রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১০০
মুজাহাদা ও সাধনা-সংগ্ৰাম।
ঈমানকে শক্তিশালী করা, কর্মতৎপর থাকা ও তাকদীরে অটুট বিশ্বাস রাখার প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ১০০

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, শক্তিশালী মু'মিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মু'মিন অপেক্ষা উত্তম ও বেশি প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। যা তোমার জন্য উপকারী, তার প্রতি লোভ কর এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। অক্ষম হয়ে পড়ো না। যদি তোমার কোনও বিপদ আসে তবে বলো না, যদি আমি এরূপ করতাম তবে এমন এমন হত। বরং বল, আল্লাহ তাকদীরে এটাই রেখেছেন। তিনি যা চেয়েছেন, করেছেন। কেননা 'যদি' শব্দটি শয়তানের কাজ (করার পথ) খুলে দেয়। -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৬৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৮০; বায়হাকী, হাদীছ নং ২০১৭৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৭২২)
11 - باب في المجاهدة
100 - السادس: عن أبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «المُؤْمِنُ القَوِيُّ خَيرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ المُؤْمِنِ الضَّعيفِ وَفي كُلٍّ خَيرٌ (1). احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، واسْتَعِنْ بِاللهِ وَلاَ تَعْجَزْ. وَإنْ أَصَابَكَ شَيءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أنّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ: قَدرُ (2) اللهِ، وَمَا شَاءَ فَعلَ؛ فإنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيطَانِ». رواه مسلم. (3)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে শক্তিশালী মু'মিনকে দুর্বল মু'মিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, এ শক্তি দ্বারা শারীরিক শক্তি বোঝানো হয়নি; বরং ঈমানী শক্তি বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ওই মু'মিন, যে আসবাব-উপকরণের উপর ভরসা করে না। সকল পরিস্থিতিতে এক আল্লাহর উপরই তার ভরসা। সে সর্বাবস্থায় 'ইবাদত-আনুগত্যে অটল থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সে ধৈর্যশীল। দীনী দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও করে, আর তাতে মানুষের পক্ষ থেকে কোনও অপ্রীতিকর আচরণের সম্মুখীন হলে হাসিমুখে তা বরদাশত করে নেয়। এরকম মু'মিন আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ এ কারণে যে, ঈমানী শক্তির কারণে তার পক্ষে সর্বপ্রকার ইবাদত-বন্দেগীতে যত্নবান থাকা সম্ভব হয় এবং দীনের যে-কোনও চাহিদা পূরণে সে সচেষ্ট থাকতে পারে। পক্ষান্তরে যে মু'মিন দুর্বল, সে অনেক সময়ই পরিবেশ-পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তার পক্ষে সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনেক সময়ই শরী'আত মোতাবেক চলা সম্ভব হয় না। প্রতিকূল পরিবেশে সত্যের উপর জমে থাকার হিম্মত হয় না। ফলে শক্তিশালী মু'মিন অপেক্ষা সে দীনদারীতে অনেক পিছিয়ে থাকে। তাই বলা হয়েছে, দুর্বল মু'মিন অপেক্ষা শক্তিশালী মু'মিন আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ ও বেশি প্রিয়।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য ঈমানী শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করা। ঈমান বেশি শক্তিশালী হয় প্রতিকূল পরিবেশে দীনের অনুসরণে সচেষ্ট থাকার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে প্রকৃত ঈমানদার ও আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অনেক বেশি উপকারী। তাদের জীবনীগ্রন্থ, বিশেষত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত ও সাহাবায়ে কিরামের জীবনচরিত পাঠও ঈমানী শক্তি বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক।
তারপর বলা হয়েছে- وفى كل خير উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে'। অর্থাৎ মু'মিন দুর্বল হোক বা শক্তিশালী, যেহেতু উভয়ের মধ্যে ঈমান আছে আর ঈমান মু'মিনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ, সে হিসেবে কল্যাণ আছে উভয়ের মধ্যেই। দুর্বল মু'মিন নেক কাজে শক্তিশালী মু'মিনের সমপর্যায়ে পৌঁছতে না পারলেও ঈমানের কারণে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার একটা মর্যাদা আছেই। দুনিয়ায় সে মু'মিনদের কাতারে গণ্য হয় এবং অপরাপর মু'মিনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিধান প্রযোজ্য হয়, তার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। অপরাপর মু'মিন যেসব অধিকার লাভ করে, ঈমানের কারণে সেও তা লাভ করে। মুমিন না হলে সেসব অধিকার সে লাভ করত না। আর ঈমানের বদৌলতে আখিরাতেও সে মুক্তি পাবে। শুরুতে না হলেও একদিন না একদিন সে জান্নাতে যাবেই।
প্রকাশ থাকে যে, শারীরিক শক্তিও উপেক্ষণীয়ও নয়। মু'মিন ব্যক্তি যদি শারীরিক শক্তিকে ঈমান দ্বারা পরিচালিত করে, ঈমানের দাবি অনুযায়ী শক্তির ব্যবহার করে, তবে এর মাধ্যমে সে বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হতে পারে। হজ্জ করা, আল্লাহর পথে জিহাদ করা, বিপদগ্রস্ত লোকের সাহায্যে ছুটে যাওয়া, ত্রাণ তৎপরতা চালানো এবং এ জাতীয় আরও বহু কাজ শক্তিমানদের পক্ষেই বেশি সম্ভবপর। ইসলামের ইতিহাস- রচনায় বীর শক্তিমান মুজাহিদদের অবদান তো কম নয়। কাজেই আল্লাহ তা'আলা যাকে শারীরিক শক্তি দিয়েছেন, তার কর্তব্য সে শক্তির হেফাজত করা এবং নেক কাজে তা ব্যবহার করা। হাঁ, কেউ যদি তার শক্তির অন্যায় ব্যবহার করে, তা দ্বারা মানুষের উপর জোরজুলুম চালায়, তবে সে শক্তি নিছক পাশবিকতা। শক্তির এ অপব্যবহার পার্থিব জীবনেও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং আখিরাতেও তা জাহান্নামের কারণ হয়ে যায়।
মোটকথা, শারীরিক শক্তি এমনিতে প্রশংসনীয়ও নয়, নিন্দনীয়ও নয়। তার প্রশংসা ও নিন্দা হয় ব্যবহার অনুযায়ী। যে শক্তির সদ্ব্যবহার করা হয় এবং শরী'আত মোতাবেক তা পরিচালনা করা হয়, তবে সে শক্তি অবশ্যই প্রশংসনীয়। আর যে শক্তি অন্যায়- অনাচারে ব্যবহৃত হয়, তা নিন্দনীয়।
উল্লেখ্য, ইমাম বুখারী রহ. তাঁর 'তারীখ' গ্রন্থে হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকে একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তাতে আছে-

الْمُؤْمِنُ ضَعِيفٌ مُتَضَعَّفُ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ

“মু'মিন ব্যক্তি দুর্বল। লোকে তাকে দুর্বল মনে করে। সে যদি আল্লাহর নামে কোনওকিছু কসম করে, তবে আল্লাহ তার কসম রক্ষা করেন (অর্থাৎ কসম করে যা বলে, আল্লাহ তা পূরণ করেন)। কাশফুল খাফা, হাদীছ নং ২৭১২

ইবন মাজাহ শরীফে আছে-

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعَّفٍ

“তোমাদের কি বলে দেব জান্নাতবাসী কে? জান্নাতবাসী হচ্ছে প্রত্যেক ওই লোক, যে দুর্বল এবং লোকেও তাকে দুর্বল মনে করে।সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১১৭
এ দুই হাদীছে দুর্বল হওয়াকে মু'মিনের গুণ ও জান্নাতবাসীর আলামত বলা হয়েছে। অথচ রিয়াযুস সালেহীনের আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা শক্তিশালী মু'মিনকে বেশি ভালোবাসেন এবং দুর্বল মু'মিন অপেক্ষা সে-ই শ্রেষ্ঠ। বাহ্যত উভয়ের মধ্যে বিরোধ মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই। কেননা আলোচ্য হাদীছে যে শক্তির কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ঈমানী শক্তি। আর যে দুর্বলতাকে মু'মিনের গুণ বলা হয়েছে, তা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ক্ষমতার দুর্বলতা। অর্থাৎ যাদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি নেই এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের ধান্দায়ও তারা থাকে না। শক্তিশালী ঈমানওয়ালা লোক সামাজিকভাবে দুর্বল হতেই পারে। ইসলামের শুরু যমানায় এমন বহু মুসলিম ছিল, যাদের সামাজিক কোনও প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না। বর্তমানকালে এরূপ লোক প্রচুর।
কারও মতে, দুর্বল মু'মিন বলে নম্র ও বিনয়ী মু'মিন বোঝানো হয়েছে। মানুষের সঙ্গে যাদের আচার-আচরণ নম্র, কোমল ও নিরহংকার। এরূপ লোক আল্লাহর অনেক প্রিয়। কুরআন মাজীদে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ হিসেবে বিনয় ও নম্রতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ অর্থ হিসেবে উভয় হাদীছের মধ্যে বিরোধ না থাকার বিষয়টা আরও বেশি স্পষ্ট হয়।
প্রকাশ থাকে যে, হালাল পথে অর্থ উপার্জন দূষণীয় নয়; বরং প্রশংসনীয়। হালাল পথে যদি প্রচুর টাকাপয়সা হয়ে যায় তাতেও ক্ষতি নেই। এমনিভাবে আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিভা ও বিদ্যাবুদ্ধির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং সামাজিক কর্মতৎপরতার ফলে যে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জিত হয় তাও নিন্দনীয় নয়। বরং এর মাধ্যমেও দীনের অনেক কাজ হতে পারে এবং লাভ করা যেতে পারে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হল এই যে, এ শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বড় কম। এদের তুলনায় ওই শ্রেণির দীনদারদের সংখ্যাই বেশি, যারা সামাজিকভাবে দুর্বল ও প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- احرص على ما ينفعك তোমার জন্য যা উপকারী তার লোভ করা। মানুষের জন্য প্রকৃত উপকারী বিষয় হচ্ছে দীন। যত দীনী কাজ আছে সবই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের পক্ষে কল্যাণকর। দীনের অনুসরণ দ্বারা দুনিয়ায় শান্তি লাভ হয় এবং আখিরাতে নাজাত পাওয়া যায়। সুতরাং এ হাদীছের মর্ম হচ্ছে, দীনী কাজ করার প্রতি লালায়িত থাক। উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দীনী কাজে ব্যস্ত থাক। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা, যাকাত ফরয হলে যাকাত দেওয়া, হজ্জ ফরয হলে হজ্জ করা, এছাড়া নফল ইবাদত-বন্দেগী করা, আল্লাহর পথে দানখয়রাত করা, গরীব-দুঃখীর সাহায্য করা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইত্যাদি।
পার্থিব যে সকল বিষয় দীনী কাজের পক্ষে সহায়ক, তা অর্জন করাও কাম্য। যেমন, হালাল রুজি, বাসগৃহ, বিবাহ ইত্যাদি। নিজ দীন ও ঈমান হেফাজত করার জন্য এর প্রত্যেকটিই জরুরি। সুতরাং এ ব্যাপারে অবহেলা করার সুযোগ নেই। হাঁ, এগুলোকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য বানানো এবং এ ব্যাপারে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া ও অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে দূষণীয়। কেননা তা কেবলই দুনিয়াদারী। কাজেই এসব বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন জরুরি। কামাই-রোজগার ছেড়ে দিয়ে একদম বৈরাগ্য জীবনযাপন করাও উচিত নয়, আবার এগুলোকেই জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আখিরাত ভুলে যাওয়াও ঠিক নয়। আখিরাতই হবে জীবনের লক্ষ্যবস্তু। দুনিয়াকে কেবল তার সহায়করূপেই গ্রহণ করতে হবে।
এ হাদীছে যে 'লোভ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা দ্বারা মূলত উৎসাহ-উদ্দীপনা বোঝানো উদ্দেশ্য। দীনের অনুসরণ দ্বারা যেহেতু আখিরাতে নাজাত ও মুক্তিলাভ হয়, তাই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গেই তা করা উচিত। লোভ শব্দ দ্বারা হয়তো ইশারা করা হয়েছে, তোমরা যে দুনিয়ার অর্থসম্পদের লোভ কর, প্রকৃতপক্ষে তা কোনও লোভনীয় বস্তু নয়। প্রকৃত লোভের বস্তু হচ্ছে জান্নাত। সেই জান্নাত যা দ্বারা লাভ হয়, প্রকৃতপক্ষে তা-ই তোমাদের জন্য উপকারী বিষয়। কাজেই লোভ যদি কোনওকিছুতে করতে হয়, তবে তা এই প্রকৃত উপকারী বিষয়েই করা চাই। আর সে উপকারী বিষয় হচ্ছে দীনের কাজকর্ম।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- واستعن بالله ولا تعجز 'আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং অক্ষম হয়ে থেকো না'। অর্থাৎ উপকারী বিষয় অর্জনে আল্লাহর সাহায্য চাও। কেবল নিজ চেষ্টার উপর ভরসা করো না। কেবল আসবাব-উপকরণের উপর নির্ভর করো না। আসবাব-উপকরণ অবশ্যই অবলম্বন করবে, চেষ্টাচরিত্রও চালিয়ে যাবে, কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস রাখবে- যা-কিছু হওয়ার তা কেবল আল্লাহর সাহায্যেই হতে পারে। তাঁর সাহায্য ছাড়া কোনওকিছু দ্বারাই কিছু হওয়া সম্ভব নয়। তাই চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে দু'আও করবে, যেন তিনি তোমাকে সাহায্য করেন এবং তোমার চেষ্টাকে সফল করেন।
ولا تعجز অক্ষম হয়ে থেকো না'- এর অর্থ আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনায় অবহেলা করো না এবং তাঁর উপর ভরসা করতেও ভুল করো না। নিজ চেষ্টার উপর ভরসা করাও একরকম অক্ষমতা। কেননা আল্লাহ তা'আলার সাহায্য ছাড়া চেষ্টা দিয়ে কিছুই হয় না। তিনি সাহায্য না করলে সব চেষ্টা ব্যর্থ যেতে বাধ্য। আর ব্যর্থ চেষ্টা অক্ষমতাই বটে।
এর আরেক অর্থ হচ্ছে- নিষ্কর্মা হয়ে বসে থেকো না। আল্লাহ তা'আলা তোমাকে যে ইচ্ছা ও কর্মশক্তি দান করেছেন তার সদ্ব্যবহার কর। আল্লাহর উপর ভরসা করে যদি কাজে লেগে থাক, তবে আল্লাহ তোমার কাজে সুফল দেবেন। তোমার পক্ষে যা-কিছু করা সম্ভব, তাতে মেহনত করতে থাকলে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় তুমি দোজাহানের সফলতা লাভ করতে পারবে। আল্লাহ তা'আলা তোমার ভেতর বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রেখেছেন। তুমি সাধনা ও মুজাহাদা করতে থাক। আল্লাহ চাইলে সে সম্ভাবনার বিকাশ ঘটবে। তাতে তোমার দীন-দুনিয়া চমকে যাবে। দীনের পথের কর্মবীরেরা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা এমন অনেক কিছু করে দেখিয়েছেন, যা আমাদের মত সাধারণ ব্যক্তিদের পক্ষে অকল্পনীয়। কিন্তু যতই অকল্পনীয় হোক, বাস্তবে তা তারা করে দেখিয়েছেন। জ্ঞানের জগতে তাদের অসামান্য কীর্তি জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। জিহাদের ময়দানে তাদের রক্তদান মানুষের হিদায়াতলাভের পথ তৈরি করেছে। তাদের বহুমুখী গবেষণা মানবজীবনে বিপুল কল্যাণ বয়ে এনেছে। সে সম্ভাবনার বিকাশ আজও সম্ভব। 'আল্লাহ তা'আলা কাউকেই সম্পূর্ণ অক্ষমরূপে সৃষ্টি করেননি। কাজেই প্রত্যেকের কর্তব্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করে যাওয়া। আল্লাহ চাহেন তো আপন আপন সক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যেকে সে চেষ্টার সুফল পাবেই।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন যে- لو انى فعلت كان كذا وكذا 'আমি যদি এরূপ করতাম তবে এরকম হত' - এ জাতীয় কথা বলো না। কেননা এতে তাকদীরের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পায়। আল্লাহ তা'আলা সবকিছুই তাকদীরে লিখে রেখেছেন। যা-কিছু ঘটে, সে অনুযায়ীই ঘটে। আমাদের প্রতি কাজ করার হুকুম তাই করি। কিন্তু হবে তা-ই, যা আল্লাহ তা'আলা স্থির করেছেন। তাই কাজ করার পর যে ফলাফল দেখা দেয় তাতে সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য। আমি অন্যকিছু করলে অন্যরকম হত, এ ধারণা ভুল। হত সেটাই, যা এখন হয়েছে। কারণ এটাই তাকদীরে আছে। এর ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং 'যদি এরূপ করতাম - এ জাতীয় বাক্য তাকদীরকে অস্বীকার করার নামান্তর। এর থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
বলতে হবে, আল্লাহ যা তাকদীরে নির্দিষ্ট করেছেন তা-ই হয়েছে। তিনি যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন। তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। আমার প্রতি কাজ করার হুকুম ছিল, আমি কাজ করেছি। ফলাফল আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কাজেই তিনি যে ফল দান করেছেন, আমি তাতে সন্তুষ্ট। এ সন্তুষ্টিই প্রকৃত ঈমান।
বলা হয়েছে— فان لو تفتح عمل الشيطان 'যদি' কথাটি শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়। অর্থাৎ তাকদীরে আস্থার বিপরীতে এ কথা বলা যে- আমি যদি এরূপ করতাম তবে এরূপ হত, এর দ্বারা শয়তান মনে মনে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টির সুযোগ পায়। সে মানুষের দৃষ্টি তাকদীর থেকে সরিয়ে চেষ্টা ও আসবাব-উপকরণের দিকে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে মানুষকে সম্পূর্ণরূপে তাকদীরের প্রতি অবিশ্বাসী করে তোলে। আর শয়তান তো তা-ই চায়। সে চায় মানুষকে বেঈমান বানিয়ে জাহান্নামে নিতে। সে যাতে তার ইচ্ছায় সফল হতে না পারে, তাই প্রত্যেকের কর্তব্য এ জাতীয় কথা বলা হতে বিরত থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, 'যদি এরূপ করতাম' কথাটি বলা নিষেধ কেবল তখনই, যখন তা তাকদীরে বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। কারও যদি তাকদীরে বিশ্বাস অটুট থাকে আর এ অবস্থায় কোনও কল্যাণকর বিষয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে আক্ষেপ করে বলে- আহা! যদি আমি এরূপ করতাম, তবে তা দূষণীয় নয়। যেমন, নামাযের জামাত ছুটে যাওয়ার কারণে আফসোস করে বলা- আহা! যদি আরেকটু আগে আসতাম; পুত্র অবাধ্য হয়ে যাওয়ার কারণে বলা- আহা! যদি তাকে দীনের শিক্ষা দিতাম; সময়সুযোগ থাকা অবস্থায় হজ্জ না করা, তারপর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আক্ষেপ করে বলা- আহা! যদি সুস্থ থাকা অবস্থায় হজ্জ করতাম ইত্যাদি। এসব বাক্য বলাতে কোনও দোষ নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও এরূপ কথা বলার প্রমাণ আছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের কর্তব্য নিজ ঈমান শক্তিশালী করার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং যে সমস্ত উপায়ে ঈমান শক্তিশালী হয় তা অবলম্বন করা।

খ. মানুষ যেমন দুনিয়ার ধনসম্পদের প্রতি লোভ করে, মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য, দীনী কাজের প্রতি তেমনি বরং তারচে'ও বেশি লোভ করা।

গ. কেবল ইচ্ছাশক্তি ও শারীরিক শক্তি ব্যবহার করলেই দীনী কাজ করা সম্ভব হয় না। এর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীকও থাকা দরকার। তাওফীক লাভ হয় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে। তাই যে-কোনও দীনী কাজ করার সময় আল্লাহ তা'আলার সাহায্য চাওয়া উচিত।

ঘ. নিষ্কর্মা হয়ে থাকা উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা যাকে যেই শক্তি ও ক্ষমতা দিয়েছেন, দীন-দুনিয়ার সাফল্য লাভে তার সুষ্ঠু ব্যবহার করা উচিত।

ঙ. কোনও কাজে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া না গেলে ভাগ্যকে দোষারোপ করা উচিত নয় এবং তাকদীরের প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ পায়, এ জাতীয় কোনও কথা বলাও উচিত নয়। যেমন এরূপ বলা যে, আমি এরকম না করে ওই রকম করলে এরূপ হত না।

চ. সর্বাবস্থায় তাকদীরে বিশ্বাস অটুট রাখা উচিত এবং কোনওক্রমেই এমন কোনও কথা বলা বা এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যদ্দরুন শয়তান অন্তরে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টির ও ঈমান-আমলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পেয়ে যায়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন