রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬১
অধ্যায় ৫
মুরাকাবা-সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণ।
মুরাকাবা-সর্বাবস্থায় আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণ।
৬১। যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো:
হযরত আবু যর জুনদুব ইবনে জুনাদা রাযি. ও হযরত আবু আব্দুর রহমান মুআয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো এবং মন্দ কাজের পর নেককাজ করো। তা ওই মন্দকাজ মিটিয়ে দেবে। আর মানুষের সাথে আচরণ করো উত্তম চরিত্রের সাথে।
ইমাম তিরমিযী রহ. এ হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ। (হাদীস নং ১৯৮৭)
হযরত আবু যর জুনদুব ইবনে জুনাদা রাযি. ও হযরত আবু আব্দুর রহমান মুআয ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো এবং মন্দ কাজের পর নেককাজ করো। তা ওই মন্দকাজ মিটিয়ে দেবে। আর মানুষের সাথে আচরণ করো উত্তম চরিত্রের সাথে।
ইমাম তিরমিযী রহ. এ হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ। (হাদীস নং ১৯৮৭)
5 - باب المراقبة
61 - الثاني: عن أبي ذر جُنْدُب بنِ جُنادَةَ وأبي عبدِ الرحمانِ معاذِ بنِ جبلٍ رضي الله عنهما، عن رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «اتَّقِ الله حَيْثُمَا كُنْتَ وَأتْبعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ». رواه الترمذي، (1) وَقالَ: «حديث حسن».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি উপদেশ দান করেন। প্রতিটি উপদেশ অতি মূল্যবান। এর অনুসরণ দ্বারা একজন ব্যক্তির গোটা জীবন পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবনের নমুনা হয়ে উঠতে পারে।
প্রথম উপদেশ
তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহকে ভয় করতে হবে এ কারণে যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অন্তর্জামী। তিনি সবকিছু দেখেন এবং তিনি সর্বশক্তিমান। তাঁর কাছ থেকে কেউ কিছু লুকাতে পারে না। মানুষ যত গোপনেই কোনও অপরাধ করুক না কেন, তা আর কেউ না দেখুক আল্লাহ তা'আলা ঠিকই দেখেন। মানুষ চোরাচোখে যা দেখে, অন্তরে যা কল্পনা করে তাও আল্লাহর অগোচরে থাকে না। তিনি লক্ষ রাখছেন মানুষ কখন কোথায় কী করছে। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।” নিসা: ১
বান্দার আমলের প্রতি তাঁর সতর্ক দৃষ্টি রাখা এমনিই তো নয়। তিনি আখিরাতে প্রতিটি কাজের কৈফিয়ত নেবেন। প্রত্যেককে তার প্রতিটি কাজের উপযুক্ত বদলা দেবেন। ইরশাদ হয়েছে--
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (7) وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ (8)
"সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।" যিলযাল: ৭-৮
এ অবস্থায় কোনও বুদ্ধিমান কি তাঁকে ভয় না করে পারে? আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يُحذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسه
"আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে তাঁর নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন।"
অন্যত্র ইরশাদ-
واتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
"তোমরা ভয় করো সেই আল্লাহকে, যাঁর কাছে তোমাদেরকে একত্র করা হবে।"
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ۖ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
“এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে যা সে অর্জন করেছে, আর তাদের প্রতি কোনোরূপ জুলুম করা হবে না।"
কুরআন মাজীদে তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহকে ভয় করা সম্পর্কে প্রচুর আয়াত আছে। মাঝেমধ্যেই তিনি মানুষকে তার মৃত্যু, কবরের জীবন, হাশরের ময়দানে উত্থান, আল্লাহর সামনে হাজিরা, হিসাব-নিকাশ, পাপ-পুণ্যের ওজন এবং জাহান্নাম ও তার দূর্বিষহ শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছেন, যাতে তারা পার্থিব জীবনে সতর্ক হয়ে চলে, পাপাচার থেকে দূরে থাকে ও সৎকর্মে মনোযোগী হয়। সুতরাং সবকালে সকল বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীজন তাঁকে ভয় করে আসছে। আল্লাহ সম্পর্কে যে যতবেশি জেনেছে, সে তাঁকে ততবেশি ভয় করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্কে বলেন, তোমাদের মধ্যে আমিই আল্লাহকে সবচে' বেশি জানি এবং আমিই তাঁকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভয় করি। আমাদের কর্তব্য তাঁকে সদাসর্বদা ভয় করে চলা।
আল্লাহকে ভয় করার মানে কী? এর মানে পরহেযগার হয়ে চলা। অর্থাৎ তিনি যা-কিছু আদেশ করেছেন তা পরিপূর্ণরূপে পালন করা, যা-কিছু নিষেধ করেছেন তার ধারেকাছেও না যাওয়া। আর এ সবকিছুতেই ইখলাসের পরিচয় দেওয়া। অর্থাৎ তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে কেবল তাঁরই ভয়ে, তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তা করতে হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণে।
আল্লাহর আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে শরীআত বলে। শরী'আত অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই শরী'আতের কোনও না কোন বিধান আছে। ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ও সমাজ জীবন সম্পর্কে। বিধান আছে প্রকাশ্যে লোকসম্মুখে থাকা অবস্থায় এবং আছে একান্তে নিভৃতে নির্জনে এ হাদীস বলছে, জীবনের এ সকল ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করো ও তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলো।
দ্বিতীয় উপদেশ
কোনো মন্দকাজ হয়ে যাওয়ার পর অবিলম্বে সৎকাজ করো। মন্দকাজের পরে সৎকাজ করলে মন্দকাজ মিটে যায় ও তা মাফ হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ
"নিশ্চয়ই সৎকর্ম অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়।"
অধিকাংশ মানুষের দ্বারাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভুলত্রুটি হয়ে যায়। মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় এবং নফসের কুমন্ত্রণার শিকার হয়। ফলে কখনও কখনও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার যে সমস্ত কাজের হুকুম দেওয়া হয়েছে তা করতে অলসতা করে। এভাবে তার দ্বারা নানারকম গুনাহ হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা চান বান্দা গুনাহের বোঝা নিয়ে কবরে না আসুক। যে-কোনও উপায়ে তার পাপের পঙ্কিলতা ধুয়ে সাফ হয়ে যাক। তারই ব্যবস্থা হিসেবে নেককাজের হুকুম দিয়েছেন। নেককাজ দ্বারা গুনাহের পঙ্কিলতা মুছে যায়, যেমন উপরের আয়াতে বলা হয়েছে। তাওবা- ইস্তিগফারও একটি নেক কাজ; বরং অতিবড় নেক কাজ। যত বড়ই পাপী হোক, তাওবা-ইস্তিগফার করলে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেন। সুতরাং কোনও গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর বান্দার উচিত অবিলম্বে তাওবায় রত হওয়া।
ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُولَٰئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا
"আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের তাওবা কবুল করেন যারা অজ্ঞতাবশত কোনও গুনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়।" নিসা ১৭
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে –
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوا مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا إِنَّ رَبَّكَ مِن بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
'তোমার প্রতিপালক এমন যে, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে এবং তারপর তাওবা করে ও নিজেদেরকে শুধরিয়ে নেয়, তোমার প্রতিপালক তারপরও তাদের জন্য অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' নাহল ১১৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
"এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনও অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনওভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।" আলু ইমরান ১৩৫
বস্তুত এসব আয়াত আমাদেরকে এই নিশ্চয়তা দান করে যে, আমাদের দ্বারা যত কঠিন পাপই হয়ে যাক, যথার্থ তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেন। তাওবায় আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ করা হয়। তাঁকে স্মরণ করে নিজ গুনাহের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করা হয়। ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প নেওয়া হয়। এর প্রত্যেকটিই নেককাজ। এর প্রত্যেকটি তাওবা কবুলের শর্ত। শর্ত মোতাবেক তাওবা করলে তা দ্বারা সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সগীরা ও কবীরা সবই।
তবে সগীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবা শর্ত নয়। সাধারণ নেককাজ দ্বারাও তা মাফ হয়। রোগী দেখতে যাওয়া, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা, দান-সদাকা করা ইত্যাদি দ্বারাও সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সর্বাপেক্ষা বেশি মাফ হয় নামায দ্বারা। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জুমআর নামায দ্বারা এক সপ্তাহের সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কোনও এক ব্যক্তির দ্বারা গুনাহ হয়ে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নামায পড়তে বলেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذَٰلِكَ ذِكْرَىٰ لِلذَّاكِرِينَ
“এবং (হে নবী!) দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম কর। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ মানে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ।” হুদ ১১৪
নামায দ্বারা যে গুনাহ মাফ হয়, এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। তা দ্বারা বোঝা যায় গুনাহ মাফের সর্বোত্তম পন্থা নামায আদায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে হেফাজত করুন এবং বেশি বেশি নেককাজের তাওফীক দিন- আমীন।
তৃতীয় উপদেশ
'মানুষের সাথে আচরণ করো উত্তম চরিত্রের সাথে' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। উত্তম চরিত্রের শিক্ষা ইসলামের অন্যতম প্রধান মৌলিক শিক্ষা। এটা ঈমান ও তাকওয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর সম্পর্ক মূলত হুকুকুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হকের সাথে। অনেকে মনে করে মুত্তাকী-পরহেযগার হওয়ার জন্য আল্লাহর হক আদায় করাই যথেষ্ট। তারা বান্দার হক আদায়ের বিশেষ জরুরত মনে করে না। তারা নামায পড়ে, রোযা রাখে, কিন্তু আমানত রক্ষা করা, ছোটকে স্নেহ করা, বড়কে সম্মান করা, সত্যকথা বলা, ওয়াদা রক্ষা করা, বিনয় অবলম্বন করা, সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, ক্ষমা প্রদর্শন করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষ যত্নবান নয়। অথচ কুরআন মাজীদে এ সবের প্রতি যত্নবান থাকার জন্য বিশেষ তাকীদ করা হয়েছে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
"(জান্নাত সেই মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।" আলে ইমরান ১৩৪
এ আয়াতে বদান্যতা, ক্রোধ হজম করা ও ক্ষমা প্রদর্শনকে মুত্তাকীদের অপরিহার্য গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا (34) وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (35) وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا (36) وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ
“আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যখন পরিমাপ পাত্র দ্বারা কাউকে কোনও জিনিস মেপে নাও, তখন পরিপূর্ণ মাপে দিও আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট । যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই (তাকে সত্য মনে করে) তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর, এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে। ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না।” বনী ইসরাইল ৩৪-৩৭
এছাড়াও কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আখলাক-চরিত্রের আরও বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব চরিত্রের বাস্তব নমুনা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
'আপনি মহৎ চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।' কলম ০৪
তিনি নিজে নিজের সম্পর্কে বলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ
'আমাকে পাঠানো হয়েছে মহৎ চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।'
তিনি তাঁর উম্মতকেও উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষাদান করেছেন। হাদীছ গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কে আছে বিস্তর হাদীছ, যেমন এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا.
'সর্বাপেক্ষা বেশি পূর্ণাঙ্গ মু'মিন সেই, যার চরিত্র সর্বাপেক্ষা ভালো।"
অপর এক হাদীছে বলেন-
أكثرُ مَا يُدْخِل الجنَّةَ تَقوى اللهِ وَحُسْنُ الخلق.
“মানুষকে সর্বাপেক্ষা বেশি জান্নাতে দাখিল করবে আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র।”
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
“মু'মিন ব্যক্তি উত্তম চরিত্র দ্বারা (নফল) রোযাদার ও (নফল) নামাযীর সমমর্যাদা লাভ করতে পারে।”
অপর এক হাদীছে আছে-
”মীযানে এমন কোনও জিনিস রাখা হবে না, যার ওজন সচ্চরিত্রের চেয়ে বেশি।”
মানুষের সাথে সচ্চরিত্রের সাথে আচরণ করার অর্থ তাদের সামনে চেহারায় হাসি ও প্রসন্নভাব ফুটিয়ে তোলা, তাদের সংগে যে-কোনও কষ্টদায়ক আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং তাদের উপকার করতে সচেষ্ট থাকা। কেউ বলেন, তাদের প্রতি ঠিক তেমনি আচরণ করা, যেমনটা আচরণ তাদের পক্ষ থেকে আপনি আশা করেন। সুতরাং তাদের প্রতি এমন আন্তরিক ব্যবহার করতে হবে, যাতে আপনার ভেতর ও বাহির এক থাকে, মনোভাব ও মুখের কথা দুই রকম না হয় এবং কোনও আচরণ প্রতারণাপূর্ণ না হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছের প্রথম শিক্ষা মুরাকাবা সম্পর্কে। সবখানে সর্বদা অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত রেখে কাজ করাকেই এক কথায় মুরাকাবা বলে।
খ. যে-কোনও পাপকাজ হয়ে যাওয়ার পর তার মলিনতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য কোনও নেককাজে মশগুল হওয়া, বিশেষত তাওবা-ইস্তিগফার করা অবশ্যকর্তব্য।
গ. মানুষের সাথে আচার-আচরণ যাতে উত্তম চরিত্রের সাথে হয়, সে ব্যাপারে যত্নবান থাকা উচিত।
প্রথম উপদেশ
তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহকে ভয় করতে হবে এ কারণে যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও অন্তর্জামী। তিনি সবকিছু দেখেন এবং তিনি সর্বশক্তিমান। তাঁর কাছ থেকে কেউ কিছু লুকাতে পারে না। মানুষ যত গোপনেই কোনও অপরাধ করুক না কেন, তা আর কেউ না দেখুক আল্লাহ তা'আলা ঠিকই দেখেন। মানুষ চোরাচোখে যা দেখে, অন্তরে যা কল্পনা করে তাও আল্লাহর অগোচরে থাকে না। তিনি লক্ষ রাখছেন মানুষ কখন কোথায় কী করছে। ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।” নিসা: ১
বান্দার আমলের প্রতি তাঁর সতর্ক দৃষ্টি রাখা এমনিই তো নয়। তিনি আখিরাতে প্রতিটি কাজের কৈফিয়ত নেবেন। প্রত্যেককে তার প্রতিটি কাজের উপযুক্ত বদলা দেবেন। ইরশাদ হয়েছে--
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (7) وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ (8)
"সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।" যিলযাল: ৭-৮
এ অবস্থায় কোনও বুদ্ধিমান কি তাঁকে ভয় না করে পারে? আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يُحذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسه
"আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে তাঁর নিজের সম্পর্কে সতর্ক করছেন।"
অন্যত্র ইরশাদ-
واتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
"তোমরা ভয় করো সেই আল্লাহকে, যাঁর কাছে তোমাদেরকে একত্র করা হবে।"
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ۖ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
“এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে যা সে অর্জন করেছে, আর তাদের প্রতি কোনোরূপ জুলুম করা হবে না।"
কুরআন মাজীদে তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহকে ভয় করা সম্পর্কে প্রচুর আয়াত আছে। মাঝেমধ্যেই তিনি মানুষকে তার মৃত্যু, কবরের জীবন, হাশরের ময়দানে উত্থান, আল্লাহর সামনে হাজিরা, হিসাব-নিকাশ, পাপ-পুণ্যের ওজন এবং জাহান্নাম ও তার দূর্বিষহ শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছেন, যাতে তারা পার্থিব জীবনে সতর্ক হয়ে চলে, পাপাচার থেকে দূরে থাকে ও সৎকর্মে মনোযোগী হয়। সুতরাং সবকালে সকল বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীজন তাঁকে ভয় করে আসছে। আল্লাহ সম্পর্কে যে যতবেশি জেনেছে, সে তাঁকে ততবেশি ভয় করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্কে বলেন, তোমাদের মধ্যে আমিই আল্লাহকে সবচে' বেশি জানি এবং আমিই তাঁকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভয় করি। আমাদের কর্তব্য তাঁকে সদাসর্বদা ভয় করে চলা।
আল্লাহকে ভয় করার মানে কী? এর মানে পরহেযগার হয়ে চলা। অর্থাৎ তিনি যা-কিছু আদেশ করেছেন তা পরিপূর্ণরূপে পালন করা, যা-কিছু নিষেধ করেছেন তার ধারেকাছেও না যাওয়া। আর এ সবকিছুতেই ইখলাসের পরিচয় দেওয়া। অর্থাৎ তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে কেবল তাঁরই ভয়ে, তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তা করতে হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণে।
আল্লাহর আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে শরীআত বলে। শরী'আত অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই শরী'আতের কোনও না কোন বিধান আছে। ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে ও সমাজ জীবন সম্পর্কে। বিধান আছে প্রকাশ্যে লোকসম্মুখে থাকা অবস্থায় এবং আছে একান্তে নিভৃতে নির্জনে এ হাদীস বলছে, জীবনের এ সকল ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করো ও তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলো।
দ্বিতীয় উপদেশ
কোনো মন্দকাজ হয়ে যাওয়ার পর অবিলম্বে সৎকাজ করো। মন্দকাজের পরে সৎকাজ করলে মন্দকাজ মিটে যায় ও তা মাফ হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ
"নিশ্চয়ই সৎকর্ম অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়।"
অধিকাংশ মানুষের দ্বারাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভুলত্রুটি হয়ে যায়। মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় এবং নফসের কুমন্ত্রণার শিকার হয়। ফলে কখনও কখনও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার যে সমস্ত কাজের হুকুম দেওয়া হয়েছে তা করতে অলসতা করে। এভাবে তার দ্বারা নানারকম গুনাহ হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা চান বান্দা গুনাহের বোঝা নিয়ে কবরে না আসুক। যে-কোনও উপায়ে তার পাপের পঙ্কিলতা ধুয়ে সাফ হয়ে যাক। তারই ব্যবস্থা হিসেবে নেককাজের হুকুম দিয়েছেন। নেককাজ দ্বারা গুনাহের পঙ্কিলতা মুছে যায়, যেমন উপরের আয়াতে বলা হয়েছে। তাওবা- ইস্তিগফারও একটি নেক কাজ; বরং অতিবড় নেক কাজ। যত বড়ই পাপী হোক, তাওবা-ইস্তিগফার করলে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেন। সুতরাং কোনও গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর বান্দার উচিত অবিলম্বে তাওবায় রত হওয়া।
ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُولَٰئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا
"আল্লাহ অবশ্যই সেইসব লোকের তাওবা কবুল করেন যারা অজ্ঞতাবশত কোনও গুনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়।" নিসা ১৭
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে –
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوا مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا إِنَّ رَبَّكَ مِن بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
'তোমার প্রতিপালক এমন যে, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে এবং তারপর তাওবা করে ও নিজেদেরকে শুধরিয়ে নেয়, তোমার প্রতিপালক তারপরও তাদের জন্য অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' নাহল ১১৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
"এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনও অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনওভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।" আলু ইমরান ১৩৫
বস্তুত এসব আয়াত আমাদেরকে এই নিশ্চয়তা দান করে যে, আমাদের দ্বারা যত কঠিন পাপই হয়ে যাক, যথার্থ তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তা মাফ করে দেন। তাওবায় আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ করা হয়। তাঁকে স্মরণ করে নিজ গুনাহের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করা হয়। ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প নেওয়া হয়। এর প্রত্যেকটিই নেককাজ। এর প্রত্যেকটি তাওবা কবুলের শর্ত। শর্ত মোতাবেক তাওবা করলে তা দ্বারা সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সগীরা ও কবীরা সবই।
তবে সগীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবা শর্ত নয়। সাধারণ নেককাজ দ্বারাও তা মাফ হয়। রোগী দেখতে যাওয়া, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা, দান-সদাকা করা ইত্যাদি দ্বারাও সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। সর্বাপেক্ষা বেশি মাফ হয় নামায দ্বারা। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জুমআর নামায দ্বারা এক সপ্তাহের সগীরা গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কোনও এক ব্যক্তির দ্বারা গুনাহ হয়ে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নামায পড়তে বলেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ۚ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ۚ ذَٰلِكَ ذِكْرَىٰ لِلذَّاكِرِينَ
“এবং (হে নবী!) দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম কর। নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ মানে তাদের জন্য এটা এক উপদেশ।” হুদ ১১৪
নামায দ্বারা যে গুনাহ মাফ হয়, এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। তা দ্বারা বোঝা যায় গুনাহ মাফের সর্বোত্তম পন্থা নামায আদায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে হেফাজত করুন এবং বেশি বেশি নেককাজের তাওফীক দিন- আমীন।
তৃতীয় উপদেশ
'মানুষের সাথে আচরণ করো উত্তম চরিত্রের সাথে' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ। উত্তম চরিত্রের শিক্ষা ইসলামের অন্যতম প্রধান মৌলিক শিক্ষা। এটা ঈমান ও তাকওয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর সম্পর্ক মূলত হুকুকুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হকের সাথে। অনেকে মনে করে মুত্তাকী-পরহেযগার হওয়ার জন্য আল্লাহর হক আদায় করাই যথেষ্ট। তারা বান্দার হক আদায়ের বিশেষ জরুরত মনে করে না। তারা নামায পড়ে, রোযা রাখে, কিন্তু আমানত রক্ষা করা, ছোটকে স্নেহ করা, বড়কে সম্মান করা, সত্যকথা বলা, ওয়াদা রক্ষা করা, বিনয় অবলম্বন করা, সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, ক্ষমা প্রদর্শন করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষ যত্নবান নয়। অথচ কুরআন মাজীদে এ সবের প্রতি যত্নবান থাকার জন্য বিশেষ তাকীদ করা হয়েছে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
"(জান্নাত সেই মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদেরকে ভালোবাসেন।" আলে ইমরান ১৩৪
এ আয়াতে বদান্যতা, ক্রোধ হজম করা ও ক্ষমা প্রদর্শনকে মুত্তাকীদের অপরিহার্য গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا (34) وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (35) وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا (36) وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ
“আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যখন পরিমাপ পাত্র দ্বারা কাউকে কোনও জিনিস মেপে নাও, তখন পরিপূর্ণ মাপে দিও আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট । যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই (তাকে সত্য মনে করে) তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর, এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে। ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না।” বনী ইসরাইল ৩৪-৩৭
এছাড়াও কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আখলাক-চরিত্রের আরও বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব চরিত্রের বাস্তব নমুনা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
'আপনি মহৎ চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।' কলম ০৪
তিনি নিজে নিজের সম্পর্কে বলেন-
بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ
'আমাকে পাঠানো হয়েছে মহৎ চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।'
তিনি তাঁর উম্মতকেও উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষাদান করেছেন। হাদীছ গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কে আছে বিস্তর হাদীছ, যেমন এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيْمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا.
'সর্বাপেক্ষা বেশি পূর্ণাঙ্গ মু'মিন সেই, যার চরিত্র সর্বাপেক্ষা ভালো।"
অপর এক হাদীছে বলেন-
أكثرُ مَا يُدْخِل الجنَّةَ تَقوى اللهِ وَحُسْنُ الخلق.
“মানুষকে সর্বাপেক্ষা বেশি জান্নাতে দাখিল করবে আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র।”
অপর এক হাদীছে ইরশাদ-
“মু'মিন ব্যক্তি উত্তম চরিত্র দ্বারা (নফল) রোযাদার ও (নফল) নামাযীর সমমর্যাদা লাভ করতে পারে।”
অপর এক হাদীছে আছে-
”মীযানে এমন কোনও জিনিস রাখা হবে না, যার ওজন সচ্চরিত্রের চেয়ে বেশি।”
মানুষের সাথে সচ্চরিত্রের সাথে আচরণ করার অর্থ তাদের সামনে চেহারায় হাসি ও প্রসন্নভাব ফুটিয়ে তোলা, তাদের সংগে যে-কোনও কষ্টদায়ক আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং তাদের উপকার করতে সচেষ্ট থাকা। কেউ বলেন, তাদের প্রতি ঠিক তেমনি আচরণ করা, যেমনটা আচরণ তাদের পক্ষ থেকে আপনি আশা করেন। সুতরাং তাদের প্রতি এমন আন্তরিক ব্যবহার করতে হবে, যাতে আপনার ভেতর ও বাহির এক থাকে, মনোভাব ও মুখের কথা দুই রকম না হয় এবং কোনও আচরণ প্রতারণাপূর্ণ না হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছের প্রথম শিক্ষা মুরাকাবা সম্পর্কে। সবখানে সর্বদা অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত রেখে কাজ করাকেই এক কথায় মুরাকাবা বলে।
খ. যে-কোনও পাপকাজ হয়ে যাওয়ার পর তার মলিনতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য কোনও নেককাজে মশগুল হওয়া, বিশেষত তাওবা-ইস্তিগফার করা অবশ্যকর্তব্য।
গ. মানুষের সাথে আচার-আচরণ যাতে উত্তম চরিত্রের সাথে হয়, সে ব্যাপারে যত্নবান থাকা উচিত।
