রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৪৪০
আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত
মানুষ এ নশ্বর জগতের তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ের জন্যও আশাবাদী থাকে। আশা করে উচ্চশিক্ষার, ভালো চাকরির, ভালো বাড়ি, দামি গাড়ির, ক্ষমতা, সুনাম-সুখ্যাতির এবং আরও অনেক কিছুর। আবার মানুষ কোনওকিছু অর্জনের আশায় থাকলে সেজন্য চেষ্টা-মেহনতও করে। যে বস্তু তার কাছে যতো গুরুত্বপূর্ণ, তা অর্জনের জন্য ততো বেশি চেষ্টা করে। যে ব্যক্তি ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশা রাখে, সে দিনমান ব্যবসার পেছনে খাটে। যে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেতে চায়, সে পড়াশোনার পেছনে দিনরাত একাকার করে দেয়। যে রাজনীতিক ক্ষমতার মসনদে পৌঁছাতে চায়, সে তার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে। এ সবই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার অতি অল্পস্থায়ী ভোগ-উপভোগের বস্তু। এর জন্যও মানুষের এত চেষ্টা-সাধনা! আশাই মানুষকে দিয়ে সে চেষ্টা করিয়ে নেয়।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার চেয়ে মূল্যবান কোনও সম্পদ নেই। এরচে' বড় কাম্যবস্তু আর কিছু হতে পারে না। তুচ্ছ, নশ্বর বস্তুর আকাঙ্ক্ষায় যখন মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকে, তখন যা সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি, সর্বাপেক্ষা বেশি দামি, সর্বাপেক্ষা বেশি উপকারী, সেইসঙ্গে স্থায়ী ও অবিনশ্বরও, তার জন্য তো সর্বাপেক্ষা বেশিই আশা লালন করা উচিত এবং সে লক্ষ্যে উচিত সর্বাপেক্ষা বেশি চেষ্টা-মেহনত করা। তা যাতে আমরা করি, সেজন্য কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত ও মাহাত্ম্য বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত সম্পর্কিত একটি আয়াত
{وأفوض أمري إلى الله إن الله بصير بالعباد * فوقاه الله سيئات ما مكروا} [غافر: 44، 45]
অর্থ : আমি আমার বিষয় আল্লাহর উপরই ন্যস্ত করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা। অতঃপর তারা যেসব নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করেছিল, আল্লাহ তাকে (সেই মুমিন ব্যক্তিকে) তা হতে রক্ষা করলেন।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতদু'টি সূরা মু'মিনের। সূরাটির অপর নাম সূরা গাফির। মু'মিন অর্থ বিশ্বাসী। ফির'আউনের সম্প্রদায় অর্থাৎ মিশরের কিবতী জনগোষ্ঠীর এক ব্যক্তি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তিনি তার জাতিকেও মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি তাদের দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেছিলেন, কুরআন মাজীদের এ সূরায় তা উদ্ধৃত হয়েছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেই এ সূরাটির নাম রাখা হয়েছে 'সূরা মুমিন'। তার ভাষণের শেষকথা ছিল-
{ فَسَتَذْكُرُونَ مَا أَقُولُ لَكُمْ وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ} [غافر: 44]
আমি তোমাদেরকে যা বলছি তোমরা অচিরেই তা স্মরণ করবে। আমি আমার বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা - সূরা মুমিন :
অর্থাৎ কিয়ামতে যখন তোমরা ইহজীবনের অন্যায়-অবিচারের শাস্তি দেখতে পাবে, যখন এ জীবনের পরিপূর্ণ কর্মফল তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে, তখন তোমরা আমার এ উপদেশ-নসীহতের মূল্য বুঝতে পারবে। তখন তোমরা ঠিকই আমার কথা স্মরণ করবে যে, আল্লাহর এক বান্দা আমাদেরকে এ দিন সম্পর্কে সতর্ক করেছিল এবং আমাদেরকে নবী মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিল। আমরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিলে আজ আমাদেরকে এ মহা দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হতোনা। কিন্তু সেদিনকার বুঝে আসার কোনও ফায়দা থাকবে না। সেদিন হাজার অনুতাপ করলেও তোমরা শাস্তি হতে রক্ষা পাবে না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমার যা উপদেশ দেওয়ার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি। এখন মানা না মানা তোমাদের ব্যাপার। এখন আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত করছি। আমার সবকিছু তাঁরই হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি। আমার এ উপদেশের প্রতিক্রিয়ায় তোমরা যদি আমার কোনও ক্ষতি করতে চাও, আমি তার পরওয়া করিনা। আল্লাহ তা'আলাই আমার সাহায্যকারী। কে কী করছে না করছে সবই তিনি দেখছেন। সকলেই তাঁর দৃষ্টির সামনে। কারও কোনওকিছু তাঁর কাছে গোপন থাকে না। তিনি আমাকেও দেখছেন, তোমাদেরও দেখছেন। প্রত্যেককে তার কর্ম অনুসারে প্রতিফল দিয়ে থাকেন। তারপর কী হল, পরের আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
{فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ } [غافر: 45]
"অতঃপর তারা যেসব নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করেছিল, আল্লাহ তাকে (সেই মুমিন ব্যক্তিকে) তা হতে রক্ষা করলেন আর ফিরআউনের সম্প্রদায়কে পরিবেষ্টন করল নিকৃষ্টতম শাস্তি।
ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সকল অনুসারীকে গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তি দিতে চেয়েছিল। উল্লিখিত মুমিন ব্যক্তিও তাদের একজন। আল্লাহ তা'আলা তাদের সে চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। তিনি তাদের হাত থেকে মুমিন ব্যক্তিকেও রক্ষা করেন এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর অপরাপর অনুসারীদেরও। তাদেরকে অলৌকিকভাবে লোহিত সাগর পার করিয়ে দেন। অপরদিকে ফিরআউনকে তার সৈন্যদলসহ সাগরে ডুবিয়ে নিপাত করেন।
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে আশাবাদী ছিলেন। তিনি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখেছিলেন। নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। তার নগদ সুফল এই পেলেন যে, শত্রুর হাত থেকে তিনি পরিপূর্ণরূপে রক্ষা পেয়ে গেলেন আর সেইসঙ্গে আখিরাতের যে স্থায়ী পুরস্কার সংরক্ষিত আছে তা তো পাবেনই। মুমিনদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে যে, তারা যদি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ন্যায়ের উপর অটল-অবিচল থাকে, তবে বিরুদ্ধবাদীগণ তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তা'আলাই তাদের সাহায্য করবেন। এটা আলাদা কথা যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে কিভাবে সাহায্য করবেন এবং কখন সাহায্য করবেন তা তিনিই জানেন। তিনি নিজ হিকমত অনুযায়ী তা করে থাকেন। অনেক সময় আমরা তা বুঝতে পারি না। তা বুঝি বা না-ই বুঝি, আমাদের কাজ সত্য-ন্যায়ের উপর অবিচল থাকা, আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা রাখা, তাঁর কাছে আশাবাদী থাকা এবং তাঁর ফয়সালায় রাজি-খুশি থাকা।
মানুষ এ নশ্বর জগতের তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ের জন্যও আশাবাদী থাকে। আশা করে উচ্চশিক্ষার, ভালো চাকরির, ভালো বাড়ি, দামি গাড়ির, ক্ষমতা, সুনাম-সুখ্যাতির এবং আরও অনেক কিছুর। আবার মানুষ কোনওকিছু অর্জনের আশায় থাকলে সেজন্য চেষ্টা-মেহনতও করে। যে বস্তু তার কাছে যতো গুরুত্বপূর্ণ, তা অর্জনের জন্য ততো বেশি চেষ্টা করে। যে ব্যক্তি ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশা রাখে, সে দিনমান ব্যবসার পেছনে খাটে। যে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেতে চায়, সে পড়াশোনার পেছনে দিনরাত একাকার করে দেয়। যে রাজনীতিক ক্ষমতার মসনদে পৌঁছাতে চায়, সে তার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে। এ সবই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার অতি অল্পস্থায়ী ভোগ-উপভোগের বস্তু। এর জন্যও মানুষের এত চেষ্টা-সাধনা! আশাই মানুষকে দিয়ে সে চেষ্টা করিয়ে নেয়।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার চেয়ে মূল্যবান কোনও সম্পদ নেই। এরচে' বড় কাম্যবস্তু আর কিছু হতে পারে না। তুচ্ছ, নশ্বর বস্তুর আকাঙ্ক্ষায় যখন মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকে, তখন যা সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি, সর্বাপেক্ষা বেশি দামি, সর্বাপেক্ষা বেশি উপকারী, সেইসঙ্গে স্থায়ী ও অবিনশ্বরও, তার জন্য তো সর্বাপেক্ষা বেশিই আশা লালন করা উচিত এবং সে লক্ষ্যে উচিত সর্বাপেক্ষা বেশি চেষ্টা-মেহনত করা। তা যাতে আমরা করি, সেজন্য কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত ও মাহাত্ম্য বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আল্লাহর কাছে আশাবাদী থাকার ফযীলত সম্পর্কিত একটি আয়াত
{وأفوض أمري إلى الله إن الله بصير بالعباد * فوقاه الله سيئات ما مكروا} [غافر: 44، 45]
অর্থ : আমি আমার বিষয় আল্লাহর উপরই ন্যস্ত করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা। অতঃপর তারা যেসব নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করেছিল, আল্লাহ তাকে (সেই মুমিন ব্যক্তিকে) তা হতে রক্ষা করলেন।
ব্যাখ্যা
এ আয়াতদু'টি সূরা মু'মিনের। সূরাটির অপর নাম সূরা গাফির। মু'মিন অর্থ বিশ্বাসী। ফির'আউনের সম্প্রদায় অর্থাৎ মিশরের কিবতী জনগোষ্ঠীর এক ব্যক্তি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তিনি তার জাতিকেও মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি তাদের দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেছিলেন, কুরআন মাজীদের এ সূরায় তা উদ্ধৃত হয়েছে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেই এ সূরাটির নাম রাখা হয়েছে 'সূরা মুমিন'। তার ভাষণের শেষকথা ছিল-
{ فَسَتَذْكُرُونَ مَا أَقُولُ لَكُمْ وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ} [غافر: 44]
আমি তোমাদেরকে যা বলছি তোমরা অচিরেই তা স্মরণ করবে। আমি আমার বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা - সূরা মুমিন :
অর্থাৎ কিয়ামতে যখন তোমরা ইহজীবনের অন্যায়-অবিচারের শাস্তি দেখতে পাবে, যখন এ জীবনের পরিপূর্ণ কর্মফল তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে, তখন তোমরা আমার এ উপদেশ-নসীহতের মূল্য বুঝতে পারবে। তখন তোমরা ঠিকই আমার কথা স্মরণ করবে যে, আল্লাহর এক বান্দা আমাদেরকে এ দিন সম্পর্কে সতর্ক করেছিল এবং আমাদেরকে নবী মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিল। আমরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিলে আজ আমাদেরকে এ মহা দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হতোনা। কিন্তু সেদিনকার বুঝে আসার কোনও ফায়দা থাকবে না। সেদিন হাজার অনুতাপ করলেও তোমরা শাস্তি হতে রক্ষা পাবে না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমার যা উপদেশ দেওয়ার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি। এখন মানা না মানা তোমাদের ব্যাপার। এখন আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত করছি। আমার সবকিছু তাঁরই হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি। আমার এ উপদেশের প্রতিক্রিয়ায় তোমরা যদি আমার কোনও ক্ষতি করতে চাও, আমি তার পরওয়া করিনা। আল্লাহ তা'আলাই আমার সাহায্যকারী। কে কী করছে না করছে সবই তিনি দেখছেন। সকলেই তাঁর দৃষ্টির সামনে। কারও কোনওকিছু তাঁর কাছে গোপন থাকে না। তিনি আমাকেও দেখছেন, তোমাদেরও দেখছেন। প্রত্যেককে তার কর্ম অনুসারে প্রতিফল দিয়ে থাকেন। তারপর কী হল, পরের আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
{فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ } [غافر: 45]
"অতঃপর তারা যেসব নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র করেছিল, আল্লাহ তাকে (সেই মুমিন ব্যক্তিকে) তা হতে রক্ষা করলেন আর ফিরআউনের সম্প্রদায়কে পরিবেষ্টন করল নিকৃষ্টতম শাস্তি।
ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সকল অনুসারীকে গ্রেপ্তার করে কঠিন শাস্তি দিতে চেয়েছিল। উল্লিখিত মুমিন ব্যক্তিও তাদের একজন। আল্লাহ তা'আলা তাদের সে চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। তিনি তাদের হাত থেকে মুমিন ব্যক্তিকেও রক্ষা করেন এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর অপরাপর অনুসারীদেরও। তাদেরকে অলৌকিকভাবে লোহিত সাগর পার করিয়ে দেন। অপরদিকে ফিরআউনকে তার সৈন্যদলসহ সাগরে ডুবিয়ে নিপাত করেন।
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে আশাবাদী ছিলেন। তিনি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখেছিলেন। নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। তার নগদ সুফল এই পেলেন যে, শত্রুর হাত থেকে তিনি পরিপূর্ণরূপে রক্ষা পেয়ে গেলেন আর সেইসঙ্গে আখিরাতের যে স্থায়ী পুরস্কার সংরক্ষিত আছে তা তো পাবেনই। মুমিনদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে যে, তারা যদি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ন্যায়ের উপর অটল-অবিচল থাকে, তবে বিরুদ্ধবাদীগণ তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তা'আলাই তাদের সাহায্য করবেন। এটা আলাদা কথা যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে কিভাবে সাহায্য করবেন এবং কখন সাহায্য করবেন তা তিনিই জানেন। তিনি নিজ হিকমত অনুযায়ী তা করে থাকেন। অনেক সময় আমরা তা বুঝতে পারি না। তা বুঝি বা না-ই বুঝি, আমাদের কাজ সত্য-ন্যায়ের উপর অবিচল থাকা, আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা রাখা, তাঁর কাছে আশাবাদী থাকা এবং তাঁর ফয়সালায় রাজি-খুশি থাকা।
আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা, আল্লাহর যিকির, তাওবা ও সৎকর্মের গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৪৪০
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণার সঙ্গে থাকি। সে আমাকে যেখানেই স্মরণ করে, সেখানেই আমি তার সঙ্গে থাকি। আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ তরুলতাহীন প্রান্তরে তার হারিয়ে যাওয়া পশুটি ফিরে পেয়ে যেমন খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তারচে'ও বেশি খুশি হন। যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ আমার নিকটবর্তী হবে, আমি একহাত পরিমাণ তার নিকটবর্তী হব। যে ব্যক্তি একহাত পরিমাণ আমার নিকটবর্তী হবে, আমি দুই হাতের বিস্তার পরিমাণ তার নিকটবর্তী হব। যে ব্যক্তি আমার দিকে আসবে হেঁটে হেঁটে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসব - বুখারী ও মুসলিম
এ হাদীছটি সহীহ মুসলিমে একাধিক রেওয়ায়েতে এসেছে। এখানে তার একটি রেওয়ায়েতের শব্দমালা উদ্ধৃত হল। এর (অংশ বিশেষের) ব্যাখ্যা পেছনের অধ্যায়ে গত হয়েছে।
হাদীছ নং: ৪৪০
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণার সঙ্গে থাকি। সে আমাকে যেখানেই স্মরণ করে, সেখানেই আমি তার সঙ্গে থাকি। আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ তরুলতাহীন প্রান্তরে তার হারিয়ে যাওয়া পশুটি ফিরে পেয়ে যেমন খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তারচে'ও বেশি খুশি হন। যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ আমার নিকটবর্তী হবে, আমি একহাত পরিমাণ তার নিকটবর্তী হব। যে ব্যক্তি একহাত পরিমাণ আমার নিকটবর্তী হবে, আমি দুই হাতের বিস্তার পরিমাণ তার নিকটবর্তী হব। যে ব্যক্তি আমার দিকে আসবে হেঁটে হেঁটে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসব - বুখারী ও মুসলিম
এ হাদীছটি সহীহ মুসলিমে একাধিক রেওয়ায়েতে এসেছে। এখানে তার একটি রেওয়ায়েতের শব্দমালা উদ্ধৃত হল। এর (অংশ বিশেষের) ব্যাখ্যা পেছনের অধ্যায়ে গত হয়েছে।
52 - باب فضل الرجاء
قَالَ الله تَعَالَى إخبارًا عن العبدِ الصالِحِ: {وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ * فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا} [غافر: 44، 45]
قَالَ الله تَعَالَى إخبارًا عن العبدِ الصالِحِ: {وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ * فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا} [غافر: 44، 45]
440 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أَنَّهُ قَالَ: «قَالَ الله - عز وجل: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنا معه حَيْثُ يَذْكُرنِي، وَاللهِ، للهُ أَفْرَحُ بِتَوبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أحَدِكُمْ [ص:157] يَجِدُ ضَالَّتَهُ (1) بِالفَلاَةِ، وَمَنْ تَقَرَّبَ إلَيَّ شِبْرًا، تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَمَنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا، تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِذَا أَقْبَلَ إِلَيَّ يَمْشِي أَقْبَلْتُ إِلَيْهِ أُهَرْوِلُ». متفقٌ عليه، (2) وهذا لفظ إحدى روايات مسلم. وتقدم شرحه في الباب قبله. (3)
ورُوِيَ في الصحيحين: «وأنا معه حين يذكرني» بالنون، وفي هذه الرواية
«حيث» بالثاء وكلاهما صحيح.
ورُوِيَ في الصحيحين: «وأنا معه حين يذكرني» بالنون، وفي هذه الرواية
«حيث» بالثاء وكلاهما صحيح.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে মৌলিকভাবে চারটি কথা আছে। প্রথম কথা আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে বান্দার কেমন ধারণা রাখা উচিত সে বিষয়ে।
আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে সুধারণা রাখার গুরুত্ব
ظن অর্থ ধারণা। আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে বান্দার ধারণা ভালোও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। ভালো ধারণা রাখা ফরয। যেমন তাওবা করে এই ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা কবুল করবেন। বিপদে পড়ে এই ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা সাহায্য করবেন। ইবাদত-বন্দেগী করে ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হবে। আর মন্দ ধারণা রাখা হারাম। যেমন মন্দ ধারণার কারণে আল্লাহ তা'আলা মুনাফিকদের নিন্দা করেন যে, وَظَنَنْتُمْ ظَنَّ السَّوْءِ وَكُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا, (এবং তোমরা নানারকম কু-ধারণা করেছিলে। বস্তুত তোমরা ছিলে এক ধ্বংসমুখী সম্প্রদায় - সূরা ফাতহ : ১২)।
মানুষ সম্পর্কে অহেতুক মন্দ ধারণা করা জায়েয নয়। ইরশাদ হয়েছে يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ “হে মুমিনগণ! অনেক রকম ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কোনও কোনও ধারণা গুনাহ।
এ হাদীছে ظن শব্দটি জ্ঞান ও প্রত্যয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন ও হাদীছে এরূপ অর্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। যেমন এক আয়াতে আছে— وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللَّهِ إِلَّا إِلَيْهِ ‘এবং তারা নিশ্চিতভাবে জানল, আল্লাহর (ধরা) থেকে খোদ তাঁর আশ্রয় ছাড়া কোথাও আশ্রয় পাওয়া যাবে না।
সুতরাং أنا عند ظن عبدي بي -এর অর্থ হবে (আমি আমার প্রতি আমার বান্দার জ্ঞান ও প্রত্যয়ের সঙ্গে থাকি)। অর্থাৎ আমি বান্দার প্রতি যেরকম আচরণ করব বলে বান্দা বিশ্বাস রাখে, আমি তার প্রতি সেরকম আচরণ করতে সক্ষম। যদি ভালো আচরণের বিশ্বাস রাখে, তবে ভালো আচরণ করব। যদি মন্দ আচরণের বিশ্বাস রাখে, তবে মন্দ আচরণ করব। যদি বিশ্বাস রাখে আমি তার সৎকর্ম কবুল করব, তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করব এবং তার দু'আ কবুল করব, তবে আমি তার সে বিশ্বাস অনুযায়ীই কাজ করে থাকি।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, أنا عند ظن عبدي بي এর অর্থ হল দু'আ করার সময় দু'আ কবুল হওয়া, তাওবা করার সময় তাওবা গৃহীত হওয়া, ইস্তিগফার করার সময় মাগফিরাত লাভের এবং যথাযথ শর্তপূরণের সঙ্গে ইবাদত করার সময় আল্লাহ তা'আলার ওয়াদা অনুযায়ী পুরস্কার লাভের আশা রাখা। একটি হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
ادعوا الله وأنتم موقنون بالإجابة، واعلموا أن الله لا يستجيب دعاء من قلب غافل لاه
“তোমরা কবুলের ইয়াকীন রেখে আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আ করবে। জেনে রেখো, আল্লাহ গাফিল ও উদাসীন অন্তরের দু'আ কবুল করেন না।
এ কারণেই ইবাদত-বন্দেগী করার সময় অন্তরে বিশ্বাস রাখা জরুরি যে, আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তা কবুল করবেন এবং তাকে ক্ষমা করবেন। কেননা তিনি এরকম ওয়াদা করেছেন আর আল্লাহ তো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যদি অন্তরে এই ধারণা রাখে যে, আল্লাহ তার ইবাদত কবুল করবেন না এবং তার আমল কোনও কাজে আসবে না, তবে তা আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হওয়ার নামান্তর, যা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য একই গুনাহ বারবার করতে থাকা আর এই আশা রাখা যে, আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন, এটা চরম অজ্ঞতা ও মারাত্মক ধোঁকা।
এ হাদীছটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, অন্তরে আল্লাহর আযাবের ভয় অপেক্ষা তাঁর রহমতের আশাই বেশি রাখা উচিত। কেননা আল্লাহ যখন বান্দার সঙ্গে ভালো-মন্দ উভয় আচরণের ক্ষমতা রাখেন এবং এর মধ্যে বান্দা যে আচরণের ধারণা রাখবে, আল্লাহ তা'আলা সেরকম আচরণ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন, তখন কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহর মন্দ আচরণের ধারণা রাখতে পারে না। বরং সে নিজের জন্য ভালো আচরণের ধারণাই রাখবে। অর্থাৎ আশা রাখবে যে, আল্লাহ তার প্রতি রহমত করবেন। এ কারণেই কোনও কোনও বর্ণনায় হাদীছটির শেষে আছে— فليظن بي ما شاء "সুতরাং সে আমার সম্পর্কে যেমন ইচ্ছা ধারণা রাখুক।
অবশ্য বিজ্ঞজনেরা বলেন, সাধারণ অবস্থায় ভয় ও আশা উভয়টিই সমমাত্রায় রাখা উচিত। ভয়ের চেয়ে আশার দিকটি প্রবল রাখা চাই মৃত্যুকালে। একটি হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের তিনদিন আগে ইরশাদ করেন لا يموتن أحدكم إلا وهو يحسن الظن بالله عز وجل “তোমাদের প্রত্যেকেই যেন মৃত্যুকালে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা রাখে।
আল্লাহ তা'আলার যিকরের ফযীলত
হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্য যিকরের ফযীলত সম্পর্কে। বলা হয়েছে- وأنا معه حيث يذكرني (সে আমাকে যেখানেই স্মরণ করে, সেখানেই আমি তার সঙ্গে থাকি)। অর্থাৎ আমি জ্ঞানগতভাবে তার সঙ্গে থাকি। সে আমাকে প্রকাশ্যে স্মরণ করুক বা গোপনে, সর্বাবস্থায়ই আমি তা অবগত থাকি। সে কী উদ্দেশ্যে আমাকে স্মরণ করে তারও খবর রাখি। অথবা সঙ্গে থাকা" এর অর্থ, যিকরকারীর প্রতি রহমত বর্ষণ করা, তাকে নেক আমলের তাওফীক দেওয়া, তাকে সুপথ দেখানো ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করা।
এ হাদীছে যিকর ও স্মরণ দ্বারা অন্তরের স্মরণ, মুখের উচ্চারণ এবং আদেশ-নিষেধ পালন সবই বোঝানো হতে পারে। বোঝানো উদ্দেশ্য যে, বান্দার কোনও যিকরই বৃথা যায় না। ভালো নিয়তে যিকর করলে আল্লাহ তা'আলা তার উত্তম প্রতিদান দেবেন আর নিয়ত ভালো না হলে সে ক্ষেত্রে তার নিয়ত অনুযায়ী আচরণ করবেন।
তাওবার ফযীলত
এ হাদীছ দ্বারা তাওবার গুরুত্ব ও ফযীলত জানা যায়। বান্দার তাওবায় আল্লাহ তা'আলা কতটা খুশি হন, এ হাদীছে একটা উদাহরণের মাধ্যমে তা বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে والله ، لله أفرح بتوبة عبده من أحدكم يجد ضالته بالفلاة (আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ তরুলতাহীন প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া পশুটি ফিরে পেয়ে যেমন খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তারচে'ও বেশি খুশি হন)। কোনও মুসাফির মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া তার বাহন-পশুটি ফিরে পেলে সে কেমন খুশি হয়, তা বিস্তারিতভাবে অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার সারমর্ম হল
এক ব্যক্তি এক মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলছিল। চলতি পথে হয়তো কোনও প্রয়োজনে সে উটের পিঠ থেকে নেমে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে তার উটটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সে পেরেশান হয়ে সেটি খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। তার খাদ্য ও পানি সবই ছিল উটটির সঙ্গে। মরুভূমির মাঝখানে বাহন হারিয়ে যাওয়া, তাও খাদ্য ও পানীয়সহ, কত বড়ই না বিপদের কথা। এখান থেকে সে কিভাবে কোথায় যাবে? আর কিসের দ্বারাই বা ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাবে? সে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এবং জীবনের ব্যাপারেই হতাশ হয়ে পড়ল। সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল উটটি তার পাশে দাঁড়ানো। পানি ও খাদ্য সবই তার সঙ্গে। এটা কত বড় আনন্দের কথা তা কি ভাবা যায়? এ যে মৃত্যুর পর পুনর্জীবন! জীবন ফিরে পাওয়ার মহানন্দ তাকে দিশেহারা করে ফেলল। সে চিৎকার করে উঠল, 'হে আল্লাহ! তুমি আমার গোলাম, আমি তোমার মনিব'। আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানানো। বলতে চেয়েছিল, হে আল্লাহ! তুমি আমার মনিব, আমি তোমার গোলাম। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলল। তার মুখ দিয়ে উল্টো কথা বের হয়ে গেল।
উদাহরণের এই ঘটনায় লোকটার যে কতটা আনন্দ হয়েছিল, তা সকলেরই অনুমেয়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, বান্দার তাওবায় আল্লাহ তা'আলা এরচে'ও বেশি খুশি হন। কারণ আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দা অনেক বেশি প্রিয়। সেই প্রিয় বান্দা পাপাচারের মরুভূমিতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সে তাওবা করে আল্লাহর কাছে আবার ফিরে এসেছে। প্রিয় বান্দার এ প্রত্যাবর্তনে তিনি যে আরও বেশি খুশি হবেন, এই তো স্বাভাবিক। কারণ বান্দাকে তাঁর ভালোবাসা সকলের সকল ভালোবাসার অধিক।
আল্লাহ কর্তৃক বান্দার নেক আমলের মূল্যায়ন
বস্তুত তাওবার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তা'আলার দিকে অগ্রসর হয়। আল্লাহ তা'আলার কোনও বান্দা তাঁর পথে অগ্রসর হলে আল্লাহ তা'আলা তার অভাবনীয় মূল্যায়ন করেন। বান্দা যে গতিতে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তা'আলার রহমত ও তাওফীক তার দিকে ততধিক গতিতে এগিয়ে আসে। এ হাদীছ জানাচ্ছে
ومن تقرب إلي شبرا، تقربت إليه ذراعا، ومن تقرب إلي ذراعا، تقربت إليه باعا، وإذا أقبل إلي يمشي أقبلت إليه أهرول
(যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ আমার নিকট এগিয়ে আসে, আমি একহাত পরিমাণ তার নিকট এগিয়ে যাই। যে ব্যক্তি একহাত পরিমাণ আমার নিকট এগিয়ে আসে, আমি দুই হাতের বিস্তার পরিমাণ তার নিকট এগিয়ে যাই। যে ব্যক্তি আমার দিকে আসে হেঁটে হেঁটে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসি)।
ইমাম নববী রহ. এর অর্থ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার দিকে এগিয়ে আসে আমার আনুগত্য দ্বারা, আমি তার দিকে এগিয়ে যাই নিজ রহমত দ্বারা। সে যতবেশি আনুগত্য করে, আমি ততবেশি রহমত নিয়ে এগিয়ে যাই। সে যদি আমার আনুগত্যের দিকে হেঁটে হেঁটে আসে, আমি তাঁর প্রতি আমার রহমত ঢেলে দিই এবং তার আনুগত্যের চেয়েও দ্রুতগতিতে আমি তার কাছে রহমত পৌঁছে দিই। ফলে মাকসূদ ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে তার খুব বেশি হাঁটার প্রয়োজন হয় না।
এ ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আল্লাহর দিকে বান্দার এগিয়ে যাওয়া ও বান্দার দিকে আল্লাহর এগিয়ে আসার দ্বারা শারীরিকভাবে এগোনোর কথা বোঝানো হয়নি। এমনিভাবে আল্লাহর দিকে হেঁটে যাওয়া এবং বান্দার দিকে আল্লাহর হেঁটে বা দৌড়ে আসার অর্থও বাস্তবিক পা সঞ্চালন নয়। কেননা আল্লাহ তা'আলার সত্তা শরীর ও অঙ্গের ধারণা থেকে ঊর্ধ্বে। তাই তাঁর সম্পর্কে এরূপ অর্থ গ্রহণের কোনও অবকাশ নেই। সুতরাং আল্লাহর দিকে বান্দার এগোনো ও হেঁটে যাওয়ার অর্থ হল ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার হুকুম-আহকাম পালন করা, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আপন সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে থাকা। আর বান্দার দিকে আল্লাহ তা'আলার এগিয়ে আসার অর্থ তাকে ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দেওয়া, তা কবুল করা, তাঁর প্রতি রহমত বর্ষণ করা এবং ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া।
উলামায়ে কেরাম বলেন, বান্দার সঙ্গে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নৈকট্য তিন প্রকার -
ক. আমসাধারণের সঙ্গে নৈকট্য। বান্দার সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার এ নৈকট্য স্থাপিত রয়েছে তাঁর ইলম ও জ্ঞান দ্বারা।
খ. বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নৈকট্য। এটা হল বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলার রহমতের নৈকট্য।
গ. অতি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নৈকট্য। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ প্রিয় বান্দাদের উপর যে খাস করুণার দৃষ্টি রাখেন, যা দ্বারা তিনি তাদেরকে গুনাহ থেকে হেফাজত করেন, শয়তান ও নফসের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন, তাদের অন্তরে ইবাদত-বন্দেগীর উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগ্রত রাখেন এবং ইবাদতের মজা ও ঈমানের প্রশান্তি সঞ্চার করেন। অতি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এটাই আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নৈকট্যের স্বরূপ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইবাদত-বন্দেগী করার সময় আশা রাখা চাই যে, আল্লাহ তা কবুল করবেন। তাওবা-ইস্তিগফার করার সময় আশা রাখা চাই আল্লাহ ক্ষমা করবেন এবং দু'আ করার সময় আশা রাখা চাই আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন।
খ. অন্তরে ও মুখে সর্বদা আল্লাহর যিকর ও স্মরণ জারি রাখা চাই।
গ. বান্দার তাওবায় যেহেতু আল্লাহ খুশি হন, তাই বেশি বেশি তাওবা করা উচিত।
ঘ. সৎকর্ম দ্বারা যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় এবং আমলের তুলনায় আল্লাহ অনেক বেশি পুরস্কার দিয়ে থাকেন, তাই আমলে কিছুতেই গাফলাতী করা উচিত নয়।
আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে সুধারণা রাখার গুরুত্ব
ظن অর্থ ধারণা। আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে বান্দার ধারণা ভালোও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। ভালো ধারণা রাখা ফরয। যেমন তাওবা করে এই ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা কবুল করবেন। বিপদে পড়ে এই ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা সাহায্য করবেন। ইবাদত-বন্দেগী করে ধারণা রাখা যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হবে। আর মন্দ ধারণা রাখা হারাম। যেমন মন্দ ধারণার কারণে আল্লাহ তা'আলা মুনাফিকদের নিন্দা করেন যে, وَظَنَنْتُمْ ظَنَّ السَّوْءِ وَكُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا, (এবং তোমরা নানারকম কু-ধারণা করেছিলে। বস্তুত তোমরা ছিলে এক ধ্বংসমুখী সম্প্রদায় - সূরা ফাতহ : ১২)।
মানুষ সম্পর্কে অহেতুক মন্দ ধারণা করা জায়েয নয়। ইরশাদ হয়েছে يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ “হে মুমিনগণ! অনেক রকম ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কোনও কোনও ধারণা গুনাহ।
এ হাদীছে ظن শব্দটি জ্ঞান ও প্রত্যয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন ও হাদীছে এরূপ অর্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। যেমন এক আয়াতে আছে— وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللَّهِ إِلَّا إِلَيْهِ ‘এবং তারা নিশ্চিতভাবে জানল, আল্লাহর (ধরা) থেকে খোদ তাঁর আশ্রয় ছাড়া কোথাও আশ্রয় পাওয়া যাবে না।
সুতরাং أنا عند ظن عبدي بي -এর অর্থ হবে (আমি আমার প্রতি আমার বান্দার জ্ঞান ও প্রত্যয়ের সঙ্গে থাকি)। অর্থাৎ আমি বান্দার প্রতি যেরকম আচরণ করব বলে বান্দা বিশ্বাস রাখে, আমি তার প্রতি সেরকম আচরণ করতে সক্ষম। যদি ভালো আচরণের বিশ্বাস রাখে, তবে ভালো আচরণ করব। যদি মন্দ আচরণের বিশ্বাস রাখে, তবে মন্দ আচরণ করব। যদি বিশ্বাস রাখে আমি তার সৎকর্ম কবুল করব, তার ভুলত্রুটি ক্ষমা করব এবং তার দু'আ কবুল করব, তবে আমি তার সে বিশ্বাস অনুযায়ীই কাজ করে থাকি।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, أنا عند ظن عبدي بي এর অর্থ হল দু'আ করার সময় দু'আ কবুল হওয়া, তাওবা করার সময় তাওবা গৃহীত হওয়া, ইস্তিগফার করার সময় মাগফিরাত লাভের এবং যথাযথ শর্তপূরণের সঙ্গে ইবাদত করার সময় আল্লাহ তা'আলার ওয়াদা অনুযায়ী পুরস্কার লাভের আশা রাখা। একটি হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন মেলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
ادعوا الله وأنتم موقنون بالإجابة، واعلموا أن الله لا يستجيب دعاء من قلب غافل لاه
“তোমরা কবুলের ইয়াকীন রেখে আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আ করবে। জেনে রেখো, আল্লাহ গাফিল ও উদাসীন অন্তরের দু'আ কবুল করেন না।
এ কারণেই ইবাদত-বন্দেগী করার সময় অন্তরে বিশ্বাস রাখা জরুরি যে, আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তা কবুল করবেন এবং তাকে ক্ষমা করবেন। কেননা তিনি এরকম ওয়াদা করেছেন আর আল্লাহ তো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যদি অন্তরে এই ধারণা রাখে যে, আল্লাহ তার ইবাদত কবুল করবেন না এবং তার আমল কোনও কাজে আসবে না, তবে তা আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হওয়ার নামান্তর, যা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য একই গুনাহ বারবার করতে থাকা আর এই আশা রাখা যে, আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন, এটা চরম অজ্ঞতা ও মারাত্মক ধোঁকা।
এ হাদীছটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, অন্তরে আল্লাহর আযাবের ভয় অপেক্ষা তাঁর রহমতের আশাই বেশি রাখা উচিত। কেননা আল্লাহ যখন বান্দার সঙ্গে ভালো-মন্দ উভয় আচরণের ক্ষমতা রাখেন এবং এর মধ্যে বান্দা যে আচরণের ধারণা রাখবে, আল্লাহ তা'আলা সেরকম আচরণ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন, তখন কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহর মন্দ আচরণের ধারণা রাখতে পারে না। বরং সে নিজের জন্য ভালো আচরণের ধারণাই রাখবে। অর্থাৎ আশা রাখবে যে, আল্লাহ তার প্রতি রহমত করবেন। এ কারণেই কোনও কোনও বর্ণনায় হাদীছটির শেষে আছে— فليظن بي ما شاء "সুতরাং সে আমার সম্পর্কে যেমন ইচ্ছা ধারণা রাখুক।
অবশ্য বিজ্ঞজনেরা বলেন, সাধারণ অবস্থায় ভয় ও আশা উভয়টিই সমমাত্রায় রাখা উচিত। ভয়ের চেয়ে আশার দিকটি প্রবল রাখা চাই মৃত্যুকালে। একটি হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের তিনদিন আগে ইরশাদ করেন لا يموتن أحدكم إلا وهو يحسن الظن بالله عز وجل “তোমাদের প্রত্যেকেই যেন মৃত্যুকালে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা রাখে।
আল্লাহ তা'আলার যিকরের ফযীলত
হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্য যিকরের ফযীলত সম্পর্কে। বলা হয়েছে- وأنا معه حيث يذكرني (সে আমাকে যেখানেই স্মরণ করে, সেখানেই আমি তার সঙ্গে থাকি)। অর্থাৎ আমি জ্ঞানগতভাবে তার সঙ্গে থাকি। সে আমাকে প্রকাশ্যে স্মরণ করুক বা গোপনে, সর্বাবস্থায়ই আমি তা অবগত থাকি। সে কী উদ্দেশ্যে আমাকে স্মরণ করে তারও খবর রাখি। অথবা সঙ্গে থাকা" এর অর্থ, যিকরকারীর প্রতি রহমত বর্ষণ করা, তাকে নেক আমলের তাওফীক দেওয়া, তাকে সুপথ দেখানো ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করা।
এ হাদীছে যিকর ও স্মরণ দ্বারা অন্তরের স্মরণ, মুখের উচ্চারণ এবং আদেশ-নিষেধ পালন সবই বোঝানো হতে পারে। বোঝানো উদ্দেশ্য যে, বান্দার কোনও যিকরই বৃথা যায় না। ভালো নিয়তে যিকর করলে আল্লাহ তা'আলা তার উত্তম প্রতিদান দেবেন আর নিয়ত ভালো না হলে সে ক্ষেত্রে তার নিয়ত অনুযায়ী আচরণ করবেন।
তাওবার ফযীলত
এ হাদীছ দ্বারা তাওবার গুরুত্ব ও ফযীলত জানা যায়। বান্দার তাওবায় আল্লাহ তা'আলা কতটা খুশি হন, এ হাদীছে একটা উদাহরণের মাধ্যমে তা বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে والله ، لله أفرح بتوبة عبده من أحدكم يجد ضالته بالفلاة (আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ তরুলতাহীন প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া পশুটি ফিরে পেয়ে যেমন খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তারচে'ও বেশি খুশি হন)। কোনও মুসাফির মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া তার বাহন-পশুটি ফিরে পেলে সে কেমন খুশি হয়, তা বিস্তারিতভাবে অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার সারমর্ম হল
এক ব্যক্তি এক মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলছিল। চলতি পথে হয়তো কোনও প্রয়োজনে সে উটের পিঠ থেকে নেমে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে তার উটটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সে পেরেশান হয়ে সেটি খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। তার খাদ্য ও পানি সবই ছিল উটটির সঙ্গে। মরুভূমির মাঝখানে বাহন হারিয়ে যাওয়া, তাও খাদ্য ও পানীয়সহ, কত বড়ই না বিপদের কথা। এখান থেকে সে কিভাবে কোথায় যাবে? আর কিসের দ্বারাই বা ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাবে? সে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এবং জীবনের ব্যাপারেই হতাশ হয়ে পড়ল। সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল উটটি তার পাশে দাঁড়ানো। পানি ও খাদ্য সবই তার সঙ্গে। এটা কত বড় আনন্দের কথা তা কি ভাবা যায়? এ যে মৃত্যুর পর পুনর্জীবন! জীবন ফিরে পাওয়ার মহানন্দ তাকে দিশেহারা করে ফেলল। সে চিৎকার করে উঠল, 'হে আল্লাহ! তুমি আমার গোলাম, আমি তোমার মনিব'। আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানানো। বলতে চেয়েছিল, হে আল্লাহ! তুমি আমার মনিব, আমি তোমার গোলাম। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলল। তার মুখ দিয়ে উল্টো কথা বের হয়ে গেল।
উদাহরণের এই ঘটনায় লোকটার যে কতটা আনন্দ হয়েছিল, তা সকলেরই অনুমেয়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, বান্দার তাওবায় আল্লাহ তা'আলা এরচে'ও বেশি খুশি হন। কারণ আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দা অনেক বেশি প্রিয়। সেই প্রিয় বান্দা পাপাচারের মরুভূমিতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সে তাওবা করে আল্লাহর কাছে আবার ফিরে এসেছে। প্রিয় বান্দার এ প্রত্যাবর্তনে তিনি যে আরও বেশি খুশি হবেন, এই তো স্বাভাবিক। কারণ বান্দাকে তাঁর ভালোবাসা সকলের সকল ভালোবাসার অধিক।
আল্লাহ কর্তৃক বান্দার নেক আমলের মূল্যায়ন
বস্তুত তাওবার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তা'আলার দিকে অগ্রসর হয়। আল্লাহ তা'আলার কোনও বান্দা তাঁর পথে অগ্রসর হলে আল্লাহ তা'আলা তার অভাবনীয় মূল্যায়ন করেন। বান্দা যে গতিতে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তা'আলার রহমত ও তাওফীক তার দিকে ততধিক গতিতে এগিয়ে আসে। এ হাদীছ জানাচ্ছে
ومن تقرب إلي شبرا، تقربت إليه ذراعا، ومن تقرب إلي ذراعا، تقربت إليه باعا، وإذا أقبل إلي يمشي أقبلت إليه أهرول
(যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ আমার নিকট এগিয়ে আসে, আমি একহাত পরিমাণ তার নিকট এগিয়ে যাই। যে ব্যক্তি একহাত পরিমাণ আমার নিকট এগিয়ে আসে, আমি দুই হাতের বিস্তার পরিমাণ তার নিকট এগিয়ে যাই। যে ব্যক্তি আমার দিকে আসে হেঁটে হেঁটে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসি)।
ইমাম নববী রহ. এর অর্থ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার দিকে এগিয়ে আসে আমার আনুগত্য দ্বারা, আমি তার দিকে এগিয়ে যাই নিজ রহমত দ্বারা। সে যতবেশি আনুগত্য করে, আমি ততবেশি রহমত নিয়ে এগিয়ে যাই। সে যদি আমার আনুগত্যের দিকে হেঁটে হেঁটে আসে, আমি তাঁর প্রতি আমার রহমত ঢেলে দিই এবং তার আনুগত্যের চেয়েও দ্রুতগতিতে আমি তার কাছে রহমত পৌঁছে দিই। ফলে মাকসূদ ও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে তার খুব বেশি হাঁটার প্রয়োজন হয় না।
এ ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আল্লাহর দিকে বান্দার এগিয়ে যাওয়া ও বান্দার দিকে আল্লাহর এগিয়ে আসার দ্বারা শারীরিকভাবে এগোনোর কথা বোঝানো হয়নি। এমনিভাবে আল্লাহর দিকে হেঁটে যাওয়া এবং বান্দার দিকে আল্লাহর হেঁটে বা দৌড়ে আসার অর্থও বাস্তবিক পা সঞ্চালন নয়। কেননা আল্লাহ তা'আলার সত্তা শরীর ও অঙ্গের ধারণা থেকে ঊর্ধ্বে। তাই তাঁর সম্পর্কে এরূপ অর্থ গ্রহণের কোনও অবকাশ নেই। সুতরাং আল্লাহর দিকে বান্দার এগোনো ও হেঁটে যাওয়ার অর্থ হল ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার হুকুম-আহকাম পালন করা, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আপন সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে থাকা। আর বান্দার দিকে আল্লাহ তা'আলার এগিয়ে আসার অর্থ তাকে ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক দেওয়া, তা কবুল করা, তাঁর প্রতি রহমত বর্ষণ করা এবং ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া।
উলামায়ে কেরাম বলেন, বান্দার সঙ্গে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নৈকট্য তিন প্রকার -
ক. আমসাধারণের সঙ্গে নৈকট্য। বান্দার সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার এ নৈকট্য স্থাপিত রয়েছে তাঁর ইলম ও জ্ঞান দ্বারা।
খ. বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নৈকট্য। এটা হল বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলার রহমতের নৈকট্য।
গ. অতি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে নৈকট্য। আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ প্রিয় বান্দাদের উপর যে খাস করুণার দৃষ্টি রাখেন, যা দ্বারা তিনি তাদেরকে গুনাহ থেকে হেফাজত করেন, শয়তান ও নফসের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন, তাদের অন্তরে ইবাদত-বন্দেগীর উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগ্রত রাখেন এবং ইবাদতের মজা ও ঈমানের প্রশান্তি সঞ্চার করেন। অতি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এটাই আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নৈকট্যের স্বরূপ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইবাদত-বন্দেগী করার সময় আশা রাখা চাই যে, আল্লাহ তা কবুল করবেন। তাওবা-ইস্তিগফার করার সময় আশা রাখা চাই আল্লাহ ক্ষমা করবেন এবং দু'আ করার সময় আশা রাখা চাই আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন।
খ. অন্তরে ও মুখে সর্বদা আল্লাহর যিকর ও স্মরণ জারি রাখা চাই।
গ. বান্দার তাওবায় যেহেতু আল্লাহ খুশি হন, তাই বেশি বেশি তাওবা করা উচিত।
ঘ. সৎকর্ম দ্বারা যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় এবং আমলের তুলনায় আল্লাহ অনেক বেশি পুরস্কার দিয়ে থাকেন, তাই আমলে কিছুতেই গাফলাতী করা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
