আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬১১৭
৩২৩৯. লজ্জাশীলতা
৫৬৮৭। আদম (রাহঃ) ......... ইমরান ইবনে হুসাইন (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ লজ্জাশীলতা কল্যাণ ব্যতীত কোন কিছুই বয়ে আনে না। তখন বুশায়র ইবনে কা'ব (রাহঃ) বললেনঃ হিকমতের পুস্তকে লিখা আছে যে, কোন কোন লজ্জাশীলতা ধৈর্যশীলতা বয়ে আনে। আর কোন কোন লজ্জাশীলতা এনে দেয় শান্তি ও সুখ। তখন ইমরান (রাযিঃ) বললেন, আমি তোমার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করছি। আর তুমি (এর মোকাবিলায়) আমাকে তোমার পুস্তিকা থেকে বর্ণনা করছ!

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লজ্জাশীলতা যে কত উৎকৃষ্ট গুণ, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, তা কেবল কল্যাণই বয়ে আনে। হাদীসে আরো আছে, এর পুরোটাই কল্যাণ। বস্তুত লজ্জাশীলতা এমনই এক গুণ, যা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণ বয়ে আনে। কেননা যার মধ্যে এ গুণ থাকে, সে যদি একজন দুনিয়াদার ব্যক্তিও হয়, তবুও সহজে মন্দকাজে লিপ্ত হয় না। লোকলজ্জার ভয়ে সে তা থেকে বিরত থাকে। সে ভাবে, লোকে যদি জানতে পারে আমি এই এই কাজ করি, তবে তারা কী মনে করবে! লোকলজ্জার ভয়ও যখন মানুষের মন্দকাজ থেকে বিরত থাকার কারণ হয়, তখন আল্লাহর প্রতি যার লজ্জাবোধ থাকে, সে কীভাবে মন্দকাজে লিপ্ত হতে পারে? নিশ্চয়ই এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর কোনও আদেশ অমান্য করবে না এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তাতেও কখনও লিপ্ত হবে না।

ইবনে আরাবী রহ. বলেন, হায়া তো এই যে, মানুষ এমন কাজ করা হতে বিরত থাকবে, যা সে করেছে বলে লোকে জানতে পারলে তাদের মধ্যে তাকে লজ্জিত ও অপদস্থ হতে হবে। মুমিন ব্যক্তি জানে যে, সে যা-কিছুই করে তা আল্লাহ দেখেন। এ কথা জানে, তখন তো আল্লাহকে তার অনেক বেশি লজ্জা করা উচিত। কেননা কিয়ামতের দিন তিনি যখন লোকসম্মুখে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তখন তাকে চরমভাবে লজ্জিত হতে হবে। সে লজ্জার ভয়ে এখনই তার কর্তব্য যাবতীয় লজ্জাজনক কাজ অর্থাৎ শরী'আতবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকা। এটাই প্রকৃত হায়া। এজন্যই বলা হয়েছে, লজ্জা কেবল কল্যাণই বয়ে আনে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, যে ব্যক্তি লজ্জার পোশাক পরিধান করে, লোকে তার মধ্যে কখনও কোনও দোষ দেখতে পাবে না।

প্রশ্ন হতে পারে, অনেক সময় মানুষ লজ্জার কারণে সত্য কথা বলতে পারে না, এমনিভাবে ন্যায়ের আদেশ করা ও অন্যায়ে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় লজ্জা প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে, তো এরূপ ক্ষেত্রে লজ্জা কল্যাণ বয়ে আনল কই; বরং তা তো কল্যাণের জন্য বাধা হয়ে গেল?
এর উত্তর হল, যে লজ্জা সত্য বলা বা ন্যায়ের আদেশ করা ও অন্যায়ে বাধা দেওয়ার পক্ষে প্রতিবন্ধক হয়, তা আদৌ লজ্জা নয়; বরং তা এক রকম মানসিক অক্ষমতা ও ঈমানী দুর্বলতা। যে লজ্জা ঈমানের অঙ্গ, তার তো দাবি হল সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকা ও সত্য বলতে অদম্য থাকা। এটা ভিন্ন কথা যে, সত্য বলতে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রাখা জরুরি। সে হিসেবে সত্য বলার ধরন-ধারণ যেখানে যেমন হওয়া উচিত সেখানে তেমনই পন্থা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। সঠিক ও যৌক্তিক পন্থায় এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে। লজ্জার অজুহাতে তা থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই। আসল কর্তব্য হল লজ্জাশীলতাকে ঈমান ও শরী'আতের ছাঁচে ঢালাই করে নেওয়া। তা করা হলে লজ্জা কখনও কোনও কল্যাণকর কাজে প্রতিবন্ধক হবে না; বরং তা সম্পন্ন করার পক্ষেই প্রেরণাদায়ী হবে।

সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে একবার লজ্জাশীলতা সম্পর্কে আলোচনা হলে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! লজ্জাশীলতা কি দীনের অঙ্গ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
بَلْ هُوَ الدِّيْنُ كُلُّهُ
‘বরং দীনের সবটাই তো লজ্জাশীলতা'। (তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮০৮)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. লজ্জাশীলতা যেহেতু কল্যাণই বয়ে আনে, তাই সকল ক্ষেত্রে এ গুণের চর্চা করা চাই।

খ. লজ্জার কারণে যদি কেউ এমন কোনও কাজ করে, যা শরী'আত অনুমোদন করে না, তবে বুঝতে হবে সে লজ্জা আদৌ লজ্জা নয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন