রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
নাজাত লাভের উপায়
হাদীছ নং : ৮৬
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা ভারসাম্য বজায় রাখ এবং এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাক। জেনে রেখ, তোমাদের কেউ নিজ আমল দ্বারা মুক্তি পাবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও না? তিনি বললেন, আমিও না, যদি না আল্লাহ তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করে নেন। মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭০৬৫; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২০১; মুসনাদে আহমাদ,হাদীছ নং ৯৮৩২, ১০০১০, ১১৪৮৫, ১৪৬২৮)
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
قاربوا শব্দটি المقاربة থেকে গঠিত। এর অর্থ মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য, যাতে কোনও বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্য নেই। সুতরাং,قاربوا অর্থ- দীনের ব্যাপারে তোমরা ভারসাম্য বজায় রাখ। কুরআন ও সুন্নাহ যে বিশ্বাস যেভাবে পোষণ করতে বলেছে এবং যে আমল যেভাবে করতে বলেছে ঠিক সেভাবেই কর। তার বেশিও করো না, কমও করো না। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়ো না। এটাই দীনের ব্যাপারে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য। سددوا শব্দটি السداد থেকে গঠিত। এর অর্থ ইস্তিকামাত। অর্থাৎ সঠিক ও বিশুদ্ধ হওয়া এবং স্থায়িত্ব লাভ করা। বোঝানো হচ্ছে— তোমরা দীনের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর ও তাতে স্থির থাক। কোনও অবস্থায়ই মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করো না। কেউ কেউ বলেন, السداد অর্থ কথা, কাজ ও উদ্দেশ্য সঠিক হওয়া। এ তিনওটি সঠিক হলে তাকে বলা হয় ইস্তিকামাত। এগুলো সঠিক হওয়া মানে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া। ইমাম নববী রহ. “উলামায়ে কিরামের বরাত দিয়ে বলেন, তাদের মতে ইস্তিকামাতের অর্থ নিয়মিতভাবে আল্লাহর অনুগত হয়ে চলা। অর্থাৎ তাঁর সকল আদেশ মান্য করা এবং যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা পরিহার করা। “উলামায়ে কিরাম আরও বলেন, এটি 'জাওয়ামিউল কালিম' (جوامع الكلم)-এর অন্তর্ভুক্ত। জাওয়ামিউল কালিম বলা হয় এমন সারগর্ভ কথাকে, যাতে শব্দ কম কিন্তু অর্থ অতি গভীর ও ব্যাপক। এটা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্ট্য ছিল। অল্প কথায় তাঁর ব্যাপক ভাব প্রকাশ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। قاربوا وسددوا এর যে ব্যাখ্যা উপরে উল্লেখ করা হল, তা ইমাম নববী রহ.-এর দেওয়া। তিনি হাদীছটি উল্লেখ করার পর এ শব্দ দু'টির এরকম ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ‘উলামায়ে কিরাম সাধারণত سددوا এর ব্যাখ্যা করেন এভাবে যে, এর মূল হচ্ছে যার অর্থ বিশুদ্ধতা ও সঠিকতা। সে হিসেবে سددوا এর অর্থ- তোমরা চেষ্টা করবে যাতে তোমাদের আমল যথাসম্ভব সঠিক হয় অর্থাৎ শরী'আত মোতাবেক হয়। তাঁরা قاربوا সম্পর্কে বলেন যে, এর উৎপত্তি قرب থেকে, যার অর্থ নৈকট্য। সুতরাং , এর অর্থ- তোমরা বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা কর। অর্থাৎ তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেন, শরী'আতের যাবতীয় বিধান ঠিক যেভাবে বলা হয়েছে শতভাগ সেভাবে পালন করতে পারবে না, কিছু না কিছু ত্রুটি হয়েই যাবে। হয়তো তাতে বাড়াবাড়ি ঘটবে, নয়তো শিথিলতা দেখা দেবে। ঠিক মাঝখানে অর্থাৎ শরী'আত যেভাবে বলেছে হুবহু সেভাবে পারবে না। তবে সতর্ক থাকবে যাতে হুবহু না পারলেও বেশি দূরে সরে না যাও। যথাসম্ভব বিশুদ্ধতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে। মোটকথা মানুষের প্রতি শরী'আতের আদেশ হচ্ছে- সকল বিধানে যথাসম্ভব কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমলের চেষ্টা করা, ইচ্ছাকৃতভাবে তাতে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা না করা। আল্লাহর রহমতই জান্নাত লাভের একমাত্র উপায় তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ নিজ আমল দ্বারা কিছুতেই মুক্তিলাভ করতে পারবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও নন? বললেন, আমিও না, যদি না আল্লাহ তা'আলা নিজ রহমত ও মেহেরবানী দ্বারা আমাকে ঢেকে নেন! প্রশ্ন দাঁড়ায়, কুরআন মাজীদে তো জান্নাতকে আমলের প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (72) অর্থ : এটাই সেই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে তোমাদের কর্মের বিনিময়ে।সূরা যুখরুফ, আয়াত ৭২ অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ অর্থ : : তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর। সূরা নাহল, আয়াত ৩২ এ আয়াতের সাথে হাদীছের স্পষ্ট বিরোধ মনে হয়। এর উত্তর কী? ‘উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। যেমন : ক. আমল নাজাত ও জান্নাতলাভের বাহ্যিক কারণ। প্রকৃত কারণ আল্লাহ তা'আলার তাওফীক। আল্লাহ তা'আলা নিজ রহমতে বান্দাকে ঈমান ও আমলে সালিহার তাওফীক দিয়ে থাকেন। তাঁর রহমত না হলে কারও ভাগ্যে ঈমান জুটত না এবং কেউ কোনও নেক কাজ করতে পারত না। হাদীছে সেই বাস্তবতার প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে আর কুরআন মাজীদের আয়াতে আমলকে জান্নাত লাভের কারণ বলা হয়েছে কেবলই বাহ্যিক অবস্থা হিসেবে। সেইসঙ্গে তা দ্বারা বান্দাকে আমলের প্রতি উৎসাহিত করাও উদ্দেশ্য। বান্দা যখন জানতে পারবে সে যতবেশি আমল করবে ততই জান্নাতলাভের বেশি সম্ভাবনা, তখন সে বেশি বেশি আমল করার উৎসাহ বোধ করবে। খ. এক হল জান্নাত লাভ করা, আরেক হচ্ছে জান্নাতের বিভিন্ন নি'আমত ও উচ্চমর্যাদা হাসিল হওয়া। তো জান্নাতলাভের ব্যাপারটা নির্ভর করে কেবলই আল্লাহ তা'আলার রহমতের উপর। আর জান্নাতের বিভিন্ন নি'আমত ও উচ্চমর্যাদা হাসিল হবে আমলের বিনিময়ে। হাদীছে মূল জান্নাতলাভের কথা বলা হয়েছে যে, তা হবে কেবলই আল্লাহর রহমত দ্বারা। আর কুরআন মাজীদের আয়াতে জান্নাতের বিভিন্ন নি'আমত ও মর্যাদা লাভের কথা বোঝানো হয়েছে। গ. মূলত আল্লাহর রহমতই জান্নাতলাভের মূল কারণ। তবে বান্দা নেক আমলের দ্বারা আল্লাহ তা'আলার রহমতলাভের উপযুক্ত হয়, যদিও নেক আমলের পেছনেও আল্লাহর রহমত কার্যকর থাকে। তো যেহেতু নেক আমল আল্লাহর রহমত লাভের কারণ হয় আর রহমত দ্বারা জান্নাত পাওয়া যায়, সে হিসেবে কোথাও নেক আমলকে জান্নাত লাভের কারণ বলা হয়েছে এবং কোথাও আল্লাহর রহমতকে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। ঘ. আল্লাহ তা'আলার কাছে নেক আমলের বদলা পাওয়ার জন্য সে আমল কবুল হওয়া জরুরি। আল্লাহর কাছে কবুল না হলে যত বড় আমলই হোক তার কোনও মূল্য নেই। কবূল করার বিষয়টা কেবলই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ তা'আলার শানের বিপরীতে বান্দার আমল নিতান্তই তুচ্ছ। তা সত্ত্বেও যে আল্লাহ তা কবুল করে নেন, এটা কেবলই তাঁর রহমত। সেদিকে লক্ষ করেই বলা হয়েছে- আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। আবার যেহেতু তিনি নিজ রহমতে আমল কবুল করেন, তারপর সে আমলের বিনিময়ে জান্নাত দান করেন, সে হিসেবে জান্নাতলাভের সাথে আমলের একটা সম্পর্ক আছে। সে সম্পর্কের ভিত্তিতেই কুরআন মাজীদে জান্নাতলাভকে আমলের প্রতিদানরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহর রহমত থেকে বেনিয়াজ নয় কেউ। বান্দা যত বড়ই হোক সে আল্লাহর রহমতের সৃষ্টি এবং তার যত সৎগুণ তা আল্লাহরই দান। সে হিসেবে যে যত বড় তার শোকর আদায়ের দায়ও ততবেশি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টির সেরা। মানবীয় সকল গুণের শ্রেষ্ঠতম স্তরে তিনি অধিষ্ঠিত। আল্লাহ নিজ রহমতেই তাঁকে তা দান করেছেন। তাই আল্লাহ তা'আলার প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতার বোধও ছিল তাঁর ভেতর সবচে' বেশি। জীবনভর তিনি কৃতজ্ঞতা আদায়ে সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর অত্যধিক আমলের প্রতি তাকিয়ে কেউ যখন বিস্ময় বোধ করেছে, তখন তিনি বলে উঠেছেন- আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতরাশির প্রতি লক্ষ করলে প্রত্যেকের বেলায় এ কথা সত্য যে, তার সারা জীবনের আমলও যদি আল্লাহর দেওয়া নি'আমতের বিপরীতে রাখা হয়, তবে শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ের দায় শেষ হয়ে যায় না। এ অবস্থায় তার জান্নাতলাভ হবে। কিসের বিনিময়ে? সেজন্য আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কী উপায় থাকতে পারে? আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে যে কত নি'আমত দান করেছেন, প্রত্যেক নি'আমতের যে কী মূল্য, সে হিসেবে কী পরিমাণ শোকর আদায় করা দরকার এবং বাস্তবিকপক্ষে তা আদায় করা কার পক্ষে কতটুকু সম্ভব, সে কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপেক্ষা কে বেশি বুঝত? কার পক্ষেই বা তাঁর মত বোঝা সম্ভব? তিনি যে বলেছেন- আল্লাহর রহমত ছাড়া আমিও জান্নাতে যেতে পারব না, এটা তাঁর সেই বুঝ ও বোধেরই প্রকাশ। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. প্রত্যেক আমলের ক্ষেত্রেই চেষ্টা করা উচিত। যাতে কোনও বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা না হয়ে যায় এবং মধ্যপন্থা অর্থাৎ শরী'আত যেভাবে শিক্ষা দিয়েছে ঠিক সেভাবেই আমল করা হয়। খ. নিজ আমলকে সর্বদাই তুচ্ছ মনে করা উচিত, দেখতে তা যত বড় ও বেশিই মনে হোক না কেন। কেননা আল্লাহর কাছে কবুল হওয়াই আসল কথা। ককূল না হলে কোনও আমলের কিছুমাত্র মূল্য নেই। গ. কোনও আমলের কারণে যাতে আত্মতুষ্টি ও বড়ত্বভাব সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা অবশ্যকর্তব্য, যেহেতু আল্লাহর রহমত ছাড়া কোনও আমলই কোনও কাজের নয়। ঘ. আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। নিজ আমলকে তুচ্ছ গণ্য করার পাশাপাশি তাঁর রহমতেরও আশা রাখা চাই। তিনি নিজ রহমত ও দয়ায় আমার তুচ্ছ আমলও কবূল করে তার অপরিমিত বিনিময় দান করতে পারেন।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন