রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৪৪
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়: ২৯

মুসলমানদের প্রয়োজন সমাধা করা

কুরআন-হাদীছের শিক্ষা অনুযায়ী এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। তাদের কর্তব্য ভাই-ভাই হিসেবে থাকা এবং ঐক্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে চলা। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই সামাজিক জীব। ইসলামও প্রকৃতিসম্মত দীন। তাই ইসলামী শিক্ষায় সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ঐক্য ও সম্প্রীতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে মুসলিম সাধারণের অন্তরে ভ্রাতৃত্ববোধের উজ্জীবন অতি জরুরি। আল্লাহর কালাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ সে বোধ চেতনার জিয়নকাঠি। পেছনের অধ্যায়সমূহে আমরা তা লক্ষ করে এসেছি। সে শিক্ষারই একটা অঙ্গ মুসলিম-সাধারণের একের দ্বারা অন্যের প্রয়োজন সমাধার চেষ্টা। এক মুসলিম যখন অপর মুসলিমের ভাই আর সে হিসেবে তাদেরকে পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গে জীবনযাপন করতে হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ দায়িত্ব-কর্তব্যও তাদের কাঁধে চেপে যায় যে, তারা একে অন্যের প্রয়োজন সমাধায় ঝাঁপিয়ে পড়বে।
দুনিয়ায় কারও পক্ষেই নিজের সব প্রয়োজন নিজে নিজে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। নিজের কোনও না কোনও প্রয়োজন পূরণে আমরা প্রত্যেকেই অন্যের কাছে ঠ্যাকা। কাজেই যে ব্যক্তি অন্যের প্রয়োজন পূরণে ভূমিকা রাখবে না, তার নিজ প্রয়োজনেও অন্যকে পাশে পাবে না। এর অনিবার্য পরিণতি সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া, হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়া ও জুলুম-নিপীড়নের বিস্তার ঘটা। সে পরিণতি যাতে দেখা দিতে না পারে, তাই ইসলাম একে অন্যের প্রয়োজন পূরণে ভূমিকা রাখার জোর তাগিদ করেছে। এটা যেমন পার্থিব জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও ঐক্য-সম্প্রীতি রক্ষায় সহায়ক, তেমনি আখেরাতের নাজাত লাভেরও অনেক বড় অসিলা। এটা উচ্চপর্যায়ের এক নেক আমল। এর ফযীলতও অনেক বেশি। ইমাম নববী রহ. আলোচ্য অধ্যায়ে এ বিষয়ক কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।


‘মুসলমানদের প্রয়োজন সমাধা করা' সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত


এক নং আয়াত

وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থ : (হে মুমিনগণ! রুকূ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর) এবং সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার।১৮৬

ব্যাখ্যা : আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে রুকূ-সিজদা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পর সাধারণভাবে সৎকর্ম করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেন- وَافْعَلُوا الْخَيْرَ (এবং সৎকর্ম কর)। الْخَيْرَ অর্থ ভালো, উৎকৃষ্ট, কল্যাণ, ন্যায়, অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি এমনসব বিষয়, যার প্রতি সকলেই আগ্রহ বোধ করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. এস্থলে এর অর্থ করেছেন আত্মীয়তা রক্ষা ও উন্নত চরিত্রপ্রসূত কাজ করা। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ফরয ও অবশ্যপালনীয় কাজের বাইরেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিরিক্ত ইবাদত-বন্দেগী ও দান-খয়রাত করতে থাকা। যেমন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায়ের পরও বাড়তি খোঁজখবর রাখা, তাদের প্রয়োজনীয় সেবা করা, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, দুস্থ ও আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকা ইত্যাদি। আয়াতটির শেষে বলা হয়েছে- لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পার)। সফলতা বলতে পার্থিব শান্তি-নিরাপত্তা ও আখেরাতের মুক্তি বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তোমরা যদি দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তি পেতে চাও, তবে আল্লাহ তাআলা যেসকল ইবাদত-বন্দেগী ফরয করেছেন তা আদায়ে ক্ষান্ত না থেকে আপন আপন হিম্মত ও সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব বাড়তি আমলও কর। বিশেষত আল্লাহর পথে যতসম্ভব খরচ করতে থাক। অধীনস্থদের হক আদায়ের পর অতিরিক্ত যে অর্থ-সম্পদ থাকে, তা থেকে অকৃপণভাবে দান-খয়রাত করে যাও। তারপরও নিজ ফরয ও নফল আমলের উপর নির্ভর না করে আল্লাহর রহমতের আশাবাদী থাক। আশা রাখ যে, এসব আমলের অসিলায় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি রহমত করবেন। তিনি নিজ দয়ায় তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে দাখিল করবেন।

দুই নং আয়াত

وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ

অর্থ : 'আর তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত।১৮৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন ও অন্যান্য প্রয়োজনগ্রস্ত লোকদেরকে আপন সাধ্য অনুযায়ী অর্থসাহায্য করার নির্দেশনা দান করেছেন। তারপর এর প্রতি উৎসাহদানের লক্ষ্যে ইরশাদ করছেন- তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। এ কল্যাণকর কাজ দ্বারা বিশেষভাবে আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ খরচ করাও বোঝানো হতে পারে, যেহেতু অর্থ-সম্পদ ব্যয় প্রসঙ্গে এ কথাটি বলা হয়েছে। আবার ব্যাপক অর্থে এর দ্বারা যে-কোনও সৎকর্মই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে।
আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা হোক বা অন্য কোনও সৎকর্ম, আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য বান্দা যা-কিছুই করুক না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। অর্থাৎ বান্দার সে আমল বৃথা যাওয়ার নয়। আল্লাহ তার পূর্ণ প্রতিদান দান করবেন। যেন তিনি বলছেন, বান্দা তুমি যত পার দান-খয়রাত ও অন্যান্য নেক আমল করতে থাক, আমি তা নিষ্ফল যেতে দেব না, দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ইচ্ছামত তার পুরস্কার তোমাদেরকে অবশ্যই দেব।
এ উভয় আয়াতে যে সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ দান করা হয়েছে, মুসলিম সাধারণের প্রয়োজন সমাধা করাও তার একটি। সে হিসেবেই ইমাম নববী রহ. আয়াতদু'টি এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।

১৮৬. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত নং ৭৭

১৮৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত নং ২১৫
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধার ফযীলত
হাদীছ নং : ২৪৪

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমকে গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে গোপন রাখবেন -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬৪৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৫১২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭২০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩৩)
مقدمة الامام النووي
29 - باب قضاء حوائج المسلمين

قَالَ الله تَعَالَى: {وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ} [الحج: 77].
244 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «المُسْلِمُ أخُو المُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ، وَلاَ يُسْلِمُهُ. مَنْ كَانَ في حَاجَةِ أخِيه، كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كرَبِ يَومِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَومَ القِيَامَةِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম সাধারণকে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করার পর তাদের যেসকল বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ করণীয় উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধার চেষ্টা করা। এর ফযীলত বলা হয়েছে এই যে, এ কাজে যে মুসলিম নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ তাআলাও তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। কাজেই এ আমল আপন প্রয়োজন সমাধার এক উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। আল্লাহ তাআলা যার প্রয়োজন সমাধা করে দেন, তার কি কোনও মাখলূকের মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার পড়ে? নিশ্চয়ই নয়।
হুবহু এ হাদীছটিই ২৭ নং অধ্যায়ে ২৩৩ নম্বরে গত হয়েছে। সেখানে এর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠক সেখানে দেখে নিতে পারেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ মুসলিম উম্মাহকে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করে।

খ. আমরা কেউ একে অন্যের প্রতি জুলুম করব না। অর্থাৎ অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের উপর আঘাত করব না। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী।।

গ. কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে তার সাহায্য না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিত নয়; বরং তার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি।

ঘ. কোনও মুসলিম ভাইয়ের বিশেষ কোনও জরুরত ও প্রয়োজন দেখা দিলে আমাদের কর্তব্য তার সে প্রয়োজন সমাধায় ভূমিকা রাখা।

ঙ. মুসলিম ভাইয়ের জরুরত পূরণ করলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিজ জরুরত পূরণের আশ্বাস রয়েছে।

চ. মুসলিম ভাইয়ের পেরেশানি ও দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সচেষ্ট থাকা চাই। এটাও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি।

ছ. এ হাদীছ দ্বারা কিয়ামতের অবশ্যম্ভাবিতা ও সেদিনের কঠিন বিপদ-আপদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সেদিনের বিপদ থেকে নিস্তার লাভের একটি উপায় হচ্ছে দুনিয়ায় মুসলিম ভাইয়ের বিপদ-আপদে সাহায্য করা।

জ. অপরের যে দোষত্রুটি অন্যের জন্য ক্ষতিকারক নয় তা গোপন রাখা চাই। অন্যের দোষ গোপন রাখার দ্বারা কিয়ামতে নিজ দোষ গোপন থাকার আশা রয়েছে।

ঝ. অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা বা যে-কোনও নেককাজের জন্য মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য আখেরাতের বিনিময় আশা করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে পরকালীন বিনিময়ের উল্লেখ দ্বারা সৎকর্মের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন, যেমনটা এ হাদীছ দ্বারাও জানা যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৪৪ | মুসলিম বাংলা