রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৩০৩
অধ্যায়: ৩৯
প্রতিবেশীর হক এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপদেশ
الجار -এর অর্থ প্রতিবেশী। শব্দটির উৎপত্তি الجوار (আশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ) থেকে। বলা হয়ে থাকে- استجرته فاجارني (আমি তার কাছে আশ্রয় চাইলাম, সে আমাকে আশ্রয় দিল)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ (আর আমিই তোমাদের রক্ষক, সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৪৮)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ (এবং যিনি আশ্রয় দান করেন এবং তার বিপরীতে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না, সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৮৮)। শব্দটি ‘নৈকট্য’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কেউ কারও নিকটবর্তী হলে বলা হয়ে থাকে- جاره وجاوره। বলা হয়- جاورا (তারা দু'জন একে অন্যের নিকটবর্তী হলো)। কুরআন মাজীদে আছে- وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ (আর পৃথিবীতে আছে বিভিন্ন ভূখণ্ড, যা পাশাপাশি অবস্থিত, সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ৪)।
এক প্রতিবেশী যেহেতু অপর প্রতিবেশীর নিকটবর্তী থাকে এবং তাদের একজন অন্যজনের আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারী হয়ে থাকে, তাই তাদেরকে (একবচনে) : جار ও (বহুবচনে) جيران বলা হয়। পরিভাষায় جار বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যার বাসস্থান অন্যের বাসস্থানের নিকটবর্তী হয়। এদের প্রত্যেকেই একে অন্যের جار।
جار (জার) শব্দটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, প্রকৃত প্রতিবেশী সেই, যে অপর প্রতিবেশীর রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখে। কোনও প্রতিবেশী দ্বারা যদি অপর প্রতিবেশীর জান, মাল বা ইজ্জতের কোনওরকম ক্ষতি সাধিত হয়, তবে সে যেন সত্যিকার প্রতিবেশীই নয়। এমনিভাবে অন্য কারও দ্বারা যদি এমন কোনও কাজ হয়,যা প্রতিবেশীর পক্ষে ক্ষতিকর আর অপর প্রতিবেশী তা দেখেও তাতে বাধা না দেয়; বরং নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে, তবে সেও প্রতিবেশী নামের উপযুক্ত নয়।
প্রকাশ থাকে যে, মুসলিম ব্যক্তির 'জার' বা প্রতিবেশী হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া শর্ত নয়; বরং মুসলিম-অমুসলিম, নেককার বদকার, বন্ধু-শত্রু, আত্মীয়-অনাত্মীয়, উপকারী-ক্ষতিকর, স্থানীয়-বহিরাগত যেই হোক না কেন, পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা হলেই সে জার বা প্রতিবেশী বলে গণ্য হবে এবং ইসলাম প্রতিবেশীর যে অধিকার সাব্যস্ত করেছে তা তার জন্য প্রযোজ্য হবে, যদিও সম্পর্কের পার্থক্যভেদে অধিকারের মধ্যে সংখ্যাগত পার্থক্য হবে। যেমন প্রতিবেশী মুসলিম হলে প্রতিবেশিত্বের অধিকারের পাশাপাশি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অধিকারও তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আবার সে যদি আত্মীয়ও হয়, তবে প্রতিবেশিত্ব, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তা এ তিনটি অধিকার তার প্রাপ্য হবে। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী যদি অমুসলিম ও অনাত্মীয় হয়, তবে তার অধিকার হবে কেবল একটি— প্রতিবেশিত্বের অধিকার।
ইসলাম প্রতিবেশীর হক আদায় ও তার প্রতি সদাচরণের জোর তাগিদ করেছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কিত একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার অর্থ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা চাওফীক দান করুন- আমীন।
‘প্রতিবেশীর হক এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা’ সম্পর্কিত আয়াত
আল্লাহ ত‘'আলা ইরশাদ করেন-
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا
অর্থ : আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না।
(সূরা নিসা (০৪), আয়াত ৩৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজ ইবাদত বন্দেগীর আদেশ করার পর নয় শ্রেণীর লোকের প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম দিয়েছেন। এটাকে আমরা এককথায় হুকুকুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক আদায়ের হুকুমও বলতে পারি। এ নয় শ্রেণীর মধ্যে মানবসমাজের অধিকাংশ লোকই শামিল রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্য করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আল্লাহ তাআলা বান্দার হক আদায়ের আগে তাঁর নিজের ইবাদত-বন্দেগী করা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করার আদেশ করেছেন। প্রথমে এ আদেশ করার কারণ এর গুরুত্ব পরবর্তী হকসমূহের চেয়ে অনেক বেশি। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার হক। আল্লাহ তাআলার আরও অনেক হক আছে। তার মধ্যে এ হকই প্রধান। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করার মূল কথা হচ্ছে তাওহীদ। তাওহীদের অর্থ আল্লাহ তাআলাকে এক জানা ও কেবল তাঁরই ইবাদত করা। এটা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের মূল ও প্রাণবস্তু। এর উপরই বাকি সব নির্ভর করে । এটা যার ঠিক নেই, তার কোনওকিছুই আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ গুরুত্বের কারণেই আদেশটিকে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এ আদেশ ওই নয় শ্রেণীর লোকের হক আদায়ের হুকুম দেওয়ার আগে একটি ভূমিকারও মর্যাদা রাখে।
আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান। তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই দেখেন। তাঁকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা নেই কারও। কাজেই যে ব্যক্তি সেই সর্বশক্তিমানের ইবাদত-বন্দেগী ও আনুগত্য করতে অভ্যস্ত হয়, তার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত থাকে। আল্লাহভীতি এমন এক গুণ, যা বান্দাকে তার যাবতীয় কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান করে তোলে এবং অন্যায়- অনুচিত কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহভীরু লোকের পক্ষে বান্দার হক আদায়ও সহজ হয়ে যায়, বিশেষত যখন সে এ সম্পর্কে সচেতন থাকে যে, বান্দার হক আদায় করা আল্লাহ তাআলার হক আদায়েরও অন্তর্ভুক্ত, যেহেতু এটা তাঁর আদেশ। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই লক্ষ করা যায় যারা আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্যে বেশি যত্নবান, তারা বান্দার হক আদায়ের প্রতিও বেশি সচেতন। ইবাদত-আনুগত্যে গাফেল লোকদের পক্ষ থেকেই বান্দার হক আদায়ে বেশি অবহেলা হয়ে থাকে। কেননা তাদের অন্তরে যেহেতু আল্লাহর ভয় থাকে না, অন্যদিকে মানুষের হক মেরে দিয়ে বাঁচার নানা ফাঁক-ফোকর থাকে, তাই তাদের হক আদায়েরও বিশেষ গুরুত্ব তাদের অন্তরে থাকে না; বরং কার হক কিভাবে মেরে দেওয়া যায় সেটাই থাকে তাদের লক্ষ্যবস্তু। আর এভাবে তারা তাদের দীন-দুনিয়া উভয়ই ধ্বংস করে ।
১. পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশ করার পর যে নয় শ্রেণীর লোকের প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে পিতা-মাতা। ইরশাদ হয়েছে- وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا (পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর)। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।
(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৭)
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পরপর পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার আদেশ দেওয়ার কারণ বাহ্যত এই যে, আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা। তারপর পিতা-মাতা তাদের দুনিয়ায় আসার মাধ্যম। মানুষের অস্তিত্বলাভে আল্লাহ তাআলার সৃজনক্ষমতার পর পিতা-মাতার যেহেতু একটা বাহ্যিক ভূমিকা আছে, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশিই হওয়ার কথা। এ কারণেই আল্লাহর ইবাদতের পরপর অন্য সবকিছুর আগে পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়ে আসছে।
২. আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়
আয়াতে পিতা-মাতার ‘হক’র পর দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থান পেয়েছে আত্মীয়-স্বজনের হক। ইরশাদ হয়েছে- وَبِذِي الْقُرْبَى (আত্মীয়-স্বজনের প্রতি)। অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ফরয ও অতি বড় ছাওয়াবের কাজ। তাদের প্রতি অসদ্ব্যবহার করা হারাম ও কঠিন গুনাহ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الصَّدَقَةَ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الرَّحِمِ اثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
‘গরীবদের দান-সদাকা করার দ্বারা কেবল সদাকার ছাওয়াব হয়। আর আত্মীয়দের দান-সদাকা করলে তাতে যেমন সদাকা হয়, তেমনি আত্মীয়তা রক্ষারও ছাওয়াব হয়।’
(সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৮২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬২৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৫৪১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৭২৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৩৪)
পিতা-মাতা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে অর্থসাহায্য করা কেবল তখনই ওয়াজিব, যখন তারা আয়-রোজগার করতে অক্ষম হয়, যেমন অন্ধ, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, শিশু ইত্যাদি। পিতা-মাতার সাহায্য করার ক্ষেত্রে এ শর্ত নেই। কোনও ধনী ব্যক্তির সামনে যদি তার আত্মীয়-স্বজন অনাহারে কষ্ট করে এবং তা সত্ত্বেও সে তাকে সাহায্য না করে, তবে তা আলোচ্য আয়াতের হুকুম অমান্য করার শামিল হবে। এরূপ ক্ষেত্রে দান- খয়রাত করা অবশ্যকর্তব্য।
৩-৪. ইয়াতীম ও মিসকীনের প্রতি সদাচরণ
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে এসেছে ইয়াতীম ও মিসকীনের হক আদায়ের হুকুম। বলা হয়েছে - وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ (এবং ইয়াতীম ও মিসকীনদের প্রতি)। ইয়াতীম ও মিসকীনগণ যাকাত আদায়ের খাত। তাদেরকে যাকাতের অর্থ দান করা ধনীদের উপর ফরয। সাধারণভাবে যাকাত ছাড়া অন্যান্য দান-খয়রাত করা মুস্তাহাব। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্যও হয়ে যায়। যেমন কোনও ব্যক্তি যদি অনাহারে কষ্ট পায় আর ধনী ব্যক্তির যাকাত আদায় শেষ হয়ে যায়, তবে এ অবস্থায় তার অনাহারের কষ্ট দূর করার জন্য বাড়তি অর্থ খরচ করা ওয়াজিব।
ইয়াতীমের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا، وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى، وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا
‘আমি ও ইয়াতীমের লালনপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। তিনি নিজের তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন এবং দুটোর মধ্যে ফাঁক করলেন।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯১৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮২০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৬০; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৩৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯০৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬২)
মিসকীন ও বিধবাদের সাহায্য করার ফযীলত সম্পর্কে এক হাদীছে আছে-
الساعي على الأرملة والمسكين كالمجاهد في سبيل الله وأحسبه قال كالقائم لا يفتر وكالصائم لا يفطر
‘'বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত। (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮)
বস্তুত ইয়াতীম-মিসকীনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ঈমানের দাবি। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা তাদের পক্ষেই মানায়, যাদের অন্তরে ঈমান নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ (1) فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ (2) وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ (3)
‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে কর্মফলকে অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।’ (সূরা মা'উন (১০৭), আয়াত ১-৩)
আখেরাতে জাহান্নামীগণ তাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলবে-
قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ (44)
‘তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা মিসকীনদেরকে খাবার দিতাম না। (সূরা মুদ্দাচ্ছির (৭৪), আয়াত ৪৩-৪৪)
এসব আয়াত দ্বারা বোঝা যায় ইয়াতীম-মিসকীনের প্রতি সদয় আচরণ না করার পরিণাম কত ভয়াবহ। তাই আমাদের এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা দরকার।
৫. ৬. নিকট ও দূর প্রতিবেশীর হক আদায়
পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে নিকট ও দূর প্রতিবেশীর হক আদায়ের তাগিদ।
ইরশাদ হয়েছে— وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ (নিকট প্রতিবেশী এবং দূর প্রতিবেশী)। অর্থাৎ নিকট ও দূর প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার কর। নিকট প্রতিবেশী হলো ওই প্রতিবেশী, যার বাড়ি সবচে' বেশি কাছে। কেউ বলেন, এমন প্রতিবেশী, যার সঙ্গে প্রতিবেশিত্বের পাশাপাশি আত্মীয়তা বা ধর্মীয় সম্পর্কও আছে।
দূর প্রতিবেশী হলো ওই প্রতিবেশী, যার বাড়ি অন্য প্রতিবেশীর তুলনায় দূরে। অথবা এমন প্রতিবেশী, যার সঙ্গে আত্মীয়তা বা ধর্মীয় সম্পর্ক নেই। এক বর্ণনায় আছে-
الجيران ثلاثة فمنهم من له ثلاثة حقوق و منهم من له حقان و منهم من له حق فأما الذي له ثلاثة حقوق فالجار المسلم القريب له حق الجار و حق الإسلام و حق القرابة و أما الذي له حقان فالجار المسلم له حق الجوار و حق الإسلام و أما الذي له حق واحد فالجار الكافر له حق الجوار
‘প্রতিবেশী তিন প্রকার। ক. এমন প্রতিবেশী, যার হক তিনটি। খ. এমন প্রতিবেশী, যার হক দু'টি এবং গ. এমন প্রতিবেশী, যার হক একটি। যার হক তিনটি, সে হলো মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী। তার এক হক হলো প্রতিবেশিত্বের, দ্বিতীয় হক ইসলামের এবং তৃতীয় হক আত্মীয়তার। যার হক দু'টি, সে হলো কেবল মুসলিম প্রতিবেশী। তার এক হক প্রতিবেশিত্বের, দ্বিতীয় হক মুসলিম ভাই হিসেবে। যার হক কেবল একটি সে হলো অমুসলিম প্রতিবেশী। তার জন্য রয়েছে কেবল প্রতিবেশিত্বের হক।’ (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯১১৩; আল খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ২৪৭)
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে প্রতিবেশী মুসলিম হোক বা অমুসলিম এবং আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, প্রতিবেশী হিসেবে তার নির্ধারিত হক আছেই। তার সে হক আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, প্রতিবেশীর হক হলো সে সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করা, ঋণ চাইলে ঋণ দেওয়া, অসুস্থ হলে খোঁজখবর রাখা, মারা গেলে জানাযায় শরীক হওয়া, তার কোনও সুখবর থাকলে মুবারকবাদ জানানো, বিপদে পড়লে সহানুভূতি প্রকাশ করা, তার অনুমতি ছাড়া এমন উঁচু প্রাচীর বা বাড়ি না বানানো, যাতে তার বাড়িতে বাতাস আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, ভালো খাবার তৈরি হলে তাতে তাকে শরীক করা ইত্যাদি। এ অধ্যায়ের হাদীছসমূহে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আসছে।
৭. সাথী-সঙ্গীর প্রতি সদ্ব্যবহার
সপ্তম পর্যায়ে হলো পার্শ্বসহচরের হক। ইরশাদ হয়েছে- وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ ‘সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি'। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের সঙ্গে বসা বা দাঁড়ানো থাকে, তার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। সহপাঠী, সফরসঙ্গী, সহকর্মী, সহযাত্রী, একই মজলিসে পাশাপাশি উপবিষ্ট ব্যক্তি এবং এরকম আরও যাদের সঙ্গে পাশাপাশি ওঠা-বসা করা হয় তারা সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত।
এই শ্রেণীর লোকদেরও যে হক থাকতে পারে, সে ব্যাপারে সাধারণত চিন্তাই করা হয় না। অথচ ইসলাম হুকুকুল ইবাদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণীকেও শামিল রেখেছে। সুতরাং ওঠাবসা-চলাফেরায় লক্ষ রাখা চাই যাতে কোনওভাবেই এদের হক নষ্ট না হয়। এককথায় এদের হক হলো ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা ও কষ্টদান থেকে বিরত থাকা। যেমন গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ধুমপান থেকে বিরত থাকা চাই। কেননা তাতে পাশের যাত্রীদের কষ্ট হয়ে থাকে। অনেকে নিজ আসনের অতিরিক্ত জায়গা দখল করে রাখে। এতে পার্শ্ববর্তী যাত্রীর হক নষ্ট হয়। কেউ কেউ এত উচ্চস্বরে কথা বলে, যাতে পাশের যাত্রী অতিষ্ঠ হয়ে যায়। অপ্রয়োজনে বার বার ওঠাবসা করার দ্বারাও তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। এমনিভাবে আরও যেসব আচরণ পার্শ্ববর্তী যাত্রীর পক্ষে কষ্টদায়ক হয়, সেসব থেকেই বিরত থাকা কর্তব্য। অন্যথায় তা সহযাত্রীর অধিকার হরণের মধ্যে গণ্য হবে।
এ আয়াতে সদ্ব্যবহারের হুকুম দেওয়া হয়েছে। এটা অধিকার আদায়ের চেয়েও উচ্চপর্যায়ের। সুতরাং যেসব কাজে তাদের হক নষ্ট হয় তা থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং যা-কিছুই অশোভন ও অরুচিকর, তা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি এমন ভদ্রোচিত ব্যবহার করা উচিত, যা শান্তিদায়ক ও সম্মানজনক হয়। যেমন মজলিসে থাকা অবস্থায় বেশি ওঠাবসা না করা, অন্যদের সামনে নাক না ঝাড়া, অতিরিক্ত শব্দে হাঁচি ও কাশি না দেওয়া, শরীরের কোনওরকম দুর্গন্ধে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখা, পাশের ব্যক্তিকে আরামে বসার সুযোগ করে দেওয়া, তার কোনওকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা সে খবর নেওয়া ও তা পূরণের চেষ্টা করা ইত্যাদি।
৮. পথিক ও মুসাফিরের প্রতি সদাচরণ
এ আয়াতে বর্ণিত হক্কুল ইবাদের অষ্টম শ্রেণী হলো ইবনুস্ সাবীল । অর্থাৎ পথিক ও অতিথি । কোনও ব্যক্তি সফরকালে কারও মেহমান হলে সামর্থ্য অনুযায়ী তার সেবা করা ও তার মেহমানদারির দিকে লক্ষ রাখা একটি ঈমানী দায়িত্ব। ইসলামে অতিথির যে ‘হক’র কথা বলা হয়েছে, লোকে সাধারণত তা দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের হক বুঝে থাকে। মূল ব্যাপার তা নয়। আত্মীয়ের হক আলাদা এবং ইবনুস্ সাবীলের হকও আলাদা। ইবনুস্ সাবীল হলো ওই পথিক ও মুসাফির, যে সফরকালে কারও বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরূপ ব্যক্তি অতিথিরূপে ভালো ব্যবহারের হকদার হয়ে যায়। এমনিভাবে কোনও মুসাফির ও পথিক প্রখর রোদ, ঝড়-বাদল বা অন্ধকার রাতে সামনে চলতে অক্ষম হয়ে কোনও বাড়ির দরজায় পৌঁছলে সে বাড়ির লোকজনের কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে আশ্রয় দেওয়া ও তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা। এটা তাদের কাছে সেই পথিক ও মুসাফিরের প্রাপ্য।
৯. দাস-দাসী ও শ্রমিক-কর্মচারীর হক আদায়
নবম শ্রেণী হলো দাস-দাসী। আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ (এবং নিজেদের দাস-দাসীদের প্রতিও)। এর আক্ষরিক অর্থ- তোমাদের হাত যাদের মালিকানা লাভ করেছে। বোঝানো উদ্দেশ্য ওই সকল গোলাম-বাঁদীকে, যারা মনিবের মালিকানাধীন থাকে, মনিব যাদেরকে বেচাকেনা করার অধিকারও রাখে। ইসলামে এটা অনুমোদিত। তবে ইসলামের দাসপ্রথা ও পশ্চিমা বিশ্বের অধুনালুপ্ত দাসপ্রথা এক জিনিস নয়। ইসলামের দাসপ্রথা কেবলই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তাদের প্রতি আচার- আচরণ সম্পর্কিত ইসলামী বিধানও সম্পূর্ণ মানবিক। গভীরভাবে লক্ষ করলে ইসলামের দাসপ্রথা—নামেই যা দাসপ্রথা। বাস্তবিকপক্ষে দাস-দাসীগণ ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরই অংশ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ
‘দাস-দাসীগণ তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। কাজেই আল্লাহ তাআলা তার যে ভাইকে তার অধীন করেছেন, তার প্রতি তার কর্তব্য হচ্ছে নিজে যা খাবে তাকে তাই খাওয়াবে, নিজে যা পরবে তাকে তাই পরাবে, তার সাধ্যের বাইরে কোনও কাজের বোঝা তার উপর চাপাবে না, যদি সাধ্যের বাইরে কোনও কাজ তার উপর চাপায়, তবে সে কাজে নিজে তার সাহায্য করবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৬৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৪০৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৯৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৭৫)
অপর এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لِلْمَمْلُوكِ طَعَامُهُ وَكِسْوَتُهُ، وَلَا يُكَلِّفُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا يُطِيقُ
‘দাস-দাসীর খাদ্য ও পোশাকের দায়িত্ব তার মনিবের উপর। মনিবের আরও কর্তব্য হলো তার উপর তার ক্ষমতার বেশি কাজের বোঝা না চাপানো।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬২; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং১৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৩৬৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩১৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৭২: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮১৯৭)
ইসলামে দাস-দাসীকে মারপিট করা সম্পূর্ণ নিষেধ। একবার বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ মাসউদ আনসারী রাযি, তাঁর এক গোলামকে পেটাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি পেছন থেকে আওয়াজ শুনতে পান আবূ মাস'উদ। জেনে রেখ, ওর উপর তোমার যতটুকু ক্ষমতা, তারচে' তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশি। আওয়াজ শুনে তিনি পেছন দিকে ফিরে তাকান। দেখতে পান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই গোলামটিকে আযাদ করে দেন। তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ للفَحَتْكَ النَّارُ، أَوْ لَمَسَّكَ النَّارُ
‘শোন! তুমি যদি এরূপ না করতে, তবে অবশ্যই আগুন তোমাকে গ্রাস করত। কিংবা বলেছেন, অবশ্যই আগুন তোমাকে স্পর্শ করত।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৫৯; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৭১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮২০৮)
এই হচ্ছে ইসলামে দাস-দাসীর অধিকার। এই হচ্ছে দাস-দাসীর প্রতি আচার- আচরণে ইসলামের শিক্ষা। পক্ষান্তরে পশ্চিমা বিশ্বে যে দাসপ্রথা চালু ছিল, তা ছিল নিতান্তই নিপীড়ন। তাতে নিয়ম-নীতির কোনও বালাই ছিল না। জোর জুলুম করে অসহায় স্বাধীন লোকদেরকেই দাস-দাসীরূপে ব্যবহার করা হতো। তারা তো এখনও তাদের আধিপত্যভুক্ত দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি দাস-দাসীসুলভ আচরণই করে থাকে। তাদের জন্য তারা ‘দাস’ শব্দটি ব্যবহার করে না বটে, কিন্তু কার্যত তারা তাদেরকে দাসত্বের শেকলেই আবদ্ধ করে রেখেছে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের দাসপ্রথাকে বিবেচনা করা মোটেই সুবিচার নয় ।
প্রকাশ থাকে যে, যদিও আয়াতে সরাসরি দাস-দাসীর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপকার্থে শ্রমিক, কর্মচারী ও গৃহকর্মীরাও এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। তাদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য। যথাসময়ে তাদের পারিশ্রমিক আদায় করতে হবে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাতে গড়িমসি করলে তা জুলুম বলে গণ্য হবে। তাদের প্রতি কথাবার্তায় কোমলতা প্রদর্শন করা ও আচার-আচরণে সহানুভূতিশীল থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। গালাগাল করা, রূঢ় ভাষা ব্যবহার করা ও কঠিন-কঠোর আচরণ করা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মোটকথা তাদের প্রতি আচার-আচরণ করতে হবে পুরোপুরি মানবিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا صَنَعَ لأَحَدِكُمْ خَادِمُهُ طَعَامَهُ ، ثُمَّ جَاءَهُ بِهِ ، وَقَدْ وَلِيَ حَرَّهُ وَدُخَانَهُ ، فَلْيُقْعِدْهُ مَعَهُ ، فَلْيَأْكُلْ ، فَإِنْ كَانَ الطَّعَامُ مَشْفُوهًا قَلِيلاً ، فَلْيَضَعْ فِي يَدِهِ مِنْهُ أُكْلَةً ، أَوْ أُكْلَتَيْنِ
‘তোমাদের কারও জন্যে তার খাদেম যখন আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করে খানা পাকাবে, তখন সে যেন তাকে নিজের সঙ্গে বসিয়ে খানা খাওয়ায়। খানার পরিমাণ যদি খুব কম হয়, তবে অন্ততপক্ষে তার হাতে দুই-এক লোকমা অবশ্যই তুলে দেবে।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৮৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৭২৬)
একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা চাকরদের কতবার ক্ষমা করব? তিনি নীরব থাকলেন। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল। এবারও তিনি নীরব থাকলেন। সে তৃতীয়বার একই কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন-
كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِينَ مَرَّةً
‘তাকে রোজ সত্তরবার ক্ষমা করবে।’ (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৬৪; মুসনাদে আহমাদ,
হাদীছ নং ৫৮১৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৯৮)
প্রতিবেশীর হক এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপদেশ
الجار -এর অর্থ প্রতিবেশী। শব্দটির উৎপত্তি الجوار (আশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ) থেকে। বলা হয়ে থাকে- استجرته فاجارني (আমি তার কাছে আশ্রয় চাইলাম, সে আমাকে আশ্রয় দিল)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ (আর আমিই তোমাদের রক্ষক, সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৪৮)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ (এবং যিনি আশ্রয় দান করেন এবং তার বিপরীতে কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না, সূরা মুমিনূন (২৩), আয়াত ৮৮)। শব্দটি ‘নৈকট্য’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কেউ কারও নিকটবর্তী হলে বলা হয়ে থাকে- جاره وجاوره। বলা হয়- جاورا (তারা দু'জন একে অন্যের নিকটবর্তী হলো)। কুরআন মাজীদে আছে- وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ (আর পৃথিবীতে আছে বিভিন্ন ভূখণ্ড, যা পাশাপাশি অবস্থিত, সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ৪)।
এক প্রতিবেশী যেহেতু অপর প্রতিবেশীর নিকটবর্তী থাকে এবং তাদের একজন অন্যজনের আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারী হয়ে থাকে, তাই তাদেরকে (একবচনে) : جار ও (বহুবচনে) جيران বলা হয়। পরিভাষায় جار বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যার বাসস্থান অন্যের বাসস্থানের নিকটবর্তী হয়। এদের প্রত্যেকেই একে অন্যের جار।
جار (জার) শব্দটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, প্রকৃত প্রতিবেশী সেই, যে অপর প্রতিবেশীর রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখে। কোনও প্রতিবেশী দ্বারা যদি অপর প্রতিবেশীর জান, মাল বা ইজ্জতের কোনওরকম ক্ষতি সাধিত হয়, তবে সে যেন সত্যিকার প্রতিবেশীই নয়। এমনিভাবে অন্য কারও দ্বারা যদি এমন কোনও কাজ হয়,যা প্রতিবেশীর পক্ষে ক্ষতিকর আর অপর প্রতিবেশী তা দেখেও তাতে বাধা না দেয়; বরং নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে, তবে সেও প্রতিবেশী নামের উপযুক্ত নয়।
প্রকাশ থাকে যে, মুসলিম ব্যক্তির 'জার' বা প্রতিবেশী হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া শর্ত নয়; বরং মুসলিম-অমুসলিম, নেককার বদকার, বন্ধু-শত্রু, আত্মীয়-অনাত্মীয়, উপকারী-ক্ষতিকর, স্থানীয়-বহিরাগত যেই হোক না কেন, পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা হলেই সে জার বা প্রতিবেশী বলে গণ্য হবে এবং ইসলাম প্রতিবেশীর যে অধিকার সাব্যস্ত করেছে তা তার জন্য প্রযোজ্য হবে, যদিও সম্পর্কের পার্থক্যভেদে অধিকারের মধ্যে সংখ্যাগত পার্থক্য হবে। যেমন প্রতিবেশী মুসলিম হলে প্রতিবেশিত্বের অধিকারের পাশাপাশি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অধিকারও তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। আবার সে যদি আত্মীয়ও হয়, তবে প্রতিবেশিত্ব, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তা এ তিনটি অধিকার তার প্রাপ্য হবে। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী যদি অমুসলিম ও অনাত্মীয় হয়, তবে তার অধিকার হবে কেবল একটি— প্রতিবেশিত্বের অধিকার।
ইসলাম প্রতিবেশীর হক আদায় ও তার প্রতি সদাচরণের জোর তাগিদ করেছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কিত একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার অর্থ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা চাওফীক দান করুন- আমীন।
‘প্রতিবেশীর হক এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা’ সম্পর্কিত আয়াত
আল্লাহ ত‘'আলা ইরশাদ করেন-
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا
অর্থ : আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না।
(সূরা নিসা (০৪), আয়াত ৩৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজ ইবাদত বন্দেগীর আদেশ করার পর নয় শ্রেণীর লোকের প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম দিয়েছেন। এটাকে আমরা এককথায় হুকুকুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক আদায়ের হুকুমও বলতে পারি। এ নয় শ্রেণীর মধ্যে মানবসমাজের অধিকাংশ লোকই শামিল রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্য করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আল্লাহ তাআলা বান্দার হক আদায়ের আগে তাঁর নিজের ইবাদত-বন্দেগী করা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করার আদেশ করেছেন। প্রথমে এ আদেশ করার কারণ এর গুরুত্ব পরবর্তী হকসমূহের চেয়ে অনেক বেশি। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার হক। আল্লাহ তাআলার আরও অনেক হক আছে। তার মধ্যে এ হকই প্রধান। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করার মূল কথা হচ্ছে তাওহীদ। তাওহীদের অর্থ আল্লাহ তাআলাকে এক জানা ও কেবল তাঁরই ইবাদত করা। এটা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের মূল ও প্রাণবস্তু। এর উপরই বাকি সব নির্ভর করে । এটা যার ঠিক নেই, তার কোনওকিছুই আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ গুরুত্বের কারণেই আদেশটিকে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এ আদেশ ওই নয় শ্রেণীর লোকের হক আদায়ের হুকুম দেওয়ার আগে একটি ভূমিকারও মর্যাদা রাখে।
আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান। তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই দেখেন। তাঁকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা নেই কারও। কাজেই যে ব্যক্তি সেই সর্বশক্তিমানের ইবাদত-বন্দেগী ও আনুগত্য করতে অভ্যস্ত হয়, তার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত থাকে। আল্লাহভীতি এমন এক গুণ, যা বান্দাকে তার যাবতীয় কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান করে তোলে এবং অন্যায়- অনুচিত কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহভীরু লোকের পক্ষে বান্দার হক আদায়ও সহজ হয়ে যায়, বিশেষত যখন সে এ সম্পর্কে সচেতন থাকে যে, বান্দার হক আদায় করা আল্লাহ তাআলার হক আদায়েরও অন্তর্ভুক্ত, যেহেতু এটা তাঁর আদেশ। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই লক্ষ করা যায় যারা আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্যে বেশি যত্নবান, তারা বান্দার হক আদায়ের প্রতিও বেশি সচেতন। ইবাদত-আনুগত্যে গাফেল লোকদের পক্ষ থেকেই বান্দার হক আদায়ে বেশি অবহেলা হয়ে থাকে। কেননা তাদের অন্তরে যেহেতু আল্লাহর ভয় থাকে না, অন্যদিকে মানুষের হক মেরে দিয়ে বাঁচার নানা ফাঁক-ফোকর থাকে, তাই তাদের হক আদায়েরও বিশেষ গুরুত্ব তাদের অন্তরে থাকে না; বরং কার হক কিভাবে মেরে দেওয়া যায় সেটাই থাকে তাদের লক্ষ্যবস্তু। আর এভাবে তারা তাদের দীন-দুনিয়া উভয়ই ধ্বংস করে ।
১. পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশ করার পর যে নয় শ্রেণীর লোকের প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে পিতা-মাতা। ইরশাদ হয়েছে- وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا (পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর)। এর দ্বারা বোঝা যায় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।
(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৭)
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পরপর পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার আদেশ দেওয়ার কারণ বাহ্যত এই যে, আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা। তারপর পিতা-মাতা তাদের দুনিয়ায় আসার মাধ্যম। মানুষের অস্তিত্বলাভে আল্লাহ তাআলার সৃজনক্ষমতার পর পিতা-মাতার যেহেতু একটা বাহ্যিক ভূমিকা আছে, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশিই হওয়ার কথা। এ কারণেই আল্লাহর ইবাদতের পরপর অন্য সবকিছুর আগে পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের হুকুম দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়ে আসছে।
২. আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়
আয়াতে পিতা-মাতার ‘হক’র পর দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থান পেয়েছে আত্মীয়-স্বজনের হক। ইরশাদ হয়েছে- وَبِذِي الْقُرْبَى (আত্মীয়-স্বজনের প্রতি)। অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ফরয ও অতি বড় ছাওয়াবের কাজ। তাদের প্রতি অসদ্ব্যবহার করা হারাম ও কঠিন গুনাহ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الصَّدَقَةَ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الرَّحِمِ اثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
‘গরীবদের দান-সদাকা করার দ্বারা কেবল সদাকার ছাওয়াব হয়। আর আত্মীয়দের দান-সদাকা করলে তাতে যেমন সদাকা হয়, তেমনি আত্মীয়তা রক্ষারও ছাওয়াব হয়।’
(সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৮২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬২৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১০৫৪১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৭২৩; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৩৪)
পিতা-মাতা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে অর্থসাহায্য করা কেবল তখনই ওয়াজিব, যখন তারা আয়-রোজগার করতে অক্ষম হয়, যেমন অন্ধ, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, শিশু ইত্যাদি। পিতা-মাতার সাহায্য করার ক্ষেত্রে এ শর্ত নেই। কোনও ধনী ব্যক্তির সামনে যদি তার আত্মীয়-স্বজন অনাহারে কষ্ট করে এবং তা সত্ত্বেও সে তাকে সাহায্য না করে, তবে তা আলোচ্য আয়াতের হুকুম অমান্য করার শামিল হবে। এরূপ ক্ষেত্রে দান- খয়রাত করা অবশ্যকর্তব্য।
৩-৪. ইয়াতীম ও মিসকীনের প্রতি সদাচরণ
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে এসেছে ইয়াতীম ও মিসকীনের হক আদায়ের হুকুম। বলা হয়েছে - وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ (এবং ইয়াতীম ও মিসকীনদের প্রতি)। ইয়াতীম ও মিসকীনগণ যাকাত আদায়ের খাত। তাদেরকে যাকাতের অর্থ দান করা ধনীদের উপর ফরয। সাধারণভাবে যাকাত ছাড়া অন্যান্য দান-খয়রাত করা মুস্তাহাব। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্যও হয়ে যায়। যেমন কোনও ব্যক্তি যদি অনাহারে কষ্ট পায় আর ধনী ব্যক্তির যাকাত আদায় শেষ হয়ে যায়, তবে এ অবস্থায় তার অনাহারের কষ্ট দূর করার জন্য বাড়তি অর্থ খরচ করা ওয়াজিব।
ইয়াতীমের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ هَكَذَا، وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى، وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا
‘আমি ও ইয়াতীমের লালনপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। তিনি নিজের তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন এবং দুটোর মধ্যে ফাঁক করলেন।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯১৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮২০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৬০; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৩৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯০৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬২)
মিসকীন ও বিধবাদের সাহায্য করার ফযীলত সম্পর্কে এক হাদীছে আছে-
الساعي على الأرملة والمسكين كالمجاهد في سبيل الله وأحسبه قال كالقائم لا يفتر وكالصائم لا يفطر
‘'বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত। (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮)
বস্তুত ইয়াতীম-মিসকীনের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ঈমানের দাবি। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা তাদের পক্ষেই মানায়, যাদের অন্তরে ঈমান নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ (1) فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ (2) وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ (3)
‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে কর্মফলকে অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না।’ (সূরা মা'উন (১০৭), আয়াত ১-৩)
আখেরাতে জাহান্নামীগণ তাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলবে-
قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ (44)
‘তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা মিসকীনদেরকে খাবার দিতাম না। (সূরা মুদ্দাচ্ছির (৭৪), আয়াত ৪৩-৪৪)
এসব আয়াত দ্বারা বোঝা যায় ইয়াতীম-মিসকীনের প্রতি সদয় আচরণ না করার পরিণাম কত ভয়াবহ। তাই আমাদের এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা দরকার।
৫. ৬. নিকট ও দূর প্রতিবেশীর হক আদায়
পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে নিকট ও দূর প্রতিবেশীর হক আদায়ের তাগিদ।
ইরশাদ হয়েছে— وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ (নিকট প্রতিবেশী এবং দূর প্রতিবেশী)। অর্থাৎ নিকট ও দূর প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার কর। নিকট প্রতিবেশী হলো ওই প্রতিবেশী, যার বাড়ি সবচে' বেশি কাছে। কেউ বলেন, এমন প্রতিবেশী, যার সঙ্গে প্রতিবেশিত্বের পাশাপাশি আত্মীয়তা বা ধর্মীয় সম্পর্কও আছে।
দূর প্রতিবেশী হলো ওই প্রতিবেশী, যার বাড়ি অন্য প্রতিবেশীর তুলনায় দূরে। অথবা এমন প্রতিবেশী, যার সঙ্গে আত্মীয়তা বা ধর্মীয় সম্পর্ক নেই। এক বর্ণনায় আছে-
الجيران ثلاثة فمنهم من له ثلاثة حقوق و منهم من له حقان و منهم من له حق فأما الذي له ثلاثة حقوق فالجار المسلم القريب له حق الجار و حق الإسلام و حق القرابة و أما الذي له حقان فالجار المسلم له حق الجوار و حق الإسلام و أما الذي له حق واحد فالجار الكافر له حق الجوار
‘প্রতিবেশী তিন প্রকার। ক. এমন প্রতিবেশী, যার হক তিনটি। খ. এমন প্রতিবেশী, যার হক দু'টি এবং গ. এমন প্রতিবেশী, যার হক একটি। যার হক তিনটি, সে হলো মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী। তার এক হক হলো প্রতিবেশিত্বের, দ্বিতীয় হক ইসলামের এবং তৃতীয় হক আত্মীয়তার। যার হক দু'টি, সে হলো কেবল মুসলিম প্রতিবেশী। তার এক হক প্রতিবেশিত্বের, দ্বিতীয় হক মুসলিম ভাই হিসেবে। যার হক কেবল একটি সে হলো অমুসলিম প্রতিবেশী। তার জন্য রয়েছে কেবল প্রতিবেশিত্বের হক।’ (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯১১৩; আল খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ২৪৭)
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে প্রতিবেশী মুসলিম হোক বা অমুসলিম এবং আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, প্রতিবেশী হিসেবে তার নির্ধারিত হক আছেই। তার সে হক আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, প্রতিবেশীর হক হলো সে সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করা, ঋণ চাইলে ঋণ দেওয়া, অসুস্থ হলে খোঁজখবর রাখা, মারা গেলে জানাযায় শরীক হওয়া, তার কোনও সুখবর থাকলে মুবারকবাদ জানানো, বিপদে পড়লে সহানুভূতি প্রকাশ করা, তার অনুমতি ছাড়া এমন উঁচু প্রাচীর বা বাড়ি না বানানো, যাতে তার বাড়িতে বাতাস আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, ভালো খাবার তৈরি হলে তাতে তাকে শরীক করা ইত্যাদি। এ অধ্যায়ের হাদীছসমূহে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আসছে।
৭. সাথী-সঙ্গীর প্রতি সদ্ব্যবহার
সপ্তম পর্যায়ে হলো পার্শ্বসহচরের হক। ইরশাদ হয়েছে- وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ ‘সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি'। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের সঙ্গে বসা বা দাঁড়ানো থাকে, তার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। সহপাঠী, সফরসঙ্গী, সহকর্মী, সহযাত্রী, একই মজলিসে পাশাপাশি উপবিষ্ট ব্যক্তি এবং এরকম আরও যাদের সঙ্গে পাশাপাশি ওঠা-বসা করা হয় তারা সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত।
এই শ্রেণীর লোকদেরও যে হক থাকতে পারে, সে ব্যাপারে সাধারণত চিন্তাই করা হয় না। অথচ ইসলাম হুকুকুল ইবাদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণীকেও শামিল রেখেছে। সুতরাং ওঠাবসা-চলাফেরায় লক্ষ রাখা চাই যাতে কোনওভাবেই এদের হক নষ্ট না হয়। এককথায় এদের হক হলো ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা ও কষ্টদান থেকে বিরত থাকা। যেমন গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ধুমপান থেকে বিরত থাকা চাই। কেননা তাতে পাশের যাত্রীদের কষ্ট হয়ে থাকে। অনেকে নিজ আসনের অতিরিক্ত জায়গা দখল করে রাখে। এতে পার্শ্ববর্তী যাত্রীর হক নষ্ট হয়। কেউ কেউ এত উচ্চস্বরে কথা বলে, যাতে পাশের যাত্রী অতিষ্ঠ হয়ে যায়। অপ্রয়োজনে বার বার ওঠাবসা করার দ্বারাও তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। এমনিভাবে আরও যেসব আচরণ পার্শ্ববর্তী যাত্রীর পক্ষে কষ্টদায়ক হয়, সেসব থেকেই বিরত থাকা কর্তব্য। অন্যথায় তা সহযাত্রীর অধিকার হরণের মধ্যে গণ্য হবে।
এ আয়াতে সদ্ব্যবহারের হুকুম দেওয়া হয়েছে। এটা অধিকার আদায়ের চেয়েও উচ্চপর্যায়ের। সুতরাং যেসব কাজে তাদের হক নষ্ট হয় তা থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং যা-কিছুই অশোভন ও অরুচিকর, তা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি এমন ভদ্রোচিত ব্যবহার করা উচিত, যা শান্তিদায়ক ও সম্মানজনক হয়। যেমন মজলিসে থাকা অবস্থায় বেশি ওঠাবসা না করা, অন্যদের সামনে নাক না ঝাড়া, অতিরিক্ত শব্দে হাঁচি ও কাশি না দেওয়া, শরীরের কোনওরকম দুর্গন্ধে কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ রাখা, পাশের ব্যক্তিকে আরামে বসার সুযোগ করে দেওয়া, তার কোনওকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা সে খবর নেওয়া ও তা পূরণের চেষ্টা করা ইত্যাদি।
৮. পথিক ও মুসাফিরের প্রতি সদাচরণ
এ আয়াতে বর্ণিত হক্কুল ইবাদের অষ্টম শ্রেণী হলো ইবনুস্ সাবীল । অর্থাৎ পথিক ও অতিথি । কোনও ব্যক্তি সফরকালে কারও মেহমান হলে সামর্থ্য অনুযায়ী তার সেবা করা ও তার মেহমানদারির দিকে লক্ষ রাখা একটি ঈমানী দায়িত্ব। ইসলামে অতিথির যে ‘হক’র কথা বলা হয়েছে, লোকে সাধারণত তা দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের হক বুঝে থাকে। মূল ব্যাপার তা নয়। আত্মীয়ের হক আলাদা এবং ইবনুস্ সাবীলের হকও আলাদা। ইবনুস্ সাবীল হলো ওই পথিক ও মুসাফির, যে সফরকালে কারও বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরূপ ব্যক্তি অতিথিরূপে ভালো ব্যবহারের হকদার হয়ে যায়। এমনিভাবে কোনও মুসাফির ও পথিক প্রখর রোদ, ঝড়-বাদল বা অন্ধকার রাতে সামনে চলতে অক্ষম হয়ে কোনও বাড়ির দরজায় পৌঁছলে সে বাড়ির লোকজনের কর্তব্য আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে আশ্রয় দেওয়া ও তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা। এটা তাদের কাছে সেই পথিক ও মুসাফিরের প্রাপ্য।
৯. দাস-দাসী ও শ্রমিক-কর্মচারীর হক আদায়
নবম শ্রেণী হলো দাস-দাসী। আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ (এবং নিজেদের দাস-দাসীদের প্রতিও)। এর আক্ষরিক অর্থ- তোমাদের হাত যাদের মালিকানা লাভ করেছে। বোঝানো উদ্দেশ্য ওই সকল গোলাম-বাঁদীকে, যারা মনিবের মালিকানাধীন থাকে, মনিব যাদেরকে বেচাকেনা করার অধিকারও রাখে। ইসলামে এটা অনুমোদিত। তবে ইসলামের দাসপ্রথা ও পশ্চিমা বিশ্বের অধুনালুপ্ত দাসপ্রথা এক জিনিস নয়। ইসলামের দাসপ্রথা কেবলই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তাদের প্রতি আচার- আচরণ সম্পর্কিত ইসলামী বিধানও সম্পূর্ণ মানবিক। গভীরভাবে লক্ষ করলে ইসলামের দাসপ্রথা—নামেই যা দাসপ্রথা। বাস্তবিকপক্ষে দাস-দাসীগণ ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরই অংশ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ
‘দাস-দাসীগণ তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। কাজেই আল্লাহ তাআলা তার যে ভাইকে তার অধীন করেছেন, তার প্রতি তার কর্তব্য হচ্ছে নিজে যা খাবে তাকে তাই খাওয়াবে, নিজে যা পরবে তাকে তাই পরাবে, তার সাধ্যের বাইরে কোনও কাজের বোঝা তার উপর চাপাবে না, যদি সাধ্যের বাইরে কোনও কাজ তার উপর চাপায়, তবে সে কাজে নিজে তার সাহায্য করবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৬৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১৪০৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৯৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৭৫)
অপর এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لِلْمَمْلُوكِ طَعَامُهُ وَكِسْوَتُهُ، وَلَا يُكَلِّفُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا يُطِيقُ
‘দাস-দাসীর খাদ্য ও পোশাকের দায়িত্ব তার মনিবের উপর। মনিবের আরও কর্তব্য হলো তার উপর তার ক্ষমতার বেশি কাজের বোঝা না চাপানো।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬২; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং১৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৩৬৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩১৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৭২: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮১৯৭)
ইসলামে দাস-দাসীকে মারপিট করা সম্পূর্ণ নিষেধ। একবার বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ মাসউদ আনসারী রাযি, তাঁর এক গোলামকে পেটাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি পেছন থেকে আওয়াজ শুনতে পান আবূ মাস'উদ। জেনে রেখ, ওর উপর তোমার যতটুকু ক্ষমতা, তারচে' তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশি। আওয়াজ শুনে তিনি পেছন দিকে ফিরে তাকান। দেখতে পান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই গোলামটিকে আযাদ করে দেন। তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ للفَحَتْكَ النَّارُ، أَوْ لَمَسَّكَ النَّارُ
‘শোন! তুমি যদি এরূপ না করতে, তবে অবশ্যই আগুন তোমাকে গ্রাস করত। কিংবা বলেছেন, অবশ্যই আগুন তোমাকে স্পর্শ করত।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৫৯; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৭১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮২০৮)
এই হচ্ছে ইসলামে দাস-দাসীর অধিকার। এই হচ্ছে দাস-দাসীর প্রতি আচার- আচরণে ইসলামের শিক্ষা। পক্ষান্তরে পশ্চিমা বিশ্বে যে দাসপ্রথা চালু ছিল, তা ছিল নিতান্তই নিপীড়ন। তাতে নিয়ম-নীতির কোনও বালাই ছিল না। জোর জুলুম করে অসহায় স্বাধীন লোকদেরকেই দাস-দাসীরূপে ব্যবহার করা হতো। তারা তো এখনও তাদের আধিপত্যভুক্ত দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি দাস-দাসীসুলভ আচরণই করে থাকে। তাদের জন্য তারা ‘দাস’ শব্দটি ব্যবহার করে না বটে, কিন্তু কার্যত তারা তাদেরকে দাসত্বের শেকলেই আবদ্ধ করে রেখেছে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের দাসপ্রথাকে বিবেচনা করা মোটেই সুবিচার নয় ।
প্রকাশ থাকে যে, যদিও আয়াতে সরাসরি দাস-দাসীর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপকার্থে শ্রমিক, কর্মচারী ও গৃহকর্মীরাও এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। তাদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য। যথাসময়ে তাদের পারিশ্রমিক আদায় করতে হবে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাতে গড়িমসি করলে তা জুলুম বলে গণ্য হবে। তাদের প্রতি কথাবার্তায় কোমলতা প্রদর্শন করা ও আচার-আচরণে সহানুভূতিশীল থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। গালাগাল করা, রূঢ় ভাষা ব্যবহার করা ও কঠিন-কঠোর আচরণ করা ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মোটকথা তাদের প্রতি আচার-আচরণ করতে হবে পুরোপুরি মানবিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا صَنَعَ لأَحَدِكُمْ خَادِمُهُ طَعَامَهُ ، ثُمَّ جَاءَهُ بِهِ ، وَقَدْ وَلِيَ حَرَّهُ وَدُخَانَهُ ، فَلْيُقْعِدْهُ مَعَهُ ، فَلْيَأْكُلْ ، فَإِنْ كَانَ الطَّعَامُ مَشْفُوهًا قَلِيلاً ، فَلْيَضَعْ فِي يَدِهِ مِنْهُ أُكْلَةً ، أَوْ أُكْلَتَيْنِ
‘তোমাদের কারও জন্যে তার খাদেম যখন আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করে খানা পাকাবে, তখন সে যেন তাকে নিজের সঙ্গে বসিয়ে খানা খাওয়ায়। খানার পরিমাণ যদি খুব কম হয়, তবে অন্ততপক্ষে তার হাতে দুই-এক লোকমা অবশ্যই তুলে দেবে।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৬৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৮৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৭২৬)
একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা চাকরদের কতবার ক্ষমা করব? তিনি নীরব থাকলেন। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল। এবারও তিনি নীরব থাকলেন। সে তৃতীয়বার একই কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন-
كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِينَ مَرَّةً
‘তাকে রোজ সত্তরবার ক্ষমা করবে।’ (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৬৪; মুসনাদে আহমাদ,
হাদীছ নং ৫৮১৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৭৯৮)
প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব
হাদীছ নং : ৩০৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জিবরীল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে উপদেশ দিতে থাকেন। এমনকি আমার মনে হলো, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন-বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৬৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৫৭৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৫৪১৬; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৬৮)
হাদীছ নং : ৩০৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জিবরীল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে উপদেশ দিতে থাকেন। এমনকি আমার মনে হলো, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন-বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৫১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৪২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৬৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৫৭৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৫৪১৬; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৬৮)
39 - باب حق الجار والوصية بِهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاعْبُدُوا اللهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ} [النساء: 36].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاعْبُدُوا اللهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ} [النساء: 36].
303 - وعن ابن عمر وعائشة رضي الله عنهما، قالا: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَا زَالَ جِبْريلُ يُوصِيني بِالجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أنَّهُ سَيُورِّثُهُ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবেশীর হক যে কত বড়, সেদিকে উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম একের পর এক তাঁকে প্রতিবেশী সম্পর্কে আদেশ-উপদেশ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁর ধারণা হয়ে যায় যে, প্রতিবেশীকে বুঝি ওয়ারিশই বানিয়ে দেওয়া হবে। ইসলামে মৃত ব্যক্তির মীরাছ ও উত্তরাধিকার লাভ করে তার নিকটাত্মীয়। তো উপর্যুপরি আদেশ-উপদেশের দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে হচ্ছিল প্রতিবেশীকেও হয়তো নিকটাত্মীয়ের পর্যায়ভুক্ত বানিয়ে দেওয়া হবে। যদিও বাস্তবে সেরকম করা হয়নি, কিন্তু এর দ্বারা অনুমান করা যায় প্রতিবেশীর মর্যাদা কত উচ্চে এবং তার হক কত বড়।
বিদায় হজ্জের ভাষণেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হযরত আবূ উমামা রাযি. বলেন-
سمعت رسول الله ﷺ وهو على ناقته الجدعاء في حجة الوداع، يقول: «أوصيكم بالجار حتى أكثر، فقلت: إنه ليورثة
“আমি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর উটনী আল জাদ’আর উপর সাওয়ার অবস্থায় বলতে শুনেছি- আমি তোমাদেরকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করছি। তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকেন। আর আমি মনে মনে বললাম, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।১৮
বস্তুত প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা ও তার প্রতি সদ্ব্যবহার করা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এমনকি এ গুরুত্ব জাহিলী যুগের আরবগণও উপলব্ধি করত। কিন্তু আজ ঈমান ও ইসলামের দাবিদারদের কাছেও এটি এক অবহেলিত বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন।
এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর হক হলো সে তার জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতিসাধন হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। এছাড়া তার অনাহারের কষ্ট দূর করা, বিপদে সাহায্য করা ও রোগ-ব্যাধিতে সেবাযত্ন করাও অবশ্যপালনীয় হক। সে অমুসলিম হলে তাকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়াও তার অধিকার। অবশ্য সে দাওয়াত গ্রহণ করার পক্ষে সদাচরণ বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে যদি তাকে উপহার উপঢৌকন দেওয়া হয়, তাও নেককাজরূপেই গণ্য হবে। বিশেষত ভালো খাবার-দাবারে তাকে তো শরীক রাখাই চাই। আলোচ্য হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, কোনও এক রাতে তাঁর গোলাম একটি ছাগল যবাহ করে তার চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তখন ইবন উমর রাযি. তাকে লক্ষ্য করে বলেন, এ ছাগলের গোশত থেকে সর্বপ্রথম একটা অংশ আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে দিও। তিনি এ কথাটি আরও কয়েকবার বললেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, আপনি ইহুদী লোকটির কথা আর কতবার বলবেন? এর উত্তরে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করে শোনান।
প্রতিবেশীকে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করাও অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি হিকমত ও মমত্ববোধের সঙ্গে করা বাঞ্ছনীয়।
প্রতিবেশীর কোনও দোষ জানতে পারলে অপর প্রতিবেশীর কর্তব্য তা গোপন রাখা এবং নম্রতার সঙ্গে বোঝানো যাতে সেই দোষটি আর না করে। বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে বিরত না হলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেবে। মোটকথা তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই করা চাই।
যেসকল আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রতিবেশী কষ্ট পায়, তা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। অনেকে এমন এমন কাজ করে, যা রীতিমত উত্যক্তকর। এটা ইসলামী প্রতিবেশিত্বের পরিচায়ক নয়।
প্রতিবেশীকে সালাম দেওয়া, হাদিয়া প্রদান করা, দেখা-সাক্ষাতকালে হাসিমুখে কথা বলা, তার খোঁজখবর নেওয়া, তার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ তার প্রতি সদাচরণের অন্তর্ভুক্ত। মুমিন প্রতিবেশীর এগুলো অবশ্যই করা উচিত।
প্রতিবেশীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো শুফ'আ। অর্থাৎ এক প্রতিবেশী যদি তার স্থাবর সম্পদ বিক্রি করতে চায়, তবে শরীআতের দৃষ্টিতে অপর প্রতিবেশী তা ক্রয়ের অগ্রাধিকার রাখে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الجار أحق بسقبه ‘প্রতিবেশী তার সংলগ্ন ভূমির বেশি হকদার।১৯
এ মর্মে আরও বহু হাদীছ আছে। বিস্তারিত বিধানাবলীর জন্য ফিকহী গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটির প্রধান শিক্ষা তো প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে। এর দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিবেশীর অধিকার অনেক বড়। প্রত্যেক মুসলিমের তা আদায়ে যত্নবান থাকা চাই।
খ. আরও জানা গেল ধারণামাত্রই খারাপ নয়। যদি কারও সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা হয় তা দোষের নয়। মন্দ ধারণাই দোষের।
গ. অন্তরে যদি কোনও ভালো চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত হয়, তবে তা প্রকাশ করা যেতে পারে, তাতে দোষের কিছু নেই।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল উত্তরাধিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কাজেই এ ব্যাপারে শরীআতের নীতিমালা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই।
১৮. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫২৩; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ২২৫
১৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২২৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৫১৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৭০২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪৯৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৩৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৪৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীছ নং ১৪৩৮০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২২৭২৯
বিদায় হজ্জের ভাষণেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হযরত আবূ উমামা রাযি. বলেন-
سمعت رسول الله ﷺ وهو على ناقته الجدعاء في حجة الوداع، يقول: «أوصيكم بالجار حتى أكثر، فقلت: إنه ليورثة
“আমি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর উটনী আল জাদ’আর উপর সাওয়ার অবস্থায় বলতে শুনেছি- আমি তোমাদেরকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করছি। তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকেন। আর আমি মনে মনে বললাম, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।১৮
বস্তুত প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা ও তার প্রতি সদ্ব্যবহার করা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এমনকি এ গুরুত্ব জাহিলী যুগের আরবগণও উপলব্ধি করত। কিন্তু আজ ঈমান ও ইসলামের দাবিদারদের কাছেও এটি এক অবহেলিত বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন।
এক প্রতিবেশীর উপর অপর প্রতিবেশীর হক হলো সে তার জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতিসাধন হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। এছাড়া তার অনাহারের কষ্ট দূর করা, বিপদে সাহায্য করা ও রোগ-ব্যাধিতে সেবাযত্ন করাও অবশ্যপালনীয় হক। সে অমুসলিম হলে তাকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়াও তার অধিকার। অবশ্য সে দাওয়াত গ্রহণ করার পক্ষে সদাচরণ বেশি সহায়ক হয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে যদি তাকে উপহার উপঢৌকন দেওয়া হয়, তাও নেককাজরূপেই গণ্য হবে। বিশেষত ভালো খাবার-দাবারে তাকে তো শরীক রাখাই চাই। আলোচ্য হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, কোনও এক রাতে তাঁর গোলাম একটি ছাগল যবাহ করে তার চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তখন ইবন উমর রাযি. তাকে লক্ষ্য করে বলেন, এ ছাগলের গোশত থেকে সর্বপ্রথম একটা অংশ আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে দিও। তিনি এ কথাটি আরও কয়েকবার বললেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, আপনি ইহুদী লোকটির কথা আর কতবার বলবেন? এর উত্তরে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করে শোনান।
প্রতিবেশীকে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করাও অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি হিকমত ও মমত্ববোধের সঙ্গে করা বাঞ্ছনীয়।
প্রতিবেশীর কোনও দোষ জানতে পারলে অপর প্রতিবেশীর কর্তব্য তা গোপন রাখা এবং নম্রতার সঙ্গে বোঝানো যাতে সেই দোষটি আর না করে। বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে বিরত না হলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেবে। মোটকথা তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সকল চেষ্টাই করা চাই।
যেসকল আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় প্রতিবেশী কষ্ট পায়, তা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। অনেকে এমন এমন কাজ করে, যা রীতিমত উত্যক্তকর। এটা ইসলামী প্রতিবেশিত্বের পরিচায়ক নয়।
প্রতিবেশীকে সালাম দেওয়া, হাদিয়া প্রদান করা, দেখা-সাক্ষাতকালে হাসিমুখে কথা বলা, তার খোঁজখবর নেওয়া, তার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ তার প্রতি সদাচরণের অন্তর্ভুক্ত। মুমিন প্রতিবেশীর এগুলো অবশ্যই করা উচিত।
প্রতিবেশীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো শুফ'আ। অর্থাৎ এক প্রতিবেশী যদি তার স্থাবর সম্পদ বিক্রি করতে চায়, তবে শরীআতের দৃষ্টিতে অপর প্রতিবেশী তা ক্রয়ের অগ্রাধিকার রাখে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الجار أحق بسقبه ‘প্রতিবেশী তার সংলগ্ন ভূমির বেশি হকদার।১৯
এ মর্মে আরও বহু হাদীছ আছে। বিস্তারিত বিধানাবলীর জন্য ফিকহী গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটির প্রধান শিক্ষা তো প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে। এর দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিবেশীর অধিকার অনেক বড়। প্রত্যেক মুসলিমের তা আদায়ে যত্নবান থাকা চাই।
খ. আরও জানা গেল ধারণামাত্রই খারাপ নয়। যদি কারও সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা হয় তা দোষের নয়। মন্দ ধারণাই দোষের।
গ. অন্তরে যদি কোনও ভালো চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত হয়, তবে তা প্রকাশ করা যেতে পারে, তাতে দোষের কিছু নেই।
ঘ. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল উত্তরাধিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কাজেই এ ব্যাপারে শরীআতের নীতিমালা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই।
১৮. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫২৩; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ২২৫
১৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২২৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৫১৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৭০২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪৯৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৩৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৪৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীছ নং ১৪৩৮০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২২৭২৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
