রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৭৮
স্ত্রীদের প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ
পূর্ণাঙ্গ মুমিন ও উৎকৃষ্ট লোক কে
হাদীছ নং : ২৭৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আখলাক-চরিত্র সবচেয়ে ভালো। এবং তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম লোক তারা, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে শ্রেষ্ঠতম -তিরমিযী।
(জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১১৬২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪০২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৭৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ২৫৩১৮; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪৪২০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৩৪১; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৪৪৩১)
34 - باب الوصية بالنساء
278 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أكْمَلُ المُؤمِنِينَ إيمَانًا أحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وخِيَارُكُمْ خياركم لِنِسَائِهِمْ». رواه الترمذي، (1) وَقالَ: «حديث حسن صحيح».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছের প্রথম বাক্য হচ্ছে- أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا (ঈমানের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আখলাক-চরিত্র সবচেয়ে ভালো)। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ আখলাক-চরিত্রওয়ালাকে সর্বাপেক্ষা পরিপূর্ণ মুসলিম বলা হয়েছে। আখলাক-চরিত্র হচ্ছে মানুষের স্বভাবগত এক ক্ষমতা, যা মানুষকে প্রশংসনীয় কাজে উৎসাহ যোগায় ও ভদ্রোচিত আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। হাসান বসরী রহ. বলেন, উত্তম চরিত্রের হাকীকত হল মানুষের উপকার করা, তাদেরকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা এবং প্রসন্ন মুখে সাক্ষাত করা। ইমাম বাজী রহ.-এর মতে চরিত্র সুন্দর হওয়ার অর্থ যারা তার সঙ্গে ওঠাবসা করে বা সাক্ষাত করতে আসে, তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, সহনশীল আচরণ করা ও মায়া-মমতা প্রকাশ করা, শিক্ষাদানে সবর অবলম্বন করা এবং ছোট-বড় সকলের সঙ্গে মহব্বত ও ভালোবাসা বজায় রাখা।

ভালো আখলাক-চরিত্র অনেকের জন্মগতভাবেই থাকে। আবার কাউকে এটা চেষ্টা-সাধনা দ্বারা অর্জন করতে হয়।

এ হাদীছে পূর্ণাঙ্গ মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে উত্তম আখলাকওয়ালা হওয়া। এর দ্বারা বোঝা যায় আখলাক-চরিত্র উন্নত করাই শ্রেষ্ঠ আমল। আবার অন্যান্য হাদীছে আরও বিভিন্ন আমলকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। স্থান-কাল-পাত্রভেদে আমল-আখলাকের মান-মর্যাদায় পার্থক্য হতে পারে। ইসলামের সূচনাকালে জিহাদ ছিল শ্রেষ্ঠতম আমল। কারণ তখন এটা ছিল ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও স্থিতির বড় উপায়। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, দান-সদাকা অপেক্ষা নামায শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যখন মন্দা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন দান-সদাকার ফযীলত অনেক বেড়ে যায়। আখলাক-চরিত্রের বিষয়টাও এরকমই। ক্ষেত্রবিশেষে এর গুরুত্ব অন্যসব আমলকে ছাপিয়ে যায়।

এ হাদীছের দ্বিতীয় বাক্য হচ্ছে- وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ (এবং তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম লোক তারা, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে শ্রেষ্ঠতম)। স্ত্রীর কাছে যে শ্রেষ্ঠ, তাকে শ্রেষ্ঠতম মানুষ সাব্যস্ত করার কারণ হল মানুষের আসল চরিত্র এখানেই ধরা পড়ে। মানুষ বাইরে সাধারণত একরকম কৃত্রিমতার সঙ্গে থাকে। ভান করে হলেও ভদ্রতা বজায় রাখে। মন্দ স্বভাবগুলো যাতে অন্যের কাছে ধরা না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকে। কিন্তু ঘরে থাকা অবস্থায় এরকম ভান-ভনিতা থাকে না। ফলে আসল চরিত্র প্রকাশ পেয়ে যায়। সে সত্যবাদী না মিথ্যুক, দয়ালু না নিষ্ঠুর, কৃপণ না দানবীর, স্বার্থপর না নিঃস্বার্থ, অহংকারী না বিনয়ী, ন্যায়নিষ্ঠ না জালেম, সৎ না অসৎ, চরিত্রহীন না চরিত্রবান ইত্যাদি ভালোমন্দ স্বভাব কেউ স্ত্রীর কাছে লুকাতে পারে না। কাজেই এসব ব্যাপারে কারও স্ত্রী যদি তার পক্ষে প্রশংসনীয় সনদ দেয়, তবে সে প্রকৃতই একজন ভালো মানুষ।

এর দ্বারা স্বামীকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে সে যেন স্ত্রীর সঙ্গে মাধুর্যপূর্ণ আচরণ করে, তাকে কষ্ট না দেয়, আর স্ত্রী যদি তাকে কষ্ট দেয়, সে ক্ষেত্রে যেন সবর করে। তার এ আচরণ যেমন স্ত্রীর পক্ষে স্বস্তিকর ও শান্তিদায়ী হবে, তেমনি এর দ্বারা তার নিজ আখলাক-চরিত্রেরও নির্মাণ ও সংশোধন হবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এরকমই ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম স্বামী। ইন্তিকালের সময় তাঁর নয়জন স্ত্রী ছিল। তাঁর দাম্পত্যজীবনের সবকিছুই সংরক্ষিত আছে। স্ত্রীদের প্রতি তাঁর ব্যবহার কেমন ছিল তাও হাদীছগ্রন্থে লেখা আছে। তিনি কখনও কোনও স্ত্রীকে কষ্ট দিয়েছেন এমন নজির নেই। এমনিই তিনি শ্রেষ্ঠতম মানুষ ছিলেন। আবার এ হাদীছে যে বলা হয়েছে স্ত্রীদের কাছে যে শ্রেষ্ঠ সে সকলের শ্রেষ্ঠ। এদিক থেকেও তিনি শ্রেষ্ঠতম। কেননা তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর চোখে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي
‘তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে তার পরিবারের কাছে শ্রেষ্ঠ। আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠজন।৩৩৯

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ আমাদেরকে আখলাক-চরিত্র উন্নত করার উৎসাহ যোগায়।

খ. এ হাদীছ নিজেকে স্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ সাব্যস্ত করার প্রতি মনোযোগী হতে অনুপ্রাণিত করে। তার একমাত্র উপায় স্ত্রীর প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ থাকা ও সদাচরণকারী হওয়া।

৩৩৯. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৯৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৯৭৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪১৭৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৯; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫০২: তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৫২৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৭৮ | মুসলিম বাংলা