রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৮৫

পরিচ্ছেদঃ ইস্তিকামাত ও অবিচলতা।

‘ইস্তিকামাত’- এর ব্যাখ্যা

ইস্তিকামাত (الاستقامة) -এর অর্থ সোজা হওয়া। স্থির ও অবিচল থাকা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, ইস্তিকামাত অর্থ সরল-সঠিক পন্থা আঁকড়ে ধরে রাখা। অর্থাৎ সরলতা ও অবক্রতার সাথে অবিচলতা যুক্ত হলে তা হয় ইস্তিকামাত। ইসলাম সরল সঠিক ধর্ম। এতে কোনও বক্রতা নেই। এ পথ সোজা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ পথে চললে সোজা জান্নাতে পৌছা যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়। তবে সেজন্য দরকার এ পথে অবিচল থাকা অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা।
হযরত 'উমর রাযি. বলেন- ইস্তিকামাত এই যে, তুমি সদাসর্বদা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, তা থেকে শেয়ালের মত এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করবে না। অর্থাৎ অনুসরণ করতে হবে কেবলই আল্লাহর বিধান তথা দীনে ইসলামের, যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদের দিয়েছেন। আর সে অনুসরণ করতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এমন নয় যে, ইসলামের উপর কিছুক্ষণ চললাম আবার কিছুক্ষণ থেমে থাকলাম বা অন্যপথে চললাম। একবার এ পথে আসার পর মৃত্যু পর্যন্ত আর অন্যদিকে ফিরে তাকানো যাবে না। একটানা এ পথেই চলতে হবে এবং বিশ্বাস রাখতে হবে এ পথে চলা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে পারলেই মুক্তি ও জান্নাতলাভ হবে। সুতরাং অটুট বিশ্বাসের সাথে মৃত্যু পর্যন্ত সরল-সঠিক পথ তথা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই হচ্ছে ইস্তিকামাত। তাহলে ইস্তিকামাতের ভিত্তি দুই জিনিসের উপর–

ক. আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান;

খ. জাহিরী ও বাতিনীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো দীনের স্থায়ী অনুসরণ।
এ দুই ভিত্তির দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় দীনে ইসলামের সম্পূর্ণটাই ইস্তিকামাতে অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহর প্রতি অটুট ঈমান বলতে আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক সবকিছুকেই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে ইস্তিকামাতের জন্য জরুরি হল- আকীদা-বিশ্বাসের যত ধারা আছে তার প্রতিটিতে সবরকম বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করা এবং কুরআন-সুন্নাহে যেমনটা বলা হয়েছে ঠিক সেভাবেই তা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হলে পথভ্রষ্টতা দেখা দেয়। ইসলামের আগে যত ধর্ম ছিল তার অনুসারীরা কেন বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কেউ তা হয়েছে ছাড়াছাড়ি কবলে পড়ে। কালক্রমে সেসব ধর্ম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলেছে। তা হারানোর আসল কারণ ইস্তিকামাতের উপর না থাকা। ইস্তিকামাত পরিহার করার কারণে এই উম্মতের মধ্যেও বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজও ইসলামের প্রতিটি আকীদায় প্রকৃত শিক্ষার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। সর্বশেষ দীন হওয়ায় শেষপর্যন্ত তা থাকবেও ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ আকীদা-বিশ্বাস হেফাজতের প্রতি যত্নবান থাকা, যাতে কোনওরকম বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হয়ে ইস্তিকামাত থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়ি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সঠিক বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারি।
এমনিভাবে শরী'আত তথা ইসলামী বিধানাবলির প্রতিটি ধারায়ও ইস্তিকামাতের ব্যাপারটা এসে যায়। বাহ্যিক বিধানাবলি তথা আল্লাহর হক ও বান্দার হক সংক্রান্ত প্রতিটি বিধিবিধান নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে রেখে গেছেন, কোনওরকম হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া ঠিক সেভাবে মেনে চললে তা ইস্তিকামাতরূপে গণ্য হবে।
বাতিনী বিধানাবলি তথা আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে শিক্ষা বর্ণিত আছে, ইস্তিকামাতের জন্য তাও হুবহু অনুসরণের চেষ্টা করা জরুরি। আখলাক-চরিত্রের ক্ষেত্র অতি ব্যাপক। ইসলামী শিক্ষায় সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্রের দীর্ঘ তালিকা আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল মানুষের সাথে ভালো ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষায় রয়েছে মন্দ আচরণ পরিহার করে চলার জোর তাগিদ। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যবহারিক জীবন আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা। তিনি আপন-পর ও শত্রু-মিত্রের সাথে আচার আচরণসহ চরিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্যমান দৃষ্টান্ত পেশ করে গেছেন, মানুষের ইতিহাসে যার কোনও নজির নেই। তাঁর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমেই একজন মানুষের পক্ষে সত্যিকারের চরিত্রবান হওয়া সম্ভব।
আজ সারাবিশ্বে মানুষের চরিত্র চরম অবক্ষয়ের শিকার। আমরা মুসলিম জাতিও সে অবক্ষয় থেকে মুক্ত নই। এর একমাত্র কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া ভারসাম্যমান চারিত্রিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকা। আমরা তাঁর চারিত্রিক শিক্ষা যথাযথভাবে অনুসরণও করছি না। এদিক-ওদিক ঝুঁকে পড়ছি। হয় কার্পণ্য, নয়তো অপব্যয়; হয় মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা, নয়তো অনুচিত নমনীয়তা; হয় পুরোপুরি সংসারমুখিতা, নয়তো সম্পূর্ণ বৈরাগ্য- এভাবে সকল ক্ষেত্রে কোনও একদিকে হেলে পড়ার নীতি অবলম্বন করে আমরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। তাই বিপর্যয় নেমে এসেছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে দীনের উপর ইস্তিকামাতের যে তাগিদ কুরআন-সুন্নাহে দেওয়া হয়েছে, আমাদের প্রত্যেককে তাতে মনোযোগী হতে হবে।
কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে ইস্তিকামাতের আদেশ করা হয়েছে। তা দ্বারা এর গুরুত্ব ও ফযীলত উপলব্ধি করা যায়। এ সম্পর্কে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদীছ। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি।

ইস্তিকামাত সম্পর্কিত আয়াত

এক নং আয়াত আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْت

হে নবী! তোমাকে যেভাবে হুকুম করা হয়েছে সে অনুযায়ী সরল পথে স্থির থাক এটি সূরা হূদের একটি আয়াতের অংশবিশেষ। পূর্ণ আয়াতটি নিম্নরূপঃ

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

অর্থ : সুতরাং (হে নবী!) তোমাকে যেভাবে হুকুম করা হয়েছে, সে অনুযায়ী নিজেও সরল পথে স্থির থাক এবং যারা তাওবা করে তোমার সঙ্গে আছে তারাও। আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই তোমরা যা-কিছুই কর, তিনি তা ভালোভাবে দেখেন। সূরা হুদ, আয়াত ১১২

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যারা তাওবা করে তাঁর সঙ্গে ছিলেন, সেই সাহাবায়ে কিরামকে ইস্তিকামাতের আদেশ করেছেন। বলা হচ্ছে যে, হে নবী! আপনার প্রতিপালক আপনাকে যে দীন দিয়েছেন, আপনি সে দীনের উপর তাঁর আদেশ মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত থাকুন, তাঁর অনুসরণ করুন এবং মানুষকে সেদিকে ডাকুন।
প্রকাশ থাকে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর আদেশের উপর সদা প্রতিষ্ঠিত ছিলেনই, কখনও তা থেকে একচুল সরেননি। তা সত্ত্বেও যে, তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে তা দ্বারা ইস্তিকামাতের তাকীদ বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আপনি আল্লাহর আদেশ পালনে যেমন অবিচল আছেন, সদাসর্বদা তেমনি থাকুন।
এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারা উম্মতকে বোঝানো উদ্দেশ্য। তারা যেন দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে, এখানে মূলত সে আদেশই করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। অর্থাৎ তিনি তো আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ পালনে স্থির অবিচল ছিলেনই। তা সত্ত্বেও যখন তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে, তখন সে অবিচলতা রক্ষায় তাঁর উম্মতের তো আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত।
হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এমনিতে ইস্তিকামাত তো ছোট্ট একটি শব্দ, কিন্তু এর অর্থের ভেতর রয়েছে বিশাল ব্যাপকতা। কেননা এর অর্থ হচ্ছে- 'আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, ব্যবসাবাণিজ্য,আখলাক-চরিত্র, আচারব্যবহার, আয়ব্যয় প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ জাল্লা শানুহু যে সীমারেখা এঁকে দিয়েছেন সেই সীমারেখার ভেতর থেকে তাঁর প্রদর্শিত সরলপথে চলতে থাকা। এর কোনও ক্ষেত্রে কোনও কাজে কোনও অবস্থায়ই কোনও একদিকে ঝুঁকে পড়লে বা কমবেশি হয়ে গেলে তখন আর ইস্তিকামাত বাকি থাকে না।
দুনিয়ায় যত গোমরাহী ও দুষ্কর্ম দেখা দেয়, তা সবই ইস্তিকামাত থেকে সরে যাওয়ার পরিণাম। আকায়েদের ক্ষেত্রে ইস্তিকামাত না থাকলে বিদ'আত শুরু হয়ে যায়। এমনকি তা কুফর পর্যন্ত গড়ায়। আল্লাহ তা'আলার তাওহীদ এবং তাঁর জাত ও সিফাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভারসাম্যমান ও বিশুদ্ধ মূলনীতি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে শৈথিল্য ও সীমালঙ্ঘন বা কমবেশি করার পরিণাম গোমরাহী ছাড়া কিছু নয়, তা যত নেক নিয়তেই করা হোক না কেন। নবীগণের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা প্রদর্শনের যে সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তাতে যারা শিথিলতা প্রদর্শন করে তারা যে পথভ্রষ্ট ও বেআদব সাব্যস্ত হয় তা তো সকলেই জানে। কিন্তু যারা তাতে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করে তারাও যে চরম পথভ্রষ্টতার শিকার হয় এ ব্যাপারে সকলে সচেতন নয়। ভক্তি-ভালোবাসায় সীমালঙ্ঘন করে রাসূলকে আল্লাহর গুণ ও ক্ষমতার মালিক বানিয়ে দেওয়া কতই না কঠিন গোমরাহী। ইহুদী ও খ্রিষ্টসম্প্রদায় এ কারণেই পথভ্রষ্ট হয়েছে।
ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে পন্থা কুরআন-সুন্নাহ নির্ধারণ করে দিয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য যেমন মানুষকে ইস্তিকামাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তেমনি তাতে কোনওরূপ সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়িও ইস্তিকামাত বরবাদ করে দেয়। আর এর পরিণামে মানুষ বিদ'আতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। নেক নিয়তের কারণে লোকে মনে করে আমি এর মাধ্যমেই আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করছি। প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহ তা'আলার নারাজির কারণ হয়ে থাকে...।
এমনিভাবে লেনদেন ও আখলাক চরিত্রের সকল ক্ষেত্রে কুরআন-বর্ণিত মূলনীতির ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে এক ভারসাম্যমান ও বিশুদ্ধ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাতে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা, কোমলতা ও কঠোরতা, ক্রোধ ও সহনশীলতা, কার্পণ্য ও বদান্যতা, জীবিকা উপার্জন ও সংসারবিমুখতা, আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও সম্ভাব্য ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় আসবাব-উপকরণ সংগ্রহ ও প্রকৃত দাতা আল্লাহর প্রতি দৃষ্টি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে এমন এক ভারসাম্যমান সরলপথ এ উম্মতকে দান করা হয়েছে, যার নজির আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। তা অবলম্বনের মাধ্যমেই মানুষ কামেল ও পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে। পক্ষান্তরে এ ক্ষেত্রে ইস্তিকামাত থেকে সরে যাওয়ার পরিণামেই সমাজে বহুমুখী বিপর্যয় দেখা দেয়।
মোটকথা ইস্তিকামাত এমন এক পূর্ণাঙ্গ শব্দ, দীনের সকল শাখাপ্রশাখা যার অন্তর্ভুক্ত। আর সেসবের বিশুদ্ধ আমল হচ্ছে এর ব্যাখ্যা।তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন ৪র্থ খণ্ড, ৬৭০-৬৭১ পৃষ্ঠা।

وَلَا تَطْغَوْا - সীমালঙ্ঘন করো না। সীমালঙ্ঘন করা হচ্ছে ইস্তিকামাতের বিপরীত কাজ। প্রথমে ইতিবাচকভাবে ইস্তিকামাতের হুকুম দেওয়ার পর এ শব্দের মাধ্যমে তার বিপরীত কাজকে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা ইস্তিকামাত যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে জানানো হচ্ছে- দীনের কোনও ক্ষেত্রেই শরী'আতের সীমারেখার বাইরে চলে যেও না; বরং শরী'আত যে সীমারেখা স্থির করে দিয়েছে তার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখ তথা পূর্ণাঙ্গ দীনের উপর অবিচল ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাক।

দুই নং আয়াত

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ (32)

অর্থ : যারা বলেছে, আমাদের রব্ব আল্লাহ! তারপর তারা তাতে থাকে অবিচলিত, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে (এবং বলবে) যে, তোমরা কোনও ভয় করো না এবং কোনও কিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের সুসংবাদে, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত। আমরা পার্থিব জীবনেও তোমাদের বন্ধু ছিলাম এবং আখিরাতেও থাকব। জান্নাতে তোমাদের জন্য আছে এমন সবকিছুই, যা তোমাদের অন্তর চাবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে এমন সব কিছুই, যার ফরমায়েশ তোমরা করবে, অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (আল্লাহ)-এর পক্ষ হতে প্রাথমিক আতিথেয়তাস্বরূপ।সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ৩০-৩২

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহ দ্বারা ইস্তিকামাতের গুরুত্ব ও ফযীলত জানা যায়। শুরুতে বলা হয়েছে- إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا

যারা বলে আমাদের রব্ব আল্লাহ এবং তাতে অবিচলিত থাকে।
অর্থাৎ যারা খাঁটিমনে আল্লাহ তা'আলাকে নিজেদের রব্ব বলে বিশ্বাস করে এবং মুখে তা স্বীকার করে, অতঃপর তাতে অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফিরিশতা নাযিল হয়। ফিরিশতা নাযিল হওয়া এবং তাদের পক্ষ থেকে সুসংবাদ শোনানোর বিষয়টা ঈমান ও ইস্তিকামাতের পুরস্কার। আমাদের রব্ব আল্লাহ বলার দ্বারা দৃঢ় ঈমানের কথা বোঝানো হয়েছে। আর তাতে ইস্তিকামাত ও অবিচলতার অর্থ হচ্ছে ঈমানের দাবি মোতাবেক কাজ করা।
কুরআন-হাদীছে 'ইবাদত-বন্দেগী ও আমল-আখলাকের যে সুদীর্ঘ ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা সবই ঈমানের দাবি। যে ব্যক্তি আল্লাহকে নিজের রব্ব বলে ঘোষণা করবে তার কর্তব্য সে দাবি পূরণ করা অর্থাৎ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত 'ইবাদত-বন্দেগী ও আমল-আখলাকের প্রতি যত্নবান থাকা। তাতে যত্নবান থাকার দ্বারাই মূলত ঈমানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা যায়। কেননা আমল-আখলাকে ত্রুটির দ্বারা ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয়। নিজ ঈমানকে শক্তিশালী ও অটুট রাখতে হলে আমলে যত্নবান থাকা অপরিহার্য।
নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি সৎ আমলে যত্নবান থাকবে সে সর্বপ্রকার গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকবে। শিরক ও সগীরা কবীরা সর্বপ্রকার গুনাহ পরিহার করে চলবে। পূর্বে হযরত উমর ফারূক রাযি. থেকে ইস্তিকামাতের যে ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তার সারমর্মও এটাই। এ কারণেই উলামায়ে কিরাম বলেন, ইস্তিকামাত শব্দটি ছোট হলেও গোটা ইসলামী শরী'আত এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যা-কিছু আদেশ-নিষেধ বর্ণিত হয়েছে তা যে ব্যক্তি পুরোপুরি পালন করবে তার সম্পর্কে বলা যাবে যে, সে ইস্তিকামাতের উপর আছে। তার মানে দাঁড়ায় পুরোপুরিভাবে ইসলামের মধ্যে দাখিল হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অবিচল থাকাই হচ্ছে ইস্তিকামাত। তাই তো হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, ইস্তিকামাত এই যে, তুমি সমস্ত কাজে আল্লাহর আনুগত্য করবে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকবে। সুতরাং শব্দটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর মর্মার্থ অতি ব্যাপক। তাই এর ফযীলতও অনেক বেশি, যেমনটা আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে।

ইস্তিকামাতের পুরস্কার

১. تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَيْكَةُ

নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের কাছে ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে কখন? এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবন 'আব্বাস রাযি. বলেন, মৃত্যুকালে। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয়। যেমন, হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا احْتُضِرَ أَتَتْهُ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ بِحَرِيرَةٍ بَيْضَاءَ فَيَقُولُونَ: اخْرُجِي رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً عَنْكِ إِلَى رَوْحِ اللَّهِ، وَرَيْحَانٍ، وَرَبٍّ غَيْرِ غَضْبَانَ

যখন মুমিন ব্যক্তি মৃত্যুসন্ধিক্ষণে পৌঁছে, তখন রহমতের ফিরিশতাগণ সাদা রেশমি কাপড় নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা বলে, হে আত্মা! বের হয়ে এস সন্তুষ্ট ও সস্তোষভাজন হয়ে। এস আল্লাহর দেওয়া শান্তি ও আরামের দিকে, ক্রুদ্ধ নয় এমন রব্বের দিকে। আল-মুসতাদরাক, হাদীছ নং ১৩০২; দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৫৩৪
হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. সূত্রে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীছে আছে-

الْمُؤْمِنَ إِذَا حَضَرَهُ الْمَوْتُ بُشِّرَ بِرِضْوَانِ اللهِ وَكَرَامَتِهِ، فَلَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا أَمَامَهُ؛ فَأَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ وَأَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ،

মুমিন ব্যক্তির যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যায়, তখন তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর সম্মানের সুসংবাদ দেওয়া হয়। তখন তার কাছে তার সামনের বিষয়াবলির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছু থাকে না। ফলে সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎ পসন্দ করে এবং আল্লাহ তা'আলাও তার সাক্ষাৎ পসন্দ করেন।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০৭। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৮৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৮৩৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪২৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২০৪৭
কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত আছে, ফিরিশতাদের আগমন হবে মানুষ যখন কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানের দিকে অগ্রসর হবে তখন। ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রহ বলেন, তাদের কাছে ফিরিশতা হাজির হবে তিনবার-
ক. মৃত্যুকালে;
খ. কবর থেকে উঠার সময়;
গ. হাশরের ময়দানে। বস্তুত এ তিনও মতই সঠিক। নেককার মু'মিনদেরকে সুসংবাদ দান করা এবং তাদের মনে শক্তি ও স্বস্তি যোগানোর জন্য এ তিনও অবস্থায়ই ফিরিশতাদের আগমন ঘটবে।

২. أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ

(এবং তারা বলবে) যে, তোমরা কোনও ভয় করো না এবং কোনওকিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত।

এখানে তিনটি কথা বলা হয়েছে-

ক. ‘তোমরা কোনও ভয় করো না।’ অর্থাৎ মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী অবস্থার জন্য ভয় করো না। অথবা এর অর্থ- তোমরা তোমাদের ভালো ও মন্দ কর্মের ব্যাপারে ভয় করো না। ভালো কাজের ব্যাপারে এই ভয় করো না যে, তোমাদেরকে তার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হবে। তোমাদের আমল আল্লাহ কবুল করেছেন। সুতরাং তোমরা
তার পুরস্কার পাবেই। আর মন্দ কাজের ব্যাপারে এই ভয় করো না যে, তোমাদেরকে তার শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা তোমরা যেহেতু ঈমানের উপর অবিচল ছিলে ও সৎকর্মে প্রতিষ্ঠিত ছিলে, সেহেতু অসতর্কতাবশত হয়ে যাওয়া গুনাহের কারণে তোমাদেরকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে না। কোনও কবীরা গুনাহ করে থাকলে তাওবার কারণে তাও মাফ হয়ে গেছে। কাজেই তোমাদের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা।

খ. ‘এবং কোনওকিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না।’ অর্থাৎ যে আওলাদ ও ওয়ারিশগণকে দুনিয়ায় রেখে যাচ্ছ তাদের ব্যাপারে এই চিন্তা করো না যে, দুনিয়ায় তাদের কিভাবে চলবে এবং কে তাদের দেখাশোনা করবে। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জীবিত অবস্থায়ও তোমাদের এবং তাদের সকলের প্রতিপালন আল্লাহ তা'আলাই করতেন। তোমরা তাঁরই হেফাজত ও তত্ত্বাবধানে ছিলে। তোমাদের মৃত্যুর পরও তিনিই তাদের দেখাশোনা করবেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই তারা থাকবে।
এর অর্থ এমনও হতে পারে যে, তোমরা তোমাদের গুনাহের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ো না। কেননা ঈমান ও ইস্তিকামাতের কারণে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেবেন। সেজন্য তোমাদেরকে কোনও শাস্তি ভোগ করতে হবে না।

গ. ‘আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত।’ অর্থাৎ যে-কেউ বলে আমার রব্ব আল্লাহ এবং আল্লাহর দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, সে জান্নাতবাসী হবে। নবী-রাসূলগণের জবানীতে এরূপ লোকদেরকে দুনিয়ার জীবনে এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। তাঁর প্রতিশ্রুতির কখনও ব্যতিক্রম হয় না।
বর্ণিত আছে যে, মু'মিন বান্দাকে যখন তার কবর থেকে উঠানো হবে তখন তার সাথে ওই দুই ফিরিশতা মিলিত হবে, যারা দুনিয়ার জীবনে তার সঙ্গে থাকত। তখন তারা তাকে বলবে, ভয় করো না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। এভাবে আল্লাহ তা'আলা তাকে ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করবেন এবং তার চোখ জুড়িয়ে দেবেন।


৩. نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ

“আমরা পার্থিব জীবনেও তোমাদের সাথী-বন্ধু ছিলাম এবং আখিরাতেও থাকব।” এটাও ওই ফিরিশতাগণের কথা, যারা সুসংবাদদানের জন্য মু'মিন ব্যক্তির কাছে আসবে। তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় তোমার সঙ্গী হয়ে থাকতাম এবং আমরা তোমার বন্ধু ছিলাম। আমরা শয়তানদের কবল থেকে তোমাদের রক্ষা করতাম এবং তোমাদেরকে নেক কাজের প্রতি উৎসাহিত করতাম। আমাদের সে বন্ধুত্ব দুনিয়ায়ই শেষ হয়ে যায়নি,আখিরাতেও আমরা তোমাদের বন্ধু হয়ে থাকব। তোমরা যতক্ষণ না জান্নাতে প্রবেশ কর, ততক্ষণ আমরা তোমাদের ছেড়ে যাব না। এভাবে ফিরিশতাগণ তাদেরকে ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করবেন।


৪. وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ

“জান্নাতে তোমাদের জন্য আছে এমন সবকিছুই, যা তোমাদের অন্তর চাবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে এমন সব কিছুই যার ফরমায়েশ তোমরা করবে।” অর্থাৎ তোমাদের অন্তর যা-কিছু আনন্দ ও মর্যাদা লাভ করতে চাবে তা সবই জান্নাতে দেওয়া হবে এবং তোমরা যে-কোনও চাহিদা প্রকাশ করবে তাও মেটানো হবে। মোটকথা তোমাদের সকল কামনা-বাসনা পূরণ করে দেওয়া হবে, তোমরা মুখে প্রকাশ কর বা না-ই কর।

৫. نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ

“অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (আল্লাহ)-এর পক্ষ হতে প্রাথমিক আতিথেয়তাস্বরূপ”
এর দ্বারা বোঝা যায় জান্নাতে মু'মিন ব্যক্তি মুখে যা চাবে এবং মনে মনে যা কামনা করবে তার বাইরেও তাকে অনেক কিছু দেওয়া হবে। প্রাথমিক আতিথেয়তায়ই যখন মনের সব ইচ্ছা পূরণ করে দেওয়া হবে, তখন পরবর্তী পরিবেশনা কী রকম হবে তা কি ভাবা যায়? এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থ : সুতরাং কোনও ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বরূপ চোখ জুড়ানোর কত কী উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সূরা আলিফ-লাম-মীম সাজদা, আয়াত ১৭
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

قَالَ اللهُ تَعَالَىأَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ، وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ

“আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমনসব নি'আমত প্রস্তুত রেখেছি, যা কোনও চোখ দেখেনি, কোনও কান শোনেনি এবং কোনও মানুষের অন্তর কল্পনাও করেনি। সহীহ বুখারী হাদীছ নং ৩২৪৪, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮২৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১৯৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪৩২৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮১৪৩, ৮৮২৭, ৯৬৪৯

আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে ঈমান ও আমলে সালিহার উপর ইস্তিকামাত দান করুন, আমীন।

তিন নং আয়াত

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (13) أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (14)

অর্থ : নিশ্চয়ই যারা বলেছে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, তারপর এতে অবিচল থেকেছে, তাদের কোনও ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা, তারা যা করত তার প্রতিদানস্বরূপ।সুরা আহকাফ,আয়াত ১৩-১৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতেও পূর্বের আয়াতের মত ঈমান ও ইস্তিকামাতের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর এর ফযীলত বর্ণিত হয়েছে যে, যারা ঈমান ও ইস্তিকামাতের উপর থাকবে তাদের কোনও ভয় ও চিন্তা নেই। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও অপ্রিয় অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা তাদের নেই এবং যে আওলাদ ও ওয়ারিশগণকে দুনিয়ায় রেখে যাবে, তাদের ব্যাপারেও কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আল্লাহ তা'আলাই তাদের অভিভাবকত্ব করবেন।
তারপর সুসংবাদ শোনানো হয়েছে যে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী হবে এবং তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। তাদেরকে জান্নাত থেকে বেরও করে দেওয়া হবে না এবং তাদেরকে আর কখনও মৃত্যুরও সম্মুখীন হতে হবে না। জান্নাতে তারা চিরসুখের অনন্ত জীবন লাভ করবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও এ ফযীলত লাভের তাওফীক দান করুন, আমীন।

ইস্তিকামাতের গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৮৫

হযরত আবূ ‘আমর বা আবূ ‘আমরা সুফয়ান ইবন ‘আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইসলাম সম্পর্কে আমাকে এমন কোনও কথা বলে দিন, যে সম্পর্কে আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করব না। তিনি বললেন, বল- আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম। তারপর (তুমি এর উপর) সুপ্রতিষ্ঠিত থাক। -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১০; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৪১৬)

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছটি দ্বারা ইস্তিকামাতের গুরুত্ব বোঝা যায়। হযরত সুফয়ান ইবন 'আব্দুল্লাহ রাখি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দীন ও শরী'আত সম্পর্কে এমন কোনও পূর্ণাঙ্গ কথা জানতে চেয়েছেন, যা দীনের যাবতীয় বিষয় শামিল করবে এবং এমন স্পষ্ট হবে যে, সে সম্পর্কে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়বে না। তাঁর সে জিজ্ঞাসার উত্তরেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষিপ্ত এ বাণীটি পেশ করেন। তিনি এতে দু'টি কথা বলেছেন। প্রথমে বলেছেন- বল, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম। অর্থাৎ তুমি তোমার ঈমানকে নবায়ন কর। তুমি যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখ সে কথা বার বার স্মরণ কর, হৃদয়মনে তা জাগ্রত করে তোল এবং মুখেও তা উচ্চারণ কর। সেইসঙ্গে 'হাদীছে জিবরীল'-এর ভেতর ঈমানের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেদিকেও লক্ষ রাখ। তারপর বলেছেন- ‘এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাক।' ঈমানের উপর ইস্তিকামাতের সাথে থাকা বা তার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার মানে শরী'আতের যাবতীয় আদেশ ঠিক সেইভাবে মানা, যেভাবে তা মানতে বলা হয়েছে। তাতে কোনওরকম কমবেশি না করা, কোনও একদিকে সরে না যাওয়া এবং কোনওরকম বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের শিকার না হওয়া। সেইসঙ্গে যা-কিছু নিষেধ করা হয়েছে তা থেকেও পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকা। নিঃসন্দেহে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ হাদীছ। এতে শব্দ কম হলেও এর অর্থ অতিব্যাপক । গোটা ইসলামই এর মধ্যে এসে গেছে। ইসলাম সম্পর্কে যাদের জানা আছে তারা একটু লক্ষ করলেই এ হাদীছের গভীরতা ও ব্যাপকতা বুঝতে পারে। এ সংক্ষিপ্ত হাদীছ তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম স্মরণ করিয়ে দেয়। এ হাদীছটি স্মরণ করলেই পূর্ব ইসলামের ছবি তাদের অন্তরে ভেসে ওঠে। তারা বুঝতে পারে এর মানে হচ্ছে পরিপূর্ণরূপে ইসলামের মধ্যে দাখিল হয়ে যাওয়া। সুতরাং স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে হযরত সুফয়ান ইবন 'আব্দুল্লাহ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যে অনুরোধ রেখেছিলেন, এ সংক্ষিপ্ত বাণীর মাধ্যমে তা পূরণ হয়ে গেছে। হাদীছটির গভীরতা ও ব্যাপকতার প্রতি লক্ষ করেই 'উলামায়ে কিরাম বলেন, এটি ওই অল্পসংখ্যক হাদীছসমূহের অন্যতম, সমগ্র ইসলাম যার মধ্যে কেন্দ্রীভূত। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বীর আহমাদ ‘উছমানী রহ. বলেন, এটি অত্যন্ত সারগর্ভ হাদীছসমূহের একটি। ইসলামের মৌলিক ও শাখাগত যাবতীয় বিষয় এর মধ্যে শামিল রয়েছে। ইসলামের সর্বপ্রধান মৌলিক বিষয় হচ্ছে তাওহীদ। امنت بالله -এর মধ্যে রয়েছে সেই তাওহীদের বাণী । তারপর ثم استقم এর মধ্যে এসে গেছে গোটা শরী'আত। কেননা ইস্তিকামাত হচ্ছে সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নাম। এর মধ্যে অন্তর ও বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কিত সকল বিধান চলে আসে...। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা তাওহীদের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই আমার রব্বু— এটা ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মূল ভিত্তি। প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য সদাসর্বদা এ বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতন থাকা। খ. ঈমানের পর ইস্তিকামাত তথা ঈমানের দাবি অনুযায়ী শরী'আতের যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে চলাই হওয়া উচিত একজন মু'মিনের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু । এ হাদীছ সে শিক্ষাই আমাদের দান করে।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন