আসে, সঙ্গে সঙ্গে তা খরচ করে ফেলে, তা ভুল জায়গাতেই হোক না কেন। এমনিভাবে কোনও বালা-মুসিবত দেখা দিলে মুক্তির কোনও ব্যবস্থা করে না। তাদের দৃষ্টিতে এরকম হওয়াই বুযুর্গীর শর্ত।
এ হাদীছ জানাচ্ছে, এসব মোটেই শর্ত নয়। বরং নিজ হাতের অর্থ-সম্পদ অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার উপর বেশি নির্ভরশীল থাকা জরুরি। আর বালা-মুসিবত যদিও কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু তার জন্য যে ছাওয়াবের ওয়াদা আছে তা পাওয়ার প্রতি আগ্রহী থাকা চাই। কাজেই মুসিবতের কারণে কেবল এজন্যই খুশি থাকা দরকার যে, তা প্রভৃত ছাওয়াবের কারণ (এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, মসিবত থেকে মুক্তির কোনও চেষ্টা করা হবে না) - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮।
উহুদের যুদ্ধে প্রথমে অর্জিত বিজয়ের পর মাঝখানে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ } [الحديد: 23]
“তা এই জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ, তার জন্য যাতে দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।
এ আয়াত স্পষ্টভাবেই বলছে যে, দুনিয়ার সম্পদ বা অন্য কোনওকিছুই হারানোর কারণে আক্ষেপ করতে নেই এবং অর্জনের দরুন উল্লসিতও হতে নেই। কেননা হারানোতে আক্ষেপ ও অর্জনে উল্লাস দুনিয়ার প্রতি মোহ ও আসক্তির ইঙ্গিত বহন করে, যা মুমিনদের মধ্যে থাকতে নেই।
কোনওকিছু হারালে যদি সবর করা যায় ও তার মধ্যেই কল্যাণ আছে বলে বিশ্বাস করা যায়, তবে তার বিপরীতে আখিরাতে অপরিমিত ছাওয়াব লাভ হয়। এমনিভাবে কোনওকিছু অর্জিত হলে উল্লাসের পরিবর্তে যদি সেজন্য শোকর আদায় করা হয় এবং আখিরাতের প্রতিদান আরও মূল্যবান বিবেচনায় আল্লাহর হুকুমমতো তা ব্যবহার বা খরচ করা হয়, তাতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হয়। তো সেই ছাওয়ার ও সন্তুষ্টিই হবে মুমিনের লক্ষ্যবস্তু। এটাই আয়াতের সারমর্ম। আর এরই নাম যুহদ।
হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. বলেন, বস্তুত যুহদ হল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বান্দার অন্তরে প্রদত্ত নূর ও ইলম। সেই নূর ও ইলমের কারণে হৃদয়ের ফোয়ারা খুলে যায় ও সত্য উন্মোচিত হয়। তখন বুঝে আসে দুনিয়ার সাজ-সরঞ্জাম মাছির ডানা অপেক্ষাও তুচ্ছ এবং আখিরাতই উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।
এ নূর যার হাসিল হয়ে যায়, তার কাছে আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া এমনই হীন হয়ে যায় যে, বহুমূল্য মণিমুক্তার বিপরীতে ছেড়া ন্যাকড়ার যে মূল্য, তার চোখে দুনিয়ার ততটুকু মূল্যও থাকে না - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮
যুহদের বিপরীত হল দুনিয়ার মোহ ও আসক্তি। এটা সমস্ত রোগের মূল। এর কারণে মানুষের ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল দুর্বল হয়ে যায়। তার মধ্যে দেখা দেয় কৃপণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ। এক-এক করে অন্তরের সব ভালো গুণ নিঃশেষ হয়ে যায়, তার পরিবর্তে মন্দ খাসলতসমূহ শিকড় গেড়ে বসে। এ কারণেই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أول صلاح هذه الأمةِ بِالْيَقِينِ وَالزَّهْدِ، وَأَوَّلُ فَسَادِهَا بِالْبُخْلِ وَالأمل
"এ উম্মতের প্রথম গঠন-সংস্কার হয়েছে ইয়াকীন ও যুহদ দ্বারা। আর এ উম্মতের বিনাশ ও পচনের সূচনা হবে কৃপণতা ও দীর্ঘ আশা দ্বারা।"
প্রকাশ থাকে যে, যুহদ ও বৈরাগ্য এক নয়। ইসলামে বৈরাগ্য নিষেধ। এক দিকে যেমন বলা হয়েছে-
وَمَا الْحَيْوَةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
'আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।'
অপরদিকে ইরশাদ হয়েছে-
{ قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ} [الأعراف: 32]
'বলো, আল্লাহ নিজ বান্দাদের জন্য যে শোভার উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, কে তা হারাম করেছে? এবং (এমনিভাবে) উৎকৃষ্ট জীবিকার বস্তুসমূহ? বল, এসব পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য (এবং) কিয়ামতের দিনে বিশেষভাবে (তাদেরই)।
বস্তুত নিষেধ হচ্ছে দুনিয়ার আসক্তি; দুনিয়ার লিপ্ততা নয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য, দীন, ঈমান ও ইজ্জতের হেফাজতের জন্য দুনিয়ার আসবাব- উপকরণ যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্জন করা মোটেই নিষেধ নয়। বরং শরীআত তা অর্জনে উৎসাহিত করেছে। ঘর-সংসার উপেক্ষা করতে বলেনি। বরং সংসারজীবন যাপনের মধ্য দিয়ে হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করেছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খাঁটি অনুসারীগণ সংসারজীবন যাপন করেছেন। তাঁরা স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মহব্বত করেছেন। তাঁরা বিলাসিতা করেননি বটে, তবে রুচিসম্মত খাবার খেয়েছেন এবং রুচিসম্মত পোশাকও পরেছেন। তাঁরা এ সবই করেছেন আখিরাতমুখিতার সঙ্গে। করেছেন আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত থাকার সঙ্গে। ফলে তাঁরা কোনওভাবেই যাতে আল্লাহ তা'আলার ও মাখলুকের কোনও হক নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পেরেছেন। বরং তা আদায় করেছেন পরম নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। বস্তুত এই-ই যুহদ।
এ দৃষ্টিতে একজন ধনী ব্যক্তিও যাহিদ হতে পারে, আবার একজন গরীবও হতে পারে বিষয়াসক্ত ও দুনিয়াপ্রেমী। যে ধনী উপার্জন করে হালাল পথে, উপার্জনচেষ্টার পর যা অর্জিত হয় তাতে খুশি থাকে, অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না, অর্জিত সম্পদ খরচ করে আল্লাহর হুকুমমতো এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে কার্পণ্য করে না, সে প্রকৃত যাহিদ বটে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো যাহিদ ছিলেনই, তাঁর সব সাহাবীও যাহিদ ছিলেন। ধনী সাহাবী হযরত উছমান গণী রাযি. ও আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. যেমন যাহিদ ছিলেন, তেমনি গরীব সাহাবী হযরত বিলাল রাযি., হযরত আম্মার রাযি. প্রমুখও যাহিদ ছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা রাহঃ, ও আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. যেমন বড় ধনী ছিলেন, তেমনি বড় যাহিদও ছিলেন। অন্যদিকে যে গরীব ব্যক্তি ধনীর কাছ থেকে পাওয়ার আশায় থাকে, একটুতেই অন্যের কাছে হাত পাতে, হালাল-হারাম নির্বিচারে যখন যা পায় তাই লুফে নেয়, সে গরীব হয়েও পাক্কা দুনিয়াদার বৈকি। বস্তুত যুহুদ অন্তরের শিকড়বদ্ধ গুণ। ধন-সম্পদের কমবেশি দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। প্রমাণ হয় আচার-আচরণ ও কর্মপন্থা দ্বারা। ইউনুস ইবন মায়সারা রহ. এর আলামত বলেন-
ليست الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا بِتَحْرِيمِ الْحَلَالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنِ الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا أَن تَكُونَ بِمَا فِي بَدِ اللهِ أَولَقَ مِنْكَ مِمَّا فِي يَدَيْكَ، وَأَنْ يَكُونَ حَالُكَ فِي الْمُصِيبَةِ وَحَالُكَ إِذا لَمْ تُصَبُ بهَا سَوَاءَ، وَأَنْ يَكُونَ دَامَكَ وَمَادِحُكَ فِي الْحَقِّ سَوَاء.
“দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া, বিপদ-আপদকালে তোমার মনের অবস্থা যেমন থাকে, স্বস্তি ও নিরাপত্তার কালেও ঠিক তেমনই থাকা, আর ন্যায়ের ক্ষেত্রে তোমার কাছে নিন্দুক ও প্রশংসাকারী সমান গণ্য হওয়া ।
যুহদের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]
অর্থ : 'পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এরকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেইসব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যেসকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে পার্থিব জীবনের নশ্বরতাকে তুলনা করা হয়েছে এমন একটি শস্যক্ষেত্রের সঙ্গে, যা বৃষ্টি বর্ষণে সিঞ্চিত হয়ে মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্যোপযোগী ঘন উদ্ভিদরাজিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং দেখতে না দেখতে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যে পরিণত হয়ে কৃষকের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। তারপর যখন ফসল পেকে ওঠে আর কৃষকরা মনে করে সে ফসল তাদের আয়ত্তাধীন, যখন ইচ্ছা তারা তা কেটে ঘরে তুলতে পারবে, অমনি আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব সম্পর্কিত নির্দেশ এসে পড়ে আর মুহুর্তের মধ্যে কৃষকদের হতাশ করে দিয়ে সেই ভরা ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে খাঁ খাঁ মাঠে পরিণত হয়ে যায়। দেখলে মনে হয় যেন এখানে কখনও কোনওকিছুর অস্তিত্বই ছিল না।
আল্লাহ তা'আলা বোঝাচ্ছেন দুনিয়ার জীবনটাও এরকমই। তা দেখতে যতই সজীব ও চাকচিক্যপূর্ণ মনে হোক, তার কোনও স্থায়িত্ব নেই। নির্বোধ শ্রেণীর লোক বাহ্যিক চাকচিক্য ও সৌন্দর্য দেখে ধোঁকায় পড়ে যায়। তারা এর মোহে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন ভুলে যায়। কিন্তু তাদের সে মোহ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। অনেক সময় বালা-মসিবত এসে মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দেয়। আর মৃত্যু নামক এক অমোঘ বিধান তো রয়েছেই। যে-কোনও মুহূর্তে হানা দিয়ে সে নিমিষেই জীবনের সব রঙিন স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তাই বুদ্ধিমান লোকের উচিত দুনিয়ার ক্ষণিকের চাকচিক্যে মাতোয়ারা না হয়ে স্থায়ী অবিনশ্বর আখিরাতের জীবন সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার সাধনায় রত হওয়া। এ আয়াত সে আহ্বানই আমাদের জানাচ্ছে।
• দুই নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]
অর্থ : 'তাদের কাছে পার্থিব জীবনের এই উপমাও পেশ কর যে, তা পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, ফলে ভূমিজ উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে যায়, তারপর তা এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, যা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। সম্পদ ও সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা। তবে যে সৎকর্ম স্থায়ী, তোমার প্রতিপালকের নিকট তা ছাওয়াবের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট এবং আশা পোষণের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট।
ব্যাখ্যা
এখানে দু'টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতটিতে উপরের আয়াতের মত পার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ও চাকচিক্যের ক্ষণস্থায়িত্বকে একটি উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে।। শুষ্ক ও মৃত ভূমি বৃষ্টির পানিতে সিঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন উপকারী ফসল ও তৃণাদি উদ্গত করে। তারপর খুব দ্রুত তা বড় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তার সবুজ-শ্যামল দৃশ্য দর্শকের হৃদয়মন মাতিয়ে তোলে। কিন্তু সে সৌন্দর্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আবার খরা দেখা দেয়। মাঠঘাট সব শুকিয়ে যায়। পানির অভাবে গাছপালাও শুকাতে থাকে। শুকাতে শুকাতে একদম ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারপর মনকাড়া সেই সবুজ-শ্যামল ভূমি ফের শুষ্ক মৃত প্রান্তরে পরিণত হয়ে যায়। পার্থিব জীবনের সবকিছুই এরকম। দু'দিনের বাহার। মৃত্যুতে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা মাত্র। মৃত্যুর পর এসব কোনও কাজে আসে না। সেখানে কাজে আসে দুনিয়ায় করে যাওয়া সৎকর্ম। মানুষ যা-কিছু সৎকর্ম করে, তা স্থায়ী সম্পদরূপে থেকে যায়। মৃত্যুতে শেষ হয় না; বরং মৃত্যুর পরও বাকি থাকে এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তা-ই কাজে আসে। তাই সৎকর্মকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' অর্থাৎ স্থায়ী পুণ্য বলা হয়েছে।
পুণ্য মাত্রই স্থায়ী, যেহেতু অনন্ত আখিরাতে তা কাজে আসবে। তাই এক হাদীছে
سُبْحانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله
যিকরকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' বলা হয়েছে।
আবার কোনও কোনও সৎকর্ম এমন, দুনিয়ায় যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এরূপ সৎকর্মকে সাধারণত সদকায়ে জারিয়া বলা হয়। যেমন ইলমে দীনের শিক্ষাদান, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, ক্ষেত-খামার ওয়াকফ করা ইত্যাদি। এদিকে লক্ষ করলে সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কেবল পার্থিব শোভা হয়েই থাকে না; স্থায়ী পুণ্যও হতে পারে। অর্থ ও সম্পদ যদি কোনও স্থায়ী সৎকর্মের খাতে ব্যয় করা হয়, তবে মৃত্যুর পরও তার ছাওয়াব জারি থাকে। এমনিভাবে সন্তান-সন্ততিকে নেককাররূপে গড়ে তুললে তাও একটি স্থায়ী পূণ্য। পিতা-মাতার আমলনামায় এর ছাওয়াব লেখা অব্যাহত থাকে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثة: من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له»
“মানুষ মারা গেলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ব্যতিক্রম (অর্থাৎ তার ছাওয়াব জারি থাকে)। তা হচ্ছে- সদাকায়ে জারিয়া; ওই ইলম, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় আর নেককার সন্তান, যে তার জন্য (অর্থাৎ পিতা-মাতার জন্য) দুআ করবে।
তিন নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]،
অর্থ : 'জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, বাহ্যিক সাজসজ্জা, তোমাদের পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে অন্যের উপরে থাকার প্রতিযোগিতারই নাম। তার উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদগত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, তারপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপর তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পার্থিব জীবনের হাকীকত তুলে ধরা হয়েছে। পার্থিব জীবনের মোটামুটি তিনটি স্তর শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। শিশুকালে মানুষ খেলাধুলায় মেতে থাকে। যৌবনকালে সাজসজ্জা ও পারস্পরিক অহমিকা প্রদর্শন মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধকালে ধনে-জনে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এ তিনও স্তরের তিনওটি কাজ সম্পূর্ণ অসার ও নিরর্থক। ইহজীবনেই পর্যায়ক্রমে তা স্পষ্ট হতে থাকে।
শৈশবে খেলাধুলাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়। কেউ তাতে ব্যাঘাত ঘটালে শিশুদের কাছে তা মহা ক্ষতিকর মনে হয়। কিন্তু যৌবনকাল আসলে তা নিয়ে হাসি পায়। তখন মনে হয় কী ফালতু কাজেই না মেতে থাকা হয়েছিল। যেই না বার্ধক্য শুরু হয়, অমনি বুঝে আসে অহেতুক সাজসজ্জা ও অহমিকা প্রদর্শনের পেছনে পড়ে জীবনের কত বড়ই না ক্ষতি করা হয়েছে। সে ক্ষতির প্রতিবিধান করার জন্য শুরু হয় প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা। ধনে-জনে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দৌড়। তারপর হঠাৎ করে যখন মৃত্যু এসে হানা দেয়, তখন বুঝে আসে সে দৌড়ও ছিল নেহাতই আত্মপ্রবঞ্চনা। তখন মনে আক্ষেপ জাগে, কেন দুনিয়াদারীর ধোকায় পড়ে জীবনটা বরবাদ করা হল। আকাঙ্ক্ষা হয়, যদি একটুখানি সময় পাওয়া যেত, তবে মনেপ্রাণে সৎকর্মে লেগে পড়তাম। কিন্তু শেষ সময়ের এ আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ হওয়ার নয়।
কুরআন মাজীদ জীবনের এ ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্য ও আনন্দ-ফুর্তিকে ক্ষেত-খামারের ক্ষণিকের মনোহারিত্ব, তারপর তার আকস্মিক লোপাট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছে। ফল-ফসলের ভূমিতে যখন বৃষ্টিপাত হয়, তখন উদ্ভিদরাজি সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। তার নয়নাভিরাম দৃশ্যে মানুষ মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে যায়। তারপর যদি খরা দেখা দেয়, তবে আস্তে আস্তে তা শুকাতে শুরু করে। একপর্যায়ে তা শুকিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। মানুষ এরকমই। শিশুকালে ফুটন্ত ফুলের মত সুন্দর ও মনোহর থাকে। যৌবনকালে তার সৌন্দর্য ও সজীবতা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর বার্ধক্য আসে। সৌন্দর্য ম্লান হতে শুরু করে। একপর্যায়ে তার রূপ ও শোভা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। মু'মিন ও কাফের সকলকেই এ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তারপর মৃত্যু
আসে। শুরু হয় কবর ও আখিরাতের যিন্দেগী। তখন মানুষ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদ এ আয়াতে বলছে- "আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি”। অর্থাৎ কাফের ও ফাসিকের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। মুমিনের ঠিকানা জান্নাত। তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির স্থান। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ক্ষমা পেয়ে তারা অনন্ত সুখের সে ঠিকানায় স্থায়ী হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ
এর অর্থ এরকমও করা যায় যে, বৃষ্টিতে উদ্গত উদ্ভিদরাজি কাফেরদের মুগ্ধ ও মোহিত করে দেয়। বিশেষভাবে কাফেরদের কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে সৃষ্টির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়া কাফের- মুশরিকদেরই কাজ। যারা প্রকৃত মুমিন, তারা সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে স্রষ্টার কথা মনে করে এবং তা দ্বারা তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা অনুধাবন করে। ফলে তাদের আল্লাহ মুখিতা ও আনুগত্যের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
সবশেষে আল্লাহ বলেন; وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ (পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়)। অর্থাৎ যারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ দ্বারা আখিরাতের সাফল্য সন্ধান না করে বরং এর আসক্তিতেই মত্ত হয়ে যায়, তাদের জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার ধন- সম্পদ পুরোপুরি ধোঁকা। তারা মনে করে দুনিয়ার জীবনই প্রকৃত জীবন, এরপর আর কিছু নেই। কাজেই এখানে যতটা পার ফুর্তি করে নাও। অথচ আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া নিতান্তই তুচ্ছ। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَوْضِعُ سَوْطٍ أَحَدِكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا.
“জান্নাতে তোমাদের একটা লাঠি রাখার স্থানও দুনিয়া ও দুনিয়ায় যা-কিছু আছে তারচে' উত্কৃষ্ট।
বস্তুত দুনিয়ার জীবন ও উপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে-কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি সহজেই বুঝতে পারে যে, এ দুনিয়া ও দুনিয়ার আসবাবপত্র পুরোটাই কেবল ধোঁকা। এর উপর ভরসা রাখা যায় না। এর পেছনে দৌড়ঝাঁপ করা সম্পূর্ণ বেহুদা কাজ। তাই এতে মগ্ন না হয়ে আমাদের কর্তব্য হবে সর্বদা স্থায়ী অনন্ত আখিরাতের কথা মাথায় রাখা এবং সেই অনন্ত-অসীম জীবন যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয়, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সে লক্ষ্যে পরিচালনা করা।
চার নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]
অর্থ : 'মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে ৬টি জিনিস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলো মানুষের জন্য মনোরম ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। কে আকর্ষণীয় করেছে তা বলা হয়নি। কারণ এটা জানা কথা যে, তা আল্লাহ তা'আলাই করেছেন। তিনিই যাবতীয় বস্তু ও তার গুণাবলীর স্রষ্টা। এসবকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা। কুরআন মাজীদের অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
'নিশ্চিত জেনো, ভূপৃষ্ঠে যা-কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে বেশি ভালো কাজ করে।
দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুরাজিকে সুশোভিত করে তোলার মধ্যে আল্লাহ তা'আলার বহুবিধ হিকমত আছে। এক তো তাদেরকে পরীক্ষা করা যে, কে এই শোভায় মুগ্ধ হয়ে একেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেয় এবং কে একে জীবনের লক্ষ্যবস্তু না বানিয়ে বরং একে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করে তাঁর সন্তুষ্টিবিধানকে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
দ্বিতীয় হিকমত- ব্যক্তি ও সমাজজীবনের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানব- অস্তিত্বে নিহিত বহুবিধ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো আর এভাবে স্রষ্টার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় করে তোলা। নারীর প্রতি আকর্ষণ না থাকলে কে অহেতুক সংসারজীবনের ঘানি টানত? কেই বা সোনা-রূপা, হীরা-জহরত ও মণিমুক্তা কুড়ানোর সংগ্রামে জীবনপাত করত, যদি না এসবের আকর্ষণ প্রণোদনা যোগাত? কেই বা ফল-ফসলের বাগান: বিন্যাস ও গবাদি পশুর খামার গড়ার পরিশ্রমে দিনরাত একাকার করত, যদি না এসবের শোভা ও লাভ মনে আনন্দ দান করত? সাধনা-গবেষণার এডভ্যাঞ্চারে অবতীর্ণ হয়ে মানুষ বন বাদাড়, মরুভূমি, সাগরতল ও দূর মহাকাশের কত অজানা রহস্য উদ্ঘাটন করেছে, মানবকল্যাণের নব-অভিনব দুয়ার উন্মোচন করেছে, কত সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন আজ মানবসংগ্রহের ভাণ্ডার, সে ওই প্রাণ আকুল করা সৃষ্টিশোভার কল্যাণে নয় কি?
নফসের বিরুদ্ধে নিরন্তন সাধনা-মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মা ও আত্মোৎকর্ষেরও এর মোক্ষম ব্যবস্থা এই বিত্ত-বস্তুর আকর্ষণ। আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণ এ আকর্ষণ পাশ কাটিয়ে নিজেদের দিল-দেমাগ সর্বক্ষণ আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত রাখার সাধনায় রত থাকেন। ফলে বিত্ত ও বস্তুর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এর মলিনতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। বরং এর বিরুদ্ধে মুজাহাদা তার আল্লাহপ্রাপ্তির কারণ হয়ে যায়।
আয়াতে বলা হয়েছে, এসব বস্তুর আসক্তি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আকর্ষণীয় তো করা হয়েছে এসব বস্তু। মূলত 'বস্তুর আকর্ষণ'-এর স্থানে 'বস্তুর আসক্তির আকর্ষণ' বলার উদ্দেশ্য—এ আকর্ষণে নিমজ্জিত হওয়ার নিন্দায় তীব্রতা আনা। ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, মানুষ আকর্ষণীয় বস্তুর আসক্তিতে এত বেশি বিভোর যে, তারা বস্তুর ভালোবাসায় নিমজ্জিত তো বটেই, এমনকি তারা বস্তুর আকর্ষণকে পর্যন্ত ভালোবাসে। এটা কতইনা নিন্দনীয় ব্যাপার। মানুষের তো উচিত ছিল বস্তুর আকর্ষণ উপেক্ষা করে বস্তুর প্রতি সম্পূর্ণ নির্মোহ থাকা। তাদের কর্তব্য ছিল বস্তুর পরিবর্তে বস্তুর স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত থাকা। উল্টো তারা বস্তুর আকর্ষণের ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে আছে।
আয়াতে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে নারীর আকর্ষণকে। নারীর আকর্ষণের মধ্যে মানুষের বহুবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিন্তু আখিরাতবিমুখ মানুষ সে কল্যাণ অর্জনের পরিবর্তে নারীর আকর্ষণ দ্বারা নিজ দুনিয়া ও আখিরাত বরবাদ করে ফেলে।
তাই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةٌ هِيَ أَضَرُّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ
"আমি আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর পরীক্ষার বিষয় আর কিছু রেখে যাইনি।
এ ক্ষতি হয় তখনই, যখন উদ্দেশ্য থাকে কেবলই দুনিয়া। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি হয় দীন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, তখন পুরুষের জন্য নারী এবং নারীর জন্য পুরুষ কতইনা উপকারী। সে ক্ষেত্রে উভয়ের জন্য উভয়ে পরম কাম্য। একবার মুহাজির ও আনসারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
لِسَانًا ذَاكِرًا، وَقَلْبًا شَاكِرًا، وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِيْنُهُ عَلَى إِيْمَانِهِ ‘
যিকরকারী জিহ্বা, শোকরকারী অন্তর ও মুমিনা স্ত্রী, যে তাকে তার ঈমানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
আয়াতে উল্লেখিত দ্বিতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সন্তান-সন্তুতি। সন্তান-সন্তুতি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় দান। এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের বংশবিস্তার হয়, মানবপ্রজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সন্তান সুসন্তান হলে তার দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের মুখ উজ্জ্বল হয় এবং আখিরাতেও মুক্তির ব্যবস্থা হয়। নেককার সন্তান পিতা- মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়াস্বরূপ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সন্তান-সন্ততিকে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। ফলে এ ক্ষেত্রে তারা আখিরাত ভূলে যায়। তাদের জন্য সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তা'আলার বহু হুকুম-আহকাম পালনে অন্তরায় হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْوَلَدَ مَبْخَلَةٌ مَجْبَنَةٌ
‘সন্তান মানুষের কৃপণতা ও ভীরুতার কারণ।
আয়াতে উল্লেখিত তৃতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সোনা-রূপা। সোনা-রুপা বলতে যেমন এর মূল ধাতু বোঝায়, তেমনি টাকা-পয়সাও। এর প্রতিও মানুষের আকর্ষণ স্বভাবগত। এর একটা বড় কারণ এর দ্বারা মনের চাহিদা পূরণ করা যায়। মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়সুখের অধিকাংশ উপকরণ এর দ্বারাই অর্জিত হয়ে থাকে। তাই মানুষ এ সম্পদ অর্জনের জন্য প্রাণের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে ফেলে। এমনিতে এটা অর্জন দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন এর মোহে লিপ্ত হয়ে শরীআতের আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করা হয়। অন্যথায় শরীআত মোতাবেক এর আয়-ব্যয় করা হলে তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে।চতুর্থ আকর্ষণীয় বস্তু দামী ঘোড়া। সেকালে ঘোড়া যেমন চলাফেরার কাজে ব্যবহার হতো, তেমনি এটা যুদ্ধ-বিগ্রহেরও অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ছিল। দিগবিজয়ী বীর ও রাজা-বাদশাদের কাছে এটা ছিল অতীব মূল্যবান সম্পদ। গাধা সেকালে একই কাজে ব্যবহৃত হতো। কুরআন মাজীদের অন্য এক আয়াতে এ তিন প্রকারের পশু সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
والْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَ الْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ '
এবং ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাতে আরোহন করতে পার এবং তা তোমাদের শোভা হয়। তিনি সৃষ্টি করেন এমন বহু জিনিস, যা তোমরা জান না।
বর্তমানকালেও এর গুরুত্ব সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তবে এখন এর স্থান দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক যানবাহন। একটি সুন্দর বাড়ির পাশাপাশি একটি মূল্যবান গাড়ি এখন মানুষের স্বপ্নের বস্তু। যার যত বেশি সম্পদ, সে তত মূল্যবান গাড়ি সংগ্রহের চেষ্টা করে। এটা অর্জনের জন্য হালাল-হারাম নির্বিচারে টাকা কামাইয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্যের উপর জুলুম-অত্যাচার চালায়। অর্জন হয়ে গেলে অন্যের উপর অহমিকা দেখায়। এগুলো সবই শরীআতবিরোধী। হাঁ, বৈধ উপায়ে যদি গাড়ি-ঘোড়া অর্জিত হয়ে যায় এবং অহংকার-অহমিকা থেকে বিরত থেকে এর সদ্ব্যবহার করা হয়, পাশাপাশি সুযোগমত একে মানবসেবায়ও কাজে লাগানো যায়, তবে এটা ছাওয়াব অর্জনেরও উপকরণ হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الخَيْلُ ثَلاثَةٌ هِيَ لِرَجُلٍ وِزْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ سِتْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ أَجْرٌ
ঘোড়া তিন প্রকার। তা এক ব্যক্তির জন্য গুনাহ, এক ব্যক্তির জন্য (আত্মসম্মান রক্ষার) আবরণ এবং এক ব্যক্তির জন্য পুণ্য।
পঞ্চম আকর্ষণীয় বস্তু গবাদি পশু তথা উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি। এর কোনওটি পরিবহনের কাজে লাগে, কোনওটি খাদ্যচাহিদা পূরণ করে। আবার এগুলো একরকম শোভাও বটে। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ (5) وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ (6) وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنْفُسِ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (7)
তিনিই চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে তোমাদের জন্য শীত থেকে বাঁচার উপকরণ এবং তাছাড়া আরও বহু উপকার রয়েছে এবং তা থেকেই তোমরা খেয়েও থাক। তোমরা সন্ধ্যাকালে যখন সেগুলোকে বাড়িতে ফিরিয়ে আন এবং ভোরবেলা যখন সেগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তার ভেতর তোমাদের জন্য দৃষ্টিনন্দন শোভাও রয়েছে। এবং তারা তোমাদের ভার বয়ে নিয়ে যায় এমন নগরে, যেখানে প্রাণান্তকর কষ্ট ছাড়া তোমরা পৌঁছতে পারতে না। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের প্রতিপালক অতি মমতাময়, পরম দয়ালু।
বহুবিধ উপকারী এসব পশু সংগ্রহে মৌলিকভাবে কোনও দোষ নেই। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। তাঁর দেওয়া নি'আমতের গুরুত্ব বোঝা ও তার যথাযথ ব্যবহারই কাম্য। শরী'আত এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الإِبلُ عِز لِأَهْلِهَا، وَالْعَلَمُ بَرَكَةٌ
উট তার মালিকের পক্ষে মর্যাদা। আর ছাগলে রয়েছে বরকত।
এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচাতো বোন উম্মে হানীকে লক্ষ্য করে বলেন-
اتَّخِذِي غَنَمًا فَإِنَّ فِيهَا بَرَكَةً
ছাগল প্রতিপালন কর, কেননা এর মধ্যে বরকত আছে।
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعُ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ شِفَاءٌ، فَعَلَيْكُمْ بِأَلْبَانِ الْبَقَرِ، فَإِنَّهَا تَرُمُّ مِنْ كُل الشجر
"আল্লাহ তা'আলা এমন কোনও রোগ দেননি, যার কোনও শেফা দেননি। তোমরা গরুর দুধ পান করো, কেননা গরু সর্বপ্রকার গাছগাছালি খেয়ে থাকে।"
এসব হাদীছ গবাদি পশু প্রতিপালনে উৎসাহ যোগায়। কাজেই প্রতিপালন ও ব্যবহার দোষের নয়। দোষ হল এর মোহ। এর শরী'আতনির্ধারিত হক আদায় না করা এবং এতে লিপ্ত হয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়া হল এর প্রতি মোহমুগ্ধতার আলামত। অন্তরে থাকবে কেবলই আল্লাহর ভালোবাসা। দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা। কাজকর্ম হবে শরী'আতনিষ্ঠ। এ সিফাতের সঙ্গে গবাদি পশুসহ দুনিয়ার যে-কোনও সম্পদ যত বেশিই অর্জন করা হোক, ইসলাম তাতে আপত্তি করে না। সর্বক্ষেত্রে এটাই মূল লক্ষণীয় বিষয়।
ষষ্ঠ আকর্ষণীয় বস্তু হল শস্যক্ষেত্র। শস্যক্ষেত্র যে কত চিত্তাকর্ষী ও নয়নাভিরাম হয়ে থাকে, এ অধ্যায়ের প্রথম তিন আয়াতে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও আয়াতেরই উদ্দেশ্য চাষাবাদে অনাগ্রহ সৃষ্টি করা নয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষকে এর প্রতি নির্মোহ করা। মানুষ যাতে এর ব্যতিব্যস্ততায় আখিরাত না ভুলে যায়। এর সৌন্দর্য-শোভা যাতে মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে না তোলে। অন্তরে আল্লাহপ্রেম ও আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত রেখে চাষাবাদের কাজ করলে তা দুনিয়াদারী হয় না। এরূপ চরিত্রের মানুষ চাষাবাদের কাজ দ্বারাও আখিরাতের সাফল্য অর্জন করতে পারে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«لا يغرس مسلم غرسا، ولا يزرع زرعا، فيأكل منه إنسان، ولا دابة، ولا شيء، إلا كانت له صدقة»
«لا يغرس رجل مسلم غرسا، ولا زرعا، فيأكل منه سبع أو طائر أو شيء، إلا كان له فيه أجر»
“কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি কোনও গাছ লাগায় বা ফসল বপন করে, তারপর কোনও হিংস্র পশু বা কোনও পাখি কিংবা অন্য কোনও কিছু তা থেকে খায়, তবে তাতে তার জন্য পুণ্য রয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ
(এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে)। অর্থাৎ এর উপকার কেবল এই ক্ষণস্থায়ী ইহজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এতে দিল লাগানো উচিত নয়। কেননা তাতে আখিরাত বরবাদ হয় এবং দুনিয়ায় এগুলো উপকারের পাশাপাশি নানারকম ক্ষতিরও কারণ হয়। তাই প্রয়োজনমাফিক এসব ব্যবহার করবে বটে, তবে দিল-দেমাগ নিবিষ্ট রাখবে আল্লাহ তা'আলার স্মরণ ও আখিরাতের প্রতি। তাতে আখিরাতের নিশ্চিত কল্যাণ তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে দুনিয়ায়ও এসবের মধ্যে যে উপকার আছে তা অর্জিত হয় আর যতটুকু ক্ষতি আছে তা থেকে বেঁচে থাকা যায়।
পাঁচ নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]
অর্থ : 'হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং এই পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে এবং আল্লাহর সম্পর্কেও যেন মহা ধোঁকাবাজ (শয়তান) তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে।
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হওয়া ও কিয়ামতের দিন কর্মফল দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন, তা অমোঘ সত্য। তার অন্যথা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পার্থিব জীবনের ব্যতিব্যস্ততা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর সে প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। দুনিয়ার আকর্ষণ ও এর মোহমুগ্ধতা যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে না পারে। সেইসঙ্গে মহাপ্রতারক শয়তান তো আছেই। তোমরা যেন কিছুতেই তার ধোঁকায় না পড়ে যাও। আল্লাহ তা'আলা তাকে অবকাশ দিয়ে রেখেছেন। সে তোমাদেরকে ফাঁদে ফেলতে চাইবে। তোমাদেরকে আখিরাতের শাস্তির কথা ভুলিয়ে রেখে দুনিয়ার মোহে অন্ধ করে রাখতে চাইবে, যাতে সে নিজের সঙ্গে তোমাদেরকেও জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাবধান, তোমরা তার কুমন্ত্রণায় যেন পড়ে না যাও। সে তোমাদের চিরশত্রু। তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। সর্বদা অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখো এবং যাবতীয় কাজে আখিরাতের কথা চিন্তা করো।
ছয় নং আয়াত
{ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]،
অর্থ : '(পার্থিব ভোগসামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি এ কথা জানতে (তবে এরূপ করতে না)।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহ সূরা তাকাছুরের। এ সূরায় মোট ৮টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ
(একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে)। অর্থাৎ ধনে-জনে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। তোমরা এসব নিয়ে অহংকার-অহমিকায় লিপ্ত হয়ে পড় আর সে অহমিকা তোমাদেরকে আখিরাত হতে গাফেল করে রাখে। ফলে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ও শরী'আতের অনুসরণ সম্পর্কে তোমরা উদাসীন হয়ে থাক।
ইবনুল কায়্যিম রহ. পার্থিব আসবাব-উপকরণের পাশাপাশি এমনসব জ্ঞান-বিদ্যা অর্জনের প্রতিযোগিতাকেও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যে জ্ঞান-বিদ্যার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ না। এমনিভাবে তার মতে যে আমল দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্য থাকে না এবং যে আমল আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের দিকে এগিয়ে নেয় না, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যারা ইলম ও আমলে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় বিভোর, তাদেরও এদিকে লক্ষ রাখা উচিত, যাতে সে প্রচেষ্টা কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের জন্যই নিবেদিত থাকে।
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে— ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ (যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ)। এর দুই অর্থ হতে পারে। এক অর্থ আক্ষরিক। আয়াতটির শানে নুযূলের দিকে লক্ষ করে আক্ষরিক অর্থ করারও অবকাশ আছে। অর্থাৎ অহমিকা প্রদর্শনার্থে বাস্তবিকই কবরস্থানে পৌঁছে যাওয়া। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আনসার বা কুরায়শদের দু'টি গোত্র একে অপরের উপর ধন ও জন নিয়ে গর্ব করত। বলত, তোমাদের মধ্যে কি আমাদের অমুকের মত কেউ আছে? এমনকি কবরস্থানে গিয়ে কোনও কোনও কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বলত, এই কবরে যে শুয়ে আছে, তার মত কেউ তোমাদের মধ্যে আছে বা কখনও ছিল? কিংবা বলত, অর্থ-সম্পদ ও লোকসংখ্যায় আমরা তোমাদের উপরে। সংখ্যাধিক্য প্রমাণের জন্য এমনকি তারা কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের সংখ্যাও হিসাব করত। আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, নিজেদের আধিক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এমনকি তোমরা কবরস্থানেও হাজির হয়ে যাও।
দ্বিতীয় অর্থ প্রায়োগিক অর্থাৎ ইন্তিকাল করা। বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা অর্থবিত্তে, লোকসংখ্যায় ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে থাক। যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বড়াই তোমাদেরকে আখিরাত থেকে উদাসীন করে রাখে। অথচ তোমাদের এ বড়াই সম্পূর্ণ মিছে। যে ধন ও জন নিয়ে তোমরা বড়াই কর, মৃত্যুতে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়। মৃত্যুর পর এসব কোনওই কাজে আসে না। মৃত্যুর পর কাজে আসে কেবলই নেক আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يتبع الميت ثلاثة أهلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى وَاحِدٌ : يَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ
'মায়্যিতের পেছনে পেছনে যায় তিনটি জিনিস- তার পরিবার-পরিজন, তার সম্পদ ও তার আমল। তারপর দু'টি ফিরে আসে, থেকে যায় একটি। ফিরে আসে তার পরিবার-পরিজন ও সম্পদ আর থেকে যায় তার আমল ।
তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ (কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে)। অর্থাৎ কিছুতেই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচুর্যের বড়াই করা উচিত নয়। এ বড়াই ও অহমিকার অশুভ পরিণাম তোমরা অচিরেই জানতে পারবে। মৃত্যু অতি সন্নিকটে। মৃত্যুর পর যখন কবরে পৌঁছবে এবং কবরের শাস্তির সম্মুখীন হবে, তখন জানতে পারবে এ বড়াই কতটা মিছে ছিল এবং ছিল কত অন্যায় ও অনুচিত।
একই কথা দুই আয়াতে দু'বার উচ্চারিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, এ অনৌচিত্য ও এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কিত সতর্কবাণীকে জোরদার করা। কারও কারও মতে এ দুই আয়াতের প্রথম আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে মৃত্যুকালীন কষ্ট ও যন্ত্রণা অথবা কবরের আযাব সম্পর্কে। অর্থাৎ যখন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হবে বা যখন কবরে পৌঁছবে ও কবরের আযাব শুরু হয়ে যাবে, তখন বুঝতে পারবে এ অহমিকা কত অসার ও অনুচিত ছিল। দ্বিতীয় আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে পুনরুত্থানের পর হাশর ময়দানের বিভীষিকা সম্পর্কে। সেখানে যখন নিজ নিজ আমলের হিসাব-নিকাশ দিতে হবে, যখন আমলনামা সামনে খুলে দেওয়া হবে এবং দাড়িপাল্লায় নেকী-বদী ওজন করা হবে, তখন পার্থিব জীবনের সবরকম দর্প-অহংকারের হাকীকত খুলে যাবে। তখন বুঝতে পারবে এসব দর্প-অহংকার দেখানো কতটা নির্বুদ্ধিতা ছিল এবং এর পরিবর্তে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে নেক আমলে যত্নবান থাকা কত জরুরি ছিল।
তারপর ইরশাদ হয়েছে- كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ
“কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি জানতে (তবে এরূপ করতে না)"। এ আয়াত দ্বারা পূর্বের সতর্কীকরণকে অধিকতর বলিষ্ঠ করা হয়েছে। আয়াতে تَعْلَمُونَ
এর কর্মপদ উহ্য। অর্থাৎ তোমাদের সামনে কবরে ও হাশরে কী আছে এবং কী পরিস্থিতি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে। জানলে কী হতো তাও অব্যক্ত রাখা হয়েছে, যেহেতু একটু চিন্তা করলেই তা বোঝা যায়। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে তা জানলে তোমরা এসব দৰ্প ও বড়াই করতে না। বরং সবকিছু ভুলে গিয়ে সে চিন্তায় বিভোর থাকতে এবং সেজন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনেই ব্যস্ত থাকতে।
ইমাম নববী রহ. যুহদ প্রসঙ্গে এখানে এ পাঁচটি আয়াতই উল্লেখ করেছেন। অবশিষ্ট তিন আয়াতও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং আমরা সংক্ষেপে সে তিন আয়াতেরও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ
(তোমরা জাহান্নাম অবশ্যই দেখবে)। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কবরে জাহান্নাম দেখতে পাবে। শেষ বিচারের পর পাপীগণ তো জাহান্নামে নিক্ষিপ্তই হবে। কিন্তু তখনকার সে দেখা কোনও কাজে আসবে না। কেননা তখন প্রতিকারের কোনও সুযোগ থাকবে না।
মৃত ব্যক্তি কবরে থাকা অবস্থায় যে জাহান্নাম দেখতে পায়, কুরআন ও হাদীছ দ্বারা তা প্রমাণিত। যেমন ফিরআওন ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
{ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ } [غافر: 46]
“আগুন, যার সামনে তাদেরকে প্রতি সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সে দিন (আদেশ করা হবে) ফিরআওনের সম্প্রদায়কে কঠিনতম শাস্তিতে প্রবেশ করাও ।
এক হাদীছে আছে-
إِذا مَاتَ أَحَدُكُمْ عُرِضَ عَلَيْهِ مَقْعَدُهُ، غُدْوَةً وَعَشِيًّا، إِمَّا النَّارُ وَإِمَّا الْجَنَّةُ، فَيُقَالُ: هَذَا مَفْعَدُكَ حَتَّى تُبْعَثَ إِلَيْهِ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মারা যায়, তখন সকাল ও সন্ধ্যায় তার সামনে তার অবস্থানস্থল প্রকাশ করা হয়। হয় তা জাহান্নাম, নয়তো জান্নাত। তাকে বলা হয়, এই তোমার স্থান। পুনরুত্থানের পর তোমাকে এখানে পৌঁছানো হবে।
অপর এক হাদীছে আছে-
«وإن الكافر» فذكر موته قال: " وتعاد روحه في جسده، ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان: له من ربك؟ فيقول: هاه هاه هاه، لا أدري، فيقولان له: ما دينك؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فيقولان: ما هذا الرجل الذي بعث فيكم؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فينادي مناد من السماء: أن كذب، فأفرشوه من النار، وألبسوه من النار، وافتحوا له بابا إلى النار " قال: «فيأتيه من حرها وسمومها» قال: «ويضيق عليه قبره حتى تختلف فيه أضلاعه» زاد في حديث جرير قال: «ثم يقيض له أعمى أبكم معه مرزبة من حديد لو ضرب بها جبل لصار ترابا» قال: «فيضربه بها ضربة يسمعها ما بين المشرق والمغرب إلا الثقلين فيصير ترابا» قال: «ثم تعاد فيه الروح»
'নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফের ব্যক্তির মৃত্যুর অবস্থা বর্ণনা করার পর ইরশাদ করেন, তার দেহে তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার কাছে দু'জন ফিরিশতা আসে। তারা তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার রব্ব কে? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার দীন কী? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তখন আসমান থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করে, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরাও আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দুয়ার খুলে দাও ।
তারপর আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ (6) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِمِ
(তোমরা অবশ্যই তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে)। এর দ্বারা পূর্বের আয়াতের বক্তব্যকে শক্তিশালী করা হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, দুনিয়ায় ঈমানদারগণ কল্পনার চোখে বা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা জাহান্নাম দেখতে পায়। তাদের এ দেখা চামড়ার চোখে নয়; বরং এটা তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহাতীত জ্ঞান। তারা তাদের জ্ঞান ও বিশ্বাস দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে জাহান্নামের শাস্তি কত কঠিন। কিন্তু মৃত্যুর পর এটা কেবল জ্ঞান ও বিশ্বাসের স্থলে থাকবে না; বরং চাক্ষুষ হয়ে যাবে। তারা চর্মচক্ষেই তখন জাহান্নাম দেখতে পাবে। এটা স্পষ্ট করার প্রয়োজন এ কারণেও ছিল যে, الرؤية শব্দটি যেমন 'চোখের দেখা' অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি মন-মস্তিষ্কের দেখা তথা 'জানা' অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আখিরাতে জাহান্নাম দেখার বিষয়টি কেবল জানা অর্থে নয়; বরং তা হবে পুরোপুরি চোখের দেখা। কেউ যাতে এটাকে জানা অর্থে না বোঝে, তাই আয়াতে لَتَرَوُنَّ عَيْنَ الْيَقِينِ(চাক্ষুষ প্রত্যয়) শব্দ ব্যবহার করে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
সবশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ "অতঃপর সেদিন তোমাদেরকে নি'আমতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?)"। অর্থাৎ মানুষ ইহজীবনে যা-কিছু ভোগ করে, তার কৃতজ্ঞতা কে কতটুকু আদায় করেছে কিংবা আদৌ করেছে কি না? সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা জিজ্ঞেস করা হবে মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলকেই।
কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে দেওয়া স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে, এর কী শোকর তারা আদায় করেছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, শারীরিক সুস্থতা, চোখ ও কান সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞাসা করবেন, বান্দা এগুলো কী কাজে ব্যবহার করেছিল?
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমরা এমন কী নি'আমত ভোগ করছি? আমরা তো সামান্য যবের রুটি খেয়েই দিন কাটাচ্ছি। উত্তরে বলা হল, তোমরা কি জুতা পায়ে দাও না এবং ঠাণ্ডা পানি পান কর না? এটাও নি'আমতের অন্তর্ভুক্ত।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়ছাম রাযি.-এর বাড়িতে যান। তিনি তাদের খেজুর ও গোশত খাওয়ান এবং পানি পান করান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এটাই সে নি'আমত, যে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে।
মানুষের জ্ঞানও অনেক বড় নি'আমত। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হবে। এমনকি জিজ্ঞেস করা হবে মানুষের প্রভাব- প্রতিপত্তি সম্পর্কে। তাছাড়া জিজ্ঞেস করা হবে আয়ু ও যৌবনকাল সম্পর্কেও। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس، عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم.
“কিয়ামতের দিন নিজ প্রতিপালকের সম্মুখ থেকে আদমসন্তানের পা সরতে পারবে না, যাবৎ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। জিজ্ঞেস করা হবে তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কিসে নিঃশেষ করেছে; তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে জরাজীর্ণ করেছে; তার অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে; আর সে যা জানত সে অনুযায়ী কী আমল করেছে।
অবশ্য আল্লাহ তা'আলার এমন অনেক বান্দাও আছে, যারা বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করবে। তাদেরকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল করে নিন– আমীন।
সাত নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64]
অর্থ : 'এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ খেলাধুলার যেমন স্থায়িত্ব নেই এবং তা মানুষকে অন্যসব কাজ থেকে গাফেল করে রাখে, তেমনি মানুষের পার্থিব জীবন ও জীবনের উপকরণসমূহেরও কোনও স্থায়িত্ব নেই। আর এতে লিপ্ত মানুষ তার আসল ঠিকানা আখিরাত ভুলে যায়। সে উদাসীন হয়ে পড়ে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের চেষ্টা হতে। সে গাফেল হয়ে যায় শরীআতের বিধান পালন থেকে। মানুষ দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, পদ ও পদবী, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সুনাম-সুখ্যাতির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে। কিন্তু এসবের স্থায়িত্ব কতটুকু? অথচ এর পেছনে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন বরবাদ করে দেয়! এ আয়াত সতর্ক করছে যে, মানুষ যেন এসবে মাতোয়ারা হয়ে তার আখিরাত ভুলে না যায়। তাকে মনে রাখতে হবে আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। সে জীবন স্থায়ী। সেখানে কোনও মৃত্যু নেই। জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও কষ্ট-ক্লেশ নেই। তাই মানুষকে সেই প্রকৃত জীবনের সফলতা লাভের জন্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
এর অর্থ এ নয় যে, মানুষ দুনিয়ার সকল উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে যাবে। জীবনরক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ দোষের নয়। বরং সে সংগ্রহ যদি আল্লাহ তা'আলার জন্য হয় এবং হয় শরী'আত মোতাবেক, তবে তা খেলাধুলা বলে গণ্য হবে না । ইসলাম তাকে আখিরাতের কাজ বলেই গণ্য করে। এক হাদীছে ইরশাদ-
ألا إِنَّ الدُّنْيا مَلْعُوْنَةٌ، مَلْعُونٌ مَا فِيهَا، إِلَّا ذِكرُ الله، وَمَا وَالاهُ، وَعَالِم أو مُتَعَلم
“শোন! দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত এর সবকিছুই। ব্যতিক্রম কেবল আল্লাহর যিকর এবং ওইসকল কাজ, যা বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। আর ব্যতিক্রম আলেম ও ইলমে দীনের সন্ধানী।”
যেসকল কাজ বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়, তার মধ্যে যেমন আছে নামায-রোযা, তেমনি আছে হালাল উপার্জন, দান-খয়রাত ও সৃষ্টির সেবাও। যেসব কাজ সদকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য তার জন্য বিভিন্ন আসবাব-উপকরণের প্রয়োজন হয়। সেগুলো সংগ্রহের চেষ্টা নিশ্চয়ই অভিশপ্ত কাজ নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য হবে, যেহেতু তা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উপলক্ষ্য। ইসলাম যেহেতু বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদের দীন নয়, তাই পার্থিব জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক কোনওকিছুই নিন্দনীয় নয়, যদি তা নিছক ভোগের জন্য না হয়। এবং তার অর্জন ও ব্যবহার হয় শরী'আতসম্মতভাবে। দুনিয়ার কাজকর্ম যদি কেবল দুনিয়াদারীর জন্যই হয়, নিছক ভোগাসক্তির জন্য হয়, তবে সেটাই নিন্দনীয়। আয়াত সেটাকেই খেলতামাশা সাব্যস্ত করেছে।
যুহদ অর্থ ত্যাগ করা। তুলনামূলক বেশি লাভজনক বা বেশি আগ্রহের বস্তু পাওয়ার লক্ষ্যে তদপেক্ষা নিম্নস্তরের বস্তু ছেড়ে দেওয়াকে যুহদ বলে। এককথায় একে দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি বা নির্মোহ শব্দে ব্যক্ত করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছে বিষয়টি এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে-
الزهادة في الدُّنْيَا لَيْسَتْ بِتَحْرِيمُ الْحَلالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنَّ الزَّهَادَةَ فِي الدُّنْيَا أَن لا تَكُونَ بِمَا فِي يَدَبَّكَ أَوْثَقَ مِمَّا فِي يَدِ اللهِ، وَأَنْ تَكُونَ فِي ثَوَابِ الْمُصِيَّة إِذا أنتَ أصِبْتَ بها أرغب فيها أو أنها أبقيت لك.
"দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া এবং কোনও মুসিবত দেখা দিলে তা দূর হওয়া অপেক্ষা সে মসিবতের ছাওয়াবের প্রতি বেশি আগ্রহ থাকা।
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. এ হাদীছের আলোকে বলেন, যুহদ হচ্ছে আত্মার একটি গুণ। এ হাদীছে তার আলামত বলে দেওয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা যুহদ সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা শুধরে দেওয়া হয়েছে।
অধিকাংশ আমলোক নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করে যাহিদ হল সেই লোক, যে দুনিয়ার যাবতীয় আনন্দ ও স্বাদের বস্তু পরিহার করে চলে যেমন হারাম বস্তু পরিহার করা হয়। এবং তাদের কাছে যা-কিছু আসে, সঙ্গে সঙ্গে তা খরচ করে ফেলে, তা ভুল জায়গাতেই হোক না কেন। এমনিভাবে কোনও বালা-মুসিবত দেখা দিলে মুক্তির কোনও ব্যবস্থা করে না। তাদের দৃষ্টিতে এরকম হওয়াই বুযুর্গীর শর্ত।
এ হাদীছ জানাচ্ছে, এসব মোটেই শর্ত নয়। বরং নিজ হাতের অর্থ-সম্পদ অপেক্ষা আল্লাহ তা'আলার উপর বেশি নির্ভরশীল থাকা জরুরি। আর বালা-মুসিবত যদিও কাঙ্ক্ষিত নয়, কিন্তু তার জন্য যে ছাওয়াবের ওয়াদা আছে তা পাওয়ার প্রতি আগ্রহী থাকা চাই। কাজেই মুসিবতের কারণে কেবল এজন্যই খুশি থাকা দরকার যে, তা প্রভৃত ছাওয়াবের কারণ (এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, মসিবত থেকে মুক্তির কোনও চেষ্টা করা হবে না) - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮।
উহুদের যুদ্ধে প্রথমে অর্জিত বিজয়ের পর মাঝখানে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ } [الحديد: 23]
“তা এই জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ, তার জন্য যাতে দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ এমন কোনও ব্যক্তিকে পসন্দ করেন না, যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে।
এ আয়াত স্পষ্টভাবেই বলছে যে, দুনিয়ার সম্পদ বা অন্য কোনওকিছুই হারানোর কারণে আক্ষেপ করতে নেই এবং অর্জনের দরুন উল্লসিতও হতে নেই। কেননা হারানোতে আক্ষেপ ও অর্জনে উল্লাস দুনিয়ার প্রতি মোহ ও আসক্তির ইঙ্গিত বহন করে, যা মুমিনদের মধ্যে থাকতে নেই।
কোনওকিছু হারালে যদি সবর করা যায় ও তার মধ্যেই কল্যাণ আছে বলে বিশ্বাস করা যায়, তবে তার বিপরীতে আখিরাতে অপরিমিত ছাওয়াব লাভ হয়। এমনিভাবে কোনওকিছু অর্জিত হলে উল্লাসের পরিবর্তে যদি সেজন্য শোকর আদায় করা হয় এবং আখিরাতের প্রতিদান আরও মূল্যবান বিবেচনায় আল্লাহর হুকুমমতো তা ব্যবহার বা খরচ করা হয়, তাতেও আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হয়। তো সেই ছাওয়ার ও সন্তুষ্টিই হবে মুমিনের লক্ষ্যবস্তু। এটাই আয়াতের সারমর্ম। আর এরই নাম যুহদ।
হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. বলেন, বস্তুত যুহদ হল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বান্দার অন্তরে প্রদত্ত নূর ও ইলম। সেই নূর ও ইলমের কারণে হৃদয়ের ফোয়ারা খুলে যায় ও সত্য উন্মোচিত হয়। তখন বুঝে আসে দুনিয়ার সাজ-সরঞ্জাম মাছির ডানা অপেক্ষাও তুচ্ছ এবং আখিরাতই উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।
এ নূর যার হাসিল হয়ে যায়, তার কাছে আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া এমনই হীন হয়ে যায় যে, বহুমূল্য মণিমুক্তার বিপরীতে ছেড়া ন্যাকড়ার যে মূল্য, তার চোখে দুনিয়ার ততটুকু মূল্যও থাকে না - বাছায়েরে হাকীমুল উম্মত, পৃ. ৪০৮
যুহদের বিপরীত হল দুনিয়ার মোহ ও আসক্তি। এটা সমস্ত রোগের মূল। এর কারণে মানুষের ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল দুর্বল হয়ে যায়। তার মধ্যে দেখা দেয় কৃপণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ। এক-এক করে অন্তরের সব ভালো গুণ নিঃশেষ হয়ে যায়, তার পরিবর্তে মন্দ খাসলতসমূহ শিকড় গেড়ে বসে। এ কারণেই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
أول صلاح هذه الأمةِ بِالْيَقِينِ وَالزَّهْدِ، وَأَوَّلُ فَسَادِهَا بِالْبُخْلِ وَالأمل
"এ উম্মতের প্রথম গঠন-সংস্কার হয়েছে ইয়াকীন ও যুহদ দ্বারা। আর এ উম্মতের বিনাশ ও পচনের সূচনা হবে কৃপণতা ও দীর্ঘ আশা দ্বারা।"
প্রকাশ থাকে যে, যুহদ ও বৈরাগ্য এক নয়। ইসলামে বৈরাগ্য নিষেধ। এক দিকে যেমন বলা হয়েছে-
وَمَا الْحَيْوَةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
'আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।'
অপরদিকে ইরশাদ হয়েছে-
{ قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِيَ لِلَّذِينَ آمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ} [الأعراف: 32]
'বলো, আল্লাহ নিজ বান্দাদের জন্য যে শোভার উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, কে তা হারাম করেছে? এবং (এমনিভাবে) উৎকৃষ্ট জীবিকার বস্তুসমূহ? বল, এসব পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্য (এবং) কিয়ামতের দিনে বিশেষভাবে (তাদেরই)।
বস্তুত নিষেধ হচ্ছে দুনিয়ার আসক্তি; দুনিয়ার লিপ্ততা নয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য, দীন, ঈমান ও ইজ্জতের হেফাজতের জন্য দুনিয়ার আসবাব- উপকরণ যতটুকু দরকার, ততটুকু অর্জন করা মোটেই নিষেধ নয়। বরং শরীআত তা অর্জনে উৎসাহিত করেছে। ঘর-সংসার উপেক্ষা করতে বলেনি। বরং সংসারজীবন যাপনের মধ্য দিয়ে হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করেছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খাঁটি অনুসারীগণ সংসারজীবন যাপন করেছেন। তাঁরা স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মহব্বত করেছেন। তাঁরা বিলাসিতা করেননি বটে, তবে রুচিসম্মত খাবার খেয়েছেন এবং রুচিসম্মত পোশাকও পরেছেন। তাঁরা এ সবই করেছেন আখিরাতমুখিতার সঙ্গে। করেছেন আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত থাকার সঙ্গে। ফলে তাঁরা কোনওভাবেই যাতে আল্লাহ তা'আলার ও মাখলুকের কোনও হক নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পেরেছেন। বরং তা আদায় করেছেন পরম নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। বস্তুত এই-ই যুহদ।
এ দৃষ্টিতে একজন ধনী ব্যক্তিও যাহিদ হতে পারে, আবার একজন গরীবও হতে পারে বিষয়াসক্ত ও দুনিয়াপ্রেমী। যে ধনী উপার্জন করে হালাল পথে, উপার্জনচেষ্টার পর যা অর্জিত হয় তাতে খুশি থাকে, অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না, অর্জিত সম্পদ খরচ করে আল্লাহর হুকুমমতো এবং তা থেকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে কার্পণ্য করে না, সে প্রকৃত যাহিদ বটে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো যাহিদ ছিলেনই, তাঁর সব সাহাবীও যাহিদ ছিলেন। ধনী সাহাবী হযরত উছমান গণী রাযি. ও আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযি. যেমন যাহিদ ছিলেন, তেমনি গরীব সাহাবী হযরত বিলাল রাযি., হযরত আম্মার রাযি. প্রমুখও যাহিদ ছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা রাহঃ, ও আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. যেমন বড় ধনী ছিলেন, তেমনি বড় যাহিদও ছিলেন। অন্যদিকে যে গরীব ব্যক্তি ধনীর কাছ থেকে পাওয়ার আশায় থাকে, একটুতেই অন্যের কাছে হাত পাতে, হালাল-হারাম নির্বিচারে যখন যা পায় তাই লুফে নেয়, সে গরীব হয়েও পাক্কা দুনিয়াদার বৈকি। বস্তুত যুহুদ অন্তরের শিকড়বদ্ধ গুণ। ধন-সম্পদের কমবেশি দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। প্রমাণ হয় আচার-আচরণ ও কর্মপন্থা দ্বারা। ইউনুস ইবন মায়সারা রহ. এর আলামত বলেন-
ليست الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا بِتَحْرِيمِ الْحَلَالِ وَلا إضَاعَةِ الْمَالِ، وَلكِنِ الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيا أَن تَكُونَ بِمَا فِي بَدِ اللهِ أَولَقَ مِنْكَ مِمَّا فِي يَدَيْكَ، وَأَنْ يَكُونَ حَالُكَ فِي الْمُصِيبَةِ وَحَالُكَ إِذا لَمْ تُصَبُ بهَا سَوَاءَ، وَأَنْ يَكُونَ دَامَكَ وَمَادِحُكَ فِي الْحَقِّ سَوَاء.
“দুনিয়ার প্রতি যুহদ বা নিরাসক্তির অর্থ হালালকে হারাম করা ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলা নয়। বরং দুনিয়ার প্রতি যুহদ হল আল্লাহর হাতে যা আছে তা অপেক্ষা নিজের হাতে যা আছে তাতে বেশি আস্থাশীল না হওয়া, বিপদ-আপদকালে তোমার মনের অবস্থা যেমন থাকে, স্বস্তি ও নিরাপত্তার কালেও ঠিক তেমনই থাকা, আর ন্যায়ের ক্ষেত্রে তোমার কাছে নিন্দুক ও প্রশংসাকারী সমান গণ্য হওয়া ।
যুহদের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বহু আয়াত ও হাদীছ আছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]
অর্থ : 'পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এরকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেইসব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যেসকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে পার্থিব জীবনের নশ্বরতাকে তুলনা করা হয়েছে এমন একটি শস্যক্ষেত্রের সঙ্গে, যা বৃষ্টি বর্ষণে সিঞ্চিত হয়ে মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্যোপযোগী ঘন উদ্ভিদরাজিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং দেখতে না দেখতে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যে পরিণত হয়ে কৃষকের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। তারপর যখন ফসল পেকে ওঠে আর কৃষকরা মনে করে সে ফসল তাদের আয়ত্তাধীন, যখন ইচ্ছা তারা তা কেটে ঘরে তুলতে পারবে, অমনি আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযব সম্পর্কিত নির্দেশ এসে পড়ে আর মুহুর্তের মধ্যে কৃষকদের হতাশ করে দিয়ে সেই ভরা ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে খাঁ খাঁ মাঠে পরিণত হয়ে যায়। দেখলে মনে হয় যেন এখানে কখনও কোনওকিছুর অস্তিত্বই ছিল না।
আল্লাহ তা'আলা বোঝাচ্ছেন দুনিয়ার জীবনটাও এরকমই। তা দেখতে যতই সজীব ও চাকচিক্যপূর্ণ মনে হোক, তার কোনও স্থায়িত্ব নেই। নির্বোধ শ্রেণীর লোক বাহ্যিক চাকচিক্য ও সৌন্দর্য দেখে ধোঁকায় পড়ে যায়। তারা এর মোহে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন ভুলে যায়। কিন্তু তাদের সে মোহ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। অনেক সময় বালা-মসিবত এসে মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দেয়। আর মৃত্যু নামক এক অমোঘ বিধান তো রয়েছেই। যে-কোনও মুহূর্তে হানা দিয়ে সে নিমিষেই জীবনের সব রঙিন স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তাই বুদ্ধিমান লোকের উচিত দুনিয়ার ক্ষণিকের চাকচিক্যে মাতোয়ারা না হয়ে স্থায়ী অবিনশ্বর আখিরাতের জীবন সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার সাধনায় রত হওয়া। এ আয়াত সে আহ্বানই আমাদের জানাচ্ছে।
• দুই নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]
অর্থ : 'তাদের কাছে পার্থিব জীবনের এই উপমাও পেশ কর যে, তা পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, ফলে ভূমিজ উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে যায়, তারপর তা এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, যা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। সম্পদ ও সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা। তবে যে সৎকর্ম স্থায়ী, তোমার প্রতিপালকের নিকট তা ছাওয়াবের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট এবং আশা পোষণের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট।
ব্যাখ্যা
এখানে দু'টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতটিতে উপরের আয়াতের মত পার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ও চাকচিক্যের ক্ষণস্থায়িত্বকে একটি উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে।। শুষ্ক ও মৃত ভূমি বৃষ্টির পানিতে সিঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন উপকারী ফসল ও তৃণাদি উদ্গত করে। তারপর খুব দ্রুত তা বড় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তার সবুজ-শ্যামল দৃশ্য দর্শকের হৃদয়মন মাতিয়ে তোলে। কিন্তু সে সৌন্দর্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আবার খরা দেখা দেয়। মাঠঘাট সব শুকিয়ে যায়। পানির অভাবে গাছপালাও শুকাতে থাকে। শুকাতে শুকাতে একদম ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারপর মনকাড়া সেই সবুজ-শ্যামল ভূমি ফের শুষ্ক মৃত প্রান্তরে পরিণত হয়ে যায়। পার্থিব জীবনের সবকিছুই এরকম। দু'দিনের বাহার। মৃত্যুতে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা মাত্র। মৃত্যুর পর এসব কোনও কাজে আসে না। সেখানে কাজে আসে দুনিয়ায় করে যাওয়া সৎকর্ম। মানুষ যা-কিছু সৎকর্ম করে, তা স্থায়ী সম্পদরূপে থেকে যায়। মৃত্যুতে শেষ হয় না; বরং মৃত্যুর পরও বাকি থাকে এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তা-ই কাজে আসে। তাই সৎকর্মকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' অর্থাৎ স্থায়ী পুণ্য বলা হয়েছে।
পুণ্য মাত্রই স্থায়ী, যেহেতু অনন্ত আখিরাতে তা কাজে আসবে। তাই এক হাদীছে
سُبْحانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لله، ولا إله إلا الله، والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله
যিকরকে 'আল-বাকিয়াতুস সালিহাত' বলা হয়েছে।
আবার কোনও কোনও সৎকর্ম এমন, দুনিয়ায় যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এরূপ সৎকর্মকে সাধারণত সদকায়ে জারিয়া বলা হয়। যেমন ইলমে দীনের শিক্ষাদান, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, ক্ষেত-খামার ওয়াকফ করা ইত্যাদি। এদিকে লক্ষ করলে সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কেবল পার্থিব শোভা হয়েই থাকে না; স্থায়ী পুণ্যও হতে পারে। অর্থ ও সম্পদ যদি কোনও স্থায়ী সৎকর্মের খাতে ব্যয় করা হয়, তবে মৃত্যুর পরও তার ছাওয়াব জারি থাকে। এমনিভাবে সন্তান-সন্ততিকে নেককাররূপে গড়ে তুললে তাও একটি স্থায়ী পূণ্য। পিতা-মাতার আমলনামায় এর ছাওয়াব লেখা অব্যাহত থাকে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثة: من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له»
“মানুষ মারা গেলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ব্যতিক্রম (অর্থাৎ তার ছাওয়াব জারি থাকে)। তা হচ্ছে- সদাকায়ে জারিয়া; ওই ইলম, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় আর নেককার সন্তান, যে তার জন্য (অর্থাৎ পিতা-মাতার জন্য) দুআ করবে।
তিন নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]،
অর্থ : 'জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, বাহ্যিক সাজসজ্জা, তোমাদের পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে অন্যের উপরে থাকার প্রতিযোগিতারই নাম। তার উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদগত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, তারপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপর তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পার্থিব জীবনের হাকীকত তুলে ধরা হয়েছে। পার্থিব জীবনের মোটামুটি তিনটি স্তর শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। শিশুকালে মানুষ খেলাধুলায় মেতে থাকে। যৌবনকালে সাজসজ্জা ও পারস্পরিক অহমিকা প্রদর্শন মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধকালে ধনে-জনে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে সে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এ তিনও স্তরের তিনওটি কাজ সম্পূর্ণ অসার ও নিরর্থক। ইহজীবনেই পর্যায়ক্রমে তা স্পষ্ট হতে থাকে।
শৈশবে খেলাধুলাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়। কেউ তাতে ব্যাঘাত ঘটালে শিশুদের কাছে তা মহা ক্ষতিকর মনে হয়। কিন্তু যৌবনকাল আসলে তা নিয়ে হাসি পায়। তখন মনে হয় কী ফালতু কাজেই না মেতে থাকা হয়েছিল। যেই না বার্ধক্য শুরু হয়, অমনি বুঝে আসে অহেতুক সাজসজ্জা ও অহমিকা প্রদর্শনের পেছনে পড়ে জীবনের কত বড়ই না ক্ষতি করা হয়েছে। সে ক্ষতির প্রতিবিধান করার জন্য শুরু হয় প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা। ধনে-জনে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দৌড়। তারপর হঠাৎ করে যখন মৃত্যু এসে হানা দেয়, তখন বুঝে আসে সে দৌড়ও ছিল নেহাতই আত্মপ্রবঞ্চনা। তখন মনে আক্ষেপ জাগে, কেন দুনিয়াদারীর ধোকায় পড়ে জীবনটা বরবাদ করা হল। আকাঙ্ক্ষা হয়, যদি একটুখানি সময় পাওয়া যেত, তবে মনেপ্রাণে সৎকর্মে লেগে পড়তাম। কিন্তু শেষ সময়ের এ আকাঙ্ক্ষা তো পূরণ হওয়ার নয়।
কুরআন মাজীদ জীবনের এ ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্য ও আনন্দ-ফুর্তিকে ক্ষেত-খামারের ক্ষণিকের মনোহারিত্ব, তারপর তার আকস্মিক লোপাট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছে। ফল-ফসলের ভূমিতে যখন বৃষ্টিপাত হয়, তখন উদ্ভিদরাজি সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। তার নয়নাভিরাম দৃশ্যে মানুষ মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে যায়। তারপর যদি খরা দেখা দেয়, তবে আস্তে আস্তে তা শুকাতে শুরু করে। একপর্যায়ে তা শুকিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। মানুষ এরকমই। শিশুকালে ফুটন্ত ফুলের মত সুন্দর ও মনোহর থাকে। যৌবনকালে তার সৌন্দর্য ও সজীবতা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর বার্ধক্য আসে। সৌন্দর্য ম্লান হতে শুরু করে। একপর্যায়ে তার রূপ ও শোভা সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। মু'মিন ও কাফের সকলকেই এ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তারপর মৃত্যু
আসে। শুরু হয় কবর ও আখিরাতের যিন্দেগী। তখন মানুষ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদ এ আয়াতে বলছে- "আর আখিরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি”। অর্থাৎ কাফের ও ফাসিকের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। মুমিনের ঠিকানা জান্নাত। তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির স্থান। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে ক্ষমা পেয়ে তারা অনন্ত সুখের সে ঠিকানায় স্থায়ী হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ
এর অর্থ এরকমও করা যায় যে, বৃষ্টিতে উদ্গত উদ্ভিদরাজি কাফেরদের মুগ্ধ ও মোহিত করে দেয়। বিশেষভাবে কাফেরদের কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে সৃষ্টির সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়া কাফের- মুশরিকদেরই কাজ। যারা প্রকৃত মুমিন, তারা সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে স্রষ্টার কথা মনে করে এবং তা দ্বারা তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা অনুধাবন করে। ফলে তাদের আল্লাহ মুখিতা ও আনুগত্যের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
সবশেষে আল্লাহ বলেন; وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ (পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়)। অর্থাৎ যারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ দ্বারা আখিরাতের সাফল্য সন্ধান না করে বরং এর আসক্তিতেই মত্ত হয়ে যায়, তাদের জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার ধন- সম্পদ পুরোপুরি ধোঁকা। তারা মনে করে দুনিয়ার জীবনই প্রকৃত জীবন, এরপর আর কিছু নেই। কাজেই এখানে যতটা পার ফুর্তি করে নাও। অথচ আখিরাতের বিপরীতে দুনিয়া নিতান্তই তুচ্ছ। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَمَوْضِعُ سَوْطٍ أَحَدِكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا.
“জান্নাতে তোমাদের একটা লাঠি রাখার স্থানও দুনিয়া ও দুনিয়ায় যা-কিছু আছে তারচে' উত্কৃষ্ট।
বস্তুত দুনিয়ার জীবন ও উপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যে-কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি সহজেই বুঝতে পারে যে, এ দুনিয়া ও দুনিয়ার আসবাবপত্র পুরোটাই কেবল ধোঁকা। এর উপর ভরসা রাখা যায় না। এর পেছনে দৌড়ঝাঁপ করা সম্পূর্ণ বেহুদা কাজ। তাই এতে মগ্ন না হয়ে আমাদের কর্তব্য হবে সর্বদা স্থায়ী অনন্ত আখিরাতের কথা মাথায় রাখা এবং সেই অনন্ত-অসীম জীবন যাতে সাফল্যমণ্ডিত হয়, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সে লক্ষ্যে পরিচালনা করা।
চার নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]
অর্থ : 'মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে ৬টি জিনিস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলো মানুষের জন্য মনোরম ও আকর্ষণীয় করা হয়েছে। কে আকর্ষণীয় করেছে তা বলা হয়নি। কারণ এটা জানা কথা যে, তা আল্লাহ তা'আলাই করেছেন। তিনিই যাবতীয় বস্তু ও তার গুণাবলীর স্রষ্টা। এসবকে আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্য মানুষকে পরীক্ষা করা। কুরআন মাজীদের অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
'নিশ্চিত জেনো, ভূপৃষ্ঠে যা-কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে বেশি ভালো কাজ করে।
দুনিয়া ও দুনিয়ার বস্তুরাজিকে সুশোভিত করে তোলার মধ্যে আল্লাহ তা'আলার বহুবিধ হিকমত আছে। এক তো তাদেরকে পরীক্ষা করা যে, কে এই শোভায় মুগ্ধ হয়ে একেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেয় এবং কে একে জীবনের লক্ষ্যবস্তু না বানিয়ে বরং একে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করে তাঁর সন্তুষ্টিবিধানকে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
দ্বিতীয় হিকমত- ব্যক্তি ও সমাজজীবনের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানব- অস্তিত্বে নিহিত বহুবিধ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো আর এভাবে স্রষ্টার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় করে তোলা। নারীর প্রতি আকর্ষণ না থাকলে কে অহেতুক সংসারজীবনের ঘানি টানত? কেই বা সোনা-রূপা, হীরা-জহরত ও মণিমুক্তা কুড়ানোর সংগ্রামে জীবনপাত করত, যদি না এসবের আকর্ষণ প্রণোদনা যোগাত? কেই বা ফল-ফসলের বাগান: বিন্যাস ও গবাদি পশুর খামার গড়ার পরিশ্রমে দিনরাত একাকার করত, যদি না এসবের শোভা ও লাভ মনে আনন্দ দান করত? সাধনা-গবেষণার এডভ্যাঞ্চারে অবতীর্ণ হয়ে মানুষ বন বাদাড়, মরুভূমি, সাগরতল ও দূর মহাকাশের কত অজানা রহস্য উদ্ঘাটন করেছে, মানবকল্যাণের নব-অভিনব দুয়ার উন্মোচন করেছে, কত সমৃদ্ধ ও সম্পন্ন আজ মানবসংগ্রহের ভাণ্ডার, সে ওই প্রাণ আকুল করা সৃষ্টিশোভার কল্যাণে নয় কি?
নফসের বিরুদ্ধে নিরন্তন সাধনা-মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মা ও আত্মোৎকর্ষেরও এর মোক্ষম ব্যবস্থা এই বিত্ত-বস্তুর আকর্ষণ। আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণ এ আকর্ষণ পাশ কাটিয়ে নিজেদের দিল-দেমাগ সর্বক্ষণ আল্লাহপ্রেমে নিমজ্জিত রাখার সাধনায় রত থাকেন। ফলে বিত্ত ও বস্তুর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এর মলিনতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। বরং এর বিরুদ্ধে মুজাহাদা তার আল্লাহপ্রাপ্তির কারণ হয়ে যায়।
আয়াতে বলা হয়েছে, এসব বস্তুর আসক্তি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আকর্ষণীয় তো করা হয়েছে এসব বস্তু। মূলত 'বস্তুর আকর্ষণ'-এর স্থানে 'বস্তুর আসক্তির আকর্ষণ' বলার উদ্দেশ্য—এ আকর্ষণে নিমজ্জিত হওয়ার নিন্দায় তীব্রতা আনা। ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, মানুষ আকর্ষণীয় বস্তুর আসক্তিতে এত বেশি বিভোর যে, তারা বস্তুর ভালোবাসায় নিমজ্জিত তো বটেই, এমনকি তারা বস্তুর আকর্ষণকে পর্যন্ত ভালোবাসে। এটা কতইনা নিন্দনীয় ব্যাপার। মানুষের তো উচিত ছিল বস্তুর আকর্ষণ উপেক্ষা করে বস্তুর প্রতি সম্পূর্ণ নির্মোহ থাকা। তাদের কর্তব্য ছিল বস্তুর পরিবর্তে বস্তুর স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত থাকা। উল্টো তারা বস্তুর আকর্ষণের ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে আছে।
আয়াতে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে নারীর আকর্ষণকে। নারীর আকর্ষণের মধ্যে মানুষের বহুবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিন্তু আখিরাতবিমুখ মানুষ সে কল্যাণ অর্জনের পরিবর্তে নারীর আকর্ষণ দ্বারা নিজ দুনিয়া ও আখিরাত বরবাদ করে ফেলে।
তাই এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةٌ هِيَ أَضَرُّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ
"আমি আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর পরীক্ষার বিষয় আর কিছু রেখে যাইনি।
এ ক্ষতি হয় তখনই, যখন উদ্দেশ্য থাকে কেবলই দুনিয়া। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি হয় দীন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি, তখন পুরুষের জন্য নারী এবং নারীর জন্য পুরুষ কতইনা উপকারী। সে ক্ষেত্রে উভয়ের জন্য উভয়ে পরম কাম্য। একবার মুহাজির ও আনসারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
لِسَانًا ذَاكِرًا، وَقَلْبًا شَاكِرًا، وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِيْنُهُ عَلَى إِيْمَانِهِ ‘
যিকরকারী জিহ্বা, শোকরকারী অন্তর ও মুমিনা স্ত্রী, যে তাকে তার ঈমানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
আয়াতে উল্লেখিত দ্বিতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সন্তান-সন্তুতি। সন্তান-সন্তুতি মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় দান। এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের বংশবিস্তার হয়, মানবপ্রজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সন্তান সুসন্তান হলে তার দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের মুখ উজ্জ্বল হয় এবং আখিরাতেও মুক্তির ব্যবস্থা হয়। নেককার সন্তান পিতা- মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়াস্বরূপ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সন্তান-সন্ততিকে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখে। ফলে এ ক্ষেত্রে তারা আখিরাত ভূলে যায়। তাদের জন্য সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তা'আলার বহু হুকুম-আহকাম পালনে অন্তরায় হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْوَلَدَ مَبْخَلَةٌ مَجْبَنَةٌ
‘সন্তান মানুষের কৃপণতা ও ভীরুতার কারণ।
আয়াতে উল্লেখিত তৃতীয় আকর্ষণীয় বস্তু হল সোনা-রূপা। সোনা-রুপা বলতে যেমন এর মূল ধাতু বোঝায়, তেমনি টাকা-পয়সাও। এর প্রতিও মানুষের আকর্ষণ স্বভাবগত। এর একটা বড় কারণ এর দ্বারা মনের চাহিদা পূরণ করা যায়। মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইন্দ্রিয়সুখের অধিকাংশ উপকরণ এর দ্বারাই অর্জিত হয়ে থাকে। তাই মানুষ এ সম্পদ অর্জনের জন্য প্রাণের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে ফেলে। এমনিতে এটা অর্জন দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন এর মোহে লিপ্ত হয়ে শরীআতের আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করা হয়। অন্যথায় শরীআত মোতাবেক এর আয়-ব্যয় করা হলে তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে।চতুর্থ আকর্ষণীয় বস্তু দামী ঘোড়া। সেকালে ঘোড়া যেমন চলাফেরার কাজে ব্যবহার হতো, তেমনি এটা যুদ্ধ-বিগ্রহেরও অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ছিল। দিগবিজয়ী বীর ও রাজা-বাদশাদের কাছে এটা ছিল অতীব মূল্যবান সম্পদ। গাধা সেকালে একই কাজে ব্যবহৃত হতো। কুরআন মাজীদের অন্য এক আয়াতে এ তিন প্রকারের পশু সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
والْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَ الْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ '
এবং ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাতে আরোহন করতে পার এবং তা তোমাদের শোভা হয়। তিনি সৃষ্টি করেন এমন বহু জিনিস, যা তোমরা জান না।
বর্তমানকালেও এর গুরুত্ব সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তবে এখন এর স্থান দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক যানবাহন। একটি সুন্দর বাড়ির পাশাপাশি একটি মূল্যবান গাড়ি এখন মানুষের স্বপ্নের বস্তু। যার যত বেশি সম্পদ, সে তত মূল্যবান গাড়ি সংগ্রহের চেষ্টা করে। এটা অর্জনের জন্য হালাল-হারাম নির্বিচারে টাকা কামাইয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্যের উপর জুলুম-অত্যাচার চালায়। অর্জন হয়ে গেলে অন্যের উপর অহমিকা দেখায়। এগুলো সবই শরীআতবিরোধী। হাঁ, বৈধ উপায়ে যদি গাড়ি-ঘোড়া অর্জিত হয়ে যায় এবং অহংকার-অহমিকা থেকে বিরত থেকে এর সদ্ব্যবহার করা হয়, পাশাপাশি সুযোগমত একে মানবসেবায়ও কাজে লাগানো যায়, তবে এটা ছাওয়াব অর্জনেরও উপকরণ হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الخَيْلُ ثَلاثَةٌ هِيَ لِرَجُلٍ وِزْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ سِتْرُ، وَهِيَ لِرَجُلٍ أَجْرٌ
ঘোড়া তিন প্রকার। তা এক ব্যক্তির জন্য গুনাহ, এক ব্যক্তির জন্য (আত্মসম্মান রক্ষার) আবরণ এবং এক ব্যক্তির জন্য পুণ্য।
পঞ্চম আকর্ষণীয় বস্তু গবাদি পশু তথা উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি। এর কোনওটি পরিবহনের কাজে লাগে, কোনওটি খাদ্যচাহিদা পূরণ করে। আবার এগুলো একরকম শোভাও বটে। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ (5) وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ (6) وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنْفُسِ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (7)
তিনিই চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে তোমাদের জন্য শীত থেকে বাঁচার উপকরণ এবং তাছাড়া আরও বহু উপকার রয়েছে এবং তা থেকেই তোমরা খেয়েও থাক। তোমরা সন্ধ্যাকালে যখন সেগুলোকে বাড়িতে ফিরিয়ে আন এবং ভোরবেলা যখন সেগুলোকে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তার ভেতর তোমাদের জন্য দৃষ্টিনন্দন শোভাও রয়েছে। এবং তারা তোমাদের ভার বয়ে নিয়ে যায় এমন নগরে, যেখানে প্রাণান্তকর কষ্ট ছাড়া তোমরা পৌঁছতে পারতে না। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের প্রতিপালক অতি মমতাময়, পরম দয়ালু।
বহুবিধ উপকারী এসব পশু সংগ্রহে মৌলিকভাবে কোনও দোষ নেই। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। তাঁর দেওয়া নি'আমতের গুরুত্ব বোঝা ও তার যথাযথ ব্যবহারই কাম্য। শরী'আত এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الإِبلُ عِز لِأَهْلِهَا، وَالْعَلَمُ بَرَكَةٌ
উট তার মালিকের পক্ষে মর্যাদা। আর ছাগলে রয়েছে বরকত।
এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচাতো বোন উম্মে হানীকে লক্ষ্য করে বলেন-
اتَّخِذِي غَنَمًا فَإِنَّ فِيهَا بَرَكَةً
ছাগল প্রতিপালন কর, কেননা এর মধ্যে বরকত আছে।
অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعُ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ شِفَاءٌ، فَعَلَيْكُمْ بِأَلْبَانِ الْبَقَرِ، فَإِنَّهَا تَرُمُّ مِنْ كُل الشجر
"আল্লাহ তা'আলা এমন কোনও রোগ দেননি, যার কোনও শেফা দেননি। তোমরা গরুর দুধ পান করো, কেননা গরু সর্বপ্রকার গাছগাছালি খেয়ে থাকে।"
এসব হাদীছ গবাদি পশু প্রতিপালনে উৎসাহ যোগায়। কাজেই প্রতিপালন ও ব্যবহার দোষের নয়। দোষ হল এর মোহ। এর শরী'আতনির্ধারিত হক আদায় না করা এবং এতে লিপ্ত হয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়া হল এর প্রতি মোহমুগ্ধতার আলামত। অন্তরে থাকবে কেবলই আল্লাহর ভালোবাসা। দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা। কাজকর্ম হবে শরী'আতনিষ্ঠ। এ সিফাতের সঙ্গে গবাদি পশুসহ দুনিয়ার যে-কোনও সম্পদ যত বেশিই অর্জন করা হোক, ইসলাম তাতে আপত্তি করে না। সর্বক্ষেত্রে এটাই মূল লক্ষণীয় বিষয়।
ষষ্ঠ আকর্ষণীয় বস্তু হল শস্যক্ষেত্র। শস্যক্ষেত্র যে কত চিত্তাকর্ষী ও নয়নাভিরাম হয়ে থাকে, এ অধ্যায়ের প্রথম তিন আয়াতে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও আয়াতেরই উদ্দেশ্য চাষাবাদে অনাগ্রহ সৃষ্টি করা নয়। প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষকে এর প্রতি নির্মোহ করা। মানুষ যাতে এর ব্যতিব্যস্ততায় আখিরাত না ভুলে যায়। এর সৌন্দর্য-শোভা যাতে মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে না তোলে। অন্তরে আল্লাহপ্রেম ও আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত রেখে চাষাবাদের কাজ করলে তা দুনিয়াদারী হয় না। এরূপ চরিত্রের মানুষ চাষাবাদের কাজ দ্বারাও আখিরাতের সাফল্য অর্জন করতে পারে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«لا يغرس مسلم غرسا، ولا يزرع زرعا، فيأكل منه إنسان، ولا دابة، ولا شيء، إلا كانت له صدقة»
«لا يغرس رجل مسلم غرسا، ولا زرعا، فيأكل منه سبع أو طائر أو شيء، إلا كان له فيه أجر»
“কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি কোনও গাছ লাগায় বা ফসল বপন করে, তারপর কোনও হিংস্র পশু বা কোনও পাখি কিংবা অন্য কোনও কিছু তা থেকে খায়, তবে তাতে তার জন্য পুণ্য রয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ
(এসব ইহজীবনের ভোগসামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে)। অর্থাৎ এর উপকার কেবল এই ক্ষণস্থায়ী ইহজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এতে দিল লাগানো উচিত নয়। কেননা তাতে আখিরাত বরবাদ হয় এবং দুনিয়ায় এগুলো উপকারের পাশাপাশি নানারকম ক্ষতিরও কারণ হয়। তাই প্রয়োজনমাফিক এসব ব্যবহার করবে বটে, তবে দিল-দেমাগ নিবিষ্ট রাখবে আল্লাহ তা'আলার স্মরণ ও আখিরাতের প্রতি। তাতে আখিরাতের নিশ্চিত কল্যাণ তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে দুনিয়ায়ও এসবের মধ্যে যে উপকার আছে তা অর্জিত হয় আর যতটুকু ক্ষতি আছে তা থেকে বেঁচে থাকা যায়।
পাঁচ নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]
অর্থ : 'হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং এই পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে এবং আল্লাহর সম্পর্কেও যেন মহা ধোঁকাবাজ (শয়তান) তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে।
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হওয়া ও কিয়ামতের দিন কর্মফল দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন, তা অমোঘ সত্য। তার অন্যথা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং পার্থিব জীবনের ব্যতিব্যস্ততা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর সে প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। দুনিয়ার আকর্ষণ ও এর মোহমুগ্ধতা যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে না পারে। সেইসঙ্গে মহাপ্রতারক শয়তান তো আছেই। তোমরা যেন কিছুতেই তার ধোঁকায় না পড়ে যাও। আল্লাহ তা'আলা তাকে অবকাশ দিয়ে রেখেছেন। সে তোমাদেরকে ফাঁদে ফেলতে চাইবে। তোমাদেরকে আখিরাতের শাস্তির কথা ভুলিয়ে রেখে দুনিয়ার মোহে অন্ধ করে রাখতে চাইবে, যাতে সে নিজের সঙ্গে তোমাদেরকেও জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাবধান, তোমরা তার কুমন্ত্রণায় যেন পড়ে না যাও। সে তোমাদের চিরশত্রু। তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। সর্বদা অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখো এবং যাবতীয় কাজে আখিরাতের কথা চিন্তা করো।
ছয় নং আয়াত
{ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]،
অর্থ : '(পার্থিব ভোগসামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি এ কথা জানতে (তবে এরূপ করতে না)।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহ সূরা তাকাছুরের। এ সূরায় মোট ৮টি আয়াত আছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ
(একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে)। অর্থাৎ ধনে-জনে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। তোমরা এসব নিয়ে অহংকার-অহমিকায় লিপ্ত হয়ে পড় আর সে অহমিকা তোমাদেরকে আখিরাত হতে গাফেল করে রাখে। ফলে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ও শরী'আতের অনুসরণ সম্পর্কে তোমরা উদাসীন হয়ে থাক।
ইবনুল কায়্যিম রহ. পার্থিব আসবাব-উপকরণের পাশাপাশি এমনসব জ্ঞান-বিদ্যা অর্জনের প্রতিযোগিতাকেও এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যে জ্ঞান-বিদ্যার উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভ না। এমনিভাবে তার মতে যে আমল দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্য থাকে না এবং যে আমল আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যলাভের দিকে এগিয়ে নেয় না, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যারা ইলম ও আমলে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় বিভোর, তাদেরও এদিকে লক্ষ রাখা উচিত, যাতে সে প্রচেষ্টা কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের জন্যই নিবেদিত থাকে।
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে— ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ (যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ)। এর দুই অর্থ হতে পারে। এক অর্থ আক্ষরিক। আয়াতটির শানে নুযূলের দিকে লক্ষ করে আক্ষরিক অর্থ করারও অবকাশ আছে। অর্থাৎ অহমিকা প্রদর্শনার্থে বাস্তবিকই কবরস্থানে পৌঁছে যাওয়া। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আনসার বা কুরায়শদের দু'টি গোত্র একে অপরের উপর ধন ও জন নিয়ে গর্ব করত। বলত, তোমাদের মধ্যে কি আমাদের অমুকের মত কেউ আছে? এমনকি কবরস্থানে গিয়ে কোনও কোনও কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বলত, এই কবরে যে শুয়ে আছে, তার মত কেউ তোমাদের মধ্যে আছে বা কখনও ছিল? কিংবা বলত, অর্থ-সম্পদ ও লোকসংখ্যায় আমরা তোমাদের উপরে। সংখ্যাধিক্য প্রমাণের জন্য এমনকি তারা কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের সংখ্যাও হিসাব করত। আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, নিজেদের আধিক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এমনকি তোমরা কবরস্থানেও হাজির হয়ে যাও।
দ্বিতীয় অর্থ প্রায়োগিক অর্থাৎ ইন্তিকাল করা। বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা অর্থবিত্তে, লোকসংখ্যায় ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে থাক। যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বড়াই তোমাদেরকে আখিরাত থেকে উদাসীন করে রাখে। অথচ তোমাদের এ বড়াই সম্পূর্ণ মিছে। যে ধন ও জন নিয়ে তোমরা বড়াই কর, মৃত্যুতে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়। মৃত্যুর পর এসব কোনওই কাজে আসে না। মৃত্যুর পর কাজে আসে কেবলই নেক আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يتبع الميت ثلاثة أهلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى وَاحِدٌ : يَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ
'মায়্যিতের পেছনে পেছনে যায় তিনটি জিনিস- তার পরিবার-পরিজন, তার সম্পদ ও তার আমল। তারপর দু'টি ফিরে আসে, থেকে যায় একটি। ফিরে আসে তার পরিবার-পরিজন ও সম্পদ আর থেকে যায় তার আমল ।
তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ (কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন), কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে)। অর্থাৎ কিছুতেই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচুর্যের বড়াই করা উচিত নয়। এ বড়াই ও অহমিকার অশুভ পরিণাম তোমরা অচিরেই জানতে পারবে। মৃত্যু অতি সন্নিকটে। মৃত্যুর পর যখন কবরে পৌঁছবে এবং কবরের শাস্তির সম্মুখীন হবে, তখন জানতে পারবে এ বড়াই কতটা মিছে ছিল এবং ছিল কত অন্যায় ও অনুচিত।
একই কথা দুই আয়াতে দু'বার উচ্চারিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য, এ অনৌচিত্য ও এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কিত সতর্কবাণীকে জোরদার করা। কারও কারও মতে এ দুই আয়াতের প্রথম আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে মৃত্যুকালীন কষ্ট ও যন্ত্রণা অথবা কবরের আযাব সম্পর্কে। অর্থাৎ যখন মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হবে বা যখন কবরে পৌঁছবে ও কবরের আযাব শুরু হয়ে যাবে, তখন বুঝতে পারবে এ অহমিকা কত অসার ও অনুচিত ছিল। দ্বিতীয় আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে পুনরুত্থানের পর হাশর ময়দানের বিভীষিকা সম্পর্কে। সেখানে যখন নিজ নিজ আমলের হিসাব-নিকাশ দিতে হবে, যখন আমলনামা সামনে খুলে দেওয়া হবে এবং দাড়িপাল্লায় নেকী-বদী ওজন করা হবে, তখন পার্থিব জীবনের সবরকম দর্প-অহংকারের হাকীকত খুলে যাবে। তখন বুঝতে পারবে এসব দর্প-অহংকার দেখানো কতটা নির্বুদ্ধিতা ছিল এবং এর পরিবর্তে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে নেক আমলে যত্নবান থাকা কত জরুরি ছিল।
তারপর ইরশাদ হয়েছে- كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ
“কক্ষনও নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সাথে যদি জানতে (তবে এরূপ করতে না)"। এ আয়াত দ্বারা পূর্বের সতর্কীকরণকে অধিকতর বলিষ্ঠ করা হয়েছে। আয়াতে تَعْلَمُونَ
এর কর্মপদ উহ্য। অর্থাৎ তোমাদের সামনে কবরে ও হাশরে কী আছে এবং কী পরিস্থিতি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে। জানলে কী হতো তাও অব্যক্ত রাখা হয়েছে, যেহেতু একটু চিন্তা করলেই তা বোঝা যায়। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে তা জানলে তোমরা এসব দৰ্প ও বড়াই করতে না। বরং সবকিছু ভুলে গিয়ে সে চিন্তায় বিভোর থাকতে এবং সেজন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনেই ব্যস্ত থাকতে।
ইমাম নববী রহ. যুহদ প্রসঙ্গে এখানে এ পাঁচটি আয়াতই উল্লেখ করেছেন। অবশিষ্ট তিন আয়াতও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সুতরাং আমরা সংক্ষেপে সে তিন আয়াতেরও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ
(তোমরা জাহান্নাম অবশ্যই দেখবে)। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কবরে জাহান্নাম দেখতে পাবে। শেষ বিচারের পর পাপীগণ তো জাহান্নামে নিক্ষিপ্তই হবে। কিন্তু তখনকার সে দেখা কোনও কাজে আসবে না। কেননা তখন প্রতিকারের কোনও সুযোগ থাকবে না।
মৃত ব্যক্তি কবরে থাকা অবস্থায় যে জাহান্নাম দেখতে পায়, কুরআন ও হাদীছ দ্বারা তা প্রমাণিত। যেমন ফিরআওন ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
{ النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ } [غافر: 46]
“আগুন, যার সামনে তাদেরকে প্রতি সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সে দিন (আদেশ করা হবে) ফিরআওনের সম্প্রদায়কে কঠিনতম শাস্তিতে প্রবেশ করাও ।
এক হাদীছে আছে-
إِذا مَاتَ أَحَدُكُمْ عُرِضَ عَلَيْهِ مَقْعَدُهُ، غُدْوَةً وَعَشِيًّا، إِمَّا النَّارُ وَإِمَّا الْجَنَّةُ، فَيُقَالُ: هَذَا مَفْعَدُكَ حَتَّى تُبْعَثَ إِلَيْهِ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মারা যায়, তখন সকাল ও সন্ধ্যায় তার সামনে তার অবস্থানস্থল প্রকাশ করা হয়। হয় তা জাহান্নাম, নয়তো জান্নাত। তাকে বলা হয়, এই তোমার স্থান। পুনরুত্থানের পর তোমাকে এখানে পৌঁছানো হবে।
অপর এক হাদীছে আছে-
«وإن الكافر» فذكر موته قال: " وتعاد روحه في جسده، ويأتيه ملكان فيجلسانه فيقولان: له من ربك؟ فيقول: هاه هاه هاه، لا أدري، فيقولان له: ما دينك؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فيقولان: ما هذا الرجل الذي بعث فيكم؟ فيقول: هاه هاه، لا أدري، فينادي مناد من السماء: أن كذب، فأفرشوه من النار، وألبسوه من النار، وافتحوا له بابا إلى النار " قال: «فيأتيه من حرها وسمومها» قال: «ويضيق عليه قبره حتى تختلف فيه أضلاعه» زاد في حديث جرير قال: «ثم يقيض له أعمى أبكم معه مرزبة من حديد لو ضرب بها جبل لصار ترابا» قال: «فيضربه بها ضربة يسمعها ما بين المشرق والمغرب إلا الثقلين فيصير ترابا» قال: «ثم تعاد فيه الروح»
'নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফের ব্যক্তির মৃত্যুর অবস্থা বর্ণনা করার পর ইরশাদ করেন, তার দেহে তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার কাছে দু'জন ফিরিশতা আসে। তারা তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার রব্ব কে? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার দীন কী? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তখন আসমান থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করে, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরাও আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দুয়ার খুলে দাও ।
তারপর আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ (6) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِمِ
(তোমরা অবশ্যই তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে)। এর দ্বারা পূর্বের আয়াতের বক্তব্যকে শক্তিশালী করা হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, দুনিয়ায় ঈমানদারগণ কল্পনার চোখে বা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা জাহান্নাম দেখতে পায়। তাদের এ দেখা চামড়ার চোখে নয়; বরং এটা তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহাতীত জ্ঞান। তারা তাদের জ্ঞান ও বিশ্বাস দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে জাহান্নামের শাস্তি কত কঠিন। কিন্তু মৃত্যুর পর এটা কেবল জ্ঞান ও বিশ্বাসের স্থলে থাকবে না; বরং চাক্ষুষ হয়ে যাবে। তারা চর্মচক্ষেই তখন জাহান্নাম দেখতে পাবে। এটা স্পষ্ট করার প্রয়োজন এ কারণেও ছিল যে, الرؤية শব্দটি যেমন 'চোখের দেখা' অর্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনি মন-মস্তিষ্কের দেখা তথা 'জানা' অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আখিরাতে জাহান্নাম দেখার বিষয়টি কেবল জানা অর্থে নয়; বরং তা হবে পুরোপুরি চোখের দেখা। কেউ যাতে এটাকে জানা অর্থে না বোঝে, তাই আয়াতে لَتَرَوُنَّ عَيْنَ الْيَقِينِ(চাক্ষুষ প্রত্যয়) শব্দ ব্যবহার করে সে সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
সবশেষে আল্লাহ তা'আলা বলেন- ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ "অতঃপর সেদিন তোমাদেরকে নি'আমতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?)"। অর্থাৎ মানুষ ইহজীবনে যা-কিছু ভোগ করে, তার কৃতজ্ঞতা কে কতটুকু আদায় করেছে কিংবা আদৌ করেছে কি না? সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এটা জিজ্ঞেস করা হবে মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলকেই।
কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে দেওয়া স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে, এর কী শোকর তারা আদায় করেছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, শারীরিক সুস্থতা, চোখ ও কান সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞাসা করবেন, বান্দা এগুলো কী কাজে ব্যবহার করেছিল?
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমরা এমন কী নি'আমত ভোগ করছি? আমরা তো সামান্য যবের রুটি খেয়েই দিন কাটাচ্ছি। উত্তরে বলা হল, তোমরা কি জুতা পায়ে দাও না এবং ঠাণ্ডা পানি পান কর না? এটাও নি'আমতের অন্তর্ভুক্ত।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়ছাম রাযি.-এর বাড়িতে যান। তিনি তাদের খেজুর ও গোশত খাওয়ান এবং পানি পান করান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এটাই সে নি'আমত, যে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে।
মানুষের জ্ঞানও অনেক বড় নি'আমত। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হবে। এমনকি জিজ্ঞেস করা হবে মানুষের প্রভাব- প্রতিপত্তি সম্পর্কে। তাছাড়া জিজ্ঞেস করা হবে আয়ু ও যৌবনকাল সম্পর্কেও। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس، عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم.
“কিয়ামতের দিন নিজ প্রতিপালকের সম্মুখ থেকে আদমসন্তানের পা সরতে পারবে না, যাবৎ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। জিজ্ঞেস করা হবে তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কিসে নিঃশেষ করেছে; তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে জরাজীর্ণ করেছে; তার অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে; আর সে যা জানত সে অনুযায়ী কী আমল করেছে।
অবশ্য আল্লাহ তা'আলার এমন অনেক বান্দাও আছে, যারা বিনা হিসেবে জান্নাত লাভ করবে। তাদেরকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল করে নিন– আমীন।
সাত নং আয়াত
وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64]
অর্থ : 'এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ খেলাধুলার যেমন স্থায়িত্ব নেই এবং তা মানুষকে অন্যসব কাজ থেকে গাফেল করে রাখে, তেমনি মানুষের পার্থিব জীবন ও জীবনের উপকরণসমূহেরও কোনও স্থায়িত্ব নেই। আর এতে লিপ্ত মানুষ তার আসল ঠিকানা আখিরাত ভুলে যায়। সে উদাসীন হয়ে পড়ে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের চেষ্টা হতে। সে গাফেল হয়ে যায় শরীআতের বিধান পালন থেকে। মানুষ দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা, পদ ও পদবী, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সুনাম-সুখ্যাতির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে। কিন্তু এসবের স্থায়িত্ব কতটুকু? অথচ এর পেছনে পড়ে আখিরাতের স্থায়ী জীবন বরবাদ করে দেয়! এ আয়াত সতর্ক করছে যে, মানুষ যেন এসবে মাতোয়ারা হয়ে তার আখিরাত ভুলে না যায়। তাকে মনে রাখতে হবে আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। সে জীবন স্থায়ী। সেখানে কোনও মৃত্যু নেই। জান্নাত চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে কোনও কষ্ট-ক্লেশ নেই। তাই মানুষকে সেই প্রকৃত জীবনের সফলতা লাভের জন্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।
এর অর্থ এ নয় যে, মানুষ দুনিয়ার সকল উপকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে যাবে। জীবনরক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ দোষের নয়। বরং সে সংগ্রহ যদি আল্লাহ তা'আলার জন্য হয় এবং হয় শরী'আত মোতাবেক, তবে তা খেলাধুলা বলে গণ্য হবে না । ইসলাম তাকে আখিরাতের কাজ বলেই গণ্য করে। এক হাদীছে ইরশাদ-
ألا إِنَّ الدُّنْيا مَلْعُوْنَةٌ، مَلْعُونٌ مَا فِيهَا، إِلَّا ذِكرُ الله، وَمَا وَالاهُ، وَعَالِم أو مُتَعَلم
“শোন! দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত এর সবকিছুই। ব্যতিক্রম কেবল আল্লাহর যিকর এবং ওইসকল কাজ, যা বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। আর ব্যতিক্রম আলেম ও ইলমে দীনের সন্ধানী।”
যেসকল কাজ বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়, তার মধ্যে যেমন আছে নামায-রোযা, তেমনি আছে হালাল উপার্জন, দান-খয়রাত ও সৃষ্টির সেবাও। যেসব কাজ সদকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য তার জন্য বিভিন্ন আসবাব-উপকরণের প্রয়োজন হয়। সেগুলো সংগ্রহের চেষ্টা নিশ্চয়ই অভিশপ্ত কাজ নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রশংসনীয় কাজ বলেই গণ্য হবে, যেহেতু তা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উপলক্ষ্য। ইসলাম যেহেতু বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদের দীন নয়, তাই পার্থিব জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক কোনওকিছুই নিন্দনীয় নয়, যদি তা নিছক ভোগের জন্য না হয়। এবং তার অর্জন ও ব্যবহার হয় শরী'আতসম্মতভাবে। দুনিয়ার কাজকর্ম যদি কেবল দুনিয়াদারীর জন্যই হয়, নিছক ভোগাসক্তির জন্য হয়, তবে সেটাই নিন্দনীয়। আয়াত সেটাকেই খেলতামাশা সাব্যস্ত করেছে।
দুনিয়ার প্রাচুর্য নিয়ে উম্মত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয়:
হাদীছ নং : ৪৫৬
অর্থ : হযরত আমর ইবন আওফ আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে বাহরাইনে পাঠান সেখানকার জিযিয়া নিয়ে আসার জন্য। তিনি বাহরাইন থেকে অর্থ-সম্পদ নিয়ে ফিরে আসলেন। আনসারগণ আবূ উবায়দার আগমনের কথা শুনতে পেলেন। ফলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফজরের নামাযে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলে তারা তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে দিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনতে পেয়েছ আবু উবায়দা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে। তারা বললেন, হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও এবং যা তোমাদের আনন্দিত করবে তার আশা কর। আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য। ফলে তোমরা পরস্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হবে, যেমনটা তারা রেষারেষিতে লিপ্ত হয়েছিল। পরিণামে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল - বুখারী ও মুসলিম।
হাদীছ নং : ৪৫৬
অর্থ : হযরত আমর ইবন আওফ আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে বাহরাইনে পাঠান সেখানকার জিযিয়া নিয়ে আসার জন্য। তিনি বাহরাইন থেকে অর্থ-সম্পদ নিয়ে ফিরে আসলেন। আনসারগণ আবূ উবায়দার আগমনের কথা শুনতে পেলেন। ফলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফজরের নামাযে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলে তারা তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে দিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনতে পেয়েছ আবু উবায়দা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে। তারা বললেন, হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও এবং যা তোমাদের আনন্দিত করবে তার আশা কর। আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য। ফলে তোমরা পরস্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হবে, যেমনটা তারা রেষারেষিতে লিপ্ত হয়েছিল। পরিণামে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল - বুখারী ও মুসলিম।
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث عَلَى التقلل منها وفضل الفقر
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]، وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]، وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]، وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]، وقال تَعَالَى: {ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]، وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64] والآيات في الباب كثيرة مشهورة.
وأما الأحاديث فأكثر مِنْ أن تحصر فننبِّهُ بطرف منها عَلَى مَا سواه.
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا مَثَلُ الحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ والأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيهَا أتَاهَا أمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]، وقال تَعَالَى: {وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بهِ نَبَاتُ الأَرْضِ فَأصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا المَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَالبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا} [الكهف: 45 - 46]، وقال تَعَالَى: {اعْلَمُوا أَنَّمَا الحَياةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ في الأَمْوَالِ وَالأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أعْجَبَ الْكُفّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الآخِرَةِ عَذابٌ شَديدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ الله ورِضْوَانٌ وَمَا الحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الغُرُورِ} [الحديد: 20]، وقال تَعَالَى: {زُيِّنَ لِلْنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالبَنِينَ وَالقَنَاطِيرِ المُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ وَالْخَيْلِ المُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الحَياةِ الْدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ المآبِ} [آل عمران: 14]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الحَياةُ الْدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الغَرُورُ} [فاطر: 5]، وقال تَعَالَى: {ألْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ حَتَّى زُرْتُمُ المَقَابِرَ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُونَ كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ} [التكاثر: 1 - 5]، وقال تَعَالَى: {وَمَا هذِهِ الحَياةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا
يَعْلَمُونَ} [العنكبوت: 64] والآيات في الباب كثيرة مشهورة.
وأما الأحاديث فأكثر مِنْ أن تحصر فننبِّهُ بطرف منها عَلَى مَا سواه.
456 - عن عمرو بن عوف الأنصاري - رضي الله عنه: أنَّ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - بَعَثَ أَبَا عبيدة بنَ الجَرَّاح - رضي الله عنه - إِلَى الْبَحْرَيْنِ يَأتِي بِجِزْيَتِهَا، فَقَدِمَ بمَالٍ مِنَ الْبَحْرَيْنِ، فَسَمِعَتِ الأَنْصَارُ بقُدُومِ أَبي عُبيْدَةَ، فَوَافَوْا صَلاَةَ الفَجْرِ مَعَ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فَلَمَّا صَلَّى رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - انْصَرفَ، فَتَعَرَّضُوا لَهُ، فَتَبَسَّمَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - حِيْنَ رَآهُمْ، ثُمَّ قَالَ: «أَظُنُّكُمْ سَمِعْتُمْ أنَّ أَبَا عُبَيْدَةَ قَدِمَ بِشَيْءٍ مِنَ الْبَحْرَيْنِ؟» فقالوا: أجل، يَا رسول الله، فقال: «أبْشِرُوا وَأَمِّلْوا مَا يَسُرُّكُمْ، فَوالله مَا الفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلكِنِّي أخْشَى أَنْ تُبْسَط الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا، فَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أهْلَكَتْهُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীছে বাহরাইন থেকে জিযিয়ার অর্থ আসা, তা থেকে অংশ পেতে আনসারদের আগ্রহ এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে তাদের লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশবাণী বর্ণিত হয়েছে।
বাহরাইন ইসলামী হুকুমতের অধীনে আসে হিজরী ৮ম সনে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলা ইবনুল হাযরামী রাযি.-কে সেখানকার শাসনকর্তা মুনযির ইবন ‘সাওয়ী'-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মারফত মুনযিরের কাছে ইসলামী দাওয়াতের একখানি পত্রও পাঠিয়েছিলেন। হযরত 'আলা রাযি. বাহরাইনে পৌঁছে পত্রখানি মুনযিরের হাতে তুলে দিলে তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার গোত্রের লোকজনও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তবে সেখানকার মাজুসী সম্প্রদায় ইসলামগ্রহণে রাজি হয়নি। তারা জিযিয়া আদায়ের শর্তে হযরত 'আলা রাযি.-এর সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করে। জিযিয়া ধার্য করা হয়েছিল মাথাপিছু এক দীনার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনায়নের যুদ্ধের পর হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে জিযিয়ার অর্থ নিয়ে আসার জন্য বাহরাইন পাঠান। তিনি জিযিয়ার অর্থ নিয়ে যথাসময়ে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসেন। তার পরিমাণ ছিল এক লক্ষ দিরহাম। হযরত আবূ উবায়দা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা হাজির করলে তিনি মসজিদের এক কোণে তা রেখে দিতে বলেন। সেখানে তা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই চারদিকে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, হযরত আবূ উবায়দা রাযি, বাহরাইন থেকে বিপুল অর্থকড়ি নিয়ে এসেছেন। বর্ণনাকারী বলেন
فسمعت الأنصار بقدوم أبي عبيدة، فوافوا صلاة الفجر مع رسول الله ﷺ (আনসারগণ আবূ উবায়দার আগমনের কথা শুনতে পেলেন। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফজরের নামাযে মিলিত হলেন)। সাধারণত পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে এত মুসল্লী হতো না। কারণ প্রত্যেক এলাকায় আলাদা আলাদা মসজিদ ছিল। মুসল্লীগণ আপন আপন মহল্লার মসজিদেই নামায আদায় করত। কেবল জুমু'আর দিনেই জুমু'আর নামায আদায়ের জন্য সকলে মসজিদে নববীতে চলে আসত। ফজরের নামায আদায়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন আনসারগণ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাদের দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঁচ করতে পারলেন হয়তো তারা আবূ উবায়দার আগমন-সংবাদ শুনতে পেয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন
فتبسم رسول اللہ ﷺ حين رآهم، ثم قال: «أظنكم سمعتم أن أبا عبيدة قدم بشيء من البحرين؟ (তাদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে দিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনতে পেয়েছ আবূ উবায়দা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে)। কেন তিনি হেসেছিলেন? সম্ভবত এতসংখ্যক সাহাবীকে একসঙ্গে দেখতে পাওয়ার খুশিতে। এমনিতেও তিনি যে-কোনও আগুন্তুককে মুচকি হাসির সঙ্গেই গ্রহণ করতেন। কোনও সাহাবী এসে দেখা করলে চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস লক্ষ করা যেত।
তাঁর হাসির কারণ এরকমও হতে পারে যে, তিনি হয়তো অনুভব করছিলেন কিভাবেই না অর্থের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যায়। তিনি তাদের অন্তরে দুনিয়াবিমুখতার চেতনা সঞ্চার করে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ত্যাগের মানসিকতা প্রবল। সবসময়ই নিজের উপর অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ান। আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে চূড়ান্ত পর্যায়ের দুনিয়াবিমুখ। তিনি তাদের মধ্যে সশরীরে হাজির রয়েছেন। এতদ্সত্ত্বেও কিভাবে অর্থকড়ির সংবাদ শুনে তারা হাজির হয়ে পড়েছেন।
বলাবাহুল্য, আনসারদের অন্তরে অর্থের মোহ ছিল না। তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিতান্তই গরীব। কাজেই তাদের এ আগমন লোভের কারণে নয়; বরং ছিল প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লক্ষ্য তো তাদেরকে চূড়ান্ত পর্যায়ের ত্যাগ ও নির্মোহ মানসিকতার আদর্শরূপে গড়ে তোলা এবং তাদের অন্তরে দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের হীনতা ও তুচ্ছতার বোধ বদ্ধমূল করে দেওয়া। তাই তিনি হযরত আবূ উবায়দা রাযি.-এর নিয়ে আসা অর্থকে شيء শব্দে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কিছু বা সামান্য কিছু। তাঁর দৃষ্টিতে লক্ষ দিরহামও সামান্য কিছুই বটে। আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের জন্য আখিরাতে যা প্রস্তুত রেখেছেন তার বিপরীতে লক্ষ দিরহাম কী, সমগ্র দুনিয়াও অতি সামান্যই। বিভিন্ন হাদীছে তিনি এ কথা স্পষ্ট করেছেন।
সাহাবীগণও ছিলেন বড় সরল, অকপট। তারা বললেন- أجل يا رسول الله (হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণা সত্য বলে তারা স্বীকার করলেন। শুধু أجل (হাঁ) না বলে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলে সম্বোধনও করেছেন। এটাই আদব। বড় ও সম্মানিত ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে কেবল 'হাঁ' বা 'না' না বলে সম্মানসূচক সম্বোধনও করা চাই। প্রিয় ব্যক্তিকে সম্বোধন করার মধ্যে একরকম আস্বাদও নিহিত থাকে। ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ' সম্বোধনের মধ্যে যে আনন্দ ও আস্বাদ রয়েছে, তার কি কোনও তুলনা আছে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তারা যে উদ্দেশ্যে এসেছেন তা পূরণ হবে বলে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও এবং যা তোমাদের আনন্দিত করবে তার আশা কর। তারপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর আনীত দীনের রূহানী সবক দিলেন। তাদেরকে দিলেন যুহদের শিক্ষা। একজন মুমিনের জন্য দারিদ্র্য নয়; বরং ধনই যে বেশি বিপজ্জনক সে ব্যাপারে তাদের হুঁশিয়ার করলেন। তিনি বললেন
فوالله ما الفقر أخشى عليكم، ولكني أخشى أن تبسط الدنيا عليكم كما بسطت على من كان قبلكم (আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের প্রতি দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি)। ওহী দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হয়েছিল যে, অচিরেই তাঁর উম্মত দুনিয়ার দিকে দিকে জয়লাভ করবে। তাতে করে বড় বড় রাজা-বাদশার ধনভাণ্ডার তাদের দখলে চলে আসবে আর এভাবে তাদের বর্তমান দারিদ্র্য দূর হয়ে যাবে, তারা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাবে। তিনি জানতেন মানুষের দীন ও ঈমানের জন্য ধন-সম্পদ যতবেশি ক্ষতিকর, অভাব-অনটন ততটা ক্ষতিকর নয়। অন্যদিকে সন্তানের প্রতি পিতার যে মায়া-মমতা, উম্মতের প্রতি তাঁর মায়া-মমতা ছিল তারচে'ও বেশি। পিতা-মাতা তো সন্তানের দুনিয়ার দিকটাই দেখে। অর্থ-সম্পদ থাকলে দুনিয়ায় আরাম-আয়েশে থাকা যায়। অভাব-অনটনে নানা কষ্ট পেতে হয়। তাই পিতা-মাতা সন্তানের ক্ষেত্রে ভয় করে দারিদ্র্যের, যাতে তাদের মৃত্যুর পর সন্তান অভাব-অনটনে কষ্ট না পায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য আখিরাতের মুক্তির চিন্তা করতেন। উম্মত যাতে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পেয়ে চিরসুখের জান্নাত পেয়ে যায়, সেটাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। এর জন্য দরকার দীন ও ঈমানের হেফাজত। বেশি বিত্তবৈভব দীন ও ঈমানের জন্য বিপজ্জনক। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى
বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করছে। কেননা সে নিজেকে ঐশ্বর্যশালী মনে করে।
তো ঐশ্বর্যশালী হয়ে গেলে মানুষ যেহেতু প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সতর্ক করেছেন যে, আমি তোমাদের জন্য দারিদ্রের নয়; বরং দুনিয়ার প্রাচুর্যেরই ভয় করি। হাদীছের পরবর্তী অংশে তিনি এ ভয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে দেন যে
فتنافسوها كما تنافسوها فتهلككم كما أهلكتهم (ফলে তোমরা পরস্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হবে, যেমনটা তারা রেষারেষিতে লিপ্ত হয়েছিল। পরিণামে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল)। এটা পরীক্ষিত বিষয় যে, অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দিলে মানুষ পরস্পরে রেষারেষিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রত্যেকের চেষ্টা থাকে কিভাবে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবে। কেউ যখন দেখে অন্য কেউ তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়ে। সে বিদ্বেষ থেকে সৃষ্টি হয় শত্রুতা। তখন একে অন্যের ক্ষতি করতে চায়। যে-কোনও উপায়ে অন্যকে দাবিয়ে রেখে নিজে উপরে উঠতে চায়। এভাবে পরস্পরে শুরু হয়ে যায় মারামারি হানাহানি। মানুষের ইতিহাসে রক্তপাতের যত ঘটনা ঘটেছে, তার একটা বড় অংশই ঘটেছে অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতা থেকে। অতীতে বহু জাতি এই হানাহানিতে ধ্বংস হয়ে গেছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
اتقوا الشح، فإن الشح أهلك من كان قبلكم، حملهم على أن سفكوا دماءهم واستحلوا محارمهم
তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থাক, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে এবং তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছিল।
অতীতের উদাহরণ টেনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে সতর্ক করেন যে, অতীতে যেমন প্রাচুর্যের রেষারেষিতে দুনিয়ার বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার ভয় তোমরাও তেমনি রেষারেষিতে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রাচুর্য তো দেখা দেবে। কিন্তু সাবধান! তোমরা সে কারণে একে অন্যের প্রতি রেষারেষিতে লিপ্ত হয়ে যেয়ো না। বরং যার যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থেকো। দৃষ্টি রেখো আখিরাতের দিকে। সেখানে যাতে মুক্তিলাভ হয়, সর্বদা সেজন্য চিন্তিত ও সচেষ্ট থেকো।
উল্লেখ্য, এ হাদীছটিতে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর খুব বেশি দিন যায়নি। হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর আমলেই রোম, পারস্য ও মিশরের বিস্তীর্ণ এলাকা এ উম্মতের দখলে চলে আসে। এসব শক্তির ধনভাণ্ডার তাদের করতলগত হয়। হযরত উছমান রাযি.-এর আমলে এ উম্মত অভাবনীয় প্রাচুর্য লাভ করে। এমনও দেখা যায় যে, যাকাতদাতা কাকে যাকাত দেবে এরকম লোক খুঁজে পাচ্ছে না।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কবাণী এ উম্মতের প্রতিরক্ষার কাজ করেছে। প্রাচুর্যের সয়লাবে সামগ্রিকভাবে এ উম্মত ভেসে যায়নি। একটা অংশ সবসময়ই নির্মোহ চরিত্র ধরে রেখেছে। তারা নিজেরাও প্রাচুর্যের ক্ষতি হতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে এবং অন্যদেরকেও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, অভাব-অনটনকালে উম্মত যে চারিত্রিক ও নৈতিক মানদণ্ড রক্ষায় সক্ষম হয়েছিল, বিত্ত-বৈভব দেখা দেওয়ার পর তাদের বিপুল অংশ আর তা রক্ষা করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের যে অধঃপতন শুরু হয়, কালক্রমে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
আজকের অবস্থা তো ভয়াবহ। কোথায় সাহাবা তাবিঈনের সেই যুহদ ও সেই তাকওয়া-পরহেযগারী। আজ অর্থবিত্তের মোহ, প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা ও সেই প্রতিযোগিতা থেকে জন্ম নেওয়া হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানিতে এ উম্মত বিপর্যস্ত। এর থেকে মুক্তির জন্য উম্মতকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার দিকে ফিরে আসতে হবে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র সে শিক্ষার ব্যাপক চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. প্রিয়জন ও আগুন্তুকদের হাসিমুখে গ্রহণ করা ও মুখে আনন্দভাব ফুটিয়ে তোলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।
খ. সম্পদের প্রতি আকর্ষণ মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এ আকর্ষণ যাতে সীমালঙ্ঘনের কারণ না হয়, তাই অন্তরে সর্বদা আখিরাতের চিন্তা জাগরুক রাখা চাই।
গ. নিজের অধীন ও সম্পৃক্তজনরা যাতে অর্থ-সম্পদের মোহে না পড়ে যায়, মুরুব্বী ও গুরুজনদের কর্তব্য সেদিকে লক্ষ রাখা এবং সে বিষয়ে তাদেরকে সচেতন ও সতর্ক করা।
ঘ. কারও ধন-দৌলত অর্জিত হয়ে গেলে তার উচিত সে ধন-দৌলতের ফিতনা ও তার অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে সাবধান থাকা, যাতে তা তার অন্তরে বিদ্বেষ ও অহমিকা সৃষ্টি করতে না পারে।
ঙ. অন্যের ধন-দৌলত দেখে কিছুতেই তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও রেষারেষিতে লিপ্ত হতে নেই। নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা চাই।
বাহরাইন ইসলামী হুকুমতের অধীনে আসে হিজরী ৮ম সনে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলা ইবনুল হাযরামী রাযি.-কে সেখানকার শাসনকর্তা মুনযির ইবন ‘সাওয়ী'-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মারফত মুনযিরের কাছে ইসলামী দাওয়াতের একখানি পত্রও পাঠিয়েছিলেন। হযরত 'আলা রাযি. বাহরাইনে পৌঁছে পত্রখানি মুনযিরের হাতে তুলে দিলে তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার গোত্রের লোকজনও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তবে সেখানকার মাজুসী সম্প্রদায় ইসলামগ্রহণে রাজি হয়নি। তারা জিযিয়া আদায়ের শর্তে হযরত 'আলা রাযি.-এর সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করে। জিযিয়া ধার্য করা হয়েছিল মাথাপিছু এক দীনার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনায়নের যুদ্ধের পর হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.-কে জিযিয়ার অর্থ নিয়ে আসার জন্য বাহরাইন পাঠান। তিনি জিযিয়ার অর্থ নিয়ে যথাসময়ে মদীনা মুনাউওয়ারায় ফিরে আসেন। তার পরিমাণ ছিল এক লক্ষ দিরহাম। হযরত আবূ উবায়দা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা হাজির করলে তিনি মসজিদের এক কোণে তা রেখে দিতে বলেন। সেখানে তা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই চারদিকে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, হযরত আবূ উবায়দা রাযি, বাহরাইন থেকে বিপুল অর্থকড়ি নিয়ে এসেছেন। বর্ণনাকারী বলেন
فسمعت الأنصار بقدوم أبي عبيدة، فوافوا صلاة الفجر مع رسول الله ﷺ (আনসারগণ আবূ উবায়দার আগমনের কথা শুনতে পেলেন। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফজরের নামাযে মিলিত হলেন)। সাধারণত পাঁচ ওয়াক্তের নামাযে এত মুসল্লী হতো না। কারণ প্রত্যেক এলাকায় আলাদা আলাদা মসজিদ ছিল। মুসল্লীগণ আপন আপন মহল্লার মসজিদেই নামায আদায় করত। কেবল জুমু'আর দিনেই জুমু'আর নামায আদায়ের জন্য সকলে মসজিদে নববীতে চলে আসত। ফজরের নামায আদায়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন আনসারগণ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাদের দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঁচ করতে পারলেন হয়তো তারা আবূ উবায়দার আগমন-সংবাদ শুনতে পেয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন
فتبسم رسول اللہ ﷺ حين رآهم، ثم قال: «أظنكم سمعتم أن أبا عبيدة قدم بشيء من البحرين؟ (তাদেরকে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে দিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় তোমরা শুনতে পেয়েছ আবূ উবায়দা বাহরাইন থেকে কিছু নিয়ে এসেছে)। কেন তিনি হেসেছিলেন? সম্ভবত এতসংখ্যক সাহাবীকে একসঙ্গে দেখতে পাওয়ার খুশিতে। এমনিতেও তিনি যে-কোনও আগুন্তুককে মুচকি হাসির সঙ্গেই গ্রহণ করতেন। কোনও সাহাবী এসে দেখা করলে চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস লক্ষ করা যেত।
তাঁর হাসির কারণ এরকমও হতে পারে যে, তিনি হয়তো অনুভব করছিলেন কিভাবেই না অর্থের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যায়। তিনি তাদের অন্তরে দুনিয়াবিমুখতার চেতনা সঞ্চার করে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ত্যাগের মানসিকতা প্রবল। সবসময়ই নিজের উপর অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ান। আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে চূড়ান্ত পর্যায়ের দুনিয়াবিমুখ। তিনি তাদের মধ্যে সশরীরে হাজির রয়েছেন। এতদ্সত্ত্বেও কিভাবে অর্থকড়ির সংবাদ শুনে তারা হাজির হয়ে পড়েছেন।
বলাবাহুল্য, আনসারদের অন্তরে অর্থের মোহ ছিল না। তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিতান্তই গরীব। কাজেই তাদের এ আগমন লোভের কারণে নয়; বরং ছিল প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লক্ষ্য তো তাদেরকে চূড়ান্ত পর্যায়ের ত্যাগ ও নির্মোহ মানসিকতার আদর্শরূপে গড়ে তোলা এবং তাদের অন্তরে দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের হীনতা ও তুচ্ছতার বোধ বদ্ধমূল করে দেওয়া। তাই তিনি হযরত আবূ উবায়দা রাযি.-এর নিয়ে আসা অর্থকে شيء শব্দে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কিছু বা সামান্য কিছু। তাঁর দৃষ্টিতে লক্ষ দিরহামও সামান্য কিছুই বটে। আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের জন্য আখিরাতে যা প্রস্তুত রেখেছেন তার বিপরীতে লক্ষ দিরহাম কী, সমগ্র দুনিয়াও অতি সামান্যই। বিভিন্ন হাদীছে তিনি এ কথা স্পষ্ট করেছেন।
সাহাবীগণও ছিলেন বড় সরল, অকপট। তারা বললেন- أجل يا رسول الله (হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণা সত্য বলে তারা স্বীকার করলেন। শুধু أجل (হাঁ) না বলে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ' বলে সম্বোধনও করেছেন। এটাই আদব। বড় ও সম্মানিত ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে কেবল 'হাঁ' বা 'না' না বলে সম্মানসূচক সম্বোধনও করা চাই। প্রিয় ব্যক্তিকে সম্বোধন করার মধ্যে একরকম আস্বাদও নিহিত থাকে। ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ' সম্বোধনের মধ্যে যে আনন্দ ও আস্বাদ রয়েছে, তার কি কোনও তুলনা আছে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তারা যে উদ্দেশ্যে এসেছেন তা পূরণ হবে বলে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, তোমরা সুসংবাদ নাও এবং যা তোমাদের আনন্দিত করবে তার আশা কর। তারপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর আনীত দীনের রূহানী সবক দিলেন। তাদেরকে দিলেন যুহদের শিক্ষা। একজন মুমিনের জন্য দারিদ্র্য নয়; বরং ধনই যে বেশি বিপজ্জনক সে ব্যাপারে তাদের হুঁশিয়ার করলেন। তিনি বললেন
فوالله ما الفقر أخشى عليكم، ولكني أخشى أن تبسط الدنيا عليكم كما بسطت على من كان قبلكم (আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের প্রতি দুনিয়া প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমনটা প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি)। ওহী দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হয়েছিল যে, অচিরেই তাঁর উম্মত দুনিয়ার দিকে দিকে জয়লাভ করবে। তাতে করে বড় বড় রাজা-বাদশার ধনভাণ্ডার তাদের দখলে চলে আসবে আর এভাবে তাদের বর্তমান দারিদ্র্য দূর হয়ে যাবে, তারা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাবে। তিনি জানতেন মানুষের দীন ও ঈমানের জন্য ধন-সম্পদ যতবেশি ক্ষতিকর, অভাব-অনটন ততটা ক্ষতিকর নয়। অন্যদিকে সন্তানের প্রতি পিতার যে মায়া-মমতা, উম্মতের প্রতি তাঁর মায়া-মমতা ছিল তারচে'ও বেশি। পিতা-মাতা তো সন্তানের দুনিয়ার দিকটাই দেখে। অর্থ-সম্পদ থাকলে দুনিয়ায় আরাম-আয়েশে থাকা যায়। অভাব-অনটনে নানা কষ্ট পেতে হয়। তাই পিতা-মাতা সন্তানের ক্ষেত্রে ভয় করে দারিদ্র্যের, যাতে তাদের মৃত্যুর পর সন্তান অভাব-অনটনে কষ্ট না পায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য আখিরাতের মুক্তির চিন্তা করতেন। উম্মত যাতে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পেয়ে চিরসুখের জান্নাত পেয়ে যায়, সেটাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। এর জন্য দরকার দীন ও ঈমানের হেফাজত। বেশি বিত্তবৈভব দীন ও ঈমানের জন্য বিপজ্জনক। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বলেন
إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى
বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করছে। কেননা সে নিজেকে ঐশ্বর্যশালী মনে করে।
তো ঐশ্বর্যশালী হয়ে গেলে মানুষ যেহেতু প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সতর্ক করেছেন যে, আমি তোমাদের জন্য দারিদ্রের নয়; বরং দুনিয়ার প্রাচুর্যেরই ভয় করি। হাদীছের পরবর্তী অংশে তিনি এ ভয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে দেন যে
فتنافسوها كما تنافسوها فتهلككم كما أهلكتهم (ফলে তোমরা পরস্পর রেষারেষিতে লিপ্ত হবে, যেমনটা তারা রেষারেষিতে লিপ্ত হয়েছিল। পরিণামে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেমন তাদের ধ্বংস করেছিল)। এটা পরীক্ষিত বিষয় যে, অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দিলে মানুষ পরস্পরে রেষারেষিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রত্যেকের চেষ্টা থাকে কিভাবে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবে। কেউ যখন দেখে অন্য কেউ তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়ে। সে বিদ্বেষ থেকে সৃষ্টি হয় শত্রুতা। তখন একে অন্যের ক্ষতি করতে চায়। যে-কোনও উপায়ে অন্যকে দাবিয়ে রেখে নিজে উপরে উঠতে চায়। এভাবে পরস্পরে শুরু হয়ে যায় মারামারি হানাহানি। মানুষের ইতিহাসে রক্তপাতের যত ঘটনা ঘটেছে, তার একটা বড় অংশই ঘটেছে অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতা থেকে। অতীতে বহু জাতি এই হানাহানিতে ধ্বংস হয়ে গেছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
اتقوا الشح، فإن الشح أهلك من كان قبلكم، حملهم على أن سفكوا دماءهم واستحلوا محارمهم
তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থাক, কেননা লোভ-লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে এবং তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছিল।
অতীতের উদাহরণ টেনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে সতর্ক করেন যে, অতীতে যেমন প্রাচুর্যের রেষারেষিতে দুনিয়ার বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার ভয় তোমরাও তেমনি রেষারেষিতে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রাচুর্য তো দেখা দেবে। কিন্তু সাবধান! তোমরা সে কারণে একে অন্যের প্রতি রেষারেষিতে লিপ্ত হয়ে যেয়ো না। বরং যার যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থেকো। দৃষ্টি রেখো আখিরাতের দিকে। সেখানে যাতে মুক্তিলাভ হয়, সর্বদা সেজন্য চিন্তিত ও সচেষ্ট থেকো।
উল্লেখ্য, এ হাদীছটিতে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর খুব বেশি দিন যায়নি। হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর আমলেই রোম, পারস্য ও মিশরের বিস্তীর্ণ এলাকা এ উম্মতের দখলে চলে আসে। এসব শক্তির ধনভাণ্ডার তাদের করতলগত হয়। হযরত উছমান রাযি.-এর আমলে এ উম্মত অভাবনীয় প্রাচুর্য লাভ করে। এমনও দেখা যায় যে, যাকাতদাতা কাকে যাকাত দেবে এরকম লোক খুঁজে পাচ্ছে না।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কবাণী এ উম্মতের প্রতিরক্ষার কাজ করেছে। প্রাচুর্যের সয়লাবে সামগ্রিকভাবে এ উম্মত ভেসে যায়নি। একটা অংশ সবসময়ই নির্মোহ চরিত্র ধরে রেখেছে। তারা নিজেরাও প্রাচুর্যের ক্ষতি হতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে এবং অন্যদেরকেও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, অভাব-অনটনকালে উম্মত যে চারিত্রিক ও নৈতিক মানদণ্ড রক্ষায় সক্ষম হয়েছিল, বিত্ত-বৈভব দেখা দেওয়ার পর তাদের বিপুল অংশ আর তা রক্ষা করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের যে অধঃপতন শুরু হয়, কালক্রমে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
আজকের অবস্থা তো ভয়াবহ। কোথায় সাহাবা তাবিঈনের সেই যুহদ ও সেই তাকওয়া-পরহেযগারী। আজ অর্থবিত্তের মোহ, প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা ও সেই প্রতিযোগিতা থেকে জন্ম নেওয়া হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানিতে এ উম্মত বিপর্যস্ত। এর থেকে মুক্তির জন্য উম্মতকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার দিকে ফিরে আসতে হবে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র সে শিক্ষার ব্যাপক চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. প্রিয়জন ও আগুন্তুকদের হাসিমুখে গ্রহণ করা ও মুখে আনন্দভাব ফুটিয়ে তোলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।
খ. সম্পদের প্রতি আকর্ষণ মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এ আকর্ষণ যাতে সীমালঙ্ঘনের কারণ না হয়, তাই অন্তরে সর্বদা আখিরাতের চিন্তা জাগরুক রাখা চাই।
গ. নিজের অধীন ও সম্পৃক্তজনরা যাতে অর্থ-সম্পদের মোহে না পড়ে যায়, মুরুব্বী ও গুরুজনদের কর্তব্য সেদিকে লক্ষ রাখা এবং সে বিষয়ে তাদেরকে সচেতন ও সতর্ক করা।
ঘ. কারও ধন-দৌলত অর্জিত হয়ে গেলে তার উচিত সে ধন-দৌলতের ফিতনা ও তার অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে সাবধান থাকা, যাতে তা তার অন্তরে বিদ্বেষ ও অহমিকা সৃষ্টি করতে না পারে।
ঙ. অন্যের ধন-দৌলত দেখে কিছুতেই তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও রেষারেষিতে লিপ্ত হতে নেই। নিজের যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
