রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১১২
ভূমিকা অধ্যায়
জীবনের শেষদিকে বেশি বেশি নেক কাজ করার প্রতি উৎসাহদান
বৃদ্ধলোকের বাদবাকি সময়ের গুরুত্ব
কারও যখন বার্ধক্য এসে যায়, তখন যেন তার মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে যায়। মৃত্যু এখন সমরের ব্যাপার মাত্র। যে-কোনও সময়ই ঘটে যেতে পারে। যুবকদের তো একটা আশা থাকে- হয়তো আরও কিছুকাল বাঁচব এবং মৃত্যু আসতে আসতে হয়তো বৃদ্ধকালে পৌঁছে যাব। কিন্তু যে ব্যক্তি বৃদ্ধকালে পৌঁছে গেছে তার আর কিসের ভরসা? বৃদ্ধকালটাই তার জন্য সতর্কসংকেত যে, মৃত্যু কিন্তু খুব কাছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওহী মারফত সতর্ক করা হয়েছিল যে, মৃত্যুর আর দেরি নেই। তাঁকে একটা আলামত বলে দেওয়া হয়েছিল। সে আলামত যখন দেখা যাবে, বুঝে নিতে হবে মৃত্যু কাছে এসে গেছে। আলামতটি হল মক্কাবিজয় ও দলে দলে মানুষের ইসলামগ্রহণ। এ আলামত দেখতে পাওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব বেশি পরিমাণে তাসবীহ পাঠ ও ইস্তিগফারে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
আমাদের কাছে তো আর ওহী আসার কোনও অবকাশ নেই। আমাদের মৃত্যু কাছে এসে যাওয়ার সতর্কসংকেত হচ্ছে বার্ধক্য। বার্ধক্য যার এসে গেল, সে যেন পাকা ফসল। ফসল পেকে গেলে যেমন কৃষক যে-কোনও সময় তা কেটে নিতে পারে, তেমনি মানুষ বৃদ্ধ হয়ে গেলেও যে-কোনও মুহূর্তে মালাকুল মাওত জান কবজ করে ফেলতে পারে। সুতরাং এখন কর্তব্য যতবেশি সম্ভব তাওবা-ইস্তিগফারে লিপ্ত হয়ে পড়া।
ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার বয়স কত? সে বলেছিল, ষাট বছর। তিনি বললেন, তুমি ষাট বছর যাবৎ তোমার প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ছুটে চলছ। অতি শীঘ্রই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবে। লোকটি বলে উঠল, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি জানে সে আল্লাহর বান্দা এবং সে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে তার এটাও জানা উচিত যে, তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং আল্লাহ যা প্রশ্ন করবেন তার উত্তর দিতে হবে। অতএব তার কর্তব্য সে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করা। লোকটি জিজ্ঞেস করল, এর উপায় কী? তিনি বললেন, খুব সহজ। বলল, তা কী? তিনি বললেন, বাকি যতটুকু সময় পাওয়া যায় নেক আমলে লেগে থাক। তাহলে তোমার অতীতে যা ঘটে গেছে তা মাফ করে দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে এখনও যদি মন্দ আমলে লেগে থাক, তবে অতীতের সাথে অবশিষ্ট দিনগুলোর গুনাহের জন্য ধরা পড়ে যাবে।
হাঁ, বন্ধুগণ! আমাদের যাদের বার্ধক্য এসে গেছে তাদের এখন কেবল একই চিন্তা হওয়া উচিত- কবরে যাওয়ার চিন্তা। বিগত দিনগুলো তো চরম অবহেলার মধ্যেই কেটেছে, বাকি সামান্য কটা দিনও যদি অবহেলায়ই কাটে, তবে সে ক্ষতির তো কোনও সীমা নেই। জীবনের দিনগুলো ব্যবসায়ের মূলধনের মত। মূলধন তো প্রায় শেষ হতে চলল। এতদিন সে মূলধন খাটিয়ে কেবল লোকসানই কুঁড়ানো হয়েছে। শেষ দিনগুলোও কি লোকসানেই যাবে? এখনও যে সময়টুকু আছে, চেষ্টা করলে বিগত লোকসানের প্রতিকার করা সম্ভব। জীবনের অবসান যে আমলের উপর হয় তা-ই ধর্তব্য হয়। এখনও যদি নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া যায় এবং খাঁটিমনে তাওবা-ইস্তিগফার করে নেওয়া যায়, তবে শেষ মূলধনটুকু কাজে লেগে যাবে। পরকালের জন্য তা অফুরন্ত মুনাফা বয়ে আনবে। সুতরাং আর গড়িমসি নয়, এসো বন্ধু! আমরা এখনই তাওবা-ইস্তিগফারে রত হয়ে যাই এবং আর যতটুকু সময় পাওয়া যায় তা নেক আমলের মধ্যে কাটাই। হে আল্লাহ! আমরা অতি বড় গুনাহগার। আমাদের ক্ষমা করে দিন, আমাদের তাওবা কবূল করে নিন এবং জীবনের বাকি সময়টুকু নেক আমলে কাটানোর তাওফীক দিন- আমীন।
কুরআন ও হাদীছে মানুষকে বৃদ্ধকালে বেশি বেশি নেক আমলে রত হওয়ার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ-
أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ
অর্থ : আমি কি তোমাদেরকে এমন দীর্ঘ আয়ু দেইনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারত? এবং তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল।সূরা ফাতির, আয়াত ৩৭
আয়াতের ব্যাখ্যা
ইমাম নববী রহ. এ আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আমরা প্রথমে সে ব্যাখ্যার বঙ্গানুবাদ করব, তারপর এ আয়াতের তাফসীরে মুফাস্সিরগণ যে আলোচনা করেছেন তার ভিত্তিতে আয়াতখানি থেকে এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে যতটুকু সম্ভব আলো গ্রহণের চেষ্টা করব।
ইমাম নববী রহ.-এর ব্যাখ্যা
قال ابن عباس والمحققون: معناه أو لم نعمركم ستين سنة؟ ويؤيده الحديث الذي سنذكره إن شاء الله تعالى، وقيل: معناه ثماني عشرة سنة، وقيل أربعين سنة قاله الحسن والكلبي ومسروق، ونقل عن ابن عباس أيضا. ونقلوا أن أهل المدينة كانوا إذا بلغ أحدهم أربعين سنة تفرغ للعبادة، وقيل: هو البلوغ. وقوله تعالى: «وجاءكم النذير» قال ابن عباس والجمهور هو التي ، وقيل الشيب، قاله عكرمة وابن عيينة وغيرهما. والله أعلم
“হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন 'আব্বাস রাযি. ও মুহাক্কিক 'আলেমগণের মতে এর দ্বারা ৬০ বছর বয়স বোঝানো হয়েছে। সামনে যে হাদীছ উল্লেখ করা হবে তা এর সমর্থন করে। কারও মতে, ১৮ বছর বয়স। আবার কেউ ৪০ বছর বয়সের কথাও বলেছেন। হাসান বসরী রহ., কালবী রহ. ও মাসরূক রহ.-এর মত এটাই। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন ‘আব্বাস রাযি. থেকেও এরূপ বর্ণিত আছে।
মদীনাবাসীদের সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হতেন তখন সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে 'ইবাদত-বন্দেগীতে লেগে যেতেন। কারও মতে, এ আয়াতে যে বয়সের কথা বলা হয়েছে তা দ্বারা বালেগ হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য।”
এ আয়াতে যে সতর্ককারী আসার কথা বলা হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ‘আব্বাস রাযি. ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘উলামায়ে কিরামের মতে সে সতর্ককারী হলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কারও মতে এ সতর্ককারী হল বার্ধক্য। ইকরিমা রহ., সুফয়ান ইব্ন 'উয়াইনা রহ. প্রমুখ-ও এরূপ বলেছেন।
আয়াতখানি থেকে আলোগ্রহণ
এ আয়াতের বক্তব্যটি মূলত জাহান্নামবাসীদের কথার উত্তর। এ আয়াতের শুরুতে আছেঃ-
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ
অর্থ : জাহান্নামের ভেতর তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রব্বু! আমাদেরকে এর থেকে বের করুন। আমরা সৎকাজ করব। আগে যা করতাম তা করব না।সূরা ফাতির, আয়াত ৩৭
এভাবে তারা তাদের অসৎকাজের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা প্রকাশ করবে এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি চাইবে। আয়াতের শেষাংশে তাদের সে ফরিয়াদেরই জবাব দেওয়া হয়েছে। জবাবের সারকথা হল, এখন আর তোমাদের কোনও ওজর-আপত্তি শোনা হবে না। কেননা তোমরা যাতে অসৎকাজ ছেড়ে সৎকাজে লিপ্ত হও, সেজন্য আমি তোমাদেরকে সর্বপ্রকারে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। তোমাদের কাছে সতর্ককারী পাঠিয়েছি, তোমাদেরকে বুদ্ধিবিবেক দিয়েছি এবং এমন একটা আয়ু দিয়েছি, যখন তোমরা সতর্ককারীর কথা শুনে এবং বুদ্ধিবিবেক কাজে লাগিয়ে সৎকাজ করতে পারতে। তখন তোমরা দুনিয়ার জীবনে ছিলে। সে জীবনই ছিল সৎকাজের সময়। আর আখিরাত হল কর্মফল ভোগের সময়। যখন সৎকাজের সুযোগ ছিল তখন তা করোনি। সুতরাং এখন অনুতাপ ও অনুশোচনায় কোনও কাজ হবে না। এখন কর্মফল হিসেবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে থাক।
এ আয়াতে যে বয়সের কথা বলা হয়েছে, তা যে ৬০ বছরই হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। এর দ্বারা মূলত এমন একটা জীবন বোঝানো উদ্দেশ্য, যে জীবন লাভ করলে চিন্তাভাবনা করার ও উপদেশ গ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া যায়। তা ৬০ বছরের আগেও হতে পারে। মানুষ বালেগ হওয়ার পর থেকেই বিবেকবুদ্ধির উন্মেষ ঘটতে থাকে। যত বয়স বাড়ে ততই বুদ্ধিতে পরিপক্কতা আসে এবং অস্থিরতা ও চপলতা কমতে থাকে। যখন বয়স পূর্ণ চল্লিশে পৌছায়, তখন বুদ্ধিও পূর্ণতা পায় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভারিক্কি ও ভারসাম্য আসে। যে-কোনও বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা ও বুঝেশুনে কাজকর্ম করার পক্ষে এ বয়সটা খুবই সহায়ক। তাই তো দেখা যায় নবীগণ এ বয়সেই নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও তাঁর ৪০ বছর বয়সকালেই প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল। সুতরাং বলা যায় এ আয়াতের ইঙ্গিত ৪০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বয়সকালের প্রতিই। এ উম্মতের গড়পড়তা বয়স ৬০ বছর। যদি কেউ এর বেশি কাল বাঁচে, তবে সে আরও বেশি সুযোগ পেল। তার ক্ষেত্রে এ আয়াতের বক্তব্য আরও বেশি প্রযোজ্য হবে।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে 'ইবাদত-বন্দেগীর প্রতিও বেশি মনোযোগী হওয়া।
এ আয়াতে বর্ণিত সতর্ককারী কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। যেমন ইমাম নববী রহ. ইঙ্গিত করেছেন এবং অধিকাংশ ‘উলামার বরাতে বলেছেন, এ সতর্ককারী হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কেউ কেউ কুরআন মাজীদের কথাও বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উভয়ই সতর্ককারী। কুরআনও তার বাণীসমূহের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করে থাকে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মানুষকে আল্লাহর আযাব ও গযব সম্পর্কে সতর্ক করতেন। এর আগের উম্মতসমূহের জন্যও তাদের কাছে প্রেরিত নবীগণ এবং তাদের উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থসমূহ ছিল সতর্ককারী।
কারও কারও মতে মানুষের আকলবুদ্ধিও সতর্ককারী। যে ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্ন অবাধ্যতা ও পাপাচার দ্বারা নিজ বুদ্ধিবিবেক বিকৃত করে ফেলেনি, তার বুদ্ধিবিবেক এক উত্তম পরামর্শদাতা। যখনই কোনও মন্দ কাজের অবকাশ আসে, সুস্থ বিবেক তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে সে কাজে লিপ্ত হতে বারণ করে। এজন্যই বিবেকবান লোক সাধারণত অন্যায়-অনাচার কমই করে। কাজেই বলা যায় অপরাপর সতর্ককারীর মত বুদ্ধিবিবেকও মানুষের এক সতর্ককারী।
প্রকাশ থাকে যে, এসব মতের মধ্যে কোনও বৈপরিত্য নেই। এর কোনও একটিকে সতর্ককারী মানলে আরেকটিকে যে মানা যাবে না, ব্যাপারটা এরকম নয়। কেননা আলাদা আলাদাভাবে এর প্রত্যেকেই মানুষকে সতর্ক করে থাকে। বরং এটা আল্লাহ তা'আলার এক মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে সতর্ক করার নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি মানুষকে সতর্ক করেন নবী-রাসূলের দ্বারা, তাকে সতর্ক করেন আসমানী কিতাব দ্বারা, এর পাশাপাশি সতর্ক করেন বুদ্ধিবিবেক দ্বারা, কখনও সতর্ক করেন বিপদ-আপদ দ্বারা, কখনও করেন শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তন বিশেষত বার্ধক্য দ্বারা। এভাবে তিনি সতর্কীকরণের বহুবিধ ব্যবস্থা নিয়েছেন, যাতে একটিতে সতর্ক না হলে আরেকটিতে হয়ে যায়। আল্লাহ চান কোনও না কোনওভাবে বান্দা নিজেকে সংশোধন করে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করে ফেলুক এবং জান্নাতের অধিকারী হয়ে যাক। তা সত্ত্বেও যদি আমাদের হুঁশ না হয় এবং পাপাচারের ভেতরই জীবন ধ্বংস করি, তবে তা কত বড়ই না দুর্ভাগ্যের কথা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সুবুদ্ধি দিন এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।
বৃদ্ধলোকের বাদবাকি সময়ের গুরুত্ব
কারও যখন বার্ধক্য এসে যায়, তখন যেন তার মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে যায়। মৃত্যু এখন সমরের ব্যাপার মাত্র। যে-কোনও সময়ই ঘটে যেতে পারে। যুবকদের তো একটা আশা থাকে- হয়তো আরও কিছুকাল বাঁচব এবং মৃত্যু আসতে আসতে হয়তো বৃদ্ধকালে পৌঁছে যাব। কিন্তু যে ব্যক্তি বৃদ্ধকালে পৌঁছে গেছে তার আর কিসের ভরসা? বৃদ্ধকালটাই তার জন্য সতর্কসংকেত যে, মৃত্যু কিন্তু খুব কাছে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওহী মারফত সতর্ক করা হয়েছিল যে, মৃত্যুর আর দেরি নেই। তাঁকে একটা আলামত বলে দেওয়া হয়েছিল। সে আলামত যখন দেখা যাবে, বুঝে নিতে হবে মৃত্যু কাছে এসে গেছে। আলামতটি হল মক্কাবিজয় ও দলে দলে মানুষের ইসলামগ্রহণ। এ আলামত দেখতে পাওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব বেশি পরিমাণে তাসবীহ পাঠ ও ইস্তিগফারে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
আমাদের কাছে তো আর ওহী আসার কোনও অবকাশ নেই। আমাদের মৃত্যু কাছে এসে যাওয়ার সতর্কসংকেত হচ্ছে বার্ধক্য। বার্ধক্য যার এসে গেল, সে যেন পাকা ফসল। ফসল পেকে গেলে যেমন কৃষক যে-কোনও সময় তা কেটে নিতে পারে, তেমনি মানুষ বৃদ্ধ হয়ে গেলেও যে-কোনও মুহূর্তে মালাকুল মাওত জান কবজ করে ফেলতে পারে। সুতরাং এখন কর্তব্য যতবেশি সম্ভব তাওবা-ইস্তিগফারে লিপ্ত হয়ে পড়া।
ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার বয়স কত? সে বলেছিল, ষাট বছর। তিনি বললেন, তুমি ষাট বছর যাবৎ তোমার প্রতিপালকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ছুটে চলছ। অতি শীঘ্রই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবে। লোকটি বলে উঠল, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি জানে সে আল্লাহর বান্দা এবং সে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে তার এটাও জানা উচিত যে, তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং আল্লাহ যা প্রশ্ন করবেন তার উত্তর দিতে হবে। অতএব তার কর্তব্য সে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করা। লোকটি জিজ্ঞেস করল, এর উপায় কী? তিনি বললেন, খুব সহজ। বলল, তা কী? তিনি বললেন, বাকি যতটুকু সময় পাওয়া যায় নেক আমলে লেগে থাক। তাহলে তোমার অতীতে যা ঘটে গেছে তা মাফ করে দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে এখনও যদি মন্দ আমলে লেগে থাক, তবে অতীতের সাথে অবশিষ্ট দিনগুলোর গুনাহের জন্য ধরা পড়ে যাবে।
হাঁ, বন্ধুগণ! আমাদের যাদের বার্ধক্য এসে গেছে তাদের এখন কেবল একই চিন্তা হওয়া উচিত- কবরে যাওয়ার চিন্তা। বিগত দিনগুলো তো চরম অবহেলার মধ্যেই কেটেছে, বাকি সামান্য কটা দিনও যদি অবহেলায়ই কাটে, তবে সে ক্ষতির তো কোনও সীমা নেই। জীবনের দিনগুলো ব্যবসায়ের মূলধনের মত। মূলধন তো প্রায় শেষ হতে চলল। এতদিন সে মূলধন খাটিয়ে কেবল লোকসানই কুঁড়ানো হয়েছে। শেষ দিনগুলোও কি লোকসানেই যাবে? এখনও যে সময়টুকু আছে, চেষ্টা করলে বিগত লোকসানের প্রতিকার করা সম্ভব। জীবনের অবসান যে আমলের উপর হয় তা-ই ধর্তব্য হয়। এখনও যদি নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া যায় এবং খাঁটিমনে তাওবা-ইস্তিগফার করে নেওয়া যায়, তবে শেষ মূলধনটুকু কাজে লেগে যাবে। পরকালের জন্য তা অফুরন্ত মুনাফা বয়ে আনবে। সুতরাং আর গড়িমসি নয়, এসো বন্ধু! আমরা এখনই তাওবা-ইস্তিগফারে রত হয়ে যাই এবং আর যতটুকু সময় পাওয়া যায় তা নেক আমলের মধ্যে কাটাই। হে আল্লাহ! আমরা অতি বড় গুনাহগার। আমাদের ক্ষমা করে দিন, আমাদের তাওবা কবূল করে নিন এবং জীবনের বাকি সময়টুকু নেক আমলে কাটানোর তাওফীক দিন- আমীন।
কুরআন ও হাদীছে মানুষকে বৃদ্ধকালে বেশি বেশি নেক আমলে রত হওয়ার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ-
أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ
অর্থ : আমি কি তোমাদেরকে এমন দীর্ঘ আয়ু দেইনি যে, তখন কেউ সতর্ক হতে চাইলে সতর্ক হতে পারত? এবং তোমাদের কাছে সতর্ককারীও এসেছিল।সূরা ফাতির, আয়াত ৩৭
আয়াতের ব্যাখ্যা
ইমাম নববী রহ. এ আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আমরা প্রথমে সে ব্যাখ্যার বঙ্গানুবাদ করব, তারপর এ আয়াতের তাফসীরে মুফাস্সিরগণ যে আলোচনা করেছেন তার ভিত্তিতে আয়াতখানি থেকে এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে যতটুকু সম্ভব আলো গ্রহণের চেষ্টা করব।
ইমাম নববী রহ.-এর ব্যাখ্যা
قال ابن عباس والمحققون: معناه أو لم نعمركم ستين سنة؟ ويؤيده الحديث الذي سنذكره إن شاء الله تعالى، وقيل: معناه ثماني عشرة سنة، وقيل أربعين سنة قاله الحسن والكلبي ومسروق، ونقل عن ابن عباس أيضا. ونقلوا أن أهل المدينة كانوا إذا بلغ أحدهم أربعين سنة تفرغ للعبادة، وقيل: هو البلوغ. وقوله تعالى: «وجاءكم النذير» قال ابن عباس والجمهور هو التي ، وقيل الشيب، قاله عكرمة وابن عيينة وغيرهما. والله أعلم
“হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন 'আব্বাস রাযি. ও মুহাক্কিক 'আলেমগণের মতে এর দ্বারা ৬০ বছর বয়স বোঝানো হয়েছে। সামনে যে হাদীছ উল্লেখ করা হবে তা এর সমর্থন করে। কারও মতে, ১৮ বছর বয়স। আবার কেউ ৪০ বছর বয়সের কথাও বলেছেন। হাসান বসরী রহ., কালবী রহ. ও মাসরূক রহ.-এর মত এটাই। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন ‘আব্বাস রাযি. থেকেও এরূপ বর্ণিত আছে।
মদীনাবাসীদের সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হতেন তখন সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে 'ইবাদত-বন্দেগীতে লেগে যেতেন। কারও মতে, এ আয়াতে যে বয়সের কথা বলা হয়েছে তা দ্বারা বালেগ হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য।”
এ আয়াতে যে সতর্ককারী আসার কথা বলা হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ‘আব্বাস রাযি. ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘উলামায়ে কিরামের মতে সে সতর্ককারী হলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কারও মতে এ সতর্ককারী হল বার্ধক্য। ইকরিমা রহ., সুফয়ান ইব্ন 'উয়াইনা রহ. প্রমুখ-ও এরূপ বলেছেন।
আয়াতখানি থেকে আলোগ্রহণ
এ আয়াতের বক্তব্যটি মূলত জাহান্নামবাসীদের কথার উত্তর। এ আয়াতের শুরুতে আছেঃ-
وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ
অর্থ : জাহান্নামের ভেতর তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের রব্বু! আমাদেরকে এর থেকে বের করুন। আমরা সৎকাজ করব। আগে যা করতাম তা করব না।সূরা ফাতির, আয়াত ৩৭
এভাবে তারা তাদের অসৎকাজের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা প্রকাশ করবে এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি চাইবে। আয়াতের শেষাংশে তাদের সে ফরিয়াদেরই জবাব দেওয়া হয়েছে। জবাবের সারকথা হল, এখন আর তোমাদের কোনও ওজর-আপত্তি শোনা হবে না। কেননা তোমরা যাতে অসৎকাজ ছেড়ে সৎকাজে লিপ্ত হও, সেজন্য আমি তোমাদেরকে সর্বপ্রকারে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। তোমাদের কাছে সতর্ককারী পাঠিয়েছি, তোমাদেরকে বুদ্ধিবিবেক দিয়েছি এবং এমন একটা আয়ু দিয়েছি, যখন তোমরা সতর্ককারীর কথা শুনে এবং বুদ্ধিবিবেক কাজে লাগিয়ে সৎকাজ করতে পারতে। তখন তোমরা দুনিয়ার জীবনে ছিলে। সে জীবনই ছিল সৎকাজের সময়। আর আখিরাত হল কর্মফল ভোগের সময়। যখন সৎকাজের সুযোগ ছিল তখন তা করোনি। সুতরাং এখন অনুতাপ ও অনুশোচনায় কোনও কাজ হবে না। এখন কর্মফল হিসেবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে থাক।
এ আয়াতে যে বয়সের কথা বলা হয়েছে, তা যে ৬০ বছরই হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। এর দ্বারা মূলত এমন একটা জীবন বোঝানো উদ্দেশ্য, যে জীবন লাভ করলে চিন্তাভাবনা করার ও উপদেশ গ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া যায়। তা ৬০ বছরের আগেও হতে পারে। মানুষ বালেগ হওয়ার পর থেকেই বিবেকবুদ্ধির উন্মেষ ঘটতে থাকে। যত বয়স বাড়ে ততই বুদ্ধিতে পরিপক্কতা আসে এবং অস্থিরতা ও চপলতা কমতে থাকে। যখন বয়স পূর্ণ চল্লিশে পৌছায়, তখন বুদ্ধিও পূর্ণতা পায় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভারিক্কি ও ভারসাম্য আসে। যে-কোনও বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা ও বুঝেশুনে কাজকর্ম করার পক্ষে এ বয়সটা খুবই সহায়ক। তাই তো দেখা যায় নবীগণ এ বয়সেই নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরও তাঁর ৪০ বছর বয়সকালেই প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল। সুতরাং বলা যায় এ আয়াতের ইঙ্গিত ৪০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বয়সকালের প্রতিই। এ উম্মতের গড়পড়তা বয়স ৬০ বছর। যদি কেউ এর বেশি কাল বাঁচে, তবে সে আরও বেশি সুযোগ পেল। তার ক্ষেত্রে এ আয়াতের বক্তব্য আরও বেশি প্রযোজ্য হবে।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে 'ইবাদত-বন্দেগীর প্রতিও বেশি মনোযোগী হওয়া।
এ আয়াতে বর্ণিত সতর্ককারী কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। যেমন ইমাম নববী রহ. ইঙ্গিত করেছেন এবং অধিকাংশ ‘উলামার বরাতে বলেছেন, এ সতর্ককারী হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কেউ কেউ কুরআন মাজীদের কথাও বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম- উভয়ই সতর্ককারী। কুরআনও তার বাণীসমূহের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করে থাকে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মানুষকে আল্লাহর আযাব ও গযব সম্পর্কে সতর্ক করতেন। এর আগের উম্মতসমূহের জন্যও তাদের কাছে প্রেরিত নবীগণ এবং তাদের উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থসমূহ ছিল সতর্ককারী।
কারও কারও মতে মানুষের আকলবুদ্ধিও সতর্ককারী। যে ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্ন অবাধ্যতা ও পাপাচার দ্বারা নিজ বুদ্ধিবিবেক বিকৃত করে ফেলেনি, তার বুদ্ধিবিবেক এক উত্তম পরামর্শদাতা। যখনই কোনও মন্দ কাজের অবকাশ আসে, সুস্থ বিবেক তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে সে কাজে লিপ্ত হতে বারণ করে। এজন্যই বিবেকবান লোক সাধারণত অন্যায়-অনাচার কমই করে। কাজেই বলা যায় অপরাপর সতর্ককারীর মত বুদ্ধিবিবেকও মানুষের এক সতর্ককারী।
প্রকাশ থাকে যে, এসব মতের মধ্যে কোনও বৈপরিত্য নেই। এর কোনও একটিকে সতর্ককারী মানলে আরেকটিকে যে মানা যাবে না, ব্যাপারটা এরকম নয়। কেননা আলাদা আলাদাভাবে এর প্রত্যেকেই মানুষকে সতর্ক করে থাকে। বরং এটা আল্লাহ তা'আলার এক মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে সতর্ক করার নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি মানুষকে সতর্ক করেন নবী-রাসূলের দ্বারা, তাকে সতর্ক করেন আসমানী কিতাব দ্বারা, এর পাশাপাশি সতর্ক করেন বুদ্ধিবিবেক দ্বারা, কখনও সতর্ক করেন বিপদ-আপদ দ্বারা, কখনও করেন শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তন বিশেষত বার্ধক্য দ্বারা। এভাবে তিনি সতর্কীকরণের বহুবিধ ব্যবস্থা নিয়েছেন, যাতে একটিতে সতর্ক না হলে আরেকটিতে হয়ে যায়। আল্লাহ চান কোনও না কোনওভাবে বান্দা নিজেকে সংশোধন করে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করে ফেলুক এবং জান্নাতের অধিকারী হয়ে যাক। তা সত্ত্বেও যদি আমাদের হুঁশ না হয় এবং পাপাচারের ভেতরই জীবন ধ্বংস করি, তবে তা কত বড়ই না দুর্ভাগ্যের কথা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সুবুদ্ধি দিন এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।
বৃদ্ধদের জন্য সতর্কবার্তা
হাদীছ নং: ১১২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা ওই ব্যক্তির ওজর কবুল করেন না, যার মৃত্যু বিলম্বিত করেছেন, এমনকি সে ষাট বছর বয়সে উপনীত হয়েছে। -বুখারী।
উলামায়ে কিরাম বলেন, এর অর্থ- আল্লাহ তা'আলা যখন এতটা বয়স পর্যন্ত অবকাশ দিয়েছেন, তখন আর তার ওজর দেখানোর কোনও সুযোগ রাখেননি। বলা হয়ে থাকে, أعذر الرجل অর্থাৎ লোকটি তার অজুহাত প্রদর্শনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৬৯৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৫৯৭)
হাদীছ নং: ১১২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা ওই ব্যক্তির ওজর কবুল করেন না, যার মৃত্যু বিলম্বিত করেছেন, এমনকি সে ষাট বছর বয়সে উপনীত হয়েছে। -বুখারী।
উলামায়ে কিরাম বলেন, এর অর্থ- আল্লাহ তা'আলা যখন এতটা বয়স পর্যন্ত অবকাশ দিয়েছেন, তখন আর তার ওজর দেখানোর কোনও সুযোগ রাখেননি। বলা হয়ে থাকে, أعذر الرجل অর্থাৎ লোকটি তার অজুহাত প্রদর্শনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৬৯৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৫৯৭)
مقدمة الامام النووي
12 - باب الحث عَلَى الازدياد من الخير في أواخر العمر
قَالَ الله تَعَالَى: {أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءكُمُ النَّذِيرُ} [فاطر: 37] قَالَ ابن عباس والمُحَقِّقُونَ: معناه أَو لَمْ نُعَمِّرْكُمْ سِتِّينَ سَنَةً؟ وَيُؤَيِّدُهُ الحديث الَّذِي سنذْكُرُهُ إنْ شاء الله تَعَالَى، وقيل: معناه ثماني عَشْرَة سَنَةً، وقيل: أرْبَعينَ سَنَةً، قاله الحسن والكلبي ومسروق ونُقِلَ عن ابن عباس أيضًا. وَنَقَلُوا أنَّ أَهْلَ المدينَةِ كانوا إِذَا بَلَغَ أَحَدُهُمْ أربْعينَ سَنَةً تَفَرَّغَ للعِبادَةِ، وقيل: هُوَ البُلُوغُ. وقوله تَعَالَى: {وجَاءكُمُ النَّذِيرُ} قَالَ ابن عباس والجمهور: هُوَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - وقيل: الشَّيبُ، قاله عِكْرِمَةُ وابن عُيَيْنَة وغيرهما. والله أعلم.
قَالَ الله تَعَالَى: {أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءكُمُ النَّذِيرُ} [فاطر: 37] قَالَ ابن عباس والمُحَقِّقُونَ: معناه أَو لَمْ نُعَمِّرْكُمْ سِتِّينَ سَنَةً؟ وَيُؤَيِّدُهُ الحديث الَّذِي سنذْكُرُهُ إنْ شاء الله تَعَالَى، وقيل: معناه ثماني عَشْرَة سَنَةً، وقيل: أرْبَعينَ سَنَةً، قاله الحسن والكلبي ومسروق ونُقِلَ عن ابن عباس أيضًا. وَنَقَلُوا أنَّ أَهْلَ المدينَةِ كانوا إِذَا بَلَغَ أَحَدُهُمْ أربْعينَ سَنَةً تَفَرَّغَ للعِبادَةِ، وقيل: هُوَ البُلُوغُ. وقوله تَعَالَى: {وجَاءكُمُ النَّذِيرُ} قَالَ ابن عباس والجمهور: هُوَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - وقيل: الشَّيبُ، قاله عِكْرِمَةُ وابن عُيَيْنَة وغيرهما. والله أعلم.
112 - فالأول: عن أبي هريرةَ - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أعْذَرَ الله إِلَى امْرِئٍ أَخَّرَ أجَلَهُ حَتَّى بَلَغَ سِتِّينَ سَنَةً». رواه البخاري. (1)
قَالَ العلماء: معناه لَمْ يَتْرُكْ لَهُ عُذرًا إِذْ أمْهَلَهُ هذِهِ المُدَّةَ. يقال: أعْذَرَ الرجُلُ إِذَا بَلَغَ الغايَةَ في العُذْرِ.
قَالَ العلماء: معناه لَمْ يَتْرُكْ لَهُ عُذرًا إِذْ أمْهَلَهُ هذِهِ المُدَّةَ. يقال: أعْذَرَ الرجُلُ إِذَا بَلَغَ الغايَةَ في العُذْرِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে ওজর দেখানো বলতে নেক কাজ না করার পক্ষে ওজর দেখানোর কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যখন কেউ ৬০ বছর বয়স পেয়ে যায়, তা সত্ত্বেও সৎকর্মে লিপ্ত না হয় আর এ অবস্থায় মৃত্যু হয়ে যায়, তবে তার আর এ কথা বলার সুযোগ থাকে না যে, আমি আমল করার মত সময় পাইনি। আমাকে যদি আরও আয়ু দেওয়া হত, তবে নেক কাজ করতাম এবং আমাকে যেসব আদেশ করা হয়েছে সেসব পালন করতাম। সুতরাং কারও যখন ৬০ বছর বয়স হয়ে যায় তখন তার অবশ্যকর্তব্য, সকল গড়িমসি ছেড়ে দিয়ে তাওবা-ইস্তিগফার করে ফেলা এবং সর্বতোপ্রকারে আখিরাতমুখী হয়ে যাওয়া। অতঃপর সবরকম পাপাচার থেকে দূরে থেকে একান্ত মনে 'ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হয়ে যাওয়া।
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছ দ্বারা ৬০ বছর বয়সের আগে গাফলাতি করার সুযোগ দিয়ে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, যাদের বয়স ষাটে পৌছেনি,তারা কোনও গুনাহ করলে সেজন্য তাদের ধরা হবে না এবং তাদের ওজর গ্রহণ করা হবে। কেননা যৌবনে পদার্পণ করার পর সালাত ও অন্যান্য ফরয কাজ ছাড়ার কোনও অবকাশ থাকতে পারে না।
৬০ বছর বয়সের সীমারেখা দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য যে, গাফলতি করার সুযোগ তো এর আগেও ছিল না, কিন্তু বয়স যখন ৬০ বছর হয়ে গেল তখন সে সুযোগ আরও বেশি রহিত হয়ে গেল। এর আগে পাপাচার করলে তাও অপরাধ ছিল, কিন্তু এখন করলে সেটা আরও বেশি অপরাধ। সুতরাং শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন সব কালেই করতে হবে। যখন যে জীবন আসে সেটাকেই আমলের প্রকৃত সময় মনে করতে হবে। কেননা চলতি দিনগুলোর পর আয়ু আর অবশিষ্ট নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় সে সময়টাকে গাফলাতির মধ্যে কাটালে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেওয়া যাবে? গাফলতি তো এমন কোনও বিষয় নয়, যাকে আল্লাহর সামনে অজুহাত হিসেবে পেশ করা যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ আমাদেরকে বেশি বেশি আমলে যত্নবান হওয়ার উৎসাহ যোগায়, বিশেষত বয়স যখন বার্ধক্যের দিকে অগ্রসর হয়।
খ. প্রত্যেকের কর্তব্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ জীবনেও পরিবর্তন আনা। বিশেষত ৬০ বছর যদি হয়ে যায়, তখন কোনওক্রমেই গাফলাতির জীবন কাটানো উচিত নয়, যেহেতু তখনকার গাফলাতির জন্য কোনও অজুহাত চলবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছ দ্বারা ৬০ বছর বয়সের আগে গাফলাতি করার সুযোগ দিয়ে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, যাদের বয়স ষাটে পৌছেনি,তারা কোনও গুনাহ করলে সেজন্য তাদের ধরা হবে না এবং তাদের ওজর গ্রহণ করা হবে। কেননা যৌবনে পদার্পণ করার পর সালাত ও অন্যান্য ফরয কাজ ছাড়ার কোনও অবকাশ থাকতে পারে না।
৬০ বছর বয়সের সীমারেখা দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য যে, গাফলতি করার সুযোগ তো এর আগেও ছিল না, কিন্তু বয়স যখন ৬০ বছর হয়ে গেল তখন সে সুযোগ আরও বেশি রহিত হয়ে গেল। এর আগে পাপাচার করলে তাও অপরাধ ছিল, কিন্তু এখন করলে সেটা আরও বেশি অপরাধ। সুতরাং শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন সব কালেই করতে হবে। যখন যে জীবন আসে সেটাকেই আমলের প্রকৃত সময় মনে করতে হবে। কেননা চলতি দিনগুলোর পর আয়ু আর অবশিষ্ট নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় সে সময়টাকে গাফলাতির মধ্যে কাটালে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেওয়া যাবে? গাফলতি তো এমন কোনও বিষয় নয়, যাকে আল্লাহর সামনে অজুহাত হিসেবে পেশ করা যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ আমাদেরকে বেশি বেশি আমলে যত্নবান হওয়ার উৎসাহ যোগায়, বিশেষত বয়স যখন বার্ধক্যের দিকে অগ্রসর হয়।
খ. প্রত্যেকের কর্তব্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ জীবনেও পরিবর্তন আনা। বিশেষত ৬০ বছর যদি হয়ে যায়, তখন কোনওক্রমেই গাফলাতির জীবন কাটানো উচিত নয়, যেহেতু তখনকার গাফলাতির জন্য কোনও অজুহাত চলবে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)