আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬১২৮
৩২৪২. নবী (ﷺ) এর বাণীঃ তোমরা নম্র হও, কঠোর ব্যবহার করো না। এবং নবী (ﷺ) মানুষের সাথে নম্র ব্যবহার পছন্দ করতেন।
৫৬৯৮। আবুল ইয়ামান ও লাঈস (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করে দিলো। তখন লোকজন তাকে শাসন করার জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠলো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের বললেনঃ তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং তার পেশাবের উপর এক বালতি পানি অথবা একপাত্র পানি ঢেলে দাও। কারণ, তোমাদের নম্র ব্যবহারকারী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসেবে পাঠানো হয় নি।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

أَعْرَاب শব্দটি عَرَبٌ এর বহুবচন। কোনও ব্যক্তিকে عَرَبٌ এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে যখন عربي বলা হয়, তখন তা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য হয় সে হযরত ইসমা'ঈল আলাইহিস সালামের বংশধর। যখন أَعْرَاب এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে أَعرابي বলা হয়, তখন অর্থ হয় সে একজন বেদুঈন বা মরুবাসী। আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তি মরু এলাকায় বা আরব পল্লী অঞ্চলে বাস করত। সুতরাং সে একজন বেদুঈন। এ শ্রেণির লোক ইসলামী আদব-কায়দার সঙ্গে ভালো পরিচিত থাকে না। তাই তাদের দ্বারা এমন এমন কাজ হয়ে যায়, যা ভদ্র ও সভ্য লোকদের পক্ষে কিছুতেই মানায় না। তাদেরকে তা ধীরে ধীরে শিখিয়ে নিতে হয়। নম্র-কোমল ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হয়।

হাদীছে বর্ণিত এ বেদুঈনের নাম ছিল যুল-খুওয়ায়সিরা। তিনি ইয়ামানের লোক ছিলেন এবং একজন খাঁটি সাহাবী ছিলেন। যুল-খুওয়ায়সিরা নামে আরও এক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন তামীম গোত্রের লোক। তার থেকেই পথভ্রষ্ট খারিজী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি।

হযরত যুল-খুওয়ায়সিরা আল-ইয়ামানী রাযি. তিনটি কারণে বিশেষ পরিচিত। সে তিনটি বিষয় একত্রে উল্লেখ করে বলা হয়ে থাকে- هُوَ الْبَائِلُ وَالْقَائِلُ وَالسَّائِلُ (তিনিই প্রস্রাবকারী, উক্তিকারী ও প্রশ্নকারী)। 'উক্তি' বলে তাঁর একটি বিশেষ দু'আর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
دَخَلَ أَعْرَابِيُّ الْمَسْجِدَ وَالنَّبِيُّ ﷺ جَالِسٌ ، فَصَلَّى، فَلَمَّا فَرَغَ، قَالَ: اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي وَمُحَمَّدًا وَلَا تَرْحَمْ مَعَنَا أَحَدًا ، فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ ، فَقَالَ : لَقَدْ تَحَجَّرْتَ وَاسِعًا
জনৈক বেদুঈন মসজিদে প্রবেশ করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বসা। লোকটি নামায পড়ল। নামায শেষে দু'আ করল, হে আল্লাহ! আপনি আমার ও মুহাম্মাদের প্রতি রহমত করুন। আমাদের সঙ্গে অন্য কারও প্রতি রহমত করবেন না। এ কথা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, তুমি তো প্রশ্বস্ত বিষয়কে সংকীর্ণ করে দিলে। (জামে' তিরমিযী: ১৪৭; সুনানে আবু দাউদ: ৮৮২; সুনানে নাসাঈ ১২১৬; মুসনাদে আহমাদ: ৭৭৮৯; মুসনাদুল হুমায়দী : ৯৬৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৬৫৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ৮৬৪)

'প্রশ্ন' বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাঁর একটি জিজ্ঞাসার প্রতি। সে সম্পর্কে হযরত আনাস রাযি. বর্ণনা করেন-
أَنَّ رَجُلًا مِنَ الْأَعْرَابِ أَتَى رَسُولَ اللهِ ﷺ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى السَّاعَةُ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: مَا أَعْدَدْتَ لَهَا ؟ فَقَالَ الْأَعْرَابِيُّ : مَا أَعْدَدْتُ لَهَا مِنْ كَبِيرٍ أَحْمَدُ عَلَيْهِ نَفْسِي ، إِلَّا أَنِّي أُحِبُّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: فَإِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ
'জনৈক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিয়ামত কবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সেজন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? বেদুঈন বলল, আমি সেজন্য এমন বেশি কিছু দিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারিনি, যা দ্বারা আমি নিজের প্রশংসা করতে পারি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যাকে ভালোবাস তার সঙ্গেই থাকবে। (সহীহ বুখারী: ৬১৬৭; সহীহ মুসলিম: ২৬৩৯; জামে তিরমিযী: ২৩৮৫; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২২৪৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩০৬১; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৪৬১)

এই বেদুঈন সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কথা বলার পর মসজিদের ভেতরেই প্রস্রাব করতে বসে গেলেন। তা দেখে উপস্থিত সাহাবীগণ তাঁর দিকে তেড়ে গেলেন। এ হাদীছে বলা হয়েছে- فَقَامَ النَّاسُ إِلَيْهِ لِيَقَعُوْا فِيْهِ (লোকেরা তাকে কিছু বলার জন্য উঠে তার দিকে গেল)। কোনও বর্ণনায় আছে, তারা তাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠলেন। কোনও বর্ণনায় আছে, তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে থামিয়ে দিলেন এবং তাঁর প্রস্রাবের উপর বালতিতে করে পানি ঢেলে দিতে বললেন। তারপর ইরশাদ করলেন-
فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ (তোমাদেরকে সহজতা অবলম্বনকারীরূপে পাঠানো হয়েছে, কঠোরতা অবলম্বনকারীরূপে পাঠানো হয়নি)। অর্থাৎ সে তো কেবলই ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলামের নিয়ম-কানুন তার জানা নেই। কাজেই তাকে তিরস্কার করা বা ধমকানো উচিত নয়। তার প্রতি কঠোরতা করা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং তোমাদের কর্তব্য তার প্রতি সহজ আচরণ করা, তাকে কোমলভাবে শিক্ষাদান করা। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাকে মমতার সঙ্গে শিক্ষাদান করলেন। তাঁর মমত্বভরা শিক্ষা গ্রহণ করার পর সেই বেদুঈন সাহাবী এভাবে নিজ অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন যে-
فَقَامَ إِلَيَّ بِأَبِي وَأُمِّي، فَلَمْ يُؤَنبْ، وَلَمْ يَسُبَّ، فَقَالَ : إِنَّ هَذَا الْمَسْجِدَ لَا يُبَالُ فِيْهِ وَإِنَّمَا بُنِيَ لِذِكْرِ اللَّهِ وَلِلصَّلَاة
'তাঁর প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক। তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। কিন্তু আমাকে তিরস্কার করলেন না, নিন্দাও করলেন না। কেবল বললেন, এটা মসজিদ। এর ভেতর প্রস্রাব করা যায় না। এটা তৈরি করা হয়েছে আল্লাহর যিকির করার জন্য ও নামায আদায়ের জন্য। (সুনানে ইবন মাজাহ: ৫২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৯৮৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৬৬০

অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন-
إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذرِ، إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ.
এ মসজিদসমূহ পেশাব করা বা ময়লা ফেলার উপযুক্ত স্থান নয়। এসব তো কেবল আল্লাহ তা'আলার যিকির করা, নামায পড়া ও কুরআন পাঠ করার জন্য। (সহীহ মুসলিম: ২৮৫; মুসনাদুল বাযযার ৬৪২৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৫০০৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪১৪২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৫০০)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মসজিদ অপবিত্র করা বা নোংরা করা জায়েয নয়।

খ. কেউ মসজিদ অপবিত্র বা নোংরা করলে অতি দ্রুত তা পবিত্র ও পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

গ. প্রস্রাবরত ব্যক্তিকে মাঝখানে থামিয়ে দিতে নেই। তাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

ঘ. যে ব্যক্তির ইসলামী আদব-কায়দা জানা নেই, তাকে নম্র ও কোমলভাবে তা শিখিয়ে দেওয়া চাই।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন