রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬২
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ।
আসমানী ‘ইলম ও হিদায়াতের দৃষ্টান্ত
হাদীছ নং: ১৬২

হযরত আবূ মূসা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা আমাকে যে হিদায়াত ও 'ইলমসহ পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ বৃষ্টির মত, যা কোনও ভূমিতে পতিত হয়। সে ভূমির একটা অংশ উৎকৃষ্ট। তা পানি ধারণ করে নেয়। অতঃপর তা তৃণ ও প্রচুর ঘাস উৎপন্ন করে। তার আরেক অংশ শক্ত জমি, যা পানি ধরে রাখে। তারপর আল্লাহ তা'আলা তা দ্বারা মানুষের উপকার করেন। তারা সেখান থেকে পানি পান করে ও (গবাদি পশুকে) পান করায় এবং চাষাবাদ করে। সে বৃষ্টি ভূমির এমন এক অংশেও পড়ে, যা কিনা এমন ঊষর, যা পানি ধরেও রাখে না এবং তৃণও উৎপন্ন করে না। এ হচ্ছে ওই লোকের উদাহরণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছে এবং আল্লাহ আমাকে যা-সহ পাঠিয়েছেন তা দ্বারা তাকে উপকৃত করেছেন- সে নিজে তা শিখেছে এবং অন্যকেও শিখিয়েছে। আর ওই ব্যক্তির উদাহরণ, যে তার প্রতি মাথা তুলে তাকায়নি এবং আল্লাহর সে হিদায়াত গ্রহণ করেনি, যা-সহ আমি প্রেরিত হয়েছি। -বুখারী ও মুসলিম। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২২৮২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৫৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪: শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৩৫)
16 - باب في الأمر بالمحافظة على السنة وآدابها
162 - السابع: عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ مَثَلَ مَا بَعَثَنِي الله بِهِ مِنَ الهُدَى والعِلْم كَمَثَلِ غَيثٍ أَصَابَ أرْضًا فَكَانَتْ مِنْهَا طَائِفةٌ طَيِّبَةٌ، قَبِلَتِ المَاءَ فَأَنْبَتَتِ الكَلأَ [ص:74] والعُشْبَ الكَثِيرَ، وَكَانَ مِنْهَا أَجَادِبُ (1) أمسَكَتِ المَاء فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَربُوا مِنْهَا وَسَقُوا وَزَرَعُوا، وَأَصَابَ طَائفةً مِنْهَا أخْرَى إنَّمَا هِيَ قيعَانٌ لا تُمْسِكُ مَاءً وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقُهَ في دِينِ اللهِ وَنَفَعَهُ بمَا بَعَثَنِي الله بِهِ فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأسًا وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللهِ الَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
«فَقُهَ» بضم القافِ عَلَى المشهور وقيل بكسرِها: أي صار فقيهًا.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আনীত 'ইলম ও হিদায়াতকে বৃষ্টির সাথে এবং যাদের সামনে তা পেশ করেছেন, অবস্থাভেদে তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার ভূমির সাথে তুলনা করেছেন।

বৃষ্টি বোঝানোর জন্য আরবী ভাষায় বিভিন্ন শব্দ আছে। তার মধ্যে المطر ও الغيث শব্দ দু'টি বেশি প্রসিদ্ধ। তবে المطر শব্দটি সাধারণভাবে যে-কোনও বৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর الغيث ব্যবহৃত হয় ওই বৃষ্টির অর্থে, যা খরাকবলিত এলাকায় বহু প্রতীক্ষার পর বর্ষিত হয়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আনীত 'ইলম ও হিদায়াতকেالمطر -এর সাথে তুলনা না করে যে الغيث -এর সাথে তুলনা করেছেন, এর মধ্যে বিশেষ তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। কেননা খরাকবলিত ভূমিতে গাছপালা ও তৃণলতা শুকিয়ে যায়, জীবজন্তু মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হয় এবং চারদিকে বৃষ্টির জন্য হাহাকার ওঠে। সর্বত্র একই প্রতীক্ষা- কখন বৃষ্টি হবে? কখন জীবনের ছোঁয়া লাগবে এবং সেই ছোঁয়ায় মৃত ভূমিতে প্রাণ সঞ্চার হবে? অতঃপর যখন প্রতীক্ষার অবসান হয়ে বৃষ্টি বর্ষিত হয়, তখন সে মৃত ভূমি সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। তাতে গাছপালা, তরুলতা জন্মায় ও মুমূর্ষু জীবজন্তু প্রাণ ফিরে পায়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের আগে মানুষের আত্মিক ভুবনেরও একই অবস্থা ছিল। দীর্ঘকাল ওহীর বৃষ্টিপাত না থাকায় মানবাত্মা ঊষর হয়ে পড়েছিল। তা থেকে না ঘটছিল মানবিক গুণাবলীর স্ফুরণ, আর না হচ্ছিল মানবীয় প্রতিভার বিকাশ। মানুষের মুমূর্ষু আত্মা প্রতীক্ষা করছিল কখন ওহীর বৃষ্টি বর্ষণ হবে আর দীনী ‘ইলমের জীবনস্পর্শে মৃত আত্মা সঞ্জীবিত হবে। অবশেষে সে প্রতীক্ষার অবসান হল। নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর ধারাবর্ষণে মানুষের আত্মিক ভুবনে প্রাণ সঞ্চার হল। এই হচ্ছে বৃষ্টির সাথে আসমানী 'ইলম ও হিদায়াতের সামঞ্জস্য। বৃষ্টি যেভাবে মৃত ভূমিতে প্রাণ সঞ্চার করে, আসমানী 'ইলম ও হিদায়াতও তেমনি মৃত আত্মাকে সঞ্জীবিত করে তোলে। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আনীত 'ইলম ও হিদায়াতকে খরাকবলিত এলাকার বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছেন।

অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদের সামনে আসমানী ইলম ও হিদায়াত পেশ করেছিলেন, সেই মানবগোষ্ঠীকে বিভিন্নপ্রকার ভূমির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি এখানে ভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন।

ক. ওই উৎকৃষ্ট ও উর্বর ভূমি, যা বৃষ্টি দ্বারা সিঞ্চিত হয়ে নিজে উপকৃত হয় এবং তৃণলতা ও ফল-ফসল জন্মিয়ে অন্যকে উপকৃত করে।

খ. ওই শক্ত ভূমি, যাতে পানি জমে থাকে। ফলে ওই জমি নিজে উপকৃত না হতে পারলেও তাতে জমে থাকা পানি দ্বারা লোকে উপকৃত হতে পারে।

গ. ওই উষর ভূমি, যা পানি ধরে রাখতে পারে না। ফলে বৃষ্টি দ্বারা সে নিজেও উপকৃত হতে পারে না এবং অন্যকেও উপকৃত করতে পারে না এ তিন প্রকার ভূমির সঙ্গে তিন শ্রেণীর মানুষকে তুলনা করা হয়েছেঃ-

ক. ওই আলেম, যে তার অর্জিত ইলম দ্বারা নিজে উপকৃত হয় অর্থাৎ সে অনুযায়ী আমল করে এবং অন্যকেও সে ইলমের শিক্ষা দান করে। ফলে অন্যরাও তার দ্বারা উপকৃত হয়। এ শ্রেণীর লোককে তুলনা করা হয়েছে প্রথম শ্রেণীর ভূমির সাথে।

খ. ওই 'ইলমের সন্ধানী, যে 'ইলম আহরণে ব্যতিব্যস্ত থাকে এবং যথেষ্ট পরিমাণে তা অর্জনও করে, কিন্তু নিজে তা দ্বারা উপকৃত হয় না অর্থাৎ সে অনুযায়ী আমল করে না। তবে সে তার অর্জিত 'ইলম অন্যকে শেখায়। ফলে তারা তা দ্বারা উপকৃত হয়। এ শ্রেণীর লোককে দ্বিতীয় প্রকার ভূমির সাথে তুলনা করা হয়েছে।

গ. তৃতীয় হচ্ছে ওই শ্রেণীর লোক, যারা আসমানী 'ইলম ও হিদায়াতের বাণী শোনে, কিন্তু তারা তা সংরক্ষণ করে না, সে অনুযায়ী আমল করে না এবং অন্যদের কাছে তা পৌছায়ও না। এভাবে নিজেরাও তার উপকার থেকে বঞ্চিত থাকে এবং অন্যরাও তাদের দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। এ শ্রেণীর লোকের উদাহরণ হচ্ছে তৃতীয় প্রকারের ভূমি।

প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে উপমা হিসেবে তিন প্রকার ভূমির কথা উল্লেখ করা হলেও উপমিত হিসেবে কেবল দু' শ্রেণীর লোকেরই উল্লেখ করা হয়েছে- প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণী। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক অর্থাৎ যারা অর্জিত 'ইলম অনুযায়ী নিজেরা আমল করে না কিন্তু অন্যদেরকে তা শেখায়, তাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি এজন্য যে, প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীর উল্লেখ দ্বারা দ্বিতীয় শ্রেণীর বিষয়টা এমনিই বুঝে আসে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতকে আসমানী ‘ইলম ও হিদায়াত অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য গভীর আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে তা অর্জনে সচেষ্ট থাকা।

খ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যারা অর্জিত ইলম অনুযায়ী আমল করে এবং অন্যকে তা শেখায়, মানুষের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ।

গ. এ হাদীছ দ্বারা 'ইলম প্রচারের ফযীলত জানা যায়। সুতরাং আমাদের উচিত আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী 'ইলমের প্রচারে ভূমিকা রাখা।

ঘ. আসমানী ‘ইলম ও হিদায়াতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা অনেক বড় মাহরূমী। এ শ্রেণীর লোক ঊষর ও লোনা ভূমির মত, যার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত, যাতে এ শ্রেণীর লোকের অন্তর্ভুক্ত না হই।

ঙ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষাদানের একটা পদ্ধতি জানা যায় যে, শিক্ষার বিষয়বস্তু যদি গুরুত্বপূর্ণ ও সারগর্ভ হয় তবে তা দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ দ্বারা বোঝানো শ্রেয়, যেমনটা এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করার পক্ষে এ পদ্ধতি সহায়ক হয়ে থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)