আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬২২২
৩২৮৬. হাঁচিদাতার আলহামদুলিল্লাহ- এর জবাব দেয়া।
৫৭৮৯। সুলাইমান ইবনে হারব (রাহঃ) ......... বারা' ইবনে আযিব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (ﷺ) আমাদের সাতটি কাজের আদেশ দিয়েছেন এবং সাতটি কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। রোগীর দেখাশোনা করতে, জানাযার সঙ্গে যেতে, হাঁচিদাতার জবাব দিতে, দাওয়াত গ্রহণ করতে, সালামের জবাব দিতে, মযলুম মানুষের সাহায্য করতে এবং কসম পুরা করতে তিনি আমাদের আদেশ দিয়েছেন। আর সোনার আংটি অথবা বালা ব্যবহার করতে, সাধারণ রেশমী কাপড় পরতে, মিহিন রেশমী কাপড়, রেশমী জিন ব্যবহার করতে, কাসীই ব্যবহার করতে এবং রৌপ্য পাত্র ব্যবহার করতে আমাদের নিষেধ করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি শিক্ষাদান করেছেন। এ শিক্ষাগুলো সমাজনীতি সম্পর্কিত। এগুলো অনুসরণ করার দ্বারা একদিকে বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনও সুদৃঢ় হয়। পারস্পরিক শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা এবং ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে এ শিক্ষাসমূহের অনুসরণ অত্যন্ত কার্যকর এক ব্যবস্থা।
আমরা নিচে এক একটি করে এর ব্যাখ্যা প্রদান করছি।

রোগী দেখতে যাওয়া
عِيَادَةُ الْمَرِيضِ (রোগীর 'ইয়াদাত করা)। অর্থাৎ রোগী দেখতে যাওয়া ও তার খোঁজখবর নেওয়া। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কোনও কোনও হাদীছে একে মুসলিম ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। এটা যখন মুসলিম ব্যক্তির হক, তখন অবশ্যপালনীয়ও বটে। কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তার খোঁজখবর নিতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাকে দেখতেও যেতে হবে। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বেরও দাবি। এর দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من مسلم يعود مسلما غدوة, إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي, وإن عاده عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح, وكان له خريف في الجنة
'যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি সকালবেলা কোনও অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে গেলে عَادَهُ সত্তর হাজার ফিরিশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে। যদি সন্ধ্যাবেলা তাকে দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফিরিশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান করা হয়’।
(জামে তিরমিযী: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৭৪২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৪১০)
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَيُّمَا رَجُلٍ يَعُودُ مَرِيضًا، فَإِنَّمَا يَخُوضُ فِي الرَّحْمَةِ، فَإِذَا قَعَدَ عِنْدَ الْمَرِيضِ غَمَرَتْهُ الرَّحْمَةُ، قَالَ : فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللهِ ، هَذَا لِلصَّحِيحِ الَّذِي يَعُودُ الْمَرِيضِ، فَالْمَرِيض مَا لَهُ؟ قَالَ: تُحَطَّ عَنْهُ ذُنُوبُهُ.
'যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় সে রহমতের ভেতর ডুব দিতে থাকে। যখন সে রোগীর কাছে গিয়ে বসে তখন রহমত তাকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বর্ণনাকারী (হযরত আনাস রাযি.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা তো ওই সুস্থ ব্যক্তির জন্য, যে রোগী দেখতে যায়। তা অসুস্থ ব্যক্তি কী পাবে? তিনি বললেন, তার পাপরাশি মিটিয়ে দেওয়া হয়’।
(মুসনাদে আহমাদ: ১২৭৮২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ১০৮৩৯; মুসান্নাফ আব্দুর রায্ যাক : ৬৭৬৪; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা: ৬৫৮৩; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত: ২২০৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৪৫২)
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
.مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلاً
‘যে ব্যক্তি কোনও রোগী দেখতে যায় বা তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার উদ্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করে, তুমি শুভ হও, তোমার যাত্রা শুভ হোক এবং জান্নাতে তোমার ঠিকানা হোক’।
(জামে তিরমিযী: ২০০৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৩৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৬১০; আল-আদাবুল মুফরাদ : ৩৪৫; শারহুস্ সুন্নাহ: ২৪৭৪)
হযরত ছাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَائِدُ الْمَرِيضِ فِي مَخْرَفَةِ الْجَنَّةِ
'যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে জান্নাতের ফলের বাগানে (অথবা এর অর্থ সে জান্নাতের পথে) থাকে’।
(সহীহ মুসলিম : ২৫৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৪৪২; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩৭৫০; মুসনাদে আহমাদ: ২২৪০৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫৮০; শুআবুল ঈমান : ৮৭৩৮)

জানাযায় অংশগ্রহণ
إِتَّبَاعُ الْجَنائِز (জানাযায় অংশগ্রহণ করা)। কোনও মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার জানাযা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা জীবিতদের উপর ফরয। এটা ফরযে কিফায়াহ। একদল লোক এটা সমাধা করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। অন্যথায় সকলেই গুনাহগার হয়। এ কাজ মৃতব্যক্তির হক, তার প্রাপ্য। এর দ্বারা মৃতব্যক্তিও উপকৃত হয় এবং যারা এ কাজে অংশগ্রহণ করে তারাও উপকৃত হয়। সেইসঙ্গে এটা মৃতব্যক্তির পরিবার ও তার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশও বটে। এতে তারা সান্ত্বনা পায়, তাদের কষ্ট লাঘব হয়। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যেকেরই এতে অংশগ্রহণ করা উচিত। এতে মৃতব্যক্তির উপকার তো এই যে, জানাযার নামায মূলত তার জন্য দু'আ। মৃতব্যক্তির জন্য জীবিতদের দু'আ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হয়ে থাকে। এটা তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ। জীবিতদের সুপারিশ মৃতব্যক্তির উপকারে আসে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ مَيِّتِ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُوْنَ مِائَةً، كُلُّهُمْ يَشْفَعُوْنَ لَهُ، إِلَّا شُفّعُوا فِيهِ
'একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়িয়তের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়’।
(সহীহ মুসলিম: ৯৩২; জামে তিরমিযী: ১০২৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৩৮০৪; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা : ১১৬২২; সুনানে নাসাঈ ১৯৯১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৮১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৯০৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلاً، لا يشركون بالله شيئاً إلا شَفَعهم الله فيه
'কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন। (সহীহ মুসলিম: ৯৪৮; সুনানে আবু দাউদ: ৩১৭০; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩০৮২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা ৫৬২১; শুআবুল ঈমান: ৮৮১২)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ দ্বারা অংশগ্রহণকারীদের নিজেদেরও অনেক ফায়দা হয়। একটা বড় ফায়দা তো নসীহত ও উপদেশলাভ। জানাযায় অংশগ্রহণ দ্বারা এই উপদেশ লাভ হয় যে, একদিন আমারও মরতে হবে। আমারও জানাযা পড়া হবে। হয়তো যে-কোনওদিনই মালাকুল-মাওত আমার কাছে এসে পড়বে। আমি সেজন্য কতটুকু প্রস্তুত? এভাবে এ চিন্তা জানাযায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আখিরাতমুখী করে তোলে। এ চিন্তা তার আত্মসংশোধনে সহায়ক হয়। সে সৎকর্মশীল হলে সৎকর্মের প্রতি আরও অগ্রগামী হবে। পাপী হলে তাওবা করে সৎকর্মে মনোযোগী হবে। তাই হাদীছে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عُودُوا الْمَرْضَى، وَاتَّبِعُوا الْجَنَائِزَ يُذَكِّرْكُمُ الْآخِرَةَ
'রোগীদের ইয়াদাত করো এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করো। তা তোমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেবে’।
(মুসনাদে আহমাদ:১২৩৬; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৫৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১০৮৪১; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৫১৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ১১১৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৯৫৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৭৫০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫০৩)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলতেন-
كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا
'উপদেশদাতা হিসেবে মৃত্যুই যথেষ্ট।'
অর্থাৎ মৃতব্যক্তিকে দেখলে তার দ্বারা উপদেশ লাভ হয়। আর নিজেকে সংশোধন করা ও আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য সে উপদেশই যথেষ্ট। এ বাক্যটি হাদীছরূপেও বর্ণিত আছে।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৭২; আল-মুজালাসা ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম: ১৯২৫)
জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণকারীর আরেকটা বড় ফায়দা হল বিপুল ছাওয়াব অর্জন। এর অনেক ছাওয়াব। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من شهد الجنازة حتى يصلي، فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان»، قيل: وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين
'যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।
(সহীহ বুখারী: ১৩২৫ সহীহ মুসলিম : ৯৪৫; মুসনাদে আহমাদ: ৯২০৮; সহীহ ইবন হিব্বান : ৩০৭৮; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৭৪৫; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ২১৩৩)

হাঁচিদাতাকে يَرْحَمُكَ اللهُ বলা
تَشمِيت الْعَاطِسِ (হাঁচিদাতাকের يَرْحَمُكَ اللهُ বলা) । تَشمِيت এর মূল অর্থ কল্যাণ ও বরকতের দু'আ করা। শব্দটির উৎপত্তি شمامة থেকে। এর অর্থ অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া। تَشمِيت অর্থ সেই আনন্দ প্রতিহত করা। এখানে تَشْمِيْت দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য يَرْحَمُكَ الله (তোমার প্রতি আল্লাহর রহমত হোক) বলা। যার প্রতি আল্লাহর রহমত হয় তার বিপদও কেটে যায়। ফলে শত্রুর আনন্দ ঘুচে যায়। যেহেতু এ দু'আটি পরিণামে শত্রুর আনন্দ ঘুচিয়ে দেয়, তাই একে تَشْمِيْت নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কারও মতে تَشمِيت এর উৎপত্তি شَوَامِت থেকে। شَوَامِت অর্থ হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সে হিসেবে অর্থ স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত রাখা। يَرْحَمُكَ اللهُ বলার দ্বারা হাঁচিদাতার জন্য তাকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার দু'আ করা হয়। তাই এ দু'আকে تشميت নাম দেওয়া হয়েছে।
হাঁচি দেওয়া একটি নি'আমত। এর দ্বারা আলস্য কাটে ও শরীর ঝরঝরে হয়। ফলে কাজকর্মে স্ফুর্তি আসে। তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে ভালো লাগে। তাই হাঁচিদাতার কর্তব্য হাঁচি দেওয়ার পর আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা অর্থাৎ বলা। আলহামদুলিল্লাহ শোকর আদায়ের ভাষা। হাঁচিদাতা আলহামদুলিল্লাহ বলার পর যে ব্যক্তি তা শুনবে তার কর্তব্য يرحمك الله বলা। সে يرحمك الله বললে হাঁচিদাতা আবার বলবে: يهديكُمُ اللهُ وَيُصْلِح بالكم (আল্লাহ তোমাদের হিদায়াত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁচির বিষয়ে এ তিনটি দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেন- :
إِذَا عَطَسَ أَحَدُكُمْ، فَلْيَقُلْ: الْحَمْدُ لِلَّهِ، فَإِذَا قَالَ: الْحَمْدُ لِلَّهِ، قَالَ لَهُ أَخُوهُ يَرْحَمُكَ اللَّهُ، فَإِذَا قِيلَ لَهُ يَرْحَمُكَ اللَّهُ : فَلْيَقُلْ: يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ
'তোমাদের কেউ হাঁচি দিলে সে যেন বলে الْحَمْدُ لِلهِ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর)। সে যখন الْحَمْدُ لِلهِ বলবে তখন উপস্থিত ভাই যেন বলে يَرْحَمُكَ اللهُ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন)। তাকে লক্ষ্য করে يَرْحَمُكَ الله বললে সে যেন বলে يهديكم الله وَيُصْلِحُ بَالْكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হিদায়াত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।
(সহীহ বুখারী: ৬২২৪; সুনানে আবু দাউদ: ৫০৩৩; জামে তিরমিযী: ২৭৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৭১৫; মুসনাদে আহমাদ: ৯৭২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: ২৫৯৯৭; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা: ৯৯৮৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৫৯৯)
হাঁচিদাতা আলহামদুলিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা ওয়াজিব। সেখানে একাধিক লোক থাকলে তাদের পক্ষ থেকে যে-কোনও একজন এটা বললে সকলের পক্ষ থেকে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। উপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা হবে, তখন আবার হাঁচিদাতার কাজ তাদের জন্য দু'আ করা। সে তাদের জন্য দু'আ করবে- يَهْدِيكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ (আল্লাহ তোমাদের হেদায়েত দান করুন এবং তোমাদের অবস্থা দুরস্ত করে দিন)।

মজলুমকে সহযোগিতা করা
عون المظلوم (মজলুমকে সহযোগিতা করা)। মজলুম হল ওই ব্যক্তি, যার কোনও হক অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের হক তিন প্রকার। জানের হক, মালের হক ও ইজ্জতের হক। অন্যায়ভাবে কাউকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়ার দ্বারা তার জানের হক নষ্ট করা হয়। অন্যায়ভাবে হত্যা করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের শারীরিক জুলুম। কারও স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া, ব্যবসায়ের ক্ষতি করা, ফল-ফসল নষ্ট করা, পাওনা পরিশোধ না করা বা পরিশোধে গড়িমসি করা কিংবা প্রাপ্যের চেয়ে কম দেওয়া, সুদ-ঘুষ খাওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ দ্বারা মানুষের মালের হক নষ্ট করা হয়। কারও গীবত করা, অপবাদ দেওয়া, গালাগালি করা এবং এমনিভাবে যে-কোনও অসম্মানজনক আচরণ করার দ্বারা ইজ্জতের হক নষ্ট করা হয়। এ তিনও প্রকারের হক নষ্ট করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। যার প্রতি এর কোনও একটি করা হয় সেই মজলুম।
জুলুম করা যেমন হারাম ও নাজায়েয, তেমনি জুলুমে সহযোগিতা করাও নাজায়েয। জুলুমের নীরব দর্শক হয়ে থাকাও নাজায়েয কাজ। মুসলিম ব্যক্তি নিজে যেমন কারও প্রতি জুলুম করতে পারে না, তেমনি সে কাউকে অন্যের দ্বারা জুলুমের শিকার হতেও দিতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ
'এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না’।
(সহীহ বুখারী:২৪৪২; সহীহ মুসলিম: ২৫৮০; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৯৩; জামে তিরমিযী: ১৪২৬; সুনানে ইবন মাজাহ; ২২৫; মুসনাদে আহমাদ: ৫৬৪৬)
কাজেই কারও প্রতি জুলুম হতে দেখলে আপন সাধ্যমতো তা প্রতিহত করা এবং মজলুমের সাহায্য-সহযোগিতা করা অবশ্যকর্তব্য। এটা ফরয। এ ফরয আদায় না করা কঠিন গুনাহ। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন আমরা যেন মজলুমের সাহায্য করি। তা কথা দিয়ে হোক বা কাজ দিয়ে হোক। যেভাবেই হোক মজলুম ব্যক্তি যাতে জালেমের হাত থেকে রেহাই পেতে পারে, জালেম যাতে তার কোনও প্রকার হক নষ্ট করতে না পারে, সে চেষ্টা করা একান্ত কর্তব্য। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি সে চেষ্টা করবে না সে গুনাহগার হবে। এজন্য আখিরাতে তো বটেই, দুনিয়ায়ও তাকে এর কুফল ভোগ করতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ امْرِئٍ مُسلِم يَخْذُلُ امْرَأ مُسْلِمًا فِي مَوْضِع تُنْتَهَكُ فِيهِ حُرْمَتُه ويُنتقص فيه مِنْ عِرْضهِ، إِلَّا خَذَلَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ فِيْهِ نُصْرَتَه
‘যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি এমন স্থানে অপর কোনও মুসলিম ব্যক্তির সাহায্য করা হতে বিরত থাকে, যেখানে তার সম্মান নষ্ট করা হয় ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়, আল্লাহ তা’আলা এমন স্থানে তার সাহায্য করা হতে বিরত থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে’।
(মুসনাদে আহমাদ : ১৬৩৬৮; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৮৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা : ১৬৬৮২; শুআবুল ঈমান: ৭২২৬; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ৪৭৩৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৫৩২)
এর বিপরীতে যে ব্যক্তি মজলুমকে সাহায্য করবে, সে দুনিয়া ও আখিরাতে এর জন্য পুরস্কৃতও হবে। সুতরাং এ হাদীছেরই শেষাংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا مِنْ امْرِئٍ يَنْصُرُ مُسْلِمًا فِي مَوْضِع يُنتَقَصُ فِيْهِ مِنْ عِرْضهِ وَيُنْتَهَكُ فِيهِ مِنْ حُرْمته إِلَّا نَصَرَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ فِيْهِ نُصْرَتَه
'অপরদিকে যে-কোনও মুসলিম ব্যক্তি এমন স্থানে অপর কোনও মুসলিম ব্যক্তির সাহায্য করে, যেখানে তার সম্মান নষ্ট করা হয় ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়, আল্লাহ তা'আলা এমন স্থানে তার সাহায্য করবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে।'
অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما من امرئ مسلم يرد عن عرض أخيه، إلا كان حقا على الله عز وجل أن يرد عنه نار جهنم يوم القيامة ثُمَّ تَلَا هُذِهِ الْآيَةَ : وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ
'যে কোনও মুসলিম ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের ইজ্জত রক্ষায় ভূমিকা রাখে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন অবশ্যই জাহান্নামের আগুন তার থেকে দূরীভূত করবেন। এই বলে তিনি পাঠ করলেন- وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ (আর মুমিনদেরকে সাহায্য করার দায়িত্ব আমি নিজের উপর রেখেছি)।’
(জামে তিরমিযী : ১৯৩১; মুসনাদে আহমাদ: ২৭৫৩৬; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৮৮৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ : ৩৫২৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর: ৪৪৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা: ২৫৫৪০)

সালামের জবাব দেওয়া
رد السلام -সালামের জবাব দেওয়া। এক মুসলিমের সঙ্গে আরেক মুসলিমের সাক্ষাত হলে তাদের প্রথম কাজ একজন আরেকজনকে সালাম দেওয়া। যাকে সালাম দেওয়া হবে তার কর্তব্য সালামের জবাব দেওয়া। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا ‘যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম দেয়, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিও কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিও। সূরা নিসা (৪), আয়াত নং ৮৬
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। একাধিক ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া হলে সকলের পক্ষ থেকে একজন উত্তর দিলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। কেউ উত্তর না দিলে সকলেই গুনাহগার হয়। উত্তর না দেওয়া অসৌজন্যমূলক আচরণও বটে। এর দ্বারা সালামদাতাকে অবজ্ঞা করা হয়। সেইসঙ্গে তার মনে দুর্ভাবনাও সৃষ্টি করা হয়। কেননা সালাম মূলত নিরাপত্তাদানের ভাষা। যে ব্যক্তি সালাম দেয় সে সালামের বাক্য দ্বারা আশ্বস্ত করে যে, তোমরা নিরাপদ। আমার দিক থেকে তোমাদের কোনও অনিষ্টের আশঙ্কা নেই। তারপর সে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে যে, তারাও তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে কি না। উত্তর না দিলে তার মনে অনিষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয়। সে আশঙ্কা দূর করার জন্য উত্তর দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
সালাম দেওয়া ও তার উত্তর দেওয়া ইসলামের অতি মূল্যবান এক শিক্ষা। এটা ইসলামী তাহযীব ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনও বটে। যেখানে সালামের রেওয়াজ আছে সেখানকার লোকজন যে মুসলিম এবং তারা ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত, তা এই রেওয়াজ দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটির মূল্য বোঝা এবং সর্বস্তরে এটা বাস্তবায়ন করা।

কসমকারীর কসম রক্ষায় সহযোগিতা করা
إِبْرَارُ الْمُقسِمِ (কসমকারীর কসম রক্ষায় সহযোগিতা করা)। কেউ যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কাউকে কোনও কাজ করতে বলে, যেমন বলল- আল্লাহর কসম, তুমি এ কাজ অবশ্যই করবে, তবে সেই ব্যক্তির কর্তব্য কাজটি অবশ্যই করা, যদি সে কাজটি বৈধ হয় এবং তার পক্ষে তা করা সম্ভবপরও হয়। এটা করলে সেই ব্যক্তি কসম ভঙ্গের অপরাধ থেকে বেঁচে যাবে। কসম ভঙ্গ করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা তাতে আল্লাহ তা'আলার নামের অমর্যাদা হয়। একজন মুমিন সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসে আল্লাহ তা'আলাকে। তাই সে আল্লাহ তা'আলার নামের অমর্যাদা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আর তা পারে না বলেই সে নিজে যেমন নিজ কসম পূরণ করে আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদা রক্ষা করবে, তেমনি অন্যের কসম পূরণে সহায়তা করেও আল্লাহ তাআলার নামের মর্যাদা রক্ষা করবে। কাজেই তাকে কেউ কসমের সঙ্গে কিছু করতে বললে সে তা অবশ্যই করতে সচেষ্ট থাকবে।
বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এক ব্যক্তিকে চরি করতে দেখে পাকড়াও করেছিলেন। সে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করে চুরির কথা অস্বীকার করল। উত্তরে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি। কাজেই ধরে নিচ্ছি আমার দেখাটাই ভুল। এভাবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তার কসমের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
অন্যের মর্যাদা রক্ষা না করা এক রকম অপরাধ। অন্য হাদীছ দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من حلف على أحد بيمين وهو يرى أنه سيبره فلم يفعل فإنما إثمه على الذي لم يبره
'যে ব্যক্তি কারও প্রতি কোনও বিষয়ে কসম করে আর সে ব্যক্তি মনে করে যে, সে (কাজটি করে) তার কসম রক্ষা করাতে পারবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তা না করে, তবে এর গুনাহ হবে ওই ব্যক্তির উপর, যে তার কসম রক্ষা করতে দিল না’।
(বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ১৯৮৯১; সুনানে দারা কুতনী: ৪২৭০)
একবার এক মহিলা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে কিছু খেজুর হাদিয়া দিলে তিনি তা থেকে কিছু খেলেন এবং কিছু রেখে দিলেন। তখন সেই মহিলা বলল, আমি কসম করে বলছি সবগুলোই খান। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তার কসম পূর্ণ করো। কেননা যে ব্যক্তি কসম ভাঙ্গায়, গুনাহ তারই হয়।
(বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ১৯৮৯২; মুসনাদে আহমাদ: ২৪৮৩৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এরকমই করতেন। কেউ তাঁকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু করার অনুরোধ জানালে তিনি সেই অনুরোধ রক্ষা করতেন। একবার চাচা আব্বাস রাযি. আল্লাহর নামে কসম করে তাঁর কাছে এক ব্যক্তির পক্ষে বাইআতের সুপারিশ করলে তিনি বলেছিলেন, হাঁ, আমি আমার চাচার কসম পূর্ণ করলাম।
(সুনানে ইবন মাজাহ : ২১১৬; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৫১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা : ১৯৮৮৯)

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি বিষয় নিষেধ করেছেন। নিচে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাদান করা যাচ্ছে।

পুরুষের জন্য স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
হযরত বারা ইব্ন আযিব রাযি. বলেন- (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সোনার আংটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন)। এ নিষেধাজ্ঞা পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়। পুরুষের জন্য কোনওরূপ স্বর্ণালংকার ব্যবহার করা জায়েয নয়, তার পরিমাণ যত অল্পই হোক না কেন। স্বর্ণালংকার ব্যবহার করা জায়েয কেবল নারীর জন্য, তাও যদি অহংকার ও প্রদর্শনের জন্য না হয়। অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, পুরুষের জন্য জান্নাতে স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কাজেই যেসকল পুরুষ দুনিয়ায় স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার করবে, জান্নাতে তারা তা পাবে না। এটা তাদের জন্য জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার সতর্কবাণী। কাজেই জান্নাতকামী পুরুষদের কর্তব্য দুনিয়ায় স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। তা থাকতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতে তাদেরকে নানারকম স্বর্ণালঙ্কার ও সাজসজ্জায় ভূষিত করা হবে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদঃ- يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا “তাদেরকে সেখানে স্বর্ণকঙ্কনে অলংকৃত করা হবে। আর তারা উচ্চ আসনে হেলান দেওয়া অবস্থায় মিহি ও পুরু রেশমী কাপড় পরিহিত থাকবে। কতইনা উৎকৃষ্ট প্রতিদান এবং কত সুন্দর বিশ্রামস্থল। সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৩১
অপর এক আয়াতে ইরশাদঃ- يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ ‘সেখানে তাদেরকে সজ্জিত করা হবে সোনার কাঁকন ও মণি-মুক্তা দ্বারা। আর সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের। সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ২৩

সোনা-রুপার পাত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
وعن شرب بآنية الفضة এবং (নিষেধ করেছেন) রুপার পাত্রে পান করতে'। রুপার পাত্রে পানি পান করা পুরুষ ও নারী কারও জন্যই জায়েয নয়। সোনারুপার অন্যকোনও পাত্রও ব্যবহারের অনুমতি নেই। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- لا تشربوا في إناء الذهب والفضة، ولا تلبسوا الديباج والحرير، فإنه لهم في الدنيا وهو لكم في الآخرة يوم القيامة 'তোমরা সোনা-রুপার পাত্রে পান করো না এবং রেশম ও দীবাজ (এক ধরনের রেশমী কাপড়) পরিধান করো না। কেননা এটা দুনিয়ায় তাদের (কাফেরদের) জন্য এবং তোমাদের জন্য আখেরাতে।[৮]
এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছেঃ- ولا تأكلوا في صحافها এবং তোমরা সোনা-রুপার পাত্রে আহার করো না'।[৯]
এক হাদীছে এ নিষেধাজ্ঞার কারণ বলা হয়েছে যে, জান্নাতে পানাহারের পাত্র হবে সোনারুপার। কাজেই এটা নারী-পুরুষ সকলের জন্যই নিষেধ। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি. বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে- من شرب في إناء من ذهب، أو فضة، فإنما يجرجر في بطنه نارا من جهنم “যে ব্যক্তি সোনা-রূপার পাত্রে পান করে, সে তার পেটে কেবল জাহান্নামের আগুনই ঢোকায়।[১০]
মোটকথা, সোনা-রুপার পাত্র ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম ও কঠিন পাপ। কাজেই ঈমানদারদেরকে অবশ্যই এর থেকে বিরত থাকতে হবে। এ জাতীয় বিলাসিতা ঈমানদারদের জন্য শোভা পায় না।
এ নিষেধাজ্ঞা পানাহারের পাত্র ছাড়া অন্য আসবাবপত্রেও প্রযোজ্য, যেমন সুরমাদানি, কলম, চশমার ফ্রেম, আতরদানি ইত্যাদি।
বিভিন্ন রেশমী পোশাকের নিষেধাজ্ঞা
وعن المياثر এবং (তিনি নিষেধ করেছেন) মায়াছির ব্যবহার করতে”। ইমাম নববী রহ. "المياثر -এর ব্যাখ্যা করেছেন যে, এ শব্দটি ميثرة এর বহুবচন। এটা একরকম গদি। রেশম দ্বারা তৈরি করা হয়। ভেতরে তুলা বা অন্যকিছুর পুর দেওয়া হয়। এটা উট, গাধা ইত্যাদি বাহনের পিঠে রেখে আরোহী তার উপর বসে। রেশমের তৈরি সব মায়াছিরই হারাম, তা যে রঙেরই হোক।

রেশম ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ, রেশমি পোশাক ব্যবহার করতে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে - من لبس الحرير في الدنيا لم يلبسه في الآخرة 'যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশমী পোশাক পরে, সে আখেরাতে তা পরতে পারবে না।[১১]
তবে এ নিষেধাজ্ঞা কেবল পুরুষের জন্য। নারীর জন্য রেশমী পোশাক পরা জায়েয, যেমন তাদের জন্য স্বর্ণালঙ্কারও জায়েয। হযরত উকবা ইবন আমির রাযি থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- الذهب والحرير حل لإناث أمتي وحرام على ذكورها সোনা ও রেশম আমার উম্মতের মহিলাদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম।[১২]
হযরত আলী রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাম হাতে রেশম এবং ডান হাতে স্বর্ণ ধরলেন। তারপর দু'হাত তুলে বললেনঃ- إن هذين حرام على ذكور أمتي، حل لإناثهم ‘এ দুটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম, মহিলাদের জন্য হালাল।[১৩]
শায়খ আবূ মুহাম্মাদ রহ. এ নিষেধাজ্ঞার হিকমত বর্ণনা করেন যে, সাজসজ্জার ব্যাপারে নারীদের সংযম কম। তাই এটা তাদের জন্য হালাল করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষত এ কারণেও যে, তাদের সাজসজ্জা হবে কেবল স্বামীদের জন্য। এর দ্বারা বোঝা যায় পুরুষদের জন্য বেশি সাজসজ্জা ও উপভোগের বস্তু ব্যবহার করা ভালো নয়। কেননা এটা নারীর বৈশিষ্ট্য।
والإستبرق والديباج ‘এবং (তিনি নিষেধ করেছেন) ইসতাবরাক ও দীবাজ ব্যবহার করতে। ইসতাবরাক বলা হয় মোটা রেশমী কাপড়কে। আর দীবাজ হচ্ছে চিকন রেশমী কাপড়।

হারানো প্রাপ্তির ঘোষণাদানের আদেশ
وإنشاد الضالة 'হারানো প্রাপ্তির ঘোষণা'। এটি একটি আদিষ্ট বিষয়। অর্থাৎ হাদীছটির প্রথম অংশে যে সাতটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে, কোনও কোনও বর্ণনায় তাতে কসমের পরিবর্তে এটির উল্লেখ আছে। কেউ যদি কোনও হারানো বস্তু পায়, তবে তার কর্তব্য জনসম্মুখে তা ঘোষণা করা। এটা মুসলিম ব্যক্তির হক। যে ব্যক্তি তার কোনও বস্তু হারায়, সে পেরেশান হয়ে পড়ে। বস্তুটি যত দামী বা যতবেশি প্রয়োজনীয় হয়, পেরেশানিও ততবেশি হয়। মুসলিম ভাইয়ের পেরেশানি দূর করা অপর মুসলিম ভাইয়ের কর্তব্য। পেছনে মুসলিম ব্যক্তির হকসমূহের বর্ণনায় এটিরও উল্লেখ আছে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনওরকম অবহেলা করা উচিত নয়।
কারও কোনও হারানো বস্তু দেখতে পেলে যদি আশঙ্কা হয় সেটি পড়ে থাকলে কোনও দুষ্ট লোকের হাতে পড়বে বা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, ফলে প্রকৃত মালিক সেটি আর ফিরে পাবে না, তবে তার উচিত হবে মালিকের হাতে পৌঁছানোর নিয়তে সেটি তুলে নেওয়া, তারপর যতদিন মালিককে না পাওয়া যায় ততদিন সেটি সংরক্ষণ করা এবং ঘোষণা দিতে থাকা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন তা এভাবে সংরক্ষণ করতে হবে? এটা একেক মালের জন্য একেকরকম। কোনওটির জন্য হয়তো তিনদিনই যথেষ্ট, আবার কোনওটির জন্য মাস কি বছরকালও হেফাজতের প্রয়োজন হতে পারে। একবার জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে পড়ে পাওয়া টাকার থলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল । তিনি বলেন- إعرف عفاصها ووكاءها، ثم عرفها سنة، فإن جاء صاحبها وإلا فشأنك بها 'তুমি থলি ও তার বাঁধন-রশিটি চিনে রাখ। তারপর এক বছর সেটি প্রচার কর। এর মধ্যে তার মালিক আসলে তো ভালো, অন্যথায় তোমার যা ভালো মনে হয় করো।[১৪]
এক বছর সংরক্ষণ ও প্রচার করতে হবে অর্থের পরিমাণ বেশি হলে বা খুব দামী মাল হলে। অন্যথায় মালিককে পাওয়ার সম্ভাব্য সময় চিন্তাভাবনা করে দেখবে। যখন মনে করবে তাকে আর পাওয়া যাবে না, তখন তার উদ্দেশ্যে সেটি সদাকা করে দেবে। নেহাত গরীব হলে নিজেও ভোগ করতে পারে। পরে যদি মালিককে পাওয়া যায়, তখন হয় সেটি তাকে ফেরত দেবে, নয়তো তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেবে।
কারও হারানো মাল পেয়ে গেলে তা লুকানো ও নিজে নিয়ে নেওয়া কঠিন পাপ। এটা আত্মসাতের মধ্যে পড়ে। বেশি দামী বস্তু হলে অনেকে লোভে পড়ে যায়। এরকম লোভ অবশ্যই সামলাতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- لا يأوي الضالة إلا ضال হারিয়ে যাওয়া বস্তু (নিজে ভোগের জন্য) তুলে নেয় কেবল পথভ্রষ্ট লোক।[১৫]
কারও হারানো বস্তু পেলে তার মালিক সন্ধান করা কর্তব্য বটে, তবে এ কাজে মসজিদ ব্যবহার করা উচিত নয়। ইদানীং মসজিদে হারানো বস্তু ও হারানো প্রাপ্তির ঘোষণা দেওয়াটা ব্যাপক হয়ে গেছে। অথচ মসজিদে এটা করা নিষেধ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من سمع رجلا ينشد ضالة في المسجد، فليقل: لا أداها الله إليك فإن المساجد لم تبن لهذا “যে ব্যক্তি কাউকে মসজিদে তার হারিয়ে যাওয়া বস্তুর ঘোষণা দিতে শুনে সে যেন তাকে বলে দেয়, আল্লাহ করুন তুমি যেন এটা না-ই পাও। মসজিদ তো এজন্য বানানো হয়নি।[১৬]
অবশ্য মসজিদের ভেতরে ঘোষণা না করে যদি মসজিদের দরজার সামনে ঘোষণা করে, তবে অসুবিধা নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রোগী দেখতে যাওয়া ও রোগীর খোঁজখবর নেওয়া মুসলিম ব্যক্তির এক বিশেষ দায়িত্ব।

খ. জানাযার নামায ও দাফনে অংশগ্রহণ করা মৃতব্যক্তির হক। এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

গ. কেউ হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে তার উত্তরে অবশ্যই يَرْحَمُكَ اللهُ বলতে হবে।

ঘ. দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির সাহায্য করা সক্ষম ও শক্তিমানের কর্তব্য।

ঙ. মজলুম ও নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো ও সামর্থ্য অনুযায়ী তার সাহায্য করা দীনের। এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

চ. সালামের জবাব দেওয়া সালামদাতার হক।

ছ. কেউ কসম দিয়ে কোনও কাজ করতে বললে আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদা। রক্ষার্থে সে কাজটি অবশ্যই করা উচিত, যদি তা শরী'আতসম্মত হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন