রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১১৪
ভূমিকা অধ্যায়
জীবনের শেষদিকে বেশী বেশী নেক কাজ করার প্রতি উৎসাহদান।
মৃত্যুর আগে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করা
হাদীছ নং: ১১৪

উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নামাযই পড়তেন তাতে অবশ্যই বলতেন-
سُبْحَانَكَ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي
“হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি এবং আপনার প্রশংসা করছি। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন।” -বুখারী ও মুসলিম। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৯৬৭, ৪৯৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১৯, ৪৮৪
বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রুকু ও সিজদায় বেশি বেশি বলতেন-
سُبْحَانَكَ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ ، اللهُمَّ اغْفِرْ لِي
এর দ্বারা তিনি কুরআনের নির্দেশ অনুসরণ করতেন।
বর্ণনাটির শেষ শব্দ يتأول القرآن -এর অর্থ কুরআনের আয়াত فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ -এর ভেতর তাঁকে যে আদেশ করা হয়েছে তা পালন করতেন। এতে আদেশ করা হয়েছে- তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাসবীহ পাঠ কর এবং তাঁর কাছে ইস্তিগফার কর। মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগে বেশি বেশি পড়তেন-
سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ
“হে আল্লাহ! আমি আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি এবং আপনার প্রশংসা করছি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাওবা করছি।”
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কথাগুলো কী, যা আপনাকে ইদানীং পড়তে দেখছি? তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে আমাকে একটি আলামাত দেওয়া হয়েছে, যা দেখলে আমাকে এগুলো পড়তে বলা হয়েছে। আলামতটি হল إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ - এই সূরাটি শেষ পর্যন্ত।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি পড়তেন-
سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ
“আল্লাহ পবিত্র। সমস্ত প্রশংসা তাঁর। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর নিকট তাওবা করছি।”
হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে দেখছি- سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ -এ কথাটি বেশি বেশি বলছেন। তিনি বললেন, আমার প্রতিপালক আমাকে অবগত করেছেন আমি শীঘ্রই আমার উম্মতের মধ্যে একটি আলামত দেখব। যখন সেটি দেখি তখন যেন বেশি বেশি বলি- سُبْحَانَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ আমি আলামতটি দেখে ফেলেছি। তা হচ্ছে إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ সূরাটি। এতে বিজয় বলতে মক্কাবিজয় বোঝানো হয়েছে।
مقدمة الامام النووي
12 - باب الحث عَلَى الازدياد من الخير في أواخر العمر
114 - الثالث: عن عائشة رضي الله عنها، قَالَتْ: مَا صلّى رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - صلاةً بَعْدَ أَنْ نَزَلتْ عَلَيهِ: {إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ} إلاَّ يقول فِيهَا: «سُبحَانَكَ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وفي رواية في الصحيحين عنها: كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يُكْثِرُ أَنْ يقُولَ في ركُوعِه وسُجُودهِ: «سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمدِكَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي»،
يَتَأوَّلُ القُرآنَ. معنى: «يَتَأَوَّلُ القُرآنَ» أي يعمل مَا أُمِرَ بِهِ في القرآن في قوله تَعَالَى: {فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ}.
وفي رواية لمسلم: كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يُكثِرُ أَنْ يَقُولَ قَبلَ أَنْ يَمُوتَ:
«سُبحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَ‍مدِكَ أسْتَغْفِرُكَ وَأتُوبُ إلَيْكَ». قَالَتْ عائشة: قُلْتُ: يَا رَسُول الله، مَا هذِهِ الكَلِماتُ الَّتي أرَاكَ أحْدَثْتَها تَقُولُهَا؟ قَالَ: «جُعِلَتْ لي عَلامَةٌ في أُمَّتِي إِذَا رَأيْتُها قُلتُها {إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ} ... إِلَى آخِرِ السورة».
وفي رواية لَهُ: كَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - يُكثِرُ مِنْ قَولِ: «سبْحَانَ اللهِ وَبِحَمدِهِ أسْتَغفِرُ اللهَ وأتُوبُ إِلَيْهِ». قَالَتْ: قُلْتُ: يَا رسولَ اللهِ، أَراكَ تُكثِرُ مِنْ قَولِ سُبحَانَ اللهِ وَبِحَمدهِ أسْتَغْفِرُ اللهَ وأتُوبُ إِلَيْه؟ فَقَالَ: «أخبَرَني رَبِّي أنِّي سَأرَى عَلامَةً في أُمَّتي فإذا رَأيْتُها أكْثَرْتُ مِنْ قَولِ: سُبْحَانَ اللهِ وبِحَمدهِ أسْتَغْفرُ اللهَ وَأَتُوبُ إِلَيْه فَقَدْ رَأَيْتُهَا: {إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ} فتح مكّة، {وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللهِ أَفْوَاجًا، فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا}».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

سبحانك এর অর্থ- হে আল্লাহ আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আপনি সকল দোষত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
وبحمدك এর অর্থ- এবং আমি আপনার প্রশংসা আদায়ে রত হচ্ছি। আপনি যে কেবল দোষত্রুটি থেকে মুক্ত তাই নয়, সেইসঙ্গে যতরকম ভালো ভালো গুণ আছে তাও সব আপনার মধ্যে পরিপূর্ণরূপে আছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য তা ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে। সারকথা তিনি সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে মা'সূম ছিলেন। সমস্ত নবী-রাসূলই মা'সূম। তা সত্ত্বেও বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতেন এ কারণে যে, মাসূম ও নিষ্পাপ হওয়াটা তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট রহমত। এর শোকর আদায়ের জন্য তিনি বেশি বেশি 'ইবাদত-বন্দেগী করতেন। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার যথাযথ শোকর আদায় কার পক্ষে সম্ভব? তিনি যে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের যথাযথ শোকর আদায় করতে পারছেন না, এ অনুভূতি ছিল তাঁর মধ্যে অতি প্রবল। এ না পারাকে তিনি নিজ ত্রুটিরূপে গণ্য করতেন। আর সে কারণেই এত বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। আল্লাহ তা'আলার সামনে তাঁর 'আবদিয়াত ও দাসত্বের অনুভূতি ছিল অতি প্রবল। এবং তা এতই উচ্চপর্যায়ের, যেখানে পৌছা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সেই অবস্থান থেকে নিজ বন্দেগীর কর্তব্য এবং আল্লাহর রাবূবিয়াতের হকের বিপরীতে নিজ ‘ইবাদত-বন্দেগীকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমরা তোমার যথার্থ ‘ইবাদত করতে পারলাম না। তিনি এ কমতিকে নিজের এক অপরাধরূপে গণ্য করতেন বলেই বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতেন। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনও অপরাধ ছিল না, এটা ছিল তাঁর উচ্চপর্যায়ের তাওয়াযু ও বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ।
এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার হাম্দ ও তাসবীহ এবং তাঁর কাছে তাওবা ও ইস্তিগফার করার বিভিন্ন বাক্য বর্ণিত হয়েছে। এ বিভিন্নতা এ কারণে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সবগুলোই পড়তেন। একেকবার একেকটি পড়তেন। আমরাও এর যে-কোনওটি পড়তে পারি।
এ হাদীছে বলা হয়েছে, তিনি রুকূ'-সিজদায় যে তাসবীহ বেশি বেশি পড়তেন তা হচ্ছেঃ- سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ،اَللّٰهُمَّ اغْفِرْلِيْ বা এরই কাছাকাছি কোনও বাক্য, যেমনটা এ হাদীছের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। তাহলে আমরা কেন রুকূ'তে পড়ি سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ আর সিজদায় পড়ি سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى ?
এর উত্তর হচ্ছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের অধিকাংশ সময় রুকূ'তে سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ আর সিজদায় سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى –ই পড়েছেন। তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় যা পড়েছেন, ফকীহগণ সেটাকেই সুন্নতরূপে গ্রহণ করেছেন। তবে কেউ যদি এ হাদীছে বর্ণিত দু'আ পড়ে, তাতেও নামাযের কোনও ক্ষতি হবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছেরও শিক্ষা হচ্ছে বার্ধক্য এসে গেলে অথবা তার আগেই মৃত্যুর কোনও আলামত বোঝা গেলে যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হয়ে আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ১১৪ | মুসলিম বাংলা