রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২০২
আমানত আদায় প্রসঙ্গ।
হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি.-এর ঋণ পরিশোধের ঘটনা
হাদীছ নং: ২০২
হযরত আবূ খুবায়ব আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র ইবনুল আওয়াম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'আল জামাল'-এর (যুদ্ধের) দিন যুবায়র যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন, তখন আমাকে ডাকলেন। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, হে বাছা! আজ কেবল জালেম বা মজলূমই নিহত হবে। আমি নিজের সম্পর্কে মনে করি যে, আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব। আমার সবচে' বড় চিন্তা হচ্ছে আমার দেনা নিয়ে। তুমি কি মনে কর আমাদের দেনা আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট রাখবে? তারপর বললেন, হে বাছা! আমাদের সম্পদ বিক্রি করে আমার দেনা পরিশোধ করো। তারপর তিনি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন আর তার (অর্থাৎ সেই এক-তৃতীয়াংশের) এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন তার পুত্রদের জন্য। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়রের পুত্রদেরকে এক-তৃতীয়াংশের তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার অসিয়ত করলেন। বললেন, দেনা পরিশোধের পর আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার পুত্রদের। হিশাম* বলেন, আব্দুল্লাহর কোনও কোনও পুত্র যেমন খুবায়ব ও আব্বাদ—–যুবায়রের কোনও কোনও পুত্রের সমবয়সী ছিল। তখন যুবায়র রাযি.-এর ৯ পুত্র ও ৯ কন্যাসন্তান বর্তমান ছিল। আব্দুল্লাহ বলেন, তিনি তার দেনা সম্পর্কে অসিয়ত করছিলেন এবং বলছিলেন, হে বাছা! তুমি যদি দেনার কোনও অংশ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়, তবে সে ব্যাপারে আমার মাওলার কাছে সাহায্য চেয়ো। আব্দুল্লাহ বলেন, আল্লাহর কসম! আমি বুঝতে পারিনি। তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছিলেন। শেষে বললাম, আব্বাজী, আপনার মাওলা কে? তিনি বললেন, আল্লাহ।
আব্দুল্লাহ বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যখনই তার দেনা পরিশোধ করতে সংকটে পড়ে যেতাম তখনই বলতাম- হে যুবায়রের মাওলা! আপনি তার পক্ষ থেকে দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিন। তিনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিতেন।
তারপর যুবায়র নিহত হলেন। তিনি কোনও দীনার ও দিরহাম রেখে যাননি। রেখে গিয়েছিলেন স্থাবর সম্পত্তি আর তা হল- গাবা (-এর এক লপ্ত ভূমি), মদীনায় এগারোটি বাড়ি, বসরায় দু'টি বাড়ি, কুফায় একটি বাড়ি এবং মিসরে একটি বাড়ি।
আব্দুল্লাহ বলেন, তার দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণ ছিল এই যে, কোনও লোক তার কাছে এসে কিছু অর্থ গচ্ছিত রাখতে চাইলে তিনি বলতেন, না, বরং এটা আমি তোমার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিলাম। কেননা (আমানত হিসেবে থাকলে) আমার আশঙ্কা তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তিনি কখনও শাসনকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি এবং না কর আদায়, না খারাজ আদায় আর না অন্য কিছুর দায়িত্ব। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন এবং আবূ বকর রাযি, উমর রাযি, ও উছমান রাযি.- এর সঙ্গেও।
আব্দুল্লাহ বলেন, আমি তার সমস্ত দেনা হিসাব করলাম। দেখলাম তার পরিমাণ হয় ২২ লাখ দিরহাম।
এ অবস্থায় হযরত হাকিম ইবন হিযাম রাযি, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ওহে ভাতিজা! আমার ভাইয়ের দেনার পরিমাণ কত?
(হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি. বলেন,) আমি তার কাছে তা গোপন করলাম এবং বললাম এক লক্ষ দিরহাম। তা শুনে হাকিম বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের যা সম্পদ, আমি মনে করি না তা দ্বারা এসব পরিশোধ সম্ভব হবে।
আব্দুল্লাহ বললেন, আচ্ছা বলুন তো, তা যদি হয় ২২ লাখ দিরহাম? তিনি বললেন, তাহলে আমি মনে করি না তোমরা তা পরিশোধে সক্ষম হবে। যদি তোমরা তা থেকে কিছু আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়, তবে আমার সাহায্য নিয়ো। আব্দুল্লাহ বলেন, যুবায়র গাবা কিনেছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার দিরহামে।
(হিশাম বলেন,) আব্দুল্লাহ সেটি বিক্রি করলেন ১৬ লাখ দিরহামে। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, যুবায়রের কাছে যার কিছু পাওনা আছে সে যেন গাবায় এসে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
সেমতে আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর তার কাছে আসলেন। যুবায়রের কাছে তার ৪ লাখ দিরহাম পাওনা ছিল। তিনি আব্দুল্লাহকে বললেন, যদি তোমরা চাও তোমাদের জন্য আমি তা ছেড়ে দিতে পারি। আব্দুল্লাহ বললেন, না। তিনি বললেন, তোমরা চাইলে তা ওইসব দেনার মধ্যে রাখতে পার, যা তোমরা পরে পরিশোধের ইচ্ছা রাখ। আব্দুল্লাহ বললেন, না। তিনি বললেন, তাহলে আমার জন্য একখণ্ড জমি নির্দিষ্ট করে দাও। আব্দুল্লাহ বললেন, এখান থেকে ওই পর্যন্ত তোমার।
তারপর আব্দুল্লাহ গাবার জমি থেকে একটা অংশ বিক্রি করে তার দেনা পরিশোধ করলেন এবং তাতে তার সবটা দেনা পরিশোধ হয়ে গেল। তারপর সে জমি থেকে সাড়ে চার খণ্ড অবশিষ্ট থাকল। তারপর তিনি হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে আসলেন। তখন সেখানে আমর ইবন উছমান, মুনযির ইবন যুবায়র ও ইবন যাম'আ উপস্থিত ছিলেন।
হযরত মু'আবিয়া রাযি, তাকে বললেন, গাবা'র দাম কত ধরা হয়েছে? তিনি বললেন, প্রতি খণ্ড ১ লাখ দিরহাম। হযরত মু'আবিয়া রাযি. বললেন, তার কত খণ্ড বাকি আছে? তিনি বললেন, সাড়ে চার খণ্ড। তখন মুনযির ইবন যুবায়র বললেন, আমি তা থেকে এক খণ্ড ১ লাখ দিরহামে নিলাম। আমর ইবন উছমান বললেন, আমিও এক খণ্ড ১ লাখ নিরহামে নিলাম। ইবন যাম'আ বললেন, আমিও এক খণ্ড ১ লাখ দিরহামে নিয়ে নিলাম। তারপর হযরত মু'আবিয়া রাযি. বললেন, এখন তার কী পরিমাণ অবশিষ্ট আছে? আব্দুল্লাহ বললেন, দেড় খণ্ড। তিনি বললেন, আমি তা দেড় লাখ দিরহামে নিয়ে নিলাম।
হিশাম বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন জাফর তার অংশ মু'আবিয়া রাযি.-এর কাছে ৬ লাখ নিরহামে বিক্রি করে দেন। আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র যখন তার দেনা পরিশোধ করে সারলেন তখন যুবায়রের পুত্রগণ বলল, আমাদের মধ্যে আমাদের মীরাছ বন্টন করে দিন। তিনি বললেন, আমি তা তোমাদের মধ্যে বণ্টন করব না যাবৎ না চার বছর হজ্জের মওসুমে ঘোষণা করি যে, মুবায়রের কাছে যে-কারও কিছু পাওনা আছে, সে যেন আমাদের কাছে আসে, আমরা তা পরিশোধ করে দেব। তিনি প্রতি বছর হজ্জের মওসুমে এ ঘোষণা দিতে থাকেন। এভাবে চার বছর গত হওয়ার পর তিনি তাদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেন এবং (অসিয়ত মোতাবেক) এক-তৃতীয়াংশও (যাদের জন্য অসিয়ত করা হয়েছিল তাদেরকে) প্রদান করেন। যুবায়রের ছিল চারজন স্ত্রী। প্রত্যেক স্ত্রীর ভাগে ১২ লাখ দিরহাম করে পড়ল। সুতরাং তার সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ হয় ৫ কোটি ২ লাখ দিরহাম- বুখারী।
*হিশাম হচ্ছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-এর ভাতিজা। তিনি নিজ পিতা উরওয়া ইবনু যুবায়র রহ.-এর সূত্রে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় তাবি'ঈ ছিলেন। আলেম ও মুহাদ্দিছ হিসেবে হযরত হাসান বসরী রহ. ও মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ.-এর সমপর্যায়ের। তাঁর জন্য হিজরী ৬১ সালে। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি. হযরত জাবির রাযি. ও হযরত আনাস রাযি.-কে দেখেছেন। হিজরী ১৪৬ সালে তিনি ইন্তিকাল করেন।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩১২৯; ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খ. ৩, পৃ. ১০৮, ইবন আসাকির, তারীখু দিমাশক, খ. ১৮, পৃ. ৪৩০; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, খ.৩, পৃ.২১৪)
হাদীছ নং: ২০২
হযরত আবূ খুবায়ব আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র ইবনুল আওয়াম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'আল জামাল'-এর (যুদ্ধের) দিন যুবায়র যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন, তখন আমাকে ডাকলেন। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, হে বাছা! আজ কেবল জালেম বা মজলূমই নিহত হবে। আমি নিজের সম্পর্কে মনে করি যে, আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব। আমার সবচে' বড় চিন্তা হচ্ছে আমার দেনা নিয়ে। তুমি কি মনে কর আমাদের দেনা আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট রাখবে? তারপর বললেন, হে বাছা! আমাদের সম্পদ বিক্রি করে আমার দেনা পরিশোধ করো। তারপর তিনি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন আর তার (অর্থাৎ সেই এক-তৃতীয়াংশের) এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন তার পুত্রদের জন্য। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়রের পুত্রদেরকে এক-তৃতীয়াংশের তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার অসিয়ত করলেন। বললেন, দেনা পরিশোধের পর আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার পুত্রদের। হিশাম* বলেন, আব্দুল্লাহর কোনও কোনও পুত্র যেমন খুবায়ব ও আব্বাদ—–যুবায়রের কোনও কোনও পুত্রের সমবয়সী ছিল। তখন যুবায়র রাযি.-এর ৯ পুত্র ও ৯ কন্যাসন্তান বর্তমান ছিল। আব্দুল্লাহ বলেন, তিনি তার দেনা সম্পর্কে অসিয়ত করছিলেন এবং বলছিলেন, হে বাছা! তুমি যদি দেনার কোনও অংশ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়, তবে সে ব্যাপারে আমার মাওলার কাছে সাহায্য চেয়ো। আব্দুল্লাহ বলেন, আল্লাহর কসম! আমি বুঝতে পারিনি। তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছিলেন। শেষে বললাম, আব্বাজী, আপনার মাওলা কে? তিনি বললেন, আল্লাহ।
আব্দুল্লাহ বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যখনই তার দেনা পরিশোধ করতে সংকটে পড়ে যেতাম তখনই বলতাম- হে যুবায়রের মাওলা! আপনি তার পক্ষ থেকে দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিন। তিনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিতেন।
তারপর যুবায়র নিহত হলেন। তিনি কোনও দীনার ও দিরহাম রেখে যাননি। রেখে গিয়েছিলেন স্থাবর সম্পত্তি আর তা হল- গাবা (-এর এক লপ্ত ভূমি), মদীনায় এগারোটি বাড়ি, বসরায় দু'টি বাড়ি, কুফায় একটি বাড়ি এবং মিসরে একটি বাড়ি।
আব্দুল্লাহ বলেন, তার দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণ ছিল এই যে, কোনও লোক তার কাছে এসে কিছু অর্থ গচ্ছিত রাখতে চাইলে তিনি বলতেন, না, বরং এটা আমি তোমার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নিলাম। কেননা (আমানত হিসেবে থাকলে) আমার আশঙ্কা তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তিনি কখনও শাসনকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি এবং না কর আদায়, না খারাজ আদায় আর না অন্য কিছুর দায়িত্ব। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন এবং আবূ বকর রাযি, উমর রাযি, ও উছমান রাযি.- এর সঙ্গেও।
আব্দুল্লাহ বলেন, আমি তার সমস্ত দেনা হিসাব করলাম। দেখলাম তার পরিমাণ হয় ২২ লাখ দিরহাম।
এ অবস্থায় হযরত হাকিম ইবন হিযাম রাযি, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ওহে ভাতিজা! আমার ভাইয়ের দেনার পরিমাণ কত?
(হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি. বলেন,) আমি তার কাছে তা গোপন করলাম এবং বললাম এক লক্ষ দিরহাম। তা শুনে হাকিম বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের যা সম্পদ, আমি মনে করি না তা দ্বারা এসব পরিশোধ সম্ভব হবে।
আব্দুল্লাহ বললেন, আচ্ছা বলুন তো, তা যদি হয় ২২ লাখ দিরহাম? তিনি বললেন, তাহলে আমি মনে করি না তোমরা তা পরিশোধে সক্ষম হবে। যদি তোমরা তা থেকে কিছু আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়, তবে আমার সাহায্য নিয়ো। আব্দুল্লাহ বলেন, যুবায়র গাবা কিনেছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার দিরহামে।
(হিশাম বলেন,) আব্দুল্লাহ সেটি বিক্রি করলেন ১৬ লাখ দিরহামে। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, যুবায়রের কাছে যার কিছু পাওনা আছে সে যেন গাবায় এসে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
সেমতে আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর তার কাছে আসলেন। যুবায়রের কাছে তার ৪ লাখ দিরহাম পাওনা ছিল। তিনি আব্দুল্লাহকে বললেন, যদি তোমরা চাও তোমাদের জন্য আমি তা ছেড়ে দিতে পারি। আব্দুল্লাহ বললেন, না। তিনি বললেন, তোমরা চাইলে তা ওইসব দেনার মধ্যে রাখতে পার, যা তোমরা পরে পরিশোধের ইচ্ছা রাখ। আব্দুল্লাহ বললেন, না। তিনি বললেন, তাহলে আমার জন্য একখণ্ড জমি নির্দিষ্ট করে দাও। আব্দুল্লাহ বললেন, এখান থেকে ওই পর্যন্ত তোমার।
তারপর আব্দুল্লাহ গাবার জমি থেকে একটা অংশ বিক্রি করে তার দেনা পরিশোধ করলেন এবং তাতে তার সবটা দেনা পরিশোধ হয়ে গেল। তারপর সে জমি থেকে সাড়ে চার খণ্ড অবশিষ্ট থাকল। তারপর তিনি হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে আসলেন। তখন সেখানে আমর ইবন উছমান, মুনযির ইবন যুবায়র ও ইবন যাম'আ উপস্থিত ছিলেন।
হযরত মু'আবিয়া রাযি, তাকে বললেন, গাবা'র দাম কত ধরা হয়েছে? তিনি বললেন, প্রতি খণ্ড ১ লাখ দিরহাম। হযরত মু'আবিয়া রাযি. বললেন, তার কত খণ্ড বাকি আছে? তিনি বললেন, সাড়ে চার খণ্ড। তখন মুনযির ইবন যুবায়র বললেন, আমি তা থেকে এক খণ্ড ১ লাখ দিরহামে নিলাম। আমর ইবন উছমান বললেন, আমিও এক খণ্ড ১ লাখ নিরহামে নিলাম। ইবন যাম'আ বললেন, আমিও এক খণ্ড ১ লাখ দিরহামে নিয়ে নিলাম। তারপর হযরত মু'আবিয়া রাযি. বললেন, এখন তার কী পরিমাণ অবশিষ্ট আছে? আব্দুল্লাহ বললেন, দেড় খণ্ড। তিনি বললেন, আমি তা দেড় লাখ দিরহামে নিয়ে নিলাম।
হিশাম বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন জাফর তার অংশ মু'আবিয়া রাযি.-এর কাছে ৬ লাখ নিরহামে বিক্রি করে দেন। আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র যখন তার দেনা পরিশোধ করে সারলেন তখন যুবায়রের পুত্রগণ বলল, আমাদের মধ্যে আমাদের মীরাছ বন্টন করে দিন। তিনি বললেন, আমি তা তোমাদের মধ্যে বণ্টন করব না যাবৎ না চার বছর হজ্জের মওসুমে ঘোষণা করি যে, মুবায়রের কাছে যে-কারও কিছু পাওনা আছে, সে যেন আমাদের কাছে আসে, আমরা তা পরিশোধ করে দেব। তিনি প্রতি বছর হজ্জের মওসুমে এ ঘোষণা দিতে থাকেন। এভাবে চার বছর গত হওয়ার পর তিনি তাদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেন এবং (অসিয়ত মোতাবেক) এক-তৃতীয়াংশও (যাদের জন্য অসিয়ত করা হয়েছিল তাদেরকে) প্রদান করেন। যুবায়রের ছিল চারজন স্ত্রী। প্রত্যেক স্ত্রীর ভাগে ১২ লাখ দিরহাম করে পড়ল। সুতরাং তার সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ হয় ৫ কোটি ২ লাখ দিরহাম- বুখারী।
*হিশাম হচ্ছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-এর ভাতিজা। তিনি নিজ পিতা উরওয়া ইবনু যুবায়র রহ.-এর সূত্রে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় তাবি'ঈ ছিলেন। আলেম ও মুহাদ্দিছ হিসেবে হযরত হাসান বসরী রহ. ও মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ.-এর সমপর্যায়ের। তাঁর জন্য হিজরী ৬১ সালে। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি. হযরত জাবির রাযি. ও হযরত আনাস রাযি.-কে দেখেছেন। হিজরী ১৪৬ সালে তিনি ইন্তিকাল করেন।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩১২৯; ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খ. ৩, পৃ. ১০৮, ইবন আসাকির, তারীখু দিমাশক, খ. ১৮, পৃ. ৪৩০; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, খ.৩, পৃ.২১৪)
25 - باب الأمر بأداء الأمانة
202 - وعن أَبي خُبيب - بضم الخاء المعجمة - عبد الله بن الزبير رضي الله عنهما، قَالَ: لَمَّا وَقفَ الزُّبَيْرُ يَوْمَ الجَمَل (1) دَعَانِي فَقُمْتُ إِلَى جَنْبه، فَقَالَ: يَا بُنَيَّ، إنَّهُ لاَ يُقْتَلُ اليَومَ إلاَّ ظَالِمٌ أَوْ مَظْلُومٌ، وَإنِّي لاَ أراني إلاَّ سَأُقْتَلُ اليومَ مظلومًا، وإنَّ مِنْ أكبرَ هَمِّي لَدَيْنِي، أفَتَرَى دَيْننا يُبقي من مالِنا شَيئًا؟ ثُمَّ قَالَ: يَا بُنَيَّ، بِعْ مَا لَنَا وَاقْضِ دَيْنِي، وَأَوْصَى بِالثُّلُثِ وَثُلُثِهِ لِبَنِيهِ، يعني لبني عبد الله بن الزبير ثُلُثُ الثُّلُث. قَالَ: فَإنْ فَضَلَ مِنْ مَالِنَا بَعْدَ قَضَاءِ الدَّينِ شَيء فَثُلُثُه لِبَنِيكَ. قَالَ هِشَام: وَكَانَ بَعْضُ وَلَدِ عَبْدِ اللهِ قَدْ وَازى (2) بَعْضَ بَنِي الزُّبَيْرِ خُبيبٍ وَعَبَّادٍ، وَلهُ يَوْمَئذٍ تِسْعَةُ بَنينَ وَتِسْعُ بَنَات. قَالَ عَبدُ الله: فَجَعلَ يُوصينِي بدَيْنِهِ وَيَقُولُ: يَا بُنَيَّ، إنْ عَجَزْتَ عَن شَيْءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِنْ عَلَيهِ بِمَوْلاَيَ. قَالَ: فَوَاللهِ مَا دَرَيْتُ مَا أرَادَ حَتَّى قُلْتُ: يَا أبَتِ مَنْ مَوْلاَكَ؟ قَالَ: الله. قَالَ: فَوَاللهِ مَا وَقَعْتُ في كُرْبةٍ مِنْ دَيْنِهِ إلاَّ قُلْتُ: يَا مَوْلَى الزُّبَيْرِ اقْضِ عَنْهُ دَيْنَهُ فَيَقْضِيَهُ. قَالَ: فَقُتِلَ الزُّبَيْرُ وَلَم يَدَعْ دِينَارًا وَلاَ دِرْهمًا إلاَّ أرَضِينَ، مِنْهَا الغَابَةُ (3) وإحْدَى عَشْرَةَ دَارًا بالمَدِينَةِ، وَدَارَيْنِ بالبَصْرَةِ، ودَارًا بالكُوفَةِ، ودَارًا بمِصْرَ. قَالَ: وَإِنَّمَا كَانَ دَيْنُهُ الَّذِي كَانَ عَلَيهِ أنَّ الرَّجُلَ كَانَ يَأتِيهِ بالمال، فَيَسْتَودِعُهُ إيَّاهُ، فَيَقُولُ الزُّبَيْرُ: لا، وَلَكِنْ هُوَ سَلَفٌ إنِّي أخْشَى عَلَيهِ الضَّيْعَةَ (4). وَمَا وَليَ إمَارَةً قَطُّ وَلا جِبَايَةً (5) ولا خراجًا (6) وَلاَ شَيئًا إلاَّ أَنْ يَكُونَ في
[ص:90] غَزْوٍ مَعَ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - أَوْ مَعَ أَبي بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ - رضي الله عنهم - قَالَ عَبدُ الله: فَحَسَبْتُ مَا كَانَ عَلَيهِ مِن الدَّيْنِ فَوَجَدْتُهُ ألْفيْ ألْفٍ وَمئَتَي ألْف! فَلَقِيَ حَكِيمُ بنُ حِزَام عَبْدَ الله بْنَ الزُّبَيْرِ، فَقَالَ: يَا ابْنَ أخِي، كَمْ عَلَى أخي مِنَ الدَّيْنِ؟ فَكَتَمْتُهُ وَقُلْتُ: مِائَةُ ألْف. فَقَالَ حَكيمٌ: واللهِ مَا أرَى أمْوَالَكُمْ تَسَعُ هذِهِ. فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: أرَأيْتُكَ إنْ كَانَتْ ألْفَي ألف وَمئَتَيْ ألْف؟ قَالَ: مَا أرَاكُمْ تُطيقُونَ هَذَا، فَإنْ عَجَزْتُمْ عَنْ شَيءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِينُوا بي، قَالَ: وَكَانَ الزُّبَيرُ قَد اشْتَرَى الغَابَةَ بِسَبْعِينَ ومئة ألف، فَبَاعَهَا عَبدُ اللهِ بِألْفِ ألْف وَسِتّمِئَةِ ألْف، ثُمَّ قَامَ فَقَالَ: مَنْ كَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ شَيْء فَلْيُوافِنَا بِالغَابَةِ، فَأتَاهُ عَبدُ اللهِ بنُ جَعفَر، وَكَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ أرْبَعمئةِ ألْف، فَقَالَ لعَبدِ الله: إنْ شِئْتُمْ تَرَكْتُهَا لَكمْ؟ قَالَ عَبدُ الله: لا، قَالَ: فَإنْ شِئتُمْ جَعَلْتُمُوهَا فِيمَا تُؤَخِّرُونَ إنْ إخَّرْتُمْ، فَقَالَ عَبدُ الله: لا، قَالَ: فَاقْطَعُوا لِي قطْعَةً، قَالَ عَبدُ الله: لَكَ مِنْ هاهُنَا إِلَى هَاهُنَا. فَبَاعَ عَبدُ اللهِ مِنهَا فَقَضَى عَنْهُ دَينَه وَأوْفَاهُ، وَبَقِيَ مِنْهَا أرْبَعَةُ أسْهُم وَنِصْفٌ، فَقَدِمَ عَلَى مُعَاوِيَة وَعنْدَهُ عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ، وَالمُنْذِرُ بْنُ الزُّبَيْرِ، وَابْنُ زَمْعَةَ، فَقَالَ لَهُ مُعَاويَةُ: كَمْ قُوِّمَتِ الغَابَةُ؟ قَالَ: كُلُّ سَهْم بمئَة ألف، قَالَ: كَمْ بَقِيَ مِنْهَا؟ قَالَ: أرْبَعَةُ أسْهُم وَنصْفٌ، فَقَالَ المُنْذِرُ بْنُ الزُّبَيرِ: قَدْ أخَذْتُ مِنْهَا سَهمًا بِمئَةِ ألف، قَالَ عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ: قَدْ أخَذْتُ مِنْهَا سَهْمًا بمئَةِ ألْف. وَقالَ ابْنُ زَمْعَةَ: قَدْ أخَذْتُ سَهْمًا بِمئَةِ ألْف، فَقَالَ مُعَاويَةُ: كَمْ بَقِيَ مِنْهَا؟ قَالَ: سَهْمٌ ونصْفُ سَهْم، قَالَ: قَدْ أخَذْتُهُ بخَمْسِينَ وَمئَةِ ألْف. قَالَ: وَبَاعَ عَبدُ الله بْنُ جَعفَر نَصيبهُ مِنْ مَعَاوِيَةَ بستِّمِئَةِ ألْف، فَلَمَّا فَرَغَ ابْنُ الزُّبَيرِ مِنْ قَضَاءِ دَيْنِهِ، قَالَ بَنُو الزُّبَيرِ: اقسمْ بَينَنَا ميراثَنا، قَالَ: وَاللهِ لا أقْسِمُ بَيْنَكُمْ حَتَّى أنَادِي بالمَوْسم أرْبَعَ سنينَ: ألا مَنْ كَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ دَيْنٌ فَلْيَأتِنَا فَلْنَقْضِهِ. فَجَعَلَ كُلّ سَنَةٍ يُنَادِي في المَوْسِمِ، فَلَمَّا مَضَى أرْبَعُ سنينَ قَسَمَ بيْنَهُمْ وَدَفَعَ الثُّلُثَ. وَكَانَ للزُّبَيْرِ أرْبَعُ نِسْوَةٍ، فَأصَابَ كُلَّ امرَأةٍ ألْفُ ألف وَمِئَتَا ألْف، فَجَميعُ مَالِه خَمْسُونَ ألف ألْف وَمِئَتَا ألْف. رواه البخاري. (1)
[ص:90] غَزْوٍ مَعَ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - أَوْ مَعَ أَبي بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ - رضي الله عنهم - قَالَ عَبدُ الله: فَحَسَبْتُ مَا كَانَ عَلَيهِ مِن الدَّيْنِ فَوَجَدْتُهُ ألْفيْ ألْفٍ وَمئَتَي ألْف! فَلَقِيَ حَكِيمُ بنُ حِزَام عَبْدَ الله بْنَ الزُّبَيْرِ، فَقَالَ: يَا ابْنَ أخِي، كَمْ عَلَى أخي مِنَ الدَّيْنِ؟ فَكَتَمْتُهُ وَقُلْتُ: مِائَةُ ألْف. فَقَالَ حَكيمٌ: واللهِ مَا أرَى أمْوَالَكُمْ تَسَعُ هذِهِ. فَقَالَ عَبْدُ اللهِ: أرَأيْتُكَ إنْ كَانَتْ ألْفَي ألف وَمئَتَيْ ألْف؟ قَالَ: مَا أرَاكُمْ تُطيقُونَ هَذَا، فَإنْ عَجَزْتُمْ عَنْ شَيءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِينُوا بي، قَالَ: وَكَانَ الزُّبَيرُ قَد اشْتَرَى الغَابَةَ بِسَبْعِينَ ومئة ألف، فَبَاعَهَا عَبدُ اللهِ بِألْفِ ألْف وَسِتّمِئَةِ ألْف، ثُمَّ قَامَ فَقَالَ: مَنْ كَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ شَيْء فَلْيُوافِنَا بِالغَابَةِ، فَأتَاهُ عَبدُ اللهِ بنُ جَعفَر، وَكَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ أرْبَعمئةِ ألْف، فَقَالَ لعَبدِ الله: إنْ شِئْتُمْ تَرَكْتُهَا لَكمْ؟ قَالَ عَبدُ الله: لا، قَالَ: فَإنْ شِئتُمْ جَعَلْتُمُوهَا فِيمَا تُؤَخِّرُونَ إنْ إخَّرْتُمْ، فَقَالَ عَبدُ الله: لا، قَالَ: فَاقْطَعُوا لِي قطْعَةً، قَالَ عَبدُ الله: لَكَ مِنْ هاهُنَا إِلَى هَاهُنَا. فَبَاعَ عَبدُ اللهِ مِنهَا فَقَضَى عَنْهُ دَينَه وَأوْفَاهُ، وَبَقِيَ مِنْهَا أرْبَعَةُ أسْهُم وَنِصْفٌ، فَقَدِمَ عَلَى مُعَاوِيَة وَعنْدَهُ عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ، وَالمُنْذِرُ بْنُ الزُّبَيْرِ، وَابْنُ زَمْعَةَ، فَقَالَ لَهُ مُعَاويَةُ: كَمْ قُوِّمَتِ الغَابَةُ؟ قَالَ: كُلُّ سَهْم بمئَة ألف، قَالَ: كَمْ بَقِيَ مِنْهَا؟ قَالَ: أرْبَعَةُ أسْهُم وَنصْفٌ، فَقَالَ المُنْذِرُ بْنُ الزُّبَيرِ: قَدْ أخَذْتُ مِنْهَا سَهمًا بِمئَةِ ألف، قَالَ عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ: قَدْ أخَذْتُ مِنْهَا سَهْمًا بمئَةِ ألْف. وَقالَ ابْنُ زَمْعَةَ: قَدْ أخَذْتُ سَهْمًا بِمئَةِ ألْف، فَقَالَ مُعَاويَةُ: كَمْ بَقِيَ مِنْهَا؟ قَالَ: سَهْمٌ ونصْفُ سَهْم، قَالَ: قَدْ أخَذْتُهُ بخَمْسِينَ وَمئَةِ ألْف. قَالَ: وَبَاعَ عَبدُ الله بْنُ جَعفَر نَصيبهُ مِنْ مَعَاوِيَةَ بستِّمِئَةِ ألْف، فَلَمَّا فَرَغَ ابْنُ الزُّبَيرِ مِنْ قَضَاءِ دَيْنِهِ، قَالَ بَنُو الزُّبَيرِ: اقسمْ بَينَنَا ميراثَنا، قَالَ: وَاللهِ لا أقْسِمُ بَيْنَكُمْ حَتَّى أنَادِي بالمَوْسم أرْبَعَ سنينَ: ألا مَنْ كَانَ لَهُ عَلَى الزُّبَيرِ دَيْنٌ فَلْيَأتِنَا فَلْنَقْضِهِ. فَجَعَلَ كُلّ سَنَةٍ يُنَادِي في المَوْسِمِ، فَلَمَّا مَضَى أرْبَعُ سنينَ قَسَمَ بيْنَهُمْ وَدَفَعَ الثُّلُثَ. وَكَانَ للزُّبَيْرِ أرْبَعُ نِسْوَةٍ، فَأصَابَ كُلَّ امرَأةٍ ألْفُ ألف وَمِئَتَا ألْف، فَجَميعُ مَالِه خَمْسُونَ ألف ألْف وَمِئَتَا ألْف. رواه البخاري. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি. তাঁর পিতার দেনা কিভাবে পরিশোধ করেছিলেন তা বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। সুতরাং তার কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে দেনার বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কিছু কথা এসেছে, যা ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছুটা আলোচনা দরকার। নিচে সেই প্রাসঙ্গিক কথাগুলোরই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।
এক.
হযরত যুবায়র রাযি. পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
إِنَّهُ لاَ يُقْتَلُ اليَوْمَ إِلَّا ظَالِمٌ أَوْ مَظْلُومٌ، وَإِنِّي لاَ أُرَانِي إِلَّا سَأُقْتَلُ اليَوْمَ مَظْلُومًا
(আজ কেবল জালেম বা মজলুমই নিহত হবে। আমি নিজের সম্পর্কে মনে করি যে, আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব)। প্রশ্ন হয়, সব যুদ্ধই তো এরকম যে, তাতে একপক্ষ জালেম ও অন্যপক্ষ মজলূম হয়, কাজেই তাতে জালেম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা জালেমরূপে এবং মজলূম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা মজলূমরূপেই নিহত হবে এই তো স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও হযরত যুবায়র রাযি. এ কথা কেন বলছেন যে, আজ যে নিহত হবে সে হয় জালেম নয়তো মজলূমরূপে নিহত হবে?
এর উত্তর হচ্ছে, এ যুদ্ধে উভয়পক্ষে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা ছিলেন সাহাবী। তারা সকলেই ইখলাসের অধিকারী ছিলেন এবং শরী'আতের সীমারেখা মেনে চলতেন। কাজেই তাদের জালেম হওয়ার প্রশ্ন আসে না। তাদের যে-কেউ নিহত হবেন, নিঃসন্দেহে তিনি মজলূমরূপেই নিহত হবেন। যেমন এর আগে তারা যত যুদ্ধ করেছেন, তাতে তাদের পক্ষের নিহতগণ শহীদ ও মজলুমই ছিলেন। অপরপক্ষে ছিল কাফের ও মুশরিক সম্প্রদায়। তাদের নিহত হওয়া বা বেঁচে থাকা সবটাই হত জালেমরূপে। কিন্তু এটা একটা ব্যতিক্রম যুদ্ধ। কেননা এটাই প্রথম যুদ্ধ, যাতে উভয়পক্ষেই মুসলিম ও সাহাবী। তাই এ ক্ষেত্রে কোনও একপক্ষের নয়; বরং উভয়পক্ষের নিহতগণেরই মজলুম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তাহলে জালেম কারা? জালেম হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা এতে শরীক হয়েছে কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। যাদের উদ্দেশ্য আখিরাত নয়; কেবলই দুনিয়া। বিশেষত ওই সাবাঈ গোষ্ঠী, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হযরত উছমান রাযি.-এর হত্যাকর্মে অংশগ্রহণ করেছিল।
তারপর তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন- আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব। তিনি একথা বলেছিলেন খুবসম্ভব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে যে-
بَشِّر قَاتِلَ ابْنِ صَفِيَّةَ بِالنَّارِ
(আমার ফুফু) সাফিয়্যার পুত্রের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সংবাদ দিও।
সেইসঙ্গে তাঁর নিজের এ আত্মবিশ্বাস তো ছিলই যে, তিনি কোনও মন্দ উদ্দেশ্যে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি এতে অংশগ্রহণ করেছেন বিদ্রোহী ঘাতকদের বিচারের উদ্দেশ্যে এবং তাও করেছেন ইজতিহাদের ভিত্তিতে, মনগড়া ধারণার বশবর্তীতে নয়।
হযরত যুবায়র রাযি.-এর ভাবনা সত্যে পরিণত হয়েছিল। 'আল জামাল'-এর যুদ্ধকালে সত্যিই তিনি নিহত হন। তাও রণক্ষেত্রে নয়; বরং ওয়াদী সিবা' নামক এক উপত্যকায় নিঃসঙ্গ অবস্থায়। যুদ্ধ শুরুর আগেই হযরত আলী রাযি.-এর বোঝানোতে তিনি আপন শিবির পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। ওই উপত্যকায় রাত্রী যাপনকালে বিদ্রোহী গ্রুপের জনৈক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন। সুতরাং তিনি যে যথার্থই মজলূম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন এতে কোনও সন্দেহ নেই।
দুই.
তাঁর এত বিপুল দেনা কিভাবে হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বলেছেন যে, তা হয়েছিল মানুষের রাখা আমানতকে ঋণরূপে গ্রহণের কারণে। অর্থাৎ যে-কেউ তাঁর কাছে টাকা-পয়সা ও মালামাল আমানত রাখতে চাইত তাকেই তিনি বলতেন, আমি এটা আমানতরূপে না রেখে ঋণ হিসেবে নিয়ে নিচ্ছি।
তিনি এটা করতেন আমানতকারীর কল্যাণার্থে। কেননা আমানতের মাল হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে জরিমানা দিতে হয় না। বলাবাহুল্য তা হারানো বা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই। আর বাস্তবিকই যদি তা হয়ে যায়, তবে আমানতকারী যেহেতু তার বিপরীতে কিছু পাবে না, সেহেতু তার ক্ষতিই হয়ে গেল। পক্ষান্তরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তা হারিয়ে যাক, নষ্ট হয়ে যাক বা অন্য যা-ই হোক না কেন।
এটা প্রমাণ করে হযরত যুবায়র রাযি. কতটা উদারপ্রাণ এবং মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি অনেক বড় দানশীল ছিলেন। কাজেই যে যা-কিছু আমানত রাখার জন্য নিয়ে আসত, তা ঋণরূপে নিয়ে খরচ করে ফেলতেন। হয়তো দান-সদাকা করতেন কিংবা মেহমানদারী করতেন বা অন্য কোনওভাবে খরচ করতেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসও ছিল গভীর। বিশ্বাস ছিল বলেই তো তাঁর কাছে আমানত রাখার জন্য আসত। কাজেই তাদের এ আস্থাও ছিল যে, ঋণ হিসেবে নিলেও তিনি তা অবশ্যই পরিশোধ করবেন। এ আস্থার কারণে প্রচুর লোক তাঁর কাছে অর্থকড়ি নিয়ে আসত আর তিনিও তা খুশিমনে রেখে দিতেন। এই করে করেই তাঁর এতটা মোটা অঙ্কের ঋণ হয়ে যায়।
তিন.
তিনি ঋণ পরিশোধের অসিয়ত করার পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করারও অসিয়ত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. যে বর্ণনা দিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা সাংঘর্ষিক মনে হয়। কেননা প্রথমে বলেছেন-
وَأَوْصَى بِالثُّلُثِ، وَثُلُثِهِ لِبَنِيهِ - يَعْنِي بَنِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ - ثُلُثُ الثُّلُثِ
"তারপর তিনি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন আর তার (অর্থাৎ সেই এক-তৃতীয়াংশের) এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন তার পুত্রদের জন্য। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়রের পুত্রদেরকে এক-তৃতীয়াংশের তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার অসিয়ত করলেন"।
আবার পরক্ষণেই বলেছেন-
فإن فضل من مالنا بعد قضاء الدين شيء فثلثه لبنيك
"দেনা পরিশোধের পর আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার পুত্রদের দিও"।
প্রথম কথার অর্থ দাঁড়ায় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দান-খয়রাতের অসিয়ত করেছেন এবং সেই এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আব্দুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন। কিন্তু পরের কথা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাঁর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন দেনা পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার এক-তৃতীয়াংশ।
এর উত্তর হচ্ছে, মূলত প্রথম কথার অর্থও এটাই যে, ঋণ পরিশোধের পর কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে তার এক-তৃতীয়াংশ অসিয়তের খাতে ব্যয় হবে, যার তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়া হবে আব্দুল্লাহ রাযি.-এর ছেলেদেরকে। কেননা অসিয়ত কার্যকর করা যায় কেবল মানুষের হক আদায়ের পরই। যদি সবটা সম্পদই দেনা পরিশোধে লেগে যায়, তবে অসিয়তের কার্যকারিতা থাকে না। ব্যস এ হিসেবে উভয় কথার মধ্যে আর কোনও বিরোধ থাকল না।
এখানে আরও একটি বিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রথমে বলা হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আদুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে হবে, পরের বাক্যে বলা হয়েছে তাদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের সবটা। মূলত এখানেও কোনও বিরোধ নেই। পরের বাক্যটি সংক্ষেপ। প্রথমে যখন খুলে বলা হল- তার পুত্রদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ, তখন পরের বাক্যেও এক- তৃতীয়াংশ দ্বারা এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশই বুঝতে হবে। তখন আর কোনও বিরোধ থাকবে না।
উল্লেখ্য, অসিয়ত প্রযোজ্য হয় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে, তাও ঋণ পরিশোধ এবং মানুষের অন্যান্য হক আদায়ের পর। সম্পূর্ণ সম্পদ দানের অসিয়ত জায়েয নয়। কেননা তা ওয়ারিশদের হক। শরী'আত তাদেরকে বঞ্চিত করার অনুমতি দেয়নি।
চার.
দেনা পরিশোধে অক্ষমতা দেখা দিলে তখন কী করতে হবে, সে সম্পর্কে হযরত যুবায়র রাযি, পুত্রকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন-
إِنْ عَجَزْتَ عَن شَيْءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِنْ بِمَوْلاَيَ
"তুমি যদি দেনার কোনও অংশ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়, তবে সে ব্যাপারে আমার মাওলার কাছে সাহায্য চেয়ো"। হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. আমাদের জানাচ্ছেন যে, হযরত যুবায়র রাযি. 'মাওলা' বলে কাকে বোঝাচ্ছিলেন তিনি তা বুঝতে পারেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. কেন তা বুঝতে পারেননি?
উত্তর হচ্ছে, আমরা আমাদের ভাষায় 'মাওলা' বলে সাধারণত আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু আরবীতে এ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন মনিব, অভিভাবক,নেতা, কর্তৃত্ববান ব্যক্তি, বন্ধু, সঙ্গী, চুক্তিবদ্ধ মিত্র, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, মুক্তিদাতা মনিব ইত্যাদি। কাজেই শব্দটি দ্বারা যেমন আল্লাহকে বোঝানো যায়, তেমনি উল্লিখিত অর্থসমূহের যে-কোনও অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কুরআন ও হাদীছে এসব অর্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ
(জেনে রেখ) তার (রাসূলের) মাওলা (সঙ্গী ও সাহায্যকারী) আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ। সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৪
আলেমদেরকে যে 'মাওলানা' বলা হয়ে থাকে তাও এ হিসেবেই যে, তারা দীনের অভিভাবক, সাহায্যকারী, নেতা ইত্যাদি।
তো 'মাওলা' দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও যেহেতু বোঝানো হয় এবং ঋণ পরিশোধে সাহায্য চাওয়াটা যেমন দু'আর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার কাছে হতে পারে, তেমনি কোনও মানুষের কাছেও এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। দুনিয়ার কাজে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ায় শরী'আতের কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। কাজেই এ ক্ষেত্রে এটা বোঝার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে, হযরত যুবায়র রাযি. ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে তাঁর যে মাওলার কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন, তিনি তাঁর কোনও বন্ধু, চুক্তিবদ্ধ মিত্র বা অন্য কেউ-ও হতে পারে। তাই হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বুঝতে পারছিলেন না যে, তাঁর পিতা 'মাওলা' বলে ঠিক কাকে বোঝাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি পিতাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। পিতা বলে দিলেন যে, মাওলা বলে তিনি আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়েছেন।
এটা আল্লাহ তা'আলার প্রতি হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি.-এর চূড়ান্ত তাওয়াক্কুল ও পরম নির্ভরতারই পরিচয় বহন করে। সেইসঙ্গে এটা পরিচয় বহন করে তাঁর গভীর তাকওয়া ও আল্লাহভীতিরও। তাঁর ভয় ছিল শহীদ হয়ে গেলে তাঁর ঋণ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে? এটা বান্দার হক। এ হক পরিশোধ না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন কী উপায় হবে? তিনি বড় কোনও ব্যবসায়ী ছিলেন না, মোটা অঙ্কের নগদ টাকা-পয়সা বা সোনা-রূপারও মালিক ছিলেন না। তাঁর যা সম্পদ তা কেবলই স্থাবর সম্পত্তি জমি-জায়েদাদ, যা তিনি যুদ্ধে গনীমতের অংশ হিসেবে পেয়েছিলেন। বাহ্যত তা দ্বারা এত বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ হওয়া সম্ভবপর ছিল না। তাঁর উল্লিখিত কথা দ্বারা সে আশঙ্কার প্রতি ইশারাও হয়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা। তাঁর বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলার কাছে পরিপূর্ণ আস্থার সাথে সাহায্য চাইলে তিনি অবশ্যই তা পরিশোধের একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। যারা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা করে এবং অন্তরে তাঁর ভয়ও রাখে, আল্লাহ তা'আলা অকল্পনীয়ভাবে তাদের সাহায্য করে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে-কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ২-৩
বাস্তবেও তা-ই হল। এত বিপুল অঙ্কের ঋণ খুব আসানীর সঙ্গে পরিশোধ হয়ে গেল। এর জন্য তাঁর সবটা সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়নি। গাবা'র ভূমিই যথেষ্ট হয়ে গেছে। এটা বরকত ছাড়া কিছুই নয়। জমির যে মূল্য হওয়ার কথা ছিল, কার্যত তারচে' বহুগুণ বেশি মূল্যে তা বিক্রি হয়েছে। সুবহানাল্লাহ, এভাবে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাওয়াক্কুল করার সুফল কেবল আখিরাতে নয়; বরং দুনিয়ায়ও লাভ হয়ে থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দেনা বান্দার হক। মৃত্যুর আগে নিজে তা পরিশোধ করতে না পারলে ওয়ারিশদেরকে তা পরিশোধের জন্য অসিয়ত করে যাওয়া চাই।
খ. যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছু আমানত রাখে, আমানতগ্রহীতার কর্তব্য তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।
গ. কেউ দেনা রেখে মারা গেলে সচ্ছল ও সম্পদশালী ব্যক্তিদের উচিত তা পরিশোধে সহযোগিতা করা, যেমন হযরত হাকিম ইবন হিযাম রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-এর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ঘ. পাওনাদার ব্যক্তির উচিত তার পাওনা পরিশোধের জন্য দেনাদারের প্রতি কঠোরতা না করে সে যাতে তা আসানীর সাথে পরিশোধ করতে পারে সেই সুযোগ দেওয়া, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-কে সেই সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
ঙ. আল্লাহ তা'আলার প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল থাকলে অবশ্যই তার সুফল পাওয়া যায়।
চ. বড় পুত্রের কর্তব্য পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের ব্যাপারে শরী'আতসম্মতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমনটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি, করেছিলেন।
এক.
হযরত যুবায়র রাযি. পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
إِنَّهُ لاَ يُقْتَلُ اليَوْمَ إِلَّا ظَالِمٌ أَوْ مَظْلُومٌ، وَإِنِّي لاَ أُرَانِي إِلَّا سَأُقْتَلُ اليَوْمَ مَظْلُومًا
(আজ কেবল জালেম বা মজলুমই নিহত হবে। আমি নিজের সম্পর্কে মনে করি যে, আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব)। প্রশ্ন হয়, সব যুদ্ধই তো এরকম যে, তাতে একপক্ষ জালেম ও অন্যপক্ষ মজলূম হয়, কাজেই তাতে জালেম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা জালেমরূপে এবং মজলূম পক্ষের যারা নিহত হবে তারা মজলূমরূপেই নিহত হবে এই তো স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও হযরত যুবায়র রাযি. এ কথা কেন বলছেন যে, আজ যে নিহত হবে সে হয় জালেম নয়তো মজলূমরূপে নিহত হবে?
এর উত্তর হচ্ছে, এ যুদ্ধে উভয়পক্ষে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা ছিলেন সাহাবী। তারা সকলেই ইখলাসের অধিকারী ছিলেন এবং শরী'আতের সীমারেখা মেনে চলতেন। কাজেই তাদের জালেম হওয়ার প্রশ্ন আসে না। তাদের যে-কেউ নিহত হবেন, নিঃসন্দেহে তিনি মজলূমরূপেই নিহত হবেন। যেমন এর আগে তারা যত যুদ্ধ করেছেন, তাতে তাদের পক্ষের নিহতগণ শহীদ ও মজলুমই ছিলেন। অপরপক্ষে ছিল কাফের ও মুশরিক সম্প্রদায়। তাদের নিহত হওয়া বা বেঁচে থাকা সবটাই হত জালেমরূপে। কিন্তু এটা একটা ব্যতিক্রম যুদ্ধ। কেননা এটাই প্রথম যুদ্ধ, যাতে উভয়পক্ষেই মুসলিম ও সাহাবী। তাই এ ক্ষেত্রে কোনও একপক্ষের নয়; বরং উভয়পক্ষের নিহতগণেরই মজলুম হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তাহলে জালেম কারা? জালেম হচ্ছে ওই সকল লোক, যারা এতে শরীক হয়েছে কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। যাদের উদ্দেশ্য আখিরাত নয়; কেবলই দুনিয়া। বিশেষত ওই সাবাঈ গোষ্ঠী, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হযরত উছমান রাযি.-এর হত্যাকর্মে অংশগ্রহণ করেছিল।
তারপর তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন- আজ আমি মজলূমরূপেই নিহত হব। তিনি একথা বলেছিলেন খুবসম্ভব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে যে-
بَشِّر قَاتِلَ ابْنِ صَفِيَّةَ بِالنَّارِ
(আমার ফুফু) সাফিয়্যার পুত্রের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সংবাদ দিও।
সেইসঙ্গে তাঁর নিজের এ আত্মবিশ্বাস তো ছিলই যে, তিনি কোনও মন্দ উদ্দেশ্যে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি এতে অংশগ্রহণ করেছেন বিদ্রোহী ঘাতকদের বিচারের উদ্দেশ্যে এবং তাও করেছেন ইজতিহাদের ভিত্তিতে, মনগড়া ধারণার বশবর্তীতে নয়।
হযরত যুবায়র রাযি.-এর ভাবনা সত্যে পরিণত হয়েছিল। 'আল জামাল'-এর যুদ্ধকালে সত্যিই তিনি নিহত হন। তাও রণক্ষেত্রে নয়; বরং ওয়াদী সিবা' নামক এক উপত্যকায় নিঃসঙ্গ অবস্থায়। যুদ্ধ শুরুর আগেই হযরত আলী রাযি.-এর বোঝানোতে তিনি আপন শিবির পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। ওই উপত্যকায় রাত্রী যাপনকালে বিদ্রোহী গ্রুপের জনৈক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন। সুতরাং তিনি যে যথার্থই মজলূম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন এতে কোনও সন্দেহ নেই।
দুই.
তাঁর এত বিপুল দেনা কিভাবে হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বলেছেন যে, তা হয়েছিল মানুষের রাখা আমানতকে ঋণরূপে গ্রহণের কারণে। অর্থাৎ যে-কেউ তাঁর কাছে টাকা-পয়সা ও মালামাল আমানত রাখতে চাইত তাকেই তিনি বলতেন, আমি এটা আমানতরূপে না রেখে ঋণ হিসেবে নিয়ে নিচ্ছি।
তিনি এটা করতেন আমানতকারীর কল্যাণার্থে। কেননা আমানতের মাল হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে জরিমানা দিতে হয় না। বলাবাহুল্য তা হারানো বা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো থাকেই। আর বাস্তবিকই যদি তা হয়ে যায়, তবে আমানতকারী যেহেতু তার বিপরীতে কিছু পাবে না, সেহেতু তার ক্ষতিই হয়ে গেল। পক্ষান্তরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তা হারিয়ে যাক, নষ্ট হয়ে যাক বা অন্য যা-ই হোক না কেন।
এটা প্রমাণ করে হযরত যুবায়র রাযি. কতটা উদারপ্রাণ এবং মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি নিজের ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি অনেক বড় দানশীল ছিলেন। কাজেই যে যা-কিছু আমানত রাখার জন্য নিয়ে আসত, তা ঋণরূপে নিয়ে খরচ করে ফেলতেন। হয়তো দান-সদাকা করতেন কিংবা মেহমানদারী করতেন বা অন্য কোনওভাবে খরচ করতেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসও ছিল গভীর। বিশ্বাস ছিল বলেই তো তাঁর কাছে আমানত রাখার জন্য আসত। কাজেই তাদের এ আস্থাও ছিল যে, ঋণ হিসেবে নিলেও তিনি তা অবশ্যই পরিশোধ করবেন। এ আস্থার কারণে প্রচুর লোক তাঁর কাছে অর্থকড়ি নিয়ে আসত আর তিনিও তা খুশিমনে রেখে দিতেন। এই করে করেই তাঁর এতটা মোটা অঙ্কের ঋণ হয়ে যায়।
তিন.
তিনি ঋণ পরিশোধের অসিয়ত করার পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করারও অসিয়ত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. যে বর্ণনা দিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা সাংঘর্ষিক মনে হয়। কেননা প্রথমে বলেছেন-
وَأَوْصَى بِالثُّلُثِ، وَثُلُثِهِ لِبَنِيهِ - يَعْنِي بَنِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الزُّبَيْرِ - ثُلُثُ الثُّلُثِ
"তারপর তিনি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন আর তার (অর্থাৎ সেই এক-তৃতীয়াংশের) এক-তৃতীয়াংশ সম্পর্কে অসিয়ত করলেন তার পুত্রদের জন্য। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়রের পুত্রদেরকে এক-তৃতীয়াংশের তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়ার অসিয়ত করলেন"।
আবার পরক্ষণেই বলেছেন-
فإن فضل من مالنا بعد قضاء الدين شيء فثلثه لبنيك
"দেনা পরিশোধের পর আমাদের সম্পদ থেকে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তার তিন ভাগের এক ভাগ তোমার পুত্রদের দিও"।
প্রথম কথার অর্থ দাঁড়ায় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দান-খয়রাতের অসিয়ত করেছেন এবং সেই এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আব্দুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন। কিন্তু পরের কথা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাঁর পুত্রদেরকে দিতে বলেছেন দেনা পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার এক-তৃতীয়াংশ।
এর উত্তর হচ্ছে, মূলত প্রথম কথার অর্থও এটাই যে, ঋণ পরিশোধের পর কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে তার এক-তৃতীয়াংশ অসিয়তের খাতে ব্যয় হবে, যার তিন ভাগের এক ভাগ দেওয়া হবে আব্দুল্লাহ রাযি.-এর ছেলেদেরকে। কেননা অসিয়ত কার্যকর করা যায় কেবল মানুষের হক আদায়ের পরই। যদি সবটা সম্পদই দেনা পরিশোধে লেগে যায়, তবে অসিয়তের কার্যকারিতা থাকে না। ব্যস এ হিসেবে উভয় কথার মধ্যে আর কোনও বিরোধ থাকল না।
এখানে আরও একটি বিরোধ লক্ষ করা যায়। প্রথমে বলা হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ আদুল্লাহ রাযি.-এর পুত্রদেরকে দিতে হবে, পরের বাক্যে বলা হয়েছে তাদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের সবটা। মূলত এখানেও কোনও বিরোধ নেই। পরের বাক্যটি সংক্ষেপ। প্রথমে যখন খুলে বলা হল- তার পুত্রদেরকে দেওয়া হবে এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ, তখন পরের বাক্যেও এক- তৃতীয়াংশ দ্বারা এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশই বুঝতে হবে। তখন আর কোনও বিরোধ থাকবে না।
উল্লেখ্য, অসিয়ত প্রযোজ্য হয় সম্পূর্ণ সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে, তাও ঋণ পরিশোধ এবং মানুষের অন্যান্য হক আদায়ের পর। সম্পূর্ণ সম্পদ দানের অসিয়ত জায়েয নয়। কেননা তা ওয়ারিশদের হক। শরী'আত তাদেরকে বঞ্চিত করার অনুমতি দেয়নি।
চার.
দেনা পরিশোধে অক্ষমতা দেখা দিলে তখন কী করতে হবে, সে সম্পর্কে হযরত যুবায়র রাযি, পুত্রকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন-
إِنْ عَجَزْتَ عَن شَيْءٍ مِنْهُ فَاسْتَعِنْ بِمَوْلاَيَ
"তুমি যদি দেনার কোনও অংশ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়, তবে সে ব্যাপারে আমার মাওলার কাছে সাহায্য চেয়ো"। হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. আমাদের জানাচ্ছেন যে, হযরত যুবায়র রাযি. 'মাওলা' বলে কাকে বোঝাচ্ছিলেন তিনি তা বুঝতে পারেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. কেন তা বুঝতে পারেননি?
উত্তর হচ্ছে, আমরা আমাদের ভাষায় 'মাওলা' বলে সাধারণত আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু আরবীতে এ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন মনিব, অভিভাবক,নেতা, কর্তৃত্ববান ব্যক্তি, বন্ধু, সঙ্গী, চুক্তিবদ্ধ মিত্র, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস, মুক্তিদাতা মনিব ইত্যাদি। কাজেই শব্দটি দ্বারা যেমন আল্লাহকে বোঝানো যায়, তেমনি উল্লিখিত অর্থসমূহের যে-কোনও অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কুরআন ও হাদীছে এসব অর্থে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার আছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ
(জেনে রেখ) তার (রাসূলের) মাওলা (সঙ্গী ও সাহায্যকারী) আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ। সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৪
আলেমদেরকে যে 'মাওলানা' বলা হয়ে থাকে তাও এ হিসেবেই যে, তারা দীনের অভিভাবক, সাহায্যকারী, নেতা ইত্যাদি।
তো 'মাওলা' দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরও যেহেতু বোঝানো হয় এবং ঋণ পরিশোধে সাহায্য চাওয়াটা যেমন দু'আর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার কাছে হতে পারে, তেমনি কোনও মানুষের কাছেও এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। দুনিয়ার কাজে মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ায় শরী'আতের কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। কাজেই এ ক্ষেত্রে এটা বোঝার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে, হযরত যুবায়র রাযি. ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে তাঁর যে মাওলার কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন, তিনি তাঁর কোনও বন্ধু, চুক্তিবদ্ধ মিত্র বা অন্য কেউ-ও হতে পারে। তাই হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. বুঝতে পারছিলেন না যে, তাঁর পিতা 'মাওলা' বলে ঠিক কাকে বোঝাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি পিতাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। পিতা বলে দিলেন যে, মাওলা বলে তিনি আল্লাহ তা'আলাকেই বুঝিয়েছেন।
এটা আল্লাহ তা'আলার প্রতি হযরত যুবায়র ইবনুল আউওয়াম রাযি.-এর চূড়ান্ত তাওয়াক্কুল ও পরম নির্ভরতারই পরিচয় বহন করে। সেইসঙ্গে এটা পরিচয় বহন করে তাঁর গভীর তাকওয়া ও আল্লাহভীতিরও। তাঁর ভয় ছিল শহীদ হয়ে গেলে তাঁর ঋণ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে? এটা বান্দার হক। এ হক পরিশোধ না হলে আল্লাহ তা'আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন কী উপায় হবে? তিনি বড় কোনও ব্যবসায়ী ছিলেন না, মোটা অঙ্কের নগদ টাকা-পয়সা বা সোনা-রূপারও মালিক ছিলেন না। তাঁর যা সম্পদ তা কেবলই স্থাবর সম্পত্তি জমি-জায়েদাদ, যা তিনি যুদ্ধে গনীমতের অংশ হিসেবে পেয়েছিলেন। বাহ্যত তা দ্বারা এত বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ হওয়া সম্ভবপর ছিল না। তাঁর উল্লিখিত কথা দ্বারা সে আশঙ্কার প্রতি ইশারাও হয়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা। তাঁর বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলার কাছে পরিপূর্ণ আস্থার সাথে সাহায্য চাইলে তিনি অবশ্যই তা পরিশোধের একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। যারা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা করে এবং অন্তরে তাঁর ভয়ও রাখে, আল্লাহ তা'আলা অকল্পনীয়ভাবে তাদের সাহায্য করে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে-কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। সূরা তালাক (৬৫), আয়াত ২-৩
বাস্তবেও তা-ই হল। এত বিপুল অঙ্কের ঋণ খুব আসানীর সঙ্গে পরিশোধ হয়ে গেল। এর জন্য তাঁর সবটা সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়নি। গাবা'র ভূমিই যথেষ্ট হয়ে গেছে। এটা বরকত ছাড়া কিছুই নয়। জমির যে মূল্য হওয়ার কথা ছিল, কার্যত তারচে' বহুগুণ বেশি মূল্যে তা বিক্রি হয়েছে। সুবহানাল্লাহ, এভাবে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাওয়াক্কুল করার সুফল কেবল আখিরাতে নয়; বরং দুনিয়ায়ও লাভ হয়ে থাকে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দেনা বান্দার হক। মৃত্যুর আগে নিজে তা পরিশোধ করতে না পারলে ওয়ারিশদেরকে তা পরিশোধের জন্য অসিয়ত করে যাওয়া চাই।
খ. যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছু আমানত রাখে, আমানতগ্রহীতার কর্তব্য তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।
গ. কেউ দেনা রেখে মারা গেলে সচ্ছল ও সম্পদশালী ব্যক্তিদের উচিত তা পরিশোধে সহযোগিতা করা, যেমন হযরত হাকিম ইবন হিযাম রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-এর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ঘ. পাওনাদার ব্যক্তির উচিত তার পাওনা পরিশোধের জন্য দেনাদারের প্রতি কঠোরতা না করে সে যাতে তা আসানীর সাথে পরিশোধ করতে পারে সেই সুযোগ দেওয়া, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-কে সেই সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
ঙ. আল্লাহ তা'আলার প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল থাকলে অবশ্যই তার সুফল পাওয়া যায়।
চ. বড় পুত্রের কর্তব্য পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের ব্যাপারে শরী'আতসম্মতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমনটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি, করেছিলেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
