রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৮৪
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।

মুসলিম জাতির দীনী ও আদর্শিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যেমন ব্যক্তিগতভাবে দীনের বিধানাবলী পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি, তেমনি সমগ্র জাতিও যাতে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে সে ব্যাপারেও আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখা অবশ্যকর্তব্য। কেবল ব্যক্তিগত আমল জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। সমগ্র জাতি বিপথগামী হয়ে গেলে ব্যক্তিগত আমল-আখলাকও ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তাই প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য নিজ আমল-আখলাক রক্ষায় যত্নবান থাকার পাশাপাশি সমগ্র জাতির আমল-আখলাকের হেফাজতেও ভূমিকা রাখা।
অন্যের আমল-আখলাক রক্ষায় ভূমিকা রাখার উপায় কী? আমাদের দীন এ ব্যাপারে যে উপায় শিক্ষা দিয়েছে তার নাম 'আমর বিল মারূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার'। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা।
প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই কিছু না কিছু গাফলাত ও উদাসীনতা বিদ্যমান থাকে। তাই অনেক সময়ই মানুষ সৎকাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। সে প্রস্তুতির জন্য নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা করতে হয়। যারা নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদা ও সাধনা করে নিজেকে সৎকাজের জন্য অভ্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের পক্ষে সহজেই গাফলাত ও উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সৎকাজে লিপ্ত হয়ে পড়া সম্ভব হয়। কিন্তু যাদের সে মুজাহাদা ও সাধনা করা হয়নি তাদের দ্বারা সৎকাজে গড়িমসি হয়ে যায়। কিন্তু সৎকাজ তো তাদের করতেই হবে। তারা যাতে তা করতে পারে সে লক্ষ্যে অন্যদের উচিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সৎকাজের আদেশই হচ্ছে সে সাহায্য। অন্যরা যদি হিকমতের সাথে তাকে সৎকাজের আদেশ দেয়, তার সামনে সৎকাজের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য তুলে ধরে, সৎকাজ না করার ক্ষতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে এবং দরদ ও মমত্বের সাথে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, তবে আল্লাহ চাহেন তো তার মনে সৎকাজের আগ্রহ জাগবে এবং একপর্যায়ে তা করতে সে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সমাজে এ প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত পরিমাণে জারি থাকলে ব্যাপক সুফলের আশা থাকে। এর ধারাবাহিকতার সমাজের অধিকাংশ মানুষ সৎকর্মশীল হয়ে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়।
সৎকাজের আদেশ দানের পাশাপাশি অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকাও জরুরি। কেননা কাম, ক্রোধ, হিংসা, অহমিকা প্রভৃতি রিপুর কারণে মানুষের দ্বারা নানারকম অসৎকর্ম হয়ে যায়। যারা সাধনা ও মুজাহাদা দ্বারা এসব রিপু দমন বা নিস্তেজ করেনি, তারা হামেশাই এর শিকার হয়ে পাপকার্যে লিপ্ত থাকে। আপন ঈমান-আমল ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই শ্রেণীর লোকের পাশে দাঁড়ানোও একান্ত কর্তব্য। তারা যাতে অসৎকর্ম ছেড়ে সুপথে ফিরে আসতে পারে, সে লক্ষ্যেই 'নাহী আনিল মুনকার' বা 'অসৎকাজে নিষেধ'-এর বিধান। আমরা যদি আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ বিধান মেনে চলি এবং যখনই কাউকে অসৎকর্মে লিপ্ত দেখি তখন দরদের সাথে তাকে এর অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকি, তবে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় সে একপর্যায়ে অসৎকর্ম ছেড়ে নিজেকে সংশোধন করতে সক্ষম হবে।
মোটকথা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইসলামের এক অবশ্যপালনীয় বিধান। কুরআন ও হাদীছে এর বিশেষ গুরুত্ব ও বিপুল ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ
সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (104)

অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে বাধা দেবে। এরূপ লোকই সফলতা লাভকারী।সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৪

ব্যাখ্যা

এর আগের আয়াতে 'আল্লাহর রশি' অর্থাৎ কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার তাগিদ করা হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, উম্মতের একটি দল যেন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে রত থাকে। তারপর বলা হয়েছে, এরাই সফলকাম। যেন জানানো হচ্ছে, মুসলিম জাতির সামষ্টিক ও জাতীয় সাফল্য দু'টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক হচ্ছে আল্লাহর রজ্জু কুরআন মাজীদকে শক্তভাবে ধরে রাখা, আর দ্বিতীয় হচ্ছে প্রত্যেকে যাতে শক্তভাবে তা ধরে রাখতে পারে সেজন্য সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। বিষয়টা এভাবেও বলা যায় যে, একদিকে নিজের ইসলাহ ও সংশোধনে যত্নবান থাকতে হবে, অন্যদিকে অন্যের সংশোধনকল্পে দাওয়াতী মেহনত জারি রাখতে হবে। এ আয়াতে বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিষয়ের প্রতি জোর তাগিদ করা হয়েছে।

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের জন্য বিশেষ একটি দলের জরুরত

এমনিতে তো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার সাধারণ দায়িত্ব উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর অর্পিত, যা আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করা অবশ্যকর্তব্য। সে সম্পর্কে সামনে আলোচনা আসছে। এ আয়াতে দাওয়াত সম্পর্কিত বিশেষ দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উম্মতের মধ্যে সর্বদা এমন একটা দল থাকা চাই, যাদের কাজই হবে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজ করতে নিষেধ করা। তারা সর্বদা মানুষকে কুরআন ও হাদীছের হিদায়াতের দিকে ডাকবে। ইসলাম যেসকল সৎকর্মের শিক্ষা দিয়েছে মানুষকে তা অবহিত করবে। গাফেল ও উদাসীন মানুষকে সৎকর্ম করতে উৎসাহ দেবে। আর যখনই মানুষকে অন্যায় ও অসৎকর্মে লিপ্ত দেখবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করবে এবং যথাসাধ্য তা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
বলাবাহুল্য, দাওয়াতের কাজকে একটি স্বতন্ত্র যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে তাতে নিয়োজিত রাখা এবং সে যিম্মাদারী সুচারুরূপে পালন করা যে-কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য কোনটা সৎকাজ আর কোনটা অসৎকাজ তা ভালোভাবে জানা থাকা চাই। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, সামাজিক আদব-কায়দা, অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত মাসাইলসহ ইসলামের পরিপূর্ণ রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া এ দায়িত্ব পালন করতে গেলে যথেষ্ট ভুল-ভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই দীনের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতের দায়িত্ব সাধারণভাবে সকলের ওপর ন্যস্ত না করে বিশেষ একটি দলের ওপর করা হয়েছে। যেমন অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ (122)

'সুতরাং তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করে এবং সতর্ক করে তাদের কওমকে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে, ফলে তারা (গুনাহ থেকে) সতর্ক থাকবে। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২২
আলোচ্য আয়াতের মত এ আয়াতেও মূলত দাওয়াতের বিশেষ স্তরের কথাই বলা হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতে বিশেষ দলটির দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা তিনটি কাজ করবে।
ক. তারা 'খায়র' বা কল্যাণের দিকে ডাকবে;
খ. ‘মারূফ’ বা সৎকাজের আদেশ করবে এবং
গ. মুনকার বা অসৎ ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করবে।

বিশেষ সে দলটির প্রথম কাজ

সর্বপ্রথম বলা হয়েছে- يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ ডাকবে কল্যাণের দিকে। এক বর্ণনায় আল খায়র এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে الخير هو اتباع القرآن وسنتي খায়র হচ্ছে কুরআন এবং আমার সুন্নতের অনুসরণ করা। তাফসীরে ইবনে কাছীর, খণ্ড ২, পৃ. ৭৮ (উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়)
এর মধ্যে গোটা দীন ও শরীয়ত এসে যায়। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, ওই দলটির কাজ হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীন ও শরীয়তের দাওয়াত দিতে থাকা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের জন্য তো বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতি দরকার। অর্থাৎ যখন কাউকে কোনও সৎকাজে গড়িমসি করতে দেখা যায়। তখন তাকে সেই সৎকাজের দিকে ডাকার প্রয়োজন হয়। এমনিভাবে যখন কাউকে কোনও অসৎকাজে লিপ্ত থাকতে দেখা যায় তখন তাকে তাতে নিষেধ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু খায়র ও কল্যাণ তথা দীনের দিকে ডাকার জন্য এরকম কোনও পরিস্থিতির অপেক্ষা করতে হয় না। বরং এটা সবসময়কার কাজ। সবসময় মানুষকে ইসলামের সৌন্দর্য বোঝানো; ইসলামী বিধিবিধান পালনে উৎসাহ দেওয়া এবং নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতসহ কর্মগত ও আখলাকী বিধানাবলীর গুরুত্ব ও ফযিলতের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হচ্ছে খায়রের দিকে আহ্বান। কুরআন মাজীদে এটাকে ওই দলটির দায়িত্ব কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, খায়র ও কল্যাণের দিকে ডাকার দুটি স্তর আছে।

ক. অমুসলিমকে ইসলামের দিকে ডাকা। আপন আপন যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এটা সাধারণভাবে প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। আর বিশেষভাবে এ আয়াতে বর্ণিত দলটির কাজই হবে কথায় ও কাজে সারাবিশ্বের সমস্ত অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া।

খ. খায়রের দিকে ডাকার দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মুসলিম ভাইদেরকে ইসলামী শিক্ষা অনুসরণের প্রতি উৎসাহিত করা। এটা সাধারণভাবে যেমন প্রত্যেক মুসলিমেরই দীনী দায়িত্ব, তেমনি বিশেষভাবে ওই দলটির একান্ত কর্তব্য যারা ইসলামী শিক্ষায় পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জনের পর দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত থাকাকে নিজেদের যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।

বিশেষ দলটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাজ

আয়াতে দলটির দ্বিতীয় কাজ বলা হয়েছে, يامرون بالمعروف "তারা সৎকাজের আদেশ দেবে'। মা'রূফ- এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিচিত। অর্থাৎ সকলেই যা জানে। এর দ্বারা ওই সকল নেক কাজকে বোঝানো হয় ইসলাম যা করতে আদেশ করেছে এবং প্রত্যেক যুগের নবীগণ আপন আপন উম্মতকে তা করতে উৎসাহ দিয়েছে। যেমন আল্লাহর ইবাদত করা, নবীর আনুগত্য করা, সত্য বলা, আমানতের হিফাজত করা, ওয়াদা রক্ষা করা, আর্ত ও পীড়িতের সাহায্য করা ইত্যাদি। সাধারণভাবে সকল যুগের মানুষ এগুলোকে সৎকর্মরূপে জানে ও চেনে। তাই একে মা'রূফ বা পরিচিত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আয়াতে বর্ণিত দলটির তৃতীয় কাজ বলা হয়েছে, وينهون عن المنكر তারা অসৎকাজে নিষেধ করে'। এর দ্বারা এমনসব অন্যায় ও মন্দকাজ বোঝানো হয়ে থাকে যা করতে ইসলাম নিষেধ করে দিয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মেও যা নিষিদ্ধ ছিল। যেমন আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, নবীর শিক্ষা অগ্রাহ্য করা, মিথ্যা বলা, চুরি করা, আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, গীবত করা, ঝগড়া ফাসাদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। 'মুনকার' অর্থ অপরিচিত ও আপত্তিকর বিষয়। সবযুগে সব দীনে এসকল কাজ ছিল আপত্তিকর এবং দীনদারদের কাছে ছিল অপরিচিত তথা দীন বহির্ভূত। সেকারনেই এগুলোকে মুনকার নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, নিষেধ ও আপত্তি করা যাবে কেবল এমন কাজেই যা দীন বহির্ভূত বলে জানা আছে। সুতরাং দীন ও শরীয়তে যেকাজের ভিত্তি আছে তাতে বাধা দেওয়া বা আপত্তি করার কোনও সুযোগ নেই। বরং তাতে আপত্তি করাই হবে একটি আপত্তিকর কাজ।
উল্লেখ্য, পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে এ তিনটি কাজ করতে হলে জরুরি হচ্ছে ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি উত্তম চরিত্র, তাকওয়া-পরহেযগারী, ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং মানুষকে আকর্ষণ করার মত যোগ্যতারও অধিকারী হওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ, বলেন, দীনে-ইসলাম ও সত্যের বাণী যারা প্রচার করবে তাদেরকে অবশ্যই উত্তম চরিত্র, উৎকৃষ্ট যোগ্যতা, খালেস নিয়ত, হৃদয়ের প্রশস্ততা, সততা ও সত্যবাদিতা, মিষ্টি ভাষা, উদার চরিত্র, পরহিতৈষণা, কষ্টসহিষ্ণুতা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করার মত প্রশংসনীয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। সেইসঙ্গে তাদেরকে এমনও হতে হবে যে, একমুহূর্তের জন্যও লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, রিয়াকারী এবং দুনিয়া লাভের আগ্রহকে নিজেদের অন্তরে স্থান দেবে না।মালফুযাতে কাশ্মীরী, পৃ. ২৯০

দুই নং আয়াত

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ

অর্থ : (হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করে থাক ও অন্যায় কাজে বাধা দিয়ে থাক। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১১০

ব্যাখ্যা

এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলা হয়েছে দু'টি-
ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা এবং
খ. আল্লাহর প্রতি ঈমান।
প্রশ্ন হতে পারে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা তথা দাওয়াতের দায়িত্ব তো অন্যান্য উম্মতের ওপরও ছিল, যেমন বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস দ্বারা জানা যায়। আর বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমানও তাদের ছিল, তা সত্ত্বেও তাদের অপেক্ষা এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ কী?

এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ

এর জবাব আয়াতের বাচনভঙ্গির মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। বলা হয়েছে, 'তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে থাক। এর মধ্যে ইশারা রয়েছে যে,

অন্যান্য উম্মতের ওপর এ দায়িত্ব থাকলেও তারা তা পালনে অবহেলা করত। অবহেলার কারণে কুরআন মাজীদের কোনও কোনও আয়াতে তাদেরকে তিরস্কারও করা হয়েছে। এবং সে অবহেলারই পরিণাম হল, তাদের ধর্ম কালপরিক্রমায় বিকৃত ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অপরপক্ষে এ উম্মতের কোনও না কোনও দল এ দায়িত্ব যথারীতি আদায় করে আসছে এবং হাদীসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত পালন করে যাবে, যে কারণে দীনে ইসলাম অদ্যাবধি তার স্বরূপে সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
সেইসঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের একটা কারণ হল দাওয়াতের পূর্ণাঙ্গতা ও সার্বজনীনতা। অর্থাৎ এ দীন পরিপূর্ণ ও সার্বজনীন হওয়ায় এ উম্মতের দাওয়াতের মধ্যেও পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতার গুণ বিদ্যমান, যা অন্য কোনও উম্মতের দাওয়াতে ছিল না।
আর দ্বিতীয় বিষয় অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ঈমানও যে অন্যান্য উম্মতের যথাযথ নয়, তাও এ আয়াতে স্পষ্ট। সুতরাং বলা হয়েছে, “কিতাবীগণ যদি ঈমান আনত' অর্থাৎ তারা যদি শেষ নবী ও কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমান আনত! আল্লাহ তা'আলার প্রতি ঈমান আনা কেবল তখনই সাব্যস্ত হতে পারে, যখন শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনা হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

أَتَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ» قَالُوا: اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: «شَهَادَةُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ

"তোমরা কি জান এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কী? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৭: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৮. মুসনাদ আবূ দাউদ ওয়ালিসী, হাদীছ নং ২৮৭

ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান না আনার কারণে আল্লাহ তা'আলার প্রতি তাদের ঈমানও যথার্থ হয়নি। এমনকি এ কারণে তাদের আপন-আপন নবী ও কিতাবের প্রতিও ঈমান পূর্ণাঙ্গ থাকেনি। ফলে তাদের ঈমান হয়ে গেছে খণ্ডিত ঈমান। পক্ষান্তরে দাওয়াতের মত এ উম্মতের ঈমানও পূর্ণাঙ্গ। তারা কিছুতে ঈমানে আনে, কিছুতে আনে না—এমন নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যত কিতাব নাযিল হয়েছে ও যত নবী প্রেরিত হয়েছেন, এরা তার সকলের প্রতিই বিশ্বাস রাখে। তাই বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর প্রতি (অর্থাৎ তার সমস্ত কিতাব ও সমস্ত নবীর প্রতি) ঈমান রাখ। সুতরাং ঈমানের পরিপূর্ণতা এবং সার্বজনীনতার সাথে দাওয়াতের ধারাবাহিকতা রক্ষার ভিত্তিতেই এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে।
সুতরাং আমরা যদি শ্রেষ্ঠ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই এসকল গুণের অধিকারী হতে হবে। একবার হযরত উমর ফারূক রাযি. আলোচ্য আয়াতটি পাঠ করার পর বললেন-

من سره أن يكون من تلك الأمة فليؤد شرط الله فيها

“যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ উম্মতের দলভুক্ত থাকতে চায়, সে যেন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর শর্তসমূহ পূরণ করে।'


তিন নং আয়াত

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)

অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে তিনটি আদেশ করা হয়েছে।

ক. ক্ষমাপরায়ণ হওয়া;
খ. সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও
গ. অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য করা।
الْعَفْوَ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপরায়ণতা। এ আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালামকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলেন। হযরত জিবরীল "আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে জেনে এসে তাঁকে বললেন, এ আয়াতে আপনাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে,- যে ব্যক্তি আপনার ওপর জুলুম করবে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। - যে ব্যক্তি আপনাকে বঞ্চিত করবে, আপনি তার প্রতি উদারতা প্রদর্শন করবেন। -আর যে ব্যক্তি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আপনি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
এর সারকথা হচ্ছে অন্যের প্রতি ক্ষমাশীলতার আচরণ করা। এটি একটি মহৎ গুণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা জীবন মানুষের সঙ্গে ক্ষমাশীল হয়েই থেকেছেন। মানুষ কতভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের শত্রুদেরকেও এদিন ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা!
বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উন্নত চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ক্ষমাশীলতাও ছিল অসাধারণ। তা সত্ত্বেও তাঁকে যে এ আদেশ করা হয়েছে তা মূলত উম্মতকে শেখানোর জন্য। সুতরাং সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবনে এ শিক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তারপর তাদের দেখাদেখি তাবিঈগণও ক্ষমাপরায়ণতার উচ্চতর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এভাবে যুগ পরম্পরায় এ উম্মত ক্ষমাশীলতার ব্যাপক চর্চা করে এসেছে। আমাদেরও কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণে কুরআন মাজীদের এ আদেশ মেনে চলতে সচেষ্ট থাকা।
দ্বিতীয় হুকুম করা হয়েছে সৎকাজের আদেশ দেওয়া সম্পর্কে। العرف শব্দটি প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে ব্যবহৃত المعروف -এর সমার্থক। সর্বপ্রকার সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। অন্যের দেওয়া কষ্ট ও জুলুম ক্ষমা করার পাশাপাশি হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে সৎকাজের আদেশও কর। কেননা কেবল ক্ষমা দ্বারা জালিম ও কষ্টদাতার সংশোধন নাও হতে পারে। অথচ তার সংশোধনও কাম্য। কেননা সংশোধন যদি না হয়, তবে সে একের পর এক জুলুম করেই যাবে। ফলে তার জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকবে। আর এভাবে অপরাপর মানুষও তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং জুলুম থেকে ফেরানোর জন্য তাকে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। সেজন্যই আদেশ করা হয়েছে যে, সৎকাজের নির্দেশ দাও। এ আদেশ কেবল দুঃখ-কষ্টদাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সৎকাজের নির্দেশ সকলের জন্যই প্রয়োজন। যারা অসৎকাজ করে তাদের জন্য প্রয়োজন অসৎকাজ থেকে ফেরানোর লক্ষ্যে, আর যারা সৎকাজ করে তারা যাতে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং সৎকাজে আরও বেশি উন্নতি লাভ করে, সে লক্ষ্যে সৎকাজের উপদেশ তাদের জন্যও উপকারী। যারা এ দায়িত্ব পালনে রত থাকে, তাদের নিজেদেরও এটা দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।
এ আয়াতে তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে- অজ্ঞজনদের অগ্রাহ্য কর। অর্থাৎ যারা জুলুম- অত্যাচার করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেওয়ার পরও হয়তো দেখা যাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতি জেদী চরিত্রের হওয়ায় নিজেদের সংশোধন করছে না। এত উন্নত আচরণ করা সত্ত্বেও তাদের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না। আগের মতই অন্যায় ও অসৎকাজ করে যাচ্ছে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলা। তাদের অন্যায় আচরণে উত্তেজিত হয়ে গেলে নিজের আখলাক-চরিত্র ক্ষতিক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলাই শ্রেয়। ইবন কাছীর রহ. পাশ কাটানোর একটা ব্যাখ্যা এরকমও করেছেন যে, তাদের দুর্ব্যবহারের উত্তর দুর্ব্যবহার দ্বারা নয়; বরং সদ্ব্যবহার দ্বারা করা চাই। এমন নয় যে,তাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সৎকাজের আদেশ করা ছেড়ে দেওয়া হল।

হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা

এ প্রসঙ্গে হযরত 'উমর ফারূক রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত "আব্দুল্লাহ ইবন 'আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'উয়াইনা ইবন হিসন (মদীনায়) আগমন করল এবং তার ভাতিজা হুর্র ইবন কায়স রাযি, এর মেহমান হল। হুর্র ইবন কায়স রাযি. ছিলেন ওইসব লোকের একজন, যাদেরকে হযরত উমর রাযি. (তাঁর মজলিসে) নিজের কাছে বসাতেন। হযরত উমর রাযি.-এর মজলিস ও পরামর্শসভার সদস্য হত কারী 'আলেমগণ, প্রৌঢ় হোক বা যুবক।
“উয়াইনা তার ভাতিজাকে বলল, ওহে ভাতিজা! এই আমীরের দরবারে তোমার বিশেষ মর্যাদা আছে। সুতরাং তুমি আমার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাও। তিনি অনুমতি চাইলেন। হযরত উমর রাযি, তাঁকে অনুমতি দিলেন। 'উয়াইনা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ওহে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! তুমি আমাদেরকে বেশি কিছু দিচ্ছ না। এবং আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করছ না। এ কথায় 'উমর রাযি. রেগে যান। এমনকি তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। তখন হুর্র ইবন কায়স রাযি, তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন! আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন-

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (199)

অর্থ : (হে নবী!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর এবং (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের অগ্রাহ্য করো।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯
আর নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি অজ্ঞদের একজন। আল্লাহর কসম! হুর্র যখন এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, 'উমর রাযি. আর তার সামনে বাড়লেন না। (অর্থাৎ আয়াতের নির্দেশ লঙ্ঘন করলেন না)। বস্তুত তিনি আল্লাহর কিতাবের (সীমারেখার ভেতর) অতি স্থিরকদম ছিলেন (অর্থাৎ কুরআনের হুকুমের বাইরে পা ফেলতেন না)। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬৪২, ৭২৮৬

চার নং আয়াত

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ

অর্থ : মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ করে, অসৎ কাজে বাধা দেয় । সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৭১

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের আগে মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। তাতে জানানো হয়েছিল-

الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (67)

'মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে ও ভালো কাজে বাধা দেয় এবং তারা নিজেদের হাত বন্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। এরপর আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। নিঃসন্দেহে মুনাফিকগণ ঘোর অবাধ্য। সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৬৭
এতে মুনাফিকদের তিনটি খাসলত বর্ণিত হয়েছিল।
মুনাফিকদের বিপরীতে এ আয়াতে মুমিন নর-নারীর চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে তা নিম্নরূপ।

এক. মুনাফিকরা তো ভালো কাজে বাধা দিয়ে মন্দ কাজে উৎসাহ দেয়। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং মন্দকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করে।

দুই. মুনাফিকরা কৃপণ। দানের বেলায় হাত বন্ধ করে রাখে। কৃপণতার কারণে ভালো কাজে অর্থব্যয় করতে পারে না। পক্ষান্তরে মু'মিনদের হাত খোলা। তারা আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করে।

তিন. মুনাফিকরা আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে গেছে। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ সর্বদা আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ রাখে, যে কারণে তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে এবং সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে।

মু'মিনদের প্রতি ভালোবাসা রাখা খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক

লক্ষণীয় হচ্ছে যে, মুনাফিকদের বেলায় বলা হয়েছিল- মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী সকলেই একে অন্যের মত। আর এ আয়াতে মু'মিনদের বেলায় বলা হচ্ছে- মুমিন নর ও মুমিন নারী পরস্পরে (একে অন্যের) বন্ধু ও সহযোগী। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেবলই পার্থিব স্বার্থে। উপরে উপরে তারা একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক রেখে চলে, কিন্তু অন্তরে কোনও মহব্বত ও ভালোবাসা নেই। পক্ষান্তরে মু'মিনগণ পরস্পরে সেরকম কপট সম্পর্ক রেখে চলে না। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আন্তরিক ও অকৃত্রিম। আর সে কারণেই তারা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করে। বোঝা যাচ্ছে সৎকাজে আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা বন্ধুত্বের আলামত এবং খাঁটি ঈমানের পরিচায়ক। খাঁটি ঈমানদার সর্বদা অন্যের প্রতি আন্তরিক মহব্বত রাখবে এবং তার সুখ ও দুঃখে তার পাশে থাকবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِن كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا

'এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরস্বরূপ, যার একাংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৮১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬০; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭৯০

অপর এক হাদীছে ইরশাদ-

«تَرَى المُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى»

'তুমি মুমিনদেরকে পারস্পরিক দয়ামায়া, ভালোবাসা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এক দেহের মত দেখতে পাবে, যার কোনও একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকি সব অঙ্গ অনিদ্রা ও উত্তাপে তার অংশীদার হয়ে যায়। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭২০৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৫৯
এই ঐক্য ও সম্প্রীতির দাবি সর্বদা একে অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করতে থাকা। কেননা এক মু'মিনের জন্য অপর মু'মিনের এটাই সবচে' বড় সহযোগিতা।
এ আয়াত প্রমাণ করে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা কেবল মু'মিন পুরুষের নয়; বরং মু'মিন নারীরও দায়িত্ব।

পাঁচ নং আয়াত

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (78) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ (79)

অর্থ : বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারয়ামের যবানীতে লা'নত বর্ষিত হয়েছিল। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা যেসব অসৎ কাজ করত, তাতে একে অন্যকে নিষেধ করত না। বস্তুত তাদের কর্মপন্থা ছিল অতি মন্দ।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭৮-৭৯

ব্যাখ্যা

এ দুই আয়াতে কোনও জাতির ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়া এবং তাদের মধ্যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পরিত্যাক্ত হয়ে যাওয়া বা সে দায়িত্ব আদায়ে চরম অবহেলা দেখা দেওয়ার পার্থিব পরিণামও কত অশুভ হতে পারে, সে সম্পর্কিত দু'টি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটি ঘটনা হযরত দাউদ 'আলাইহিস সালামের যমানার, অপরটি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যমানার।

হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানার ঘটনা

হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যমানায় যে ঘটনা ঘটেছিল, কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এরকম-

وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (163) وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ (164) فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165) فَلَمَّا عَتَوْا عَنْ مَا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ (166)

এবং তাদের কাছে সাগর তীরে অবস্থিত জনপদবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন তারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করত, যখন তাদের (সাগরের) মাছ শনিবার দিন তো পানিতে ভেসে ভেসে তাদের সামনে আসত; আর যখন তারা শনিবার উদ্‌যাপন করত না, (অর্থাৎ অন্যান্য দিনে) তা আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে তাদের উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে পরীক্ষা করেছিলাম।
এবং (তাদেরকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও) যখন (শনিবার মাছ শিকার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা কৌশলে তা শিকার করছিল আর তাদের কিছু লোক তাদেরকে উপদেশ দিচ্ছিল এবং এভাবে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল। এ অবস্থায়) তাদেরই একটি দল (অন্য দলকে যারা মাছ শিকারকারীদেরকে মাছ শিকার করতে নিষেধ করছিল) বলেছিল, তোমরা এমন সব লোককে কেন উপদেশ দিচ্ছ, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে ফেলবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দেবেন? তারা বলল, (আমরা এটা করছি) তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়িত্বমুক্ত হওয়ার জন্য এবং (এ উপদেশ দ্বারা) হতে পারে, তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে (এবং শনিবার মাছ শিকার থেকে বিরত হবে)।
তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল, তখন অসৎকাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত করি। সুতরাং তাদেরকে যে কাজ করতে (অর্থাৎ শনিবার মাছ শিকার) নিষেধ করা হয়েছিল, তারা যখন তার বিপরীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল, তখন আমি তাদেরকে বললাম, ঘৃণিত বানর হয়ে যাও। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৩-১৬৬

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনা

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর যামানার ঘটনাটি ছিল আসমানী খানা সম্পর্কিত। সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ (111) إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَاعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ قَالَ اتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (112) قَالُوا نُرِيدُ أَنْ نَأْكُلَ مِنْهَا وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا وَنَعْلَمَ أَنْ قَدْ صَدَقْتَنَا وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ الشَّاهِدِينَ (113) قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (114) قَالَ اللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ فَمَنْ يَكْفُرْ بَعْدُ مِنْكُمْ فَإِنِّي أُعَذِّبُهُ عَذَابًا لَا أُعَذِّبُهُ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ (115)

(এবং তাদের এ ঘটনার বর্ণনাও শোন যে.) যখন হাওয়ারীগণ বলেছিল, হে ঈসা ইবনে মারয়াম! আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে (খাদ্যের) একটা খাঞ্চা অবতীর্ণ করতে সক্ষম? ঈসা বলল, আল্লাহকে ভয় কর,যদি তোমরা মুমিন হও।
তারা বলল, আমরা চাই যে, তা থেকে খাব এবং আমাদের অন্তর পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভ করবে এবং আমরা (পূর্বাপেক্ষা অধিক প্রত্যয়ের সাথে) জানতে পারব যে,আপনি আমাদেরকে যা কিছু বলেছেন তা সত্য, আর আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্যদাতাদের অন্তর্ভুক্ত হব।
(সুতরাং) ঈসা ইবনে মারয়াম বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে একটি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন, যা হবে আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য আনন্দ উদযাপনের কারণ এবং আপনার পক্ষ হতে একটি নিদর্শন। আমাদেরকে (এ নে'আমত) অবশ্যই প্রদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।
আল্লাহ বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি সে খাঞ্চা অবতীর্ণ করব, কিন্তু তারপর তোমাদের মধ্যে যে-কেউ কুফরী করবে আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্ব জগতের অন্য কাউকে দেব না। সূরা মায়েদা (৫), আয়াত ১১২-১১৫
এ সম্পর্কে তিরমিযী শরীফে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. থেকে একটি হাদীছ এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

أُنْزِلَتِ المَائِدَةُ مِنَ السَّمَاءِ خُبْزًا وَلَحْمًا, وَأُمِرُوا أَنْ لاَ يَخُونُوا وَلاَ يَدَّخِرُوا لِغَدٍ, فَخَانُوا وَادَّخَرُوا وَرَفَعُوا لِغَدٍ, فَمُسِخُوا قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ.

'আসমান থেকে রুটি ও গোশত ভরা খাঞ্চা পাঠানো হল। আদেশ করা হল, তারা যেন খেয়ানত না করে এবং আগামীকালের জন্য জমা করে না রাখে। কিন্তু তারা খেয়ানত করল, জমা করল এবং পরবর্তী দিনের জন্য তুলে রাখল। ফলে তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করে দেওয়া হল। জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৬১

অসৎকাজে বাধা না দেওয়ার পরিণাম

আলোচ্য আয়াতে জানানো হয়েছে, এ দুই জাতিকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামের পক্ষ থেকে লা'নতের কারণে। তাঁরা তাদের প্রতি লা'নত করেছিলেন এ কারণে যে, তারা চরম পাপাচার ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল একে অন্যকে পাপাচারে লিপ্ত হতে নিষেধ করা। প্রথম ঘটনায় কিছু লোক নিষেধ করেছিল বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। পরিণামে তাদের ওপর আল্লাহর আযাব ও গযব নেমে আসে। তাদের মানবাকৃতি সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া হয়। ফলে তারা শূকর ও বানরে পরিণত হয়ে যায়।
তাদের এ বিকৃতি কেবল মনের নয়, বরং বাহ্যিক আকৃতিরও। তাদের চেহারা-সুরত সম্পূর্ণরূপেই শূকর ও বানরের মত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীতে যে শূকর ও বানর দেখা যায় এরা আগে থেকেই ছিল। এরা তাদের বংশধর নয়। তারা কিছুদিন বিকৃত অবস্থায় থাকার পর ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর পক্ষে মানুষকে শূকর ও বানর করে ফেলা মোটেই অসম্ভব নয়। সুতরাং এ ঘটনাকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
এই কঠিন শাস্তির একটি বড় কারণ বলা হয়েছে অন্যায়-অপরাধ করতে দেখেও তাতে বারণ না করা। কুরআন মাজীদে তাদের এ ঘটনার উল্লেখ দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের মত অবহেলা যেন আমরা কিছুতেই না করি। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে তা যেন অবশ্যই পালন করি। নয়তো আমাদের ক্ষেত্রেও ভয় আছে যে, ব্যাপক পাপাচারের দরুন পাপী ও অপাপী সকলের ওপরই আযাব নেমে আসবে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)

“এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন।সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫

ছয় নং আয়াত

وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ

অর্থ : বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক।'সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৯

ব্যাখ্যা

অর্থাৎ কুরআন মাজীদ এবং এতে যা-কিছু বলা হয়েছে সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা সত্যবাণী, যা তোমাদের শুনিয়ে দেয়া হলো। এখন এতে ঈমান আনা না আনা এবং এর অনুসরণ করা না করা তোমাদের ব্যাপার। যদি এর প্রতি ঈমান আন তাতে তোমাদেরই লাভ। এর অনুসরণ করে চললে দুনিয়ায় শান্তি এবং আখিরাতে মুক্তিলাভ করবে। আর যদি ঈমান না আন এবং এর অনুসরণ করে না চল তবে দুনিয়ায়ও নানান অশান্তি ভোগ করবে আর আখিরাতেও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। মোটকথা, এতে ঈমান আনা ও না আনার লাভ-ক্ষতি তোমাদেরই, আল্লাহর কিছু আসে যায় না।
এর দ্বারা মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর পর সমস্ত দাওয়াতদাতাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তোমাদের কাজ কেবল আন্তরিকতার সাথে দাওয়াত দেওয়া। কে তা শুনল এবং কে শুনল না তার কোনও দায়-দায়িত্ব তোমাদের ওপর নেই। সুতরাং কেউ যদি তোমাদের দাওয়াতে কর্ণপাত না করে সেজন্য আক্ষেপ করো না এবং মেহনত ব্যৰ্থ গেছে বলে হতাশাবোধ করো না। তোমাদের সফলতা দাওয়াত দেওয়ার ভেতর আর তাদের সফলতা তা মানার ভেতর। কাজেই কারো না মানায় হতোদ্যম হয়ে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে দিও না।

সাত নং আয়াত

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ

অর্থ : সুতরাং তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে মানুষকে শুনিয়ে দাও।সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৯৪

ব্যাখ্যা

এটি সুরা হিজরের ৯৪ নং আয়াত। এর আগের আয়াতসমূহে ইয়াহুদী নাসারা ও কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতামূলক তৎপরতার বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন যুগে তারা নবীর দাওয়াত অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি দাওয়াতী মেহনতকে ব্যর্থ করে দেওয়ার লক্ষ্যে কী-সব কূটকৌশল অবলম্বন করত এবং এখনো তা করে যাচ্ছে তা বর্ণনা করার পর এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দেওয়া হচ্ছে যে আপনি শত্রুদের আচার-আচরণ অগ্রাহ্য করে আপন দায়িত্ব পালনে রত থাকুন। তাদেরকে মানতে বাধ্য করা আপনার কাজ নয়। আপনার কাজ কেবল দাওয়াত দেওয়া। ব্যস সেকাজ করতে থাকুন। এর দ্বারা সবযুগের দাওয়াতদাতাগণকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তাদেরও কর্তব্য আপন দায়িত্বপালনে রত থাকা। অপরপক্ষ কী আচরণ করছে সেদিকে মন দিয়ে পেরেশান ও অস্থির হয়ে পড়া উচিত নয়।

আট নং আয়াত

أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (165)

অর্থ : তখন অসৎ কাজে যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে তো আমি রক্ষা করি। কিন্তু যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল, উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে এক কঠোর শাস্তি ধরো আক্রান্ত করি। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ১৬৫

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের শুরুতে আছে فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল'। এর দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠির মধ্যে একদল উপদেশদাতা থাকা চাই। যাদের কাজ হবে মানুষকে সৎকাজের দিকে ডাকা এবং কেউ অন্যায় ও অসৎকাজ করলে তাকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা। সে চেষ্টায় যদি অন্যায় অপরাধকারীগণ সুপথে ফিরে আসে তবে তো ভালো। পক্ষান্তরে তারা যদি আদেশ-উপদেশে কর্ণপাত না করে বরং উপর্যুপরি অন্যায়-অপরাধ করে যায় আর এভাবে জাতির অধিকাংশ মানুষ তাতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তবে এর পরিণামে তারা আসমানী আযাব ও গযবে ধ্বংস হলেও উপদেশদাতাগণ সে আযাব থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে। আর যদি কোনও উপদেশদাতা না থাকে; বরং অন্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখেও নীরবতা অবলম্বন করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আসমানী গযব থেকে কেউ নিস্তার পায় না। কেননা নীরবতাও একরকম অপরাধ। ফলে সরাসরি অপরাধকারীদের সঙ্গে নীরবতা অবলম্বনকারীদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করছেন-

وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (25)

"এবং সেই বিপর্যয়কে ভয় কর, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে কেবল তাদেরকেই আক্রান্ত করবে না। জেনে রেখ, আল্লাহর আযাব সুকঠিন। সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৫
এর দ্বারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
কুরআন মাজীদে এসম্পর্কে আরও বহু আয়াত আছে। শিক্ষাগ্রহণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
অন্যায় ও অসৎকাজে বাধাদানের তিনটি স্তর
হাদীছ নং : ১৮৪

হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে তা না পারে, তবে মুখের কথা দ্বারা (প্রতিহত করে)। যদি তাও না পারে, তবে অন্তর দ্বারা। আর এটা হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০৭: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৩)
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
قَالَ الله تَعَالَى: {وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [آل عمران: 104]، وَقالَ تَعَالَى: {كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَر} [آل عمران: 110]، وَقالَ تَعَالَى: {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ} [الأعراف: 199]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ} [التوبة:71]، وَقالَ تَعَالَى: {لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ} [المائدة: 78]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ} [الكهف:29]، وَقالَ تَعَالَى: {فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَر} [الحجر:94]، وَقالَ تَعَالَى: {فأَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ} [الأعراف: 165] وَالآيات في الباب كثيرة معلومة.
184 - فالأول: عن أبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أضْعَفُ (1) الإيمَانِ». رواه مسلم. (2)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধ সম্পর্কে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামসহ অনাগত ভবিষ্যতের সমস্ত মুসলিমকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধের চেষ্টা করা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মু'মিনের এই চেষ্টা অব্যাহত রাখা অবশ্যকর্তব্য।

অন্যায়-অপরাধ প্রতিহত করা কখন কর্তব্য

সাধারণত অন্যায়-অপরাধ কোথাও না কোথাও হয়ই। সবসময় তা সকলের চোখে পড়ে না এবং সকলে জানতেও পারে না। এ অবস্থায় তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব কার? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছটির শুরুতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ দায়িত্ব ওই ব্যক্তির, যে তা জানতে পারে। এখানে শব্দ আছে رأى যার অর্থ চোখে দেখা, জানতে পারা, বিশ্বাস করা ইত্যাদি। এস্থলে 'জানতে পারা' অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য । সুতরাং কোনও অন্যায় কাজ প্রতিরোধের জন্য তা চোখে দেখা শর্ত নয়; বরং যে-কোনও উপায়ে জানতে পারাই যথেষ্ট। নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় কোথাও কোনও অন্যায় কাজ হচ্ছে, তবে মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কারও সম্পর্কে কোনও কথা কানে আসলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর আগে ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া চাই আসলেই সে কাজটি করেছে কি না। এজন্য পত্র পত্রিকার সংবাদ কিংবা লোকমুখে শোনা খবর যথেষ্ট নয়। এসব খবরের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তির সম্মানহানি বা আরও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়, যা কোনওক্রমেই জায়েয নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়। (সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ৬)

প্রকাশ থাকে যে, প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কেবল তখনই, যখন নিশ্চিতভাবে জানা যাবে সে কাজটি অন্যায় ও অপরাধ। যদি তা নিশ্চিত না হয় তখন তাতে বাধা দেওয়া উচিত হবে না। কেননা দমন করতে বলা হয়েছে منكر (মুনকার) কাজকে। মুনকার হচ্ছে শরীআতবিরোধী কাজ। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও কাজ শরী'আতবিরোধী সাব্যস্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন আসে না।

অনেকে ভিন্ন মাযহাবের আমলকে ভুল আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালায়, অথচ ওই মাযহাবে সে আমলটি দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। আর যে আমল দলীল-প্রমাণভিত্তিক তা মুনকার হয় কিভাবে? তা মুনকার তো নয়ই; বরং তাকে মুনকার সাব্যস্ত করাই মুনকার ও শরী'আতবিরোধী কাজ। এরূপ কাজে লিপ্ত হওয়া একরকম ফিতনা বিস্তারের নামান্তর। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।

হুকুম দেওয়া হয়েছে- সে যেন তা প্রতিরোধ করে। বোঝা গেল অন্যায় কাজ প্রতিহত করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। এটা ফরয হওয়া সম্পর্কে এ হাদীছ ছাড়াও কুরআন-সুন্নাহ'র একাধিক দলীল আছে। কোথাও অন্যায় কাজ হচ্ছে বলে যদি কোনও একজন জানতে পারে তবে তো তা প্রতিহত করা তার জন্য ফরযে আইন হবে, আর যদি একাধিক ব্যক্তি জানে তবে ফরযে কিফায়াহ। তাদের মধ্যে যে-কোনও একজন তা প্রতিহত করলে সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে।

অপরাধ প্রতিহত করার স্তরসমূহ

হাদীছটিতে অন্যায় কাজ প্রতিহত করার তিনটি স্তর বলা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে হাত দ্বারা প্রতিহত করা। হাত দ্বারা প্রতিহত করার মানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধ দমন করা। অর্থাৎ অন্যায় কাজটি যদি এমন হয় যা প্রতিহত করার জন্য শক্তিপ্রয়োগ দরকার হয়, তবে যার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা আছে তার কর্তব্য শক্তিপ্রয়োগ দ্বারাই তা প্রতিহত করা।

দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে বাকশক্তির ব্যবহার। আর তৃতীয় হল অন্তরে ঘৃণা পোষণ। হাত ও বাকশক্তির ব্যবহার অবশ্যকর্তব্য হয় তখনই, যখন তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে। যদি তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও ব্যবহার করা না হয়, তবে তা দায়িত্বে অবহেলারূপে গণ্য হবে। সেজন্য আখিরাতে জবাবদিহিতার পাশাপাশি দুনিয়ায়ও শাস্তির ভয় আছে। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

ما من قوم يعمل فيهم بالمعاصي، ثم يقدرون على أن يغيروا فلا يغيروا، إلا يوشك أن يعمهم الله بعقاب

কোনও কওমের মধ্যে যদি পাপাচার করা হয় আর তাদের তা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও প্রতিহত না করে, তবে আশঙ্কা রয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকেই শাস্তিদান করবেন। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৫; ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০০) আবূ দাউদ শরীফে আছে, এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর ইমাম শু'বা রহ. বলেন, এর অর্থ অপরাধকারীগণ অপেক্ষা নিরপরাধ লোক যদি বেশি হয়।

হযরত জারীর রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ-

ما من رجل يكون في قوم يعمل فيهم بالمعاصي يقدرون أن يغيروا عليهم فلا يغيرون إلا أصابهم الله بعقاب قبل أن يموتوا

কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি এমন কোনও ব্যক্তি থাকে, যে পাপাচারে লিপ্ত থাকে আর তারা তাকে বাধা দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বাধা না দেয়, তবে আল্লাহ তাআলা তাদের মৃত্যুর আগে তাদেরকে শাস্তি দান করেন। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯১৯২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৯; ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০২)

হাঁ, যদি হাতে বা মুখে বাধা দেওয়ার দ্বারা নিজের জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া ফরয থাকে না। উপরে বর্ণিত হাদীছে যে সক্ষমতার কথা বলা হয়েছে তা দ্বারাও এর প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

ليس للمؤمن أن يذل نفسه، أن يعرضها من البلاء لما لا طاقة له به

মুমিন ব্যক্তির উচিত নয় নিজেকে লাঞ্ছিত করা। অর্থাৎ নিজেকে এমন বিপদের সম্মুখীন করা, যা বহনের ক্ষমতা তার নেই। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২২৫৪: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১৬)

তবে কেবল গালমন্দ বা কটুকথা শোনার ভয়ে এ দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই । এমনিভাবে অপরাধকারী যদি প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়, কিন্তু তার পক্ষ থেকে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে, তবে কেবল প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দমিত হয়ে তার অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ পরিত্যাগ করা যাবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক ভাষণে ইরশাদ করেনঃ-

ألا لا يمنعن رجلا هيبة الناس أن يقول بحق إذا علمه

শোন, কাউকে যেন কোনও ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি তার সামনে হক কথা বলতে নিবৃত্ত না করে, যদি তার তা জানা থাকে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৯১; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১১০১৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৭৮; মুসনাদ আবূ দাউদ তয়ালিসী, হাদীছ নং ২১৫১; আবু ইয়া'লা, হাদীছ নং ১২১২)

অপরাধ দমনের প্রথম স্তর : শক্তিপ্রয়োগ

কোনও কোনও অপরাধ এমন আছে, যা দমনের জন্য শক্তিপ্রয়োগ দরকার হয়, যেমন মদের পাত্র, বাদ্যযন্ত্র, অবৈধ খেলাধুলার সামগ্রী, সিনেমা হল, নাটক-থিয়েটারের মঞ্চ, নৃত্যশালা, বেদীনী বই-পুস্তক ও দীনবিরোধী প্রচারপত্র এবং এরকম আরও যা-কিছু পাপকর্মের আসবার-উপকরণ আছে, তার উৎখাত-উৎপাটন শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই যাদের সে ক্ষমতা আছে তাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা এসবের দমনে শক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মৌলিকভাবে এটা সরকারের দায়িত্ব। সরকার তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে।

এ দায়িত্ব আমজনগণের নিজ হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। তাতে হিতে বিপরীত হয়। হাঁ, কোথাও যদি তার প্রয়োজন বোধ হয় তবে সে ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতিক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে। যদি সরকার নিজে ব্যবস্থা না নেয় এবং জনগণকেও ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি না দেয়, সে ক্ষেত্রে কর্তব্য জনমত গড়ে তোলা। কোনও অবস্থাতেই হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ উচিত নয়। শরী'আত প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুপাতেই দায়িত্ব প্রদান করেছে। সে সামর্থ্যের একটা অংশ হচ্ছে সরকার বা অন্য কোনও ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে বাধা না থাকা। সেরকম বাধা থাকা অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে আরও বড় ক্ষতি এবং আরও বেশি অন্যায়-অপরাধ বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় প্রতিরোধের দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করা, যা পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে।

অপরাধ দমনের দ্বিতীয় স্তর : বাকশক্তির ব্যবহার

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় পর্যায়ে বলেন, যার হাত দিয়ে প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই সে প্রতিহত করবে মুখের কথা দিয়ে। অর্থাৎ অপরাধীকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে অপরাধ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে। তাকে আল্লাহর ভয় দেখাবে, আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে এবং দরদ ও মমতার সাথে তাকে উপদেশ দেবে। প্রয়োজনে তিরস্কারও করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচ্য। সকলের জন্য সকল পন্থা উপযোগী হয় না। কেউ নরম কথায় সংশোধন হয়ে যায়, আবার কারও জন্য ধমক ও তিরস্কারই হয়। কাউকে একাকী বোঝাতে হয়, কাউকে জনসম্মুখে তিরস্কার করতে হয়। মোটকথা কাজ করতে হবে হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে।

সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অনাচার দমনে বাহুবল ব্যবহারের অবকাশ কম। এ ক্ষেত্রে বাকশক্তিই কার্যকর। সুতরাং জানমালের ওপর আঘাত আসার আশঙ্কা না থাকলে জনগণের কর্তব্য সরকারি অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা। সেরকম আশঙ্কা থাকলে প্রতিবাদ করা জরুরি নয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যাদের জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করার হিম্মত আছে, তারা যদি প্রতিবাদ করে তবে জিহাদের ছাওয়াব পাবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-

أفضل الجهاد كلمة حق عند سلطان جائر

সর্বোত্তম জিহাদ জালেম শাসকের সামনে সত্য-ন্যায়ের কথা বলা। (সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৭৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০১১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৪; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৭৪; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪৭৪)

প্রকাশ থাকে যে, কলমের ব্যবহারও বাকশক্তি ব্যবহারেরই পর্যায়ভুক্ত। যার সে যোগ্যতা আছে তার কর্তব্য লেখার মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা, তা পত্র পত্রিকায় লেখার দ্বারা হোক বা বই-পুস্তক ও রচনার মাধ্যমে। যে সকল রিপোর্টার বা সাংবাদিক ইখলাস ও সততার সাথে এ কাজ করবে, তারা অবশ্যই শরী'আতের দৃষ্টিতে 'আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার'-এর দায়িত্ব পালনকারীরূপে বিবেচিত হবে এবং এজন্য তারা বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হবে।

অপরাধ দমনের তৃতীয় স্তর : অন্তরে ঘৃণা পোষণ

অন্যায় প্রতিরোধের তৃতীয় স্তর হচ্ছে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করা। অর্থাৎ যখন শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকে আবার মুখের কথায়ও কাজ না হয় কিংবা মুখে বলার মত অবস্থাও না থাকে, তখন মনে মনে সে কাজকে ঘৃণা করবে এবং ওই ব্যক্তির প্রতি ভেবে আক্ষেপ করবে যে, আহা, সে এরূপ পাপকর্ম করে নিজের দুনিয়া আখিরাত বরবাদ করছে! সেইসঙ্গে এ নিয়তও রাখবে যে, কখনও তার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা হলে কিংবা মুখে কিছু বলার সুযোগ হলে সে অবশ্যই সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই যে শেষোক্ত উপায় অর্থাৎ মনে মনে ঘৃণা করা, এটা সর্বাবস্থায়ই জরুরি। কেননা এর জন্য কোনও সামর্থ্যের ব্যাপার নেই। প্রথমোক্ত দুই ব্যবস্থা যেহেতু সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাই যার সে সামর্থ্য আছে কেবল সেই তা অবলম্বন করবে। কিন্তু মনে মনে ঘৃণা করার ব্যাপারটা সকলের পক্ষেই সম্ভব। তাই এটা সকলের জন্যই জরুরি।

প্রশ্ন হতে পারে, অন্তরের ঘৃণা দ্বারা অপরাধ দমন হয় কিভাবে? উত্তর এই যে, প্রথমত এর দ্বারা নিজের হেফাজত হয়। অন্যায়-অপরাধকে ঘৃণা না করাও এক কঠিন অপরাধ। কাজেই ঘৃণা করার দ্বারা নিজের ক্ষেত্রে এ অপরাধকে দমন করা হয়। দ্বিতীয়ত কোনও অপরাধের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকলে সেই অপরাধকারীর সঙ্গে মেলামেশা ওইরকম স্বাভাবিক থাকবে না, যেমনটা অন্তরঙ্গ লোকের সঙ্গে হয়ে থাকে। একরকম পাশকাটানো আচরণ তার সঙ্গে হবেই। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ লোক কিংবা বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি সেই অপরাধকারীকে পাশ কাটিয়ে চলে, তবে তার কিছু না কিছু প্রভাব তার অন্তরে পড়তে বাধ্য। একপর্যায়ে তার অন্তরে অনুশোচনা জাগবে এবং সে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হবে। এভাবে ঘৃণা পোষণ দ্বারাও নীরবে অপরাধ দমন হতে পারে।

কেউ কেউ এ তিন স্তরকে এভাবে ভাগ করেছেন যে, শক্তিপ্রয়োগ দ্বারা অপরাধ দমন করা সরকারের দায়িত্ব। মুখের কথা দ্বারা প্রতিরোধ করা উলামার দায়িত্ব। আর অন্তর দ্বারা প্রতিহত করার দায়িত্ব আহলে দিল মাশায়েখের। অর্থাৎ তারা অপরাধকারীর ব্যাপারে আল্লাহর দিকে রুজ্জু করবে এবং তার সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে রোনাজারি করবে। সেইসঙ্গে তার দিকে তাওয়াজ্জুহ দেবে ও আত্মিক শক্তি প্রয়োগ করবে। আত্মিক শক্তি প্রয়োগ দ্বারা অপরাধ দমন অভিনব কিছু নয়। ইসলামের ইতিহাসে আওলিয়া ও মাশায়েখের এমন বহু ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে কোনওরূপ বাহুবল বা বাকশক্তি প্রয়োগ ছাড়াই কেবলমাত্র রূহানী শক্তি ব্যবহারের ফলে গুরুতর অপরাধীর জীবনও আমূল বদলে গেছে।

তবে উলামা-মাশায়েখের কেউ কেউ অপরাধ প্রতিরোধের এ তিন উপায়কে তিন শ্রেণীর লোকের মধ্যে ভাগ করলেও প্রকৃতপক্ষে অবস্থাভেদে সকলেই এ তিন প্রকারের আওতাভুক্ত। মনে মনে ঘৃণার ব্যাপারটা তো সর্বদা সকলের জন্যই প্রযোজ্য। আর শক্তিপ্রয়োগ আমভাবে সকলের পক্ষে সর্বক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও শরী'আতের সীমার ভেতর কোনও কোনও ক্ষেত্রে সকলের পক্ষেই সম্ভব, যেমন পিতামাতার পক্ষে তার সন্তানদের, শিক্ষকের পক্ষে তার ছাত্রদের এবং অভিভাবকের পক্ষে তার অধীনস্তদের শাসন করা। এর বাইরেও যথাযথ শর্তসাপেক্ষে অনেক ক্ষেত্রে আমজনগণেরও শক্তি প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। আর মুখের কথা দ্বারা অন্যায়-অপরাধে বাধা দেওয়াটা শক্তিপ্রয়োগ অপেক্ষা অনেক সহজ। কোন্ কোন্‌টা অন্যায় কাজ, তার অধিকাংশই আমলোকেও বোঝে। তাই উলামা ছাড়াও অনেকের পক্ষে অন্যায়-অপরাধের প্রতিরোধে মুখের ব্যবহার সম্ভব।

ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর

সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা ঈমানের দুর্বলতম স্তর। এক বর্ণনায় আছেঃ-

وليس وراء ذلك من الإيمان حبة خردل

এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৩৮০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭১৫৪)
এর দ্বারা বোঝা যায় অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা না থাকা অন্তর থেকে ঈমান চলে যাওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাস'উদ রাযি. বলেনঃ-

هلك من لم يعرف بقلبه المعروف والمنكر

ওই ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যে তার অন্তরে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য অনুভব করে না।
কেননা এটা এমন এক ফরয, যা কোনও অবস্থায়ই কারও থেকে রহিত হয় না। বরং অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা নিকৃষ্টতম অপরাধ। এতে কার্যত অপরাধ না করেও নিজেকে অপরাধী বানানো হয়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে—

إذا عملت الخطيئة في الأرض كانت من شهدها فكرهها كمن غاب عنها، ومن غاب عنها فرضيها كان كمن شهدها

পৃথিবীতে যখন কোনও পাপকার্য করা হয় তখন যে ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকে এবং তা ঘৃণা করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে সেখানে উপস্থিত থাকে না। পক্ষান্তরে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তবে সে ওই ব্যক্তির মত গণ্য হবে, যে সেখানে উপস্থিত থাকে। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৪৫, ৪৩৪৬)

প্রশ্ন হতে পারে, যে ব্যক্তির বাহুবল বা বাকশক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা নেই তার সে অক্ষমতা তো একটা ওযর, এ অবস্থায় সে যদি মনে মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তবে তা ঈমানের দুর্বলতম স্তর হবে কেন?
উত্তর এই যে, এটাকে দুর্বল বলা হয়েছে অন্য স্তরদুটি হিসেবে। তার মানে এ হাদীসে ঈমান দ্বারা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা -সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ-কে বোঝানো হয়েছে। এ শাখার তিনটি স্তর। তার মধ্যে 'অন্তরে ঘৃণা পোষণ' হচ্ছে সর্বাপেক্ষা দুর্বল স্তর। কেননা এর জন্য যেমন বাহ্যিক কোনও শক্তির প্রয়োজন হয় না, তেমনি বিশেষ মানসিক শক্তি ও হিম্মতেরও দরকার হয় না। বোঝানো হচ্ছে যে, অন্য দু'টির তুলনায় এ কাজটি সহজ। কিংবা বলা যায় যে, প্রথম দু'টিতে শেষেরটিও যুক্ত থাকে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বাহুবল বা বাকশক্তি ব্যবহার করে তার অন্তরে অপরাধ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাও থাকে। পক্ষান্তরে প্রথম দু'টি ব্যবস্থা যে অবলম্বন করে না তার অন্তরে কেবল ঘৃণাটুকুই থাকে, এর বেশি কিছু নয়। মোটকথা, এটিকে ঈমানের দুর্বলতম স্তর বলা হয়েছে কাজ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে নয়।

আবার এরকমও বলা যায় যে, একে দুর্বল বলা হয়েছে ফলাফলের দৃষ্টিতে। কেননা বাহুবল ও বাকশক্তি ব্যবহার দ্বারা যেমন সুফল পাওয়া যায়, অতটা সুফল মনের ঘৃণা পোষণ দ্বারা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সুফল উৎপাদনের দিক থেকে এটি একটি দুর্বল ব্যবস্থা। এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, ওযরের কারণে যে ব্যক্তি প্রথম দুই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে না পারায় শেষোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে অর্থাৎ মনে মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, সে দুর্বল ঈমানদার।
হাঁ, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, ওযর না থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি প্রথম দুই ব্যবস্থা অবলম্বন করে না, কেবল শেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করেই ক্ষান্ত থাকে, সে একজন দুর্বল ঈমানদারই বটে।

হাদীছটির গুরুত্ব

উলামায়ে কিরাম বলেন, এটি এমন এক হাদীছ যাকে ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ সাব্যস্ত করা যেতে পারে। কেননা শরী'আতের বিধান সর্বমোট ছয় প্রকার ফরয (ও ওয়াজিব), সুন্নত, মুবাহ, অনুত্তম, মাকরূহ ও হারাম। এর মধ্যে দুই প্রকার বিধানের কথা এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল। প্রথম জানা গেল যে, যাবতীয় ফরয (-ওয়াজিব) সম্পর্কে আদেশ করা অবশ্যকর্তব্য। দ্বিতীয়ত জানা গেল যাবতীয় হারাম কাজে নিষেধ করা একান্ত কর্তব্য। এভাবে ছয় প্রকারের দুই প্রকার এ হাদীছের মধ্যে এসে গেল ।

কেউ কেউ বলেন, এ হাদীছের মধ্যে দীনের অর্ধেক এসে গেছে। কেননা শরী'আত নির্দেশিত কার্যাবলী দু'রকম। ক. অর্জনীয় কাজ ও খ. বর্জনীয় কাজ। অর্জনীয় কাজ তথা সৎকর্ম সম্পর্কে আদেশ করা জরুরি আর বর্জনীয় কাজ সম্পর্কে জরুরি তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করা। এ দ্বিতীয়টিই হাদীছের বিষয়বস্তু। সে হিসেবে দীনের অর্ধেক বিষয় এ হাদীছে পাওয়া গেল।

এক দৃষ্টিতে বলা যায় গোটা শরী'আতই এ হাদীছের বিষয়বস্তু। কেননা অর্জনীয় কাজ না করাটা অপরাধ। যেমন নামায একটি অর্জনীয় আমল। এ আমল না করা পাপ ও অন্যায় । সুতরাং কেউ যদি নামায না পড়ে, তখন অন্যের কর্তব্য হবে তাকে এ পাপ ও অন্যায় থেকে ফেরানো অর্থাৎ তাকে নামাযের আদেশ করা ও নামাযী বানানোর চেষ্টা করা। ব্যস এভাবে অর্জনীয় বিষয়গুলোও হাদীছটির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা একটি ঈমানী দায়িত্ব। প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য আপন আমলে যত্নবান থাকার পাশাপাশি সাধ্যমত এ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।

খ. কোনও কাজের প্রতিবাদ করার আগে ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই বাস্তবেই সে কাজটি নাজায়েয ও অপরাধ কি না।

গ. তারপর জেনে নেওয়া জরুরি যার সম্পর্কে অভিযোগ সে বাস্তবিকই অপরাধটি করেছে কি না।

ঘ. যে কাজটি বাস্তবিকই অপরাধ, তার প্রতিবাদকারী যেহেতু ঈমানী দায়িত্ব পালন করছে তাই তার সমালোচনা ও বিরোধিতা না করে অন্যদের কর্তব্য তার সমর্থন করা।

ঙ. মানুষের বাহুবল ও বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার দেওয়া অনেক বড় নি'আমত। এর অপচয় না করে ঈমানী দায়িত্ব পালনে ব্যবহার করা চাই।

চ. অন্যায়-অপরাধের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করাও ঈমানের দাবি। যার অন্তরে সে ঘৃণা নেই তার উচিত নিজ ঈমানের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হওয়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)