রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৪
'সিদক’ এর অর্থ ও ব্যাখ্যা
সিদক অর্থ সততা ও সত্যবাদিতা। মনের বিশ্বাস ও বাস্তবতার সংগে কোনও কথার সংগতিপূর্ণ হওয়াকে সিদক বলে। এরূপ কথাকে বলে 'কওলে সাদিক' (সত্য ও সঠিক কথা)। কোনও কথা সাদিক হওয়ার জন্য তার মধ্যে দু'টি গুণ থাকা অপরিহার্য। কথাটি বাস্তবানুগ হওয়া এবং সেই কথায় মনের বিশ্বাস থাকা। কথাটি যদি বাস্তবানুগ হয় কিন্তু তার প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস না থাকে, তবে সেই কথায় তাকে সাদিক ও সত্যবাদী বলা যায় না। সে কাযিব (মিথ্যাবাদী)। এজন্যই মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়া সত্ত্বেও কুরআন মাজীদে তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছে। কারণ তারা মুখে তাঁকে রাসূল বললেও মনে বিশ্বাস করত না।
এমনিভাবে যে কথায় ব্যক্তির বিশ্বাস থাকে কিন্তু কথাটি বাস্তবানুগ না হয়, তবে সে কথার বক্তাকেও সত্যবাদী বলা হবে না। কাজেই কোনও ভণ্ডনবীর অনুসারী যদি তাকে নবী বলে, তবে সে কথায় তার যতই বিশ্বাস থাকুক না কেন, বাস্তবতার সাথে মিল না থাকায় তা মিথ্যাই গণ্য হবে।
মনের বিশ্বাসের সাথে বাস্তবসম্মত কথাকে যেমন সাদিক বলে, তেমনি এরূপ কথার বক্তাকেও সাদিক বলা হয়ে থাকে। মৌলিকভাবে এ গুণটি কথার হলেও কর্ম ও বিশ্বাসের জন্যও এটি প্রযোজ্য হয়। অর্থাৎ কথার সাথে যদি কর্মের মিল থাকে বা বিশ্বাসের সাথে কর্মের, তবে সেই কর্মও সাদিক (যথার্থ) নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে প্রকৃত মু'মিনকে সাদিক বলা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেকে ঈমানদার বলে দাবি করে আর তার বাহ্যিক অবস্থা সেই দাবির সংগে সংগতিপূর্ণ হয় সে সাদিক, যেমন ইরশাদ হয়েছে-
{ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ (15)} [الحجرات: 15]
অর্থ: মুমিন তো তারা, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে অন্তর দিয়ে স্বীকার করেছে, তারপর কোনও সন্দেহে পড়েনি এবং তাদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারাই তো সত্যবাদী। হজুরাতঃ ১৫
এ আয়াতে প্রকৃত মু'মিনদের সত্যবাদী বলা হয়েছে। যেহেতু তাদের কর্ম তাদের ঈমানের দাবির সাথে সংগতিপূর্ণ। তারা তাদের কাজ দ্বারা ঈমানের দাবির সত্যতা প্রমাণ করে দেয়। এ হিসেবে বলা যায়, যার কথা ও কাজ এক হয় সে সাদিক। কিংবা বলুন, যার বিশ্বাসের সাথে কাজের মিল থাকে সে সাদিক। এভাবেও বলা যায় যে, যার মনের অবস্থার সাথে বাহ্যিক অবস্থা সংগতিপূর্ণ হয় সে সাদিক।
কথা ও কাজে মিল না থাকলে তা হয় মুনাফিকী। সুতরাং সিদক ও নিফাক একটা আরেকটার বিপরীত, যেমন মিথ্যা ও সিদকের বিপরীত। এমনিভাবে রিয়া ও সিদক পরস্পরবিরোধী। মুনাফিক ব্যক্তি সাদিক হতে পারে না। কারণ সে মুখে ঈমান প্রকাশ করে অথচ মনে বিশ্বাস নেই। অর্থাৎ তার বিশ্বাসের সাথে মুখের কথার মিল নেই। তাই সে সাদিক নয়, বরং কাযিব (মিথ্যুক)।
তদ্রূপ যে ব্যক্তি আমল করে মানুষকে দেখানোর জন্য, সেও সাদিক নয়। কেননা সে বাহ্যত আল্লাহর জন্য ইবাদত করছে বলে বোঝাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা করছে মানুষের জন্য। মানুষ তাকে আবেদ বলবে সেজন্য। বোঝা গেল আমলে সাদিক হওয়ার জন্য অন্তরে ইখলাস থাকা জরুরি।
যে ব্যক্তি কথা, কর্ম ও বিশ্বাসে সাদিক অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে সর্বদা সত্য-নিষ্ঠার পরিচয় দেয়, কখনও মিথ্যা বলে না, রিয়া পরিহার করে চলে এবং সর্বাবস্থায় মুনাফিকী-শঠতা থেকে দূরে থাকে, সেই প্রকৃত সাদিক ও সত্যবাদী। মূলত এরূপ চরিত্রের লোককে সিদ্দীক বলা হয়ে থাকে।
'সিদক'-এর সম্পর্ক যেহেতু কথা, কর্ম ও বিশ্বাস সবকিছুর সাথে তথা মানুষের সমগ্র জীবনের সাথে, সেহেতু ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটা ইসলামের অন্যতম প্রধান চারিত্ৰিক শিক্ষা। সমস্ত নবী-রাসূলগন এ গুণের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভের আগেও একজন সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার জাতি তাঁকে 'সাদিক' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের দৃষ্টিতে তাঁর নবুওয়াতপূর্ব জীবনের সত্যবাদিতা তাঁর নবুওয়াত দাবির সত্যতার পক্ষে অনেক বড় দলীল। নবুওয়াত লাভের পর তিনি মানুষকে যেসকল বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সংগে শিক্ষাদান করতেন, সিদক ও সত্যবাদিতাও তার একটি। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে এর প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। এর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আছে বহু হাদীছ। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তার আগে ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি আয়াত পেশ করেছেন। আমরা প্রথমে আয়াতসমূহের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।

সিদক ও সততা সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত

এক নং আয়াত
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ (119)} [التوبة: 119]
অর্থ : হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক। তাওবাঃ ১১৯

ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগে তাবুক যুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা আছে। এ যুদ্ধের সফর হয়েছিল হিজরী ৯ম সালে প্রচণ্ড গরমের মওসুমে। তখন খেজুর পাকারও মওসুম ছিল। আবার গন্তব্যস্থল ছিল বহুদূরে। তাও প্রচণ্ড শক্তিমান রোমক বাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই বেশিরভাগ মুনাফিক নানান বাহানায় এ যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। আলস্যবশত কয়েকজন খাঁটি মু'মিনও পিছিয়ে থেকেছিলেন। হযরত কা'ব রাযি, তাদের অন্যতম। পূর্বে তাওবা অধ্যায়ে তাঁর ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। তাতে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক থেকে ফেরার পর তিনি তাঁর কাছে কোনও মিথ্যা অজুহাত পেশ না করে সত্য প্রকাশ করেছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছিলেন, কেবল অলসতাবশেই তার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে সামাজিক বয়কটের কী কঠিন শাস্তি তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল, পূর্বোক্ত বর্ণনায় তা বিবৃত হয়েছে। কিন্তু সত্য বলার পুরস্কারে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তিনি ক্ষমার ঘোষণা পেয়ে যান। তাঁর সে ক্ষমার সনদ কুরআন মাজীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তা পাঠ করতে থাকবে এবং এই মহান সাহাবীর প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাবে। আখিরাতের অফুরন্ত পুরস্কারের পাশাপাশি দুনিয়ায় অগণিত মানুষের কাছে ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে চিরঞ্জীব হয়ে থাকার মহাপুরস্কার তিনি লাভ করেছেন কেবলই সত্য বলার বদৌলতে। সন্দেহ নেই কঠিন পরিস্থিতির ভেতর অকপট সত্য বলা কেবল তাকওয়ার কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তাই এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সকল মুমিনকে লক্ষ্য করে হুকুম দিচ্ছেন, তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সংগে থাক। তাকওয়া অবলম্বন করলে সত্য বলা সহজ হবে। আর সত্যবাদীদের সংগে থাকলে অন্তরে তাকওয়া বদ্ধমূল হবে। সত্য বলা মু'মিনের শান। সত্য মানুষকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করে। সত্যবাদীর জন্য রয়েছে আখিরাতের মহাপুরস্কার। সেই সংগে সত্যবাদী ব্যক্তি দুনিয়ায়ও ইজ্জত-সম্মান লাভ করে। তার প্রতি মানুষের আস্থা জন্মায়। মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। তার সাথে লেনদেন করতে ভরসা পায়। যে-কোনও কথা তার সাথে নিশ্চিন্তে বলতে পারে। তার কথাও গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে। ফলে তার পার্থিব জীবনযাপন অনেক সহজ হয়। দোজাহানের এতসব প্রাপ্তি যেই 'সিদক'-এর সংগে জড়িত, কোনও অবস্থায়ই তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। যাতে তা পরিত্যাগ করা না হয় এবং সদা সত্য বলা যায় ও সৎ জীবন যাপন করা হয়, সেজন্যই তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ।

সাদিকীনের সাহচর্য গ্রহণের জরুরত
যারা প্রকৃত মুত্তাকী তাদের সাহচর্য অবলম্বন করলে অর্থাৎ তাদের সাথে চলাফেরা করলে ও তাদের কাছে যাতায়াত করলে অন্তরে তাকওয়ার গুণ জন্মায়। যারা সাদিক তারাই মুত্তাকী, কিংবা বলুন মুত্তাকীগণই সাদিক। তাদের সাথে চলাফেরা করলে তাদের গুণও অন্তরে এসে যাবে। সাহচর্যের কিছু না কিছু প্রভাব থাকেই। তাই তো মানুষের মুখে মুখে চালু আছে, সৎসংগে স্বর্গবাস। আমরা বলব, জান্নাতবাস। মুত্তাকীর ঠিকানা জান্নাত। তার সংগে যে চলবে তার ঠিকানাও জান্নাত হবে বৈকি। তা হবে তার গুণ অর্জনের মাধ্যমে, সিদক ও সত্যতা যার একটি।
কুরআন মাজীদের হুকুম কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের প্রতি। এ আয়াতে যখন বলা হয়েছে সাদিকীনের সাহচর্য অবলম্বন কর, তখন বোঝা যাচ্ছে কিয়ামত পর্যন্ত সাদিকীনের জামাত থাকবে। কাজেই যারা তাকওয়া অবলম্বন করতে চায়, সাদিকীনের সাহচর্যে থেকে নিজের জীবন বদলাতে চায় এবং সিদক ও তাকওয়ার গুনে নিজেকে গুণান্বিত করতে চায়, তাদের কর্তব্য সাদিকীন খুঁজে নেওয়া। খুঁজলে অবশ্যই পাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত সাদিকীনের সাহচর্যে থাকার তাওফীক দান করুন।

শিক্ষা
ক. এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় সাহচর্য অবশ্যই তাছীর ও প্রভাব রাখে।
খ. নিজের জীবনে তাকওয়া ও সিদকের গুণ আনয়নের লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিত মুত্তাকী ও সাদিকীনের সাহচর্য অবলম্বন করা ।

দুই নং আয়াত
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ} [الأحزاب: 35]
এবং সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারীগণ। আহযাবঃ ৩৫

ব্যাখ্যা
এটি সূরা আহযাবের একটি দীর্ঘ আয়াতের অংশবিশেষ। আখিরাতে যারা আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত ও মহাপুরস্কারের অধিকারী হবে, তাদের কি কি গুণের অধিকারী হওয়া জরুরি, এ আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল সততা ও সত্যবাদিতা। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, আখিরাতে আল্লাহ তা'আলার কাছে মাগফিরাত লাভই প্রত্যেক মুমিনের পরম লক্ষ্য। যে ব্যক্তি মাগফিরাত লাভ করবে, কেবল সেই জান্নাতে যাবে এবং তার কল্পনাতীত নিআমত ভোগ করবে। জান্নাত ও তার নিআমতসমূহই আল্লাহর পক্ষ থেকে নেক বান্দার মহাপুরস্কার। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাকে সেই মহাপুরস্কার দেওয়ার কথা বলে উৎসাহ যোগাচ্ছেন, যেন সে অবশ্যই এ আয়াতে বর্ণিত সত্যবাদিতাসহ অন্যান্য গুণ অর্জনে সদা সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তা অর্জনের তাওফীক দান করুন।

শিক্ষা
ক. মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের জন্য সত্যবাদিতার গুণ অর্জন করা জরুরি।
খ. এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় পুরস্কার ঘোষণা মানুষকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করার পক্ষে সহায়ক। বলা যায় এটা ভালো কাজে উৎসাহদানের কুরআনী পন্থা।

তিন নং আয়াত
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{طَاعَةٌ وَقَوْلٌ مَعْرُوفٌ فَإِذَا عَزَمَ الْأَمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا اللَّهَ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ (21)} [محمد: 21]
অর্থ : তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে সত্যবাদিতার পরিচয় দিত, তবে তাদের জন্য ভালো হত। মুহাম্মাদঃ ২১

ব্যাখ্যা
মুনাফিকরা আল্লাহর সংগেও মিথ্যাচার করত। সবকিছুতে শঠতা প্রদর্শন করত। মনে যা থাকত, মুখে বলত তার বিপরীত কথা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংগেও প্রতারণা করত। প্রকাশ্যে দেখাত তারা যেন তাঁর কত খাঁটি অনুসারী। প্রকৃতপক্ষে ছিল ঘোর বিরোধী। তাদের লক্ষ্য করে এ আয়াতে বলা হয়েছে, তারা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সংগে সততা অবলম্বন করত, মিথ্যাচার ও শঠতা পরিহার করে অকৃত্রিম আচরণ করত, তবে তাদের পক্ষে কতই না মঙ্গলজনক হত। কিন্তু তা না করায় তারা কেবল মঙ্গল থেকেই বঞ্চিত নয়, দুনিয়া ও আখিরাতে নিজেদের চরম লাঞ্ছনায়ও নিক্ষেপ করছে।
এ আয়াতে মূলত মুনাফিকদের অবস্থা তুলে ধরে মুমিনদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তারা যেন কোনও অবস্থায়ই মিথ্যাচার ও কপটতায় লিপ্ত না হয়। যেন সদা সত্য কথা বলে ও সৎপথে চলে। অন্যথায় মুনাফিকদের অনুরূপ পরিণতি তাদেরও ভোগ করতে হবে।

শিক্ষা
ক. মিথ্যাচার ও শঠতা মুনাফিকদের চরিত্র। মু'মিনদের তা থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
খ. দুষ্টলোকের দুষ্কর্মের উল্লেখও নসীহতের একটি পন্থা। মানুষকে সৎকাজে অনুপ্রাণিত করার পক্ষেও তা বেশ উপকারী।
৫৪। সিদ্‌ক ও সততা সম্পর্কে কয়েকটি হাদীছ ; সত্যবাদিতার সুফল ও মিথ্যাচারের কুফল

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সত্যবাদিতা নেককাজের পথ দেখায়। আর নেককাজ জান্নাতে পৌঁছায়। ব্যক্তি সত্যকথা বলতে থাকে, এমনকি একসময় সে আল্লাহর কাছে 'সিদ্দীক' নামে লিখিত (অভিহিত) হয়। অন্যদিকে মিথ্যাবাদিতা পাপাচারের পথ দেখায়। আর পাপাচার জাহান্নামে পৌঁছায়। ব্যক্তি মিথ্যাচার করতে থাকে। অবশেষে আল্লাহর কাছে সে 'কায্যাব' (মহামিথ্যুক) নামে লিখিত (অভিহিত) হয় - বুখারী ও মুসলিম। (বুখারী হাদীস নং ৬০৯৪, মুসলিম হাদীস নং ২৬০৭)
4 - باب الصدق
54 - فالأول: عن ابن مسعود - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنَّ الصِّدقَ يَهْدِي إِلَى البرِّ، وإنَّ البر يَهدِي إِلَى الجَنَّةِ، وإنَّ الرَّجُلَ لَيَصدُقُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا. وَإِنَّ الكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الفُجُورِ، وَإِنَّ الفُجُورَ يَهدِي إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكتَبَ عِنْدَ الله كَذَّابًا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে সত্যবাদিতার সুফল ও মিথ্যাবাদিতার কুফল বর্ণনা করা হয়েছে। সত্যবাদিতার দুনিয়াবী সুফল হল বেশি বেশি নেককাজের সুযোগ লাভ হওয়া আর পরকালীন সুফল হল জান্নাত লাভ করা।

কেউ যখন কোনও একটি সত্যকথা বলে বা একটি সৎকাজ করে, তখন তার অন্তরে আরও বেশি সত্যতা ও সাধুতার আগ্রহ জন্মায়। সত্যকথন দ্বারা অন্তরে শক্তি সঞ্চার হয়। নিজের প্রতি আস্থা জন্মায়। ফলে আরও বেশি সত্য বলার ও সৎকাজ করার সাহস হয়। এরূপ লোক একের পর এক সত্য বলতে থাকে। ফলে তাদের প্রতি মানুষেরও আস্থা জন্মায়। মানুষ তাদের ভালোবাসে ও তাদের সুনাম-সুখ্যাতি করে। আল্লাহ তা'আলাও সত্যবাদীদের ভালোবাসেন। ফলে তিনি সত্যের উপর অটল থাকার ও সৎপথে এগিয়ে যাওয়ার তাওফীক তাদের দান করেন। এজন্যই তাদের দ্বারা বেশি বেশি নেককাজ করা সম্ভব হয়। তারা নেককাজে মানুষের সহযোগিতা লাভ করে। বরং নেককাজে মানুষ তাদের আদর্শরূপে গণ্য করে। তাদের দেখাদেখি আমসাধারণ সত্য বলতে উৎসাহ পায় ও নেককাজে অনুপ্রাণিত হয়। এসব সত্য বলার দুনিয়াবী ফায়দা সত্য বলার দ্বারা অন্তরে সাহস সঞ্চার হয়, বেশি বেশি নেককাজের তাওফীক হয়, মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা লাভ হয়, সত্যবাদী হিসেবে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জিত হয়। এবং প্রয়োজনমুহূর্তে মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যায়।

সত্য যেহেতু নেককাজের দিকে পরিচালিত করে, তাই এর দ্বারা পরকালীন ফায়দা লাভের ব্যাপারটা তো স্পষ্ট। যতবেশি নেককাজ করা যায়, ততই জান্নাতের পথ সুগম হয় ও আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা অর্জিত হয়। একপর্যায়ে আল্লাহ তা'আলা সত্যবাদীদেরকে 'সিদ্দীক' নামে অভিহিত করেন। ফলে তারা হাশরে নবী-রাসূল, শুহাদা ও সালিহীনের সংগে স্থান পাবে এবং জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভ করবে। সত্যনিষ্ঠার সত্যিকারের সুফল সেদিন তারা নিজ চোখে দেখতে পাবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থ : এটা সেই দিন, যে দিন সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যতা উপকৃত করবে। তাদের জন্য রয়েছে এমন সব উদ্যান, যার তলদেশে নহর প্রবহমান। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটাই মহা সাফল্য।

মিথ্যার ব্যাপারটা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কেউ যখন কোনও মিথ্যাকথা বলে বা অসৎকাজ করে, তখন তার গর্হিত কার্যকলাপ সেই একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একটি মিথ্যা ঢাকার জন্য আরও দশটি মিথ্যা বলতে হয়। একটি অসৎকাজ লুকানোর জন্য নানা অসৎপন্থা অবলম্বন করতে হয়। এভাবে তার অসত্যের সিলসিলা সামনে চলতেই থাকে। একপর্যায়ে সে মিথ্যাচার ও পাপ-পঙ্কিলতায় এভাবে জড়িয়ে যায় যে,তা থেকে তার মুক্তি পাওয়া সহজ হয় না। তখন আল্লাহর কাছে তার নামই হয়ে যায় 'কাযযাব’ ও মহামিথ্যুক।

এরূপ ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুনিয়ায় মানুষের কাছে মিথ্যুক নামে পরিচিতি পায়। তার প্রতি মানুষের আস্থা থাকে না। সে মানুষের ভালোবাসা হারায়। ফলে কাজেকর্মে তাদের সহযোগিতা পায় না। মিথ্যা বলার দরুন সে মানসিক শক্তিও হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে তার সত্য বলার সাহস থাকে না। পায় না সৎপথে চলার উৎসাহ। মিথ্যাতেই যেন সে স্বস্তি বোধ করে। অন্যায়-অনাচারের পথে চলতে উৎসাহ পায়। অন্যায়পথে চলতে চলতে সে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। তার সদগুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়। তখন ঘরে-বাইরে কারও কাছেই তার বিশেষ ইজ্জত থাকে না। এসব তার পার্থিব ক্ষতি। আখিরাতের ক্ষতি আরও বড়। কবরে, হাশরে, পুলসিরাতে সব জায়গায় সে আটকে যাবে। তার শেষ ঠিকানা জাহান্নাম। সেখানে তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ- وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ
আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের মিথ্যাচারের কারণে।
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে হেফাজত করুন।

এ হাদীছে বলা হয়েছে- এমনকি একসময় সে আল্লাহর কাছে 'সিদ্দীক' নামে লিখিত (অভিহিত) হয়। আল্লাহ তা'আলার পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে নবীগণের পরই সিদ্দীকদের মর্যাদা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا

অর্থ : যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা সেই সকল লোকের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও সালিহগণের সঙ্গে। কতই না উত্তম সঙ্গী তারা!

তো যে ব্যক্তি সদা সত্য বলে, কঠিন থেকে কঠিনতম পরিস্থিতিতেও সত্যের উপর অটল থাকে, কোনও অবস্থায়ই মিথ্যা বলে না, এমনকি হাসি-ঠাট্টা করেও না, তারাই এ মর্যাদা লাভ করে থাকে। তারাই আল্লাহর কাছে সিদ্দীক নামে অভিহিত। এ ব্যাপারে নারী-পুরুষের কোনও ভেদাভেদ নেই। সত্যনিষ্ঠ পুরুষ ‘সিদ্দীক' আর সত্যনিষ্ঠ নারী 'সিদ্দীকা'। কুরআন মাজীদে হযরত মারয়াম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছে وَأُمُّهُ صِدِّيقَةٌ (এবং তার মা [অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালামের মা হযরত মারয়াম] হলেন সিদ্দীকা)।

এ উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্দীক হলেন হযরত আবূ বকর রাযি.। তাঁর কন্যা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. এ উম্মতের নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সিদ্দীকা।

প্রকাশ থাকে যে, সিদ্দীক হওয়ার জন্য পরিপক্ক ঈমান শর্ত। ঈমান-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে সত্য বলে জানা ও তার প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন দ্বারাই কোনও ব্যক্তির পক্ষে সিদ্দীকের মর্যাদায় উপনীত হওয়া সম্ভব। এ মর্যাদা লাভের জন্য কেবল কথাবার্তায় সত্যনিষ্ঠ হওয়া যথেষ্ট নয়। কুরআন ও হাদীছে যা-কিছু বর্ণিত হয়েছে, তার কোনওটিতে বিন্দুমাত্র সন্দেহও এ মর্যাদা লাভের পক্ষে বাধা, যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা তা আয়ত্ত করা সম্ভব না হলেও। কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত কোনও একটি বিষয় যদি বুঝে না আসে, তবে তা না বোঝাকে নিজ অক্ষমতা গণ্য করতে হবে। সে বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কোনও অবকাশ নেই। সুতরাং সিদ্দীক হতে চাইলে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ'র যাবতীয় বিষয়ে অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত বিশ্বাসস্থাপন জরুরি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা সততা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ লাভ হয়। আরও জানা যায় বেশি বেশি নেককাজ করার তাওফীক ও জান্নাতে পৌঁছার সৌভাগ্য লাভের জন্য সদা সর্বদা সত্যনিষ্ঠ থাকা উচিত।

খ. আরও জানা যায় মিথ্যা কত গুরুতর পাপ। নানামুখী পাপাচার থেকে বাঁচা ও জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষার জন্য মিথ্যা পরিহার করা যে অতি জরুরি, এ হাদীছ দ্বারা সে শিক্ষা লাভ হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৫৪ | মুসলিম বাংলা