রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৪৩
আল্লাহর ভয় ও আশার সমন্বয়

اعْلَمْ أَنَّ المُخْتَارَ لِلْعَبْدِ في حَالِ صِحَّتِهِ أَنْ يَكُونَ خَائفًا رَاجِيًا، وَيَكُونَ خَوْفُهُ وَرَجَاؤُهُ سَواءً، وفي حَالِ المَرَضِ يُمحَّضُ الرَّجاءُ، وقواعِدُ الشَّرْع مِنْ نصُوصِ الكِتَابِ والسُّنَةِ وغَيْرِ ذَلِكَ مُتظاهِرَةٌ عَلَى ذلك.
‘প্রকাশ থাকে যে, বান্দার জন্য সুস্থতাকালে উত্তম হল ভীত ও আশাবাদী থাকা, এবং তার ভয় ও আশার অবস্থা সমান থাকা। আর অসুস্থ অবস্থায় উত্তম কেবল আশাবাদী থাকা। এটাই শরীআতের মূলনীতি। এ সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহে সুস্পষ্ট বিস্তর নস (মূলপাঠ) রয়েছে।
বান্দার ঈমান ও আমলের হেফাজতের জন্য কর্তব্য অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখার পাশাপাশি তাঁর প্রতি আশাও বজায় রাখা। ভয়হীন আশা ও আশাবিহীন ভয় উভয়ই ক্ষতিকর। কেননা ভয়হীন আশা মানুষকে ধোঁকায় ফেলে দেয়। আর আশাবিহীন ভয় হতাশার সৃষ্টি করে ।
আল্লাহর প্রতি আশা রাখার অর্থ হল কারও দ্বারা কোনও ত্রুটি হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে খাঁটি মনে তাওবা করা আর এই আশা রাখা যে, আল্লাহ তাআলা নিজ দয়ায় তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেবেন। এমনিভাবে যেসব সৎকর্ম করা হবে, সেক্ষেত্রে এই আশা রাখা যে আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেবেন। অপরপক্ষে অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখার অর্থ হচ্ছে, না জানি ইবাদত-বন্দেগীর ভেতরে এমন কোনও ত্রুটি হয়ে গেছে, যে কারণে আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হওয়ার উপযুক্ত থাকেনি। এমনিভাবে যেসব পাপকর্ম হয়ে গেছে, তার তাওবাও যথাযথভাবে করা হয়নি। ফলে সে তাওবাও আল্লাহর কাছে কবুল হয়নি। একদিকে পাপের বোঝা, অন্যদিকে ইবাদত-বন্দেগী কবুলের উপযুক্ত না হওয়া- এ দু'টিই তো ধ্বংসের কারণ। না জানি আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম!
যার অন্তরে এরূপ আশা ও ভয় বিরাজ করবে, সেই ধ্বংস হতে বাঁচবে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে-
وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَه
"এবং তারা তাঁর রহমতের আশা করে ও তাঁর আযাবকে ভয় করে।"
এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুমূর্ষু যুবককে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যুবক বলেছিল, আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী আবার নিজ গুনাহেরও ভয় করি। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন-
«لا يجتمعان في قلب عبد في مثل هذا الموطن، إلا أعطاه الله ما يرجو، وآمنه مما يخاف»
'এরূপ অবস্থায় যে বান্দারই অন্তরে এ দুই গুণ বিরাজ করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে অবশ্যই দান করেন, যা সে আশা করে। আর তাকে নিরাপত্তা দেন ওই বিষয় হতে, যার সে ভয় করে।
কুরআন ও হাদীছের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশা ও ভয় পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানেই জান্নাতের নিআমতরাজির কথা বর্ণিত হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি জাহান্নামের কঠিন আযাবের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে আল্লাহর গযব ও ক্রোধের বর্ণনা এসেছে, সেখানে পাশাপাশি তাঁর রহমত ও দয়ার বিপুলতাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি মাগফিরাত ও ক্ষমার সুসংবাদও শোনানো হয়েছে। এটা কুরআন- সুন্নাহর ই'তিদাল ও ভারসাম্য। কুরআন-সুন্নাহ'র যাবতীয় শিক্ষার মধ্যেই এ ভারসাম্য বিদ্যমান ।
আযাবের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে গুনাহ থেকে বিরত রাখা। কিন্তু ভয় যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, অন্তরে আশার কোনও স্থান যদি না থাকে, তবে এরূপ ভয় নিরাশা সৃষ্টি করে। এর ফলে ভয়ের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। কেননা নিরাশ মন অন্যায়- অপরাধ থেকে বিরত না থেকে বরং তা করতে অধিকতর স্পর্ধিত হয়ে ওঠে। অনুরূপ অন্তরে যদি ভয় বিলকুল না থাকে; বরং সেখানে কেবল আশাবাদই বিরাজ করে, তবে সে অন্তর পাপাচার করতে দ্বিধাবোধ করে না এবং সে অন্তরে সৎকর্মেরও বিশেষ উৎসাহ থাকে না। এ কারণেই কুরআন-সুন্নাহ'র এ ভারসাম্য। অন্তরে আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাও রাখতে হবে এবং পাশাপাশি তাঁর আযাব ও গযবের ভয়ে ভীতও থাকতে হবে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এবার সেসব আয়াত ও হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।

*ভয় ও আশার সমন্বয় সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

{فلا يأمن مكر الله إلا القوم الخاسرون} [الأعراف: 99]
অর্থ : 'আল্লাহপ্রদত্ত অবকাশ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকে কেবল সেইসব লোক, যারা শেষপর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'

ব্যাখ্যা
ইহজগত পরীক্ষার স্থান। এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। গরীবকে অভাব-অনটন দ্বারা পরীক্ষা করেন, আর ধনীকে ধন-সম্পদ দিয়ে। অনেক সময় সম্পদশালী লোক নিজ ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অহংকারের শিকার হয়ে যায়। চিন্তা করে না যে, ধন-সম্পদ আল্লাহর দান এবং এ কারণে তাঁর শোকর আদায় করা উচিত। উল্টো অহমিকাবশত গরীবদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালায় ও নানারকম অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হয়। অহমিকার কারণে তারা দীন ও শরী'আত উপেক্ষা করে। এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে অবকাশ দেন। তাদেরকে চিন্তা- ভাবনা করার ও দীনের পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন। তারা যখন সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে উল্টো আরও বেশি অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের ধন-সম্পদ আরও বেশি বৃদ্ধি করে দেন এবং তাদেরকে পাপাচারের পথে আরও বেশি অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেন। এতবেশি পাপ সত্ত্বেও ধন-সম্পদের প্রবৃদ্ধি হতে দেখে তারা ধোঁকায় পড়ে যায়। মনে করে তারা সঠিক পথেই আছে। আল্লাহ তা'আলা যে যে-কোনও সময় তাদের পাকড়াও করতে পারেন, সে চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। দিনে-রাতে, ঘরে-বাইরে সর্বক্ষণ সব জায়গায় তারা নিজেদেরকে নিরাপদ বোধ করে।
তারা যখন নিজেদেরকে এভাবে নিরাপদ বোধ করতে থাকে এবং আল্লাহর শাস্তি হতে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থেকে পাপকর্ম চালিয়ে যায়, তখন হঠাৎ করেই আল্লাহ তা'আলা তাদের পাকড়াও করেন। তখন আর তাদের তাওবা-ইস্তিগফার করা ও নিজেদের সংশোধন করার কোনও সুযোগ থাকে না।
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সে ব্যাপারেই সতর্ক করছেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ দেওয়ার উদ্দেশ্য মানুষকে তাওবা-ইস্তিগফার করে সুপথে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া। সে সুযোগকে কাজে না লাগানো চরম বোকামি। এর ফলে যে ক্ষতি হয়, তার প্রতিকার করার কোনও সুযোগ থাকে না। কেননা এরূপ লোকের তাওবা-ইস্তিগফার করার সুযোগ হয় না। তারা আল্লাহ তা'আলার আকস্মিক পাকড়াওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। সুতরাং মুমিনের কাজ হবে সময় ও সুযোগকে কাজে লাগানো, অবকাশকে পরীক্ষার বিষয় মনে করা এবং বাহ্যিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ধোঁকায় না পড়া।

• দুই নং আয়াত

{إنه لا ييأس من روح الله إلا القوم الكافرون} [يوسف: 87]
অর্থ : 'আল্লাহর রহমত থেকে কেবল তারাই নিরাশ হয়, যারা কাফের।'

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার রহমত ও দয়া থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া কোনও মুমিনের পক্ষে শোভা পায় না। এটা শোভা পায় কেবল কাফেরদের পক্ষেই। কেননা তারা আল্লাহ তাআলার অনন্ত-অসীম রহমত ও কুদরত সম্পর্কে খবর রাখে না। তারা জানেনা যে, আল্লাহর ক্রোধের উপর তাঁর রহমতই প্রবল। তাই একটু বিপদ-আপদেই হতাশ হয়ে পড়ে। হতাশ হয়ে যায় মাগফিরাত লাভের ব্যাপারেও।
ভাবে, আমি এত বড় পাপী, আমাকে কি আর ক্ষমা করা হবে। এর দ্বারা মুমিনদের সতর্ক করা হচ্ছে, তারা যেন কোনও অবস্থায়ই হতাশ না হয়ে যায়। তাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলার রহমত থেকে হতাশ হওয়া কাফের-বেঈমানদের কাজ। কাজেই যত কঠিন বিপদই হোক, তারা যেন আল্লাহর উপর ভরসা রাখে। যত কঠিন পাপীই হোক, যেন মাগফিরাত ও ক্ষমার আশা রাখে এবং সেই আশায় তাওবা- ইস্তিগফার ও আত্মসংশোধনে লিপ্ত হয়ে যায়।

• তিন নং আয়াত
{يوم تبيض وجوه وتسود وجوه} [آل عمران: 106]
অর্থ: 'যেদিন কতক মুখ (ঈমান ও আনুগত্যের আলোয়) উজ্জ্বল হবে এবং কতক মুখ (কুফর ও পাপের কালিমায়) কালো হয়ে যাবে।

ব্যাখ্যা
এটি সূরা আলু ইমরানের ১০৬ নং আয়াতের প্রথম অংশ। এরপর ইরশাদ-
{فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ} [آل عمران: 106]
যাদের মুখ কালো হয়ে যাবে, (তাদেরকে বলা হবে,) তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফর অবলম্বন করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর, যেহেতু তোমরা কুফরী করতে।
যারা ঈমান আনার পর সত্যিই কাফের হয়ে যায় এবং ঈমান থেকে পুরোপুরি খারিজ হয়ে যায়, এ আয়াতের সতর্কবাণী তাদের জন্য তো স্পষ্টভাবেই প্রযোজ্য। তবে যারা ঈমান থেকে খারিজ হয়নি, তাদেরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা মুমিন- মুসলিমগণ যদি কোনও ক্ষেত্রে ঈমানের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়, যদি ইসলামের বিধি- বিধান পালনে সচেষ্ট না থেকে মানবরচিত আইনের অনুসরণ করে যায়, তবে তাও ইসলাম থেকে খানিকটা হলেও সরে যাওয়াই বটে। তারা সরাসরি কাফের না হলেও তাদের কাজকর্ম অনেকটা কাফেরসুলভ বৈকি। এ অবস্থায় আখিরাতে কাফেরদের মত না হলেও কোনও না কোনও পর্যায়ের শাস্তিভোগের ভয় রয়েছে। তাছাড়া এ পশ্চাদমুখিতা কোনও এক পর্যায়ে পুরোপুরি কুফরীতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে তো কাফেররূপে জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়।
তারপর মুমিনদের সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
{ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ } [آل عمران: 107]
'পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতের ভেতর স্থান পাবে এবং তারা তাতেই সর্বদা থাকবে।'
রহমতের ভেতর মানে জান্নাতের ভেতর। জান্নাতকে 'রহমত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে, জান্নাত আল্লাহ তা'আলার রহমতেই লাভ হবে। নেক আমলের উদ্দেশ্য সেই রহমতের অধিকারী হওয়া। আল্লাহ তা'আলার রহমতে একবার জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব হলে আর কখনও সেখান থেকে বহিষ্কৃত হতে হবে না। অনন্ত-অসীম কাল জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমতের ভেতর পরম সুখে জীবন কাটতে থাকবে।

• চার নং আয়াত
إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থ : 'নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুও বটে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ অনেক সময় আল্লাহ তা'আলা পাপী ব্যক্তিকে দুনিয়ায়ও তার পাপের শাস্তি দিয়ে থাকেন। অনেক বোঝানো সমঝানোর পরও যখন সে পাপকর্ম থেকে বিরত না হয়, তখন আল্লাহ তা'আলা নিজ হিকমত অনুযায়ী দুনিয়ায়ই তাকে শাস্তি দিয়ে দেন। এটিকেই 'দ্রুত শাস্তিদান' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। আবার পাপী ব্যক্তি যখন খাঁটিমনে তাওবা-ইস্তিগফার করে, তখন তিনি তাকে ক্ষমাও করে দেন। তাঁর ক্ষমাশীলতা ও দয়ামায়া অসীম অফুরন্ত । যত বড় পাপই হোক না কেন, আল্লাহ তা'আলার দিকে সত্যিকারভাবে রুজু হতে পারলে তিনি নিজ দয়ায় অবশ্যই তা ক্ষমা করে দেন।

• পাঁচ নং আয়াত

{إن الأبرار لفي نعيم وإن الفجار لفي جحيم} [الانفطار: 13 - 14]
অর্থ : 'নিশ্চয়ই নেককারগণ প্রভৃত নি'আমতের মধ্যে থাকবে এবং পাপিষ্ঠগণ অবশ্যই জাহান্নামে থাকবে।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ নেককারগণ অফুরন্ত নি'আমতের স্থান জান্নাতের মধ্যে থাকবে। তারা তাতে থাকবে অনন্তকাল। 'থাকবে' বলে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাদেরকে সেখান থেকে কখনও বের হতে হবে না। তাদের সুখ-শান্তিতে কখনও ছেদ ঘটবে না। অপরদিকে পাপীদের স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। কাফের-বেঈমানগণ অনন্তকাল সে শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। তারা কখনও সেখান থেকে বের হতে পারবে না।

• ছয় নং আয়াত
{فأما من ثقلت موازينه فهو في عيشة راضية وأما من خفت موازينه فأمه هاوية} [القارعة: 6 - 9] .
অর্থ : 'তখন যার পাল্লা ভারী হবে, সে তো সন্তোষজনক জীবনে থাকবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে এক গভীর গর্ত।

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আখিরাতে আমলের পরিমাপ করার জন্য দাঁড়িপাল্লা স্থাপিত হবে। তাতে বান্দার আমল মাপা হবে। যার আমলের ওজন বেশি হবে, সে মুক্তি পাবে।
আমলের ওজন হয় ঈমান ও ইখলাস দ্বারা। আমলের বাহ্যিক রূপ যতই সুন্দর হোক এবং আকার-আকৃতিতে তার পরিমাণ যত বড় ও বেশিই হোক, যদি ইখলাস না থাকে, তবে তার কোনও ওজনই থাকবে না। তাই আমল করা চাই কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, পার্থিব কোনও স্বার্থে নয়। ইখলাসপূর্ণ আমল অল্প হলেও তার ওজন হবে অনেক বেশি। এরূপ ওজনওয়ালা আমলের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে জান্নাতের এমন জীবন দান করবেন, যা পেয়ে সে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে যার আমলে ইখলাস থাকবে না তার আমল হবে হালকা। পরিমাণে যত বেশিই হোক না কেন, সেই হালকা আমল দ্বারা কেউ মুক্তিলাভ করতে পারবে না। এরূপ ব্যক্তির পরিণাম হবে জাহান্নাম। জাহান্নাম হল আগুনের গর্ত। যাদের আমলে ইখলাস থাকে না, তাদেরকে সে আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে এবং তারা তাতে অবর্ণনীয় আযাব ভোগ করতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন - আমীন।
আল্লাহর রহমত ও আযাবের অসীমতা
হাদীছ নং : ৪৪৩

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিন ব্যক্তি যদি জানত আল্লাহর কাছে কেমন শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তবে কেউ আর জান্নাত লাভের আশা করত না। অপরপক্ষে কাফের ব্যক্তি যদি জানত আল্লাহর কাছে কী পরিমাণ রহমত আছে, তবে কেউ তার জান্নাত থেকে নিরাশ হতো না- মুসলিম।
53 - باب الجمع بين الخوف والرجاء
اعْلَمْ أَنَّ المُخْتَارَ لِلْعَبْدِ في حَالِ صِحَّتِهِ أَنْ يَكُونَ خَائفًا رَاجِيًا، وَيَكُونَ خَوْفُهُ وَرَجَاؤُهُ سَواءً، وفي حَالِ المَرَضِ يُمحَّضُ الرَّجاءُ، وقواعِدُ الشَّرْع مِنْ نصُوصِ الكِتَابِ والسُّنَةِ وغَيْرِ ذَلِكَ مُتظاهِرَةٌ عَلَى ذلك.
قَالَ الله تَعَالَى: {فَلاَ يَأمَنُ مَكْرَ الله إِلاَّ القَوْمُ الخَاسِرونَ} [الأعراف: 99]، وقال تَعَالَى: {إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلاَّ القَوْمُ الكافِرُونَ} [يوسف: 87]، وقال تَعَالَى: {يَوْمَ تَبْيَضُّ وَجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ} [آل عمران: 106]، وقال تَعَالَى: {إنَّ رَبَكَ لَسَرِيعُ العِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ} [الأعراف: 167]، وقال تَعَالَى: {إنَّ الأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ وَإِنَّ الفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ} [الانفطار: 13 - 14]، وقال تَعَالَى: {فَأمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ وَأمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأمُّهُ هَاوِيَةٌ} [القارعة: 6 - 9] والآيات في هذا المعنى كثيرةٌ. فَيَجْتَمعُ الخَوفُ والرجاءُ في آيَتَيْنِ مُقْتَرِنَتَيْنِ أَو آيات أَو آية.
443 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤمِنُ مَا عِنْدَ الله مِنَ العُقُوبَةِ، مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ، وَلَوْ يَعْلَمُ الكَافِرُ مَا عِنْدَ الله مِنَ الرَّحْمَةِ، مَا قَنَطَ مِنْ جَنَّتِهِ أحَدٌ». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার ক্রোধ ও দয়ার গভীরতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার প্রতিটি গুণই অসীম অন্তহীন। তাঁর কোনও গুণ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভ করা কোনও মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর ক্রোধ ও দয়ার গুণও সেরকমই। যদি ধরে নেওয়া যায় কোনও মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার ক্রোধগুণ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভে সক্ষম হয়েছে, তবে সে ব্যক্তি তাঁর ক্রোধের যে বিভীষিকা দেখতে পাবে, তার বিপরীতে সে নিজে মুমিন হওয়া সত্ত্বেও কোনওকিছুর উপর বিন্দুমাত্র ভরসা রাখতে পারবে না। সে নিজ মুক্তিলাভের ব্যাপারে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়বে। জান্নাতলাভের কোনও আশাই তার অন্তরে থাকবে না। অনুরূপ আল্লাহ তা'আলার রহমতও এত বিপুল ও বিস্তৃত যে, কোনও ব্যক্তির সে সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকলে কাফের হওয়া সত্ত্বেও সে আশাবাদী থাকবে। কঠিন কঠিন পাপ করা সত্ত্বেও সে রহমত থেকে নিরাশ হবে না। তার মনে আশা থাকবে যে, এত বিপুল রহমত থেকে সে কিছুতেই বঞ্চিত হতে পারে না। নিশ্চয়ই সে তাঁর রহমত পেয়ে মুক্তিলাভে সক্ষম হবে। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعًا وَتِسْعِيْنَ رَحْمَةً، وَأَرْسَلْ فِي خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً، فَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ بِكُلِّ الَّذِي عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الرَّحْمَةِ يئس مِنَ الْجَنَّةِ، وَلَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ بِكُلِّ الَّذِي عِندَ اللهِ مِنَ الْعَذَابِ لَمْ يَأْمَنْ مِنَ النَّارِ.
"আল্লাহ তা'আলা যেদিন তাঁর রহমতগুণের প্রকাশ করেন, সেদিন তিনি একে একশ' ভাগে ভাগ করেন। নিজের কাছে রেখে দেন নিরানব্বই ভাগ রহমত এবং সমস্ত মাখলুকের কাছে পাঠান একভাগ রহমত। কোনও কাফের যদি আল্লাহর কাছে রেখে দেওয়া রহমতের সবটা সম্পর্কে জানত, তবে সে জান্নাত পাওয়ার ব্যাপারে হতাশ হতো না। আর কোনও মুমিন যদি আল্লাহর কাছে থাকা আযাবের সবটা জানত, তবে সে জাহান্নাম থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করত না।

প্রকাশ থাকে যে, এ জাতীয় হাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ভয় ও আশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় উৎসাহ দেওয়া। ভয়বিহীন আশা ও আশাবিহীন ভয় কোনওটিই কল্যাণকর নয়। তাই যখন আল্লাহ তা'আলার রহমতের প্রতি লক্ষ করা হবে, তখন একান্তভাবে তাতেই বিভোর না থেকে তাঁর আযাব ও গযবের প্রতিও দৃষ্টিপাত করা চাই। এমনিভাবে যখন আল্লাহ তা'আলার আযাব ও গযবের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে, তখন কেবল তাতেই নিমগ্ন না থেকে তাঁর রহমতের প্রতিও লক্ষ করা চাই। এতে অন্তরে ভারসাম্য পয়দা হবে। না অতি আশার কারণে পাপ-প্রবণতা উস্কানি পাবে, আর না মাত্রাতিরিক্ত ভীতির কারণে অন্তরে হতাশা জন্ম নেবে। অতি আশা ও অতি ভয়ের কারণে ভালো-মন্দের বিচার-বুদ্ধি ঘুচে যায় আর তাতে জীবনাচার সম্পূর্ণ বেলাগাম হয়ে পড়ে। এ কারণেই হাদীছে আল্লাহর শাস্তি ও ক্রোধের পাশাপাশি তাঁর রহমতের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে-
عِبَادِى اني أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيْمُ
'আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দাও, নিশ্চয় আমিই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। এবং এটাও জানিয়ে দাও যে, আমার শাস্তিই অতি মৰ্মস্তুদ শাস্তি।
অপর এক আয়াতে মুমিনদের বিশেষত্ব বলা হয়েছে-
وَيَرْجُوْنَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ
এবং তারা তাঁর রহমতের আশা করে ও তাঁর আযাবকে ভয় করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও অবস্থায়ই আল্লাহ তা'আলার রহমত থেকে হতাশ হতে নেই। তাঁর রহমত অসীম।

খ. আল্লাহর আযাব সুকঠিন। নিজ আমলের ভরসায় কখনওই তাঁর আযাব হতে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়া উচিত নয়।

গ. নেক আমলে যত্নবান থেকে আল্লাহর রহমতের আশা রাখার পাশাপাশি তাঁর আযাব সম্পর্কে ভীত থাকাই হচ্ছে ভারসাম্যমাণ পন্থা। এটাই কল্যাণকর।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৪৪৩ | মুসলিম বাংলা