রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৬
অধ্যায় : ৪ সিদ্‌ক ও সততা।
৫৬। সত্যবাদিতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান মৌলিক শিক্ষা:

হযরত আবু সুফয়ান ছখর ইবনে হারব রাযি. থেকে একটি সুদীর্ঘ হাদীছ বর্ণিত আছে। হাদীছটি (রোম সম্রাট) হিরাকলের (কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী চিঠি পাঠানোকে কেন্দ্র করে তার) সাথে তাঁর সাক্ষাতকার সম্পর্কিত। (হিরাকল তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং তিনি তার জবাব দিয়েছিলেন। তার অংশবিশেষ এরকম-) হিরাকল বললেন, তিনি (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের কী নির্দেশ দেন? আবু সুফয়ান বলেন, আমি বললাম, তিনি বলে থাকেন- তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনও কিছুকে শরীক করো না। তোমাদের বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিত্যাগ কর। আর তিনি আমাদেরকে সালাত, সিদক (সততা ও সত্যবাদিতা), আফাফ (সংযম ও শুচিতা) ও আত্মীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন- বুখারী ও মুসলিম। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ০৭, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭৭৩)
4 - باب الصدق
56 - الثالث: عن أبي سفيانَ صَخرِ بنِ حربٍ - رضي الله عنه - في حديثه الطويلِ في قصةِ هِرَقْلَ (1)، قَالَ هِرقلُ: فَمَاذَا يَأَمُرُكُمْ - يعني: النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ أبو سفيانَ: قُلْتُ: يقولُ: «اعْبُدُوا اللهَ وَحدَهُ لا تُشْرِكوُا بِهِ شَيئًا، وَاتْرُكُوا مَا يَقُولُ آبَاؤُكُمْ، ويَأْمُرُنَا بالصَلاةِ، وَالصِّدْقِ، والعَفَافِ، وَالصِّلَةِ» (2) مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (3)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি সুদীর্ঘ এক বর্ণনার অংশ। বর্ণনাটি বিস্তারিতভাবে বুখারী শরীফের শুরুদিকে আছে। এর একটি প্রেক্ষাপট আছে, যা নিম্নরূপ-

হিজরী ৬ষ্ঠ সালে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সন্ধি স্থাপিত হয়। হিজরতের পর থেকে সন্ধিস্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে। অধিকাংশ সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে চতুর্দিকে ইসলাম প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যায়নি। হিজরী ৬ষ্ঠ সালে তিনি প্রায় দেড় হাজার সাহাবীসহ উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকগণ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির ফেলতে বাধ্য হন। সেখানে অনেক আলাপ-আলোচনার পর কুরায়শদের সংগে তাঁর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থাপিত হয়। এ চুক্তির ফলে পূর্ণোদ্যমে দা'ওয়াতী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ হয়। অভ্যন্তরীণ প্রচার-প্রচারণার বাইরেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে দা'ওয়াতীপত্র প্রেরণ করতে থাকেন। এরকম একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল রোমের বাদশার কাছেও। পত্রবাহক ছিলেন হযরত দিহয়া কালবী রাযি.।

রোম সম্রাটের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি ও সম্রাটের তদন্ত
তখনকার রোমের বাদশা ছিলেন হিরাকল (হেরাক্লিয়াস)। উপাধি কায়সার/কাইযার। রোমের প্রত্যেক বাদশাকেই কাইযার বলা হত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি যখন তার হাতে পৌঁছায়, তখন তিনি ঈলিয়া (বায়তুল মুকাদ্দাস) অবস্থান করছিলেন। এর আগে পারস্যের সংগে যুদ্ধে তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন। পারস্য রাজ কিসরা তার দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি মানত করেছিলেন পরবর্তী যুদ্ধে তিনি কিসরাকে হারাতে পারলে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে ‘ইবাদত করবেন। সে উপলক্ষেই তার বায়তুল মুকাদ্দাস আগমন। আর ঠিক এ সময়ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি তার হাতে পৌঁছায়।

হিরাকল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। চিঠি পাওয়ার পর চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তিনি চাইলেন পত্রপ্রেরক (মহানবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। তারপর ভালোভাবে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাঁর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রদান আরবের কোনও লোকের পক্ষেই সম্ভব। সে লোক যদি মক্কার হয়, বিশেষত তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেউ হয়, তবে আরও ভালো। এমন কোনও লোক পাওয়া যায় কিনা, তিনি খোঁজ নিতে বললেন। ঘটনাক্রমে আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এ সময় ফিলিস্তীনে অবস্থান করছিল। তারাও যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত থাকায় এতদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিতে পারেনি। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্যই তাদের আয়-রোজগারের একমাত্র মাধ্যম। তাই যুদ্ধবিরতির সময়টাকে তারা এ কাজে লাগাচ্ছিল। যাহোক হিরাকলের লোকজন আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলার সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা তাদেরকে রাজদরবারে নিয়ে হাজির করল। কাফেলার প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর জানা গেল আবু সুফয়ানই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। উভয়ে একই কুরায়শ বংশের লোক ও মক্কার বাসিন্দা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা ভালো ধারণা তিনিই দিতে পারবেন। কাজেই কথোপকথনের জন্য কাফেলার লোকদের মধ্যে হিরাকল তাকেই নির্বাচন করলেন।

রোম সম্রাটের দরবারে আবূ সুফয়ান
সম্রাটের পারিষদবর্গের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন দরবারে উপস্থিত। আবূ সুফয়ানকে তাদের সামনে বসানো হল। তার সঙ্গীদের বসানো হল তার পেছনে। এটা ছিল হিরাকলের সতর্কর্তা। যাতে তারা পরস্পর ইশারা-ইঙ্গিতে ভাবের লেনদেন করতে না পারে। হিরাকল তাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। আবূ সুফয়ান তার প্রত্যেকটির সঠিক উত্তর দান করেন। একটি প্রশ্নেরও উত্তরে কোনও অসত্যকথা বলেননি। রাজনৈতিক কুটকৌশলের দিকে লক্ষ করলে এ ক্ষেত্রে তার মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কথা ছিল। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার শত্রু। তাঁকে দমন করার জন্য এ যাবতকাল অনেক শক্তি ক্ষয় করেছেন। কিন্তু তাতে সফলতা লাভ করতে পারেননি। এবার সফলতা লাভের একটা বড় সুযোগ হাতে এসে গেছে। রোমসম্রাট বলতে কথা। তখনকার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি। তাকে যদি খেপিয়ে দেওয়া যায়, তবে মদীনায় হামলা চালিয়ে নিমিষেই সবকিছু চুরমার করে দিতে পারে। ইসলামের মূলোৎপাটন করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রু দমনের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না। আবূ সুফয়ানেরও তা করার কথা নয়। কিন্তু সেজন্য যে কিছু মিথ্যাকথা বলতে হয়। সমস্যা এখানেই। আবূ সুফয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! লজ্জাই বাধ সেধেছে। আমি মিথ্যা বলি- এ কথা দেশময় প্রচার হয়ে যাবে। সেই লজ্জা! নয়তো আমি অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে মিথ্যাকথা বলতাম।

এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। আবূ সুফয়ান তখনও কাফের এবং ইসলামের ঘোরশত্রু। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা বলাকে নিজের পক্ষে লজ্জাস্কর মনে করেছেন। লোকে জানবে তিনি মিথ্যা বলেন, এটাকে নিজের পক্ষে অপমানকর মনে করেছেন। বিশেষত তিনি একজন জননেতা। লোকে জানবে তাদের নেতা মিথ্যা বলে। সেই লজ্জায় তিনি মিথ্যা বলা হতে বিরত থেকেছেন। আজ আমাদের কী অবস্থা! আমরা মুসলিম। নিজেদের মুসলিম বলে গর্ববোধ করি, অথচ অসত্য বলতে দ্বিধাবোধ করি না! কথায় কথায় মিথ্যা বলি। তা জনসম্মুখে প্রকাশ্যেই বলি। ছোটদের সামনে বলি, বড়দের সামনেও বলি। আপন-পর সকলের সামনেই বলি। একটুও লজ্জাবোধ হয় না। আহা! অমুসলিম অবস্থায় আবূ সুফয়ান মিথ্যা বলতে যেই লজ্জা বোধ করেছেন, সেই লজ্জাটুকুও যদি আমাদের থাকত!

সংক্ষিপ্ত নববী শিক্ষার ভেতর পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ছবি
যাহোক হিরাকল আবু সুফয়ানকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলেন। আমরা তার বিস্তারিত বিবরণের দিকে যাচ্ছি না। এ বর্ণনায়ও তা নেই। এখানে কেবল এতটুকু আছে যে, হিরাকল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের কী আদেশ করেন (অর্থাৎ কী শিক্ষা দেন)? আবূ সুফয়ান উত্তর দিলেন, তিনি বলে থাকেন- তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনওকিছুকে শরীক করো না। তোমাদের বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিত্যাগ কর। আর তিনি আমাদেরকে সালাত, সিদক (সততা ও সত্যবাদিতা), আফাফ (সংযম ও শুচিতা) ও আত্মীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন।

লক্ষ করলে বোঝা যায় এর ভেতর সংক্ষেপে ইসলামের মূল শিক্ষাসমূহ এসে গেছে। ইসলামের সর্বপ্রধান শিক্ষা 'আকীদা-বিশ্বাস। আকীদা-বিশ্বাসের ভেতর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাওহীদ। অর্থাৎ আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সংগে কাউকে শরীক না করা। এ হাদীছে প্রথমে সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে এটা ‘আকীদা বিষয়ক একটি শিরোনাম। আখিরাত, রিসালাত, তাকদীর প্রভৃতি বিষয়ক বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। মু'মিন হওয়ার জন্য তার সবগুলোতেই বিশ্বাস রাখা জরুরি। তবে সবার আগে যেহেতু তাওহীদ, তাই শিরোনাম হিসেবে এখানে তাওহীদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।

বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিহার করতে বলে মূলত শিরক পরিহারের কথাই বলা হয়েছে। আরবে যুগ-যুগ ধরে মূর্তিপূজা চলে আসছিল। পরের প্রজন্ম আগের প্রজন্মকে দেখে দেখে সেটাকেই সত্যধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। এর বিপরীত কোনও কথা তারা মানতে রাজি ছিল না। সাধারণভাবে সর্বত্র এটাই মানুষের চরিত্র। বাপ-দাদাদের যা করতে দেখে আসে তা করতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার বিপরীত কিছু মানতে রাজি হয় না। আরব মুশরিকগণও তা মানছিল না। তাদের বড় অভিযোগ ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আবূ সুফয়ান হয়তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষাটিকে অভিযোগ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি নিজেও বাপ-দাদার পথকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে নতুন পথে চলছেন, অন্যদেরও সে পথে চালাতে চাচ্ছেন। এভাবে বাপ-দাদাকে গোমরাহ সাব্যস্ত করা ও যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ধর্মমতকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করা কি কোনও সমর্থনযোগ্য কাজ? এটা কি চরম অন্যায় ও গর্হিত কাজ নয়? এজন্যই আমরা তার নতুন ধর্ম সমর্থন করতে পারছি না। সম্ভবত এই বলে তিনি হেরাক্লিয়াসকেও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। কারণ হেরাক্লিয়াস ও তার জাতিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া সত্যধর্মের বিপরীতে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ভ্রান্ত রীতি-নীতি অনুসরণ করছিল আর তাকেই প্রকৃত খৃষ্টধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। কিন্তু আবু সুফানের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। কেননা তার মুখ থেকে যাবতীয় তথ্য শোনার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য নবী এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বর, যাঁর সম্পর্কে আগের সমস্ত। নবী-রাসুল ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এ কারণে হেরাক্লিয়াস নিজেও ঈমান আনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন পারিষদবর্গ ও যাজক-পুরোহিতদের স্পষ্ট বিরোধিতা লক্ষ করলেন এবং তার পরিণতিতে সিংহাসন হারানোরও আশংকা বোধ করলেন, তখন ভ্রান্ত জানা সত্ত্বেও প্রচলিত খৃষ্ট ধর্মমতেই অবিচল থাকলেন। ক্ষমতার মোহে পড়লে মানুষ এভাবেই সত্যবিমুখ হয়ে থাকে এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার স্বার্থে আখিরাতের চিরস্থায়ী সফলতা বিসর্জন দেয়।

প্রকাশ থাকে যে, বাপ-দাদার কথা পরিত্যাগ করার প্রশ্ন আসে তখনই, যখন সে কথা ভ্রান্ত ও অসত্য হয়। পক্ষান্তরে বাপ-দাদার কথা যদি সত্য-সঠিক হয় এবং কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয়, তবে তা পরিত্যাগের প্রশ্ন আসে না; বরং এরূপ ক্ষেত্রে বাপ-দাদার প্রতি এ কারণে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, তাদের মাধ্যমে অতি সহজে সত্য সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া গেল। তাদের মাধ্যমে তা না পেলে হয়তো অনেক চিন্তা ভাবনা, সাধনা-গবেষণা ও কষ্ট-পরিশ্রম করতে হত। আর তাতে সফল না হওয়ারও আশংকা থাকত। আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানী যে, তিনি ফুকাহা-মুজতাহিদীনের শ্রম সাধনার ফল প্রজন্মপরম্পরার সহজ মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। এজন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর। তিনি আমাদের বাপ-দাদা তথা ফুকাহা-মুজতাহিদীন ও আসাতিযা মাশায়েখকে উম্মতের পক্ষ থেকে অনেক অনেক জাযায়ে খায়র দান করুন।

দ্বিতীয় বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন ইবাদত। এটা দীনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইবাদতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নামায়। এখানে সেই নামাযকে শিরোনাম বানিয়ে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী আদায়ের প্রতিও ইশারা করা হয়েছে।

তৃতীয় শিক্ষা হল সিদক ও সত্যবাদিতা। এটা সচ্চরিত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেই হিসেবে এটাও যেন একটি শিরোনাম। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্যে ভালো ভালো যত চরিত্র আছে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং তা তাঁর আনীত ধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

চতুর্থ নম্বরে আছে 'আফাফ। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু হারাম করেছেন তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলা। নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেকে কলুষিত না করা। অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হওয়ার নফস ও শয়তানী প্ররোচনার ক্ষেত্রে নিজেকে সংযত রাখা। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু হালাল করেছেন এবং যাকে যে পরিমাণ নি'আমত দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থেকে সবরকম সীমালঙ্ঘন থেকে নিজেকে সংযত রাখাই হচ্ছে 'আফাফ। ভিক্ষা করা বা অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকাও এর অন্তর্ভুক্ত। 'আফাফকে এককথায় ইন্দ্রিয়সংযমও বলা যায়। অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়চাহিদা পূরণে কোনও অবৈধ পন্থা অবলম্বন না করে বৈধ পন্থায় সন্তুষ্ট থাকা।

মৌলিকভাবে 'আফাফকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। (ক) যৌনচাহিদায় আত্নসংযম ও (খ) উপরচাহিদায় আত্মসংযম। প্রথম ক্ষেত্রে সংযমের অর্থ ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা এবং ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহ যোগায় এমন যাবতীয় বিষয় পরিহার করে চলা, যেমন পরনারীর দিকে তাকানো, নারীদের বেপর্দা চলাফেরা করা, নর-নারীর অবাধ মেলামেশা করা, দুই নর-নারীর নির্জন জায়গায় অবস্থান করা, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এমন ভাব-ভঙ্গী করা ও এমন ভাব-ভঙ্গীতে কথাবার্তা বলা ইত্যাদি।
উদরচাহিদা পূরণে আত্মসংযম মানে হারাম পানাহার বর্জন করা, অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকা, ভিক্ষাবৃত্তি পরিহার করা, অর্থবিত্তের লোভ না করা ইত্যাদি। অভাব অনটনের ক্ষেত্রেও অন্যের কাছে হাত না পাতাই শরী'আতের শিক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন তারা যেন কোনও অবস্থায়ই অন্যের কাছে কিছু না চায়। তারা সে প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছিলেন। এমনকি উটের পিঠে থাকা অবস্থায় কারও হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলে সে লাঠিটি তুলে দেওয়ার জন্যও কাউকে অনুরোধ করতেন না। এটাও ‘আফাফের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, মানুষ তার অভাব-অনটনের কথা কেবল আল্লাহ তা'আলাকেই জানাবে, কোনও মাখলুককে নয়।
এ হাদীছের পঞ্চম বিষয় হচ্ছে আত্মীয়তা রক্ষা। আত্মীয়তা রক্ষা করা ফরয। আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব আত্মীয়তার পর্যায়ক্রম অনুযায়ী। অর্থাৎ যে যত কাছের আত্মীয়, তার সংগে সম্পর্ক রক্ষা ততবেশি জরুরি। এ ব্যাপারে পিতামাতা ও ভাইবোন সবার উপরে। তারপর রক্তসম্পর্কিত আত্মীয় রক্তসম্পর্কহীন আত্মীয় অপেক্ষা বেশি কাছের। তাই তুলনামূলকভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় বেশি যত্নবান থাকা চাই। আত্মীয়তা রক্ষার অর্থ আত্মীয়দের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ও সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকা। এ ব্যাপারে এক আত্মীয় অবহেলা করলে সে অজুহাতে অপর আত্মীয়ের অবহেলা করার সুযোগ নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হল- আত্মীয়তা রক্ষাকারী ওই ব্যক্তি নয়, যে কেবল বদলা দেয়। অর্থাৎ অপর আত্মীয় তার সংগে ভালো ব্যবহার করলে সেও ভালো ব্যবহার করে, আর অপর আত্মীয় তার সংগে মন্দ ব্যবহার করলে সেও মন্দ ব্যবহার করে। বরং ওই ব্যক্তিই আত্মীয়তা রক্ষাকারী, যার সংগে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে সে তার নিজের দিক থেকে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ অপর আত্মীয় কী করল বা করল না সেদিকে নজর না দিয়ে নিজ কর্তব্যকর্ম পালন করে যায়।

লক্ষ করলে বোঝা যায় এ সংক্ষিপ্ত হাদীছে 'আকীদা-বিশ্বাস, ‘ইবাদত-বন্দেগী, আর্থিক লেনদেন, আখলাক-চরিত্র ও সামাজিকতা- ইসলামের এই মৌলিক বিষয়সমূহ সংক্ষেপে এসে গেছে। এ হাদীছ যেন পূর্ণাঙ্গ ইসলামের সংক্ষিপ্ত চিত্র। হেরাক্লিয়াসের প্রশ্নের উত্তরে আবূ সুফয়ান সংক্ষেপে যেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দা’ ওয়াতের বিষয়বস্তু তথা গোটা ইসলামেরই ছবি এঁকে দিয়েছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা সত্যবাদিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। কেননা এতে সত্যবাদিতাকে ইসলামী শিক্ষার একটি মূল বিষয়রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

খ. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামী দাওয়াতের পন্থা জানা যায়। প্রথমে দা'ওয়াত দেওয়া হবে তাওহীদের, তারপর নামাযের, তারপর পর্যায়ক্রমে আখলাক-চরিত্র ও অন্যান্য বিষয়ের।

গ. বাপ-দাদার ধর্মমত যদি সত্য না হয় এবং তাদের রীতি-নীতি যদি শরী'আতসম্মত না হয়, তবে তা অবশ্যবর্জনীয়।

ঘ. সকল কলুষ-কালিমা থেকে নিজ চরিত্র পবিত্র রাখা ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা।

ঙ. ইসলামে আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এ ব্যাপারে যত্নবান থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৫৬ | মুসলিম বাংলা