রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৮
অধ্যায় : ৪ সিদ্ক ও সততা।
৫৮। অসততার কুফল:
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও এক নবী যুদ্ধযাত্রা করলেন। (যাত্রার আগে) তিনি নিজ কওমকে বললেন, আমার সংগে যেন না যায় ওই ব্যক্তি, যে কোনও মহিলাকে বিবাহ করেছে আর সে তার সংগে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার সাথে মিলিত হয়নি। এবং এমন কোনও ব্যক্তি, যে কোনও ঘর নির্মাণ করেছে কিন্তু এখনও তার ছাদ তোলেনি। এবং এমন কোনও ব্যক্তি, যে গর্ভবতী ছাগল বা উট ক্রয় করেছে আর সে তার বাচ্চার অপেক্ষায় আছে। তারপর তিনি যুদ্ধে গেলেন। তিনি (উদ্দিষ্ট) জনপদের নিকটে পৌঁছলেন আসরের নামাযকালে বা তার কাছাকাছি সময়ে। তখন সূর্যকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, তুমি (আল্লাহর আদেশে) আদিষ্ট এবং আমিও (তাঁর) আদেশপ্রাপ্ত। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য একে আটকে রাখুন। সুতরাং সূর্যকে আটকে রাখা হল, যাবত না আল্লাহ তাঁকে জয়যুক্ত করলেন। তারপর তিনি গনীমতের মাল একত্র করলেন। তারপর তা গ্রাস করার জন্য আগুন আসল। কিন্তু আগুন তা গ্রাস করল না। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে কোনও খেয়ানত হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক গোত্র থেকে একেক ব্যক্তি আমার হাতে বাইআত করুক। এক পর্যায়ে এক ব্যক্তির হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যেই খেয়ানত হয়েছে। সুতরাং তোমার গোত্র আমার হাতে হাত রাখুক। (তারা একেকজন করে তার হাতে হাত রাখল)। তাতে তাদের দু'জন বা তিনজন লোকের হাত তার হাতে আটকে গেল। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যেই খেয়ানত হয়েছে। সুতরাং (খেয়ানতকারী ব্যক্তি) গরুর মাথার মত সোনার একটি মাথা নিয়ে আসল এবং তা (গনীমতের অন্যান্য মালের মধ্যে) রাখল। অমনি আগুন এসে তা গ্রাস করল। আমাদের আগে আর কারও জন্য গনীমতের মাল হালাল ছিল না। আল্লাহ তা'আলা গনীমতের মাল আমাদের জন্য হালাল করেছেন। তিনি তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন আমাদের দূর্বলতা ও অক্ষমতার দিকে লক্ষ করে - বুখারী ও মুসলিম । (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩১২৪, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭৪৭)
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনও এক নবী যুদ্ধযাত্রা করলেন। (যাত্রার আগে) তিনি নিজ কওমকে বললেন, আমার সংগে যেন না যায় ওই ব্যক্তি, যে কোনও মহিলাকে বিবাহ করেছে আর সে তার সংগে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার সাথে মিলিত হয়নি। এবং এমন কোনও ব্যক্তি, যে কোনও ঘর নির্মাণ করেছে কিন্তু এখনও তার ছাদ তোলেনি। এবং এমন কোনও ব্যক্তি, যে গর্ভবতী ছাগল বা উট ক্রয় করেছে আর সে তার বাচ্চার অপেক্ষায় আছে। তারপর তিনি যুদ্ধে গেলেন। তিনি (উদ্দিষ্ট) জনপদের নিকটে পৌঁছলেন আসরের নামাযকালে বা তার কাছাকাছি সময়ে। তখন সূর্যকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, তুমি (আল্লাহর আদেশে) আদিষ্ট এবং আমিও (তাঁর) আদেশপ্রাপ্ত। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য একে আটকে রাখুন। সুতরাং সূর্যকে আটকে রাখা হল, যাবত না আল্লাহ তাঁকে জয়যুক্ত করলেন। তারপর তিনি গনীমতের মাল একত্র করলেন। তারপর তা গ্রাস করার জন্য আগুন আসল। কিন্তু আগুন তা গ্রাস করল না। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে কোনও খেয়ানত হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক গোত্র থেকে একেক ব্যক্তি আমার হাতে বাইআত করুক। এক পর্যায়ে এক ব্যক্তির হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যেই খেয়ানত হয়েছে। সুতরাং তোমার গোত্র আমার হাতে হাত রাখুক। (তারা একেকজন করে তার হাতে হাত রাখল)। তাতে তাদের দু'জন বা তিনজন লোকের হাত তার হাতে আটকে গেল। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যেই খেয়ানত হয়েছে। সুতরাং (খেয়ানতকারী ব্যক্তি) গরুর মাথার মত সোনার একটি মাথা নিয়ে আসল এবং তা (গনীমতের অন্যান্য মালের মধ্যে) রাখল। অমনি আগুন এসে তা গ্রাস করল। আমাদের আগে আর কারও জন্য গনীমতের মাল হালাল ছিল না। আল্লাহ তা'আলা গনীমতের মাল আমাদের জন্য হালাল করেছেন। তিনি তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন আমাদের দূর্বলতা ও অক্ষমতার দিকে লক্ষ করে - বুখারী ও মুসলিম । (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩১২৪, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭৪৭)
4 - باب الصدق
58 - الخامس: عن أبي هريرةَ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «غَزَا نبيٌّ مِنَ الأنْبِياءِ - صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُهُ عَلَيْهمْ - فَقَالَ لِقَومهِ: لا يَتْبَعَنِّي رَجُلٌ مَلَكَ بُضْعَ (1) امْرَأةٍ وَهُوَ يُريدُ أَنْ يَبْنِي بِهَا وَلَمَّا يَبْنِ بِهَا، وَلا أحَدٌ بَنَى بُيُوتًا لَمْ يَرْفَعْ سُقُوفَهَا، وَلا أحَدٌ اشْتَرَى غَنَمًا أَوْ خَلِفَاتٍ وَهُوَ يَنْتَظِرُ أَوْلادَها (2). فَغَزا فَدَنَا مِنَ القَرْيَةِ صَلاةَ العَصْرِ أَوْ قَريبًا مِنْ ذلِكَ، فَقَالَ لِلشَّمْسِ: إِنَّكِ مَأمُورَةٌ وَأنَا مَأمُورٌ، اللَّهُمَّ احْبِسْهَا عَلَيْنَا، فَحُبِسَتْ (3) حَتَّى فَتَحَ اللهُ عَلَيهِ، فَجَمَعَ الغَنَائِمَ فَجَاءتْ - يعني النَّارَ - لِتَأكُلَهَا (4) فَلَمْ تَطعَمْها، فَقَالَ: إنَّ فِيكُمْ غُلُولًا (5)، فَلْيُبايعْنِي مِنْ كُلِّ قَبِيلَةٍ رَجُلٌ، فَلَزِقَتْ (6) يَدَ رَجُلٍ بِيَدِهِ فَقَالَ: فِيكُمُ الغُلُولُ فَلتُبَايِعْنِي قَبِيلتَكَ، فَلَزقَت يَدُ رَجُلَين أو ثَلاَثة بيده، فقال: فيكم الغُلُولَ، فَجَاؤُوا بِرَأْس مثلِ رَأسِ بَقَرَةٍ مِنَ الذَّهَبِ، فَوَضَعَهَا فَجَاءَت النَّارُ فَأكَلَتْها. فَلَمْ تَحلَّ الغَنَائِمُ لأحَدٍ قَبْلَنَا، ثُمَّ أحَلَّ الله لَنَا الغَنَائِمَ لَمَّا رَأَى ضَعْفَنا وَعَجْزَنَا فَأحَلَّهَا لَنَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (7)
«الخَلِفَاتُ» بفتحِ الخَاءِ المعجمة وكسر اللامِ: جمع خِلفة وهي الناقة الحامِل.
«الخَلِفَاتُ» بفتحِ الخَاءِ المعجمة وكسر اللامِ: جمع خِلفة وهي الناقة الحامِل.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত ইয়ূশা' আলাইহিস-সালামের ঘটনা
এ হাদীছে আগের যমানার কোনও নবীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মুসতাদরাকে হাকিমের এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায় এ নবী ছিলেন হযরত ইয়ুশা' ইব্ন নূন আলাইহিস-সালাম। মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনা দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বনী ইসরাঈলের একজন নবী। হযরত মুসা আলাইহিস-সালামের শিষ্য ও খাদেম ছিলেন। পরে আল্লাহ তা'আলা তাঁকেও নবুওয়াত দান করেন। তাঁকে এক জনপদে যুদ্ধের হুকুম দেওয়া হয়েছিল। জনপদটির নাম এ বর্ণনায় নেই। হাকিমের বর্ণনায় নাম বলা হয়েছে আরীহা। 'আরীহা' জর্ডানের একটি জনপদের নাম।
হুকুম মোতাবেক তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রস্তুতিকালে তিনি তিন শ্রেণীর লোককে তাঁর সংগে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেন। তারা হল- (ক) ওই ব্যক্তি, যে সদ্য বিবাহ করেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্ত্রীর সংগে বাসর যাপন করেনি; (খ) যে ব্যক্তি ঘর তৈরি করছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঘরের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, ছাদ বাকি রয়ে গেছে; (গ) যে ব্যক্তি ছাগল বা উটনী কিনেছে। সেটি গর্ভবতী। সে তার বাচ্চা প্রসবের অপেক্ষায় আছে।
এই তিন ব্যক্তিকে নিষেধ করে দেন এ কারণে যে, যুদ্ধের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহ-মন সবটা নিবেদন না করলে তাতে বিশেষ ভূমিকা রাখা যায় না। পূর্ণ মনোযোগ না থাকলে শরীরে শক্তি ও উদ্দীপনা আসে না। যার মন অন্যকিছুতে লিপ্ত থাকে, তার পক্ষে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করা সম্ভব হয় না। তার যুদ্ধযোগদানে উপকারের বদলে ক্ষতিরই আশংকা বেশি। যে তিন শ্রেণীর লোকের কথা এখানে উল্লেখ করা হল, তাদের মন রণক্ষেত্র অপেক্ষা আপন বাড়িতেই বেণি মগ্ন থাকবে। সদ্যবিবাহিত ব্যক্তির মন পড়ে থাকবে তার স্ত্রীর কাছে। গৃহনির্মাতা সর্বক্ষণ তার ঘরের বাকি কাজ নিয়ে চিন্তা করবে। আর গর্ভবতী পশুর মালিকও কখন কিভাবে পশুটি বাচ্চা দেবে সেই পেরেশানিতে থাকবে। এ কারণেই হযরত ইয়ূশা' আলাইহিস-সালাম তাদেরকে তাঁর সংগে যেতে নিষেধ করেছেন।
সূর্য গেল থেমে!
প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আরীহার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে আসর হয়ে গেল। তিনি চিন্তা করলেন, সূর্যাস্তের তো আর বেশি দেরী নেই। এখন যুদ্ধ করা হলে হয়তো সূর্যাস্তের আগে তা শেষ হবে না। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার ছেয়ে যাবে। তখন যুদ্ধে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার পরের দিনের অপেক্ষায় থাকাও সমীচীন নয়। শত্রু সুযোগ পেয়ে যাবে। এ এক উভয়সংকট। এর থেকে নিস্তারের উপায় হতে পারে কেবল সূর্যাস্তের বিলম্ব দ্বারা। তিনি আল্লাহ তা'আলার কাছে সেই দু’আই করলেন। প্রথমে সূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন, হে সূর্য! তুইও আদিষ্ট, আমিও আদিষ্ট। তোর প্রতি আল্লাহর হুকুম যথানিয়মে যথাসময়ে উদয়-অস্ত যাওয়া। আমার প্রতি আল্লাহর হুকুম জিহাদ করা। সেই জিহাদের জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। যথাসময়ে অস্ত গেলে সেই সময় আমার থাকে না। তাই আজ আমার প্রয়োজন সূর্যাস্তের বিলম্ব ঘটা। সে বিলম্ব অসম্ভব নয়। চন্দ্র-সূর্যের চলাচল তো আল্লাহ তা'আলার হুকুমেরই অধীন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
'সূর্য আপন গন্তব্যের দিকে পরিভ্রমণ করছে। এসব পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ সত্তার স্থিরীকৃত (ব্যবস্থাপনা)।
যে আল্লাহ তোকে নির্দিষ্ট সময়ে অস্তগমনের হুকুম করেছেন, তিনি চাইলে আজকের জন্য তোর অস্তগমনকে বিলম্বিত করে দিতে পারেন। তখন আল্লাহর হুকুমেই তোকে বিলম্বে অস্ত যেতে হবে। তারপর দু'আ করলেন- হে আল্লাহ! আমাদের জন্য তুমি সূর্যকে আটকে দাও। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবূল করলেন। সূর্য থেমে গেল। তিনি যুদ্ধ করতে থাকলেন। যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করলেন। তারপর সূর্য অস্ত গেল। সুবহানাল্লাহ!
মু'জিযা কী ও কেন
সূর্যাস্তে বিলম্ব ঘটা ছিল হযরত ইয়ূশা আলাইহিস-সালামের একটি মু'জিযা।মু'জিযা মানে অলৌকিকত্ব। আল্লাহ তা'আলা যে প্রাকৃতিক কার্যকারণের নিয়ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বিশ্বজগত সেভাবেই চলছে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ হেকমতে কখনও কখনও তার ব্যতিক্রমও ঘটান। নবীদের ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রম ঘটান। তাঁদের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে প্রমাণস্বরূপ। এ ব্যতিক্রমকে তাঁদের মু'জিয়া বলে। একেক নবীর সত্যতা প্রমাণে আল্লাহ তা'আলা একেকরকম মুজিযা দান করেছেন, যেমন হযরত মুসা আলাইহিস-সালামের হাতের লাঠি সাপ হয়ে যেত। তাঁর লাঠির আঘাতে পাথর থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হত। হযরত ঈসা আলাইহিস-সালামের হাতে স্পর্শে অন্ধ ও কুণ্ঠরোগী ভালো হয়ে যেত। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালামের জন্য আগুন শীতল ও শাস্তিদায়ক হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক নবীরই এরকম কোনও না কোনও মু'জিযা ছিল। হযরত ইয়ূশা আলাইহিস-সালামের জন্য সূর্যের থেমে যাওয়াটাও সেরকমই এক মু'জিযা। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের মধ্যে এ মু'জিযা কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল, আর কোনও নবীকে নয়। হাঁ, আমাদের হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যও সূর্য থেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার ঘটেছিল মি'রাজের সময়। আরেকবার খন্দকের যুদ্ধকালে। এছাড়াও তার আরও বহু মু'জিযা ছিল। সর্বাপেক্ষা বেশি ও সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মু'জিয়া আল্লাহ তা'আলা তাঁকেই দান করেছিলেন।
মু'জিযা অসম্ভব কিছু নয়। প্রাকৃতিক সমস্ত নিয়ম আল্লাহ তা'আলাই স্থির করে দিয়েছেন। প্রকৃতির নিজের তা স্থির করার ক্ষমতা নেই। প্রচলিত নিয়ম নির্ধারণের ক্ষমতা যে আল্লাহর আছে, তাঁর পক্ষে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানো অসম্ভব হবে কেন? তাকে অসম্ভব মনে করা কুফর। কেননা তাতে আল্লাহর ক্ষমতার অসীমত্ব অস্বীকার করা হয়। তাছাড়া মু'জিযার বিষয়টা কুরআন-সুন্নাহার সন্দেহাতীত দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সে কারণেও তা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
আত্মসাৎকারী যেভাবে ধরা পড়ল
যুদ্ধে শত্রুসৈন্যদের যে মালামাল অর্জিত হয়েছিল, হযরত ইয়ুশা' আলাইহিস-সালাম তা এক জায়গায় জমা করতে বললেন, যাতে আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দেয়। এটা ছিল আল্লাহর কাছে যুদ্ধ কবূল হওয়ার আলামত। তখন গনীমতের মাল যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হত না। কারণ তা ভোগ করা হালাল ছিল না। এক জায়গা জমা করে রাখা হত আর যুদ্ধ কবূল হলে আসমানী আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। কবূল না হলে আগুন আসত না।
হযরত ইয়ুশা' আলাইহিস-সালাম অপেক্ষা করতে থাকলেন, কিন্তু আগুন আসল না। তিনি বুঝতে পারলেন আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। গনীমতের মাল থেকে কেউ কিছু সরিয়ে ফেলেছে। তাই আল্লাহর কাছে যুদ্ধ কবুল হয়নি এবং সে কারণেই আগুন আসছে না। তিনি এ কথা ঘোষণা করে দিলেন। বনী ইসরাঈলকে জানালেন যে, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ গনীমতের মাল থেকে কিছু আত্মসাৎ করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা ফেরত না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা কবুল হবে না। কিন্তু কেউ স্বীকার করল না। শেষে আরেক মু'জিযার প্রকাশ ঘটল।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় সত্তর হাজার। এর লোকের ভেতর কে আত্মসাৎ করেছে তা কিভাবে শনাক্ত করা যাবে? তিনি হুকুম দিলেন, প্রত্যেক গোত্র থেকে একেকজন লোক আমার হাতে হাত রাখুক। সত্তর হাজার লোকের প্রত্যেকের হাত রাখতে গেলে অনেক লম্বা সময়ের দরকার। তাই কাজ সহজ করার জন্য তিনি এ ব্যবস্থা নিলেন। যার হাত তাঁর হাতে আটকে যাবে, বোঝা যাবে তার গোত্রের কেউ চুরি করেছে। তারপর সেই গোত্রে অনুসন্ধান চালালে অপরাধী বের হয়ে আসবে। সুতরাং তাঁর হুকুমমত তারা তাঁর হাতে হাত রাখতে শুরু করল। একপর্যায়ে এক ব্যক্তির হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। এটা অলৌকিকত্ব। শুধু শুধু হাতে হাত আটকা পড়বে কেন? এর বাহ্যিক কী কারণ থাকতে পারে? বাহ্যিক কোনও কারণ নেই। অপরাধী শনাক্ত করার জন্য আল্লাহ তা'আলা অলৌকিকভাবে এটা করে দিয়েছেন। নিরপরাধ লোকের হাত আটকা পড়বে না। অপরাধীর হাতই আটকাবে। তো যার হাত আটকাল, তার বংশকে জানিয়ে দেওয়া হল- তোমাদের মধ্যকার কেউ এ কাজ করেছে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে আমার হাতে হাত রাখ। তারা হাত রাখতে শুরু করল। তাতে তাদের দু'জন বা তিনজনের হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। ধরা পড়ে গেল যে, তারাই গনীমতের মাল আত্মসাৎ করেছে। তিনি তাদেরকে তা জমা করার হুকুম দিলেন। তারা সোনা দিয়ে তৈরি গরুর মাথার মত একটি জিনিস নিয়ে আসল। সেটি যখন গনীমতের মালামালের মধ্যে রাখা হল, অমনি আসমানী আগুন এসে গেল এবং তা গনীমতের সব মাল জ্বালিয়ে দিল। এটাও আল্লাহ তা'আলার কুদরতের এক নিদর্শন ও অলৌকিকত্ব। কোথা থেকে আসল এ আগুন? কে জ্বালাল? না কোনও গাছপালা, না কেরোসিন-পেট্রোল, না অন্য কোনও উপায়-উপকরণ। বাহ্যিক আসবাব-উপকরণ ছাড়া আগুন জ্বালানো কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং এ আগুন তাঁর কুদরতেরই নিদর্শন।
আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অছিলায় এ উম্মতের উপর রহমত করেছেন। আমাদের অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে আমাদের জন্য গনীমতের মাল হালাল করেছেন। আমরা তা ভোগ করতে পারি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ- فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا
অর্থ : সুতরাং তোমরা যে গনীমত অর্জন করেছ, তা ভোগ কর বৈধ উত্তম সম্পদরূপে।
অবশ্য এ ব্যাপারে শরী'আতের কিছু নীতিমালা আছে। গনীমতের মালামাল বণ্টনে সে নীতিমালার অনুসরণ অবশ্যকর্তব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা সততার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। অসৎপথ অবলম্বনের কারণে বনী ইসরাঈলের জিহাদ কবূল হচ্ছিল না।
খ. জাতীয় বা সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন কোনও লোককে দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়, যারা ব্যক্তিগত নগদ কোনও ব্যাপারে পেরেশান ও চিন্তিত আছে। তাদেরকে বরং ব্যক্তিগত সমাধানের সুযোগ দেওয়া উচিত। নয়তো তাদের ব্যক্তিগত কাজেরও সমাধান হবে না আর জাতীয় কাজও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে না।
গ. হাদীছে বর্ণিত তিন ব্যক্তিকে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত রাখার দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত জরুরতকে গুরুত্ব প্রদানের তাকীদ বোঝা যায়। অর্থাৎ কারও ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করে তাকে সামষ্টিক কাজে টেনে নিয়ে আসা দীনের মেজায় নয়, যদি তাকে ছাড়াও সে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
ঘ. ব্যক্তিবিশেষের অসৎকর্মের কারণে সম্মিলিত কাজের শুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়। ফলে সকলের উপরেই তার দায় এসে যায়, যেমন বনী ইসরাঈলের দুই-একজনের অসততার দরুন সকলেরই জিহাদের কবূলিয়াত আটকে গিয়েছিল।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় নবীগণও গায়েব জানেন না। গনীমতের মাল কারা আত্মসাৎ করেছিল, হযরত ইয়ূশা' আলাইহিস-সালাম তা জানতেন না, যে কারণে তদন্তের দরকার হয়েছিল।
চ. নবীদের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা ফরয।
ছ. এ উম্মতের জন্য আল্লাহর বিশেষ কিছু মেহেরবানী আছে। গনীমত হালাল হওয়াও তার একটি।
এ হাদীছে আগের যমানার কোনও নবীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মুসতাদরাকে হাকিমের এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায় এ নবী ছিলেন হযরত ইয়ুশা' ইব্ন নূন আলাইহিস-সালাম। মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনা দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বনী ইসরাঈলের একজন নবী। হযরত মুসা আলাইহিস-সালামের শিষ্য ও খাদেম ছিলেন। পরে আল্লাহ তা'আলা তাঁকেও নবুওয়াত দান করেন। তাঁকে এক জনপদে যুদ্ধের হুকুম দেওয়া হয়েছিল। জনপদটির নাম এ বর্ণনায় নেই। হাকিমের বর্ণনায় নাম বলা হয়েছে আরীহা। 'আরীহা' জর্ডানের একটি জনপদের নাম।
হুকুম মোতাবেক তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রস্তুতিকালে তিনি তিন শ্রেণীর লোককে তাঁর সংগে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেন। তারা হল- (ক) ওই ব্যক্তি, যে সদ্য বিবাহ করেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্ত্রীর সংগে বাসর যাপন করেনি; (খ) যে ব্যক্তি ঘর তৈরি করছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঘরের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, ছাদ বাকি রয়ে গেছে; (গ) যে ব্যক্তি ছাগল বা উটনী কিনেছে। সেটি গর্ভবতী। সে তার বাচ্চা প্রসবের অপেক্ষায় আছে।
এই তিন ব্যক্তিকে নিষেধ করে দেন এ কারণে যে, যুদ্ধের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহ-মন সবটা নিবেদন না করলে তাতে বিশেষ ভূমিকা রাখা যায় না। পূর্ণ মনোযোগ না থাকলে শরীরে শক্তি ও উদ্দীপনা আসে না। যার মন অন্যকিছুতে লিপ্ত থাকে, তার পক্ষে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করা সম্ভব হয় না। তার যুদ্ধযোগদানে উপকারের বদলে ক্ষতিরই আশংকা বেশি। যে তিন শ্রেণীর লোকের কথা এখানে উল্লেখ করা হল, তাদের মন রণক্ষেত্র অপেক্ষা আপন বাড়িতেই বেণি মগ্ন থাকবে। সদ্যবিবাহিত ব্যক্তির মন পড়ে থাকবে তার স্ত্রীর কাছে। গৃহনির্মাতা সর্বক্ষণ তার ঘরের বাকি কাজ নিয়ে চিন্তা করবে। আর গর্ভবতী পশুর মালিকও কখন কিভাবে পশুটি বাচ্চা দেবে সেই পেরেশানিতে থাকবে। এ কারণেই হযরত ইয়ূশা' আলাইহিস-সালাম তাদেরকে তাঁর সংগে যেতে নিষেধ করেছেন।
সূর্য গেল থেমে!
প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আরীহার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে আসর হয়ে গেল। তিনি চিন্তা করলেন, সূর্যাস্তের তো আর বেশি দেরী নেই। এখন যুদ্ধ করা হলে হয়তো সূর্যাস্তের আগে তা শেষ হবে না। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার ছেয়ে যাবে। তখন যুদ্ধে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার পরের দিনের অপেক্ষায় থাকাও সমীচীন নয়। শত্রু সুযোগ পেয়ে যাবে। এ এক উভয়সংকট। এর থেকে নিস্তারের উপায় হতে পারে কেবল সূর্যাস্তের বিলম্ব দ্বারা। তিনি আল্লাহ তা'আলার কাছে সেই দু’আই করলেন। প্রথমে সূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন, হে সূর্য! তুইও আদিষ্ট, আমিও আদিষ্ট। তোর প্রতি আল্লাহর হুকুম যথানিয়মে যথাসময়ে উদয়-অস্ত যাওয়া। আমার প্রতি আল্লাহর হুকুম জিহাদ করা। সেই জিহাদের জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। যথাসময়ে অস্ত গেলে সেই সময় আমার থাকে না। তাই আজ আমার প্রয়োজন সূর্যাস্তের বিলম্ব ঘটা। সে বিলম্ব অসম্ভব নয়। চন্দ্র-সূর্যের চলাচল তো আল্লাহ তা'আলার হুকুমেরই অধীন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
'সূর্য আপন গন্তব্যের দিকে পরিভ্রমণ করছে। এসব পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ সত্তার স্থিরীকৃত (ব্যবস্থাপনা)।
যে আল্লাহ তোকে নির্দিষ্ট সময়ে অস্তগমনের হুকুম করেছেন, তিনি চাইলে আজকের জন্য তোর অস্তগমনকে বিলম্বিত করে দিতে পারেন। তখন আল্লাহর হুকুমেই তোকে বিলম্বে অস্ত যেতে হবে। তারপর দু'আ করলেন- হে আল্লাহ! আমাদের জন্য তুমি সূর্যকে আটকে দাও। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবূল করলেন। সূর্য থেমে গেল। তিনি যুদ্ধ করতে থাকলেন। যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করলেন। তারপর সূর্য অস্ত গেল। সুবহানাল্লাহ!
মু'জিযা কী ও কেন
সূর্যাস্তে বিলম্ব ঘটা ছিল হযরত ইয়ূশা আলাইহিস-সালামের একটি মু'জিযা।মু'জিযা মানে অলৌকিকত্ব। আল্লাহ তা'আলা যে প্রাকৃতিক কার্যকারণের নিয়ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বিশ্বজগত সেভাবেই চলছে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ হেকমতে কখনও কখনও তার ব্যতিক্রমও ঘটান। নবীদের ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রম ঘটান। তাঁদের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে প্রমাণস্বরূপ। এ ব্যতিক্রমকে তাঁদের মু'জিয়া বলে। একেক নবীর সত্যতা প্রমাণে আল্লাহ তা'আলা একেকরকম মুজিযা দান করেছেন, যেমন হযরত মুসা আলাইহিস-সালামের হাতের লাঠি সাপ হয়ে যেত। তাঁর লাঠির আঘাতে পাথর থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হত। হযরত ঈসা আলাইহিস-সালামের হাতে স্পর্শে অন্ধ ও কুণ্ঠরোগী ভালো হয়ে যেত। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালামের জন্য আগুন শীতল ও শাস্তিদায়ক হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক নবীরই এরকম কোনও না কোনও মু'জিযা ছিল। হযরত ইয়ূশা আলাইহিস-সালামের জন্য সূর্যের থেমে যাওয়াটাও সেরকমই এক মু'জিযা। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের মধ্যে এ মু'জিযা কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল, আর কোনও নবীকে নয়। হাঁ, আমাদের হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যও সূর্য থেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার ঘটেছিল মি'রাজের সময়। আরেকবার খন্দকের যুদ্ধকালে। এছাড়াও তার আরও বহু মু'জিযা ছিল। সর্বাপেক্ষা বেশি ও সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মু'জিয়া আল্লাহ তা'আলা তাঁকেই দান করেছিলেন।
মু'জিযা অসম্ভব কিছু নয়। প্রাকৃতিক সমস্ত নিয়ম আল্লাহ তা'আলাই স্থির করে দিয়েছেন। প্রকৃতির নিজের তা স্থির করার ক্ষমতা নেই। প্রচলিত নিয়ম নির্ধারণের ক্ষমতা যে আল্লাহর আছে, তাঁর পক্ষে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানো অসম্ভব হবে কেন? তাকে অসম্ভব মনে করা কুফর। কেননা তাতে আল্লাহর ক্ষমতার অসীমত্ব অস্বীকার করা হয়। তাছাড়া মু'জিযার বিষয়টা কুরআন-সুন্নাহার সন্দেহাতীত দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সে কারণেও তা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই।
আত্মসাৎকারী যেভাবে ধরা পড়ল
যুদ্ধে শত্রুসৈন্যদের যে মালামাল অর্জিত হয়েছিল, হযরত ইয়ুশা' আলাইহিস-সালাম তা এক জায়গায় জমা করতে বললেন, যাতে আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দেয়। এটা ছিল আল্লাহর কাছে যুদ্ধ কবূল হওয়ার আলামত। তখন গনীমতের মাল যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হত না। কারণ তা ভোগ করা হালাল ছিল না। এক জায়গা জমা করে রাখা হত আর যুদ্ধ কবূল হলে আসমানী আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। কবূল না হলে আগুন আসত না।
হযরত ইয়ুশা' আলাইহিস-সালাম অপেক্ষা করতে থাকলেন, কিন্তু আগুন আসল না। তিনি বুঝতে পারলেন আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। গনীমতের মাল থেকে কেউ কিছু সরিয়ে ফেলেছে। তাই আল্লাহর কাছে যুদ্ধ কবুল হয়নি এবং সে কারণেই আগুন আসছে না। তিনি এ কথা ঘোষণা করে দিলেন। বনী ইসরাঈলকে জানালেন যে, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ গনীমতের মাল থেকে কিছু আত্মসাৎ করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা ফেরত না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা কবুল হবে না। কিন্তু কেউ স্বীকার করল না। শেষে আরেক মু'জিযার প্রকাশ ঘটল।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় সত্তর হাজার। এর লোকের ভেতর কে আত্মসাৎ করেছে তা কিভাবে শনাক্ত করা যাবে? তিনি হুকুম দিলেন, প্রত্যেক গোত্র থেকে একেকজন লোক আমার হাতে হাত রাখুক। সত্তর হাজার লোকের প্রত্যেকের হাত রাখতে গেলে অনেক লম্বা সময়ের দরকার। তাই কাজ সহজ করার জন্য তিনি এ ব্যবস্থা নিলেন। যার হাত তাঁর হাতে আটকে যাবে, বোঝা যাবে তার গোত্রের কেউ চুরি করেছে। তারপর সেই গোত্রে অনুসন্ধান চালালে অপরাধী বের হয়ে আসবে। সুতরাং তাঁর হুকুমমত তারা তাঁর হাতে হাত রাখতে শুরু করল। একপর্যায়ে এক ব্যক্তির হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। এটা অলৌকিকত্ব। শুধু শুধু হাতে হাত আটকা পড়বে কেন? এর বাহ্যিক কী কারণ থাকতে পারে? বাহ্যিক কোনও কারণ নেই। অপরাধী শনাক্ত করার জন্য আল্লাহ তা'আলা অলৌকিকভাবে এটা করে দিয়েছেন। নিরপরাধ লোকের হাত আটকা পড়বে না। অপরাধীর হাতই আটকাবে। তো যার হাত আটকাল, তার বংশকে জানিয়ে দেওয়া হল- তোমাদের মধ্যকার কেউ এ কাজ করেছে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে আমার হাতে হাত রাখ। তারা হাত রাখতে শুরু করল। তাতে তাদের দু'জন বা তিনজনের হাত তাঁর হাতে আটকে গেল। ধরা পড়ে গেল যে, তারাই গনীমতের মাল আত্মসাৎ করেছে। তিনি তাদেরকে তা জমা করার হুকুম দিলেন। তারা সোনা দিয়ে তৈরি গরুর মাথার মত একটি জিনিস নিয়ে আসল। সেটি যখন গনীমতের মালামালের মধ্যে রাখা হল, অমনি আসমানী আগুন এসে গেল এবং তা গনীমতের সব মাল জ্বালিয়ে দিল। এটাও আল্লাহ তা'আলার কুদরতের এক নিদর্শন ও অলৌকিকত্ব। কোথা থেকে আসল এ আগুন? কে জ্বালাল? না কোনও গাছপালা, না কেরোসিন-পেট্রোল, না অন্য কোনও উপায়-উপকরণ। বাহ্যিক আসবাব-উপকরণ ছাড়া আগুন জ্বালানো কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। সুতরাং এ আগুন তাঁর কুদরতেরই নিদর্শন।
আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অছিলায় এ উম্মতের উপর রহমত করেছেন। আমাদের অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে আমাদের জন্য গনীমতের মাল হালাল করেছেন। আমরা তা ভোগ করতে পারি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ- فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا
অর্থ : সুতরাং তোমরা যে গনীমত অর্জন করেছ, তা ভোগ কর বৈধ উত্তম সম্পদরূপে।
অবশ্য এ ব্যাপারে শরী'আতের কিছু নীতিমালা আছে। গনীমতের মালামাল বণ্টনে সে নীতিমালার অনুসরণ অবশ্যকর্তব্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা সততার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। অসৎপথ অবলম্বনের কারণে বনী ইসরাঈলের জিহাদ কবূল হচ্ছিল না।
খ. জাতীয় বা সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন কোনও লোককে দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়, যারা ব্যক্তিগত নগদ কোনও ব্যাপারে পেরেশান ও চিন্তিত আছে। তাদেরকে বরং ব্যক্তিগত সমাধানের সুযোগ দেওয়া উচিত। নয়তো তাদের ব্যক্তিগত কাজেরও সমাধান হবে না আর জাতীয় কাজও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে না।
গ. হাদীছে বর্ণিত তিন ব্যক্তিকে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত রাখার দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত জরুরতকে গুরুত্ব প্রদানের তাকীদ বোঝা যায়। অর্থাৎ কারও ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করে তাকে সামষ্টিক কাজে টেনে নিয়ে আসা দীনের মেজায় নয়, যদি তাকে ছাড়াও সে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
ঘ. ব্যক্তিবিশেষের অসৎকর্মের কারণে সম্মিলিত কাজের শুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়। ফলে সকলের উপরেই তার দায় এসে যায়, যেমন বনী ইসরাঈলের দুই-একজনের অসততার দরুন সকলেরই জিহাদের কবূলিয়াত আটকে গিয়েছিল।
ঙ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় নবীগণও গায়েব জানেন না। গনীমতের মাল কারা আত্মসাৎ করেছিল, হযরত ইয়ূশা' আলাইহিস-সালাম তা জানতেন না, যে কারণে তদন্তের দরকার হয়েছিল।
চ. নবীদের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা ফরয।
ছ. এ উম্মতের জন্য আল্লাহর বিশেষ কিছু মেহেরবানী আছে। গনীমত হালাল হওয়াও তার একটি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
