রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৫৬
উলামায়ে কিরাম, প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ ও সম্মানীত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অন্যদের উপর তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, তাদেরকে উচ্চস্থানে বসানো ও তাদের মরতবা প্রকাশ করা
মানুষের সঙ্গে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করা
হাদীছ নং : ৩৫৬

মায়মুন ইবন আবী শাবীব রহ. থেকে বর্ণিত যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কাছে এক খাদ্যপ্রার্থী আসলে তিনি তাকে এক টুকরো রুটি দিলেন। আরেক ব্যক্তি তাঁর কাছে আসল, যার বেশভূষা ভালো ছিল। তিনি তাকে বসালেন। সে আহার করল। এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষকে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী স্থান দিও -আবূ দাউদ।২১৫
ইমাম আবূ দাঊদ রহ. বলেন, মায়মুন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে পাননি। ইমাম মুসলিম রহ. তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, উম্মুল মূমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন মানুষকে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ী স্থান দিই।
হাকিম আবূ আব্দুল্লাহ রহ. তাঁর মা'রিফাতু উলূমিল হাদীছ শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, এটি একটি সহীহ হাদীছ।
সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ভূমিকা দ্রষ্টব্য; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৪৮২৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৮৯
44 - باب توقير العلماء والكبار وأهل الفضل وتقديمهم عَلَى غيرهم ورفع مجالسهم وإظهار مرتبتهم
356 - وعن ميمون بن أَبي شَبيب رحمه الله: أنَّ عائشة رَضي الله عنها مَرَّ بِهَا سَائِلٌ، فَأعْطَتْهُ كِسْرَةً، وَمَرَّ بِهَا رَجُلٌ عَلَيهِ ثِيَابٌ وَهَيْئَةٌ، فَأقْعَدَتهُ، فَأكَلَ، فقِيلَ لَهَا في ذلِكَ؟ فقَالتْ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ». رواه أبو داود (1). لكن قال: ميمون لم يدرك عائشة. وقد ذكره مسلم في أول صحيحه تعليقًا فقال: وذكر عن عائشة رضي الله عنها قالت: أمرنا رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أن ننزل الناس منازلهم، وَذَكَرَهُ الحَاكِمُ أَبُو عبد الله في كتابه «مَعرِفَة عُلُومِ الحَديث» وَقالَ: «هُوَ حديث صحيح».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বলা হয়েছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. দুই ব্যক্তিকে দু'ভাবে খাদ্য প্রদান করেছেন। তাদের একজন এসে খাদ্য প্রার্থনা করেছিল। তিনি তাকে এক টুকরো রুটি দিয়ে বিদায় করেছেন। অপরজন ছিল ভালো বেশভূষাধারী আগুন্তুক। তিনি তাকে বসিয়ে খানা খাওয়ান। দু'জনের সঙ্গে দু'রকম আচরণ কেন করলেন তা জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

أَنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ

‘মানুষকে তাদের আপন আপন মর্যাদা অনুযায়ি স্থান দিও।’
অর্থাৎ প্রত্যেকের সঙ্গে তার মান ও অবস্থান অনুযায়ী আচরণ কর। এমন ব্যবহার প্রত্যেকের সঙ্গে কর, যা তার দীনদারী, ইলম ও পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। খাদেম ও মাখদূমকে সমান গণ্য করো না। নেতা ও কর্মীর সঙ্গে একইরকম ব্যবহার করো না। ‘আম ও বিশিষ্টকে অভিন্নভাবে সম্বোধন ও সম্ভাষণ করো না। কেননা তাতে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।

এটি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতি মূল্যবান এক শিক্ষা। এর দ্বারা মানুষের সামাজিক অবস্থান ও পদমর্যাদার প্রতি লক্ষ রেখে সে অনুযায়ী তাদের সঙ্গে ব্যবহার করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

সব মানুষ সমপর্যায়ের নয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। কাউকে ধনী বানিয়েছেন, কাউকে গরীব। কাউকে আলেম বানিয়েছেন, কাউকে সাধারণ। কাউকে নেতা বানিয়েছেন, কাউকে কর্মী। কাউকে কর্মকর্তা, কাউকে কর্মচারী। কাউকে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন, কাউকে নিম্নমর্যাদার। কথাবার্তা, সম্বোধন-সম্ভাষণ, মজলিসে আসনদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সে স্তরভেদের প্রতি লক্ষ রাখা চাই। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যে আচরণ করা হবে তা যেন তার মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। কারও প্রতি আচরণ তার ব্যক্তিমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তাতে আল্লাহর সৃষ্ট স্তরবিন্যাস উপেক্ষা করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ অপেক্ষা অকল্যাণই বেশি হয়ে যায়।

বিত্তবান বা অভিজাত ব্যক্তিকে মজলিসে উপযুক্ত আসন না দিয়ে সাধারণদের সঙ্গে বসতে দিলে তার মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হবেই। শাসক শ্রেণীর সঙ্গে প্রজা-সাধারণের মত ব্যবহার করলে তারা অপমানিত বোধ করবে। আবার সাধারণজনের সঙ্গে অসাধারণ আচরণও ঔদ্ধত্য সৃষ্টির পথ তৈরি করে। কখনও সাধারণজনের পক্ষে তা বিব্রতবোধেরও কারণ হয়। তাই বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি পরিহার করে প্রত্যেকের সঙ্গে তার আপন অবস্থান অনুযায়ীই আচরণ করা বাঞ্ছনীয়। তবে কাউকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। সাধারণ লোকের সঙ্গে তাদের পক্ষে মানানসই আচরণের অর্থ অসৌজন্যমূলক আচরণ কিছুতেই নয়। সর্বাবস্থায় আচার-ব্যবহার সুন্দর হওয়া ও উন্নত আখলাকের পরিচয় দেওয়াই ইসলামের শিক্ষা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-

أَنْزِلِ النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ مِنَ الْخَيْرِ وَالشَّرِّ ، وَأَحْسِنْ أَدَبَهُمْ عَلَى الْأَخْلَاقِ الصَّالِحَةِ

‘মানুষকে তাদের ভালোমন্দ অবস্থান অনুযায়ী স্থান দাও। তবে উত্তম আখলাক- চরিত্রের সঙ্গে তাদের প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন করো।২১৬

উল্লেখ্য, স্তরভেদ অনুযায়ী আচার-ব্যবহারে পার্থক্য করার এ নিয়ম সামাজিক শিষ্টাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইন-আদালতের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। সে ক্ষেত্রে শরীআত সকলের প্রতি সমান আচরণের নির্দেশ দিয়েছে। সুতরাং কিসাস, হুদূদ, দিয়াত ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে পার্থক্য করার কোনও সুযোগ নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ফকীরকে খালিহাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তবে তাকে সমাদর করে বসিয়ে খানা খাওয়ানোও জরুরি নয়।

খ. অতিথি আগুন্তুককে সমাদরের সঙ্গে আপ্যায়ন করা উচিত।

গ. প্রত্যেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ বাঞ্ছনীয়। তবে কারও সঙ্গেই উপেক্ষা ও অবজ্ঞামূলক আচরণ ইসলামী শিক্ষা নয়।

২১৬. আল খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীস নং ৪৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৫৬ | মুসলিম বাংলা