রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২২৬
মুসলিম ব্যক্তিবর্গের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকারসমূহ ও তাদের প্রতি স্নেহ-মমতার বর্ণনা।
শিশুদের চুমু দেওয়া অন্তরস্থ রহমতের প্রকাশ
হাদীছ নং : ২২৬

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বেদুঈনদের কিছু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসল। তারা বলল, আপনারা কি আপনাদের শিশুদের চুমু দেন? তিনি বললেন, হাঁ। তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা কিন্তু চুমু দেই না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে রহমত তুলে নিয়ে থাকেন, তবে আমি কি কিছু করার ক্ষমতা রাখি! বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩১৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৬৬৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৪০৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪৮)
27 - باب تعظيم حرمات المسلمين وبيان حقوقهم والشفقة عليهم ورحمتهم
226 - وعن عائشة رضي الله عنها، قَالَتْ: قَدِمَ نَاسٌ مِنَ الأعْرَابِ عَلَى رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم فقالوا: أتُقَبِّلُونَ صِبْيَانَكُمْ؟ فَقَالَ: «نَعَمْ» قالوا: لَكِنَّا والله مَا نُقَبِّلُ! فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أَوَ أَمْلِك إنْ كَانَ اللهُ نَزَعَ مِنْ قُلُوبِكُم الرَّحْمَةَ!». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটির বিষয়বস্তু আগের হাদীছটির কাছাকাছি। এতে যে বেদুঈনদের কথা বলা হয়েছে, সম্ভবত তারা বনূ তামীমেরই লোক, যাদের নেতা ছিলেন আকরা' ইব্ন হাবিস। আগের হাদীছে আকরা ইব্ন হাবিস রাযি.-এর উক্তি উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আমার দশটি সন্তান আছে, যাদের কাউকে আমি কখনও চুমু দেইনি। এ হাদীছে আছে আমরা তাদের চুমু দেই না। অসম্ভব নয় যে, দলনেতার উক্তিকেই এ হাদীছে দলের উক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবার এটি ভিন্ন ঘটনাও হতে পারে। আবূ ইয়া'লা তার মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.-এর সূত্রে একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তাতে উয়াইনা ইব্ন হিস্ন আল-ফাযারী রাযি. সম্পর্কে আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি হযরত হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি.-কে চুমু দিচ্ছেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এদেরকে চুমু খাচ্ছেন, অথচ আমার দশটি সন্তান আছে, যাদের কাউকে কখনও চুমু দেইনি।[১]
এ ঘটনাটি পূর্বে বর্ণিত আকরা' ইব্ন হাবিস রাযি.-এর ঘটনার অনুরূপ। এরকম একটি ঘটনা কায়স ইব্ন আসিম তামীমী রাযি. সম্পর্কেও বর্ণিত আছে, যা আবুল ফারাজ আল-আসবাহানী তার 'আল আগানী' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাতে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছিলেনঃ- فهل إلا أن تنزع الرحمة منك؟ অর্থাৎ শিশুদের চুমু না খাওয়ার কারণ কি তোমার অন্তর থেকে রহমত তুলে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু?[২]

এসব বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় একইরকম ঘটনা একাধিকবার ঘটেছিল। অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সচরাচরই তাঁর প্রিয় নাতি-নাতনি ও অন্যান্য শিশুদের চুমু দিতেন। কিন্তু আরবে এর রেওয়াজ না থাকায় যখন বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত লোকজন এটা দেখত, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে যেত এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত, যা বিভিন্ন সূত্রে হাদীছ গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

যাহোক, বেদুঈনগণ জিজ্ঞেস করেছিল আপনারা কি আপনাদের শিশুদের চুমু দেন? উত্তরে সাহাবীগণ বললেন, হাঁ, আমরা আমাদের শিশুদের চুমু দেই। এর দ্বারা বোঝা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার বদৌলতে মদীনা মুনাউওয়ারায় শিশুদেরকে চুমু খাওয়ার ব্যাপক রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত তখনও পর্যন্ত মদীনা মুনাউওয়ারার বাইরে কিংবা বলা যায় ইসলামী সমাজের বাইরে এর রেওয়াজ গড়ে উঠেনি। সেজন্যই বেদুঈনগণ এর সঙ্গে পরিচিত ছিল না। তাই আশ্চর্য হয়ে তারা এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল।

বেদুঈনগণ যখন জানাল তারা তাদের শিশুদের চুমু দেয় না, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের লক্ষ্য করে বললেনঃ- أو أملك أن كان الله نزع من قلوبكم الرحمة (আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে রহমত তুলে নিয়ে থাকেন, তবে আমি কি কিছু করার ক্ষমতা রাখি!)।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তর থেকে রহমত ও দয়া তুলে নিয়ে থাকলে আমি তা তোমাদের অন্তরে পুনরায় স্থাপিত করার ক্ষমতা রাখি না। বা আল্লাহ তা'আলা তোমাদের অন্তর থেকে তা তুলে নিলে আমি তা ঠেকানোর শক্তি রাখি না। আল্লাহ তাআলা যা করেন তা প্রতিহত করার ক্ষমতা কারও নেই।

এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, শিশুদের চুমু দেওয়া অন্তরে আল্লাহ তাআলার দেওয়া রহমত ও দয়ামায়ারই প্রকাশ। কাজেই কেউ শিশুকে চুমু না দিলে সেটা তার অন্তরে দয়ামায়া না থাকার আলামত। তোমরা যখন তোমাদের শিশুদের চুমু দাও না বলে স্বীকার করছ, তখন বোঝা যাচ্ছে তোমাদের অন্তরে দয়ামায়া নেই, আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তর থেকে তা তুলে নিয়েছেন। আর অন্তর দয়ামায়াশূন্য হয়ে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। এরূপ লোক কেবল যে শিশুদের চুমু দেয় না তাই নয়; তারা আরও অনেক গুরুতর অন্যায়-অপরাধ করতে পারে। ফলে তারা আল্লাহ তাআলার রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। তোমাদের যাতে সে পরিণতি না হয়, সেজন্য তোমাদের কর্তব্য অন্তরে দয়ামায়ার গুণ অর্জনের জন্য সাধনা করা। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- لا تنزع الرحمة إلا من شقي দয়ামায় তুলে নেওয়া হয় কেবল হতভাগার অন্তর থেকেই'।[৩]
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর রাযি. হতে বর্ণিত অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إن أبعد الناس من الله القلب القاسي আল্লাহ (-এর রহমত) থেকে সর্বাপেক্ষা দূরে কঠোরপ্রাণ মানুষ'।[৪]


হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আদর-সোহাগ করে শিশুদের চুমু দেওয়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত।

খ. শিশুদেরকে আদর-সোহাগ করা অন্তরস্থ রহমতের প্রকাশ।

গ. দীন সম্পর্কিত কোনও বিষয় অভিনব মনে হলে সে সম্পর্কে বিজ্ঞজনকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত।

[১] ফাতহুল বারী, খ. ১০, পৃ. ৫২৮; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫৯৮৩

[২] ফাতহুল বারী, খ, ১০, পৃ. ৫২৮

[৩] সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪২; সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২২; মুসনাদে আহমদ, হাদীছ নং ৮০০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৬২; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৩৭৪; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৪৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৩৯, বাগাবী, শারহুস-সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫১

[৪] জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬০০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩১৮৭৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২২৬ | মুসলিম বাংলা