রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২১৪
জুলুমের প্রতি নিষেধাজ্ঞা এবং জুলুমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার হুকুম।
মিথ্যা কসম দ্বারা অন্যের অধিকার হরণের পরিণাম
হাদীছ নং : ২১৪

হযরত আবূ উমামা ইয়াস হবন ছা'লাবা আল-হারিছী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি (মিথ্যা) শপথের মাধ্যমে কোনও মুসলিমের হক আত্মসাৎ করল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করবেন এবং তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন। তখন জনৈক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদিও তা কোনও তুচ্ছ জিনিস হয়? তিনি বললেন, যদিও তা আরাক গাছের একটা ডালাও হয়- মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৩৭: মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ১১। সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫৪১৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৪৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫০৮, তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৯২১৯)
26 - باب تحريم الظلم والأمر بردِّ المظالم
214 - وعن أَبي أمامة إياس بن ثعلبة الحارثي - رضي الله عنه: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَن اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِم بيَمِينه، فَقَدْ أَوْجَبَ اللهُ لَهُ النَّارَ، وَحَرَّمَ عَلَيهِ الجَنَّةَ» فَقَالَ رَجُلٌ: وَإنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيرًا يَا رَسُول الله؟ فَقَالَ: «وإنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاك». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মিথ্যা কসমের মাধ্যমে অন্যের অধিকার হরণ করা কী কঠিন পাপ এবং তার পরিণাম কী ভয়াবহ সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন-

من اقتطع حق امرئٍ مسلمٍ بيمينه

'যে ব্যক্তি (মিথ্যা) শপথের মাধ্যমে কোনও মুসলিমের হক আত্মসাৎ করল।'
এতে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থ-সম্পদ না বলে 'হক' বলা হয়েছে। অর্থ-সম্পদ অপেক্ষা হক অনেক ব্যাপক। কারও হক ও অধিকার অর্থ-সম্পদের বাইরেও হতে পারে, যেমন মানুষের মান-সম্মান সম্পর্কিত অধিকার। এ অধিকার খর্ব করা জায়েয নয়। কেউ যদি কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাতে তার সম্মানহানি হয়। এ অবস্থায় সেই ব্যক্তি যদি অপবাদদাতার বিরুদ্ধে মামলা করে আর অপবাদদাতা মিথ্যা কসম দ্বারা তার অভিযোগ সত্য প্রমাণ করে, তবে তার এ কসম দ্বারা ওই ব্যক্তির সম্মান হরণ করা হল। এছাড়াও পেছনে অন্যের বদনাম করে তার সপক্ষে যদি মিথ্যা কসম করে আর লোকে সে বদনামটি সত্য বলে বিশ্বাস করে নেয়, এতেও যার নামে বদনাম করা হয় তার সম্মানহানি ঘটে। মোটকথা অন্যের অধিকার জান সম্পর্কিত হোক বা মাল সম্পর্কিত হোক কিংবা হোক মান-ইজ্জত সম্পর্কিত, সর্বাবস্থায়ই মিথ্যা কসম দ্বারা যদি তা খর্ব করা হয়, তা এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে। হাদীছে এর পরিণাম বলা হয়েছে যে-

فَقَدْ أَوْجَبَ اللَّهُ لَهُ النَّارَ، وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ

'আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করবেন এবং তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন।'
অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্যের অধিকার হরণ করে সে যদি মৃত্যুর আগে খাঁটি তাওবা না করে এবং যে ব্যক্তির অধিকার হরণ করেছে তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে না নেয়, তবে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে। সে প্রথমেই জান্নাতে যেতে পারবে না। এ পাপের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রথমে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঈমানের বদৌলতে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে নেওয়া হবে। জাহান্নামের ক্ষণিকের শাস্তিও দুনিয়ার হাজারও বছরের ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষাও কঠিন। তাই জাহান্নামের ক্ষণিকের শাস্তিভোগও কারও কাম্য হতে পারে না। আর তা কাম্য না হওয়ার অপরিহার্য দাবি হচ্ছে অন্যের কোনও প্রকার অধিকার নষ্ট না করা এবং যেসকল কারণে অন্যের হক নষ্ট হয় তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা। এ হাদীছে যদিও মুসলিম ব্যক্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, অন্যায়ভাবে কারও হকই নষ্ট করা জায়েয নয়, তা সে ব্যক্তি মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মিথ্যা কসম দ্বারা অন্যের হক নষ্ট করার এ কঠিন পরিণামের কথা শোনালেন, তখন উপস্থিত কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগল- এ পরিণাম কি তুচ্ছ অধিকার হরণের কারণেও হবে? বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য হযরত আবূ উমামা রাযি, নিজেই বা অন্য কেউ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন। তিনি উত্তর দিলেন-

«وَإِنْ كَانَ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ»

যদিও তা আরাক গাছের একটা ডালাও হয়।

'আরাক' মরু অঞ্চলের এক প্রকার গাছ। এর ডালা দ্বারা মিসওয়াক বানানো হয়। বরং মিসওয়াক হিসেবে এর ডালাই সর্বোত্তম। এমনি আরাক গাছের কাণ্ড তেমন কিছু মূল্যবান নয় । তার ডালা তো আরও বেশি তুচ্ছই হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেরকম তুচ্ছ বস্ত্র হরণকেও এ হাদীছের সতর্কবাণীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থাৎ এতটুকু বস্তুও মিথ্যা কসমের দ্বারা আত্মসাৎ করার পর যদি বিনা তাওবায় মৃত্যু ঘটে, তবে জাহান্নামে যাওয়া অবধারিত হয়ে যায়। এর দ্বারা অনুমান করা যায় মিথ্যা কসম দ্বারা অন্যের অধিকার হরণ করা কী কঠিন পাপ।

এটা এত কঠিন হওয়ার কারণ- প্রথমত কসম করা কিছু পসন্দনীয় কাজ নয়। কেননা কসমে আল্লাহর নাম ব্যবহৃত হয়। তাঁর মহামর্যাদাপূর্ণ নামকে পার্থিব বিষয়ে ব্যবহার করা তাঁর নামের এক প্রকার অমর্যাদা করাই বটে, তাতে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে সে বিষয়টি যত মূল্যবানই হোক না কেন। দ্বিতীয়ত সে কসমটি যদি হয় মিথ্যা অর্থাৎ নিজের মিথ্যা দাবিকে সত্যরূপে প্রমাণের লক্ষ্যে, তবে তো তা এ নামের সঙ্গে সরাসরি বেআদবী। আল্লাহ তা'আলা তাঁর নামের সাথে কসম করাকে এরূপ অন্যায় ব্যবহার করতে স্পষ্টভাবেই নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَلَا تَتَّخِذُوا أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ

তোমরা নিজেদের শপথকে পরস্পরের মধ্যে অনর্থ সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করো না। সূরা নাহল(১৬) আয়াত ৯৪

আবার এরূপ কসম দ্বারা যদি অন্যের অধিকার হরণ করা হয়, যা কিনা এমনিই কঠিন পাপ, তবে তো এ আচরণ আল্লাহ তা'আলার নামের প্রতি চরম ধৃষ্টতা। যেহেতু মিথ্যা কসম দ্বারা অন্যের হক নষ্ট করার মধ্যে এ তিন প্রকারের অন্যায় মিলিত হয়ে যায়, সেজন্যই একে এত কঠিন পাপরূপে উল্লেখ করে এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এরকম পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে হেফাজত করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মিথ্যা কসম দ্বারা অন্যের হক আত্মসাৎ করা কঠিন পাপ। এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

খ. অন্যের হকের মর্যাদা রক্ষা করা চাই, তা যত তুচ্ছই হোক না কেন। কেননা সে মর্যাদা লঙ্ঘন করার পরিণাম জাহান্নামের শাস্তি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২১৪ | মুসলিম বাংলা