রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৪২
ভূমিকা অধ্যায়
‘ইবাদতে মধ্যপন্থা প্রসঙ্গ
ইসলামে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব
ইসলামে মধ্যপন্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইসলামের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সবকিছুতেই তার এ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছে। কি 'আকীদা-বিশ্বাস, কি ‘ইবাদত বন্দেগী, কি আখলাক-চরিত্র, কোনও ক্ষেত্রেই ইসলাম মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করেনি।। কোনও বিষয়ে না আছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং না আছে এমন শৈথিল্য, যা বিষয়টির গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে।
‘ইবাদতের কথাই ধরা যাক। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নামায। শরী'আত নামায ফরয করেছে পাঁচ ওয়াক্ত। এর বেশি হলে মানুষের উপর চাপ পড়ে যেত। আবার যদি কম হত তবে এর কাঙ্ক্ষিত সুফল লাভ হত না। এর রাক'আত সংখ্যাও রাখা হয়েছে পরিমাণমত। যে ওয়াক্তের জন্য যা সমীচীন ঠিক তাই। এর ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নত-মুস্তাহাব প্রতিটি বিষয়কে আপন আপন জায়গায় রাখা হয়েছে। যদি এর বিপরীত হত, অর্থাৎ যে বিধান যে সংখ্যায় ও যে পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে তার পরিবর্তে যদি অন্যরকম দেওয়া হত, তবে ভারসাম্য নষ্ট হত। ফলে এখন যত সহজে নামায পড়া সম্ভব হয়, তখন তা সম্ভব হত না এবং এখন যে সুফল এর মধ্যে নিহিত আছে, তখন তা থাকত না। তত্ত্ববিদ 'আলেমগণ তা ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তাই ইসলামের যথার্থ অনুসারীর কর্তব্য নামায, রোযা প্রভৃতি 'ইবাদত-বন্দেগী শরী'আত যেভাবে দিয়েছে ঠিক সেভাবেই পালন করা। এতে কোনও রকম বাড়াবাড়িও না করা এবং শিথিলতাও না দেখানো। শিথিলতা করার তো অবকাশই নেই। কেননা সে ক্ষেত্রে বিধান সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়। বাড়াবাড়ি করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে ও অবসাদ দেখা দেয়। ফলে আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয় না। কেননা মানুষের জৈবিক চাহিদা আছে। সে চাহিদা পূরণ না করলে শরীর ভেঙে পড়ে। ঠিকমত খাবার দেওয়া না হলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় মাত্রায় না ঘুমালে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। শরীর দিয়ে অসহনীয় পর্যায়ে কাজ নিলে আগেভাগেই শক্তিসামর্থ্য লোপ পায়। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা না করলে নানা রকম রোগব্যাধি দেখা দেয়। তো যে ব্যক্তি অতিরিক্ত আমল করবে তার হয় ঘুম নষ্ট হবে, নয়তো শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে, পানাহার, বিশ্রাম ইত্যাদির নিয়মশৃঙ্খলা নষ্ট হবে, আর এভাবে একপর্যায়ে চরম স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়ে 'ইবাদত-বন্দেগী করতেই অক্ষম হয়ে পড়বে।
বস্তুত ইসলাম এক স্বভাবধর্ম। সে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাসমূহ বৈধ সীমার ভেতর পূরণ করতে বলেছে, যাতে শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যের হুকুম দিয়েছে, যাতে মাত্রা অপেক্ষা এত কম না হয়, যা স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আবার এত বেশিও না হয়, যা পশুপ্রবৃত্তি উস্কে দেয়। ইসলাম এ ক্ষেত্রে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়াকেও অনুমোদন করেনি, আবার সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়পরবশ ও স্বেচ্ছাচারী হওয়াকেও জায়েয রাখেনি। ঠিক মাঝখানে থাকতে বলেছে। অর্থাৎ পরিমিত মাত্রায় ও বিধিসম্মতভাবে চাহিদা পূরণের হুকুম দিয়েছে। এর দ্বারা একদিকে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে, অপরদিকে 'ইবাদত-বন্দেগীর ধারাবাহিকতা রক্ষাও সম্ভব হয়। কাজেই ইবাদতের স্বার্থেই স্বাস্থ্যরক্ষা জরুরি এবং এটা শরীরের হক। এদিকে ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ- إن لنفسك عليك حقا “নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার নিজ সত্তারও হক আছে। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬১৩৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১৩; সুনানে আবু দাউদ,হাদীছ নং ১৩৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৯
এ হক আদায় দ্বারা 'ইবাদত-বন্দেগীর ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয়, তাই এটা আর কেবল দুনিয়াবী কাজ থাকে না; বরং ছাওয়াবের পরিণত হয়ে যায়। তাই তো হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি. বলেনঃ- أحتسب نومتي كما أحتسب قومتي “আমি আমার ঘুম দ্বারাও ছাওয়াবের আশা করি, যেমন ছাওয়াবের আশা করি নামায দ্বারা।” সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৩৪৪
অপরপক্ষে স্বভাবগত চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ না করলে যেহেতু শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এ কারণে ইবাদতের ধারাবাহিকতা রক্ষাও সম্ভব হয় না, সেহেতু এটা একরকম অপরাধ; হক আদায় না করার অপরাধ। জনৈক বেদুঈন ইসলাম গ্রহণের পর এক বছর যাবৎ দিনের বেলা খানা খায়নি। এ কারণে তার এমন স্বাস্থ্যহানি ঘটেছিল যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে চিনতে পারছিলেন না। শেষে বেদুঈন যখন নিজ পরিচয় দিলেন এবং একটানা রোযা রাখার কথা জানালেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেনঃ- من أمرك أن تعذب نفسك؟ “এভাবে নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে তোমাকে কে আদেশ করেছে?” মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৩২৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৭৪১; আত-তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯০১
প্রকৃতপক্ষে মধ্যপন্থাই শ্রেয়। বিখ্যাত তাবি'ঈ মুতাররিফ ইব্ন 'আব্দুল্লাহ তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে। অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্য অবস্থায়ই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে। উয়ুনুল আখবার, ১ম খ., ৩৭৬ পৃ.।
মধ্যপন্থার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আছে বহু আয়াত ও হাদীছ। ইমাম নববী রহ এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে আমরা তার অর্থ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
“ইবাদতে মধ্যপন্থা সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
طه (1) مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى (2)
অর্থ : (১) তোয়া-হা। (২) আমি তোমার প্রতি কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যে,তুমি কষ্ট ভোগ করবে। সূরা তোয়া-হা, আয়াত ১-২
ব্যাখ্যা
এটি সূরা তোয়া-হা'র প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত। এর শানে নুযূল সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, নবুওয়াত লাভের পর প্রথমদিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দীর্ঘ নামায পড়তেন। কখনও কখনও তিনি এক পা উঁচু করে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। এতে তাঁর পা ফুলে-ফেটে যেত এবং তাঁর অনেক কষ্ট হত। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয় এবং এতে জানানো হয় যে, তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কুরআন নাযিল করা হয়নি। কাজেই নামাযে এত লম্বা সময় দাঁড়িয়ে এত বেশি পরিমাণ কুরআন পড়ার দরকার নেই, যদ্দরুন তার পা ফুলে ফেটে যায় এবং অতিরিক্ত কষ্ট হয়। তার মানে নামায পড়া ও কুরআন তিলাওয়াতে ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত। এভাবে এ আয়াত দ্বারা ‘ইবাদত-বন্দেগীতে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
দুই নং আয়াত
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
অর্থ : আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না। সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে রোযা সম্পর্কে। এতে মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তিকে রমযানের রোযা না রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে। তারা পরে সময়-সুযোগমত তার কাযা করে নেবে। যেহেতু তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে, তাই সকল কষ্টক্লেশ উপেক্ষা করে যদি রোযা রাখে এবং তা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয় কিংবা এ কারণে কোনও দীনী স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তবে তাদের জন্য সে রোযা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়। এরূপ ক্ষেত্রে শরী'আতপ্রদত্ত অবকাশ গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয়। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের প্রতি কঠোরতা করতে চান না। অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ
অর্থ : তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।সূরা হজ্জ, আয়াত ৭৮
মোটকথা, দীনের প্রতিটি বিধানই সহজসাধ্য। কাজেই শরী'আত প্রতিটি বিধান যেমন সহজরূপে প্রদান করেছে, সে অবস্থায় রেখে আমল করাই উত্তম। কোনও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ে সহজ আমলকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
إِنَّكُمْ أُمَّةٌ أُرِيدَ بِكُمُ الْيُسْرُ
তোমরা এমন এক উম্মত যে, তোমাদের জন্য (দীনের সব ব্যাপারে) সহজতা ও অনায়াসসাধ্যতা চাওয়া হয়েছে।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৩৪৭
ইসলামে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব
ইসলামে মধ্যপন্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইসলামের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সবকিছুতেই তার এ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছে। কি 'আকীদা-বিশ্বাস, কি ‘ইবাদত বন্দেগী, কি আখলাক-চরিত্র, কোনও ক্ষেত্রেই ইসলাম মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করেনি।। কোনও বিষয়ে না আছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং না আছে এমন শৈথিল্য, যা বিষয়টির গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে।
‘ইবাদতের কথাই ধরা যাক। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নামায। শরী'আত নামায ফরয করেছে পাঁচ ওয়াক্ত। এর বেশি হলে মানুষের উপর চাপ পড়ে যেত। আবার যদি কম হত তবে এর কাঙ্ক্ষিত সুফল লাভ হত না। এর রাক'আত সংখ্যাও রাখা হয়েছে পরিমাণমত। যে ওয়াক্তের জন্য যা সমীচীন ঠিক তাই। এর ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নত-মুস্তাহাব প্রতিটি বিষয়কে আপন আপন জায়গায় রাখা হয়েছে। যদি এর বিপরীত হত, অর্থাৎ যে বিধান যে সংখ্যায় ও যে পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে তার পরিবর্তে যদি অন্যরকম দেওয়া হত, তবে ভারসাম্য নষ্ট হত। ফলে এখন যত সহজে নামায পড়া সম্ভব হয়, তখন তা সম্ভব হত না এবং এখন যে সুফল এর মধ্যে নিহিত আছে, তখন তা থাকত না। তত্ত্ববিদ 'আলেমগণ তা ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তাই ইসলামের যথার্থ অনুসারীর কর্তব্য নামায, রোযা প্রভৃতি 'ইবাদত-বন্দেগী শরী'আত যেভাবে দিয়েছে ঠিক সেভাবেই পালন করা। এতে কোনও রকম বাড়াবাড়িও না করা এবং শিথিলতাও না দেখানো। শিথিলতা করার তো অবকাশই নেই। কেননা সে ক্ষেত্রে বিধান সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়। বাড়াবাড়ি করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে ও অবসাদ দেখা দেয়। ফলে আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয় না। কেননা মানুষের জৈবিক চাহিদা আছে। সে চাহিদা পূরণ না করলে শরীর ভেঙে পড়ে। ঠিকমত খাবার দেওয়া না হলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় মাত্রায় না ঘুমালে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়। শরীর দিয়ে অসহনীয় পর্যায়ে কাজ নিলে আগেভাগেই শক্তিসামর্থ্য লোপ পায়। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা না করলে নানা রকম রোগব্যাধি দেখা দেয়। তো যে ব্যক্তি অতিরিক্ত আমল করবে তার হয় ঘুম নষ্ট হবে, নয়তো শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে, পানাহার, বিশ্রাম ইত্যাদির নিয়মশৃঙ্খলা নষ্ট হবে, আর এভাবে একপর্যায়ে চরম স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়ে 'ইবাদত-বন্দেগী করতেই অক্ষম হয়ে পড়বে।
বস্তুত ইসলাম এক স্বভাবধর্ম। সে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাসমূহ বৈধ সীমার ভেতর পূরণ করতে বলেছে, যাতে শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যের হুকুম দিয়েছে, যাতে মাত্রা অপেক্ষা এত কম না হয়, যা স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আবার এত বেশিও না হয়, যা পশুপ্রবৃত্তি উস্কে দেয়। ইসলাম এ ক্ষেত্রে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়াকেও অনুমোদন করেনি, আবার সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়পরবশ ও স্বেচ্ছাচারী হওয়াকেও জায়েয রাখেনি। ঠিক মাঝখানে থাকতে বলেছে। অর্থাৎ পরিমিত মাত্রায় ও বিধিসম্মতভাবে চাহিদা পূরণের হুকুম দিয়েছে। এর দ্বারা একদিকে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে, অপরদিকে 'ইবাদত-বন্দেগীর ধারাবাহিকতা রক্ষাও সম্ভব হয়। কাজেই ইবাদতের স্বার্থেই স্বাস্থ্যরক্ষা জরুরি এবং এটা শরীরের হক। এদিকে ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ- إن لنفسك عليك حقا “নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার নিজ সত্তারও হক আছে। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬১৩৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১৩; সুনানে আবু দাউদ,হাদীছ নং ১৩৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৯
এ হক আদায় দ্বারা 'ইবাদত-বন্দেগীর ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয়, তাই এটা আর কেবল দুনিয়াবী কাজ থাকে না; বরং ছাওয়াবের পরিণত হয়ে যায়। তাই তো হযরত মু'আয ইব্ন জাবাল রাযি. বলেনঃ- أحتسب نومتي كما أحتسب قومتي “আমি আমার ঘুম দ্বারাও ছাওয়াবের আশা করি, যেমন ছাওয়াবের আশা করি নামায দ্বারা।” সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৩৪৪
অপরপক্ষে স্বভাবগত চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ না করলে যেহেতু শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এ কারণে ইবাদতের ধারাবাহিকতা রক্ষাও সম্ভব হয় না, সেহেতু এটা একরকম অপরাধ; হক আদায় না করার অপরাধ। জনৈক বেদুঈন ইসলাম গ্রহণের পর এক বছর যাবৎ দিনের বেলা খানা খায়নি। এ কারণে তার এমন স্বাস্থ্যহানি ঘটেছিল যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে চিনতে পারছিলেন না। শেষে বেদুঈন যখন নিজ পরিচয় দিলেন এবং একটানা রোযা রাখার কথা জানালেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেনঃ- من أمرك أن تعذب نفسك؟ “এভাবে নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে তোমাকে কে আদেশ করেছে?” মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৩২৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৭৪১; আত-তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯০১
প্রকৃতপক্ষে মধ্যপন্থাই শ্রেয়। বিখ্যাত তাবি'ঈ মুতাররিফ ইব্ন 'আব্দুল্লাহ তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে। অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্য অবস্থায়ই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে। উয়ুনুল আখবার, ১ম খ., ৩৭৬ পৃ.।
মধ্যপন্থার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আছে বহু আয়াত ও হাদীছ। ইমাম নববী রহ এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে আমরা তার অর্থ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
“ইবাদতে মধ্যপন্থা সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
طه (1) مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى (2)
অর্থ : (১) তোয়া-হা। (২) আমি তোমার প্রতি কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যে,তুমি কষ্ট ভোগ করবে। সূরা তোয়া-হা, আয়াত ১-২
ব্যাখ্যা
এটি সূরা তোয়া-হা'র প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত। এর শানে নুযূল সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, নবুওয়াত লাভের পর প্রথমদিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দীর্ঘ নামায পড়তেন। কখনও কখনও তিনি এক পা উঁচু করে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। এতে তাঁর পা ফুলে-ফেটে যেত এবং তাঁর অনেক কষ্ট হত। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয় এবং এতে জানানো হয় যে, তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কুরআন নাযিল করা হয়নি। কাজেই নামাযে এত লম্বা সময় দাঁড়িয়ে এত বেশি পরিমাণ কুরআন পড়ার দরকার নেই, যদ্দরুন তার পা ফুলে ফেটে যায় এবং অতিরিক্ত কষ্ট হয়। তার মানে নামায পড়া ও কুরআন তিলাওয়াতে ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত। এভাবে এ আয়াত দ্বারা ‘ইবাদত-বন্দেগীতে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
দুই নং আয়াত
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
অর্থ : আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না। সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে রোযা সম্পর্কে। এতে মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তিকে রমযানের রোযা না রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে। তারা পরে সময়-সুযোগমত তার কাযা করে নেবে। যেহেতু তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে, তাই সকল কষ্টক্লেশ উপেক্ষা করে যদি রোযা রাখে এবং তা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয় কিংবা এ কারণে কোনও দীনী স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তবে তাদের জন্য সে রোযা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়। এরূপ ক্ষেত্রে শরী'আতপ্রদত্ত অবকাশ গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয়। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের প্রতি কঠোরতা করতে চান না। অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ
অর্থ : তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।সূরা হজ্জ, আয়াত ৭৮
মোটকথা, দীনের প্রতিটি বিধানই সহজসাধ্য। কাজেই শরী'আত প্রতিটি বিধান যেমন সহজরূপে প্রদান করেছে, সে অবস্থায় রেখে আমল করাই উত্তম। কোনও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ে সহজ আমলকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
إِنَّكُمْ أُمَّةٌ أُرِيدَ بِكُمُ الْيُسْرُ
তোমরা এমন এক উম্মত যে, তোমাদের জন্য (দীনের সব ব্যাপারে) সহজতা ও অনায়াসসাধ্যতা চাওয়া হয়েছে।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৩৪৭
আল্লাহর কাছে স্থায়ী আমলই বেশি পসন্দনীয়
হাদীছ নং: ১৪২
হযরত ‘আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে আসলেন। তখন তার নিকট এক স্ত্রীলোক উপস্থিত ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ কে? হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, সে অমুক। তার নামাযের কথা (লোকমুখে) চর্চা হয়। তিনি বললেন, থাম। তোমাদের কর্তব্য অতটুকুই করা, যতটুকু করার ক্ষমতা রাখ। আল্লাহর কসম! আল্লাহ ক্লান্ত হন না (অর্থাৎ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না), যাবত না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আর তাঁর কাছে ওই আমলই বেশি পসন্দ, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। -বুখারী ও মুসলিম-. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮৫
مه এটা একটা নিষেধাজ্ঞা ও বিরক্তিসূচক শব্দ। এর অর্থ রাখ, থাম।
لا يمل الله –এর আক্ষরিক অর্থ আল্লাহ ক্লান্ত হন না। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি তোমাদের আমলের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করেন না। অর্থাৎ ক্লান্তশ্রান্ত ব্যক্তি যেমনটা করে, অনুরূপ কাজ তিনি করেন না।
حتى تملوا –যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও। অর্থাৎ তোমরা ক্লান্ত হয়ে আমল ছেড়ে দাও । তোমরা আমল ছেড়ে দিলেই তিনি ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন। কাজেই তোমাদের কর্তব্য অতটুকু আমলই গ্রহণ করা, যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যেতে পারবে, যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাওয়াব দান অব্যাহত থাকে এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ জারি থাকে।
হাদীছ নং: ১৪২
হযরত ‘আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে আসলেন। তখন তার নিকট এক স্ত্রীলোক উপস্থিত ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ কে? হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, সে অমুক। তার নামাযের কথা (লোকমুখে) চর্চা হয়। তিনি বললেন, থাম। তোমাদের কর্তব্য অতটুকুই করা, যতটুকু করার ক্ষমতা রাখ। আল্লাহর কসম! আল্লাহ ক্লান্ত হন না (অর্থাৎ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না), যাবত না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আর তাঁর কাছে ওই আমলই বেশি পসন্দ, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। -বুখারী ও মুসলিম-. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮৫
مه এটা একটা নিষেধাজ্ঞা ও বিরক্তিসূচক শব্দ। এর অর্থ রাখ, থাম।
لا يمل الله –এর আক্ষরিক অর্থ আল্লাহ ক্লান্ত হন না। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি তোমাদের আমলের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করেন না। অর্থাৎ ক্লান্তশ্রান্ত ব্যক্তি যেমনটা করে, অনুরূপ কাজ তিনি করেন না।
حتى تملوا –যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও। অর্থাৎ তোমরা ক্লান্ত হয়ে আমল ছেড়ে দাও । তোমরা আমল ছেড়ে দিলেই তিনি ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন। কাজেই তোমাদের কর্তব্য অতটুকু আমলই গ্রহণ করা, যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যেতে পারবে, যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাওয়াব দান অব্যাহত থাকে এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ জারি থাকে।
مقدمة الامام النووي
14 - باب في الاقتصاد في العبادة
قَالَ الله تَعَالَى: {طه مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى} [طه: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ} [البقرة: 185].
قَالَ الله تَعَالَى: {طه مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى} [طه: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ} [البقرة: 185].
142 - وعن عائشة رضي الله عنها: أنَّ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - دخل عَلَيْهَا وعِندها امرأةٌ، قَالَ: «مَنْ هذِهِ؟» قَالَتْ: هذِهِ فُلاَنَةٌ تَذْكُرُ مِنْ صَلاتِهَا. قَالَ: «مَهْ، عَلَيْكُمْ بِمَا تُطِيقُونَ، فَواللهِ لاَ يَمَلُّ اللهُ حَتَّى تَمَلُّوا» وكَانَ أَحَبُّ الدِّينِ إِلَيْهِ مَا دَاوَمَ صَاحِبُهُ عَلَيهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وَ «مهْ»: كَلِمَةُ نَهْي وَزَجْر. ومَعْنَى «لاَ يَمَلُّ اللهُ»: لاَ يَقْطَعُ ثَوَابَهُ عَنْكُمْ وَجَزَاء أَعْمَالِكُمْ ويُعَامِلُكُمْ مُعَامَلةَ المَالِّ حَتَّى تَمَلُّوا فَتَتْرُكُوا، فَيَنْبَغِي لَكُمْ أَنْ تَأخُذُوا مَا تُطِيقُونَ الدَّوَامَ عَلَيهِ لَيدُومَ ثَوابُهُ لَكُمْ وَفَضْلُهُ عَلَيْكُمْ.
وَ «مهْ»: كَلِمَةُ نَهْي وَزَجْر. ومَعْنَى «لاَ يَمَلُّ اللهُ»: لاَ يَقْطَعُ ثَوَابَهُ عَنْكُمْ وَجَزَاء أَعْمَالِكُمْ ويُعَامِلُكُمْ مُعَامَلةَ المَالِّ حَتَّى تَمَلُّوا فَتَتْرُكُوا، فَيَنْبَغِي لَكُمْ أَنْ تَأخُذُوا مَا تُطِيقُونَ الدَّوَامَ عَلَيهِ لَيدُومَ ثَوابُهُ لَكُمْ وَفَضْلُهُ عَلَيْكُمْ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে যে ইবাদতগুযার মহিলার কথা বলা হয়েছে তার নাম হাওলা বিনত তুয়াইত। তিনি কুরায়শ বংশের বনূ আসাদের লোক ছিলেন। খুব বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রাতে একটুও ঘুমাতেন না, যে কারণে মানুষের মুখে মুখে তার ইবাদতের চর্চা ছিল। লোকে বলত, মদীনার নারীদের মধ্যে সবচে' 'ইবাদত-বন্দেগী তিনিই করে থাকেন।
হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলার পরিচয় দিলেন এবং তার ইবাদত-বন্দেগীর প্রশংসা করলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি প্রকাশ করে তাঁকে থেমে যেতে বললেন।
তাঁর বিরক্তির কারণ- শরীরের বিশ্রাম ত্যাগ করে এত বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা পসন্দনীয় নয়। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে এবং শরীর ভেঙে পড়ে। তখন আর ‘ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এতদিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের পক্ষ থেকে যে আবদিয়াত ও দাসত্ব নিবেদন করা হচ্ছিল এবং তাঁর প্রতি রুজ ও বন্দেগী-আনুগত্যের সিলসিলা জারি ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এটা একরকম বিমুখতা। এটা যেন আল্লাহর দরবারে কিছুদিন হাজির হওয়ার পর গরহাজির হয়ে যাওয়া, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই তিরস্কার করে বলেছেন, থাম! অর্থাৎ সে যা করছে তা প্রশংসার বিষয় নয় যে, এত আগ্রহের সাথে বলছ।
অথবা এ তিরস্কার করেছেন ওই মহিলাকে। তাকে বলছেন, থাম। “ইবাদত বন্দেগীতে এত বাড়াবাড়ি করো না; বরং মধ্যপন্থা রক্ষা কর। যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব অতটুকুই কর।
তারপর বলা হয়েছে- আল্লাহ ক্লান্ত হন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে ‘ক্লান্ত হয়ে যাওয়া' কথাটির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে ক্লান্ত হওয়া অসম্ভব। এটা একটা মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। বস্তুত এখানে ক্লান্ত হওয়ার দ্বারা রূপকার্থে ‘কাজের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করা' বোঝানো উদ্দেশ্য, যেমনটা ইমাম নববী রহ. ব্যাখ্যা করেছেন। এর সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছ দ্বারা। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
اكلفوا من العمل ما تطيقون، فإن الله لا يمل من الثواب حتى تملوا من العمل
“তোমরা অতটুকু আমলেরই ভার গ্রহণ কর, যতটুকু তোমরা করতে পারবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবত না তোমরা আমল বন্ধ করে দাও।” তাফসীর ইবন কাছীর, ৮ম খ., ২৫৪ পৃ.
ইমাম মা'যিরী (مأزري) রহ. বলেন, এখানে حتى অব্যয়টি و অর্থে ব্যবহৃত। সে হিসেবে অর্থ হবে- আল্লাহ ক্লান্ত হবেন না, অথচ তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।
সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হিসেবে বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তাই, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। কেননা যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আমল করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে বাদশার দরবারে নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করে। যে ব্যক্তি কখনও হাজির হয় আবার কখনও গরহাজির থাকে, সে বাদশার অতটা প্রিয় হতে পারে না, যতটা নিয়মিত হাজিরাদাতা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে ব্যক্তি নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী চালিয়ে যায়, সে যেন মাওলার দরবারের একজন নিয়মিত হাজিরাদাতা। স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর বেশি প্রিয়ভাজন হবে। তাছাড়া কোনও ইবাদত কিছুদিন করার পর ছেড়ে দেওয়াটা গরহাজির হয়ে পড়ার মত। এতে কেমন যেন বিমুখতা ও অনীহা ভাব প্রকাশ পায়, যা একরকম বেআদবীও বটে। অনুপস্থিতির সে বেআদবী যাতে না হয়ে যায় এবং ছাওয়াব পাওয়ার সিলসিলা যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য উচিত যতটুকু পরিমাণ আমল নিয়মিত করা যাবে অতটুকুই গ্রহণ করা, তা অল্পই হোক না কেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
أحب الأعمال إلى الله أدومها وإن قل
“আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তা-ই, যা স্থায়ী হয়, যদিও সে আমল অল্প পরিমাণ হয়। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৩৬৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৫৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৪০. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৮
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও কোনও কাজে প্রশংসা করার আগে সে কাজটি কতটুকু সঠিক তা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।
খ. কোনও জ্ঞানীজনের সামনে কেউ কোনও অনুচিত কথা বললে বা অনুচিত কাজ করলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
গ. আল্লাহর কাছে যেহেতু স্থায়ী আমলই বেশি পসন্দনীয়, তাই নফল ইবাদত এতটুকু পরিমাণেই শুরু করা উচিত, যা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলার পরিচয় দিলেন এবং তার ইবাদত-বন্দেগীর প্রশংসা করলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্তি প্রকাশ করে তাঁকে থেমে যেতে বললেন।
তাঁর বিরক্তির কারণ- শরীরের বিশ্রাম ত্যাগ করে এত বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা পসন্দনীয় নয়। কেননা তাতে একপর্যায়ে ক্লান্তি আসে এবং শরীর ভেঙে পড়ে। তখন আর ‘ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এতদিন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজের পক্ষ থেকে যে আবদিয়াত ও দাসত্ব নিবেদন করা হচ্ছিল এবং তাঁর প্রতি রুজ ও বন্দেগী-আনুগত্যের সিলসিলা জারি ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এটা একরকম বিমুখতা। এটা যেন আল্লাহর দরবারে কিছুদিন হাজির হওয়ার পর গরহাজির হয়ে যাওয়া, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই তিরস্কার করে বলেছেন, থাম! অর্থাৎ সে যা করছে তা প্রশংসার বিষয় নয় যে, এত আগ্রহের সাথে বলছ।
অথবা এ তিরস্কার করেছেন ওই মহিলাকে। তাকে বলছেন, থাম। “ইবাদত বন্দেগীতে এত বাড়াবাড়ি করো না; বরং মধ্যপন্থা রক্ষা কর। যতটুকু নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব অতটুকুই কর।
তারপর বলা হয়েছে- আল্লাহ ক্লান্ত হন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়। আল্লাহ তা'আলার ক্ষেত্রে ‘ক্লান্ত হয়ে যাওয়া' কথাটির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থে হতে পারে না। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে ক্লান্ত হওয়া অসম্ভব। এটা একটা মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। বস্তুত এখানে ক্লান্ত হওয়ার দ্বারা রূপকার্থে ‘কাজের ছাওয়াব ও প্রতিদান দেওয়া বন্ধ করা' বোঝানো উদ্দেশ্য, যেমনটা ইমাম নববী রহ. ব্যাখ্যা করেছেন। এর সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছ দ্বারা। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
اكلفوا من العمل ما تطيقون، فإن الله لا يمل من الثواب حتى تملوا من العمل
“তোমরা অতটুকু আমলেরই ভার গ্রহণ কর, যতটুকু তোমরা করতে পারবে। কেননা আল্লাহ তা'আলা ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবত না তোমরা আমল বন্ধ করে দাও।” তাফসীর ইবন কাছীর, ৮ম খ., ২৫৪ পৃ.
ইমাম মা'যিরী (مأزري) রহ. বলেন, এখানে حتى অব্যয়টি و অর্থে ব্যবহৃত। সে হিসেবে অর্থ হবে- আল্লাহ ক্লান্ত হবেন না, অথচ তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।
সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম 'ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হিসেবে বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তাই, যা আমলকারী নিয়মিতভাবে করে। কেননা যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আমল করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে বাদশার দরবারে নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করে। যে ব্যক্তি কখনও হাজির হয় আবার কখনও গরহাজির থাকে, সে বাদশার অতটা প্রিয় হতে পারে না, যতটা নিয়মিত হাজিরাদাতা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে ব্যক্তি নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী চালিয়ে যায়, সে যেন মাওলার দরবারের একজন নিয়মিত হাজিরাদাতা। স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর বেশি প্রিয়ভাজন হবে। তাছাড়া কোনও ইবাদত কিছুদিন করার পর ছেড়ে দেওয়াটা গরহাজির হয়ে পড়ার মত। এতে কেমন যেন বিমুখতা ও অনীহা ভাব প্রকাশ পায়, যা একরকম বেআদবীও বটে। অনুপস্থিতির সে বেআদবী যাতে না হয়ে যায় এবং ছাওয়াব পাওয়ার সিলসিলা যাতে বন্ধ না হয়, সেজন্য উচিত যতটুকু পরিমাণ আমল নিয়মিত করা যাবে অতটুকুই গ্রহণ করা, তা অল্পই হোক না কেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
أحب الأعمال إلى الله أدومها وإن قل
“আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল তা-ই, যা স্থায়ী হয়, যদিও সে আমল অল্প পরিমাণ হয়। " সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৮২। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৩৬৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৫৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৪০. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৮
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কারও কোনও কাজে প্রশংসা করার আগে সে কাজটি কতটুকু সঠিক তা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত।
খ. কোনও জ্ঞানীজনের সামনে কেউ কোনও অনুচিত কথা বললে বা অনুচিত কাজ করলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
গ. আল্লাহর কাছে যেহেতু স্থায়ী আমলই বেশি পসন্দনীয়, তাই নফল ইবাদত এতটুকু পরিমাণেই শুরু করা উচিত, যা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)