রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৮১
অধ্যায়ঃ ৩৫

স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার

এর আগের অধ্যায়ে স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এ অধ্যায়টি স্বামীর অধিকার সম্পর্কে। স্বামীর যেমন কর্তব্য স্ত্রীর হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা, তেমনি স্ত্রীরও কতব্য স্বামীর হক আদায়ে যত্নবান থাকা। এর দ্বারাই দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি অর্জিত হতে পারে। সবচে' বড় কথা অন্যের হক আদায় ইসলামী অনুশাসনের একটি বড় অংশ। তা আদায় করা ছাড়া কেউ পরিপূর্ণ মুসলিম হতে পারে না। অন্যের হক আদায় ছাড়া মারা গেলে আখেরাতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সেদিন নিজের নেকী দিয়ে অন্যের হক পরিশোধ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর বেলায়ও তাই হবে। কাজেই সেদিন যাতে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়, সে লক্ষ্যেও পারস্পরিক হসমূহ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা চাই। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও বহু হাদীছে স্ত্রীর উপর স্বামীর হক ও অধিকারসমূহের বর্ণনা আছে। সেইসঙ্গে জোর তাকিদও করা হয়েছে যাতে স্ত্রী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সে সমস্ত হক আদায় করে। তা আদায় না করলে কী পরিণাম দাঁড়াবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।

‘স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

অর্থ : 'পুরুষ নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীগণ অনুগত হয়ে থাকে, (পুরুষের) অনুপস্থিতিতে আল্লাহপ্রদত্ত হেফাজতে (তার অধিকারসমূহ) সংরক্ষণ করে।৩৪৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে প্রথমে নারীর উপর পুরুষের অভিভাবকত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর সে অভিভাবকত্বের কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তারপর নেককার স্ত্রীদের গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে।

নারীর উপর পুরুষের অভিভাবকত্ব

এ আয়াত নারীর উপর পুরুষের অভিভাবকত্ব সাব্যস্ত করেছে। বলা হচ্ছে- الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ (পুরুষ নারীদের অভিভাবক)। অর্থাৎ অভিভাবক ও দায়িত্বশীলগণ যেভাবে তাদের অধিনস্তদের দেখভাল ও পরিচালনা করে, তেমনি পুরুষদের উপরও নারীদের দেখভাল ও তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তারপর এ অভিভাবকত্বের দু'টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম কারণ হচ্ছে নারীর উপর পুরুষের আল্লাহপ্রদত্ত বাড়তি কিছু গুণ। বলা হচ্ছে-

بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ (যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নারীর উপর পুরুষকে একরকম শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যেমন, সাধারণভাবে নারী অপেক্ষা পুরুষের বুদ্ধির ব্যাপ্তি ও গভীরতা বেশি। পরিচালনাগত যোগ্যতাও তুলনামূলকভাবে পুরুষের বেশি থাকে। দৈহিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিতেও সে উপরে। বিপদ-আপদের ঝুঁকি নেওয়া এবং প্রতিকূল পরিবেশ- পরিস্থিতিতে স্থির-অবিচল থাকার মানসিক শক্তিও নারী অপেক্ষা পুরুষের বেশি। এসব বিশেষত্বের কারণে শরীআতের বিশেষ কিছু দায়-দায়িত্ব তার উপরই চাপানো হয়েছে, নারীর উপর নয়। যেমন জিহাদ ও জুমু'আ কায়েম করা, নামাযের ইমামত করা ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বভার বহন করা ইত্যাদি।
দ্বিতীয় কারণ প্রকৃতিগত নয়; বরং স্বোপার্জিত। ইরশাদ হয়েছে -وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ (এবং যেহেতু পুরুষগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে)। অর্থাৎ নারীর সার্বিক ব্যয়ভার পুরুষই বহন করে থাকে। বিবাহের আগে তার খোরপোশসহ অন্যান্য খরচাদি বহন করে পিতা। পিতা না থাকলে দাদা বা চাচা কিংবা বড় ভাই। বিবাহের পর এ দায়িত্ব পড়ে স্বামীর উপর। বিবাহে স্ত্রীর মাহরও স্বামীকেই দিতে হয়। মোটকথা আইনত নারীর উপর আর্থিক কোনও দায়-দায়িত্ব নেই। না নিজ ব্যক্তিগত খরচাদি বহনের দায়িত্ব, না অন্য কারও ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কেবলই পুরুষের। তার নিজের খরচাদিও নিজেকে বহন করতে হয় এবং স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ছোট ভাইবোন ও অন্যান্য সম্পৃক্তজনদের খরচাও। তো যেহেতু নারীর সবরকম ব্যয়ভার পুরুষের উপর চাপানো হয়েছে, সঙ্গত কারণেই তার অভিভাবকত্বও পুরুষের উপরই অর্পিত হওয়ার কথা। ইসলামী শরীআত সেটাই করেছে।
উল্লেখ্য, স্বামী-স্ত্রীকে মিলিতভাবে যেহেতু একটি যূথবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয় এবং পরস্পর মিলেমিশে সাংসারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়, তাই সে দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে একজনের নেতৃত্বদান জরুরি। নেতা ছাড়া কোনও যৌথ কারবার চলে না। সমাজ ও রাষ্ট্রসহ যে-কোনও সংঘবদ্ধ জীবন কোনও একজনের নেতৃত্ব ছাড়া সুষ্ঠুভাবে চলা সম্ভব নয়। তাই প্রাচীনকাল থেকেই পরিবার ও সমাজ কোনও একজনকে নেতা মেনে আসছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সংসারজীবনে নেতা মানা হবে কাকে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাউকে নেতা মানা হয় তার নেতৃত্বের গুণাবলী বিচারে। এটা একটা বাড়তি গুণ, যা সকলের থাকে না। সাধারণভাবে এ গুণটি আল্লাহ তাআলা পুরুষদেরই দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে বানিয়েছেনই এর উপযুক্ত করে, যেমন আলোচ্য আয়াতে ইশারা করা হয়েছে।
বস্তুত নারী ও পুরুষ প্রত্যেককেই আল্লাহ তাআলা বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে সে কাজের যোগ্যতাও দান করেছেন। যেমন মানবপ্রজন্ম বিস্তারের জন্য আল্লাহ তাআলা নারীকে মা বানিয়েছেন, তাই গর্ভে সন্তানধারণ ও শিশুসন্তানের পরিচর্যার জন্য যে মায়া-মমতা ও সুকুমার গুণাবলী দরকার ছিল, আল্লাহ তাআলা নারীকে তা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তার দেহমনকে এর উপযোগী করেই বানিয়েছেন। অন্যদিকে পুরুষকে বানিয়েছেন শক্ত ও কঠিন কাজের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। সে আয়-রোজগার করবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, এ উপলক্ষ্যে দেশ-বিদেশে সফর করবে, কঠিন কঠিন সফরের ঝুঁকি গ্রহণ করবে, দেশ পরিচালনা করবে, প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে ও শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বে এবং এরকম আরও যত কঠোর-কঠিন কাজ আছে তা আঞ্জাম দেবে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তার দেহমনও শক্ত-সমর্থ করেই তৈরি করেছেন।
নারীকে আল্লাহ তাআলা যে দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তা যাতে সে সুচারুরূপে পালন করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজন ছিল তাকে সম্পূর্ণরূপে ভারমুক্ত রাখা। তার না থাকবে নিজের খোরপোশ ও সুরক্ষার দায়িত্ব, না থাকবে সন্তানের প্রতিপালন-সামগ্রী যোগানোর যিম্মাদারী। তার ও তার সন্তানের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি প্রয়োজন সমাধার ভার থেকে তাকে মুক্ত না রাখা হলে স্ত্রীত্ব ও মাতৃত্বের যিম্মাদারী যথাযথভাবে পালন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাকে এসব ভার থেকে মুক্ত রেখেছেন এবং তা অর্পণ করেছেন পুরুষের উপর। এ সুবাদেই তাকে নারীর কর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক বানিয়ে দিয়েছেন।

অভিভাবকত্ব গৌরবের বিষয় নয়, অভিভাবকের অধীন থাকাটাও নয় অমর্যাদাকর

প্রকাশ থাকে যে, নেতা ও অভিভাবক হওয়ার দ্বারা আল্লাহর কাছে কারও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্ব হাসিল হয় কেবলই তাকওয়া-পরহেযগারী দ্বারা। অর্থাৎ সত্যকথা বলা, সৎ জীবনযাপন করা, সত্য-সঠিক পথে চলা ও শরীআত অনুযায়ী জীবনযাপন করার দ্বারা। যে ব্যক্তি শরীআত অনুযায়ী চলে, সে নেতা ও অভিভাবক না হয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারে। আবার এর অভাবে অভিভাবক হয়েও শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত হয় না।
কাজেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই কর্তব্য শরীআত মোতাবেক চলা ও তাকওয়াসম্মত জীবনযাপন করা। আপন আপন যিম্মাদারী পালন করাও শরীআতের এক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। অভিভাবকত্ব বিষয়ে স্বামীর যিম্মাদারী যেমন অভিভাবকরূপে স্ত্রীর যথাযথ দেখভাল করা, তেমনি স্ত্রীর যিম্মাদারী হচ্ছে স্বামীর অভিভাবকত্ব মেনে চলা। স্বামী যদি অভিভাবকরূপে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করে, তবে সে শ্রেষ্ঠত্বের কাতারে গণ্য হবে না। অন্যদিকে স্ত্রী যদি অভিভাবকত্ব মেনে চলে, তবে শরীআতের বিধান পালন করার কারণে সে শ্রেষ্ঠত্বের কাতারে গণ্য হবে। মোটকথা, যিম্মাদারী পালনই আসল কথা, তা অভিভাবকরূপে হোক বা অভিভাবক মানার দ্বারা হোক।
আমরা সবাই পরীক্ষার মধ্যে আছি। আল্লাহ একেকজনকে একেকভাবে পরীক্ষা করছেন। কাউকে পরীক্ষা করছেন অভিভাবক বানিয়ে, কাউকে পরীক্ষা করছেন তার অধীন বানিয়ে। পরীক্ষায় যে পাস করবে সেই আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ। কাজেই বাস্তবিকপক্ষে অভিভাবক হওয়াটা যেমন গৌরবের বিষয় নয়, তেমনি অধীন হওয়াটাও নয় কিছুমাত্র মর্যাদাহীনতা। কাজেই না স্বামীর উচিত স্বামীত্বের গর্ব করা, আর না স্ত্রীর উচিত ঈর্ষাকাতর হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبُوا وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا اكْتَسَبْنَ وَاسْأَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا (32)

‘যা দ্বারা আমি তোমাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তার আকাঙ্ক্ষা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তাতে তার অংশ থাকবে এবং নারী যা অর্জন করে তাতে তার অংশ থাকবে। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।৩৪৫
আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভ হবে কেবল সৎকর্মে লিপ্ত থাকা তথা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে মনোযোগী থাকার দ্বারা। এর মধ্যেই প্রকৃত গৌরব। সুতরাং এ আয়াতে সৎকর্মশীল নারীর গুণাবলী ও যিম্মাদারী বর্ণিত হয়েছে যে-

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীগণ অনুগত হয়ে থাকে, (পুরুষের) অনুপস্থিতিতে আল্লাহপ্রদত্ত হেফাজতে (তার অধিকারসমূহ) সংরক্ষণ করে'। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করে, যার একটা দিক স্বামীর হক আদায় করাও বটে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করার অর্থ স্বামীর ঘর ও মালের হেফাজত করা, ঘরের গোপনীয় বিষয় ফাঁস না করা, সর্বোপরি নিজ চরিত্র ও সতীত্ব রক্ষা করা।
'আল্লাহপ্রদত্ত হেফাজতে' এ কথার অর্থ আল্লাহ তাআলা স্বামীর উপর তাদের মাহর ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন। হেফাজতের এ ব্যবস্থাকরণের কৃতজ্ঞতাস্বরূপই হুকুম দেওয়া হয়েছে, যেন তারা নিজ সতীত্ব, দাম্পত্যের গোপনীয়তা ও স্বামীর অর্থ-সম্পদ হেফাজত করে।

৩৪৪. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৪

৩৪৫. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩২

এ সম্পর্কে হাদীছ আছে বহু। তার মধ্যে একটা তো ওই হাদীছ, যা হযরত আমর ইবনুল আহওয়াস রাযি. থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্বের অধ্যায়ে ২৭৬ নম্বরে গত হয়েছে। হাদীছটি সেখানে দ্র.। এখানে নতুন কিছু হাদীছ পেশ করা যাচ্ছে।
যে নারীর উপর ফিরিশতারা লা'নত করে থাকে
হাদীছ নং : ২৮১

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন কোনও ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিজ বিছানায় ডাকে আর সে না আসে, ফলে স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত কাটায়, তবে ফিরিশতাগণ তার উপর অভিশাপ দিতে থাকে, যাবৎ না ভোর হয় -বুখারী ও মুসলিম।
বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, কোনও নারী যখন তার স্বামীর বিছানা পরিত্যাগ করে রাত কাটায়, তখন ফিরিশতাগণ তাকে অভিশাপ দিতে থাকে, যাবৎ না ভোর হয়।৩৪৬
অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম, যে-কোনও ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যদি নিজ বিছানায় ডাকে আর স্ত্রী তা অস্বীকার করে, তবে যতক্ষণ না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যিনি আসমানে আছেন তিনি তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন।৩৪৭

৩৪৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩২৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২১৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৬৭১; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৭০৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৭১৩৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৩২৮

৩৪৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩৬; মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৯৭৫৫
35 - باب حق الزوج عَلَى المرأة
قَالَ الله تَعَالَى: {الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ الله} [النساء: 34].

وأما الأحاديث فمنها حديث عمرو بن الأحوص السابق في الباب قبله (1).
281 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امرَأتَهُ إِلَى فرَاشِهِ فَلَمْ تَأتِهِ، فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا، لَعَنَتْهَا المَلائِكَةُ حَتَّى تُصْبحَ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2) [ص:112]
وفي رواية لهما: «إِذَا بَاتَت المَرأةُ هَاجِرَةً فِرَاشَ زَوْجِهَا لَعَنَتْهَا المَلاَئِكَةُ حَتَّى تُصْبحَ».
وفي رواية قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «والَّذِي نَفْسِي بيَدِهِ مَا مِنْ رَجُلٍ يَدْعُو امْرَأتَهُ إِلَى فِرَاشهِ فَتَأبَى عَلَيهِ إلاَّ كَانَ الَّذِي في السَّمَاء سَاخطًا عَلَيْهَا حَتَّى يَرْضَى عَنها».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

স্বামীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর বিছানায় আসতে অস্বীকৃতির বিষয়ে হাদীসে কঠিন ধমকি বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন হাদীসে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আর কোন কোন হাদীসে ফেরেশতাদের লানতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যাইহোক ফিরিশতাদের এ লা'নত করা এবং আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ হল শরীআতে বিবাহের বিধান যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে, স্ত্রীর আচরণ তার পরিপন্থী। এ বিধানের একটি বড় উদ্দেশ্য জৈবচাহিদা পূরণ। ইসলাম মানুষের স্বভাবগত কোনও চাহিদাকেই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেনি; বরং তা বৈধভাবে পূরণের ব্যবস্থা দান করেছে। পেটে ক্ষুধা লাগা একটি স্বভাবগত বিষয়। এর জন্য মানুষের খাদ্যচাহিদা দেখা দেয়। এ চাহিদা পূরণের জন্য চাইলে মানুষ যে-কোনও উপায়ই অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু শরীআত এ ব্যাপারে সীমারেখা টেনে দিয়েছে। কোনও উপায়কে বৈধ করেছে এবং কোনওটাকে অবৈধ বলেছে। মানুষের কর্তব্য অবৈধ উপায় পরিহার করে ক্ষুধা নিবারণের বৈধ উপায় অবলম্বন করা।

কামচাহিদার ব্যাপারটাও সেরকমই। এর জন্য নানা অবৈধ উপায় আছে, কিন্তু শরীআত তা হারাম করেছে। মানুষ যাতে বৈধ উপায়ে এ চাহিদা পূরণ করতে পারে, সে লক্ষ্যেই বিবাহের ব্যবস্থা দান করেছে। কাজেই স্ত্রী যদি স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয়, তবে এটা হবে সে লক্ষ্যের পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে স্বামী হয়তো চাহিদা অবদমন করতে বাধ্য হবে, যা তার শরীরের উপর এক অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ। সে হিসেবে স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার উপর একরকম জুলুম করা হবে। অন্যথায় স্বামী অবৈধ কোনও পন্থা অবলম্বন করবে। এতে যে গুনাহ হয়, বলাবাহুল্য তার দায় স্ত্রীর উপরও বর্তায়। এ কারণেই ফিরিশতাদের লা'নত ও আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি।

উল্লেখ্য, স্ত্রীর সাড়াদান না করাটা যদি ওজরবশত হয়, তবে স্বামীর কর্তব্য সে ওজর বিবেচনা করা। কারও কারও স্থায়ী ওজরও থাকে। সে ক্ষেত্রে যদি আরেকটি বিবাহের সামর্থ্য থাকে এবং স্বামীও তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে স্ত্রীর তাতে বাধা হওয়া সমীচীন নয়। স্বামীর যদি দ্বিতীয় বিবাহের সামর্থ্য না থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে সে নিজেও মা'যূর বৈকি। তার কর্তব্য হবে সংযম অবলম্বন করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. স্বামীর বিশেষ ডাকে সাড়া না দেওয়া স্ত্রীর জন্য গুরুতর পাপ। প্রত্যেক স্ত্রীর এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৮১ | মুসলিম বাংলা