রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২২২
মুসলিম ব্যক্তিবর্গের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকারসমূহ ও তাদের প্রতি স্নেহ-মমতার বর্ণনা

ঈমান ও ইসলামের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন লোক অনেক মর্যাদাবান হয়ে যায়। তাঁর কাছে এরকম লোকের জান-মাল-ইজ্জত সবকিছুরই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি চান মানুষ এই মর্যাদা অনুভব করুক ও তা রক্ষায় যত্নবান থাকুক। তাই কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে ঈমানদারদের এ তিন বস্তুর মর্যাদার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন প্রত্যেকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। যেন প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল-ইজ্জতের মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিক থাকে। এর জন্যে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানোরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বারবার ঘোষণা করা হয়েছে এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
কাজেই তারা যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত থাকে এবং কেউ কারও জান-মাল ইজ্জতের মর্যাদাক্ষুণ্নকারী কোনও কাজে লিপ্ত না হয়। সেরকম কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়। তাতে জুলুম হয় নিজের প্রতিও। জুলুম করা মহাপাপ। কাজেই একজন অন্যের প্রতি কোনওভাবেই জুলুম করবে না। নিজে জুলুম তো করবেই না। অন্যেও জুলুম করলে সেই ক্ষেত্রে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করবে এবং জালেমকেও জুলুম করা হতে বাঁচাবে।
যেহেতু এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই কেবল জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতার আচরণ করবে। স্নেহ-মমতার দাবি অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করা। অন্যের বিপদে সাহায্য করা এবং তার যে-কোনও অভাব ও প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা।অন্যের মান-সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং যে-কোনও অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে তার হেফাজত করা।
এভাবে চলার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে উঠে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। ফলে প্রত্যেকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সহজ হয়। সুগম হয়—অন্তর্নিহিত প্রতিভা, সম্ভাবনা ও মুনষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে আখেরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে এসব বিষয়-সম্বলিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এবার আমরা তার বাংলা তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন-আমীন।


‘মুসলিম ব্যক্তিবর্গের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের অধিকারসমূহ ও তাদের প্রতি স্নেহ-মমতা'-সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ

অর্থ : আর যে ব্যক্তি আল্লাহ যেসব জিনিসকে মর্যাদা দিয়েছেন তার মর্যাদা রক্ষা করবে, তার পক্ষে তার প্রতিপালকের কাছে এ কাজ অতি উত্তম। সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩০

ব্যাখ্যা
حُرُمَاتِ শব্দটি حرمة -এর বহুবচন। এর অর্থ মর্যাদা ও নিষিদ্ধতা। পরিভাষায় ওইসকল বস্তু ও বিষয়কে حُرُمَاتِ বলে, যাকে শরীআত মর্যাদাপূর্ণ করেছে। যেমন বায়তুল্লাহ, হারাম শরীফ, মসজিদ, আযান, নামায, কুরআন, হজ্জ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানী, কুরবানীর পশু ইত্যাদি। বস্তুত দীন ও শরীআত এবং শরীআতের যাবতীয় বিধান অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং এ শব্দটি দ্বারা সমগ্র দীন ও শরীআত এবং পৃথকভাবে শরীআতের প্রতিটি বিধানকে বোঝানো হয়ে থাকে।

এ আয়াতটি মূলত হজ্জ ও কুরবানী প্রসঙ্গে অবতীর্ণ। সে হিসেবে এর দ্বারা বিশেষভাবে বোঝানো হচ্ছে যে, মসজিদুল হারাম ও কুরবানীর পশুর প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা অবশ্যকর্তব্য। আর এর দাবি হচ্ছে, কেউ হজ্জের উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারামের পথে আগমন করলে প্রত্যেকের কর্তব্য তার জান-মালের যে-কোনও রকম ক্ষতি করা হতে বিরত থাকা এবং কোনও হাজী কুরবানীর পশু নিয়ে আসলে তাতে বাধা সৃষ্টি না করে নির্বিঘ্নে তা সেখানে পৌঁছতে দেওয়া ।

তবে আয়াতটি হজ্জ ও কুরবানী সম্পর্কিত হলেও এর শব্দ ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা حُرُمَاتِ শব্দটির মধ্যে শরীআতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ এবং শরীআত মর্যাদাপূর্ণ করেছে এমন সবকিছুই এসে যায়। সে হিসেবে আয়াতটি দ্বারা দীনের যাবতীয় বিষয়ের মর্যাদা রক্ষার প্রতি তাকিদ করা হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য শরীআত যা-কিছু করতে আদেশ করেছে তা পূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা। আর যা-কিছু করতে নিষেধ করেছে, পূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে তা থেকে বিরত থাকা। এর দ্বারাই শরীআতের আদেশ-নিষেধের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য মসজিদের আদব রক্ষা করা, নামাযীকে সম্মান করা, আলেমকে ভক্তি করা, দীনের খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে মর্যাদা দেওয়া এবং এমনিভাবে দীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ের কদর করা। কেননা দীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকার কারণে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

আল্লাহ তা'আলা বলছেন- আল্লাহ তা'আলা যা-কিছুকে মর্যাদাপূর্ণ করেছেন, যে ব্যক্তি তার মর্যাদা রক্ষা করবে, তার জন্য তা উত্তম ও কল্যাণকর। অর্থাৎ মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ের মর্যাদা রক্ষা করার দ্বারা তার নিজেরই কল্যাণ সাধিত হবে।

বলা হয়েছে, فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ (এটা উত্তম ও কল্যাণকর তার প্রতিপালকের কাছে)। এর দ্বারা বান্দার দৃষ্টিকোণ আল্লাহর দিকে ফেরানো হয়েছে। অর্থাৎ এসব বস্তুর মর্যাদা রক্ষা করবে নিজ প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে, তাঁর সন্তুষ্টিবিধানের জন্য এবং তাঁরই কাছে প্রতিদান পাওয়ার আশায়; মানুষের কাছে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নয় এবং নয় পার্থিব কোনও স্বার্থে। আর যেহেতু মানুষের কাছে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, তাই মানুষ যদি এ কাজে নিরুৎসাহিত করে বা বাধা দেয় কিংবা সমাজ ও পরিবেশ তা পসন্দ না করে, তবে উৎসাহ হারানো ও দমে যাওয়া চলবে না। সমাজ ও মাখলূক দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যথারীতি আপন কর্তব্য পালনে রত থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে, এর কল্যাণ ও উত্তম প্রতিদান আল্লাহ তাআলার কাছে আছে। সুতরাং সম্মান প্রদর্শনের কাজটি বৃথা যাওয়ার নয়। আখেরাতে এর বিনিময় তো পাওয়া যাবেই, আল্লাহ চাহেন তো দুনিয়ায়ও এর নগদ পুরস্কার লাভ হতে পারে। বস্তুত দীন ও শরীআতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তথা তার অনুসরণ দ্বারা পার্থিব কল্যাণও লাভ হয়ে থাকে; বরং পার্থিব প্রকৃত কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত ।

দুই নং আয়াত

وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থ : আর কেউ আল্লাহর ‘শাআইর’-কে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়। সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩২

ব্যাখ্যা
আল্লাহর শা’আইর মানে আল্লাহর দীনের শাআইর। شَعَائِرَ শব্দটি شعيرة বা شعار-এর বহুবচন। এর অর্থ আলামত ও নিদর্শন। পরিভাষায় শাআইর (شَعَائِرَ) বলা হয় বিষয় ও বস্তুকে, যা কোনও ধর্ম বা মতাদর্শের একান্ত বিষয় ও তার এমনসব পরিচায়ক। সুতরাং ‘দীনে ইসলাম'-এর শাআইর বলতে এমনসব বিষয় ও বস্তুকে বোঝাবে, যা এ দীনের পরিচয় বহন করে বা যা একান্তভাবে এ দীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। এভাবেও বলা যায় যে, যেসকল বিষয় দেখলে বা শুনলে বোঝা যায় যে, এটা কেবল ইসলামেরই জিনিস, অন্যকিছুর নয়, তাকেই দীনের শাআইর বলে। যেমন ওযূ, আযান, নামায, মসজিদ, বায়তুল্লাহ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানীর পশু, কুরআন এবং দীনের প্রকাশ্য বিধানাবলী ।

এ আয়াতে দীনের শাআইরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ এটা অন্তরের তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়'। অর্থাৎ যার অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি আছে, সে-ই এটা করে। সে হিসেবে এটা তাকওয়ার আলামতও বটে। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল, তাকওয়া অন্তরের বিষয়। এক হাদীছেও আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইশারা করে বলেন-
أَلَا إِنَّ التَّقْوَى ههُنَا
‘জেনে রেখ, তাকওয়া এখানে'।

তাকওয়া যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই তা চোখে দেখা যায় না। আলামত দ্বারা বোঝা যায়। শাআইরকে সম্মান করা একটা আলামত। কেউ এটা করলে এর দ্বারা বোঝা যায় তার অন্তরে তাকওয়া আছে।

এ আয়াত দ্বারা মূলত মু'মিন-মুত্তাকীকে তাগিদ করা হয়েছে সে যেন দীনের শা‘আইর ও নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে ও তার আদব বজায় রাখে। সুতরাং মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য মসজিদ ও বায়তুল্লাহর আদব রক্ষা করা, কুরআন ও আযানের তাযীম করা, কুরবানীর পশুকে গুরুত্বদান ও যত্ন করা, দীনী কাজের কেন্দ্রসমূহ ও তাতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের কদর করা ইত্যাদি।

এর আগের আয়াতে শিরকী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে, যার সারকথা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে সম্মান ও শ্রদ্ধাভক্তি করা একটি নিন্দনীয় কাজ এবং সে শ্রদ্ধাভক্তি যদি আল্লাহ তা'আলাকে শ্রদ্ধাভক্তির সমপর্যায়ের হয়ে যায়, তবে তো তা সম্পূর্ণরূপেই বেঈমানী কাজ। এর দ্বারা কেউ মনে করতে পারত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনওকিছুকে কোনওপর্যায়েই শ্রদ্ধাভক্তি করা যাবে না। এ আয়াত সে ধারণা খণ্ডন করে দিচ্ছে। এতে বলা হয়েছে যে, যে-কোনও গায়রুল্লাহকে যে-কোনও পর্যায়ের শ্রদ্ধাভক্তি করা নিন্দনীয় নয়; বরং যেসকল ব্যক্তি ও বিষয় আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত, শরীআত প্রদর্শিত পন্থায় তার সম্মান রক্ষা করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম এবং এটা করা তাকওয়া ও আল্লাহভীতির অন্তর্ভুক্ত।

তিন নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ : আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দাও। সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮

ব্যাখ্যা
جناح-এর অর্থ ডানা। মৌলিকভাবে শব্দটি পাখির ডানার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাত বোঝানোর জন্যও এর ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে যে-

وَاضْمُمْ إِلَيْكَ جَنَاحَكَ مِنَ الرَّهْبِ

‘ভয় দূর করার জন্য তোমার বাহু নিজ শরীরে চেপে ধর। সূরা কাসাস (২২), আয়াত ৩২

পিতামাতার প্রতি কোমল ব্যবহারের নির্দেশ সম্পর্কিত এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ

‘তাদের প্রতি মমতায় নম্রতার ডানা নামিয়ে দাও। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৪

আলোচ্য আয়াতে ‘ডানা নামানো’ দ্বারা নম্রতা ও মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়েছে। ‘ডানা নামানো’ কথাটি আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয় পাখির ক্ষেত্রে। পাখি যখন তার ছানাদেরকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তখন প্রথমে ডানা বিস্তার করে দেয়, তারপর ছানারা যখন তার শরীরের সঙ্গে এসে মিশে যায়, তখন তাদের উপর তা নামিয়ে দেয়। এটা ছানাদের প্রতি তার মমত্বের আচরণ। নিজ অনুসারী ও অধীন ব্যক্তিবর্গকে অনুরূপ কাছে নিয়ে আসা ও তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করাকে পাখির এ আচরণের সঙ্গে উপমিত করা হয়েছে এবং সে হিসেবেই পাখির জন্য ব্যবহৃত শব্দমালাকে এস্থলে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং ‘মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও’ -এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি নম্র-কোমল ও মমত্বের আচরণ কর, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।

সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। এ আয়াতে প্রথমে তাঁকে নিষেধ করা হয়েছিল যেন তিনি কাফেরদের বিত্ত-বৈভবের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেন। কেননা তাঁকে যে-কুরআন ও আসমানী ইলম দেওয়া হয়েছে সে তুলনায় ওসব বিত্ত-বৈভবের কোনও মূল্য নেই। এমনিভাবে তাঁকে নিষেধ করা হয়েছিল তারা ঈমান না আনার কারণে তিনি যেন তাদের প্রতি দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশ না করেন। কেননা সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তাদের ঈমান না আনাটা কেবলই তাদের অহমিকা ও হঠকারিতা। যারা অহংকার ও হঠকারিতার কারণে সত্য প্রত্যাখ্যান করে ও সত্যের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে, তারা এমন মমত্ব ও বাৎসল্য পাওয়ার উপযুক্ত নয়। তা পাওয়ার উপযুক্ত তো ওইসকল মুমিন ও মুসলিম, যারা গরীব ও অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও সত্য কবুল করে নিয়েছে এবং সত্যের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছে। তাই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ করেছেন যেন তিনি গরীব মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল হয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি এই চরিত্রেরই ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশদান দ্বারা মূলত আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন একে অন্যের প্রতি কোমল আচরণ করি ও মায়া-মমতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকি। যেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘যারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪

অপর এক আয়াতে আছে-

مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র। সূরা ফাত্হ (৪৮), আয়াত ২৯

চার নং আয়াত

مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا

অর্থ : কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৩২

ব্যাখ্যা
অর্থাৎ অন্যায়ভাবে কোনও এক ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধ দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করলে যে অপরাধ হয় তার সমতুল্য। কেননা কোনও ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে কেবল তখনই হত্যা করতে পারে, যখন তার অন্তরে মানুষের প্রাণের মর্যাদা বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এরূপ ব্যক্তি নিজের তুচ্ছ তুচ্ছ স্বার্থের খাতিরে একের পর এক নরহত্যায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অন্যায়ভাবে যে ব্যক্তি কোনও একজন মানুষকে হত্যা করে, সে প্রয়োজনে জগতের সমস্ত মানুষকেও হত্যা করতে পারবে। সে হিসেবেই বলা হয়েছে- সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল।

তাছাড়া অন্যায় নরহত্যা দ্বারা যখন কেউ তার হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়, তখন অন্যরাও তা দ্বারা উৎসাহ পায়। তার দেখাদেখি অন্যরাও নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য খুনখারাবি করতে সাহসী হয়ে ওঠে। এভাবে মানুষের অন্তর থেকে ব্যাপকভাবে অন্যের জান-মালের মর্যাদাবোধ লোপ পেয়ে যায়। আর যখন এ জাতীয় মানসিকতা ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন সমস্ত মানুষই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। এদিকে লক্ষ করলে এক ব্যক্তিকে হত্যা করা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করার নামান্তর হয়ে যায়।

এর দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা কী গুরুতর পাপ । অর্থাৎ দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করা যে পর্যায়ের পাপ, একজনমাত্র মানুষকে হত্যা করাও যেন সেই পর্যায়ের পাপ।

এ আয়াত মুমিনদের অন্তরে মানুষের প্রাণের মর্যাদাবোধ সঞ্চার করে। মুমিনকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, অন্যায় নরহত্যাকে তুমি দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য পাপ মনে করে অবশ্যই এর থেকে বিরত থাকবে। নিজে তো বিরত থাকবেই, সেইসঙ্গে অন্যকেও বিরত রাখার চেষ্টা করবে। যদি কারও দ্বারা কখনও এ অপরাধ হয়ে যায়, তবে হত্যাকারীকে সমস্ত মানুষের হত্যাকারীরূপে সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধী গণ্য করবে এবং তাকে বিচারের আওতায় আনতে ভূমিকা রাখবে; তাতে সে নিহত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন ।

তারপর এ আয়াতে বলা হয়েছে- وَمَنْ أَحْيَاهَا আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে (সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণ রক্ষা করল)'। أَحْيَا-এর মূল অর্থ জীবিত করল। এখানে বোঝানো উদ্দেশ্য জীবনরক্ষায় ভূমিকা রাখল। কেননা জীবিত করা কেবল আল্লাহ তাআলারই কাজ। এটা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ কেবল জীবনরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। এটা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন পানিতে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করা, কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তার ভেতর থেকে মানুষজনকে বের করে আনার চেষ্টা করা, ভূমিধ্বস বা ভূমিকম্পে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে চাপা পড়ামানুষকে উদ্ধার করা, অন্যায় বিচারকার্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির মুক্তিতে সহায়তা করা, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করা ইত্যাদি। মানুষের জীবনরক্ষামূলক এ জাতীয় প্রচেষ্টা আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই প্রশংসনীয়। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা এরূপ প্রচেষ্টাকে 'জীবনরক্ষা' না বলে 'জীবিত করা' শব্দে প্রকাশ করেছেন। এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার কাজের একপ্রকার মূল্যায়ন কতইনা মেহেরবান মহান আল্লাহ। সেইসঙ্গে তিনি কোনও এক ব্যক্তির প্রাণরক্ষাকে সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষাতুল্য গণ্য করেছেন। অর্থাৎ এক ব্যক্তির প্রাণরক্ষা করলে ওই পরিমাণ ছাওয়াব পাওয়া যাবে, যা সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করে পাওয়া সম্ভব।

এক ব্যক্তির প্রাণরক্ষা বাস্তবিকপক্ষেও সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করার সমতুল্য। কেননা যে ব্যক্তি এটা করে, তার অন্তরে মানুষের প্রাণের মর্যাদাবোধ আছে বলে প্রমাণিত হয়। আর যার অন্তরে মানবপ্রাণের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত আছে, তার দিক থেকে দুনিয়ার সমস্ত মানুষই নিরাপদ থাকবে। সে কোনও অবস্থায় অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না। দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করার ক্ষমতা থাকলেও সে অবশ্যই এ গুরুতর অপরাধ করা হতে নিজেকে বিরত রাখবে।

তাছাড়া যে ব্যক্তি মানুষের জীবনরক্ষায় ভূমিকা রাখে, তার দেখাদেখি অন্য মানুষও এ কাজে অনুপ্রাণিত হয়। অন্যদের অন্তরেও মানুষের প্রাণের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। বলাবাহুল্য- সমাজের সর্বস্তরে মানুষের মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের জান- মালের নিরাপত্তাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ হিসেবে কোনও একজনের প্রাণরক্ষা সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষাতুল্য একটি মহত্তম কাজই বটে।

কাউকে কুফর থেকে ঈমান ও ইসলামের দিকে নিয়ে আসাটাও একরকম জীবনদান। হাসান বসরী রহ. বলেন, কোনও ব্যক্তিকে কুফর থেকে মুক্ত করা জীবনদানের শ্রেষ্ঠতম স্তর। এর প্রমাণ কুরআন মাজীদের আয়াত-
أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا
‘একটু বল তো, যে ব্যক্তি ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য এক আলোর ব্যবস্থা করেছি, যার সাহায্যে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে, সে কি ওই ব্যক্তির মত হতে পারে, যার অবস্থা এই যে, সে অন্ধকার দ্বারা পরিবেষ্টিত, যা থেকে সে কখনও বের হতে পারবে না? সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১২২

এখানে ‘মৃত’ বলে কাফের ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে আর তাকে জীবিত করা দ্বারা ঈমান দান করা বোঝানো হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা গেল কোনও অমুসলিম ব্যক্তিকে দাওয়াত দিয়ে ঈমানের উপর নিয়ে আসাও তাকে একরকম জীবন দান করাই বটে। আর এটা শ্রেষ্ঠতম জীবনদান এ কারণে যে, এর ভিত্তিতে মৃত্যুর পর স জান্নাতের অনন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারবে।

এ আয়াতে অন্যায় নরহত্যাকে গুরুতর পাপ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-

بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ
‘তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়'।

অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন কাউকে হত্যা করে, যে নিজে কাউকে হত্যা করেনি কিংবা সে পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ডও করেনি। এর দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে বা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ড করে, তাকে হত্যা করা পাপ নয়; বরং তাকে হত্যা করা যাবে। এটা ভিন্ন কথা যে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায় না। আইনপ্রয়োগ সরকারের কাজ। শরীআত হত্যাকারীকে হত্যা করার অধিকার জনসাধারণকে দেয়নি; বরং এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে শাসকদের উপর। শাসকদেরই কর্তব্য হত্যাকারীর উপর শরীআতনির্ধারিত দণ্ডবিধান কার্যকর করা।

যাহোক এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় দুই শ্রেণীর লোকের প্রাণের নিরাপত্তা থাকে না- ক. যারা নরহত্যার অপরাধ করে এবং খ. যারা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ড করে। শরীআত এদেরকে প্রাণদণ্ডের বিধান দিয়েছে।

‘অশান্তি বিস্তারমূলক’ কথাটি অনেক ব্যাপক। ডাকাতি করা, ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, জনমনে ত্রাস সৃষ্টিকারী তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি সবই অশান্তি বিস্তারমূলক কাজ। এসব কাজের ধরন অনুপাতে শরীআত বিভিন্নরকম শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। কাজটি যদি খুন-খারাবিমূলক হয়, তবে তার জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা। সে হিসেবে এটা প্রথম প্রকারেরই অন্তর্ভুক্ত। তবে অধিকতর ভয়ানক হওয়ার কারণে একে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ।

এর বাইরেও এমনকিছু অপরাধ আছে, যাতে লিপ্ত ব্যক্তির উপর প্রাণদণ্ডের বিধান আরোপিত হয়। যেমন মুরতাদ অর্থাৎ যে মুসলিম ব্যক্তি ইসলাম পরিত্যাগ করে, শাসকের কর্তব্য তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া। এটা সম্পূর্ণ ইনসাফভিত্তিক আইন। রাষ্ট্রদ্রোহী যদি মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত হয়, তবে আল্লাহদ্রোহী কেন এ শাস্তির উপযুক্ত হবে না, যখন সে একইসঙ্গে আল্লাহদ্রোহী হওয়ার পাশাপাশি মুসলিম রাষ্ট্রেরও বিদ্রোহী বটে?

এমনিভাবে বিবাহিত নর-নারী ব্যভিচারের অপরাধ করলে শরীআত তাদেরকেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়েছে।

এই মোট তিন প্রকার হল। ইসলামের কারণে মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি এ তিন প্রকারের যে-কোনও একটিতে লিপ্ত হলে তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায় এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী তাকে হত্যা করা আদালতের দায়িত্ব হয়ে যায়। এছাড়া অন্য কোনও অপরাধের কারণে কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় না। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ ، إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ : النَّفْسُ بِالنَّفْسِ ، وَالثَّيِّبُ الزَّانِي ، وَالْمُفَارِقُ لِدِينِهِ , التَّارِكُ لِلْجَمَاعَةِ
‘কোনও মুসলিম ব্যক্তির রক্ত তিনটি কারণের কোনও একটি ছাড়া হালাল হয়। না-(ব্যভিচারের কারণে) বিবাহিত ব্যভিচারকারী(-এর রক্ত হালাল হয়ে যায় অর্থাৎ তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়), কাউকে হত্যার কারণে হত্যাকারীকে হত্যা করা এবং যে ব্যক্তি দীন পরিত্যাগ করে মুসলিম জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় (দীন পরিত্যাগের কারণে তারও প্রাণের নিরাপত্তা রহিত হয়ে যায়)।[১]

[১] সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪০২; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ২৪৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৩৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪০১৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৪০৮
মুমিনদের পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা
হাদীছ নং : ২২২

হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুমিন মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। এই বলে তিনি এক হাতের আঙ্গুলসমূহ অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখান -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৮১০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৩১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭৯০)
27 - باب تعظيم حرمات المسلمين وبيان حقوقهم والشفقة عليهم ورحمتهم
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّه} [الحج: 30]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ} [الحج: 32]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ} [الحجر: 88]، وَقالَ تَعَالَى: {مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا} [المائدة: 32].
222 - وعن أَبي موسى - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «المُؤْمِنُ للْمُؤْمِنِ كَالبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا» وشبَّكَ بَيْنَ أصَابِعِهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ঈমান ও ইসলামের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন লোক অনেক মর্যাদাবান হয়ে যায়। তাঁর কাছে এরকম লোকের জান-মাল-ইজ্জত সবকিছুরই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি চান মানুষ এই মর্যাদা অনুভব করুক ও তা রক্ষায় যত্নবান থাকুক। তাই কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে ঈমানদারদের এ তিন বস্তুর মর্যাদার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন প্রত্যেকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। যেন প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল-ইজ্জতের মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিক থাকে। এর জন্যে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানোরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বারবার ঘোষণা করা হয়েছে এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
কাজেই তারা যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত থাকে এবং কেউ কারও জান-মাল ইজ্জতের মর্যাদাক্ষুণ্নকারী কোনও কাজে লিপ্ত না হয়। সেরকম কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়। তাতে জুলুম হয় নিজের প্রতিও। জুলুম করা মহাপাপ। কাজেই একজন অন্যের প্রতি কোনওভাবেই জুলুম করবে না। নিজে জুলুম তো করবেই না। অন্যেও জুলুম করলে সেই ক্ষেত্রে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করবে এবং জালেমকেও জুলুম করা হতে বাঁচাবে।
যেহেতু এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই কেবল জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতার আচরণ করবে। স্নেহ-মমতার দাবি অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করা। অন্যের বিপদে সাহায্য করা এবং তার যে-কোনও অভাব ও প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা।অন্যের মান-সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং যে-কোনও অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে তার হেফাজত করা।
এভাবে চলার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে উঠে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। ফলে প্রত্যেকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সহজ হয়। সুগম হয়—অন্তর্নিহিত প্রতিভা, সম্ভাবনা ও মুনষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে আখেরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে মুমিনদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদের সমাজকে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, মুমিনগণ তাদের দীন ও দুনিয়া কোনও ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী থাকতে পারে না।
তিনি বিষয়টাকে চাক্ষুষভাবে বোঝানোর জন্য এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখিয়ে দেন। شبك অর্থ জাল বানালেন। জাল বুনতে যেমন এক সুতার মধ্যে আরেক সুতা ঢুকাতে হয়, তেমনি করে যেহেতু এক হাতের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে অপর হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দেখিয়েছিলেন, তাই একে شبك বা 'জাল বুনলেন' শব্দে প্রকাশ করেছেন। দু'হাতের আঙ্গুল দ্বারা জাল বুনলে তা ঠিক প্রাচীরের মতই শক্ত-পোক্ত হয়ে যায়। ফলে প্রাচীরের ইটসমূহের মতই আঙ্গুলগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন করা সহজ হয় না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাস্তব উদাহরণ দ্বারা দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে মুমিনদেরকে পরস্পর মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকতে হবে।
তিনি প্রাচীরের উদাহরণ দিয়েছেন। কোনও প্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রথমে তার ভিত্তি স্থাপন করা হয়, তুলনামূলকভাবে উপর অংশের তুলনায় ভিত্তিকে বেশি মজবুতরূপে গড়ে তোলা হয়। তারপর সে ভিত্তির উপর এক-একটি করে ইট গেঁথে প্রাচীরের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীরে সবগুলো ইট পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকে আর তার একটি দ্বারা অন্যটি এমন সুদৃঢ় হয় যে, সহজে সে প্রাচীর থেকে কোনও একটি ইট পৃথক করা যায় না। কিন্তু ইটগুলো যদি পরস্পর সংযুক্ত না থেকে বরং ফাঁকা ফাঁকা থাকে, তবে প্রাচীর তো নির্মিত হতেই পারে না এবং পৃথকভাবে সেগুলোর কোনও শক্তিও থাকে না, যার যেমনি ইচ্ছা তা সরিয়ে ফেলতে বা নিয়ে যেতে পারে। মুসলিম সমাজের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদের মধ্যে কেউ থাকে শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। দুর্বলের কর্তব্য শক্তিশালীর সাথে মিশে থাকা আর শক্তিশালীর কর্তব্য দুর্বলকে নিজ পাশে রাখা। এতে করে শক্তিশালীর শক্তি বৃদ্ধি পায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তার শক্তিতে দুর্বলও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এভাবে গোটা সমাজ সুগঠিত ও সুসংহত হয়। তখন কোনও শত্রুর পক্ষে সে সমাজের ক্ষতিসাধন করা সহজ হয় না। এমনকি শত্রুপক্ষ তাদের কোনও দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গেও লাগার সাহস করে না। কেননা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে গোটা সমাজের শক্তি তার সঙ্গে।
অপরদিকে সকল মুসলিম একতাবদ্ধ না থাকলে কেবল দুর্বল ব্যক্তিই দুর্বল হয়ে থাকে না, শত্রুর চোখে সবল ব্যক্তিও দুর্বল হয়ে থাকে। কেননা একা এক ব্যক্তির শক্তি যতই বেশি হোক-না কেন, সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে তা কোনও কাজের নয়। এ কারণেই কুরআন মাজীদ মুমিনদেরকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত না হয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে জোর তাগিদ করেছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।
আরও ইরশাদঃ- وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে।
এসব আয়াতের দাবি হচ্ছে সকল মুসলিম সর্বদা একতাবদ্ধ থাকবে। আত্মকলহেও লিপ্ত হবে না এবং কেউ বিচ্ছিন্ন হয়েও থাকবে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের শক্তি যোগাবে ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করবে।
পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য সর্বস্তরের লোকের প্রয়োজনীয়তা
এ হাদীছে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো হচ্ছে যে, প্রাচীরের প্রত্যেক অংশ যেমন অন্য অংশকে শক্তি যোগায়, তেমনি প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য অপর মুসলিমকে শক্তি যোগানো। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, অন্যকে শক্তি যোগানো তো কেবল শক্তিমানের পক্ষেই সম্ভব; যে ব্যক্তি নিজেই দুর্বল সে কিভাবে অন্যের উপকারে আসবে?
প্রকৃতপক্ষে অন্যের কোনও না কোনও উপকার করা প্রত্যেকের পক্ষেই সম্ভব। কেননা শক্তি-সামর্থ্য বলতে কেবল পেশীশক্তি বা অর্থবলকেই বোঝায় না; বরং এর মধ্যে অনেক ব্যাপকতা রয়েছে। একেকজন মানুষ একেকরকম যোগ্যতা ও একেকরকম ক্ষমতা রাখে। কারও আছে বুদ্ধিবল, কারও বিদ্যাবল, কারও লোকবল, কারও অর্থবল। এমনিভাবে বিভিন্ন রকম কারিগরি-ক্ষমতা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানারকম বৃত্তি ও বিবিধ প্রতিভা, এর প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর। এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যার মধ্যে এই বিবিধপ্রকার কল্যাণকর গুণের কোনও একটিও বিদ্যমান নেই। প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে অন্যের উপকারে আসে এমন কোনও না কোনও যোগ্যতা ও ক্ষমতা পাবেই এবং সে ক্ষমতাটি এমন যে, একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তা অতীব প্রয়োজন। একজন কামার তার পেশাজনিত যোগ্যতা ব্যবহার না করলে অন্যসব লোকের যে বহু প্রয়োজনীয় কাজ আটকে যাবে এবং তাদেরকে কঠিন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে– এ কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই এ পেশার লোক সমাজের অবশিষ্ট লোকদের পক্ষে পরম উপকারী বৈকি। বাহ্যদৃষ্টিতে তাদেরকে যতই দুর্বল ভাবা হোক-না কেন, বাস্তবিকপক্ষে সামাজিক সচলতায় তারাও বিশেষ ধরনের শক্তি যুগিয়ে থাকে। সুতরাং এ হাদীছের মর্মার্থ তাদেরকেও শামিল করে।
ইমাম রাগিব রহ. বলেন, পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য কোনও ব্যক্তির যা-কিছু প্রয়োজন, তার সবটা তার নিজের একার পক্ষে যোগানো সম্ভব নয়। সেজন্য অন্যদের সহযোগিতা তার লাগবেই। এক লোকমা খাবার সংগ্রহ করতে প্রথমে জমি চাষাবাদ করতে হয়, সেখানে ফসল বুনতে হয়, তারপর ফসল কাটা, তা মাড়াই করা, তা পেষাই করা, তারপর রুটি তৈরি করা, এর জন্য যেসকল আসবাব-উপকরণ ও সরঞ্জামাদি
দরকার তা তৈরি করা ইত্যাদি যত কাজের প্রয়োজন তা হিসাব করে শেষ করাও তো কঠিন। কোন ব্যক্তির পক্ষে একা তা সব আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব? এজন্যই বলা হয়, মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। সমষ্টি থেকে পৃথক হয়ে একা জীবনযাপন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে প্রত্যেকেই অন্যের মুখাপেক্ষী। এ হাদীছ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইমাম নববী রহ. এ হাদীছটি মুসলমানদের পারস্পরিক মান-সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন সম্পর্কিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীছ দ্বারা পরোক্ষভাবে তা প্রমাণিত হয়। কেননা মুমিনগণ যখন পরস্পর প্রাচীরস্বরূপ, যাদের কর্তব্য একে অন্যকে শক্তিশালী করা ও একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় লিপ্ত থাকা, তখন তাদের একজন দ্বারা অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের ক্ষয়ক্ষতি করার তো প্রশ্নই আসে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের হেফাজতে যত্নবান থাকবে। কেউ কারও কোনও প্রকার হক নষ্ট করবে না; বরং সর্বপ্রকার হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকবে। অন্য কারও পক্ষ থেকে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হলে সকল মুসলিম তার পাশে দাঁড়াবে। যে-কোনও মুসলিমের জান-মাল বা ইজ্জতের উপর শত্রুর আক্রমণকে সকলে মিলে প্রতিহত করবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ মুমিনদেরকে সর্বাবস্থায় একতাবদ্ধ হয়ে থাকার জোর তাকিদ দেয়।

খ. এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একতাবদ্ধ হয়ে থাকার দ্বারা সামাজিক শক্তি অর্জিত হয় আর এতে করে সমাজের প্রত্যেকের পক্ষে তার জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজত করা সহজ হয়।

গ. এ হাদীছ যেহেতু সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে তাকিদ করেছে, তাই এর দ্বারা এ শিক্ষাও লাভ হয় যে, সকলকে ঐক্য পরিপন্থী যে-কোনও কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।

ঘ. জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা লাভ করা প্রত্যেকের সামাজিক অধিকার। এতে অন্যায় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ হারাম। এর দ্বারা ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। তাই প্রত্যেকের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

ঙ. ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার এক দাবি এটাও যে, প্রত্যেকে তার সাধ্যমত অপরের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাবে এবং একজনের দুঃখ-কষ্ট সকলে ভাগাভাগি করে নেবে।

চ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, উপযুক্ত উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত কোনও বিষয়বস্তু সহজে বোঝার পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। কাজেই শিক্ষক বা উপদেশদাতা প্রয়োজনে এ নীতি অবলম্বন করতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)