রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
সৃষ্টিদর্শন ও আত্মগঠন
এ অধ্যায়ের মূল আলোচ্য বিষয় আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টিমালার মধ্যে চিন্তাভাবনা করে আল্লাহ তা'আলাকে চেনা, দুনিয়ার হাকীকত বোঝা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এককথায় সৃষ্টিদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টাকে চেনা এবং নিজেকে স্রষ্টার রেজামন্দি হাসিলের উপযুক্ত বান্দারূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
বস্তুত আল্লাহ তা'আলাকে চেনার উপায় তাঁর সৃষ্টিমালাকে নিয়ে চিন্তা করা। মাখলুকাতের মধ্যে চিন্তাভাবনা করলে উপলব্ধি করা যায় এসব এমনি এমনিই সৃষ্টি হয়ে যায়নি; অবশ্যই এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। সৃষ্টির বৈচিত্র্য, এর সুশৃঙ্খল কালপরিক্রমা এবং এর পারস্পরিক সুসামঞ্জস্য সাক্ষ্য দেয়- মহান সৃষ্টিকর্তা অসীম ক্ষমতাবান ও পরিপূর্ণ জ্ঞান-প্রজ্ঞার অধিকারী।
সৃষ্টিরাজির মধ্যে চিন্তা করলে আরও বোঝা যায় সৃষ্টিকর্তা এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি; এর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর কোনও হেকমত ও উদ্দেশ্য আছে। এ উপলব্ধি মানুষকে বিশ্বসৃষ্টির হেকমত ও উদ্দেশ্য সন্ধানে অনুপ্রাণিত করে।
একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে লক্ষ করা যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে শুরু করে চন্দ্র-সূর্যের মত বৃহদাকার সৃষ্টি পর্যন্ত সবকিছুই মানুষের উপকারে আসে। আমরা যা-কিছু মাখলুকাত দেখতে পাই তার প্রত্যেকটিই মানুষের কোনও না কোনও কাজে লাগে। মানুষ প্রতিনিয়ত এসবের কল্যাণ ভোগ করছে। কিন্তু মানুষ অন্য কারও কোনও উপকারে আসছে না। অর্থাৎ মানুষ ছাড়াও এদের চলে, কিন্তু এদের ছাড়া মানুষের চলে না। সেদিকে লক্ষ করলে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, জগতের প্রতিটি সৃষ্টি মানুষের জন্য, কিন্তু মানুষ তাদের জন্য নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মানুষ কার জন্য?
প্রতিটি সৃষ্টি যখন মানুষের উপকার করছে, তখন সাব্যস্ত হয় এগুলোর কোনওটিই নিরর্থক নয় এবং নয় উদ্দেশ্যহীন। এখন মানুষ যদি কারও জন্য না হয়, তার সৃজনের পেছনে যদি কোনও উদ্দেশ্য না থাকে, তবে তো সে একান্তই নিরর্থক হয়ে যায়।
যে মানুষের জন্য অসংখ্য-অগণ্য মাখলুকাত অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে, সে মানুষ কি নিষ্কর্মা সৃষ্টি হতে পারে? যে মানুষ প্রতি মুহূর্তে অন্যসব মাখলুকের কল্যাণ ভোগ করছে, সেই মানুষের সৃজনে কি কোনও কল্যাণ নিহিত না থেকে পারে? যে মানুষকে দেওয়া হয়েছে বুদ্ধিবিবেকের অমূল্য সম্পদ, যা খাটিয়ে সে ছোট-বড় সব সৃষ্টিকে নিজ উপকারে ব্যবহার করে এবং তাদের দ্বারা নিজের বহুমুখী চাহিদা ও প্রয়োজন সমাধা করে, সে মানুষ কি কিছুতেই কোনও উদ্দেশ্যবিহীন বেহুদা সৃষ্টি হতে পারে? এটা কি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় যে, মানুষের মত বহু গুণ-প্রতিভাসম্পন্ন সৃষ্টি, যে কিনা সকল সৃষ্টির উপর আধিপত্য করে, সে এক স্বার্থসর্বস্ব সৃষ্টিরূপে কেবল ভোগ- উপভোগের জন্য জন্মাবে আর মৃত্যুতেই তার সব শেষ হয়ে যাবে? এটা কি সম্ভব যে, তার সৃষ্টির পেছনে কোনও মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কার্যকর থাকবে না?
সৃষ্টিমালার ভেতর চিন্তাভাবনা করলে মানুষের নিজ সম্পর্কে জানার কৌতূহল জাগবেই। তার মনে প্রশ্ন জাগবে, সে কোথা থেকে আসল, কেন আসল এবং কী তার পরিণতি? এ তিন প্রশ্নের উত্তর সে অবশ্যই খুঁজবে। কিন্তু সে কোথা পাবে এর উত্তর?
সৃষ্টিমালার ভেতর চিন্তা করে যখন সে একজন স্রষ্টার সন্ধান পেয়েছে, তখন এ তিন প্রশ্নের যথার্থ উত্তর জানতে একসময় তাঁরই শরণাপন্ন হবে। তাঁর শরণাপন্ন হতে সে বাধ্য। কেননা অন্য কেউ এর উত্তর দিতে পারবে না, কারও উত্তরে সে সন্তুষ্ট হতে পারবে না। সে যখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর শরণাপন্ন হবে, তখন তাঁর কাছে এর যথার্থ উত্তর পাবে। কারণ তিনি যেহেতু সৃষ্টিকর্তা, তাই এর যথার্থ উত্তর তাঁর কাছেই আছে। নিজ সৃষ্টি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবলই তাঁরই থাকতে পারে। ইরশাদ হয়েছে-
أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ
অর্থ : যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক জ্ঞাত!
সূরা মুলক, আয়াত ১৪
তাঁর কাছ থেকে যখন এসব প্রশ্নের উত্তর মানুষ পেয়ে যাবে, তখনই তার পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব হবে জীবনের আসল গতিপথ। যে পথে চললে তার সৃষ্টির লক্ষ্য- উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং তার মানবজন্ম সফল হবে।
মানবজীবনের চূড়ান্ত সফলতার রাজপথে চলার প্রথম কদম হতে পারে এই সৃষ্টিদর্শন। তাই কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মানুষকে ডেকে বলা হয়েছে- তোমরা আসমান-যমীন, গ্রহনক্ষত্র, সাগর-নদী, পশুপাখি প্রভৃতি সৃষ্টির মধ্যে চিন্তা কর, তাহলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বুঝতে পারবে এবং তাঁর অসীম গুণাবলির সন্ধান পাবে। সেইসঙ্গে বুঝতে পারবে যে, নিখিল বিশ্বের কোনওকিছুই অহেতুক সৃষ্টি করা হয়নি এবং তুমি নিজেও নও উদ্দেশ্যবিহীন কোনও মাখলুক। আর তখন তোমার পক্ষে সম্ভব হবে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার তাবেদার বানিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করা ও নিজ জীবনকে কৃতকার্য করে তোলা।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ের শিরোনামকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগ চিন্তাভাবনা করা সম্পর্কে, আর দ্বিতীয় ভাগ কর্তব্যকর্ম পালন সম্পর্কে।
চিন্তাভাবনা করা হবে কী সম্পর্কে? ইমাম নববী রহ., মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন।
ক. আল্লাহর বড় বড় সৃষ্টি;
খ. দুনিয়ার নশ্বরতা;
গ. আখিরাতের বিভীষিকা ও আখিরাত সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়।
আল্লাহর বড় বড় সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা
আমরা এ পৃথিবীতে বাস করি। জল-স্থল ও পাহাড়-পর্বত নিয়ে এ পৃথিবী। জলে-স্থলে এবং ভূগর্ভে ও ভূপৃষ্ঠে আছে বহুবিচিত্র রকমের সৃষ্টি। কোনওটি ছোট, কোনওটি বড়। স্থলের বড় সৃষ্টি হাতি, জলের তিমি মাছ। এর প্রত্যেকটিতে আছে আল্লাহর কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন।
বড় বড় সৃষ্টি যেমন আছে এ পৃথিবীতে, তেমনি আছে এর বাইরেও। আসমানে আছে আল্লাহর ফিরিশতাগণ। একেক ফিরিশতা কত বড় তা আল্লাহ তা'আলাই জানেন। হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গা মুখে নিয়ে প্রস্তুত আছেন। আল্লাহ তা'আলার হুকুম হওয়ামাত্র তিনি তাতে ফুঁ দেবেন। তাঁর শিঙ্গার ফুৎকারে এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। গ্রহনক্ষত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পাহাড়-পর্বত তুলার মত উড়তে থাকবে। তাহলে সেই শিঙ্গার ফুৎকার কত শক্তিশালী হবে? সেই শিঙ্গাই বা কত বড়? কত বড় সেই শিঙ্গার ধারক হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম এবং কত তাঁর শক্তি? আমাদের পক্ষে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।
হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম ফিরিশতাদের সর্দার। তিনি কত বড় এবং কত তাঁর শক্তি? হযরত লূত আলাইহিস সালামের কওম যে এলাকায় বাস করত, সেই গোটা এলাকাটিকে তিনি নিজ ডানা দিয়ে উপড়ে ফেলেছিলেন এবং শূন্যে নিয়ে উঠে দিয়েছিলেন। এভাবে সে এলাকাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে তাঁর আপন রূপে দেখতে পেয়েছিলেন। গোটা একটা দিগন্ত তাতে ঢেকে গিয়েছিল। সেই বিশাল কায়া দেখে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে কত বড় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সত্তা?
আবার ফিরে আসি পৃথিবীর কথায়। অসংখ্য মাখলুকাত নিয়ে কবেকার সেই দূর অতীত থেকে এ পৃথিবী আপন যাত্রাপথে ছুটে বেড়াচ্ছে। তা কত বড় পৃথিবী? বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, বিষুবরেখা বরাবর এর পরিধি ২৪৯০২ মাইল। ব্যাস ৭৯০০ মাইল। সর্বমোট আয়তন ৫১ কোটি ১ লক্ষ ৫০০ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এর আয়তন ৫৬ হাজার বর্গমাইল। বিশ্বমানচিত্রের একবিন্দু বাংলাদেশ যদি এতবড় হয়, তাহলে সারাটা পৃথিবী কত বড়? এর ওজন কত? বিজ্ঞানীরা এর একটা ওজন নির্ণয় করেছেন। সংখ্যায় লিখলে তা দাঁড়ায় ৬,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টন। এতটা ওজনের এ বিশাল পৃথিবী প্রতিনিয়ত আপন কক্ষপথে ছুটে বেড়াচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ২৯.৭৬ কি.মি., প্রতি মিনিটে ১৭৮৫.৬ কি.মি.। কতকাল থেকে তার এ ছুটে চলা, তার প্রকৃত হিসাব আল্লাহ তা'আলাই জানেন । এই বিপুল ওজনের এত বড় সৃষ্টির পক্ষে এত দ্রুতবেগে নিরন্তর ছুটে চলা কিভাবে সম্ভব? এ মহাশূন্যে পৃথিবী কি একা? তারচে' ছোট বড় কত গ্রহনক্ষত্র মহাশূন্য পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে, তার হিসাব আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে? যে সূর্যকে কেন্দ্র করে আমাদের এ সৌরজগত, সেই সূর্য কত বড়? বিজ্ঞানীগণ বলে থাকেন, পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুণ বড়। পৃথিবী থেকে সূর্য ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে। এত দূরে বলেই তাকে একটি থালার মত ছোট মনে হয়। এই সুবিশাল সূর্যও আপন কক্ষপথে নিরন্তর ছুটছে। বিজ্ঞানীগণ 'মীরা' নামক একটি তারার কথা বলে থাকেন, যা নাকি পৃথিবীর চেয়ে ৩৯০ কোটি গুণ বড়। মহাকাশে আছে অসংখ্য ছায়াপথ। একেকটি ছায়াপথে আছে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্রের পরিবার। আমাদের সৌরজগত যেই ছায়াপথে, সেখানেও নাকি এরকম আরও বহু নক্ষত্রপরিবার আছে। কুরআন মাজীদের বর্ণনানুযায়ী এ সবই প্রথম আসমানের নিচে। তাহলে প্রথম আসমান কত বড়? কুরআনের বর্ণনায় আসমানের সংখ্যা সাতটি। তাহলে সাত আসমানবিশিষ্ট মহাজগত কত বড়?
আল্লাহর বৃহৎ সৃষ্টির মধ্যে আছে আরশ ও কুরসী। আরশ যেন মহাজগতের এক মহামঞ্চ। কুরসী হল সেই মহামঞ্চে স্থাপিত এক মহা সিংহাসন। সে মঞ্চ ও সিংহাসনের ধরনধারণ ও স্বরূপ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু তা যে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কত বড়? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে—
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
অর্থ: তাঁর কুরসী আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী পরিবেষ্টন করে আছে।সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৫
এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কুরসীর ভেতর সাত আসমান যেন সুবিশাল মরুভূমির ভেতর পড়ে থাকা একটি আংটির গোলক। তাহলে কুরসী কত বড় ভাবা যায়? এই কুরসী যেই মহামঞ্চে অবস্থিত, সে আরশ কত বড়?
এই বিপুল বিশাল সৃষ্টিমালার একমাত্র শ্রষ্টা মহান আল্লাহ। অনুমান করা সম্ভব সে আল্লাহর কত ক্ষমতা? কত তাঁর হেকমত? কত তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা? সেই মহামহিয়ান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। সে ইবাদত- বন্দেগী তাঁর প্রয়োজনে নয়; আমাদেরই কল্যাণার্থে। এতবড় জগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, কারও কাছে তাঁর কোনও ঠেকা থাকতে পারে না। কুল মাখলুকাতই তাঁর কাছে ঠেকা। সেই ঠেকা থেকে আমাদের কর্তব্য তাঁর হুকুম মেনে চলা ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা। সেই শিক্ষা গ্রহণের জন্যই সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তার হুকুম।
সৃষ্টিদর্শনের উদ্দেশ্য
প্রকাশ থাকে যে, একদল লোক সৃষ্টিদর্শনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তারা চিন্তাভাবনা করে জড়বাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থাৎ কোন্ বস্তুর মধ্যে কী উপকারিতা আছে, তাকে কী কী কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করে। তারা নিত্যনতুন বস্তু আবিষ্কার করে। তাদের আবিষ্কার মানুষের কল্যাণেও আসে। কোনও কোনওটি ক্ষতিরও কারণ হয়ে থাকে। আবিষ্কার দোষের কিছু নয়। তা দোষ হয় কেবল তখনই, যখন আবিষ্কারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয় কেবলই ভোগবাদিতা। ভোগবাদী মানসিকতা থেকে চিন্তা-গবেষণার ফল হয় আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে যাওয়া এবং নিজ অস্তিত্বের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে পড়া। এরকমের চিন্তা-গবেষণা কখনও কল্যাণকর হয় না; বরং তা ব্যক্তির নিজের ও মানবসাধারণের পক্ষে নিতান্তই ক্ষতিকর হয়ে থাকে।
বস্তুত চিন্তা-গবেষণার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হতে হবে সৃষ্টিকর্তাকে চেনা এবং বস্তুসামগ্রী থেকে তাঁর হুকুম মোতাবেক উপকার লাভ করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা-গবেষণা করলে তা যেমন ব্যক্তির নিজের পক্ষে বরকতময় হয়, তেমনি মানবসাধারণের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনে। তাতে মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই সাফল্যমণ্ডিত হয়। কুরআন ও হাদীছে যে সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য মূলত এটাই।
দুনিয়ার নশ্বরতা
দুনিয়া অতি ক্ষণস্থায়ী। এখানে কেউ অমর নয়। আদী পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে এ পর্যন্ত কত মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। তাদের কেউ বেঁচে থাকেনি। আমিও থাকতে পারব না। প্রাণীমাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
অর্থ : প্রত্যেক প্রাণী অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।সূরা আনকাবূত, আয়াত ৫৭
মৃত্যু থেকে নিস্তার নেই কারও। প্রত্যেক প্রাণী মারা যাবে কেবল তাই নয়; এ পৃথিবীও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। একদিন কিয়ামত কায়েম হবে। তারপর আবার সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে।
কিন্তু দুনিয়ার চাকচিক্যে পড়ে মানুষ মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। দুনিয়ার ভোগ- উপভোগে মাতোয়ারা হয়ে থাকে। সে মুখে বলে বা মনে মনে কল্পনা করে- “মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে।”
না চাহিলেও যে অবশ্যই মরিতে হয়, সে ভাবনাটিও অনেক সময় ভাবা হয় না। ফলে সকল ধ্যানজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় এ দুনিয়া। এরই জন্য সব দৌড়ঝাঁপ। যখন সব দৌড়ঝাঁপ দুনিয়াকে কেন্দ্র করে হয় আর আখিরাতের কথা ভুলে যাওয়া হয়, তখন হালাল-হারাম ও ন্যায়-অন্যায়েরও কোনও ভেদাভেদ করা হয় না। এভাবে ব্যক্তির আখিরাত বরবাদ হয়ে যায়। অথচ আখিরাতের জীবনই আসল জীবন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (64)
অর্থ : এই পার্থিব জীবন খেলাধুলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত!সূরা আনকাবূত, আয়াত ৬৪
বস্তুত দুনিয়া শিশুদের খেলাধুলার মতই। বরং এটা এক প্রতারণার জায়গা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
অর্থ : আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৮৫
মানুষ দুনিয়ার লোভে ও মোহে পড়ে ন্যায়-অন্যায়বোধ বিসর্জন দেয়। আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে যায়। অথচ এ দুনিয়া একদিন তাকে ছেড়ে যেতে হয়। কিছুই তার সঙ্গে যায় না। বরং দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার আগে অনেক সময় দুনিয়াই তাকে ছেড়ে যায়। স্ত্রী মারা যায়, অর্থসম্পদ হাতছাড়া হয়, যৌবন চলে যায়, সুস্বাস্থ্য বিদায় নেয়, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি তাকে পরিত্যাগ করে। অনেক সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দুনিয়া ধরে রাখা সম্ভব হয় না। একদিন ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। সুতরাং দুনিয়া প্রতারণার উপকরণ নয় তো কী?
মানুষ যাতে এই প্রতারক দুনিয়ার ফাঁদে পড়ে নিজ আখিরাত ধ্বংস না করে, তাই তাকে দুনিয়ার হাকীকত সম্পর্কে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে তার সামনে দুনিয়ার হাকীকত তুলে ধরা হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (24)
অর্থ : পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এ রকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেই সব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে। অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যে সকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি। সূরা ইউনুস, আয়াত ২৪
অপর এক আয়াতে ইরশাদ-
وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا (45) الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا (46)
অর্থ : তাদের কাছে পার্থিব জীবনের এই উপমাও পেশ কর যে, তা পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, ফলে ভূমিজ উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে যায়, তারপর তা এমন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, যা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। সম্পদ ও সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা। তবে যে সৎকর্ম স্থায়ী, তোমার প্রতিপালকের নিকট তা সওয়াবের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট এবং আশা পোষণের দিক থেকেও উৎকৃষ্ট।সূরা কাহফ, আয়াত ৪৫-৪৬
দুনিয়ার নশ্বরতা সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদীছও ইরশাদ করেছেন। যেমন, এক হাদীছে আছে-
«مَالِي وَلِلدُّنْيَا مَا أَنَا وَالدُّنْيَا إِنَّمَا أَنَا وَالدُّنْيَا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرْكَهَا»
দুনিয়ার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক? আমি ও দুনিয়া হলাম এরকম, যেমন কোনও আরোহী একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিল, তারপর সে উঠে চলে গেল এবং গাছটি ছেড়ে গেল। জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৭৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৪৩
অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
الدُّنْيَا دَارُ مَنْ لَا دَارَ لَهُ وَ مَالُ مَنْ لَا مَالَ لَهُ وَ لَهَا يَجْمَعُ مَنْ لَا عَقْلَ لَهُ
“দুনিয়া ওই ব্যক্তির বাড়ি, যার (জান্নাতে) কোনও বাড়ি নেই। ওই ব্যক্তির সম্পদ, যার (আখিরাতে) কোনও সম্পদ নেই। এবং দুনিয়ার জন্য ওই ব্যক্তিই সঞ্চয় করে, যার আকলবুদ্ধি নেই।”মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৪১৯
অন্য এক হাদীছে আছে, একদা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাহাবী ছিলেন। এসময় তাঁর সামনে একটি কানকাটা মরা ছাগলের বাচ্চা পড়ল। তিনি ছাগলের বাচ্চাটিকে অপর কান ধরে তুললেন তারপর বললেন, তোমাদের কে এক দিরহামে এটি কিনতে পসন্দ করবে? তারা বললেন, আমরা এটিকে কোনওকিছুর বিনিময়ে নিতে পসন্দ করব না। আমরা এটি দিয়ে কী করব? তিনি বললেন, তবে তোমরা এটি এমনিই নিতে রাজি আছ? তারা বললেন, আল্লাহর কসম! যদি এটি জীবিত থাকত তবুও এর একটা খুঁত ছিল, যেহেতু এর একটা কান কাটা। তারপর এটা যখন মরা, তখন কিভাবে এটি নেওয়া যেতে পারে? তাদের এ মন্তব্যের পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন-
«فَوَاللَّهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللَّهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْ»
“আল্লাহর কসম! তোমাদের কাছে এই ছাগ-ছানাটি যেমন হীন, আল্লাহর কাছে দুনিয়া তার চেও বেশি হীন।”সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৫৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৮৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১১০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩০৪৭, ৮৪৬৪. ১৪৯৩১
হযরত আলী রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
«ارْتَحَلَتِ الدُّنْيَا مُدْبِرَةً، وَارْتَحَلَتِ الآخِرَةُ مُقْبِلَةً، وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا بَنُونَ، فَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الآخِرَةِ، وَلاَ تَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الدُّنْيَا، فَإِنَّ اليَوْمَ عَمَلٌ وَلاَ حِسَابَ، وَغَدًا حِسَابٌ وَلاَ عَمَلٌ»
“দুনিয়া পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে আর আখিরাত সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। দুইয়ের প্রত্যেকেরই রয়েছে সন্তান। সুতরাং তোমরা আখিরাতের সন্তান হও; দুনিয়ার সন্তান হয়ো না। কেননা আজ আমল আছে; হিসাব নেই। আর আগামীদিন হিসাব হবে; আমল থাকবে না। সহীহ বুখারী, অধ্যায়- باب في الأمل وطوله, ৬৪১৭ নং হাদীছের পূর্বে।
দুনিয়ার হীনতা ব্যাখ্যা করা এবং এর প্রতি ভালোবাসা না রাখা ও দিল না লাগানো সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। আমাদের উচিত এ জাতীয় আয়াত ও হাদীছসমূহ বার বার পড়া এবং দুনিয়ার ধোঁকা, হীনতা ও নশ্বরতা সম্পর্কে চিন্তা করা। বার বার চিন্তা করতে থাকলে অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহ দূর হয়ে যাবে এবং এর হীনতা ও ক্ষণস্থায়ীত্বের বোধ অন্তরে জাগ্রত থাকবে। আর তা জাগ্রত থাকলে পাপকর্ম ও অন্যায়- অনাচার থেকে বেঁচে থাকা এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা সহজ হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
আখিরাতের বিভীষিকা ও আখিরাত সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়
মৃত্যু
আখিরাতের সূচনা হয় মৃত্যু দ্বারা। মৃত্যু এক অবধারিত বাস্তবতা। কারও মৃত্যুর দিনক্ষণ আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। প্রত্যেকের মৃত্যুর সময় নির্ধারিত আছে। সেই নির্ধারিত সময় যখন আসে, তখন তা থেকে একমুহূর্ত আগেপিছে হয় না। আগেপিছে করার সাধ্য কারও নেই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
অর্থ : যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।সূরা আ'রাফ, আয়াত ৩৪
মৃত্যু কখন ঘটবে তা যেহেতু কেউ জানে না, তাই প্রত্যেকের উচিত আগে থেকেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। সে প্রস্তুতি হয় শরী'আতসম্মত জীবনযাপন দ্বারা। শরী'আতসম্মত জীবনযাপন অবস্থায় মৃত্যু হলে তা হয় মুসলিম অবস্থার মৃত্যু। আল্লাহ তা'আলা হুকুম দিয়েছেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (102)
অর্থ : হে মুমিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেইভাবে ভয় কর, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত। (সাবধান! অন্য কোনও অবস্থায় যেন) তোমাদের মৃত্যু (না আসে, বরং) এই অবস্থায়ই যেন আসে যে, তোমরা মুসলিম।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১০২
মৃত্যুর একটা যন্ত্রণা আছে। সে যন্ত্রণা বড় কঠিন। ওফাতের সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বার বার ভেজা হাত দিয়ে পবিত্র চেহারা মুছছিলেন আর বলছিলেন-
لا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ
“আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর অনেক যন্ত্রণা আছে।”সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪২১৭
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে এই বলে পানাহ চাইতেন-
اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى سَكْرَاتِ الْمَوْتِ
“হে আল্লাহ! মৃত্যুযন্ত্রণায় আমাকে সাহায্য কর।”জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৯৭৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৬২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৩৫৬
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর কথা খুব বেশি বেশি স্মরণ করতে বলেছেন। দুনিয়ার মোহ ও লোভলালসা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মৃত্যুর স্মরণ অত্যন্ত সহায়ক। তিনি ইরশাদ করেন-
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ الْمَوْتَ
“তোমরা স্বাদ-আহ্লাদ ধ্বংসকারী জিনিস অর্থাৎ মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ কর।জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩০৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৮২৪; মুসনাদে আহমান,হাদীছ নং ৭৯২৮
কবর
মৃত্যুর পর আখিরাতের প্রথম ঘাঁটি হচ্ছে কবর। নেককার ব্যক্তির জন্য কবর হবে জান্নাতের একটি উদ্যান আর পাপী ব্যক্তির জন্য হবে জাহান্নামের একটি গর্ত। নেককার ব্যক্তির জন্য সেখানে আরামের বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। আর পাপী ব্যক্তির জন্য আছে নানারকম শাস্তির ব্যবস্থা।
মৃতব্যক্তিকে কবরে রাখার পর সেখানে 'মুনকার' 'নাকীর' নামক দুজন ফিরিশতা আসে। তারা তাকে বসিয়ে তিনটি প্রশ্ন করে- তোমার রব্ব কে, তোমার দীন কী এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে? নেককার ব্যক্তি উত্তর দেয়- আমার রব্ব আল্লাহ, আমার দীন ইসলাম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তখন উপর থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় আমার বান্দা সঠিক বলেছে, তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও এবং জান্নাতের দিকে তার কবরের একটি দরজা খুলে দাও। ফলে জান্নাতের সুবাস ও শান্তিময় বাতাস তার কবরে আসতে থাকবে। আর দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত তার কবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু বেঈমান ব্যক্তি এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সক্ষম হয় না। সে কেবল বলে- আমি জানি না, আমি জানি না। তখন আসমান থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়- এর জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও, জাহান্নামের দিকে তার কবরের একটি দরজা খুলে দাও। ফলে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস তার কবরে আসতে থাকে। আর তার কবরকে এমন সংকীর্ণ করে দেওয়া হয় যে, পাঁজরের হাড়গুলো এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। তার জন্য সত্তরটি বিষাক্ত সাপ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। একেকটি সাপ এমন বিষাক্ত যে, তার কোনওটি পৃথিবীতে নিঃশ্বাস ফেললে পৃথিবী চিরতরে উষর হয়ে যেত। ফলে তাতে কোনও উদ্ভিদ জন্মাত না। সে সাপগুলো তাকে দংশন করতে থাকে, যা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
কবর অত্যন্ত ভয়ের জায়গা। প্রতিদিন কবর ডেকে বলে-
أَنَا بَيْتُ الغُرْبَةِ, وَأَنَا بَيْتُ الوَحْدَةِ, وَأَنَا بَيْتُ التُّرَابِ, وَأَنَا بَيْتُ الدُّودِ
“আমি এক পরদেশী ঘর, আমি এক নিঃসঙ্গতার ঘর, আমি মাটির ঘর এবং আমি পোকা-মাকড়ের ঘর।”জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৬০
কিয়ামত
প্রত্যেক ব্যক্তির যেমন নির্দিষ্ট আয়ু আছে, তেমনি জগতেরও এক সুনির্দিষ্ট আয়ু আছে। সে আয়ু যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন এ জগত ধ্বংস হয়ে যাবে। জগত ধ্বংস করার জন্য হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি শিঙ্গা নিয়ে প্রস্তুত আছেন। যেদিন আল্লাহর হুকুম হবে, ইসরাফীল আলাইহিস সালাম শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। সে ফুৎকারের এমন শক্তি হবে, যাতে পাহাড়-পর্বত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। গ্রহনক্ষত্র খসে পড়বে। কুরআন মাজীদে সেদিনের চিত্র আঁকা হয়েছে এভাবে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)
অর্থ : হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।সূরা হজ্জ, আয়াত ১-২
অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেন-
الْقَارِعَةُ (1) مَا الْقَارِعَةُ (2) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ (3) يَوْمَ يَكُونُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوثِ (4) وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ (5)
অর্থ: ( স্মরণ কর) সেই ঘটনা, যা (অন্তরাত্মা) কাঁপিয়ে দেবে। (অন্তরাত্মা) প্রকম্পিতকারী সে ঘটনা কী? তুমি কি জান (অন্তরাত্মা) প্রকম্পিতকারী সে ঘটনা কী? যেদিন সমস্ত মানুষ বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত হয়ে যাবে এবং পাহাড়সমূহ হবে ধুনিত রঙিন পশমের মত।সূরা কারি‘আ, আয়াত ১-৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ (13) وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً (14) فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ (15) وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ (16)
অর্থ : অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, একটি মাত্র ফুঁ, এবং পৃথিবী ও পর্বতসমূহকে উত্তোলিত করে একই আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা হবে, সেই দিন ঘটবে অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। এবং আকাশ ফেটে যাবে আর সেদিন তা সম্পূর্ণ জীর্ণ হয়ে যাবে।সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত ১৩-১৬
পুনরুত্থান ও হাশর
আসমান-যমীন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর কতকাল কাটবে তা আল্লাহ তা'আলাই জানেন। তারপর আল্লাহ তা'আলার যখন হুকুম হবে, হযরত ইসরাফীল আলাইহিস- সালাম শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেবেন। সে ফুৎকারে সকল মৃতপ্রাণী পুনর্জীবিত হয়ে উঠবে। ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
অর্থ : তারপর তাতে দ্বিতীয় ফুঁ দেওয়া হবে, অমনি তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকিয়ে থাকবে। সূরা যুমার, আয়াত ৬৮
অন্যত্র ইরশাদ-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ (51) قَالُوا يَاوَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ (52)
অর্থ : এবং শিঙ্গায় (দ্বিতীয়) ফুঁ দেওয়া হবে। অমনি তারা আপন-আপন কবর থেকে বের হয়ে তাদের প্রতিপালকের দিকে ছুটে চলবে। তারা বলতে থাকবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠাল? (উত্তর দেওয়া হবে, এটা সেই জিনিস, যার প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য কথা বলেছিলেন।সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৫১-৫২
কবর থেকে উঠার পর প্রত্যেকে দিশেহারা হয়ে পড়বে। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারবে না। এ অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ফিরিশতা সকলকে হাশরের ময়দানের দিকে ডাক দেবে। তার সেই ডাক লক্ষ করে সকলে ছুটতে থাকবে। ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يَدْعُ الدَّاعِ إِلَى شَيْءٍ نُكُرٍ (6) خُشَّعًا أَبْصَارُهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ كَأَنَّهُمْ جَرَادٌ مُنْتَشِرٌ (7) مُهْطِعِينَ إِلَى الدَّاعِ يَقُولُ الْكَافِرُونَ هَذَا يَوْمٌ عَسِرٌ (8)
অর্থ : যেদিন আহ্বানকারী আহ্বান করবে এক অপ্রীতিকর জিনিসের দিকে। সেদিন তারা অবনমিত চোখে কবর থেকে এভাবে বের হয়ে আসবে, যেন চারদিকে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল। ধাবমান থাকবে সেই আহ্বানকারীর দিকে। এই কাফেরগণই (যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করত) বলবে, এটা তো এক কঠিন দিন। সূরা কমার, আয়াত ৬-৮
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ سِرَاعًا كَأَنَّهُمْ إِلَى نُصُبٍ يُوفِضُونَ (43) خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ ذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِي كَانُوا يُوعَدُونَ (44)
অর্থ : সেদিন তারা দ্রুতবেগে কবর থেকে এমনভাবে বের হবে, মনে হবে যেন তারা তাদের প্রতিমাদের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনত। হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। এটাই সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে।সূরা মা‘আরিজ, আয়াত ৪৩-৪৪
ছুটতে ছুটতে সমস্ত মানুষ হাশরের ময়দানে একত্র হবে। সেখানে একত্র করার উদ্দেশ্য হবে সকলের থেকে পার্থিব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের হিসাব নেওয়া। হাশরের ময়দানের পরিস্থিতি অত্যন্ত বিভীষিকাময়। প্রত্যেকে আপন পরিণতি নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকবে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে হাশরের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ (101)
অর্থ : অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তাদের মধ্যকার কোনও আত্মীয়তা বাকি থাকবে না এবং কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না।সূরা মু'মিনূন, আয়াত ১০১
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا جَاءَتِ الصَّاخَّةُ (33) يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)
অর্থ : পরিশেষে যখন কান বিদীর্ণকারী আওয়াজ এসেই পড়বে (তখন এ অকৃতজ্ঞতার পরিণাম টের পাবে)। (তা ঘটবে সেদিন), যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।সূরা আবাসা, আয়াত ৩৩-৩৭
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ تَكُونُ السَّمَاءُ كَالْمُهْلِ (8) وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ (9) وَلَا يَسْأَلُ حَمِيمٌ حَمِيمًا (10) يُبَصَّرُونَهُمْ يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍ بِبَنِيهِ (11) وَصَاحِبَتِهِ وَأَخِيهِ (12) وَفَصِيلَتِهِ الَّتِي تُؤْوِيهِ (13) وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ يُنْجِيهِ (14)
অর্থ : (সে শাস্তি হবে সেদিন, যেদিন আকাশ তেলের গাদের মত হয়ে যাবে এবং পাহাড় হয়ে যাবে রঙিন পশমের মত। এবং কোনও অন্তরঙ্গ বন্ধু অন্তরঙ্গ বন্ধুকে জিজ্ঞেসও করবে না। অথচ তাদের পরস্পরকে দৃষ্টিগোচর করে দেওয়া হবে। অপরাধী সেদিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তার পুত্রকে মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চাবে। এবং তার স্ত্রী ও ভাইকে এবং তার সেই খান্দানকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত। এবং পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে, যাতে (এসব মুক্তিপণ দিয়ে) সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।সূরা মা‘আরিজ, আয়াত ৮-১৪
উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে খালি পায়ে, নগ্ন ও খতনাবিহীন অবস্থায়। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নারী-পুরুষ সকলকে? তারা একে অন্যকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন, হে আয়েশা! ব্যাপারটা অনেক কঠিন। তাদের কেউ একে অন্যের দিকে তাকানোর অবকাশ পাবে না।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৫৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২০৮৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৭৬
সেদিন সূর্য মাথার উপর চলে আসবে। প্রচণ্ড গরমে মানুষ অস্থির হয়ে পড়বে। এত ঘাম জমে যাবে যে, তা কারও টাখনু, কারও হাঁটু এবং কারও কোমর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। কেউ ঘামের মধ্যে ডুবে যাবে। এ পার্থক্য হবে আমলের তারতম্য অনুযায়ী। এভাবে কতকাল কাটবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। এক তো প্রচণ্ড তাপের কষ্ট, সেইসঙ্গে পরিণাম সম্পর্কে উৎকণ্ঠা। প্রত্যেকের একই চিন্তা- হায়, আমার কী হবে! আমার কী হবে! প্রতীক্ষার এ কষ্ট দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এক পর্যায়ে সকলেই আকাঙ্ক্ষা করবে, বিচারকার্য তো শুরু হয়ে যাক, যাতে হাশরের ময়দানের এ বিভীষিকা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়! সকলে নবী-রাসূলগণের কাছে ছোটাছুটি করবে, যেন তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করেন যাতে বিচারকার্য শুরু হয়। এক এক করে হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে 'ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত নবী-রাসূলগণকে সুপারিশের জন্য ধরা হবে। কিন্তু প্রত্যেকেই অপারগতা প্রকাশ করবেন। সবশেষে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। তারপর বিচারকার্য শুরু হবে। একে ‘শাফাআতে কুবরা’ বা মহা সুপারিশ বলা হয়। এটা একমাত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই বৈশিষ্ট্য।
আরশের ছায়াতলে স্থানলাভ
হাশরের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে সাত শ্রেণির লোক আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেন-
" سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ: الإِمَامُ العَادِلُ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي المَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ، أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ "
“যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনও ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় সাত ব্যক্তিকে স্থান দেবেন-
এক. ন্যায়পরায়ণ শাসক;
দুই. ওই যুবক, যে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে;
তিন. ওই ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত;
চার. ওই দুই ব্যক্তি, যারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, তাঁর জন্যই একত্র হয় এবং তাঁর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়;
পাঁচ. ওই ব্যক্তি, যাকে কোনও অভিজাত ও সুন্দরী নারী ডাকে আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি;
ছয়. ওই ব্যক্তি, যে গোপনে দানখয়রাত করে আর তার বাম হাত জানে না ডান হাত কী খরচ করেছে;
সাত. ওই ব্যক্তি, যে নিরিবিলিতে আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ করে আর তার চোখ অশ্রুসজল হয়।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৩১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৯১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫২৮০; মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৩৫০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৬৬৫, ৯৬৬৬
আমলের ওজন ও হিসাবনিকাশ
হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে আমলের হিসাবনিকাশের জন্য। প্রথম শ্রেণির মু'মিনগণ তো বিনা হিসাবেই জান্নাতে পৌঁছে যাবে। আর অন্যদেরকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। দুনিয়ায় তাদের যে- যা করেছে তার পুরোপুরি হিসাব নেওয়া হবে। জিজ্ঞেস করা হবে আয়ু সম্পর্কে যে, তা কী কাজে নিঃশেষ করেছে; যৌবনকাল সম্পর্কে যে, তা কী কাজে জরাজীর্ণ করেছে; অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে যে, তা কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কোন্ খাতে ব্যয় করেছে আর জ্ঞান সম্পর্কে যে, সে অনুযায়ী কেমন আমল করেছে। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে যত নি'আমত দান করেছেন, প্রত্যেকটি সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করা হবে যে, তা কিভাবে ব্যবহার করেছে এবং তার কতটুকু কৃতজ্ঞতা আদায় করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَقِفُوهُمْ إِنَّهُمْ مَسْئُولُونَ (24)
অর্থ : তাদেরকে দাঁড় করাও। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে।সূরা সাফফাত, আয়াত ২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ (8)
অর্থ : অতঃপর সেদিন তোমাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে নি'আমত সম্পর্কে। সূরা তাকাছুর, আয়াত ৮
সেদিন বান্দার যাবতীয় আমলের ওজন করা হবে। ইরশাদ হয়েছে-
وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ (47)
অর্থ : কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়ানুগ তুলাদণ্ড স্থাপন করব। ফলে কারও প্রতি কোনও জুলুম করা হবে না। যদি কোনও কর্ম তিল পরিমাণও হয়, তবে তাও আমি উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট। সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৪৭
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (8) وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَظْلِمُونَ (9)
অর্থ : এবং সেদিন (আমলসমূহের) ওজন (করার বিষয়টি) একটি অকাট্য সত্য। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে কৃতকার্য। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই তো সেই সব লোক, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে। নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৮-৯
আমলনামা
সেদিন মানুষের অন্যায়-অপরাধ প্রমাণের জন্য নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমনিতে তো কোনওরকম সাক্ষ্যপ্রমাণের দরকার নেই। কেননা আল্লাহ তা'আলা সবকিছুই জানেন। মানুষের প্রকাশ্য-গুপ্ত কোনও আমলই আল্লাহর অগোচরে থাকে না। তারপরও যাতে মানুষের কোনওরকম প্রশ্ন তোলা ও অজুহাত-আপত্তি প্রদর্শনের পর খোলা না থাকে, সেজন্য সর্বপ্রকার সাক্ষ্যপ্রমাণও পেশ করা হবে। এমনকি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও সাক্ষ্য দেবে। ইরশাদ হয়েছে-
حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (20)
অর্থ : অবশেষে যখন তারা তার কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের চামড়া তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।সূরা হা-মীম সাজদা, আয়াত ২০
অপর এক আয়াতে আছে-
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (65)
অর্থ : আজ আমি তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দেব। ফলে তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের। সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৬৫
এর পাশাপাশি আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ ইহজীবনে প্রত্যেকে যত কথা বলে ও যত কাজ করে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ফিরিশতাগণ তা সব লিপিবদ্ধ করে রাখে। যে রেজিস্ট্রারে তারা তা লিপিবদ্ধ করে, আমরা তাকে আমলনামা বলে থাকি।কুরআন মাজীদে তাকে 'কিতাব' নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন তা উপস্থিত করা হবে এবং প্রত্যেককে তা পড়তে বলা হবে। ইরশাদ হয়েছে-
وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا (13) اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا (14)
অর্থ : আমি প্রত্যেক মানুষের (কাজের) পরিণাম তার গলদেশে সেঁটে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন আমি (তার আমলনামা) লিপিবদ্ধরূপে তার সামনে বের করে দেব, যা সে উন্মুক্ত পাবে। (বলা হবে) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১৩-১৪
প্রত্যেকে তা পড়বে। পড়ে হয়রান হয়ে যাবে। ইহজীবনে যা-কিছু করেছে বা বলেছে তার কোনওকিছুই বাদ যায়নি, সবই লেখা রয়েছে। তারা আশ্চর্য হয়ে বলবে-
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَاوَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا
অর্থ : আর 'আমলনামা' সামনে রেখে দেওয়া হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, তাতে যা (লেখা) আছে, তার কারণে তারা আতঙ্কিত এবং তারা বলছে, হায়! আমাদের দুর্ভোগ! এটা কেমন কিতাব, যা আমাদের ছোট-বড় যত কর্ম আছে, সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে রেখেছে? তারা তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি কোনও জুলুম করবেন না।সূরা কাহফ, আয়াত ৪৯
এভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা হবে এবং আমলের ওজন করা হবে। যার নেকীর পাল্লা ভারী হবে তার ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। আর যার পাপের পাল্লা ভারী হবে তার আমলনামা দেওয়া হবে বাম হাতে। যে ব্যক্তি ডান হাতে আমলনামা পাবে তার খুশির কোনও সীমা থাকবে না। ইরশাদ হয়েছে-
فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَيَقُولُ هَاؤُمُ اقْرَءُوا كِتَابِيَهْ (19) إِنِّي ظَنَنْتُ أَنِّي مُلَاقٍ حِسَابِيَهْ (20) فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ (21) فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ (22)
অর্থ : অতঃপর যাকে আমলনামা দেওয়া হবে তার ডান হাতে, সে বলবে,হে লোকজন! এই যে আমার আমলনামা, তোমরা পড়ে দেখ। আমি আগেই বিশ্বাস করেছিলাম আমাকে অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং সে থাকবে মনঃপূত জীবনে। সমুন্নত জান্নাতে। সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত ১৯-২২
আর যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে, তার মনে প্রচণ্ড আক্ষেপ দেখা দেবে। তার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَالَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ (25) وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِيَهْ (26) يَالَيْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِيَةَ (27) مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيَهْ (28) هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيَهْ (29) خُذُوهُ فَغُلُّوهُ (30) ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ (31)
অর্থ : আর সেই ব্যক্তি, যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে; সে বলবে, আহা! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হত! আর আমি জানতেই না পারতাম, আমার হিসাব কী! আহা! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত! আমার অর্থসম্পদ আমার কোনও কাজে আসল না! আমার থেকে আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেল! (এরূপ ব্যক্তি সম্পর্কে হুকুম দেওয়া হবে) ধর ওকে এবং ওর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। তারপর ওকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত ২৫-৩১
জান্নাত পরম সুখের স্থান। সেখানে কোনও দুঃখকষ্ট নেই। আর জাহান্নাম চরম দুঃখকষ্টের জায়গা। সেখানে কোনও সুখশান্তি নেই। যে ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে, সে অনন্তকাল সেখানে থাকবে। আর যে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে তার যদি ঈমান না থাকে, তবে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। ঈমান থাকলে শাস্তি ভোগের পর আল্লাহ তা'আলার যখন ইচ্ছা হবে তখন সে মুক্তি পাবে। জাহান্নামের শাস্তি অল্পকালের জন্য হলেও তা বড় দুর্বিষহ। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে হেফাজত করুন। আমীন
এই হচ্ছে আখিরাতের অতি সংক্ষিপ্ত চিত্র। কুরআন ও হাদীছে বিস্তারিত বিবরণ আছে। বিস্তারিত বিবরণ জেনে প্রত্যেকের উচিত সে সম্পর্কে চিন্তা করা ও নিজ আমলের তত্ত্বাবধান করা। মৃত্যু, কবর, হাশর ও জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা অন্তর থেকে দুনিয়ার লোভলালসা দূর হওয়া এবং ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়া অবলম্বন করার পক্ষে সহায়ক। তাকওয়া ও পরহেযগারীর সাথে জীবনযাপন করার মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা নিহিত। কেবল এর মাধ্যমেই সম্ভব ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা, কবরে শান্তি পাওয়া, হাশরের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং ডান হাতে আমলনামা পেয়ে জান্নাতে স্থান লাভ করা। অন্ততপক্ষে মৃত্যু-চিন্তাও যদি কারও অন্তরে জাগ্রত থাকে, তবে তার অন্তরে দুনিয়ার মোহ থাকতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أَكْثِرُوْا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَاتِ الْمَوْتِ
‘তোমরা স্বাদ-আহ্লাদ ধ্বংসকারী বিষয় অর্থাৎ মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ কর।’জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩০৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৮২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৯২৫
বলা হয়ে থাকে— كفى بالموت واعظا (উপদেশদাতাস্বরূপ মৃত্যুই যথেষ্ট)। হযরত 'উমর ফারূক রাযি.-এর আংটিতে এ বাক্যটি অঙ্কিত ছিল। হযরত আবুদ-দারদা রাযি. কোনও জানাযায় হাজির হলে এ বাক্যটি উচ্চারণ করতেন। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি.-ও এ বাক্যটি বেশি বেশি বলতেন। হযরত হাসান বসরী রহ. লোকজনের সঙ্গে বসলে কেবল মৃত্যু, জাহান্নাম ও আখিরাতের বিষয় নিয়েই আলোচনা করতেন।
করণীয়কর্ম সম্পর্কেও ইমাম নববী রহ. তিনটি কথা বলেছেন।
ক. নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা;
খ. নফসকে পরিশুদ্ধ করা;
গ. নফসকে সরল-সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখা।
নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা
নফস বলতে মানুষের মনকে বোঝানো হয়ে থাকে। মানুষের মনে দু'টি জিনিসের লোভ ও আশা খুব বেশি থাকে। একটি হচ্ছে ধনের লোভ, আরেকটি বেশি দিন বাঁচার আশা। বেশিরভাগ এ দুই আশাই মানুষকে পাপ কাজের প্ররোচনা দেয় ও নেক কাজে আলস্য সৃষ্টি করে। সুতরাং এ দুটি মানবমনের অনেক বড় রোগ। সাধনা ছাড়া এ রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সাধনা না করলে এ দুটি ক্রমে বাড়তেই থাকে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
" يَهْرَمُ ابْنُ آدَمَ وَتَشِبُّ مِنْهُ اثْنَتَانِ: الْحِرْصُ عَلَى الْمَالِ، وَالْحِرْصُ عَلَى الْعُمُرِ "
“মানুষ ক্রমশ বৃদ্ধ হতে থাকে, কিন্তু তার মধ্যে দু'টি বিষয় ক্রমণ যৌবনপ্রাপ্ত হয়। একটি হচ্ছে অর্থের লোভ এবং আরেকটি বেশি দিন বাঁচার আশা।”সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৪৭: বাগাবী : শরহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৯৯৭, ১৩৬৯৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৩৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৩৯; তবারানী, হাদীছ নং ৬৮৮৮; বায়হাকী, হাদীছ নং ৬৫০৬
মানুষের অর্থলোভ যত বাড়ে, পাপের ইচ্ছাও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনিভাবে বেশি দিন বাঁচার আশা 'ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি মানুষকে অলস করে তোলে। মানুষ ভাবে আরও অনেক দিন বাঁচব, এখন আনন্দফুর্তি করে নেই। ফলে বৈধ-অবৈধ নির্বিচারে সে আনন্দফুর্তি করতে থাকে। মন যা চায় তাই করে বেড়ায়। কোনও সীমারেখা মানে না। আরও অনেকদিন বাঁচব- এই ভাবনায় তাওবাও করে না। ফলে গুনাহের বোঝা বাড়তেই থাকে। বয়স যত বাড়ে ততই মনে করে আরও বাঁচব। আরও কিছু ফুর্তি করে নেই। তাওবায় মগ্ন হওয়ার দিনটি আর আসে না। হঠাৎ একদিন মৃত্যু হানা দেয় আর পাপের বোঝা নিয়েই তাকে কবরে চলে যেতে হয়। সেই পরিণতি থেকে বাঁচার উপায় মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ আরও অনেকদিন বাঁচব- এই আশা পরিত্যাগ করা।
কে কতদিন বাঁচবে কারও তা জানা নেই। ভবিষ্যতের কোনও নিশ্চয়তা নেই। যে- কোনও দিনই মৃত্যু এসে যেতে পারে। তাই আগামী দিনের জন্য তাওবাকে স্থগিত না করে আজই এবং এখনই পাপকর্ম ছেড়ে দিয়ে সৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়া উচিত। মন শুধু গড়িমসি করতে চায়। তাকে প্রশ্রয় দিতে থাকলে কখনওই নেক কাজে মনোনিবেশ করা যায় না। তাই যখনই গড়িমসি করবে, মৃত্যুচিন্তার কষাঘাত দ্বারা তাকে শায়েস্তা করতে হবে। প্রত্যেক দিনকেই মনে করতে হবে এটাই আমার জীবনের শেষ দিন। হযরত "আব্দুল্লাহ ইবন 'উমর রাযি. বলতেন, যখন সন্ধ্যা হয় তখন আর ভোরের আশা করবে না, মনে করবে এটাই তোমার জীবনের শেষ সন্ধ্যা। আর যখন ভোর হয় তখন আর সন্ধ্যার আশা করবে না, মনে করবে এটাই তোমার জীবনের শেষ ভোর।
এমনিভাবে অর্থসম্পদের লোভও যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তবে তা কেবল বাড়তেই থাকে। যত হয় ততই বাড়ে। মানুষের ধনের ক্ষুধা কখনওই মেটে না। সেই ক্ষুধা মেটানোর ধান্দায় যে পড়ে যায়, তার পক্ষে কোনও নেক কাজেই আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। অর্থের চাহিদা মেটানোর ইচ্ছায় নেক কাজের তাকাযাকে পিছিয়ে দিতে থাকে। সে কথাই কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ (1) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (2)
অর্থ: (পার্থিব ভোগ সামগ্রীতে) একে অন্যের উপর আধিক্য লাভের চেষ্টা তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌছ।সূরা তাকাছুর, আয়াত ১-২
মন থেকে অর্থসম্পদের আসক্তি কমিয়ে আনারও উপায় মৃত্যুচিন্তা। যদি চিন্তা করা যায়- এভাবে আমি অর্থসম্পদের মোহে আটকা পড়ে আছি, অথচ যে- কোনও সময়ই আমার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে, তখন এ সম্পদ আমার কী কাজে আসবে? যে সম্পদের জন্য আমি নেক কাজ পিছিয়ে দিলাম ও পাপ কাজে মত্ত হয়ে থাকলাম, সে সম্পদ তো আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারবে না এবং মৃত্যুর পর সে সম্পদ আমার সাথে কবরেও যাবে না; বরং সম্পদ ছেড়ে যাওয়ার বাড়তি কষ্ট নিয়েই আমাকে একা নিঃসঙ্গ কবরে চলে যেতে হবে, তাহলে কেন আমি অযথা এর পেছনে পড়ে আমার আখিরাত নষ্ট করছি? তবে অন্তরে সচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং অর্থসম্পদের লালসা কমে গিয়ে নেক কাজের আগ্রহ বাড়বে।
আরও একটা বিষয়ের মোহ মানুষের দীন ও ঈমানের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। তা হচ্ছে সুনামসুখ্যাতি; পদ ও সম্মানের লালসা। সকলের জন্য এটা ব্যাপক না হলেও যাকে এই লালসা পেয়ে বসে, তার পক্ষে এটা অর্থলালসা অপেক্ষাও বেশি ভয়ংকর। পদের জন্য মানুষ যখন লালায়িত হয়ে পড়ে, তখন সে তা অর্জনের জন্য বা তা রক্ষার জন্য এমন কোনও অন্যায়-অনাচার নেই, যা করতে পারে না। এর জন্য সে অন্যায় অর্থব্যয় করে, খুনখারাবী করে এমনকি ঈমান পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। পদবঞ্চিতরাও নানারকম ফিতনাফাসাদ সৃষ্টি করে। পদের জন্য দুভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। আত্মীয়- স্বজনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
পদ এমন কী বিষয়, যার জন্য মানুষ এতকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়? একটু সম্মানসুখ্যাতিই তো? প্রকৃতপক্ষে পদ লাভের পর সেই সম্মান ও সুখ্যাতি কতটুকু লাভ হয়? এ এক সোনার হরিণ, যার পেছনে পড়ে মানুষ সর্বস্ব বিসর্জন দেয়, কিন্তু প্রকৃত সম্মান কোনও দিনই হাসিল হয় না। বরং এর দ্বারা শত্রু বাড়ে, আপনজন পর হয়ে যায় এবং ব্যাপকভাবে মানুষের অন্তরে অশ্রদ্ধা ও অভক্তি জন্ম নেয়।
সম্মানসুখ্যাতি বড়ই খারাপ জিনিস। অনেক সময় দীনদার ব্যক্তির অন্তরে এ রোগ বাসা বাঁধে আর তার অন্তর থেকে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত খতম করে দেয় এবং তার মন ও মানসিকতাকে মাখলুকমুখী করে দেয়। তারপর সে যা-কিছুই আমল করে তাতে মানুষকে খুশি করা ও মানুষের মধ্যে সম্মান প্রতিষ্ঠার বাসনা সক্রিয় থাকে। ফলে তার সমস্ত আমল আল্লাহর কাছে বৃথা হয়ে যায়। সুতরাং এ লালসা এক কঠিন রোগ। এ রোগ যাতে অন্তরে বাসা বাঁধতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। এর জন্য খুব জরুরি, নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে কোনও অবস্থায়ই তা সম্মান ও সুনামসুখ্যাতি অর্জনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। ইতিমধ্যে যদি সেদিকে মনের ঝোঁক সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সেদিক থেকে মনের গতিমুখ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। আর তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব সম্মান-লালসার ভয়াবহ ক্ষতির চিন্তা ও মৃত্যুর ধ্যান করার মাধ্যমে। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِي غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ المَرْءِ عَلَى المَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ
“দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে যদি একটি ছাগলের পালে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে সে দুটি ওই ছাগলগুলোর যে ক্ষতি করে, অর্থসম্পদ ও মানসম্মানের লালসা ব্যক্তির দীন ও ঈমানের পক্ষে তারচে'ও বেশি ক্ষতিকর হয়ে থাকে।”জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৭৬ মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৭৯৪। আত- তবারানী, আল- মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৫৯। বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৫৫
নফসকে পরিশুদ্ধ করা
নফস ও মনের পরিশুদ্ধি হয় মন্দচরিত্র থেকে মুক্তিলাভ দ্বারা। মানুষের মনে জন্মগতভাবেই বিভিন্নরকম মন্দ প্রবণতা থাকে। যেমন, হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অহংকার, কৃপণতা, লোভলালসা ইত্যাদি। এসব মন্দচরিত্র যেমন আল্লাহর নৈকট্যলাভ ও পরকালীন মুক্তির পক্ষে বাধা, তেমনি পার্থিব জীবনের শান্তি- শৃঙ্খলা ও সফলতা লাভের পক্ষেও অনেক বড় অন্তরায়। বরং এগুলো মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশকে ব্যাহত করে। যতক্ষণ এগুলো মানবমনে বিরাজ করে, ততক্ষণ সৎগুণাবলির অর্জন সম্ভব হয় না। কিংবা বলা যায়, জন্মগতভাবে মানবমনে যে সকল সৎগুণ সুপ্ত থাকে, অসৎ স্বভাবের কারণে তা প্রকাশ লাভ করতে পারে না। ফলে মানবজীবনের কোনও স্বার্থকতা থাকে না। কোনও ব্যক্তি আকার-আকৃতিতে মানুষ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সে অন্যান্য জীবজন্তুর কাতারে চলে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিত অন্তর থেকে মন্দ প্রবণতাসমূহ নির্মূলের চেষ্টা করা। অন্ততপক্ষে সেগুলোকে দুর্বল ও নিস্তেজ করে ফেলা। তা করা সম্ভব হয় সেসব চরিত্রের পার্থিব ও পরকালীন কুফল চিন্তা কর এবং মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী অবস্থাসমূহের ধ্যান করার মাধ্যমে। যেমন অহংকার ও অহমিকা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (18)
অর্থ : এবং মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিও না এবং ভূমিতে দর্পভরে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পসন্দ করেন না। সূরা লুকমান, আয়াত ১৮
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ
“ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে।” এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! লোকে পসন্দ করে তার পোশাক সুন্দর হোক এবং তার জুতাও সুন্দর হোক (এটাও কি অহংকার? এটা অহংকার হলে তো ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যায়, যেহেতু এটা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়)। তিনি বললেন-
إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالِ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ
“(না, সেটা অহংকার নয়) আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্য অগ্রাহ্য করা এবং মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।”সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯১; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৫৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৯৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪০৯১
হাসাদ ও ঈর্ষা সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ, فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
“তোমরা ঈর্ষা পরিহার কর। কেননা ঈর্ষা মানুষের পুণ্যসমূহ নিঃশেষ করে দেয়, যেমন আগুন কাঠ জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৯০৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২০৯
কৃপণতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
অর্থ : আল্লাহপ্রদত্ত অনুগ্রহে (সম্পদে) যারা কৃপণতা করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের জন্য ভালো কিছু। বরং এটা তাদের পক্ষে অতি মন্দ।যে সম্পদের ভেতর তারা কৃপণতা করে, কিয়ামতের দিন তাকে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে নেওয়া হবে।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৮০
কুরআন ও হাদীছে মানুষের অন্যান্য মন্দচরিত্র সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত “উলামায়ে কিরামের কাছ থেকে শুনে বা এ সম্পর্কিত লেখাজোখা পড়ে সেসব বিষয় ভালোভাবে জেনে নেওয়া এবং নিজ অন্তকরণকে তা থেকে হেফাজত করা।
নফসকে সরল-সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত রাখা
সরল-সঠিক পথ হচ্ছে দীনের পথ। এ পথে কোনও বক্রতা নেই। ইসলাম যা কিছু বিধিবিধান দিয়েছে, তার কোনওটিতে নেই কোনও বাড়াবাড়ি। প্রত্যেকটি বিধান সরল সহজ এবং প্রত্যেকটি বিধান সর্বপ্রকার বাড়াবাড়িমুক্ত। সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য কোনওরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত না হয়ে নিয়মিতভাবে শরী‘আতের উপর চলতে থাকা। এককথায় একে 'ইস্তিকামাত' বলে। পেছনের অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে দেখে নেওয়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, ইস্তিকামাতের উপর থাকার দ্বারাই বান্দার পক্ষে সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং শরী‘আতের যথাযথ অনুসরণ করা সম্ভব হয়। আর তখনই শরী‘আত অনুসরণের কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ইস্তিকামাতের উপর থাকা খুব সহজ নয়। এটা সম্ভব কেবল আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীক দ্বারা। কুরআন-সুন্নাহ'র অনুসরণের চেষ্টা করতে থাকলে সে তাওফীক লাভ হয়ে যায়। কুরআন-সুন্নাহ'র যথাযথ অনুসরণও একাকী মেহনত দ্বারা হয় না। এর জন্য দরকার কোনও আল্লাহওয়ালার সাহচর্যগ্রহণ ও তাঁর নির্দেশনা মেনে চলা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এ বিষয়টা বোঝার এবং দীনের উপর ইস্তিকামাত অর্জনের তাওফীক দান করুন।
সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত :
নবীজীবনের প্রতি দৃষ্টিপাতের ডাক
قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَى وَفُرَادَى ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا مَا بِصَاحِبِكُمْ مِنْ جِنَّةٍ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ (46)
অর্থ : (হে রাসূল!) তাদেরকে বল, আমি তোমাদেরকে কেবল একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু-দুজন অথবা এক একজন করে দাঁড়িয়ে যাও, তারপর চিন্তা কর (তা করলে অবিলম্বেই বুঝে এসে যাবে যে,) তোমাদের এ সাথীর (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের) মধ্যে কোনও বিকারগ্রস্ততা নেই। সে তো সুকঠিন এক শাস্তির আগে তোমাদের জন্য এক সতর্ককারী মাত্র।সূরা সাবা, আয়াত ৪৬
ব্যাখ্যা
এ আয়াত দ্বারা সত্যে উপনীত হওয়ার পক্ষে চিন্তাভাবনা করার কার্যকারিতা উপলব্ধি করা যায়। কাফের ও মুশরিকগণ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যনবী বলে স্বীকার করত না। তাঁর প্রতি নানা অপবাদ দিত। কখনও তাঁকে মিথ্যাবাদী বলত, কখনও যাদুকর বলত এবং কখনও পাগল সাব্যস্ত করত- না‘উযুবিল্লাহি মিন যালিক।
তিনি যে এ সকল অপবাদের ঊর্ধ্বে এবং সত্যিই আল্লাহ তা'আলার নবী, তা বোঝার জন্য এ আয়াতে তাদেরকে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা গোয়ার্তুমি ও হঠকারিতা ছেড়ে দাও। ইখলাস ও ইনসাফের সাথে সত্য বোঝার চেষ্টা কর। তোমরা মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তাঁর সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা কর। চিন্তা কর নিভৃতে একাকী। এবং প্রয়োজনে কয়েকজনে মিলে বস। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা কর। তাহলে বুঝতে পারবে তিনি সত্যিই আল্লাহর নবী।
তিনি জীবনের দীর্ঘ চল্লিশ বছর তোমাদের চোখের সামনে কাটিয়েছেন। তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে এ দীর্ঘ জীবনকালের প্রত্যেকটি অবস্থা তোমরা নিজ চোখে দেখেছ। তিনি কেমন আমানতদার, কেমন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, চরিত্রবান, সমঝদার ও গভীর বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন, তা তোমরা সবসময়ই লক্ষ করেছ এবং তোমরা এটা স্বীকার করে এসেছ। তোমরা সর্বদা তাঁকে তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী পেয়েছ। আপন স্বার্থে কখনও কোনও কাজ করতে তাঁকে দেখনি। ধনসম্পদ, ক্ষমতা ও রাজত্ব কোনওকিছুর পেছনে তিনি কখনও পড়েননি। এমন একজন বিশুদ্ধ ও পবিত্র চরিত্রের নিখাদ বুদ্ধিমান ব্যক্তি হঠাৎ করেই উন্মাদ হয়ে গেলেন? উন্মাদ ও পাগল ব্যক্তি কখনও এরকম জ্ঞানগর্ভ কথা বলে? তাঁর মত এমন সারগর্ভ ও কল্যাণকর কথা কোনও পাগলের পক্ষে বলা সম্ভব?
লক্ষ করে দেখ তিনি তোমাদের কী বলেন। তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। যদি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক না চল তবে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের কী ক্ষতি হতে পারে, সে ব্যাপারে তোমাদের সাবধান করেন। তিনি যা-কিছু বলেন তা মেনে চলার ভেতর কেবল আখিরাতের সফলতাই নিহিত নয়; মানুষের পার্থিব জীবনের সফলতাও নিশ্চিত হয়ে যায়। কত আকর্ষণীয় তাঁর প্রতিটি কথা, কত সাহিত্যালংকারপূর্ণ! কত যুক্তিসিদ্ধ! কত দরদভরা এবং কত পূর্ণাঙ্গ তাঁর দেওয়া কর্মসূচী!
তিনি তোমাদেরকে যে কুরআন পড়ে শোনান, তার ছোট্ট একটি সূরা নিয়েই চিন্তা কর না! তার ভাব ও ভাষা, তার সাহিত্যালংকার ও মর্মবাণী, তার বলিষ্ঠতা ও হৃদয়গ্রাহীতা এবং তার আকর্ষণ ও আবেদন কতই না অনন্য ও অসাধারণ! পাগল তো দূরের কথা, দুনিয়ার সর্বোচ্চ জ্ঞানবান ও বিদ্যান ব্যক্তির পক্ষেও তার নমুনা পেশ করা সম্ভব? কোনও এক ব্যক্তি তো দূরের কথা, বড় বড় জ্ঞানী ও বিদ্যানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও এ ব্যাপারে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা সম্ভব কেবল সেই আল্লাহর পক্ষে, যিনি এর নাযিলকর্তা। কেননা এটা আল্লাহর কালাম।
আল্লাহর কালামের নমুনা কোনও মাখলুকের পক্ষে পেশ করা সম্ভব নয়। আর আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর কালাম যে-কেউ লাভ করতে পারে না। তা পারে কেবল আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। আল্লাহর সেই মনোনীত ব্যক্তিকেই নবী বলা হয়ে থাকে।
এসব চিন্তা করলে তোমরা বুঝতে পারবে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যিই আল্লাহর নবী। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কালাম লাভ করেছেন এবং সে কালামের মাধ্যমে তিনি তোমাদের পথ দেখান ও সতর্ক করেন। সুতরাং তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর দেখানো পথে চলে কৃতকার্য হয়ে যাও।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সত্য জানা ও বোঝার জন্য চিন্তাভাবনা করা একটি কার্যকর উপায়।
খ, একাকী চিন্তাভাবনা করার দ্বারা যদি কোনও বিষয় বোঝা সম্ভব না হয়, তবে সে বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে মতবিনিময় ও আলোচনা-পর্যালোচনা করা উচিত।
গ. এ আয়াত দ্বারা আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করলে সে অভিযোগের সারবত্তা যাচাইবাছাই করে নেওয়া উচিত। চিন্তাভাবনা করাও যাচাইবাছাইয়ের একটা পন্থা।
দুই নং আয়াত :
মহাবিশ্বের প্রতি দৃষ্টিপাতের ডাক
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ (190) الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (191)
অর্থ : নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমন বহু নিদর্শন আছে ওই সকল বুদ্ধিমানদের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং তা লক্ষ করে বলে ওঠে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি (এমন ফজুল কাজ থেকে) পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯১
ব্যাখ্যা
সৃষ্টির ভেতর চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে নিজেকে চেনা ও আল্লাহর পরিচয় লাভ সম্পর্কে এ আয়াতের আবেদন অতি বলিষ্ঠ। এ আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়কে আল্লাহ তা'আলার কুদরতের নিদর্শন হিসেবে দেখানো হয়েছে। অতঃপর বুদ্ধিমানদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তারা যেন এর ভেতর চিন্তাভাবনা করে। বিষয় তিনটি হচ্ছে- ১. আকাশমণ্ডলীর সৃষ্টি, ২. পৃথিবীর সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পরিবর্তন। এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে চিন্তা করলে খুব সহজেই বোঝা সম্ভব যে, এগুলো এমনি এমনিই অস্তিত্বলাভ করতে পারে না। অবশ্যই এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তাই এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَيْلٌ لِمَنْ قَرَأَهَا وَلَمْ يَتَفَكَّرُ فِيهَا
“দুর্ভোগ ওই ব্যক্তির জন্য, যে এ আয়াত পড়ে অথচ এর মধ্যে চিন্তা করে না।”সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬২০
প্রথম নিদর্শন : মহাকাশ দর্শন
এ আয়াতে চিন্তা করতে বলা হয়েছে আকাশমণ্ডলী সম্পর্কে। সর্বমোট আকাশের সংখ্যা সাতটি। কুরআন মাজীদে সাত আকাশের উল্লেখ আছে এবং প্রত্যেক আকাশে দরজা আছে বলেও জানানো হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মি‘রাজের রাতে সে দরজা দিয়ে সাত আকাশ পার হয়েছিলেন।
আমরা যে গ্রহনক্ষত্র দেখতে পাই, কুরআন মাজীদ দ্বারা জানা যায় তা সবই প্রথম আকাশের নিচে। গ্রহনক্ষত্রের সংখ্যা কত তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সুবিশাল একেকটি গ্রহ। সূর্য আমাদের পৃথিবীর চেয়ে তেরো লক্ষ গুণ বড়। সূর্যের চেয়েও বড় বড় নক্ষত্র আছে। কোটি কোটি গ্রহনক্ষত্র যে আসমানের নিচে, সে আসমান কত বড়? কোথায় এর খুঁটি? কিভাবে এটি স্থাপিত? এর উপর কী আছে? এর নিচে যে অসংখ্য তারার মেলা, তার মিটিমিটি জ্বলা কতকাল যাবৎ? কিভাবেই বা তা মহাকাশে অবিরত ছুটে চলছে? ছুটে চলছে সুশৃঙ্খলভাবে। একটির সঙ্গে আরেকটির সংঘর্ষ হয় না। কোনওটি তার পথ হারায় না।
মহাকাশে তারাদের এমন সুশৃঙ্খল সাঁতার কেটে বেড়ানো এবং তাও প্রচণ্ড গতিবেগে, কখনও আপনা-আপনি সম্ভব নয়। এর সৃজন, বিন্যাস ও সুশৃঙ্খল পরিচালনায় কোনও মহাশক্তির হাত থাকবে না- এটা কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি মানতে পারে না। সুষ্ঠু বিবেকবুদ্ধির অধিকারী কোনও ব্যক্তি মহাকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে থাকলে একপর্যায়ে তার মন আপনা-আপনি বলে উঠবেই- অবশ্যই এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। সেই সৃষ্টিকর্তাই আল্লাহ।
বস্তুত আকাশ পর্যবেক্ষণ মানুষকে আল্লাহর সন্ধান দেয়। আল্লাহর পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে আকাশ পর্যবেক্ষণ একটি পুণ্যের কাজও বটে, যা এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায়। এক বর্ণনায় আছে, জনৈক ব্যক্তি তার বিছানায় চিত হয়ে শোয়া ছিল। এ অবস্থায় আকাশের দিকে তার নজর গেল। সে নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রতি লক্ষ করল। তারপর বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই তোমার একজন প্রতিপালক ও সৃষ্টিকর্তা আছেন। তারপর বলল, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং তাকে ক্ষমা করলেন।
দ্বিতীয় নিদর্শন : ভূমণ্ডল দর্শন
এ আয়াতে বর্ণিত কুদরতের দ্বিতীয় নিদর্শন হচ্ছে পৃথিবীর সৃষ্টি। সবুজ শ্যামল এ পৃথিবীতে অগণিত মাখলুকের বাস। জল-স্থল, গাছগাছালি ও পাহাড়-পর্বত সম্বলিত এ পৃথিবী কত সুন্দর। কত মনোরম। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে পৃথিবীর নানা নিদর্শনের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (3) وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ وَجَنَّاتٌ مِنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعٌ وَنَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَى بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ (4)
অর্থ : তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন, তাতে পাহাড় ও নদনদী সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে প্রত্যেক প্রকার ফল জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাতের চাদরে আবৃত করেন। নিশ্চয়ই এসব বিষয়ের মধ্যে সেই সকল লোকের জন্য নিদর্শন আছে, যারা চিন্তাভাবনা করে। আর পৃথিবীতে আছে বিভিন্ন ভূখণ্ড, যা পাশাপাশি অবস্থিত। আর আছে আঙ্গুরের বাগান, শস্যক্ষেত্র ও খেজুর গাছ, যার মধ্যে কতক একাধিক কাণ্ডবিশিষ্ট এবং কতক এক কাণ্ডবিশিষ্ট। সব একই পানি দ্বারা সিঞ্চিত হয়। আমি স্বাদে তার কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এসব বিষয়ের মধ্যে সেই সকল লোকের জন্য নিদর্শন আছে, যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায়। সূরা রা'দ, আয়াত ৩-৪
অন্যত্র ইরশাদ-
أَمَّنْ جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (61)
অর্থ : তবে কে তিনি, যিনি পৃথিবীকে বানিয়েছেন অবস্থানের জায়গা, তার মাঝে মাঝে সৃষ্টি করেছেন নদনদী, তার (স্থিতির) জন্য (পর্বতমালার) কীলক গেড়ে দিয়েছেন। এবং তিনি দুই সাগরের মাঝখানে স্থাপন করেছেন এক অন্তরায়? (তবুও কি তোমরা বলছ) আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও প্রভু আছে? না, বরং তাদের অধিকাংশেই (প্রকৃত সত্য) জানে না।সূরা নামল, আয়াত ৬১
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَآيَةٌ لَهُمُ الْأَرْضُ الْمَيْتَةُ أَحْيَيْنَاهَا وَأَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَأْكُلُونَ (33) وَجَعَلْنَا فِيهَا جَنَّاتٍ مِنْ نَخِيلٍ وَأَعْنَابٍ وَفَجَّرْنَا فِيهَا مِنَ الْعُيُونِ (34) لِيَأْكُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ وَمَا عَمِلَتْهُ أَيْدِيهِمْ أَفَلَا يَشْكُرُونَ (35) سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ (36)
অর্থ : আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন হল মৃত ভূমি, যাকে আমি জীবন দান করেছি এবং তাতে শস্য উৎপন্ন করেছি অতঃপর তারা তা থেকে খেয়ে থাকে। আমি সে ভূমিতে সৃষ্টি করেছি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং তা থেকে উৎসারিত করেছি পানির প্রস্রবণ, যাতে তারা তার ফল খেতে পারে। তা তো তাদের হাত তৈরি করেনি। তবুও কি তারা শোকর আদায় করবে না? পবিত্র সেই সত্তা, যিনি প্রতিটি জিনিস জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন, ভূমি যা উৎপন্ন করে তাকেও এবং তাদের নিজেদেরকেও আর তারা (এখনও) যা জানে না তাকেও।সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৩৩-৩৬
কুরআন মাজীদের আরও বহু আয়াতে পৃথিবীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। চিন্তাশীল ব্যক্তি তা মনোযোগের সঙ্গে পড়লে এবং পৃথিবীর সেসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ করলে তার মন স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, এরূপ বহুবিচিত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পৃথিবী নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারে না। নিশ্চয়ই এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং সে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়।
তৃতীয় নিদর্শন : দিনরাতের পালাবদল
এ আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় নিদর্শন হচ্ছে দিন ও রাতের পরিবর্তন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ নিদর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُونَ (67)
অর্থ : তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পার। আর দিনকে তোমাদের দেখার উপযোগী করে বানিয়েছেন। নিশ্চয়ই এতে সেইসব লোকের জন্য বহু নিদর্শন আছে, যারা লক্ষ করে শোনে। সূরা ইউনুস, আয়াত ৬৭
অর্থাৎ দিন ও রাত পরস্পরবিরোধী বিষয়। রাতে অন্ধকার ছেয়ে যায়, কোনওকিছুই চোখে পড়ে না। দিনে আলো ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে সবকিছুই দেখা যায়। এ পরস্পরবিরোধী দিন ও রাত এক আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। তেমনি আরও যত পরস্পরবিরোধী বস্তু ও বিষয় আছে, যেমন ফিরিশতা ও শয়তান, আগুন ও পানি, মানুষের ভালো চরিত্র ও মন্দ চরিত্র এবং মঙ্গল ও অমঙ্গল সবই এক আল্লাহরই সৃষ্টি। এমন নয় যে, মঙ্গল যা-কিছু আছে তার সৃষ্টিকর্তা একজন এবং অমঙ্গলের সৃষ্টিকর্তা আরেকজন, যেমনটা ‘মাজুসী' সম্প্রদায় মনে করে থাকে।
দিনরাতের আবর্তন দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কোনও অবস্থাই অপরিবর্তিত থাকে না। সুখের পর দুঃখ ও দুঃখের পর সুখ মানুষের এক পরিবর্তনীয় অবস্থা। রাতের পর যেমন দিন আসে, তেমনি দুঃখের পরও সুখের আশা থাকে। তাই দুঃখের সময় হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরা উচিত। অনুরূপ সুখও স্থায়ী কিছু নয়। তারপর আবার দুঃখ আসতে পারে। তাই সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত, আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা হওয়া ঠিক নয়। বস্তুত রোদ ও মেঘ, শীত ও গরম এবং জোয়ার-ভাটা প্রকৃতির এক অমোঘ আবর্তন, যেমন দিন ও রাতের পরিবর্তন। সুতরাং মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য কোনও অবস্থাকে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় না মনে করে তাকে আল্লাহর সাধারণ রীতি গণ্য করা এবং প্রত্যেক অবস্থায় আপন কর্তব্যকর্মে লিপ্ত থাকা।
দিন ও রাতের পরিবর্তনের মধ্যে এই শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তা'আলা রাতের অন্ধকারের পর যেমন দিনের আলোয় জগৎ আলোকিত করেন, তদ্রূপ শিরক ও কুফরের অন্ধকারে জগৎ আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর নবুওয়াতের আলো দ্বারা তাকে পুনরায় আলোকিত করে তোলাও আল্লাহ তা'আলার চিরাচরিত নিয়ম। সেই নিয়মের অধীনেই তিনি সারা জাহান কুফরের অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ার পর নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর ভুবনজয়ী সূর্যের উদয় ঘটান, যা কিয়ামত পর্যন্ত সারা জাহানে ঈমানের আলো বিস্তার করতে থাকবে।
দিনরাতের পালাবদল যেমন একদিন খতম হয়ে যাবে এবং তারপর কিয়ামত সংঘটিত হবে, তেমনি কুফরের পর ঈমানের আলো জ্বালানোর যে নবুওয়াতী ধারা, সে ধারারও এক পরিসমাপ্তি অপরিহার্য ছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের মাধ্যমে সে পরিসমাপ্তি সাধিত হয়ে গেছে। ফলে তাঁর পর আর কোনও নবীর আগমন ঘটার অবকাশ নেই। এরপর যা ঘটবে তা হচ্ছে কিয়ামত।
দিবারাত্রের পরিবর্তন সম্পর্কে কুরআন মাজীদে আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا (12)
অর্থ : আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শনরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর রাতের নিদর্শনকে অন্ধকার করেছি আর দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকিত, যাতে তোমরা নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বছর-সংখ্যা ও (মাসের) হিসাব জানতে পার। আমি সবকিছু পৃথক-পৃথকভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছি।”সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১২
এর দ্বারা দিবারাত্র পরিবর্তনের আরও একটি হিকমত জানা গেল। বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে মাস ও বছরের হিসাব রাখা ও দিন-তারিখ নির্ণয় করা সম্ভব হয়, যার সাথে মানুষের পার্থিব জীবনের বহু কাজকারবার ও নিয়মশৃঙ্খলা জড়িত। এ না হলে মানুষকে নানারকম জটিলতার সম্মুখীন হতে হত। আল্লাহ তা'আলা এ পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে সেসব জটিলতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম সহজ ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সুতরাং দিবারাত্রের পরিবর্তন মানুষের পক্ষে আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللَّهُ عَلَيْكُمُ النَّهَارَ سَرْمَدًا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللَّهِ يَأْتِيكُمْ بِلَيْلٍ تَسْكُنُونَ فِيهِ أَفَلَا تُبْصِرُونَ (72) وَمِنْ رَحْمَتِهِ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (73)
অর্থ : বল, তোমরা কী মনে কর? আল্লাহ যদি তোমাদের উপর দিনকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে আল্লাহ ছাড়া এমন কোনও মাবুদ আছে কি, যে তোমাদেরকে এমন রাত এনে দেবে, যাতে তোমরা বিশ্রাম গ্রহণ করতে পার? তবে কি তোমরা কিছুই বোঝ না? তিনিই নিজ রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন বানিয়েছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম নিতে পার ও আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।সূরা কাসাস, আয়াত ৭২-৭৩
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলার এক মহা নি'আমতের কথা তুলে ধারা হয়েছে। তিনি রাত্রিকালকে আরাম ও বিশ্রাম গ্রহণের সময় বানিয়ে দিয়েছেন। এ সময় সারাবিশ্ব অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফলে সকলের জন্য বিশ্রাম নেওয়া ও ঘুমিয়ে পড়া বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যদি এমন না হত এবং মানুষ কখন বিশ্রাম নেবে তা তাদের এখতিয়ারে ছেড়ে দেওয়া হত, তবে সকলের ঐকমত্যে কোনও একটা সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হত না। এ নিয়ে মহা জটিলতা দেখা দিত। একজন বিশ্রাম নিতে চাইলে অন্য একজন তখন কোনও কাজ করতে চাইত আর সে কাজে লিপ্ত হলে প্রথম ব্যক্তির বিশ্রামে ব্যাঘাত সৃষ্টি হত।
এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলা দিনকে তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান অর্থাৎ কামাইরোজগারের সময় বানিয়েছেন, যাতে তখন সকলে কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে। যদি সবটা সময় দিন থাকত, তবে বিশ্রাম গ্রহণ কঠিন হয়ে যেত আবার সবটা সময় রাত হলে কাজকর্ম করা অসম্ভব হয়ে পড়ত এবং মানুষ মহা সংকটের সম্মুখীন হত। সুশৃঙ্খল নিয়মের অধীনে দিনরাতের পালাবদল ঘটানোর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সে সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। মানুষের প্রতি এটা আল্লাহ তা'আলার কত বড়ই না অনুগ্রহ !
বুদ্ধিমান কারা ?
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আসমান-যমীন ও দিবারাত্রের পরিবর্তনের মধ্যে নিদর্শন আছে বুদ্ধিমানদের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে বুদ্ধিমান কারা? আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নজনকে বুদ্ধিমান মনে করে থাকি। বিশেষত আয়াতে যে চিন্তা করার কথা বলা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ করে অনেকে মনে করে সত্যিকারের বুদ্ধিমান হচ্ছে সেই সকল গবেষক ও বিজ্ঞানী, যারা বিভিন্ন বস্তু ও পদার্থের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করে নিত্যনতুন জিনিস আবিষ্কার করছে। তাদের দৃষ্টিতে যারা কোনওকিছু আবিষ্কার করে না,কেবল ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে, তাদের কোনও বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। কিন্তু আমরা যে যা-ই মনে করি না কেন, প্রকৃত বুদ্ধিমান কারা, আল্লাহ তা'আলা তা আলোচ্য দ্বিতীয় আয়াতে বলে দিয়েছেন।
এতে জানানো হয়েছে- বুদ্ধিমান তারাই, যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে সর্বাবস্থায় অন্তরে ও মুখে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান-যমীন তথা নিখিলবিশ্বের সৃজন সম্পর্কে চিন্তাকরত আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর অপার জ্ঞান-শক্তির পরিচয় লাভ করে আর বলে ওঠে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ মহাবিশ্ব ও বিশ্বের অগণিত সৃষ্টি অহেতুক সৃষ্টি করনি। এর সৃষ্টির মধ্যে অবশ্যই তোমার বিশেষ হিকমত নিহিত আছে। একটা বড় হিকমত তো এই যে, এর মাধ্যমে যাতে তোমার পরিচয় লাভ করা যায় এবং সে পরিচয় বান্দাকে তোমার আনুগত্য করতে উৎসাহ যোগায়।
এসব সৃষ্টির মধ্যে চিন্তা করলে এ বিষয়টাও বোঝা যায় যে, তুমি মানুষকে এ পৃথিবীতে এজন্য সৃষ্টি করনি যে, তারা এ পৃথিবীকেই সবকিছু মনে করবে এবং এখানকার জীবনকেই তার মূল লক্ষ্যবস্তু বানাবে। বরং তুমি সৃষ্টি করেছ তোমারই আনুগত্যের জন্য, যাতে মৃত্যুর পর তোমার সন্তোষভাজন হয়ে স্থায়ী অনন্তসুখের জান্নাতে তোমার সান্নিধ্যে স্থান লাভ করতে পারে।
অতঃপর এ চেতনার ফলে তারা তাঁর শাস্তি হতে নাজাত চায় ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে। সে চেষ্টায় যাতে তারা সফল হয় সেজন্য আল্লাহ তা'আলার দরবারে মনেপ্রাণে দু'আও করে।
বোঝা গেল সৃষ্টিমালা সম্পর্কিত সেই চিন্তা-গবেষণাই প্রসংশনীয়, যা আল্লাহর পরিচয় লাভের অছিলা হয়। সেই চিন্তা-গবেষণা নয়, যা জড়বাদ দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে এবং যা প্রকৃতির সীমানা ভেদ করে তার শ্রষ্টা পর্যন্ত পৌছায় না।
বস্তু ও পদার্থ নিয়ে গবেষণা করা ও নতুন নতুন আবিষ্কারে সফলতা লাভ করা মূলত দোষের কিছু নয়। তা দোষের হয় তখনই, যখন এর পেছনে পড়ে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলাকে ভুলে যাওয়া হয়।
মেধা ও বুদ্ধিও তো আল্লাহ তা'আলারই দান। গবেষণায় সফলতার দাবি ছিল মহাদাতা আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। শোকর আদায় না করে উল্টো তাঁর অস্তিত্বকেই যদি অস্বীকার করা হয়, তবে তা কত বড়ই না ধৃষ্টতা ও অকৃতজ্ঞতা! এ অবস্থায় তার আবিষ্কার দ্বারা মানুষের হয়তো কল্যাণ হবে এবং সে কারণে পার্থিব জীবনে সে স্বীকৃতি ও পুরস্কারও লাভ করবে, কিন্তু আখিরাতের প্রকৃত জীবনে বেঈমানীর খেসারত তাকে অবশ্যই দিতে হবে। আর আখিরাতের অকৃতকার্যতাই মানুষের সবচে বড় অকৃতকার্যতা; বরং সেটাই প্রকৃত অকৃতকার্যতা, তাতে দুনিয়ায় সে যতই সফল হোক না কেন।
গবেষক যদি তার আবিষ্কারের পেছনে মহান সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তবে তার গবেষণাকর্ম যেমন মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়, তেমনি তা তার নিজের পক্ষেও পরম কল্যাণ বয়ে আনে। সে গবেষণাকর্ম তার পক্ষে আল্লাহ তা'আলার কাছে সদাকায়ে জারিয়া হিসেবেও গণ্য হতে পারে। আল্লাহ তা'আলার পরিচয় লাভ ও তাঁর শোকরগুযারীর কারণে পরকালীন মুক্তি ও সফলতার আশা তো তার রয়েছেই।
শিক্ষা
ক. আল্লাহর পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে চিন্তা করা উচিত। এরকম চিন্তা একটি উত্তম ইবাদত।
খ. বুদ্ধিমান ব্যক্তি দুনিয়ার মাখলুকাতের মধ্যে চিন্তা করে সৃষ্টিকর্তার অভিমুখী হয় এবং নিজ আখিরাতকে সাফল্যমণ্ডিত করার প্রতি মনোযোগ দেয়।
গ. দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর ও স্মরণ করা যায়। বিশেষত নামায এ তিন অবস্থার যে অবস্থায়ই পড়া সম্ভব তা পড়া যাবে এবং পড়তে হবে। আর তাতে পূর্ণ ছাওয়াব লাভ হবে।
ঘ. বান্দার উচিত তার প্রত্যেকটি কাজ ও প্রত্যেকটি অবস্থায় অন্তরে আল্লাহকে স্মরণ করা ও মুখে তাঁর যিকর করা।
তিন নং আয়াত :
প্রকৃতির বিভিন্ন নিদর্শনের প্রতি দৃষ্টিপাত
أَفَلَا يَنْظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ (17) وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ (18) وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ (19) وَإِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ (20) فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ (21)
অর্থ : তবে কি তারা লক্ষ করে না উটের প্রতি, কিভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের প্রতি, কিভাবে তাকে উঁচু করা হয়েছে? এবং পাহাড়সমূহের প্রতি, কিভাবে তাকে প্রোথিত করা হয়েছে? এবং ভূমির প্রতি, কিভাবে তা বিছানো হয়েছে? সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি উপদেশ দিতে থাক, তুমি তো একজন উপদেশদাতাই।সূরা গাশিয়া, আয়াত ১৭-২১
ব্যাখ্যা
আরবের মানুষ সাধারণত উটে চড়ে মরুভূমিতে চলাফেরা করে। উট-সৃষ্টিতে আল্লাহ তা'আলার কুদরতের যে কারিশমা বিদ্যমান এবং অন্যান্য জীব থেকে তার যে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল ছিল। তাছাড়া উটে চড়ে চলাফেরার সময় তারা আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বত দেখতে পেত। তাই আল্লাহ তা'আলা বলছেন, তারা যদি তাদের আশপাশের বস্তুরাজিতে চোখ বুলায়, তাহলেই তারা বুঝতে সক্ষম হবে, যেই মহান সত্তা জগতের এসব বিস্ময়কর বস্তু সৃষ্টি করেছেন, নিজ প্রভুত্বে তার কোনও অংশীদারের প্রয়োজন নেই। তারা আরও বুঝতে পারবে, যে আল্লাহ বিশ্বজগতের এতসব বিশাল বিপুলায়তন বস্তু সৃষ্টি করতে সক্ষম, তিনি অবশ্যই মানুষকে তাদের মৃত্যুর পর নতুন জীবন দান করতে ও তাদের কার্যাবলির হিসাব নিতেও সক্ষম হবেন। বস্তুত বিশ্বজগতের এই মহাকারখানা আল্লাহ তা'আলা এমনি এমনিই সৃষ্টি করেননি। বরং এর পেছনে আল্লাহ তা'আলার এক উদ্দেশ্য আছে। আর তা হল নেককারদেরকে তাদের নেক কাজের জন্য পুরস্কৃত করা এবং বদকারদেরকে তাদের বন কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া।
শেষ আয়াতে বলা হয়েছে- “তুমি তাদেরকে উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতাই।” অর্থাৎ তাদের সামনে এতসব খোলা নিদর্শন রয়েছে যে, তার মধ্যে চিন্তা করলে তারা অবশ্যই বুঝতে পারত জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যার কোনও শরীক নেই। সেই সৃষ্টিকর্তাই তোমাকে নবী করে পাঠিয়েছেন। ফলে তাদের কর্তব্য তোমার শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহর 'ইবাদত-আনুগত্যে লিপ্ত থাকা। তা সত্ত্বেও যদি তারা তাদের অবাধ্যতা ও শিরকী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে, তবে ব্যস তুমি কেবল তাদের উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হও। তাদের পেছনে এর বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তোমার কাজ কেবল উপদেশ দেওয়াই। সেজন্যই তোমাকে পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষা
ক. এ আয়াত দ্বারাও আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য মাখলুকাতের মধ্যে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
খ. দুচোখের সামনে হাজারও খোলা নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ না করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ জাতীয় ব্যক্তিদের নিজেদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত।
চার নং আয়াত :
ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ
أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ دَمَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلِلْكَافِرِينَ أَمْثَالُهَا (10)
অর্থ : তবে কি তারা ভূমিতে বিচরণ করে দেখেনি তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের পরিণাম কী হয়েছে? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর (মক্কার কাফেরদের জন্য রয়েছে অনুরূপ পরিণাম।সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ১০
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে ভিন্নরকম এক চিন্তার ডাক দেওয়া হয়েছে। আগের আয়াতগুলোতে ছিল মহাবিশ্ব ও এর অন্তর্ভূক্ত মাখলুকাত সম্পর্কে চিন্তাভাবনার উপদেশ। আর এ আয়াতে অতীত জাতিসমূহের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কুরআন মাজীদে অতীতের বহু জাতির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা যখন বিপথগামী হয়েছে ও আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে, তখন তাদের কাছে আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাদেরকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন এবং তাঁর অবাধ্যতা পরিহার করে তাঁর 'ইবাদত-আনুগত্যে লিপ্ত হওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু সেসব জাতির অনেকেই নবী-রাসূলগণের কথায় কর্ণপাত করেনি। যারা কর্ণপাত করেনি এবং শেষপর্যন্ত অবাধ্যতায় অটল থেকেছে, আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর যারা নবীগণের কথা শুনেছে তাদেরকে হেফাজত করেছেন। তারা দুনিয়ায়ও শান্তি থেকে নাজাত পেয়েছে এবং আখিরাতেও তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের পুরস্কার।
আল্লাহ তা'আলা যে সকল জাতিকে ধ্বংস করেছেন, তাদের অনেকের ধ্বংসাবশেষ আজও পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। পৃথিবীতে সফর করলে সেসব ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ আছে যে, আল্লাহর অবাধ্যতা করার পরিণাম কী দাঁড়ায়। এ আয়াতে মক্কার কুরায়শকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা দেশ- বিদেশে সফর করে বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ কি লক্ষ করেনি? তাদের তো উচিত ছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে শিরক ও কুফর পরিহার করা এবং আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের পথে চলা। তারা যদি তা না করে এবং অবাধ্যতায়ই অটল থাকে, তবে অতীতের জাতিসমূহকে যেমন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, অবসম্ভব নয় তাদেরকেও তেমনি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। সময় থাকতে তাদের সাবধান হওয়া উচিত।
শিক্ষা
ক. কুরআন মাজীদ এক উপদেশগ্রন্থ। উপদেশদানের জন্য অতীতের বহু জাতির ঘটনা এতে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত সেসব জাতির ঘটনা থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা।
খ. ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া কুরআন মাজীদেরই এক সবক। সুতরাং অতীতের যে সকল ইতিহাস ও ঘটনা আমাদের জানা আছে তা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, তা কুরআন মাজীদে না থাকলেও।
গ. শিক্ষাগ্রহণ মানে কেবল পাণ্ডিত্য অর্জন নয়; বরং নিজ জীবনে তার বাস্তবায়ন।
সুতরাং বিগত জাতিসমূহের শাস্তিভোগ দ্বারা শিক্ষা নিয়ে প্রত্যেকের উচিত নিজেকে সংশোধন করে ফেলা। অন্যথায় ভয় থাকে, অন্যায়-অপরাধের কারণে তাদেরকে যেমন শাস্তিভোগ করতে হয়েছে, তেমনি শাস্তিভোগ কিনা আমাদেরও করতে হয়।
ইমাম নববী রহ. 'চিন্তাভাবনা করা' সম্পর্কে কুরআন মাজীদের এ তিন স্থান থেকে আয়াত উল্লেখ করেছেন। তারপর তিনি বলেন, এ বিষয় সম্পর্কে আরও বহু আয়াত আছে। অর্থাৎ হে পাঠক! আমি উদাহরণস্বরূপ তোমার সামনে এ আয়াতগুলো উল্লেখ করলাম। তুমি কুরআন মাজীদ পড়তে থাকলে এ রকম আরও বহু আয়াত পাবে। তোমার কর্তব্য সেসব আয়াতের নির্দেশনা মোতাবেক সৃষ্টিমালা ও অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা ও নিজ জীবনগঠনে মনোনিবেশ করা। আল্লাহ তা'আলা তোমাকে তাওফীক দান করুন।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে কোনও হাদীছ উল্লেখ করেননি। তিনি ইশারা করে দিয়েছেন যে, পূর্বে শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি.-এর সূত্রে الكيس من دان نفسه শীর্ষক যে হাদীছটি গত হয়েছে, আলোচ্য বিষয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং তুমি সেটি পড়ে নাও। আমরা পাঠকের সুবিধার্থে তাঁর ইশারা করা সে হাদীছটি এস্থলে অর্থ ও ব্যাখ্যা সহকারে পুনরায় উল্লেখ করছি-
عَنْ أَبِي يَعْلَى شَدَّادِ بْنِ أَوْسٍ.عَنِ النَّبِيِّ صَلى الله عَليه وسَلم, قَالَ: الكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ, وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ المَوْتِ, وَالعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا, وَتَمَنَّى عَلَى اللهِ.
অর্থ : হযরত আবূ ইয়া'লা শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের (জীবনের) জন্য আমল করে। আর দুর্বল (নির্বোধ) ওই ব্যক্তি, যে নিজেকে ইন্দ্রিয়ের (নফসের) অনুগামী বানায় আবার আল্লাহর কাছে আশা রাখে।-তিরমিযী,,
(জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৬০; মুসতাদরাক, হাদীছ নং ১৯১)
ব্যাখ্যা
এটি অত্যন্ত মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ হাদীছ। কে বুদ্ধিমান আর কে নির্বোধ, মানুষ নানাভাবে তা বিবেচনা করে। কিন্তু প্রকৃত বুদ্ধিমান কে? আর কেই বা নির্বোধ? এ হাদীছ বলছে প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজে নিজের হিসাব করে। অর্থাৎ অন্যলোকে কী করছে-না করছে তার পেছনে না পড়ে নিজ আমলের খতিয়ান নেয় ও আখিরাতের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের লাভ-লোকসান হিসাব করে। এ হিসাব হতে পারে দুই রকম। (ক) সময় ও আয়ুর হিসাব এবং (খ) কাজকর্মের হিসাব।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি চিন্তা করে ইহজীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। তারপরে আছে মৃত্যু। তারপর হাশরের ময়দানে হিসাবনিকাশ এবং তারপর অনন্ত বাসের জান্নাত বা জাহান্নাম। ইহজীবনের সংক্ষিপ্ত সময় এমনভাবে ব্যয় করা উচিত, যাতে মৃত্যুর পরের জীবন সুখের হয় এবং হাশরের হিসাবনিকাশে উত্তীর্ণ হয়ে অনন্তকালের জান্নাত লাভ করা যায়। অনন্তকালের জান্নাত লাভ করতে হলে সময় নষ্ট করা চলে না। প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানো উচিত। প্রতিটি সময় এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত, যাতে তা দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় হয় ও জান্নাত লাভের আশা করা যায়।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি চিন্তা করে ইহজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর অমূল্য দান। এর সঠিক ব্যবহার করা বান্দা হিসেবে আমার কর্তব্য। তা করতে পারলেই এ দানের শোকর আদায় হবে। সময় বৃথা নষ্ট হলে কিংবা অকাজে ও পাপকাজে নষ্ট হলে তা হবে নি'আমতের অকৃতজ্ঞতা। সেজন্য আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। এক হাদীছে আছে, আল্লাহ আয়ু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, বান্দা তা কোথায় কী কাজে নিঃশেষ করেছে? সে প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে হলে অবশ্যই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনওই তার সময়কে দীর্ঘ মনে করে না। কার কখন মৃত্যু, কে জানে না। যে-কোনও সময়ই মৃত্যু এসে হানা দিতে পারে। অতীতের দিনগুলো স্বপ্নের মত চলে গেছে। সামনের দিনগুলো হয়তো এভাবেই যাবে। যখন সময় ফুরিয়ে যাবে, কিছুই করার থাকবে না। যা করার, তা করার সময় এখনই। সুতরাং অবহেলা না করে সে সময় কাজে লাগাতে শুরু করে দেয়।
সে দ্বিতীয়ত হিসাব করে তার কাজের। যে দিনগুলো চলে গেছে তার অর্জন কী? এখনই যদি মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সঙ্গে কী নিয়ে যাওয়া হবে? নেওয়ার মত কিছুই চোখে পড়ে না। কাজের কাজ তেমন কিছুই করা হয়নি। আর অবহেলা নয়। এখন কাজের ভেতর দিয়েই চলতে হবে। অতীতে যা করা হয়নি, তার প্রতিকারও করতে হবে এবং বর্তমানে যা করণীয়, তাও করে যেতে হবে। মনে ভয় রাখতে হবে যে, একদিন হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। হিসাব দিতে হবে সময়ের। হিসাব দিতে হবে সবকিছুর। সেই হিসাব যাতে সহজ হয়, তাই এখনই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি কাজ করতে হবে হিসাবের সাথে।
হযরত 'উমর ফারূক রাযি, বলেন-
حَاسِبُوا قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوا
“একদিন তো তোমার হিসাব নেওয়া হবে। তার আগেই নিজে নিজের হিসাব নাও।”জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৫৯: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১১৬, কানযুল উম্মাল হাদীছ নং ৪৪২০৩
বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার সামনে রাখে শরী'আত। লক্ষ করে দেখে তাকে কী করতে বলা হয়েছে এবং কী নিষেধ করা হয়েছে। যা-কিছু করতে বলা হয়েছে তা করতে মনোযোগী হয়। আর যা-কিছু নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি কথা শরী'আতের মানদণ্ডে বিচার করে দেখে। শরীআতসম্মত হলেই তা করে ও তা বলে, নয়তো তা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে। কিছুতেই সে নিজ খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলে না। ইন্দ্রিয়পরবশ হয় না। নফসের চাহিদা পূরণ করে না; বরং নফসকে দমন করে রাখে। নফস ও কুপ্রবৃত্তিকে নিজ শাসনে রাখে।
মোটকথা, সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অধীন করে দেয় শরী'আতের। প্রতিদিন ভোরে সংকল্প নেয় শরী'আতের সীমানার বাইরে এক কদমও চলবে না। সারাদিনের যাবতীয় কাজকর্মে ও যাবতীয় কথাবার্তায় সেই সংকল্প রক্ষার চেষ্টা করে। তারপর ঘুমের আগে হিসাব নেয়, সেই সংকল্প অনুযায়ী চলা হয়েছে কি না। যতটুকু চলা হয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করে, আর যা হয়নি তার জন্য অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা ও ইস্তিগফার করে। এভাবেই চলে প্রতিদিন। চলে মুরাকাবার সাথে। আল্লাহর ধ্যানের সাথে। আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণের সাথেই দিনরাত যাপন করে। দিনের ব্যস্ততা নির্বাহ করে আল্লাহকে হাজিরনাজির জেনে এবং রাতও কাটায় আল্লাহর স্মরণের সাথে। এভাবে যে চলে, হাদীছের ভাষায় সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। কুরআন মাজীদও এরূপ ব্যক্তিকেই বুদ্ধিমান বলেছে। ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (191)
অর্থ : যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং তা লক্ষ করে বলে ওঠে) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি (এমন ফজুল কাজ থেকে) পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৯১
বুদ্ধিমানের দ্বিতীয় পরিচয় দেওয়া হয়েছে- সে কাজ করে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য। মৃত্যু দ্বারা মানুষের স্থায়ী বিনাশ ও বিলোপ ঘটে না; বরং হয় এক অনন্ত জীবনের সূচনা। সে জীবনের প্রথম ধাপ কবর। কবর মাটির ঘর। পোকা-মাকড়ের জায়গা। সেখানে আছে মুনকার-নাকিরের সওয়াল। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে আছে নিদারুণ কষ্ট। মাটির সে ঘর হয়ে যাবে সংকীর্ণ। হয়ে যাবে জাহান্নামের টুকরা। সঠিক উত্তর দিতে পারলে কবর প্রশস্ত হয়ে যাবে। হয়ে যাবে জান্নাতের টুকরা। কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে। কিয়ামতের পর আছে হিসাবনিকাশের জন্য হাশরের ময়দানের উপস্থিতি। সেখানে হিসাবনিকাশ হওয়ার পর হয় জান্নাত, নয় জাহান্নাম। এই সবটার সাফল্য নির্ভর করে ইহজীবনের কর্মকাণ্ডের উপর। এখানে কাজকর্ম ভালো না হলে দুর্ভোগ রয়েছে কবরে, হাশরের ময়দানে, তারপর জাহান্নামবাস। কর্মকাণ্ড ভালো হলে কবরেও শান্তি এবং তারপর প্রত্যেক ঘাঁটিতে নিরাপত্তা। সবশেষে জান্নাতের চিরসুখ।
যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান সে নিশ্চয়ই কবর থেকে যে অনন্ত জীবনের সূচনা হবে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে তার প্রস্তুতি নেবে। তার যাবতীয় কাজকর্ম হবে সেই জীবনকে কেন্দ্র করে। সে চিন্তা করবে কেবল সেই জীবনের কথা। কথা বলবে কেবল সেই জীবন সম্পর্কে। সে স্বপ্ন দেখবে কেবল সেই জীবনের। তার অন্তরে থাকবে কেবল সেই জীবনের স্মরণ। বরং সে নিজেকে মৃতদের একজন গণ্য করবে। ভাববে সে যেন কবরের মধ্যেই আছে। কাজেই সে অবহেলায় জীবন কাটাবে না। বর্তমান নিয়ে মেতে থাকবে না। কোনও বুদ্ধিমান পরিণাম ও পরিণতি অবজ্ঞা করে বর্তমান নিয়ে মাতামাতি করে না। বরং ভবিষ্যতের সুখের জন্য বর্তমানের কষ্ট মেনে নেয়। শুভ পরিণামের জন্য অল্পদিনের কষ্ট স্বীকার করে নেয়।
সুতরাং যে ব্যক্তি কবরে শান্তি চাবে, হাশরের বিভীষিকায় নিরাপত্তা কামনা করবে, হিসাবনিকাশে আসানী চাবে এবং জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত আশা করবে, নিশ্চয়ই সে ইহজীবনে সেজন্য প্রস্তুতি নেবে। অর্থাৎ শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করবে, তাতে যতই কষ্টকেশ হোক না কেন। তার মনের কথা ও মুখের উচ্চারণ হবে কেবল-
اللَّهُمَّ لَا عَيْشَ إِلَّا عَيْشُ الْآخِرَةِ
“হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবন ছাড়া কোনও জীবন নেই।”
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্বোধের আলামত বলেছেন- সে মনের খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলে আবার আশা রাখে- আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন ও জান্নাত দেবেন!
বুদ্ধিমানের বিপরীত হচ্ছে বুদ্ধিহীন বা নির্বোধ। আরবীতে নির্বোধকে سفيه বলে। কিন্তু এ হাদীছে তার জন্য عاجز শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ অক্ষম। যেন বোঝানো হচ্ছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তি শক্তিশালী ও সক্ষম আর নির্বোধ ব্যক্তি শক্তিহীন ও অক্ষম। এটাই সত্য। কেননা শারীরিক শক্তিও শক্তি বটে, কিন্তু মানসিক ও ঈমানী শক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ও ঈমানী শক্তি দ্বারাই নিজেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করা যায়, নফস ও কুপ্রবৃত্তির চাহিদা দমন করা যায় এবং যে-কোনও লোভলালসার মুখে নিজেকে সংযত রাখা সম্ভব হয়। যে ব্যক্তি মনের খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলে, নফসের সব চাহিদা পূরণ করে ও লোভলালসায় গা ভাসিয়ে দেয়, সে কেবল নির্বোধই নয়, অক্ষমও বটে। তার মনে জোর নেই। নেই ঈমানী শক্তি। ফলে তার নফস তাকে কাবু করে রেখেছে। তাকে তার দাস বানিয়ে রেখেছে। তাই সে নফসের গোলামীতে লিপ্ত থাকে। নফস যা চায় তাই করে। এভাবে দু'দিনের আনন্দফুর্তি লুটতে গিয়ে আখিরাতের অনন্ত জীবন ধ্বংস করে দেয়। কত বড়ই না নির্বোধ সে! আখিরাতের অনন্ত জীবনে কোথায় থাকবে সে চিন্তা নেই, তখন কী খাবে তার পরওয়া নেই, কী উপায়ে সে জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ হবে তার কোনও ভাবনা নেই। সব দৌড়ঝাঁপ ইহকাল নিয়ে। এখানে বাড়ি বানানো, এখানে সম্পদ কুড়ানো ও এখানকার ভোগ-উপভোগে মাতোয়ারা হওয়াই তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য চিরস্থায়ী আনন্দ বিসর্জন দেওয়া নির্বুদ্ধিতা নয় তো কী? নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الدُّنْيَا دَارُ مَنْ لاَ دَارَ لَهُ ، وَمَالُ مَنْ لاَ مَالَ لَهُ ، وَلَهَا يَجْمَعُ مَنْ لاَ عَقْلَ لَهُ
“দুনিয়া ওই ব্যক্তির বাড়ি, যার (আখিরাতের) বাড়ি নেই। ওই ব্যক্তির সম্পদ, যার (আখিরাতের) সম্পদ নেই। এবং দুনিয়ার জন্য ওই ব্যক্তি সঞ্চয় করে, যার আকলবুদ্ধি নেই।” মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৪১৯
কত বড়ই না নির্বুদ্ধিতার কথা, সে আখিরাতের কোনও প্রস্তুতি নেয় না, চলে মনমত, মনমত চলতে গিয়ে থাকে পাপাচারে লিপ্ত, কখনও অনুশোচনা করে না, করে না তাওবা-ইস্তিগফার, আবার আশা করে আল্লাহ মাফ করে দেবেন এবং তাকে জান্নাত দান করবেন!
হযরত সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলেন, এটা বড়ই আত্মপ্রবঞ্চনা যে, কেউ পাপাচারে লিপ্ত থাকবে আবার আশা করবে আল্লাহ মাফ করে দেবেন!
হাসান বসরী রহ. বলেন, কিছু লোককে মাগফিরাতের আশা উদাসীন করে রেখেছে। উদাসীনতার ভেতর থেকে তারা দুনিয়া হতে বিদায় নেয়। যখন দুনিয়া হতে বিদায় নেয়, তখন তাদের কোনও পুণ্য থাকে না। আবার বলে, আমি আমার প্রতিপালক সম্পর্কে সুধারণা রাখি! তারা মিথ্যুক। যদি তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে তাদের কোনও সুধারণা থাকত, তবে তাঁর জন্য সৎকাজও করত। এ তাদের মিথ্যা আশা। এটা ধোঁকা ও পথভ্রষ্টতা। নির্বোধ লোকই এরূপ ধোঁকা ও পথভ্রষ্টতায় পড়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
এ হাদীছে নির্বোধ লোকদের মিথ্যা আশা সম্পর্কে 'তামান্না' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরেক হচ্ছে 'রজা'। এটাও আশা। তবে এই আশা প্রশংসনীয়। এর অর্থ হচ্ছে নেক কাজ করার পর মনে মনে বলা- আশা করি আল্লাহ তা'আলা আমার এই ক্ষুদ্র আমল কবুল করবেন এবং এতে যে ত্রুটি হয়েছে তা মাফ করবেন। অর্থাৎ যে আশার মূলে নেক আমলের ভিত্তি থাকে, তাকে রজা বলে। এটা প্রশংসনীয় ও কাম্য। কুরআন ও হাদীছে এরূপ আশা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আর যে আশার মূলে কোনও ভিত্তি নেই অর্থাৎ তাওবা-ইস্তিগফার ছাড়াই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়ার আশা করা এবং নেক কাজ না করেই জান্নাত কামনা করা, এটা হচ্ছে তামান্না। এটা কাম্য নয়। হাদীছে এরই নিন্দা করা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেককেই কিছু না কিছু বুদ্ধি দিয়েছেন। সেই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আমাদের কর্তব্য মনমত না চলে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
খ. অন্যের পেছনে না পড়ে নিজ আমলের হিসাব নেওয়াই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা।
গ. আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও নাজাত লাভের আশায় প্রত্যেকের কর্তব্য তাঁর বিধান মোতাবেক জীবনযাপনে যত্নবান থাকা।
ঘ. আমলে উদাসীন থেকে নাজাত লাভের আশা করা চরম নির্বুদ্ধিতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা সময়ের মূল্যদানেরও শিক্ষা পাওয়া যায়। কার কখন মৃত্যু আসবে কেউ জানে না। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের জন্য আমল করাই যখন বুদ্ধিমানের কাজ, তখন প্রত্যেক বুদ্ধিমানের উচিত প্রতিটি মুহূর্ত আখিরাতের কাজে ব্যয় করা এবং একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট না করা।
নেক কাজে অগ্রগামী হওয়া এবং নেক কাজের প্রতি অভিমুখী ব্যক্তিকে উৎসাহ দেওয়া, যাতে সে দোদুল্যমানতা ত্যাগ করে দৃঢ়সংকল্পের সাথে তা শুরু করে দেয়
ইমাম নববী রহ. এ শিরোনামে দু'টি বিষয় উল্লেখ করেছেন:
ক. সৎকাজে অগ্রগামিতা;
খ. সৎকাজের ইচ্ছা জাগামাত্র গড়িমসি ত্যাগ করে তাতে মশগুল হয়ে যাওয়া।
সৎকাজে অগ্রগামিতা
সৎকাজ দ্বারা ছাওয়াব ও পুণ্য লাভ হয়। ছাওয়াব হচ্ছে আখিরাতের পাথেয়। যে যতবেশি ছাওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হবে তার আখিরাতের মুক্তি লাভের সম্ভাবনা ততবেশি । জান্নাতে মর্যাদার তারতম্য হবে ছাওয়াবের তারতম্য অনুযায়ী। যার যতবেশি ছাওয়াব অর্জিত হবে, জান্নাতে সে তত উচ্চমর্যাদার অধিকারী হবে। তাই দুনিয়ার অল্পদিনের আয়ুতে প্রত্যেকের উচিত নেক কাজে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। মানুষ পার্থিব বিষয়ে সাধারণত তা-ই করে। অল্পদিনের এ জীবনে সুখশান্তিতে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতার সাথে মেহনত করে। অথচ মেহনতের সুফল সে কতটুকু পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। নিষ্ফল প্রতিযোগিতায় অনেকেরই জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে আখিরাতও বরবাদ হয়। দু'দিনের জীবনে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশায় আখিরাত বরবাদ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ করে নিজ আখিরাত ঠিক রেখে। আখিরাত যেহেতু অনন্তকালের জন্য, তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত সেখানকার সাফল্য লাভে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। তাই কুরআন ও হাদীছে মানুষকে উৎসাহ দান করা হয়েছে তারা যেন আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণ লাভে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
সৎকাজে গড়িমসি না করা
যে-কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগামাত্রই তা করে ফেলা উচিত। কিছুতেই গড়িমসি ও অলসতা করা উচিত নয়। গড়িমসি করলে ইচ্ছা লোপ পেয়ে যায়। পরে নেক কাজ করার উৎসাহ পাওয়া যায় না। বুযুর্গানে-দীন বলেন, অন্তরে নেক কাজের ইচ্ছা জাগা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আগত মেহমানস্বরূপ। কোনও বাড়িতে যদি মেহমান আসে আর বাড়িওয়ালা তাকে আদরযত্ন ও সম্মান করে, তখন মেহমান তার বাড়িতে থাকতে আগ্রহবোধ করে এবং বার বার আসার উৎসাহ পায়। পক্ষান্তরে সে যদি দেখে বাড়িওয়ালা তাকে অবজ্ঞা করছে এবং তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাচ্ছে না, তবে সে খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় এবং পরে আর কখনও সেই বাড়িতে আসার আগ্রহ পায় না।
তদ্রূপ অন্তরে যখন কোনও নেক কাজের ইচ্ছা জাগে এবং সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কাজটি করে ফেলা হয়, তখন নতুন নতুন নেক কাজের ইচ্ছা জাগতেই থাকে। নেক কাজের ইচ্ছা যতবেশি পূরণ করা হয়, অন্তরে ততবেশি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। কোনও নেক কাজ আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করলে তাতে সহজে ক্লান্তিবোধ হয় না। ফলে অলসতাও দেখা দেয় না। নেক কাজের ইচ্ছা পূরণ করতে থাকলে অন্তর থেকে অলসতার রোগ নির্মূল হয়ে যায়। ফলে বেশি বেশি নেক কাজের সুযোগ হয় এবং অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার তাওফীক লাভ হয়। কুরআন ও হাদীছে তাই নানাভাবে বান্দাকে উৎসাহ যোগানো হয়েছে, যাতে সে নেক কাজের ইচ্ছা দেখামাত্রই অলসতা ছেড়ে তাতে মশগুল হয়ে পড়ে।
ইমাম নববী রহ. এ উভয় বিষয় সম্পর্কে কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত এর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আর সেগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দান করুন।
আলোচ্য বিষয়ের আয়াতসমূহ
এক নং আয়াত
فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ
অর্থ : তোমরা নেক কাজের প্রতি অগ্রগামী হও।সূরা বাকারা, আয়াত ১৪৮
ব্যাখ্যা
فَاسْتَبِقُوا শব্দটি الاستباق থেকে নির্গত। এর অর্থ কোনও কাজে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া এবং সকলকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকারের চেষ্টা করা। الْخَيْرَاتِ শব্দটি الخير -এর বহুবচন। এর অর্থ সৎকাজসমূহ। আয়াতে বলা হচ্ছে— তোমরা সৎকাজসমূহে একে অন্যকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান দখলের চেষ্টা কর। এমন নয় যে, কোনও একটি নেক কাজে অগ্রগামী হবে এবং অন্যসব নেক কাজে অলসতা করবে। বরং নিজ সাধ্যমত সকল নেক কাজেই সচেষ্ট থাকবে। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে নামায পড়া, রোযা রাখা, দান-সদাকা করা, হজ্জ ও উমরা করা- এগুলোই নেক কাজ। সন্দেহ নেই এগুলো অনেক বড় নেক কাজ এবং এগুলো অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু তাই বলে এগুলো করে ক্ষান্ত হলেই চলবে না। এর বাইরেও এমন অনেক কাজ আছে, কুরআন-হাদীছ যা করতে উৎসাহ দিয়েছে। যেমন বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, রোগীর সেবাযত্ন করা, বিপন্ন ব্যক্তির সাহায্য করা, অন্যের বোঝা তুলে দেওয়া, কারও জন্য সুপারিশ করা, অন্যকে সুপরামর্শ দেওয়া, পথ থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, ইয়াতীম ও বিধবার খোঁজখবর নেওয়া, শোকার্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা দেওয়া, বেশি বেশি সালাম দেওয়া, অন্যের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, জালেমকে জুলুম করতে বাধা দেওয়া, মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, অতিথির সেবা করা, মসজিদ- মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, দীনী ইলম বিস্তারে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি। বস্তুত নেক কাজের তালিকা অনেক দীর্ঘ। প্রত্যেকেরই উচিত নিজ সাধ্যমত তা আঞ্জাম দিয়ে যাওয়া। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সে উৎসাহই আমাদেরকে দান করেছেন।
দুই নং আয়াত
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ (133)
অর্থ : এবং তোমরা নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতুল্য। তা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৩৩
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দুটি জিনিস লাভের জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে মাগফিরাত, অন্যটি জান্নাত।
মাগফিরাত লাভের জন্য প্রতিযোগিতা
সাধারণভাবে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও ক্ষমালাভের উপায় তো হচ্ছে আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু আদেশ করেছেন তা সব পালন করা এবং যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এককথায় শরী‘আত মোতাবেক জীবনযাপন করা। তবে বিশেষ অর্থে মাগফিরাত দ্বারা গুনাহ মাফ করানো বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ যেসব কাজ করলে গুনাহ হয়, তার কোনওটি যদি করা হয়ে থাকে তবে আল্লাহর কাছ থেকে সে ব্যাপারে ক্ষমা পাওয়ার জন্য যা করণীয় তা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বান্দার গুনাহ মাফ করেন বিভিন্ন উপায়ে- যেমন, তাওবা করা, ফরয কাজ আদায় করা, কবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকা, দান-সদাকা করা, বিভিন্ন রকমের নফল আমল আঞ্জাম দেওয়া ইত্যাদি।
কোনও কবীরা গুনাহ হয়ে গেলে সে ব্যাপারে ক্ষমা পাওয়ার উপায় হচ্ছে তাওবা করা। বান্দার দ্বারা যত কঠিন গুনাহই হয়ে যাক, খাঁটি মনে তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেন। খাঁটি তাওবা কিভাবে হয়, এর জন্য কী কী শর্ত, সে সম্পর্কে পেছনে তাওবা অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে (১ম খণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, ৭৭-১৩৬পৃ.)। সেখানে দেখে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
কাফের ব্যক্তি যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এমনিভাবে হিজরত দ্বারাও পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ আল্লাহ তা'আলা মাফ করে দেন।
সগীরা গুনাহ মাফের বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। সহীহ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কেউ যদি সঠিকভাবে ওযু করে, তবে ওযূর অঙ্গসমূহ দ্বারা যে সমস্ত সগীরা গুনাহ করা হয়েছিল তা মাফ হয়ে যায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায দ্বারাও মধ্যবর্তী সময়ের সগীরা গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। জুমু'আর নামায দ্বারা ওই সমস্ত সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়, যা পূর্ববর্তী জুমু'আর পর বান্দা করে ফেলেছে। এমনিভাবে রমযান মাসে রোযা রাখার দ্বারাও বিগত বছরের সগীরা গুনাহসমূহ থেকে ক্ষমা পাওয়া যায়। হজ্জ সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ ও নিখুঁতভাবে হজ্জ সম্পন্ন করে, সে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মত পাপমুক্ত হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- কোনও ব্যক্তি যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তবে আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তার সগীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের একটা বড় উপায় হচ্ছে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা। নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি ইস্তিগফার করতেন। আমরা তো সগীরা-কবীরা সবরকম গুনাহই করে থাকি। তাই আমাদের আরও বেশি যত্নের সঙ্গে ইস্তিগফারে রত থাকা উচিত। ইস্তিগফার অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর সংক্ষিপ্ত আরবী বাক্য হচ্ছে- استغفرالله ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই’। বা رب اغفرلى وتب على , 'হে প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন'। এটা পড়া খুবই সহজ। আমরা চলতে-ফিরতে সর্বাবস্থায়ই এটি পড়তে পারি। কাজেই গুনাহ মাফের এমন সহজ উপায় কিছুতেই অবহেলা করা উচিত নয়।
এছাড়াও বিভিন্ন আমল সম্পর্কে হাদীছে জানানো হয়েছে, তা দ্বারা বান্দার সগীরা গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। আমাদের উচিত সে সমস্ত আমল সম্পর্কে জেনে নিয়ে ইখলাসের সঙ্গে তা পালন করা। গুনাহ ছোট হোক বা বড়, সবই ধ্বংসাত্মক। কাজেই তা থেকে ক্ষমা লাভের জন্য কুরআন ও হাদীছে যেসব উপায় শেখানো হয়েছে, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তা অবলম্বন করা উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
জান্নাত লাভের জন্য প্রতিযোগিতা
এ আয়াতে দ্বিতীয় যে বিষয়ের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার আদেশ করা হয়েছে, তা হচ্ছে জান্নাত। জান্নাত অফুরন্ত নি'আমতের জায়গা। জান্নাতের বাস অনন্তকালীন বাস। বান্দার আরাম আয়েশের জন্য আল্লাহ তা'আলা সেখানে যেসব ব্যবস্থা রেখেছেন, কুরআন ও হাদীছে তার অনেক বিবরণই দেওয়া হয়েছে। সেখানকার খাদ্য, পানীয়, আসবাবপত্র ও সেবকদের সম্পর্কে যেসব বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু সে বিবরণই শেষ নয়, এটা ধারণা দেওয়া হয়েছে মাত্র। প্রকৃত ধারণা তো সেখানে যাওয়ার পরই লাভ হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে সেজন্য কবূল করে নিন। আমীন।
জান্নাতের নি'আমত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- কোনও চোখ তা দেখেনি, কোনও কান তা শোনেনি এবং কোনও মানুষের অন্তর তা কল্পনাও করেনি। কুরআন মাজীদে জানানো হয়েছে- সেখানে বান্দা মুখে যা চাবে বা অন্তরে যা কল্পনা করবে তা সবই পাবে। বান্দার কোনও ইচ্ছাই সেখানে অপূরণ রাখা হবে না। ইচ্ছার বাইরেও অনেক কিছু তাকে দেওয়া হবে।
এ আয়াতে জান্নাত কত বড় তার একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তার প্রশস্ততা আসমান-যমীনের প্রশস্ততাতুল্য। আসমান-যমীনের প্রশস্ততা কী পরিমাণ তা আমরা জানি না। আমাদের কল্পনায় প্রশস্ততার সবচে' বড় পরিসর আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী দূরত্ব। এরচে' বেশি প্রশস্ততা কল্পনা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই আমাদের বোঝানোর জন্য জান্নাতের প্রশস্ততাকে আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী প্রশস্ততার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এর দ্বারা অনুমান করা যায় জান্নাতের প্রশস্ত আরও বেশি। যে-কোনও জিনিসের প্রশস্ততা অপেক্ষা দৈর্ঘ্য বেশি হয়ে থাকে। জান্নাতের প্রশস্ততাই যখন এত বড়, তখন তার দৈর্ঘ্য কতখানি হবে?
এ আয়াতে বলা হয়েছে- অফুরন্ত নি'আমতপূর্ণ এ সুবিশাল জান্নাত প্রস্তুত করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। কাজেই যারা জান্নাত লাভের আশা করে, তাদের একান্ত কর্তব্য নিজেদেরকে মুত্তাকীরূপে গড়ে তোলা। মুত্তাকী মানে পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ব্যক্তি। এরূপ ব্যক্তি কী কী গুণের অধিকারী হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ (134) وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ (135)
অর্থ : (মুত্তাকী ওই সকল লোক,) যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন। এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনও অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনওভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া আর কে-ইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৩৪-১৩৫
তাকওয়া সম্পর্কে পেছনে স্বতন্ত্র এক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে সেখানে দেখে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
ব্যাপক ফিতনাফাসাদ দেখা দেওয়ার আগে সৎকর্মে মনোনিবেশ করার জরুরত
হাদীছ নং: ৮৭
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা (সৎ) কর্মে অগ্রগামী হও। অচিরেই অন্ধকার রাতের খণ্ডসমূহের মত ফিতনাফাসাদ দেখা দেবে। তখন লোকে সকালবেলা মু'মিন থাকবে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে এবং সন্ধ্যাবেলা মু'মিন থাকবে, ভোরবেলা কাফের হয়ে যাবে। সে তার দীন বিক্রি করবে দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে।-মুসলিম সহীহ,, (মুসলিম, হাদীছ নং ১১৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৯৫; মুসনাদে আহমাদ,হাদীছ নং ৮০১৭)
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে প্রত্যেককে বর্তমান সময়কে কাজে লাগাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সময়কে কাজে লাগানোর উপায় হচ্ছে সৎকর্মে ব্যস্ত থাকা। সৎকর্ম বলতে ওই কাজকে বোঝানো হয়, যা শরী'আতসম্মত হয় এবং সে কাজ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিল করা উদ্দেশ্য হয়। এর মধ্যে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব সব আমলই দাখিল। এমনিভাবে এ আমল যেমন হতে পারে নামায, রোযা ও দান-সদাকা, তেমনি সৃষ্টির সেবা করা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা, দীন শেখানো ও দীনী ইলমের প্রচার করা, বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়ানো ইত্যাদি সবই হতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে ফরয-ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি যার পক্ষে যে দীনী কাজ করা সম্ভব হয়, সে কাজ এখনই শুরু করে দেওয়া উচিত। এ হাদীছ বলছে- আগামী দিনের অপেক্ষায় না থেকে নগদ সময়কে দীনী কাজে ব্যবহার কর। কারণ আগামী দিন এ সুযোগ না-ও পেতে পার। আমল করার জন্য ফিতনাফাসাদমুক্ত স্বস্তিকর সময় দরকার। সে সময় তোমার এখন আছে। ভবিষ্যতে না-ও থাকতে পারে। তখন আফসোসই করতে পারবে, কিন্তু আমল করা সম্ভব হবে না। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- অচিরেই ব্যাপক ফিতনাফাসাদ দেখা দেবে। তা নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক আসতেই থাকবে। তিনি তার তুলনা করেছেন অন্ধকার রাতের সঙ্গে। অন্ধকার রাতের এক অংশকে অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এমন নয় যে, কিছুক্ষণ অন্ধকার থাকার পর আলো দেখা দেয়, তারপর আবার অন্ধকার আসে। বরং টানা অন্ধকার চলতেই থাকে। ক্ষণিক সময় অন্ধকার থাকার পর আবার যে সময় আসে সেটাও অন্ধকারই হয়। সমস্ত রাত এভাবেই চলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে যে ফিতনাসমূহ আসবে, তা অন্ধকার রাতের অংশসমূহের মতই হবে। অর্থাৎ এক ফিতনা শেষ হওয়ামাত্র অন্য ফিতনা দেখা দেবে। মাঝখানে কোনও বিরতি পাওয়া যাবে না যে, সেই বিরতির সময় আমল করবে। প্রথম ফিতনায় যেমন দিশেহারা ছিলে, কোনও আমলের সুযোগ পাওয়া যায়নি, তদ্রূপ পরবর্তী ফিতনায়ও অস্থিরতার মধ্যেই কাটাতে হবে। না ফিতনা অবস্থায় আমলের সুযোগ পাবে, না এমন কোনও বিরতি পাওয়া যাবে যখন আমলের অবকাশ হবে। সুতরাং সেই সময় আসার আগে এখনই আমলে মশগুল হয়ে পড়। হাদীছে যে ফিতনার কথা বলা হয়েছে তা নানারকম হতে পারে। যেমন মুসলিম জাতির মধ্যে পারস্পরিক মারামারি-হানাহানি। তা দীনী বিষয় নিয়েও হতে পারে, দুনিয়াবী বিষয় নিয়েও। দীনী বিষয় নিয়ে এভাবে ফিতনা দাঁড়াতে পারে যে, কেউ কুরআন ও হাদীছের অপব্যাখ্যা করে একটি নতুন দল সৃষ্টি করল। তার কিছু অনুসারীও জুটে গেল। তারা সে নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য উগ্রপন্থা অবলম্বন করল আর এভাবে সমগ্র জাতির ভেতর মহাফাসাদ সৃষ্টি হয়ে গেল। অতীতে খারিজী, মু'তাযিলা, বাতিনী প্রভৃতি ফেরকার দ্বারা মুসলিম সমাজে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের ফিতনা তো এখনও পর্যন্ত চালু আছে। তাদের বাইরেও মুসলিম উম্মাহকে বাহাঈ, কাদিয়ানী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ফিতনা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে সবচে' বড় ফিতনা হয় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। অতীতে অনেক সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের জন্য মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। সেসব গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য ইসলামী খেলাফতকে বিপুল শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে। আজও দেশে দেশে ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে নানারকম দলাদলির জাঁতাকলে আম জনতাকে পিষ্ট হতে হচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের লড়াই সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ধ্বংস করছে। এমন বহু অঞ্চল আছে, যেখানে ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। সেসব অঞ্চলের মানুষ নেক কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায় না। কিভাবে ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করবে, এমনকি কিভাবে প্রাণ রক্ষা করবে, সেই উপায় সন্ধানেই তাদের জীবন সারা। ফিতনাফাসাদ হতে পারে বাইরের শত্রুর আক্রমণ দ্বারা। মুসলিম রাষ্ট্রের উপর অমুসলিম রাষ্ট্র আগ্রাসন চালাতে পারে। বর্তমানে সেরকম আগ্রাসন বহুদেশে চলছে। অতীতেও অনেক হয়েছে। আবার একই দেশের মধ্যে অমুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারা মুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হতে পারে। হতে পারে জাতিগত নিধনের স্বীকার, যেমনটা সম্প্রতি রোহিঙ্গা মুসলিমগণ হয়েছে। এর আগে হয়েছে পূর্ব ইউরোপের বসনিয়ায়। তার আগে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। এখনও বহু দেশ আপন আপন সীমানার ভেতর মুসলিম জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার নীলনকশা তলে তলে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চক্রান্তের ভেতর যে সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিন কাটছে, তারা জানে শান্তি ও নিরাপত্তা কী অমূল্য সম্পদ! তার অভাবে কী কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাদের সময় যাচ্ছে এবং এ অবস্থায় দীন ও ঈমান রক্ষা তাদের পক্ষে কী দুরূহ!! প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী এ হাদীছে করেছেন, ইতোমধ্যে তার বাস্তবায়নও হয়ে গেছে। একইসঙ্গে সারা মুসলিম জাহানে না হলেও একেক বার একেক অঞ্চলে এমন টানা ফিতনাফাসাদ দেখা দিয়েছে যে, তখন সাধারণ জনগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতেই হিমশিম খেয়েছে। এ অবস্থায় নফল আমল তো দূরের কথা, ফরয ইবাদত-বন্দেগী পালন করাই তো প্রায় অসম্ভব। এরকম পরিস্থিতি যে-কোনও সময় যে-কোনও এলাকায়ই দেখা দিতে পারে। তাই যারা এখনও শান্তি ও নিরাপত্তার ভেতর দিন কাটাতে পারছে, তাদের কর্তব্য, এ অবস্থাকে আল্লাহ তা'আলার মহানি‘আমত গণ্য করা এবং সে নি‘আমতের শোকরস্বরূপ ফরয-ওয়াজিবের পাশাপাশি যথাসম্ভব নফল ইবাদত-বন্দেগীও করতে থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। ফিতনা কত ভয়াবহ হবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মানুষ সকালবেলায় মু'মিন থাকবে কিন্তু সন্ধ্যাকালে কাফের হয়ে যাবে! আবার সন্ধ্যাকালে মু'মিন থাকবে কিন্তু ভোরবেলা কাফের হয়ে যাবে!! এ কাফের হওয়াটা আক্ষরিক অর্থেও হতে পারে এবং রূপকার্থেও হতে পারে। আক্ষরিক অর্থে কাফের হওয়া মানে তো ঈমানহারা হয়ে যাওয়া। আর রূপকার্থে কাফের হওয়া মানে কাফেরসুলভ কাজ করা। এ হাদীছে দুই অর্থের যে-কোনও অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়ার লোভলালসায় পড়ে অথবা জুলুমনির্যাতনের কারণে সম্পূর্ণরূপে বেঈমান হয়ে যাবে। অথবা বেঈমান না হলেও বেঈমানদের মত কাজকর্ম করবে। এর ধরন কী রকম হতে পারে, সামনের বাক্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের বিনিময়ে দীন ও ঈমান বিক্রি করে দেবে। দুনিয়ার তুচ্ছ স্বার্থে দীন ও ঈমান বিক্রি করার নজির অতীতে দেখা গেছে। কখনও এমন হয়েছে যে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে খ্রিষ্টান শাসক বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিল আর সেই সুযোগসুবিধা পেয়ে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়ে গেল। এমনও হয়েছে যে, মুসলিম শাসক পুরোপুরি দীনের উপর নেই। সে কোনও ভ্রান্ত মতাদর্শের অনুসারী। সে জনগণের উপর সেই ভ্রান্ত মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চাইল। তখন কেউ তার প্রলোভনে পড়ে সেই ভ্রান্ত মতাদর্শ গ্রহণ করে নিল এবং কেউ তা গ্রহণ করল রক্তচক্ষুতে প্রভাবিত হয়ে। একশ্রেণির ‘উলামায়ে-ছু’ (علماء سوء)-কে দেখা গেছে পার্থিব সুযোগসুবিধার লোভে সরকারের মনমত ফাতওয়া দিয়েছে। সরকার কোনও ভ্রান্তপথ অবলম্বন করলে তারা কুরআন-হাদীছের অপব্যবহার করে তা বৈধ ও সঠিক বলে প্রচার করেছে। এমনটা দেখা গেছে বনু আব্বাসিয়া'র শাসনামলে বাগদাদে। দেখা গেছে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষে। বরং আল্লাহ ও আখিরাতের ভয়ডরহীন শাসকচক্র সব সময়ই নিজেদের হীন স্বার্থে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে থাকে। আর তাদের প্রলোভনে পড়ে একশ্রেণির আলেম, সত্যিকার অর্থে 'আলেম' উপাধির উপযুক্ত যারা আদৌ নয়, সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে তারা উলামায়ে-ছু। হাদীছটির ভবিষ্যদ্বাণী তাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য। যে-কোনও প্রলোভনকে উপেক্ষা করার জন্য অনেক শক্ত ঈমানের প্রয়োজন। সে ঈমান যাদের নেই তারা লোভলালসার ফাঁদে পড়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অন্তরে ঈমানী দৃঢ়তা দান করুন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. ফিতনাফাসাদহীন নিরাপদ ও স্বস্তিকর সময় অনেক বড় নি'আমত। প্রত্যেকের উচিত সেই নি'আমতকে কাজে লাগানো। খ. কোনও নেক কাজে গড়িমসি করা উচিত নয়। কেননা জানা নেই আগামী দিন তা করার সুযোগ পাওয়া যাবে কি না। গ. সর্বাবস্থায় দীন ও ঈমান মজবুতভাবে ধরে রাখা উচিত, যাতে পার্থিব কোনও প্রলোভনে পড়ে তার ক্ষতিসাধন করা না হয়।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন