রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
অধ্যায় ৫
মুরাকাবা-সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণ।
৬৫। বনী ইসরাইলের তিন ব্যক্তির ঘটনা:

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন- বনী ইসরাঈলে তিনজন লোক ছিল। একজন কুষ্ঠরোগী, একজন টাকওয়ালা ও একজন অন্ধ। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সুতরাং তিনি একজন ফিরিশতা তাদের কাছে পাঠালেন। ফিরিশতা কুষ্ঠরোগীর কাছে আসলেন। তাকে বললেন, তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু কোনটি? সে বলল, সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক এবং লোকে এই যে (রোগের) কারণে আমাকে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্তিলাভ। ফিরিশতা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে তার রোগ নিরাময় হল এবং তাকে সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক দেওয়া হল। তারপর ফিরিশতা বললেন, কোন সম্পদ তোমার কাছে সবচে বেশি প্রিয়? সে বলল, উট। অথবা বলল, গরু। এ ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে। তো তাকে গাভীন উটনী দেওয়া হল। ফিরিশতা বললেন, আল্লাহ তোমাকে এতে বরকত দিন।
তারপর ফিরিশতা টাকওয়ালার নিকট আসলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়বস্তু কী? সে বলল, সুন্দর চুল আর লোকে আমাকে এই যে (টাকের) কারণে ঘৃণা করে, তা থেকে মুক্তি। ফিরিশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে তার রোগ থেকে নিরাময় লাভ হল এবং তাকে সুন্দর চুল দেওয়া হল। তারপর বললেন, কোন সম্পদ তোমার কাছে সবচে' বেশি প্রিয়? সে বলল, গরু। তাকে একটি গাভীন গরু দেওয়া হল। ফিরিশতা দু'আ করলেন, আল্লাহ তোমাকে এতে বরকত দিন।
তারপর ফিরিশতা অন্ধ লোকটির কাছে আসলেন। তাকে বললেন, কোন বস্তু তোমার সবচে' বেশি প্রিয়? সে বলল, আমার সবচে' বেশি প্রিয় বিষয় এই যে, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবেন, যাতে আমি লোকজন দেখতে পাই। ফিরিশতা তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। ফলে আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। তারপর ফিরিশতা বললেন, কোন সম্পদ তোমার সবচে' বেশি প্রিয়? সে বলল, ছাগল। তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেওয়া হল ।
তারপর উট ও গাভী বাচ্চা দিতে থাকল। ছাগলটিও বাচ্চা দিতে লাগল। তাতে প্রথম লোকটির এক মাঠ ভরা উট হয়ে গেল, দ্বিতীয় ব্যক্তির এক মাঠ ভরা গরু হয়ে গেল আর তৃতীয় লোকটির এক মাঠ ভরা ছাগল হয়ে গেল।
তারপর ফিরিশতা কুষ্ঠ লোকটির কাছে তার রূপ ও বেশে আসল এবং বলল, আমি একজন মিসকীন লোক। আমার সফরের অবলম্বন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া, অতঃপর তোমার সাহায্য ছাড়া আজ আমার গন্তব্যে পৌঁছার কোনও উপায় নেই। যিনি তোমাকে সুন্দর রং, সুন্দর ত্বক ও সম্পদ দিয়েছেন, তাঁর নামে আমি তোমার কাছে একটি উট চাচ্ছি, যাতে আমি সফরের প্রয়োজন সমাধা করতে পারি। সে বলল, (আমার উপর অনেকের) অনেক হক রয়েছে (তোমাকে দেওয়ার মত অতিরিক্ত কিছু নেই, অন্য কোথাও দেখ)। তখন ফিরিশতা বললেন, আমি যেন তোমাকে চিনি। তুমি কি একজন কুষ্ঠরোগী ছিলে না যে, লোকে তোমাকে ঘৃণা করত? ছিলে না গরীব, তারপর আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দান করেছেন? সে বলল, আমি তো এ সম্পদ প্রজন্ম পরম্পরায় লাভ করেছি। ফিরিশতা বললেন, তুমি যদি তোমার দাবিতে মিথ্যুক হয়ে থাক, তবে আল্লাহ তোমাকে তুমি যেমন ছিলে তেমন করে দিন।
তারপর ফিরিশতা টাকওয়ালার কাছে তার রূপ ও তার বেশে আসলেন। তারপর তাকেও ওই লোকটির মত একই কথা বললেন এবং সেও তার মত একই উত্তর দিল। শেষে তিনি বললেন, তুমি যদি মিথ্যুক হয়ে থাক, আল্লাহ তাআলা তোমাকে ওইরকম করে দিন, যেমন তুমি পূর্বে ছিলে ।
তারপর অন্ধ লোকটির কাছে তার রূপে ও তার বেশে আসলেন। তাকে বললেন, আমি একজন গরীব মানুষ ও একজন পথিক। সফরে আমার সব পাথেয় শেষ হয়ে গেছে। আজ আল্লাহ ছাড়া এবং তোমার সাহায্য ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছার কোনও উপায় আমার নেই। তোমার কাছে আমি সেই আল্লাহর নামে একটি ছাগল চাচ্ছি, যিনি তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমি সফরের প্রয়োজন সমাধা করতে পারি। সে বলল, ঠিকই আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তুমি যা চাও নিয়ে নাও আর যা ইচ্ছা রেখে যাও। আল্লাহর কসম! আজ আল্লাহ ওয়াস্তে তুমি যাই নেবে, তাতে তোমাকে বারণ করব না। ফিরিশতা বললেন, তোমার মাল তুমিই রেখে দাও। বস্তুত তোমাদের পরীক্ষা করা হয়েছে। আল্লাহ তোমার প্রতি খুশি হয়েছেন এবং তোমার সাথীদ্বয়ের প্রতি নাখোশ হয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বনী ইসরাঈল বলা হয় হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বংশধরদেরকে। ‘ইসরাঈল' হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের আরেক নাম। তিনি হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের পুত্র। হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ছোট ভাই। তাঁরা উভয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র। বর্তমানে বনী ইসরাঈল বলতে ইহুদীদেরকে বোঝায়। কুরআন মাজীদে ও হাদীছে তাদের বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা নিজেদের হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী বলে দাবি করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছে। তারা তাওরাত গ্রন্থও বিকৃত করে ফেলেছে।

এ হাদীছে তাদের তিন ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা পরীক্ষা করেছিলেন। তিনজনই ছিল নিতান্ত গরীব এবং একেকজন একেক রোগে আক্রান্ত। মানুষ তাদের ঘৃণা করত। আল্লাহ তা'আলা তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে যায়। হয়ে যায় অনেক সম্পদের মালিক। এ পরিবর্তনের জন্য তাদের কর্তব্য ছিল আল্লাহর শোকর আদায় করা। প্রত্যেকের উচিত ছিল অতীতের দুরাবস্থার কথা স্মরণ রেখে বর্তমান সুখের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা ও আপন আপন সম্পদের হক আদায় করা। কিন্তু এ কর্তব্যকর্ম তাদের মধ্যে মাত্র একজনই উপলব্ধি করেছিল। সে যথারীতি আল্লাহর শোকরগুযারী করে এবং আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে যত্নবান থাকে। কিন্তু বাকি দু'জন ছিল এর বিপরীত। অবস্থা পরিবর্তনের পর তারা বিগত জীবনের কথা মনে রাখেনি। তারা যে একদিন গরীব ছিল, ছিল মারাত্মক রোগে আক্রান্ত, তা বেমালুম ভুলে যায়। সম্পদের মোহে পড়ে ভুলে যায় তার প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাকেও। ফিরিশতা এসে যখন তাদের কাছে সাহায্য চাইল, তখন সাহায্য তো করলই না, উল্টো তাদের অতীত দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে দাবি করে বসল, তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই ধন-দৌলতের মালিক। হঠাৎ করে ধনী হয়ে যায়নি। এ যেন কারূনের কথারই প্রতিধ্বনি। তাকে যখন তার সম্পদ থেকে গরীব-দুঃখীকে দান করতে বলা হল, সে ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলেছিল কেন তা করবে? সে তো ধন-দৌলতের মালিক নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি বলেই হয়েছে। তার প্রতি এটা কারও দান নয়। কুরআন মাজীদে তার কথা বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي

"সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি।"

অর্থাৎ এ সম্পদ আমি আল্লাহর কাছ থেকে পাইনি। এ দুই ব্যক্তিও বলল, এ সম্পদ পুরুষানুক্রমে পেয়েছি। অর্থাৎ তাতে যেন আল্লাহর কোনও হাত নেই। কত বড় অকৃতজ্ঞতা! তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ ছিল। ফিরিশতা তাদের প্রত্যেকের কাছে এসেছিলেন তাদের অতীত রূপ ও অতীত বেশভূষা নিয়ে। অন্ধের কাছে অন্ধ হয়ে, কুষ্ঠীর কাছে কুষ্ঠীরূপে এবং টেকোর কাছে টেকোবেশে। এ রূপ দেখে তারা মনে করতে পারত, একদিন তারাও এরকম ছিল। তাদের কিছুই ছিল না। নিতান্তই দরিদ্র ছিল। আল্লাহ তা'আলাই নিজ করুণায় তাদের রোগমুক্তিও দান করেছেন এবং দিয়েছেন অঢেল সম্পদ। অন্ধ লোকটি তা ঠিকই মনে করেছিল এবং স্বীকার করেছিল একদিন সে নিতান্ত গরীব ছিল। ছিল অন্ধ। আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তার অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তারপর সে সাহায্য প্রার্থীকে খালি হাতেও ফিরিয়ে দেয়নি। তাকে তার যা দরকার, নিজ ইচ্ছামত নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু অপর দু'জন অকৃতজ্ঞতা দেখায়। দাবি করে বসে, আগে থেকেই তারা ধনী ছিল। তারা তাকে কিছুই দিল না। নানারকম খরচের অজুহাত দেখাল, যেমনটা সবকালের কৃপণরা করে থাকে। তারা চিন্তা করেনি ধন-সম্পদ ও আরোগ্য দিয়ে আল্লাহ তা'আলা হয়তো তাদের পরীক্ষা করছেন যে, তারা শোকর আদায় করে কি না। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নানাভাবেই পরীক্ষা করে থাকেন। কখনও পরীক্ষা করেন সুস্থতা দিয়ে, কখনও অসুস্থতা দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন দারিদ্র্য দিয়ে, কখনও ধন-সম্পদ দিয়ে। কখনও পরীক্ষা করেন ভয়-ভীতির সম্মুখীন করে, কখনও স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিয়ে। এক অবস্থায় কাম্য সবর করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা। তা করতে পারলেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা অকৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আল্লাহর পরীক্ষায় ফেল করেছে। এর জন্য আখিরাতে যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা তো রয়েছেই, দুনিয়ায়ও তাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

ফিরিশতা তাদের বলল, তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে মিথ্যুক হও, তবে আল্লাহ তা'আলা যেন তোমাদেরকে আগের মতই করে দেন। সন্দেহ নেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেছিলেন। আগেও তো তাঁর দু'আ কবুল করে তাদের সুস্থ করেছিলেন এবং ধন-সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও তাঁর দু'আ বৃথা যাওয়ার কথা নয়। ফলে হয়তো আগের মত কুষ্ঠী ও টেকো হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদ হারিয়ে ফকীর বনে যায়। অকৃতজ্ঞের পরিণাম এমনই হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

لين شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَبِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيد

“তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ আমার শাস্তি অতি কঠিন।”

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

ক. সুস্থতা-অসুস্থতা এবং দারিদ্র্য ও ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে দেখা উচিত। সেই হিসেবে এক অবস্থায় কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা, অন্য অবস্থায় শোকর আদায় করা।

খ. নিজের অতীত কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অবস্থাকে শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত। অকৃতজ্ঞতার পরিণাম হয় অত্যন্ত অশুভ।

গ. কৃতজ্ঞতা দ্বারা নি'আমত বৃদ্ধি পায়।

ঘ. কৃপণতা একটি কঠিন আত্মিক ব্যাধি। এর ফলে মানুষ নাশোকরিতে লিপ্ত হয় ও মিথ্যাচার করে। সুতরাং কৃপণতা পরিহার করা উচিত।

ঙ. বিশ্বাস করা উচিত যে, নিজ অর্থ-সম্পদে গরীবেরও হক আছে। প্রত্যেকের কর্তব্য সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা এবং কখনও কাউকে বঞ্চিত না করা।

চ. অন্তরে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান জাগরুক রাখা উচিত। তিনিই সবকিছুর প্রকৃত দাতা- এ কথা স্মরণ রাখলে নিজের জান-মাল সবকিছু তাঁর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা সহজ হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন