রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১২
অধ্যায়: ১
পরিচ্ছেদঃ সমস্ত কাজ ও কথায় এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় অবস্থায় ইখলাস ও সহীহ নিয়তের গুরুত্ব।
পরিচ্ছেদঃ সমস্ত কাজ ও কথায় এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় অবস্থায় ইখলাস ও সহীহ নিয়তের গুরুত্ব।
১২। ইখলাসবিশিষ্ট আমলের অছিলায় বিপদ থেকে মুক্তি
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্বকালে তিনজন লোক পথ চলছিল। এক পর্যায়ে তারা রাত যাপনের জন্য একটা পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করল। এ অবস্থায় পাহাড় থেকে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তারা পরস্পরে বলল, এই পাথর থেকে তোমাদেরকে কোনও কিছুই মুক্তি দিতে পারবে না। তোমরা তোমাদের কোনও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দু'আ করা ছাড়া আর কোনও উপায়েই এই পাথর থেকে মুক্তি পাবে না। (সেমতে) তাদের এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার অতিশয় বৃদ্ধ বাবা-মা ছিল। আমি তাদের আগে আমার পরিবারবর্গ (স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি) অথবা আমার কোনও সম্পদকে (দাস-দাসীকে) পানাহার করাতাম না। (একদিনকার কথা) গাছের সন্ধানে আমাকে অনেক দূরে যেতে হল। ফলে আমার ফিরে আসতে আসতে তারা ঘুমিয়ে গেল। আমি তাদের পান করানোর জন্য দুধ দোয়ালাম। তারপর তা নিয়ে এসে দেখলাম তারা ঘুমিয়ে আছে। এ অবস্থায় তাদের জাগানো আমার পছন্দ হল না। আবার আমার পরিবারবর্গ ও দাস-দাসীকে তাদের আগে পান করানোও ভালো লাগল না। এভাবে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম যে, আমার হাতে দুধের পাত্র। কখন তারা জাগবে সেই অপেক্ষা করছি আর শিশুরা আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছে। শেষ পর্যন্ত ফজর হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগল এবং তাদের পানীয় পান করল। হে আল্লাহ! আমি যদি এটা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা এই যে পাথরের নিচে পড়ে আছি, এর থেকে আমাদের পথ খুলে দাও। ফলে পাথরটা একটুখানি সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা সেখান থেকে বের হতে পারছিল না।
দ্বিতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। সে ছিল আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় মানুষ। অপর এক বর্ণনায় আছে, আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম,, যেমনটা নারীদের পুরুষগণ ভালোবেসে থাকে। আমি তার কাছে তার নিজেকে কামনা করলাম, কিন্তু সে আমার থেকে আত্মরক্ষা করল। এক পর্যায়ে সে খরাজনিত অভাবে পড়ে গেল। তখন আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসল। আমি তাকে এই শর্তে একশ' বিশ দীনার দিলাম যে, সে তার নিজেকে আমার হাতে ছেড়ে দেবে। সে তাতে সম্মত হল। পরিশেষে যখন তাকে গ্রহণে সক্ষম হলাম, অপর এক বর্ণনায় আছে যখন আমি তার দু পায়ের মাঝে বসলাম, সে বলল, আল্লাহকে ভয় করো। তুমি ন্যায়সঙ্গত অধিকার ছাড়া মোহর ভেঙ্গে ফেলো না (অর্থাৎ সতীত্ব হরণ করো না)। (আমি তার এ কথায় সচেতন হয়ে গেলাম) ফলে তার কাছ থেকে সরে গেলাম। অথচ সে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় মানুষ। আমি যে সোনা (দীনার) তাকে দিয়েছিলাম, তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি তা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা যে অবস্থায় আছি তা থেকে আমাদের মুক্তি দাও। ফলে পাথরটি আরেকটু সরে গেল। কিন্তু তাতেও তারা তা থেকে বের হতে পারছিল না।
তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন শ্রমিক ভাড়া করেছিলাম। তাদেরকে তাদের পারিশ্রমিকও দিয়েছিলাম, তবে এক ব্যক্তি ছাড়া। তার যা পাওনা ছিল সে রেখে চলে গেল। আমি তার পারিশ্রমিক বিনিয়োগ করতে থাকলাম। ফলে তা বেড়ে প্রচুর সম্পদ হয়ে গেল। কিছুকাল পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার পারিশ্রমিক আমাকে আদায় করে দাও। আমি তাকে বললাম, এই যে উট, গরু, ছাগল ও গোলাম দেখছ, এসবই তোমার সেই পারিশ্রমিক থেকে উৎপন্ন। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আমার সংগে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, তোমার সংগে ঠাট্টা করছি না। সুতরাং সে তা সব গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। তা থেকে কিছুই রেখে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা যে অবস্থায় আছি তা থেকে তুমি আমাদের মুক্তি দাও। তখন পাথরটি (পুরোপুরি) সরে গেল এবং তারা বের হয়ে চলে গেল - বুখারী ও মুসলিম।
(বুখারী হাদীস নং ২২৭২,মুসলিম হাদীস নং ২৭৪৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের পূর্বকালে তিনজন লোক পথ চলছিল। এক পর্যায়ে তারা রাত যাপনের জন্য একটা পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করল। এ অবস্থায় পাহাড় থেকে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তারা পরস্পরে বলল, এই পাথর থেকে তোমাদেরকে কোনও কিছুই মুক্তি দিতে পারবে না। তোমরা তোমাদের কোনও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দু'আ করা ছাড়া আর কোনও উপায়েই এই পাথর থেকে মুক্তি পাবে না। (সেমতে) তাদের এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার অতিশয় বৃদ্ধ বাবা-মা ছিল। আমি তাদের আগে আমার পরিবারবর্গ (স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি) অথবা আমার কোনও সম্পদকে (দাস-দাসীকে) পানাহার করাতাম না। (একদিনকার কথা) গাছের সন্ধানে আমাকে অনেক দূরে যেতে হল। ফলে আমার ফিরে আসতে আসতে তারা ঘুমিয়ে গেল। আমি তাদের পান করানোর জন্য দুধ দোয়ালাম। তারপর তা নিয়ে এসে দেখলাম তারা ঘুমিয়ে আছে। এ অবস্থায় তাদের জাগানো আমার পছন্দ হল না। আবার আমার পরিবারবর্গ ও দাস-দাসীকে তাদের আগে পান করানোও ভালো লাগল না। এভাবে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম যে, আমার হাতে দুধের পাত্র। কখন তারা জাগবে সেই অপেক্ষা করছি আর শিশুরা আমার পায়ের কাছে পড়ে কান্নাকাটি করছে। শেষ পর্যন্ত ফজর হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগল এবং তাদের পানীয় পান করল। হে আল্লাহ! আমি যদি এটা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা এই যে পাথরের নিচে পড়ে আছি, এর থেকে আমাদের পথ খুলে দাও। ফলে পাথরটা একটুখানি সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা সেখান থেকে বের হতে পারছিল না।
দ্বিতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। সে ছিল আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় মানুষ। অপর এক বর্ণনায় আছে, আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম,, যেমনটা নারীদের পুরুষগণ ভালোবেসে থাকে। আমি তার কাছে তার নিজেকে কামনা করলাম, কিন্তু সে আমার থেকে আত্মরক্ষা করল। এক পর্যায়ে সে খরাজনিত অভাবে পড়ে গেল। তখন আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসল। আমি তাকে এই শর্তে একশ' বিশ দীনার দিলাম যে, সে তার নিজেকে আমার হাতে ছেড়ে দেবে। সে তাতে সম্মত হল। পরিশেষে যখন তাকে গ্রহণে সক্ষম হলাম, অপর এক বর্ণনায় আছে যখন আমি তার দু পায়ের মাঝে বসলাম, সে বলল, আল্লাহকে ভয় করো। তুমি ন্যায়সঙ্গত অধিকার ছাড়া মোহর ভেঙ্গে ফেলো না (অর্থাৎ সতীত্ব হরণ করো না)। (আমি তার এ কথায় সচেতন হয়ে গেলাম) ফলে তার কাছ থেকে সরে গেলাম। অথচ সে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় মানুষ। আমি যে সোনা (দীনার) তাকে দিয়েছিলাম, তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি তা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা যে অবস্থায় আছি তা থেকে আমাদের মুক্তি দাও। ফলে পাথরটি আরেকটু সরে গেল। কিন্তু তাতেও তারা তা থেকে বের হতে পারছিল না।
তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন শ্রমিক ভাড়া করেছিলাম। তাদেরকে তাদের পারিশ্রমিকও দিয়েছিলাম, তবে এক ব্যক্তি ছাড়া। তার যা পাওনা ছিল সে রেখে চলে গেল। আমি তার পারিশ্রমিক বিনিয়োগ করতে থাকলাম। ফলে তা বেড়ে প্রচুর সম্পদ হয়ে গেল। কিছুকাল পর সে আমার কাছে আসল এবং বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার পারিশ্রমিক আমাকে আদায় করে দাও। আমি তাকে বললাম, এই যে উট, গরু, ছাগল ও গোলাম দেখছ, এসবই তোমার সেই পারিশ্রমিক থেকে উৎপন্ন। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আমার সংগে ঠাট্টা করো না। আমি বললাম, তোমার সংগে ঠাট্টা করছি না। সুতরাং সে তা সব গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। তা থেকে কিছুই রেখে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তা তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি, তবে আমরা যে অবস্থায় আছি তা থেকে তুমি আমাদের মুক্তি দাও। তখন পাথরটি (পুরোপুরি) সরে গেল এবং তারা বের হয়ে চলে গেল - বুখারী ও মুসলিম।
(বুখারী হাদীস নং ২২৭২,মুসলিম হাদীস নং ২৭৪৩)
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
بَابُ الْإِخْلَاصِ وَإِحْضَارِ النَّيَّةِ فِي جَمِيعِ الْأَعْمَالِ وَ الْأَقْوَالِ وَالْأَحْوَالِ الْبَارِزَةِ وَالْخَفِيَّةِ
بَابُ الْإِخْلَاصِ وَإِحْضَارِ النَّيَّةِ فِي جَمِيعِ الْأَعْمَالِ وَ الْأَقْوَالِ وَالْأَحْوَالِ الْبَارِزَةِ وَالْخَفِيَّةِ
12 - وعن أبي عبد الرحمان عبدِ الله بنِ عمرَ بن الخطابِ رضيَ اللهُ عنهما، قَالَ: سمعتُ رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «انطَلَقَ ثَلاثَةُ نَفَرٍ (1) مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حَتَّى آوَاهُمُ المَبيتُ إِلى غَارٍ فَدَخلُوهُ، فانْحَدرَتْ صَخْرَةٌ مِنَ الجَبَلِ فَسَدَّتْ عَلَيْهِمُ الغَارَ، فَقالُوا: إِنَّهُ لاَ يُنْجِيكُمْ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةِ إِلاَّ أَنْ تَدْعُوا اللهَ بصَالِحِ أعْمَالِكُمْ.
قَالَ رجلٌ مِنْهُمْ: اللَّهُمَّ كَانَ لِي أَبَوانِ شَيْخَانِ كبيرانِ، وكُنْتُ لا أغْبِقُ (1) قَبْلَهُمَا أهْلًا ولاَ مالًا، فَنَأَى (2) بِي طَلَب الشَّجَرِ يَوْمًا فلم أَرِحْ عَلَيْهمَا حَتَّى نَامَا، فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوقَهُمَا فَوَجَدْتُهُما نَائِمَينِ، فَكَرِهْتُ أَنْ أُوقِظَهُمَا وَأَنْ أغْبِقَ قَبْلَهُمَا أهْلًا أو مالًا، فَلَبَثْتُ - والْقَدَحُ عَلَى يَدِي - أنتَظِرُ اسْتِيقَاظَهُما حَتَّى بَرِقَ الفَجْرُ والصِّبْيَةُ يَتَضَاغَوْنَ (3) عِنْدَ قَدَميَّ، فاسْتَيْقَظَا فَشَرِبا غَبُوقَهُما. اللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابِتِغَاء وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةِ، فانْفَرَجَتْ شَيْئًا لا يَسْتَطيعُونَ الخُروجَ مِنْهُ.
قَالَ الآخر: اللَّهُمَّ إنَّهُ كانَتْ لِيَ ابْنَةُ عَمّ، كَانَتْ أَحَبَّ النّاسِ إليَّ - وفي رواية: كُنْتُ أُحِبُّها كأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النساءَ - فأَرَدْتُهَا عَلَى نَفْسِهَا (4) فامْتَنَعَتْ منِّي حَتَّى أَلَمَّتْ بها سَنَةٌ مِنَ السِّنِينَ فَجَاءتْنِي فَأَعْطَيْتُهَا عِشْرِينَ وَمئةَ دينَارٍ عَلَى أَنْ تُخَلِّيَ بَيْني وَبَيْنَ نَفْسِهَا فَفعَلَتْ، حَتَّى إِذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا - وفي رواية: فَلَمَّا قَعَدْتُ بَينَ رِجْلَيْهَا، قالتْ: اتَّقِ اللهَ وَلاَ تَفُضَّ الخَاتَمَ إلاّ بِحَقِّهِ (5)، فَانصَرَفْتُ عَنْهَا وَهيَ أَحَبُّ النَّاسِ إليَّ وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِي أعْطَيتُها. اللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغاءَ وَجْهِكَ فافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فيهِ، فانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، غَيْرَ أَنَّهُمْ لا يَسْتَطِيعُونَ الخُرُوجَ مِنْهَا.
وَقَالَ الثَّالِثُ: اللَّهُمَّ اسْتَأْجَرْتُ أُجَرَاءَ وأَعْطَيْتُهُمْ أجْرَهُمْ غيرَ رَجُل واحدٍ تَرَكَ الَّذِي لَهُ وَذَهبَ، فَثمَّرْتُ أجْرَهُ حَتَّى كَثُرَتْ مِنهُ الأمْوَالُ، فَجَاءنِي بَعدَ حِينٍ، فَقالَ: يَا عبدَ اللهِ، أَدِّ إِلَيَّ أجْرِي، فَقُلْتُ: كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أجْرِكَ: مِنَ الإبلِ وَالبَقَرِ والْغَنَمِ والرَّقيقِ، فقالَ: يَا عبدَ اللهِ، لاَ تَسْتَهْزِىءْ بي! فَقُلْتُ: لاَ أسْتَهْزِئ بِكَ، فَأَخَذَهُ كُلَّهُ فاسْتَاقَهُ فَلَمْ يتْرُكْ مِنهُ شَيئًا. الَّلهُمَّ إنْ كُنتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابِتِغَاءَ وَجْهِكَ فافْرُجْ عَنَّا مَا نَحنُ فِيهِ، فانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ فَخَرَجُوا يَمْشُونَ». (6) مُتَّفَقٌ عليهِ. (7)
قَالَ رجلٌ مِنْهُمْ: اللَّهُمَّ كَانَ لِي أَبَوانِ شَيْخَانِ كبيرانِ، وكُنْتُ لا أغْبِقُ (1) قَبْلَهُمَا أهْلًا ولاَ مالًا، فَنَأَى (2) بِي طَلَب الشَّجَرِ يَوْمًا فلم أَرِحْ عَلَيْهمَا حَتَّى نَامَا، فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوقَهُمَا فَوَجَدْتُهُما نَائِمَينِ، فَكَرِهْتُ أَنْ أُوقِظَهُمَا وَأَنْ أغْبِقَ قَبْلَهُمَا أهْلًا أو مالًا، فَلَبَثْتُ - والْقَدَحُ عَلَى يَدِي - أنتَظِرُ اسْتِيقَاظَهُما حَتَّى بَرِقَ الفَجْرُ والصِّبْيَةُ يَتَضَاغَوْنَ (3) عِنْدَ قَدَميَّ، فاسْتَيْقَظَا فَشَرِبا غَبُوقَهُما. اللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابِتِغَاء وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةِ، فانْفَرَجَتْ شَيْئًا لا يَسْتَطيعُونَ الخُروجَ مِنْهُ.
قَالَ الآخر: اللَّهُمَّ إنَّهُ كانَتْ لِيَ ابْنَةُ عَمّ، كَانَتْ أَحَبَّ النّاسِ إليَّ - وفي رواية: كُنْتُ أُحِبُّها كأَشَدِّ مَا يُحِبُّ الرِّجَالُ النساءَ - فأَرَدْتُهَا عَلَى نَفْسِهَا (4) فامْتَنَعَتْ منِّي حَتَّى أَلَمَّتْ بها سَنَةٌ مِنَ السِّنِينَ فَجَاءتْنِي فَأَعْطَيْتُهَا عِشْرِينَ وَمئةَ دينَارٍ عَلَى أَنْ تُخَلِّيَ بَيْني وَبَيْنَ نَفْسِهَا فَفعَلَتْ، حَتَّى إِذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا - وفي رواية: فَلَمَّا قَعَدْتُ بَينَ رِجْلَيْهَا، قالتْ: اتَّقِ اللهَ وَلاَ تَفُضَّ الخَاتَمَ إلاّ بِحَقِّهِ (5)، فَانصَرَفْتُ عَنْهَا وَهيَ أَحَبُّ النَّاسِ إليَّ وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِي أعْطَيتُها. اللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغاءَ وَجْهِكَ فافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فيهِ، فانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، غَيْرَ أَنَّهُمْ لا يَسْتَطِيعُونَ الخُرُوجَ مِنْهَا.
وَقَالَ الثَّالِثُ: اللَّهُمَّ اسْتَأْجَرْتُ أُجَرَاءَ وأَعْطَيْتُهُمْ أجْرَهُمْ غيرَ رَجُل واحدٍ تَرَكَ الَّذِي لَهُ وَذَهبَ، فَثمَّرْتُ أجْرَهُ حَتَّى كَثُرَتْ مِنهُ الأمْوَالُ، فَجَاءنِي بَعدَ حِينٍ، فَقالَ: يَا عبدَ اللهِ، أَدِّ إِلَيَّ أجْرِي، فَقُلْتُ: كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أجْرِكَ: مِنَ الإبلِ وَالبَقَرِ والْغَنَمِ والرَّقيقِ، فقالَ: يَا عبدَ اللهِ، لاَ تَسْتَهْزِىءْ بي! فَقُلْتُ: لاَ أسْتَهْزِئ بِكَ، فَأَخَذَهُ كُلَّهُ فاسْتَاقَهُ فَلَمْ يتْرُكْ مِنهُ شَيئًا. الَّلهُمَّ إنْ كُنتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابِتِغَاءَ وَجْهِكَ فافْرُجْ عَنَّا مَا نَحنُ فِيهِ، فانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ فَخَرَجُوا يَمْشُونَ». (6) مُتَّفَقٌ عليهِ. (7)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনায় যে আমল করা হয়, তা কেবল আখিরাতেই উপকারে আসে না, বরং তার অছিলায় পার্থিব জীবনেও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে আমল করা হয় তাকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহর কাছে দু'আ করলে আল্লাহ তা'আলা তা কবূল করেন এবং বান্দার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। এ হাদীছে তিনজন ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা কোথাও যাচ্ছিল। পথে রাত হয়ে গেলে সেই রাত কাটানোর প্রয়োজনে তারা একটা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। এ অবস্থায় একটা বিশাল পাথরের চাই পাহাড় থেকে সেই গুহামুখে গড়িয়ে পড়ল। ফলে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তারা তো গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল রাত কাটানোর প্রয়োজনে, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই আশ্রয়স্থলই এখন তাদের মরণফাঁদে পরিণত হয়ে গেল। গুহার ভেতর ঘোর অন্ধকার। সূর্যের আলো ঢোকার কোনও ফাঁক নেই। নেই বের হওয়ার কোনও উপায়। এক আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে তাদের বাঁচার কোনও আশা নেই। এই ঘোর অন্ধকার গুহায় ক্ষুধায়, পিপাসায় কাতর হয়ে ধুকে ধুকে মরা ছাড়া কোনও গতি নেই। অসহায় নিরুপায় বিপদগ্রস্তেরা সাধারণত যা করে থাকে, অগত্যা তারাও তাই করল। তারা এক আল্লাহর শরণাপন্ন হল এবং প্রত্যেকে নিজ জীবনের শ্রেষ্ঠ খালেস আমলকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহর কাছে দু'আয় রত হল। এরকম আমল তাদের প্রত্যেকেরই একেকটা ছিল, যা তারা কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনায় করেছিল। কোনও মাখলূককে খুশি করা বা পার্থিব কোনও স্বার্থ ও সুবিধা হাসিল করা তাদের লক্ষ্য ছিল না।
প্রথমজন ছিল পিতামাতার বাধ্য ও অনুগত সন্তান। পিতামাতার সেবাকেই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিত। তার কাজ ছিল পশু পালন করা। পশুর দুধ দ্বারাই তার ও তার পরিবারের খাদ্যচাহিদা মিটত। দুধ দোয়ানোর পর সবার আগে বৃদ্ধ পিতামাতাকে পান করাতো। তারপর পান করত তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। স্ত্রীর ভালোবাসা ও সন্তানদের মায়া তাকে তার এ নীতি থেকে টলাতে পারত না। এ নীতি রক্ষায় সে একদিন অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে।
তখন পশু চরানোর জন্য অনেক সময়ই দূর-দূরান্তে যেতে হত। সাধারণত পশুদেরকে গাছের পাতা খাওয়ানো হত। কাছের গাছ-গাছালির পাতা শেষ হয়ে গেলে দূরে কোথায় গাছের ঝোপ আছে তা খুঁজতে হত। মরুভূমি এলাকায় সাধারণত খুব কাছাকাছি গাছ-গাছালির ঝোপ থাকে না। থাকে না বিস্তীর্ণ বন-ভূমিও। সেইজন্যেই ওই ব্যক্তিকে গাছের পাতার সন্ধানে তার পশুপাল নিয়ে অনেক দূর যেতে হয়েছিল। ফিরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে যায়। ততক্ষণে তার বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের খাবার তো ছিল পশুর দুধ। আজ তাদের তা খাওয়া হয়নি। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। লোকটি বাড়ি ফেরার পর তাড়াতাড়ি পশুর দুধ দোওয়াল। দুধের পাত্র নিয়ে মা-বাবার কাছে এসে দেখে তারা ঘুমিয়ে আছে। ঘুম থেকে জাগালে তারা কষ্ট পাবে। তাই তাদেরকে জাগাতে চাইল না। ওদিকে বাচ্চারাও তো না খেয়ে আছে। এখন তাদেরকে আগে খেতে দেবে? না, তার মন তাতেও রাজি হল না। কোনওদিন তো বাবা-মায়ের আগে তাদেরকে খাওয়ায়নি। আজ কি করে খাওয়াবে? পাত্র নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। তাদের ঘুম ভাঙলে আগে তাদের খাওয়াবে, তারপর বাচ্চাদের। সে হাতে পাত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে। আরও সময় যাচ্ছে। রাত শেষ হতে চলেছে। কিন্তু তারা জাগছে না। ওদিকে শিশুরা ক্ষুধায় কাতর। তারা কাঁদছে। তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু অভুক্ত বাবা-মাকে রেখে আগে সন্তানদের খাওয়াতে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। এভাবে রাত পার হয়ে গেল। গোটা রাত সে দুধের পাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর যখন ভোরের আলো ফুটল, বাবা-মায়ের ঘুম ভাঙল। এবার সে তাদের দুধ পান করাল। তারপর বাচ্চাদেরও পান করাল। ভাবা যায়, কি কঠিন ত্যাগ! এই ত্যাগ সে স্বীকার করেছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। ফলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার এ আমল কবুল হয়ে যায়।।
দ্বিতীয়জন তার চাচাত বোনকে ভালোবেসেছিল। ভালোবাসার জনকে মানুষ একান্তভাবে কাছে পেতে চায়। সেও তাকে কাছে পেতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে সেই সুযোগ তার এসেও গিয়েছিল। অন্নকষ্টে জর্জরিত চাচাত বোন নিতান্ত ঠেকায় পড়ে তাকে সুযোগ দিয়েছিল। কষ্টকাতর অবস্থায় যখন তার কাছ থেকে অর্থসাহায্য পেয়েছিল, তখন একরকম কৃতজ্ঞতাবোধে বাধ্য হয়ে চাচাত ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একজন চরিত্রবতী নারীর কাছে তার সতীত্বের মূল্য অনেক। আজ সেই মূল্যবান সম্পদ খোয়া যাবে? মনে মনে সে কেঁপে উঠেছিল। সে তার সম্পদ রক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা করল। বলে উঠল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। এটা ছিল তার প্রাণ থেকে উঠে আসা আর্তনাদ। এ আর্তনাদ তার মনে আছর ফেলল। তারও হুঁশ হল। সর্বনাশ! আমি এ কি করতে যাচ্ছি। আর কেউ না দেখুক, আল্লাহতো দেখছেন। নাজানি কি কঠিন শাস্তি এর জন্য আমাকে তার কাছে পেতে হবে। সংগে সংগে সে উঠে গেল। যেই স্বর্ণমুদ্রা তাকে দিয়েছিল, তাও আর ফেরত নিল না। সন্দেহ নেই এতে তার কঠিন মানসিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। জাগতিকও। একশ' বিশ দীনারের মূল্য তো কম নয়। তো সে এই ত্যাগ কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই স্বীকার করেছিল। ফলে আল্লাহ তা'আলা তা কবূল করে নেন।
উল্লেখ্য, মেয়েটি আত্মরক্ষার্থে তাকে আল্লাহর ভয় দেখিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ভয়ই এমন এক শক্তি, যা মানুষকে প্রকাশ্যে গোপনে সর্বাবস্থায় অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত রাখতে পারে। আল্লাহর ভয় না থাকলে শয়তানের প্ররোচনা, মনের কুমন্ত্রণা, স্বার্থান্বেষী মহলের প্রলোভন ইত্যাদির ফাঁদে মানুষ পড়েই যায়। পুলিশের পাহারা দিয়ে মানুষকে অনুচিত কাজ থেকে বিরত রাখা সবসময় সম্ভব হয় না। আধুনিককালে মানুষ অপরাধ রোধের কত রকম চেষ্টাই না করছে। পুলিশসহ শান্তি-শৃংখলা রক্ষাকারী প্রতিটি বাহিনীকে কত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে। নিত্য-নতুন কত আইন তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এতসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উত্তরোত্তর অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে বৈ কমছে না। কেন সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে? কারণ একটাই, মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় কমে গেছে। সমাজের সর্বস্তরে আল্লাহভীতির চর্চা যথেষ্ট পরিমাণে হচ্ছে না। এরই কুফল যে, মানুষ দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে এবং অপরাধের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। একটা সময় ছিল, যখন অপরাধী ধরার জন্য এতসব ব্যবস্থা ছিল না। বাহ্যত অপরাধ করার অবারিত সুযোগ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ আজকের মত এতবেশি অপরাধ করত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ গরজেই অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে থাকত। কারণ আর কিছুই নয়, তখন মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ছিল। প্রত্যেকের হৃদস্পন্দনে সর্বক্ষণ এই সতর্কবাণী বাজত যে, সাবধান! তুমি কি বলছ, কি করছ, তা কিন্তু একজন শুনছেন এবং দেখছেন। তিনি আল্লাহ। যিনি সর্বশক্তিমান ও শ্রেষ্ঠতম বিচারক। আর যাকেই ফাঁকি দাও না কেন, তাঁকে কিন্তু ফাঁকি দিতে পারবে না। তাঁর আদালতে তোমাকে একদিন দাঁড়াতে হবে। যা-কিছুই কর না কেন, সেই হিসাব নিকাশ করে কর। আল্লাহভীতির এই বোধ ও চেতনাই প্রত্যেককে সকল পাপকর্ম হতে বিরত রাখত। আজ এই চেতনার চর্চা বড় বেশি প্রয়োজন। ব্যক্তি ও সমাজকে অন্যায় অপরাধ থেকে উদ্ধার করার এই একই উপায়- সর্বত্র আল্লাহভীতির অনুশীলন।
তৃতীয়জন তার কোনও কাজের জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ করেছিল। কাজ শেষে সে তাদের পারিশ্রমিকও পরিশোধ করেছিল। কিন্তু একজন কোনও কারণে তার পারিশ্রমিক না নিয়ে চলে যায়। সেই পারিশ্রমিক যেহেতু শ্রমিকের হক ছিল, তাই সে তা নষ্ট না করে বরং তা যথাযথ হেফাজত করে। এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আম তদারির পরিচয় দেয়। বরং তারচে'ও বেশি কিছু করে। সে শ্রমিকের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেয়। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, ওই পারিশ্রমিক ছিল নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান। সে ওই ধানগুলো নিজ জমিতে বপন করে। ফলে তা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। তারপর সে তা দিয়ে ছাগল কেনে। সেই ছাগলের সংখ্যাও একসময় অনেক বেড়ে যায়। তারপর গরু কেনে। সবশেষে উট কেনে। এবং এসব প্রতিপালনের জন্য রাখাল নিযুক্ত করে। এই বিপুল সম্পদের মূলে ছিল ওই সামান্য পরিমাণ ধান। এই বিপুল সম্পদ সে ওই লোকটির জন্য সংরক্ষণ করে। চাইলে সে তা নিজেও হাতিয়ে নিতে পারত, কিন্তু তার তো লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। সেই লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে সে তার সবটাই শ্রমিকের জন্য সংরক্ষণ করে। আশা ছিল হয়তো সে কোনওদিন ফিরে আসবে এবং সবটা তাকে বুঝিয়ে দেবে। তাই হল। বহুদিন পর শ্রমিক এসে তার সংগে সাক্ষাত করল এবং নিজের রেখে যাওয়া পারিশ্রমিক ফেরত চাইল। লোকটি যখন সেই সামান্য পরিমাণ ধানের স্থলে এই বিপুল গরু, ছাগল ও উট এবং এদের রাখালকে দেখিয়ে দিল আর বলল, এই সবই তোমার, তখন শ্রমিক তার এ কথাকে স্রেফ ঠাট্টা মনে করল। এবং যে-কেউ তাই মনে করত। কেননা সামান্য কিছু ধান এই বিপুল সম্পদে পরিণত হওয়া নিতান্তই অভাবনীয়। কার পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল। যে, সে যে ক'টি ধান রেখে গিয়েছিল তা এতকিছু সম্পদে পরিণত হয়ে যাবে? কিন্তু লোকটি তাকে নিশ্চিত করে বলল, এটা ঠাট্টা নয়। সত্যি সত্যি তুমি যে ধান রেখে গিয়েছিলে, তাই বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। এসব তোমারই। তুমি নিশ্চিন্তে নিয়ে যেতে পার। সুতরাং সে তা সব নিয়ে চলে গেল। যেহেতু এই বিশাল ত্যাগ সে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় স্বীকার করেছিল, তাই আল্লাহর দরবারে তা কবূল হয়ে যায় এবং তার বদৌলতে তাকে এই দুনিয়ার মসিবত থেকেও নিষ্কৃতি দেওয়া হয়।
সারকথা, এই তিনও ব্যক্তি তাদের শ্রেষ্ঠতম তিন আমলকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করেছিল। কোনও আমলের অছিলায় দু'আ করাকে ‘তাওয়াস্সুল' বলে। শরী'আতে এরূপ তাওয়াস্সুল জায়েয। তারা যেমন এর মাধ্যমে ঘোর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিল, তেমনি যে-কেউ কোনও কঠিন মসিবতে পড়লে কোনও নেক আমলকে অছিলা বানাতে পারে। কোনও নেক আমলকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করলে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা সেই মসিবত থেকে তাকে রক্ষা করবেন। বস্তুত বিপদ-আপদ ও বালা-মসিবত থেকে মুক্তিদান কেবল আল্লাহ তা'আলাই করতে পারেন। কাজেই যে-কোনও মসিবত থেকে উদ্ধারের জন্য তাঁরই শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন
أمن يجيب المضطر إذا دعاه ويكشف السوء
অর্থ : তবে কে তিনি, যিনি কোনও আর্ত যখন তাকে ডাকে, তার ডাকে সাড়া দেন ও তার কষ্ট দূর করে দেন??
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, পিতামাতার খেদমত অতিবড় পুণ্যের কাজ। এর দ্বারা আখিরাতে পুরস্কার লাভের পাশাপাশি দুনিয়ায় সুখ-শান্তি লাভ হয় ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং সন্তানের কর্তব্য পিতামাতার খেদমতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং বহু হাদীছে পিতামাতার আনুগত্য ও তাদের খেদমত করার গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এ গ্রন্থে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে তা উল্লেখ করা হবে। (ইনশাআল্লাহ্)
খ. চরিত্র মানুষের অতি মূল্যবান সম্পদ। এর হেফাজত অবশ্যকর্তব্য। বিশেষত ব্যভিচার ও তার আনুষাঙ্গিক কার্যাবলি থেকে দূরে থাকা ঈমানের এক জোর দাবি। কেননা ব্যভিচার করা একটি কঠিন মহাপাপ। এটা আল্লাহর গযবের কারণ। ব্যভিচারের সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে তা থেকে হেফাজত করে, আল্লাহর কাছে তার অনেক মর্যাদা। এক হাদীছে আছে, হাশরের ময়দানে আল্লাহ তা'আলা সাত ব্যক্তিকে তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। তার মধ্যে একজন ওই ব্যক্তি, যাকে কোনও অভিজাত ও রূপসী নারী ডাক দেয় আর সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।
গ. এ হাদীছ দ্বারা আমানত রক্ষা ও অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতার ফযীলত জানা যায়। এক হাদীছে বলা হয়েছে, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। আরেক হাদীছে আছে, কল্যাণকামিতাই দীন। হাদীছে বর্ণিত তৃতীয় ব্যক্তি শ্রমিকের আমানত রক্ষা করেছিল ও তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দিয়েছিল। যা তার একটি শ্রেষ্ঠ আমলরূপে বিবেচিত হয়েছে।
ঘ. শ্রমিক হওয়া দোষের কিছু নয়। শ্রম খাটিয়ে উপার্জন করা নয় নিন্দনীয় কাজ। বরং হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কায়িক শ্রম দ্বারা যে উপার্জন করা হয় তাই সর্বাপেক্ষা হালাল উপার্জন। তাই দেখা যায়, নবী-রাসূলগণও মেহনত-মজদুরি করেছেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শ্রম খাটার কথা তো কুরআন মাজীদেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কোনও শ্রমিককে খাটো করে দেখা উচিত নয় এবং শ্রমিকের নিজেরও উচিত নয় তার নিজ কাজের জন্য লজ্জাবোধ করা।
ঙ. শ্রমিকের কাজ শেষ হওয়ামাত্র তার পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
চ. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার কুদরতের পরিচয় পাওয়া যায়। এক বিশালাকার পাথর তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের নিজেদের তা সরানোর ক্ষমতা ছিল না। বাহির থেকে কেউ সরাতে চাইলেও এর জন্য অনেক বন্দোবস্তের দরকার হত। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার কোনও কিছুই লাগেনি। তিনি ইচ্ছা করেছেন আর অমনি সরে গেছে। বস্তুত আল্লাহ তা'আলা সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
ছ. বিপদ-আপদে হতাশ হতে নেই। কঠিন থেকে কঠিন বিপদেও আল্লাহ তা'আলা রক্ষা করতে পারেন। তাই সর্বাবস্থায় তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত।
জ. আল্লাহ তা'আলা বান্দার ডাক শোনেন। তিনি দু'আ কবুল করেন। বান্দার কর্তব্য সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁকে ডাকা ও তাঁর কাছে দু'আ করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
وإذا سألك عبادي عني فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعان فليستجيبوا لي وليؤمنوا بي لعلهم يرشدونه
অর্থ : (হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি। সুতরাং তারাও আমার কথা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করুক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে এসে যায়।
ঝ. এ হাদীছের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ইখলাস। ওই তিনও ব্যক্তি যে আমল করেছিল, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই করেছিল। তাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ কারণেই আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা কেবল ওই আমলই কবুল করে থাকেন, যা ইখলাসের সাথে অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় করা হয়। যে আমলে ইখলাস থাকে না; বরং মানুষকে দেখানোর জন্য করা হয়, আল্লাহর কাছে তা কবুল হয় না। এক হাদীছে ইরশাদ
أنا أغنى الشركاء عن الشرك، من عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته وشركة
অর্থ : আমি শিরক ও অংশীদারিত্ব থেকে সব অংশীদার অপেক্ষা বেশি বেনিয়াজ। যে ব্যক্তি এমন কোনও আমল করে, যাতে আমার সংগে অন্যকে শরীক করে, আমি তাকে তার সেই অংশীদারিত্বের সংগে পরিত্যাগ করি। বস্তুত লোকদেখানোর জন্য আমল করা এক ধরনের শিরক। একে 'খফী' বা প্রচ্ছন্ন শিরক বলে। মু'মিনগণ যাতে প্রকাশ্য শিরকের সাথে এই গুপ্ত শিরককেও পরিহার করে চলে, সেজন্যে কুরআন-হাদীছে জোর তাকীদ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ
فمن كان يرجوا لقاء ربه فليعمل عملا صالحا ولا يشرك بعبادة ربه أحدان
অর্থ : সুতরাং যে-কেউ নিজ মালিকের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ মালিকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সকল প্রকার শিরক থেকে হেফাজত করুন, ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফীক দিন এবং অন্তর থেকে রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা দূর করে দিন। আমীন।
প্রথমজন ছিল পিতামাতার বাধ্য ও অনুগত সন্তান। পিতামাতার সেবাকেই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিত। তার কাজ ছিল পশু পালন করা। পশুর দুধ দ্বারাই তার ও তার পরিবারের খাদ্যচাহিদা মিটত। দুধ দোয়ানোর পর সবার আগে বৃদ্ধ পিতামাতাকে পান করাতো। তারপর পান করত তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। স্ত্রীর ভালোবাসা ও সন্তানদের মায়া তাকে তার এ নীতি থেকে টলাতে পারত না। এ নীতি রক্ষায় সে একদিন অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে।
তখন পশু চরানোর জন্য অনেক সময়ই দূর-দূরান্তে যেতে হত। সাধারণত পশুদেরকে গাছের পাতা খাওয়ানো হত। কাছের গাছ-গাছালির পাতা শেষ হয়ে গেলে দূরে কোথায় গাছের ঝোপ আছে তা খুঁজতে হত। মরুভূমি এলাকায় সাধারণত খুব কাছাকাছি গাছ-গাছালির ঝোপ থাকে না। থাকে না বিস্তীর্ণ বন-ভূমিও। সেইজন্যেই ওই ব্যক্তিকে গাছের পাতার সন্ধানে তার পশুপাল নিয়ে অনেক দূর যেতে হয়েছিল। ফিরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে যায়। ততক্ষণে তার বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের খাবার তো ছিল পশুর দুধ। আজ তাদের তা খাওয়া হয়নি। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। লোকটি বাড়ি ফেরার পর তাড়াতাড়ি পশুর দুধ দোওয়াল। দুধের পাত্র নিয়ে মা-বাবার কাছে এসে দেখে তারা ঘুমিয়ে আছে। ঘুম থেকে জাগালে তারা কষ্ট পাবে। তাই তাদেরকে জাগাতে চাইল না। ওদিকে বাচ্চারাও তো না খেয়ে আছে। এখন তাদেরকে আগে খেতে দেবে? না, তার মন তাতেও রাজি হল না। কোনওদিন তো বাবা-মায়ের আগে তাদেরকে খাওয়ায়নি। আজ কি করে খাওয়াবে? পাত্র নিয়ে সে অপেক্ষা করছে। তাদের ঘুম ভাঙলে আগে তাদের খাওয়াবে, তারপর বাচ্চাদের। সে হাতে পাত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে। আরও সময় যাচ্ছে। রাত শেষ হতে চলেছে। কিন্তু তারা জাগছে না। ওদিকে শিশুরা ক্ষুধায় কাতর। তারা কাঁদছে। তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু অভুক্ত বাবা-মাকে রেখে আগে সন্তানদের খাওয়াতে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। এভাবে রাত পার হয়ে গেল। গোটা রাত সে দুধের পাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর যখন ভোরের আলো ফুটল, বাবা-মায়ের ঘুম ভাঙল। এবার সে তাদের দুধ পান করাল। তারপর বাচ্চাদেরও পান করাল। ভাবা যায়, কি কঠিন ত্যাগ! এই ত্যাগ সে স্বীকার করেছিল কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। ফলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার এ আমল কবুল হয়ে যায়।।
দ্বিতীয়জন তার চাচাত বোনকে ভালোবেসেছিল। ভালোবাসার জনকে মানুষ একান্তভাবে কাছে পেতে চায়। সেও তাকে কাছে পেতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে সেই সুযোগ তার এসেও গিয়েছিল। অন্নকষ্টে জর্জরিত চাচাত বোন নিতান্ত ঠেকায় পড়ে তাকে সুযোগ দিয়েছিল। কষ্টকাতর অবস্থায় যখন তার কাছ থেকে অর্থসাহায্য পেয়েছিল, তখন একরকম কৃতজ্ঞতাবোধে বাধ্য হয়ে চাচাত ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একজন চরিত্রবতী নারীর কাছে তার সতীত্বের মূল্য অনেক। আজ সেই মূল্যবান সম্পদ খোয়া যাবে? মনে মনে সে কেঁপে উঠেছিল। সে তার সম্পদ রক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা করল। বলে উঠল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। এটা ছিল তার প্রাণ থেকে উঠে আসা আর্তনাদ। এ আর্তনাদ তার মনে আছর ফেলল। তারও হুঁশ হল। সর্বনাশ! আমি এ কি করতে যাচ্ছি। আর কেউ না দেখুক, আল্লাহতো দেখছেন। নাজানি কি কঠিন শাস্তি এর জন্য আমাকে তার কাছে পেতে হবে। সংগে সংগে সে উঠে গেল। যেই স্বর্ণমুদ্রা তাকে দিয়েছিল, তাও আর ফেরত নিল না। সন্দেহ নেই এতে তার কঠিন মানসিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। জাগতিকও। একশ' বিশ দীনারের মূল্য তো কম নয়। তো সে এই ত্যাগ কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই স্বীকার করেছিল। ফলে আল্লাহ তা'আলা তা কবূল করে নেন।
উল্লেখ্য, মেয়েটি আত্মরক্ষার্থে তাকে আল্লাহর ভয় দেখিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ভয়ই এমন এক শক্তি, যা মানুষকে প্রকাশ্যে গোপনে সর্বাবস্থায় অন্যায়-অনাচার থেকে বিরত রাখতে পারে। আল্লাহর ভয় না থাকলে শয়তানের প্ররোচনা, মনের কুমন্ত্রণা, স্বার্থান্বেষী মহলের প্রলোভন ইত্যাদির ফাঁদে মানুষ পড়েই যায়। পুলিশের পাহারা দিয়ে মানুষকে অনুচিত কাজ থেকে বিরত রাখা সবসময় সম্ভব হয় না। আধুনিককালে মানুষ অপরাধ রোধের কত রকম চেষ্টাই না করছে। পুলিশসহ শান্তি-শৃংখলা রক্ষাকারী প্রতিটি বাহিনীকে কত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে। নিত্য-নতুন কত আইন তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এতসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও উত্তরোত্তর অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে বৈ কমছে না। কেন সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে? কারণ একটাই, মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় কমে গেছে। সমাজের সর্বস্তরে আল্লাহভীতির চর্চা যথেষ্ট পরিমাণে হচ্ছে না। এরই কুফল যে, মানুষ দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে এবং অপরাধের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। একটা সময় ছিল, যখন অপরাধী ধরার জন্য এতসব ব্যবস্থা ছিল না। বাহ্যত অপরাধ করার অবারিত সুযোগ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ আজকের মত এতবেশি অপরাধ করত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ গরজেই অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে থাকত। কারণ আর কিছুই নয়, তখন মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ছিল। প্রত্যেকের হৃদস্পন্দনে সর্বক্ষণ এই সতর্কবাণী বাজত যে, সাবধান! তুমি কি বলছ, কি করছ, তা কিন্তু একজন শুনছেন এবং দেখছেন। তিনি আল্লাহ। যিনি সর্বশক্তিমান ও শ্রেষ্ঠতম বিচারক। আর যাকেই ফাঁকি দাও না কেন, তাঁকে কিন্তু ফাঁকি দিতে পারবে না। তাঁর আদালতে তোমাকে একদিন দাঁড়াতে হবে। যা-কিছুই কর না কেন, সেই হিসাব নিকাশ করে কর। আল্লাহভীতির এই বোধ ও চেতনাই প্রত্যেককে সকল পাপকর্ম হতে বিরত রাখত। আজ এই চেতনার চর্চা বড় বেশি প্রয়োজন। ব্যক্তি ও সমাজকে অন্যায় অপরাধ থেকে উদ্ধার করার এই একই উপায়- সর্বত্র আল্লাহভীতির অনুশীলন।
তৃতীয়জন তার কোনও কাজের জন্য নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ করেছিল। কাজ শেষে সে তাদের পারিশ্রমিকও পরিশোধ করেছিল। কিন্তু একজন কোনও কারণে তার পারিশ্রমিক না নিয়ে চলে যায়। সেই পারিশ্রমিক যেহেতু শ্রমিকের হক ছিল, তাই সে তা নষ্ট না করে বরং তা যথাযথ হেফাজত করে। এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আম তদারির পরিচয় দেয়। বরং তারচে'ও বেশি কিছু করে। সে শ্রমিকের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেয়। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, ওই পারিশ্রমিক ছিল নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান। সে ওই ধানগুলো নিজ জমিতে বপন করে। ফলে তা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। তারপর সে তা দিয়ে ছাগল কেনে। সেই ছাগলের সংখ্যাও একসময় অনেক বেড়ে যায়। তারপর গরু কেনে। সবশেষে উট কেনে। এবং এসব প্রতিপালনের জন্য রাখাল নিযুক্ত করে। এই বিপুল সম্পদের মূলে ছিল ওই সামান্য পরিমাণ ধান। এই বিপুল সম্পদ সে ওই লোকটির জন্য সংরক্ষণ করে। চাইলে সে তা নিজেও হাতিয়ে নিতে পারত, কিন্তু তার তো লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। সেই লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে সে তার সবটাই শ্রমিকের জন্য সংরক্ষণ করে। আশা ছিল হয়তো সে কোনওদিন ফিরে আসবে এবং সবটা তাকে বুঝিয়ে দেবে। তাই হল। বহুদিন পর শ্রমিক এসে তার সংগে সাক্ষাত করল এবং নিজের রেখে যাওয়া পারিশ্রমিক ফেরত চাইল। লোকটি যখন সেই সামান্য পরিমাণ ধানের স্থলে এই বিপুল গরু, ছাগল ও উট এবং এদের রাখালকে দেখিয়ে দিল আর বলল, এই সবই তোমার, তখন শ্রমিক তার এ কথাকে স্রেফ ঠাট্টা মনে করল। এবং যে-কেউ তাই মনে করত। কেননা সামান্য কিছু ধান এই বিপুল সম্পদে পরিণত হওয়া নিতান্তই অভাবনীয়। কার পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল। যে, সে যে ক'টি ধান রেখে গিয়েছিল তা এতকিছু সম্পদে পরিণত হয়ে যাবে? কিন্তু লোকটি তাকে নিশ্চিত করে বলল, এটা ঠাট্টা নয়। সত্যি সত্যি তুমি যে ধান রেখে গিয়েছিলে, তাই বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। এসব তোমারই। তুমি নিশ্চিন্তে নিয়ে যেতে পার। সুতরাং সে তা সব নিয়ে চলে গেল। যেহেতু এই বিশাল ত্যাগ সে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় স্বীকার করেছিল, তাই আল্লাহর দরবারে তা কবূল হয়ে যায় এবং তার বদৌলতে তাকে এই দুনিয়ার মসিবত থেকেও নিষ্কৃতি দেওয়া হয়।
সারকথা, এই তিনও ব্যক্তি তাদের শ্রেষ্ঠতম তিন আমলকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করেছিল। কোনও আমলের অছিলায় দু'আ করাকে ‘তাওয়াস্সুল' বলে। শরী'আতে এরূপ তাওয়াস্সুল জায়েয। তারা যেমন এর মাধ্যমে ঘোর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিল, তেমনি যে-কেউ কোনও কঠিন মসিবতে পড়লে কোনও নেক আমলকে অছিলা বানাতে পারে। কোনও নেক আমলকে অছিলা বানিয়ে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করলে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা সেই মসিবত থেকে তাকে রক্ষা করবেন। বস্তুত বিপদ-আপদ ও বালা-মসিবত থেকে মুক্তিদান কেবল আল্লাহ তা'আলাই করতে পারেন। কাজেই যে-কোনও মসিবত থেকে উদ্ধারের জন্য তাঁরই শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন
أمن يجيب المضطر إذا دعاه ويكشف السوء
অর্থ : তবে কে তিনি, যিনি কোনও আর্ত যখন তাকে ডাকে, তার ডাকে সাড়া দেন ও তার কষ্ট দূর করে দেন??
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, পিতামাতার খেদমত অতিবড় পুণ্যের কাজ। এর দ্বারা আখিরাতে পুরস্কার লাভের পাশাপাশি দুনিয়ায় সুখ-শান্তি লাভ হয় ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং সন্তানের কর্তব্য পিতামাতার খেদমতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং বহু হাদীছে পিতামাতার আনুগত্য ও তাদের খেদমত করার গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এ গ্রন্থে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে তা উল্লেখ করা হবে। (ইনশাআল্লাহ্)
খ. চরিত্র মানুষের অতি মূল্যবান সম্পদ। এর হেফাজত অবশ্যকর্তব্য। বিশেষত ব্যভিচার ও তার আনুষাঙ্গিক কার্যাবলি থেকে দূরে থাকা ঈমানের এক জোর দাবি। কেননা ব্যভিচার করা একটি কঠিন মহাপাপ। এটা আল্লাহর গযবের কারণ। ব্যভিচারের সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজেকে তা থেকে হেফাজত করে, আল্লাহর কাছে তার অনেক মর্যাদা। এক হাদীছে আছে, হাশরের ময়দানে আল্লাহ তা'আলা সাত ব্যক্তিকে তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। তার মধ্যে একজন ওই ব্যক্তি, যাকে কোনও অভিজাত ও রূপসী নারী ডাক দেয় আর সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি।
গ. এ হাদীছ দ্বারা আমানত রক্ষা ও অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতার ফযীলত জানা যায়। এক হাদীছে বলা হয়েছে, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। আরেক হাদীছে আছে, কল্যাণকামিতাই দীন। হাদীছে বর্ণিত তৃতীয় ব্যক্তি শ্রমিকের আমানত রক্ষা করেছিল ও তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দিয়েছিল। যা তার একটি শ্রেষ্ঠ আমলরূপে বিবেচিত হয়েছে।
ঘ. শ্রমিক হওয়া দোষের কিছু নয়। শ্রম খাটিয়ে উপার্জন করা নয় নিন্দনীয় কাজ। বরং হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কায়িক শ্রম দ্বারা যে উপার্জন করা হয় তাই সর্বাপেক্ষা হালাল উপার্জন। তাই দেখা যায়, নবী-রাসূলগণও মেহনত-মজদুরি করেছেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শ্রম খাটার কথা তো কুরআন মাজীদেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কোনও শ্রমিককে খাটো করে দেখা উচিত নয় এবং শ্রমিকের নিজেরও উচিত নয় তার নিজ কাজের জন্য লজ্জাবোধ করা।
ঙ. শ্রমিকের কাজ শেষ হওয়ামাত্র তার পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
চ. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার কুদরতের পরিচয় পাওয়া যায়। এক বিশালাকার পাথর তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের নিজেদের তা সরানোর ক্ষমতা ছিল না। বাহির থেকে কেউ সরাতে চাইলেও এর জন্য অনেক বন্দোবস্তের দরকার হত। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার কোনও কিছুই লাগেনি। তিনি ইচ্ছা করেছেন আর অমনি সরে গেছে। বস্তুত আল্লাহ তা'আলা সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
ছ. বিপদ-আপদে হতাশ হতে নেই। কঠিন থেকে কঠিন বিপদেও আল্লাহ তা'আলা রক্ষা করতে পারেন। তাই সর্বাবস্থায় তাঁর রহমতের আশাবাদী থাকা উচিত।
জ. আল্লাহ তা'আলা বান্দার ডাক শোনেন। তিনি দু'আ কবুল করেন। বান্দার কর্তব্য সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁকে ডাকা ও তাঁর কাছে দু'আ করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
وإذا سألك عبادي عني فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعان فليستجيبوا لي وليؤمنوا بي لعلهم يرشدونه
অর্থ : (হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি। সুতরাং তারাও আমার কথা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করুক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে এসে যায়।
ঝ. এ হাদীছের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ইখলাস। ওই তিনও ব্যক্তি যে আমল করেছিল, তা কেবল আল্লাহ তা'আলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই করেছিল। তাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ কারণেই আল্লাহ তা'আলার কাছে তা কবুল হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা কেবল ওই আমলই কবুল করে থাকেন, যা ইখলাসের সাথে অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় করা হয়। যে আমলে ইখলাস থাকে না; বরং মানুষকে দেখানোর জন্য করা হয়, আল্লাহর কাছে তা কবুল হয় না। এক হাদীছে ইরশাদ
أنا أغنى الشركاء عن الشرك، من عمل عملا أشرك فيه معي غيري تركته وشركة
অর্থ : আমি শিরক ও অংশীদারিত্ব থেকে সব অংশীদার অপেক্ষা বেশি বেনিয়াজ। যে ব্যক্তি এমন কোনও আমল করে, যাতে আমার সংগে অন্যকে শরীক করে, আমি তাকে তার সেই অংশীদারিত্বের সংগে পরিত্যাগ করি। বস্তুত লোকদেখানোর জন্য আমল করা এক ধরনের শিরক। একে 'খফী' বা প্রচ্ছন্ন শিরক বলে। মু'মিনগণ যাতে প্রকাশ্য শিরকের সাথে এই গুপ্ত শিরককেও পরিহার করে চলে, সেজন্যে কুরআন-হাদীছে জোর তাকীদ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ
فمن كان يرجوا لقاء ربه فليعمل عملا صالحا ولا يشرك بعبادة ربه أحدان
অর্থ : সুতরাং যে-কেউ নিজ মালিকের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ মালিকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সকল প্রকার শিরক থেকে হেফাজত করুন, ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফীক দিন এবং অন্তর থেকে রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা দূর করে দিন। আমীন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
