রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২৮৯
অধ্যায়ঃ ৩৬
পরিবার-পরিজনের উপর অর্থব্যয়
প্রত্যেকের দায়িত্বে তার পরিবার-পরিজন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমানতস্বরূপ। তাদের যথাযথ প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করার উপর আখেরাতের মুক্তি নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করবেন সে তার এ দায়িত্ব কতটুকু সঠিকভাবে পালন করেছে। অনেকেই এটা কেবলই দুনিয়াবী বিষয় মনে করে। ফলে পরিবার-পরিজনের প্রতি নিজ খেয়াল-খুশি অনুযায়ী আচরণ করে। কেউ তো দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করে, আবার কেউ অন্যসব দায়িত্বে অবহেলা করে কেবল পরিবার-পরিজন নিয়েই থাকে। যেন এর বাইরে আর কোনও যিম্মাদারী নেই। এ উভয়রকম প্রান্তিকতা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলাম পরিবার-পরিজনের হক আদায়কে প্রথম স্থানে রেখেছে। সেইসঙ্গে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যান্য মানুষের হক আদায়ের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। উৎসাহ দিয়েছে দীনের বহুমুখী খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে। এটা ইসলামী শিক্ষার ভারসাম্য। ইসলামী শিক্ষার অনুসারীগণ যাতে এ ভারসাম্য না হারায়, সে লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছ তাদেরকে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দান করেছে।এ অধ্যায়ে ইমাম নববী রহ. সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
‘পরিবার-পরিজনের উপর অর্থব্যয়’ সংক্রান্ত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
অর্থ : ‘সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোশের ভার বহন করা।৩৬৭
ব্যাখ্যা
দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে তখন শিশুটির দুধপানের কী ব্যবস্থা হবে, এ আয়াতে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আয়াতটির শুরুতে বলা হয়েছে-
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ
‘মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু'বছর দুধ পান করাবে। (এ সময়কাল) তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়।'
এর দ্বারা বোঝা গেল শিশুর দুধপানের পূর্ণ মেয়াদ দু'বছর। আরও জানা গেল এ দু'বছর দুধ পান করানোর মূল দায়িত্ব মায়ের। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটা সত্ত্বেও নৈতিকভাবে সে এ দায়িত্ব পালনে বাধ্য। বিনা ওজরে কিংবা তালাকদাতা স্বামীর প্রতি জিদবশত দুধ পান না করালে সে গুনাহগার হবে। অবশ্য বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ায় ইদ্দতকালীন খোরপোশ ছাড়া স্বামীর কাছে অন্য কোনও আর্থিক সহযোগিতা তার প্রাপ্য নয়। তাই দুধপানের মেয়াদে দুধ পান করানো বাবদ স্বামীর কাছ থেকে সে বিনিময় গ্রহণ করতে পারবে। বিবাহ বহাল থাকাকালে তার এ বাবদ কোনও বিনিময় গ্রহণের অধিকার থাকে না। আয়াতটির পরবর্তী বাক্যে, যা এ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিনিময়ের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে-
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
(সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোশের ভার বহন করা)। লক্ষণীয়, আয়াতটির শুরুতে 'মা'-এর জন্য শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল الْوَالِدَاتُ (মায়েরা)। সে হিসেবে “পিতা”-এর জন্য এখানে الْوَالِد শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার কথা। তার বদলে الْمَوْلُودِ لَهُ (সন্তানটি যার) শব্দ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য পিতাকে খোরপোশের ভার বহনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা এবং তা বহন করা তার জন্য সহজসাধ্য করে তোলা।
প্রকৃতপক্ষে শিশুটি পিতামাতা উভয়ের সম্মিলিত ধন। এখন পিতামাতার মধ্যে যেহেতু বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তখন তার দুধপান করানো বাবদ খরচা বহনের ভার একা পিতা বহন করতে চাপ বোধ করতে পারে। সে বলতে পারে, আমি একা কেন বহন করব, দুজনকেই এটা বহন করতে হবে। কাজেই আমি তার মায়ের খোরপোশ পুরোটা নয়; বরং অর্ধেকটা দেব। এই চাপ যাতে সে বোধ না করে, তাই শুরুতে বলে দেওয়া হয়েছে الْمَوْلُودِ لَهُ (সন্তানটি যার)। অর্থাৎ সৃষ্টিগতভাবে সন্তানটি পিতামাতা উভয়ের হলেও সামাজিক পরিচয়ে তাকে পিতারই সন্তান বলা হয়ে থাকে। সে পরিচিত হয় পিতৃপরিচয়েই, যে কারণে দুধপানের পরবর্তী সব যিম্মাদারী পিতার উপরই আসে। সেদিক থেকে শিশুটি যখন তার, তখন তার দুধপান বাবদ মায়ের খোরপোশও তাকেই দিতে হবে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলে পিতার পক্ষে তা বহন করা আসান হয়ে যায়। সে লক্ষ্যেই শব্দটির ব্যবহার।
বলা হয়েছে মায়ের খোরপোশ পিতা বহন করবে ন্যায়সঙ্গতভাবে অর্থাৎ পিতার সামর্থ্য অনুযায়ী। সামর্থ্যের বাইরে তাকে চাপ দেওয়া যাবে না। আবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এমন নিম্নমানের দেবে না, যা তার মায়ের পক্ষে অসম্মানজনক হয়।
আয়াতটির মূলকথা হল পারিবারিক খরচার যিম্মাদারী পিতার উপর। পিতা হিসেবে পরিবারবর্গের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তারই। এটা যেমন বিবেক-বুদ্ধির দাবি, তেমনি এটা শরীআতেরও হুকুম।
দুই নং আয়াত
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
অর্থ : ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচা দেবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচা দেবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।৩৬৮
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ শিশুর প্রতিপালন বাবদ যা-কিছু খরচ হয়, তা বহনের দায়িত্ব পিতারই। এ ক্ষেত্রে পিতার সামর্থ্য বিবেচ্য। সচ্ছল হলে সে সচ্ছলতা অনুযায়ী ব্যয় করবে, আর অসচ্ছল হলে সে ক্ষেত্রেও তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব কেবল তাই করবে। এর বেশি করতে সে বাধ্য নয়। সেরকম চাপও তাকে দেওয়া বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা কাউকে দিয়ে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা বহন করান না। শরীআতের যাবতীয় বিধানেই বান্দার শক্তি-ক্ষমতার দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কাজেই পরিবারের সদস্যবর্গকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। নিজেদের খেয়াল-খুশিমত তার উপর চাপ সৃষ্টি করলে তা জুলুমেরই নামান্তর হবে। অপরপক্ষে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও পরিবার-পরিজনের ন্যায্য খরচ বহন করতে কার্পণ্য করাও উচিত নয়। তাদেরকে অহেতুক কষ্ট দেওয়াও জুলুম বৈকি। আল্লাহ তাআলা যখন তাকে সচ্ছলতা দান করেছেন, তখন তাদের উপর এ জুলুম শুধু শুধু করবে কেন? সচ্ছলতা অনুযায়ী ব্যয় করাটাও একরকম শোকর আদায়। এটা আল্লাহ তাআলা পসন্দ করেন। দোষ হচ্ছে অপচয় করা ও অহমিকা দেখানো। তা থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
অর্থ : ‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।৩৬৯
ব্যাখ্যা :
আয়াতটির শুরুতে আছে-
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ
‘বল, আমার প্রতিপালক নিজ বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযিকের প্রাচুর্য দান করেন এবং (যার জন্য ইচ্ছা) তা সংকীর্ণ করে দেন।'
অর্থাৎ সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা আল্লাহ তাআলারই দান। তিনি যাকে ইচ্ছা গরীব বানান, যাকে ইচ্ছা ফকীর। আবার তিনি নিজ ইচ্ছামত অবস্থা পরিবর্তনও করে দেন। ফলে একসময়ের চরম ফকীর প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যায়। অন্যদিকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক নিঃস্ব-কপর্দকহীন হয়ে পড়ে। তো ঐশ্বর্যের চাবিকাঠি যখন আল্লাহ তাআলার হাতে, তখন না নিজ ঐশ্বর্যের উপর ভরসা করা উচিত, আর না উচিত নিজ দারিদ্র্যের কারণে অসহায় বোধ করা। সর্বাবস্থায় কর্তব্য আল্লাহর দিকে রুজু' থাকা এবং তাঁর উপর ভরসা করে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করতে থাকা। আয়াতের দ্বিতীয় অংশে সে উৎসাহই দান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
(তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন)।
অর্থাৎ খরচ করলে সম্পদ কমে যাবে ও অভাবে পড়ে যাবে এ ভয় করো না। খরচ করলে রিযিক কমে না। আল্লাহ তাআলা যার ভাগ্যে যা রেখেছেন তা সে পাবেই। বরং খরচ করলেই লাভ। আল্লাহর হুকুম মোতাবেক খরচ করার দ্বারা অর্থ-সম্পদে বরকত হয় এবং আখেরাতে ছাওয়াব পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে, 'তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন' এ দেওয়াটা আখেরাতের ছাওয়াব আকারেও হতে পারে এবং দুনিয়াবী বদলাও হতে পারে। খরচ করার দ্বারা মনের ঐশ্বর্য তো লাভ হয়ই, যা কিনা প্রকৃত ঐশ্বর্য। সেইসঙ্গে লাভ হয় বরকতও। বরকত হওয়ার মানে অল্প খরচেই অনেক বড় প্রয়োজন মিটে যাওয়া, অহেতুক খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া, যা খরচ হয় তা বৃথা না যাওয়া; বরং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয় তা অর্জিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব অর্জন খরচ করার দ্বারাই হয়। খরচ না করলে এর থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-
أَنْفِقْ يَا بِلَالُ، وَلَا تَخْشَ مِنْ ذِي الْعَرْشِ إِقْلَالًا
‘হে বেলাল! খরচ কর। আরশওয়ালার কাছ থেকে কমানোর ভয় করো না।৩৭০
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর কন্যা হযরত আসমা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বিবাহকালে যুবায়র রাযি. আমাকে যে মাহর দিয়েছিলেন, আমার সম্পদ বলতে কেবল তাই। আমি তা থেকে কি কিছু দেব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-
نَعَمْ، وَلَا تُوكِي فَيُوْكَى عَلَيْكِ ، يَقُولُ: لَا تُحْصِي فَيُحْصَى عَلَيْكِ
‘হাঁ, তা থেকে খরচ কর। তা বেঁধে রেখ না, তাহলে তোমার থেকেও বেঁধে রাখা হবে। তা গুণবে না, তাহলে তোমাকেও গুণে গুণে দেওয়া হবে।৩৭১
৩৬৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৩৩
৩৬৮. সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭
৩৬৯. সূরা সাবা (৩৪), আয়াত ৩৯
৩৭০, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৩৯৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০২০
৩৭১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০২৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৬০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৪৭; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৪৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৯৭০
পরিবার-পরিজনের উপর অর্থব্যয়
প্রত্যেকের দায়িত্বে তার পরিবার-পরিজন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমানতস্বরূপ। তাদের যথাযথ প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করার উপর আখেরাতের মুক্তি নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করবেন সে তার এ দায়িত্ব কতটুকু সঠিকভাবে পালন করেছে। অনেকেই এটা কেবলই দুনিয়াবী বিষয় মনে করে। ফলে পরিবার-পরিজনের প্রতি নিজ খেয়াল-খুশি অনুযায়ী আচরণ করে। কেউ তো দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করে, আবার কেউ অন্যসব দায়িত্বে অবহেলা করে কেবল পরিবার-পরিজন নিয়েই থাকে। যেন এর বাইরে আর কোনও যিম্মাদারী নেই। এ উভয়রকম প্রান্তিকতা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলাম পরিবার-পরিজনের হক আদায়কে প্রথম স্থানে রেখেছে। সেইসঙ্গে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যান্য মানুষের হক আদায়ের প্রতিও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। উৎসাহ দিয়েছে দীনের বহুমুখী খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করতে। এটা ইসলামী শিক্ষার ভারসাম্য। ইসলামী শিক্ষার অনুসারীগণ যাতে এ ভারসাম্য না হারায়, সে লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছ তাদেরকে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দান করেছে।এ অধ্যায়ে ইমাম নববী রহ. সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
‘পরিবার-পরিজনের উপর অর্থব্যয়’ সংক্রান্ত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
অর্থ : ‘সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোশের ভার বহন করা।৩৬৭
ব্যাখ্যা
দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে তখন শিশুটির দুধপানের কী ব্যবস্থা হবে, এ আয়াতে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আয়াতটির শুরুতে বলা হয়েছে-
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ
‘মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু'বছর দুধ পান করাবে। (এ সময়কাল) তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়।'
এর দ্বারা বোঝা গেল শিশুর দুধপানের পূর্ণ মেয়াদ দু'বছর। আরও জানা গেল এ দু'বছর দুধ পান করানোর মূল দায়িত্ব মায়ের। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটা সত্ত্বেও নৈতিকভাবে সে এ দায়িত্ব পালনে বাধ্য। বিনা ওজরে কিংবা তালাকদাতা স্বামীর প্রতি জিদবশত দুধ পান না করালে সে গুনাহগার হবে। অবশ্য বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ায় ইদ্দতকালীন খোরপোশ ছাড়া স্বামীর কাছে অন্য কোনও আর্থিক সহযোগিতা তার প্রাপ্য নয়। তাই দুধপানের মেয়াদে দুধ পান করানো বাবদ স্বামীর কাছ থেকে সে বিনিময় গ্রহণ করতে পারবে। বিবাহ বহাল থাকাকালে তার এ বাবদ কোনও বিনিময় গ্রহণের অধিকার থাকে না। আয়াতটির পরবর্তী বাক্যে, যা এ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিনিময়ের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে-
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
(সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোশের ভার বহন করা)। লক্ষণীয়, আয়াতটির শুরুতে 'মা'-এর জন্য শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল الْوَالِدَاتُ (মায়েরা)। সে হিসেবে “পিতা”-এর জন্য এখানে الْوَالِد শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার কথা। তার বদলে الْمَوْلُودِ لَهُ (সন্তানটি যার) শব্দ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য পিতাকে খোরপোশের ভার বহনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা এবং তা বহন করা তার জন্য সহজসাধ্য করে তোলা।
প্রকৃতপক্ষে শিশুটি পিতামাতা উভয়ের সম্মিলিত ধন। এখন পিতামাতার মধ্যে যেহেতু বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তখন তার দুধপান করানো বাবদ খরচা বহনের ভার একা পিতা বহন করতে চাপ বোধ করতে পারে। সে বলতে পারে, আমি একা কেন বহন করব, দুজনকেই এটা বহন করতে হবে। কাজেই আমি তার মায়ের খোরপোশ পুরোটা নয়; বরং অর্ধেকটা দেব। এই চাপ যাতে সে বোধ না করে, তাই শুরুতে বলে দেওয়া হয়েছে الْمَوْلُودِ لَهُ (সন্তানটি যার)। অর্থাৎ সৃষ্টিগতভাবে সন্তানটি পিতামাতা উভয়ের হলেও সামাজিক পরিচয়ে তাকে পিতারই সন্তান বলা হয়ে থাকে। সে পরিচিত হয় পিতৃপরিচয়েই, যে কারণে দুধপানের পরবর্তী সব যিম্মাদারী পিতার উপরই আসে। সেদিক থেকে শিশুটি যখন তার, তখন তার দুধপান বাবদ মায়ের খোরপোশও তাকেই দিতে হবে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলে পিতার পক্ষে তা বহন করা আসান হয়ে যায়। সে লক্ষ্যেই শব্দটির ব্যবহার।
বলা হয়েছে মায়ের খোরপোশ পিতা বহন করবে ন্যায়সঙ্গতভাবে অর্থাৎ পিতার সামর্থ্য অনুযায়ী। সামর্থ্যের বাইরে তাকে চাপ দেওয়া যাবে না। আবার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এমন নিম্নমানের দেবে না, যা তার মায়ের পক্ষে অসম্মানজনক হয়।
আয়াতটির মূলকথা হল পারিবারিক খরচার যিম্মাদারী পিতার উপর। পিতা হিসেবে পরিবারবর্গের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তারই। এটা যেমন বিবেক-বুদ্ধির দাবি, তেমনি এটা শরীআতেরও হুকুম।
দুই নং আয়াত
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
অর্থ : ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচা দেবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, (অর্থাৎ যে গরীব) সে আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচা দেবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার উপর অর্পণ করেন না।৩৬৮
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ শিশুর প্রতিপালন বাবদ যা-কিছু খরচ হয়, তা বহনের দায়িত্ব পিতারই। এ ক্ষেত্রে পিতার সামর্থ্য বিবেচ্য। সচ্ছল হলে সে সচ্ছলতা অনুযায়ী ব্যয় করবে, আর অসচ্ছল হলে সে ক্ষেত্রেও তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব কেবল তাই করবে। এর বেশি করতে সে বাধ্য নয়। সেরকম চাপও তাকে দেওয়া বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা কাউকে দিয়ে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা বহন করান না। শরীআতের যাবতীয় বিধানেই বান্দার শক্তি-ক্ষমতার দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কাজেই পরিবারের সদস্যবর্গকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। নিজেদের খেয়াল-খুশিমত তার উপর চাপ সৃষ্টি করলে তা জুলুমেরই নামান্তর হবে। অপরপক্ষে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও পরিবার-পরিজনের ন্যায্য খরচ বহন করতে কার্পণ্য করাও উচিত নয়। তাদেরকে অহেতুক কষ্ট দেওয়াও জুলুম বৈকি। আল্লাহ তাআলা যখন তাকে সচ্ছলতা দান করেছেন, তখন তাদের উপর এ জুলুম শুধু শুধু করবে কেন? সচ্ছলতা অনুযায়ী ব্যয় করাটাও একরকম শোকর আদায়। এটা আল্লাহ তাআলা পসন্দ করেন। দোষ হচ্ছে অপচয় করা ও অহমিকা দেখানো। তা থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
অর্থ : ‘তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন।৩৬৯
ব্যাখ্যা :
আয়াতটির শুরুতে আছে-
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ
‘বল, আমার প্রতিপালক নিজ বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযিকের প্রাচুর্য দান করেন এবং (যার জন্য ইচ্ছা) তা সংকীর্ণ করে দেন।'
অর্থাৎ সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা আল্লাহ তাআলারই দান। তিনি যাকে ইচ্ছা গরীব বানান, যাকে ইচ্ছা ফকীর। আবার তিনি নিজ ইচ্ছামত অবস্থা পরিবর্তনও করে দেন। ফলে একসময়ের চরম ফকীর প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যায়। অন্যদিকে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক নিঃস্ব-কপর্দকহীন হয়ে পড়ে। তো ঐশ্বর্যের চাবিকাঠি যখন আল্লাহ তাআলার হাতে, তখন না নিজ ঐশ্বর্যের উপর ভরসা করা উচিত, আর না উচিত নিজ দারিদ্র্যের কারণে অসহায় বোধ করা। সর্বাবস্থায় কর্তব্য আল্লাহর দিকে রুজু' থাকা এবং তাঁর উপর ভরসা করে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করতে থাকা। আয়াতের দ্বিতীয় অংশে সে উৎসাহই দান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ
(তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, তিনি তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন)।
অর্থাৎ খরচ করলে সম্পদ কমে যাবে ও অভাবে পড়ে যাবে এ ভয় করো না। খরচ করলে রিযিক কমে না। আল্লাহ তাআলা যার ভাগ্যে যা রেখেছেন তা সে পাবেই। বরং খরচ করলেই লাভ। আল্লাহর হুকুম মোতাবেক খরচ করার দ্বারা অর্থ-সম্পদে বরকত হয় এবং আখেরাতে ছাওয়াব পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে, 'তদস্থলে অন্য জিনিস দিয়ে দেন' এ দেওয়াটা আখেরাতের ছাওয়াব আকারেও হতে পারে এবং দুনিয়াবী বদলাও হতে পারে। খরচ করার দ্বারা মনের ঐশ্বর্য তো লাভ হয়ই, যা কিনা প্রকৃত ঐশ্বর্য। সেইসঙ্গে লাভ হয় বরকতও। বরকত হওয়ার মানে অল্প খরচেই অনেক বড় প্রয়োজন মিটে যাওয়া, অহেতুক খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া, যা খরচ হয় তা বৃথা না যাওয়া; বরং যে উদ্দেশ্যে খরচ করা হয় তা অর্জিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব অর্জন খরচ করার দ্বারাই হয়। খরচ না করলে এর থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত বিলাল রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-
أَنْفِقْ يَا بِلَالُ، وَلَا تَخْشَ مِنْ ذِي الْعَرْشِ إِقْلَالًا
‘হে বেলাল! খরচ কর। আরশওয়ালার কাছ থেকে কমানোর ভয় করো না।৩৭০
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর কন্যা হযরত আসমা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বিবাহকালে যুবায়র রাযি. আমাকে যে মাহর দিয়েছিলেন, আমার সম্পদ বলতে কেবল তাই। আমি তা থেকে কি কিছু দেব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-
نَعَمْ، وَلَا تُوكِي فَيُوْكَى عَلَيْكِ ، يَقُولُ: لَا تُحْصِي فَيُحْصَى عَلَيْكِ
‘হাঁ, তা থেকে খরচ কর। তা বেঁধে রেখ না, তাহলে তোমার থেকেও বেঁধে রাখা হবে। তা গুণবে না, তাহলে তোমাকেও গুণে গুণে দেওয়া হবে।৩৭১
৩৬৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৩৩
৩৬৮. সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ৭
৩৬৯. সূরা সাবা (৩৪), আয়াত ৩৯
৩৭০, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৩৯৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০২০
৩৭১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০২৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৬০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৪৭; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৪৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৯৭০
পরিবার-পরিজনের মৌলিক চাহিদা পুরণের জন্য অর্থব্যয়ই শ্রেষ্ঠ অর্থব্যয়
হাদীছ নং : ২৮৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তুমি একটি দীনার আল্লাহর পথে খরচ করেছ, একটি দীনার দাসমুক্তিতে ব্যয় করেছ, একটি দীনার মিসকীনকে দান করেছ আর একটি দীনার পরিবার-পরিজনের উপর ব্যয় করেছ। এর মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সেই দীনার, যা তুমি পরিবারবর্গের উপর ব্যয় করেছ মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১০১১৯, নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩৯; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৭: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৪৩, বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৮
হাদীছ নং : ২৮৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তুমি একটি দীনার আল্লাহর পথে খরচ করেছ, একটি দীনার দাসমুক্তিতে ব্যয় করেছ, একটি দীনার মিসকীনকে দান করেছ আর একটি দীনার পরিবার-পরিজনের উপর ব্যয় করেছ। এর মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সেই দীনার, যা তুমি পরিবারবর্গের উপর ব্যয় করেছ মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১০১১৯, নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩৯; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৭: শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৪৩, বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৭৮
36 - باب النفقة عَلَى العيال
قَالَ الله تَعَالَى: {وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوف} [البقرة: 233]، وَقالَ تَعَالَى: {لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ لا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ مَا آتَاهَا} [الطلاق: 7]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُه} [سبأ: 39].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوف} [البقرة: 233]، وَقالَ تَعَالَى: {لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ لا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ مَا آتَاهَا} [الطلاق: 7]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُه} [سبأ: 39].
289 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «دِينَارٌ أنْفَقْتَهُ في سَبيلِ اللهِ، وَدِينار أنْفَقْتَهُ في رَقَبَةٍ، وَدِينارٌ تَصَدَّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِينٍ، وَدِينَارٌ أنْفَقْتَهُ عَلَى أهْلِكَ، أعْظَمُهَا أجْرًا الَّذِي أنْفَقْتَهُ عَلَى أهْلِكَ». رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছদু'টিতে চার রকম অর্থব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে আল্লাহর পথে ব্যয়। আল্লাহর পথে ব্যয়ের অর্থ জিহাদে ব্যয় করা। জিহাদে ব্যয় করার প্রধান দু'টি খাত হচ্ছে জিহাদের জন্য বাহন কেনা এবং সহযোদ্ধাদের পেছনে খরচ করা। দ্বিতীয় হাদীছে পৃথকভাবে এ দু'টি খাতকে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজে জিহাদে যাওয়ার জন্য আসবাবপত্র কেনা কিংবা নিজে যেতে না পারলে খরচা দিয়ে অন্যদের পাঠানোও জিহাদে ব্যয় করার অন্তর্ভুক্ত। এর সবটাই অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল।
আল্লাহর পথে খরচ দ্বারা ব্যাপক অর্থে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠামূলক যে-কোনও কাজে অর্থ ব্যয় করা এবং আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতায় টাকা-পয়সা খরচ করাও বোঝানো হতে পারে। এরকম অর্থব্যয়ও অনেক ছাওয়াবের কাজ। আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের ফযীলত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَة فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْف
“কেউ আল্লাহর পথে কিছু খরচ করলে তার বিনিময়ে তার জন্য সাতশ গুণ বেশি খরচের নেকী লেখা হয় (অর্থাৎ এক টাকা খরচ করলে সাতশ' টাকা খরচের ছাওয়াব পাওয়া যায়)।৩৭৪
দ্বিতীয় বলা হয়েছে দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা, যেমন কোনও গোলাম কিনে তাকে আযাদ করে দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে মনীবের সঙ্গে যে গোলামের মুক্তিচুক্তি (মুকাতাবা) সম্পন্ন হয়েছে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে তার চুক্তির অর্থ পরিশোধে সাহায্য করা ইত্যাদি। এটা বিপুল ছাওয়াবের কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً ، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُصْرٍ مِنْهُ عُضَوا مِنَ النَّارِ
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম গোলামকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তাআলা সে গোলামের প্রতি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রতি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখেন।৩৭৫
তৃতীয়ত গরীব-মিসকীনের উপর অর্থব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এটাও অনেক বড় নেকীর কাজ। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسَبُهُ قَالَ: وَكَالْقَائِم الَّذِي لا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ الَّذِي لَا يُفْطِرُ
‘হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত । (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।৩৭৬
পরিবারবর্গের পেছনে অর্থব্যয় যে কারণে শ্রেষ্ঠ
সবশেষে বলা হয়েছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থব্যয়ের কথা। এ চার প্রকার ব্যয়ের মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা, যেমন প্রথম হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন। দ্বিতীয় হাদীছে যে আল্লাহর পথে খরচকে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার মত শ্রেষ্ঠতম ব্যয় সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মানে দু'টো ব্যয়ই শ্রেষ্ঠতম ব্যয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। তবে সর্ববিচারে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করাটাই সর্বোত্তম, যেমনটা প্রথম হাদীছ দ্বারা জানা যায়।
পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করা সর্বোত্তম এ কারণে যে, এছাড়া বাকিগুলো সাধারণভাবে ওয়াজিব নয়, নফল ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। তা করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়, না করলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা ফরয। তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পরিবারের কর্তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে গুনাহ হয়। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيَّعَ مَنْ يَقُوْتُ
‘নিজ পোষ্যদের ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।৩৭৭
বলাবাহুল্য, যে-কোনও নফল আমলের চেয়ে ফরয আমলের ছাওয়ার অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে। পরিবারবর্গের পেছনে অর্থ ব্যয় করা যখন ফরয আর বাকিগুলো নফল, তখন সেগুলো অপেক্ষা পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করার ফযীলত বেশিই হবে বৈকি। সে কারণেই এ হাদীছে যে দীনারটি পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা হয়, সেটিকে অন্য তিন দীনার অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে।
একশ্রেণীর লোক কেবল জযবা দিয়ে চলে। তারা আবেগের তাড়নায় বিভিন্ন দীনী কাজে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি লক্ষ রাখে না। কেউ তো বিভিন্ন দীনী কাজে এমন মশগুল হয়ে থাকে যে, বউ-বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখারই অবকাশ হয় না। তারা খেয়ে থাকল না নাখেয়ে, তাদের চিকিৎসাহ হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। এটা একরকম বৈরাগ্য। ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এ শ্রেণীর লোককে আখেরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা পরিবার-পরিজন আমানতস্বরূপ। গৃহকর্তা তাদের দায়িত্বশীল। তাদের যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা আমানতের খেয়ানত করার শামিল। যে-কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমানতদারির সঙ্গে দায়িত্ব আদায় করেছে কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে হাদীছ মারফত আমাদের জানানো হয়েছে। অতএব কেবল জযবা দ্বারা নয়; বরং শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেকই চলা উচিত। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
উল্লেখ্য, পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার দ্বারা তাদের জরুরি ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কথাই বোঝানো উদ্দেশ্য। তাদের খেয়াল-খুশি ও অন্যায় আবদার মেটানোর ব্যয় এর মধ্যে পড়ে না। সেরকম ব্যয় ছাওয়াবের কাজ তো নয়ই; বরং কঠিন গুনাহ। এ ব্যাপারে প্রত্যেক গৃহকর্তার সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
পরিবারবর্গের প্রতি দু'রকম দায়িত্ব
প্রকাশ থাকে যে, পরিবার-পরিজনের প্রতি গৃহকর্তার দায়িত্ব-কর্তব্য দুইরকম। এক হচ্ছে দুনিয়াবী দায়িত্ব, আরেক দীনী দায়িত্ব। দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন করা অর্থাৎ তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যেমন ফরয, তেমনি দীনী দায়িত্ব পালনও ফরয বৈকি। দীনী দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে দীনের মৌলিক বিষয়াবলী শেখানো, যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ অন্যান্য বিশ্বাসের সঙ্গে তাদেরকে পরিচিত করা: নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের মাসাইল শিক্ষা দেওয়া; ওযূ-গোসল, পাক-পবিত্রতা, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত করা; পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হুকুক সম্পর্কে তালীম দেওয়া এবং ইসলামী আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিফহাল করা। এসব শেখানোর পাশাপাশি তারা যাতে এর উপর আমলে অভ্যস্ত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও জরুরি।
এ দায়িত্ব পালন করার জরুরত দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন অপেক্ষাও অনেক বেশি। পরিবার-পরিজনের দুনিয়াবী চাহিদা পূরণ না করলে তাতে তাদের ইহজীবনের ক্ষতি। এ ক্ষতি অনেক সীমিত। পক্ষান্তরে তাদের দীনী জরুরত পূরণ না করলে তাদের আখেরাতের ক্ষতি হয়। সে ক্ষতি অসীম। তাদের দুনিয়াবী ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য যে টাকা-পয়সা খরচ করা হয়, তা যদি জিহাদ ও গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান-খয়রাত করার চে'ও উত্তম হয়, তবে তাদের দীনী প্রয়োজন পূরণে যে টাকা-পয়সা খরচ করা হবে তার ফযীলত কত উচ্চ হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের মধ্যেই গাফলাতী লক্ষ করা যায়। এ গাফলাতী কিছুতেই কাম্য নয়।
হাদীছদু'টি থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছদু'টি দ্বারা জানা গেল আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা, দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা এবং গরীব-মিসকীনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের এ জাতীয় অর্থব্যয়ে শরীক থাকা চাই।
খ. নিজ পরিবারবর্গের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অর্থ ব্যয় করা ফরয এবং এর ছাওয়াব অন্যসব অর্থব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯০৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৯৪২৪; সহীহ ইবন হিব্বান হাদীছ নং ৪৬৪৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪১৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৯৬৩
৩৭৫, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৭৭৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১২৬৩৩: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৮৩৯
৩৭৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮
৩৭৭, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩৪১৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৩৬; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩২
নিজে জিহাদে যাওয়ার জন্য আসবাবপত্র কেনা কিংবা নিজে যেতে না পারলে খরচা দিয়ে অন্যদের পাঠানোও জিহাদে ব্যয় করার অন্তর্ভুক্ত। এর সবটাই অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল।
আল্লাহর পথে খরচ দ্বারা ব্যাপক অর্থে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠামূলক যে-কোনও কাজে অর্থ ব্যয় করা এবং আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতায় টাকা-পয়সা খরচ করাও বোঝানো হতে পারে। এরকম অর্থব্যয়ও অনেক ছাওয়াবের কাজ। আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের ফযীলত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَة فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْف
“কেউ আল্লাহর পথে কিছু খরচ করলে তার বিনিময়ে তার জন্য সাতশ গুণ বেশি খরচের নেকী লেখা হয় (অর্থাৎ এক টাকা খরচ করলে সাতশ' টাকা খরচের ছাওয়াব পাওয়া যায়)।৩৭৪
দ্বিতীয় বলা হয়েছে দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা, যেমন কোনও গোলাম কিনে তাকে আযাদ করে দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে মনীবের সঙ্গে যে গোলামের মুক্তিচুক্তি (মুকাতাবা) সম্পন্ন হয়েছে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে তার চুক্তির অর্থ পরিশোধে সাহায্য করা ইত্যাদি। এটা বিপুল ছাওয়াবের কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً ، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُصْرٍ مِنْهُ عُضَوا مِنَ النَّارِ
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম গোলামকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তাআলা সে গোলামের প্রতি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রতি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখেন।৩৭৫
তৃতীয়ত গরীব-মিসকীনের উপর অর্থব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এটাও অনেক বড় নেকীর কাজ। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسَبُهُ قَالَ: وَكَالْقَائِم الَّذِي لا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ الَّذِي لَا يُفْطِرُ
‘হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত । (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।৩৭৬
পরিবারবর্গের পেছনে অর্থব্যয় যে কারণে শ্রেষ্ঠ
সবশেষে বলা হয়েছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থব্যয়ের কথা। এ চার প্রকার ব্যয়ের মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা, যেমন প্রথম হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন। দ্বিতীয় হাদীছে যে আল্লাহর পথে খরচকে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার মত শ্রেষ্ঠতম ব্যয় সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মানে দু'টো ব্যয়ই শ্রেষ্ঠতম ব্যয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। তবে সর্ববিচারে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করাটাই সর্বোত্তম, যেমনটা প্রথম হাদীছ দ্বারা জানা যায়।
পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করা সর্বোত্তম এ কারণে যে, এছাড়া বাকিগুলো সাধারণভাবে ওয়াজিব নয়, নফল ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। তা করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়, না করলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা ফরয। তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পরিবারের কর্তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে গুনাহ হয়। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيَّعَ مَنْ يَقُوْتُ
‘নিজ পোষ্যদের ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।৩৭৭
বলাবাহুল্য, যে-কোনও নফল আমলের চেয়ে ফরয আমলের ছাওয়ার অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে। পরিবারবর্গের পেছনে অর্থ ব্যয় করা যখন ফরয আর বাকিগুলো নফল, তখন সেগুলো অপেক্ষা পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করার ফযীলত বেশিই হবে বৈকি। সে কারণেই এ হাদীছে যে দীনারটি পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা হয়, সেটিকে অন্য তিন দীনার অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে।
একশ্রেণীর লোক কেবল জযবা দিয়ে চলে। তারা আবেগের তাড়নায় বিভিন্ন দীনী কাজে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি লক্ষ রাখে না। কেউ তো বিভিন্ন দীনী কাজে এমন মশগুল হয়ে থাকে যে, বউ-বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখারই অবকাশ হয় না। তারা খেয়ে থাকল না নাখেয়ে, তাদের চিকিৎসাহ হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। এটা একরকম বৈরাগ্য। ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এ শ্রেণীর লোককে আখেরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা পরিবার-পরিজন আমানতস্বরূপ। গৃহকর্তা তাদের দায়িত্বশীল। তাদের যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা আমানতের খেয়ানত করার শামিল। যে-কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমানতদারির সঙ্গে দায়িত্ব আদায় করেছে কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে হাদীছ মারফত আমাদের জানানো হয়েছে। অতএব কেবল জযবা দ্বারা নয়; বরং শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেকই চলা উচিত। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
উল্লেখ্য, পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার দ্বারা তাদের জরুরি ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কথাই বোঝানো উদ্দেশ্য। তাদের খেয়াল-খুশি ও অন্যায় আবদার মেটানোর ব্যয় এর মধ্যে পড়ে না। সেরকম ব্যয় ছাওয়াবের কাজ তো নয়ই; বরং কঠিন গুনাহ। এ ব্যাপারে প্রত্যেক গৃহকর্তার সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
পরিবারবর্গের প্রতি দু'রকম দায়িত্ব
প্রকাশ থাকে যে, পরিবার-পরিজনের প্রতি গৃহকর্তার দায়িত্ব-কর্তব্য দুইরকম। এক হচ্ছে দুনিয়াবী দায়িত্ব, আরেক দীনী দায়িত্ব। দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন করা অর্থাৎ তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যেমন ফরয, তেমনি দীনী দায়িত্ব পালনও ফরয বৈকি। দীনী দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে দীনের মৌলিক বিষয়াবলী শেখানো, যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ অন্যান্য বিশ্বাসের সঙ্গে তাদেরকে পরিচিত করা: নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের মাসাইল শিক্ষা দেওয়া; ওযূ-গোসল, পাক-পবিত্রতা, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত করা; পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হুকুক সম্পর্কে তালীম দেওয়া এবং ইসলামী আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিফহাল করা। এসব শেখানোর পাশাপাশি তারা যাতে এর উপর আমলে অভ্যস্ত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও জরুরি।
এ দায়িত্ব পালন করার জরুরত দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন অপেক্ষাও অনেক বেশি। পরিবার-পরিজনের দুনিয়াবী চাহিদা পূরণ না করলে তাতে তাদের ইহজীবনের ক্ষতি। এ ক্ষতি অনেক সীমিত। পক্ষান্তরে তাদের দীনী জরুরত পূরণ না করলে তাদের আখেরাতের ক্ষতি হয়। সে ক্ষতি অসীম। তাদের দুনিয়াবী ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য যে টাকা-পয়সা খরচ করা হয়, তা যদি জিহাদ ও গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান-খয়রাত করার চে'ও উত্তম হয়, তবে তাদের দীনী প্রয়োজন পূরণে যে টাকা-পয়সা খরচ করা হবে তার ফযীলত কত উচ্চ হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের মধ্যেই গাফলাতী লক্ষ করা যায়। এ গাফলাতী কিছুতেই কাম্য নয়।
হাদীছদু'টি থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছদু'টি দ্বারা জানা গেল আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা, দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা এবং গরীব-মিসকীনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের এ জাতীয় অর্থব্যয়ে শরীক থাকা চাই।
খ. নিজ পরিবারবর্গের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অর্থ ব্যয় করা ফরয এবং এর ছাওয়াব অন্যসব অর্থব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯০৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৯৪২৪; সহীহ ইবন হিব্বান হাদীছ নং ৪৬৪৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪১৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৯৬৩
৩৭৫, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৭৭৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১২৬৩৩: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৮৩৯
৩৭৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮
৩৭৭, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩৪১৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৩৬; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
