রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৬৩
ইয়াতীম, কন্যাসন্তান, সর্বপ্রকার দুর্বল, গরীব-মিসকীন ও দুস্থ লোকদের প্রতি সদয় আচরণ, তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ
ইয়াতীমের তত্ত্বাবধান করার ফযীলত
হাদীছ নং : ২৬৩

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইয়াতীমের তত্ত্বাবধানকারী- সে ইয়াতীম তার নিজের (আত্মীয়) হোক বা অন্য কারও, আমি এবং সে জান্নাতে এভাবে থাকব। বর্ণনাকারী মালিক ইবন আনাস তার তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করলেন - মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৮৮১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৫৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫১৯; আল খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৬৫১; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৬
33 - باب ملاطفة اليتيم والبنات وسائر الضعفة والمساكين والمنكسرين والإحسان إليهم والشفقة عليهم والتواضع معهم وخفض الجناح لهم
263 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «كَافلُ اليَتيِم لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ في الجَنَّةِ» وَأَشَارَ الرَّاوِي وَهُوَ مَالِكُ بْنُ أنَس بالسَّبَّابَةِ وَالوُسْطَى. رواه مسلم. (1)
وقوله - صلى الله عليه وسلم: «اليَتِيمُ لَهُ أَوْ لِغَيرِهِ» مَعْنَاهُ: قَريبُهُ، أَو الأجْنَبيُّ مِنْهُ، فالقَريبُ مِثلُ أَنْ تَكْفَلهُ أمُّهُ أَوْ جَدُّهُ أَوْ أخُوهُ أَوْ غَيرُهُمْ مِنْ قَرَابَتِهِ، والله أعْلَمُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছদু'টির মর্মবস্তু একই। তবে উভয়ের মধ্যে দু'টি পার্থক্য আছে। এক পার্থক্য এই যে, দ্বিতীয় হাদীছে অতিরিক্ত আছে له أو لغيره (সে ইয়াতীম নিজের হোক বা অন্যের)। নিজের ইয়াতীম হওয়া মানে সে হয়তো ইয়াতীম বাচ্চাটির দাদা, চাচা, ভাই বা এরকম কোনও নিকটাত্মীয়। আর অন্যের হওয়ার অর্থ ইয়াতীম বাচ্চাটি তার কোনও আত্মীয় নয়। নিজের হওয়ার এক অর্থ এমনও হতে পারে যে, বাচ্চাটির বাবা মারা গিয়েছে, এখন তার মা পিতার স্থলে তার লালন-পালন করছে, অথবা মা মারা গিয়েছে এবং পিতা তার স্থানে মায়ের মত করে তার দেখাশোনা করছে।
বাযযারের এক রেওয়ায়েতে স্পষ্টই আছে যে, যে ব্যক্তি কোনও ইয়াতীমের লালন-পালন করে, সে ইয়াতীম তার আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়। এর দ্বারাও ব্যাখ্যা হয়ে যায় যে, ইয়াতীম নিজের হওয়া বা অন্যের হওয়ার দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে।
দ্বিতীয় পার্থক্য হল, প্রথম হাদীছে আছে- و فرج بينهما (এবং দুটোর মধ্যে ফাঁক করলেন)। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্তর এবং ইয়াতীমের প্রতিপালনকারীর স্তরের মধ্যে একটু দূরত্ব আছে, যেমন দূরত্ব দুই আঙ্গুলের মধ্যে ফাঁক করার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। তবে যেহেতু উভয় আঙ্গুলের মধ্যে তৃতীয় কোনও আঙ্গুল নেই, সে হিসেবে এ দুই আঙ্গুল যেমন কাছাকাছি, তেমনি ইয়াতীমের প্রতিপালনকারীর অবস্থানও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি হবে, মাঝখানে তৃতীয় কোনও স্তর থাকবে না।
যাহোক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াতীমের লালন-পালনকারীকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, সে জান্নাতে তাঁর পাশাপাশি থাকবে। ইমাম ইবন বাত্তাল রহ. বলেন, যে-কেউ এ হাদীছ শুনবে, এর উপর আমল করা তার অবশ্যকর্তব্য, যাতে সে জান্নাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে থাকতে পারে। বলাবাহুল্য, উম্মতের পক্ষে আখেরাতে এর চেয়ে উত্তম কোনও স্তর থাকতে পারে না।
কারও মতে ইয়াতীমের প্রতিপালনকারীর অবস্থান নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটবর্তী হওয়ার দ্বারা জান্নাতে প্রবেশকালীন অবস্থা বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছন পেছনেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাশি থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে-

أنا أوّلُ مَنْ يُفْتَحُ لَهُ بَابُ الْجَنَّةِ، إلا أنه تأتي إمرأة تُبادِرُنِي فَأَقُولُ لَهَا : مَا لَكِ؟ وما أنتِ ؟ فَتَقُولُ: أَنَا امْرَأَةٌ فَعَدْتُ عَلى أَيتام لي

‘আমি সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজা খুলব। হঠাৎ দেখা যাবে এক মহিলা আমার পেছন পেছন প্রবেশ করছে। আমি জিজ্ঞেস করব, তোমার খবর কী? তুমি কে? সে বলবে, আমি এমন এক নারী যে, আমার কয়েকজন ইয়াতীম ছিল, যাদের জন্য আমি (অন্য স্বামী গ্রহণ না করে) বৈধব্য জীবন যাপন করেছি।২৮৫
আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল ইয়াতীমকে লালন-পালন করার ফযীলত কত উঁচু। সে লালন-পালনকারী যদি হয় ইয়াতীমের বিধবা মাতা এবং সে কেবল তার ইয়াতীম সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য স্বামী গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার মর্যাদা অনেক অনেক বেশি। এ সম্পর্কে হযরত আওফ ইবন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ উল্লেখযোগ্য। তাতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَنَا وَامْرَأَةٌ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ كَهَاتَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوْمَأ يَزِيدُ بِالْوُسْطَى وَالسَّبَّابَةِ امْرَأَةٌ امَتْ مِنْ زَوْجِهَا ذَاتُ مَنْصِب ، وَجَمَالٍ، حَبَسَتْ نَفْسَهَا عَلَى يَتَامَاهَا حَتَّى بَانُوْا أَوْ مَاتُوا

‘আমি এবং ওই নারী (ইয়াতীমের লালন-পালনে কষ্ট-ক্লেশ করতে থাকায়) যার দুই গালে কালো দাগ পড়ে গেছে, কিয়ামতের দিন এভাবে থাকব, এই বলে রাবী ইয়াযীদ তার মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুলদুটি মিলিয়ে দেখালেন। এ হচ্ছে ওই নারী, যে তার স্বামী থেকে বিধবা হয়ে গেছে, সে সম্ভ্রান্ত বংশের এবং রূপসীও বটে, সে নিজেকে তার ইয়াতীমদের জন্য আটকে রাখে, যাবৎ না তারা বড় হয়ে যায় কিংবা মারা যায়।২৮৬
প্রশ্ন হতে পারে, ইয়াতীমের লালন-পালনকারীর জান্নাতে প্রবেশ বা তার জান্নাতের মর্যাদাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তুলনা করার রহস্য কী?
এর উত্তর এই যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক উম্মী সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন, যারা দীন ও ঈমান কিছু বুঝত না। তিনি মুরশিদ ও শিক্ষক হয়ে তাদের দীনী ও রূহানী প্রতিপালন করেছেন। তদ্রূপ ইয়াতীমের লালন- পালনকারীও অবোধ অবুঝ শিশুর প্রতিপালন করে থাকে। তার দুনিয়াবী দিকও লক্ষ রাখে এবং দীনী শিক্ষারও ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তো প্রতিপালন ও পরিচর্যার দিক থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তার একরকম সাদৃশ্য আছে।
প্রকাশ থাকে যে, ইয়াতীমকে লালন-পালনের এ ফযীলত পাওয়া যাবে তখনই, যখন তার প্রতি পূর্ণ কল্যাণকামিতার আচরণ করা হবে, তার প্রতি কোনওরকম জুলুম করা হবে না, না তার মালের উপর, না তার জানের উপর। অন্যায়ভাবে তার সম্পদ গ্রাস করা কঠিন পাপ, যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا

'নিশ্চয়ই যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভরতি করে। তারা অচিরেই এক জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।২৮৭
সুতরাং ইয়াতীমকে লালন-পালন করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। তার সম্পদের প্রতি লোভ করা যাবে না। পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে তার সম্পদের হেফাজত করতে হবে। এমনিভাবে তার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে মায়া-মমতার সাথে। অন্যায়ভাবে তাকে মারধর করা চলবে না। এ ব্যাপারে অনেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে না। জাহিলী যুগে তো তাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা হত। সেকালে মানুষ তাদের সম্পদ তো গ্রাস করতই, শারীরিকভাবেও নির্যাতন করত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠোরভাবে তা নিষেধ করে দেন। একবার কোনও এক সাহাবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কি কি কারণে আমি ইয়াতীমকে মারতে পারব? তিনি বললেন-

مِمَّا كُنْتَ ضارِبًا مِنْهُ وَلَدَكَ غَيْرَ وَاقٍ مَالَكَ بِمَالِهِ

‘তুমি তাকে মারতে পারবে এমন কোনও কারণে, যে কারণে তুমি নিজ সন্তানকে মেরে থাক। আর তুমি তার সম্পদ দ্বারা নিজের সম্পদ রক্ষাকারী হবে না (অর্থাৎ নিজের সম্পদ বাঁচানোর জন্য তার সম্পদ খরচ করবে না)।২৮৮

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছ দ্বারা ইয়াতীমকে লালন-পালন করার উচ্চ ফযীলত জানা গেল। সুতরাং আমাদের যখনই কোনও ইয়াতীমকে লালন-পালন করার সুযোগ আসে, তখন পূর্ণ আন্তরিকতা ও মমত্ববোধের সঙ্গে তার লালন-পালনে যত্নবান থাকব।

২৮৫. মুসনাদে আবু ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬৬৫১; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৬৪২

২৮৬. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৪৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪০০৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৪১৩

২৮৭. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১০

২৮৮. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৯৯৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৮২; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ২৬৬৮৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৪; তাবারানী, আল মুজামুস সগীর, হাদীছ নং ২৪৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৬৩ | মুসলিম বাংলা