আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬০৬৫
৩২১৯. একে অন্যকে হিংসা করা এবং পরস্পর বিরোধিতা করা নিষিদ্ধ।
৫৬৩৯। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থেকো। কোন মুসলমানের জন্য তিন দিনের বেশী তার ভাইকে পরিত্যাগ করে থাকা জায়েয নয়।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আখলাক-চরিত্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আখলাক-চরিত্র ইসলামী শিক্ষার অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا بُعِثْتُ لأتمم صالح الأخلاق
'আমাকে পাঠানো হয়েছে ভালো চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।[১]
আখলাক-চরিত্রের কিছু আছে ভালো দিক, যাকে 'আখলাকে হামীদাহ' বলে। কিছু আছে মন্দ দিক, যাকে 'আখলাকে যামীমাহ' বা 'রাযীলাহ' বলে। সব মানুষের মধ্যেই উভয়প্রকার চরিত্রই নিহিত আছে। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য মন্দ চরিত্র দমন ও উত্তম চরিত্রের বিকাশ সাধনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন মুজাহাদা ও সাধনা চালানো। কোন কোন চরিত্র মন্দ এবং কোনগুলো ভালো, তার অনেকটাই আল্লাহপ্রদত্ত বোধ-বুদ্ধি দ্বারা নিরূপণ করা যায়। আবার কোনও কোনওটি বোঝার জন্য আসমানী শিক্ষার প্রয়োজন হয়। তবে মহান ইসলাম বিষয়টাকে কেবল মানববৃদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়নি; বরং সুনির্দিষ্টভাবে প্রত্যেকটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেসব গুণ ভালো, তা অর্জনের আদেশ করেছে এবং তার ফযীলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনাপূর্বক তা অর্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। অপরদিকে যেগুলো মন্দ, তা বর্জন ও দমনের হুকুম দিয়েছে এবং তার ক্ষতি ও কদর্যতার উল্লেখপূর্বক তা পরিহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। আলোচ্য হাদীছে বিশেষ কয়েকটি মন্দ চরিত্রের উল্লেখ আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কেউ যাতে সেসব চরিত্রপ্রসূত আচরণ কারও সঙ্গে না করে, সে ব্যাপারে তাগিদ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে হাসাদ। তিনি বলেন-
একে অন্যকে হাসাদ না করা
لا تحاسدوا 'তোমরা একে অন্যের প্রতি হাসাদ করো না'। হাসাদ অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত যাতে তার থেকে দূর হয়ে যায় সেই কামনা করা। এর পাশাপাশি আরেকটি স্বভাবের নাম হচ্ছে 'গিবতা'। গিবতা অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত নিজের জন্যও কামনা করা। এটা দূষণীয় নয়, যদি তার থেকে তা হাতছাড়া হওয়ার কামনা না থাকে। সেরকম কামনা থাকলে তখন আর এটা গিবতা নয়; বরং হাসাদ হয়ে যাবে। কখনও কখনও গিবতা অর্থেও হাসাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন এক হাদীছে আছে,
لاَ حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘হাসাদ বৈধ নয়, তবে দুই ব্যক্তি ব্যতিক্রম (অর্থাৎ, তাদের প্রতি হাসাদ করা যায়)। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআন দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে তিলাওয়াত করে। দ্বিতীয়ত ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা অর্থ- সম্পদ দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।[২]
হাসাদ করা অতি কঠিন পাপ। এর দ্বারা নিজের নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
‘হাসাদ পরিহার করো। কেননা হাসাদ নেকীসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন কাষ্ঠ খেয়ে ফেলে।[৩]
হাসাদ অতি নিকৃষ্ট খাসলাত। হাসাদকারীর যেন আল্লাহর প্রতি আপত্তি— কেন তিনি অমুক ভালো জিনিসটি তাকে না দিয়ে আরেকজনকে দিলেন। সে কেবল আপত্তি করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং সে ভালো জিনিসটি তার থেকে বিলুপ্ত করার ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালায়। যার প্রতি তার হাসাদ সে তো তার মুসলিম ভাই। সে হিসেবে কর্তব্য ছিল তার প্রাপ্তিতে খুশি হওয়া এবং তার জন্য তা স্থায়ী হোক সেই কামনা করা। ঈমানের দাবি হল নিজের জন্য যা ভালোবাসা হয়ে থাকে, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসতে হবে। কিন্তু এ কেমন লোক, যে ভালো জিনিসটি নিজের জন্য তো পসন্দ করছে, কিন্তু মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ করছে না; বরং তার তা অর্জিত হওয়ায় অন্তর্জালা বোধ করছে? এক তো সে মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ না করে তার হক নষ্ট করছে, অধিকন্তু তার প্রাপ্তিতে অহেতুক অন্তর্দাহে ভুগছে। যদি তা বিলোপেরও চেষ্টা করে, তবে তা নিতান্তই পণ্ডশ্রম। এতকিছু কদর্যতা যে খাসলাতের ভেতর, তা কতইনা নিকৃষ্ট !
এ নিকৃষ্ট খাসলাত ব্যক্তির শান্তিই নষ্ট করে না; পরিবার ও সমাজকেও অশান্ত করে। এর ফলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দল হয়, পরিবারে পরিবারে কলহ দেখা দেয় এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতি হুমকিতে পড়ে যায়।
হাসাদের কদর্যতা
মূলত এটা ইবলীসের খাসলাত। হযরত আদম আলাইহি সালামের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে তার অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। সেই হিংসার বশবর্তীতে সে আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করে। ফিরিশতাগণ সিজদা করলেন, কিন্তু সে সিজদা করল না। কেবল সিজদা না করেই ক্ষান্ত হল না; বরং সে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও সন্তানদের চিরশত্রুতে পরিণত হয়ে গেল। এমনই হয় হাসাদের কুফল। পেয়েছিল কাবীলকে। এর বশবর্তীতে সে তার ভাই হাবীলকে হত্যা করল। এভাবে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ডের পেছনে এ বদগুণটি সক্রিয় ছিল। হাসাদের কারণেই হযরত ইয়ুসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ইতিহাসে এরকম হাজারও পাপ ও বড় বড় অঘটন হাসাদের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল।
হাসাদ এমনই এক মন্দ স্বভাব, যা মানুষের জন্য সত্য গ্রহণের পক্ষে বাধা হয়। এমনকি ঈমান আনা থেকেও বঞ্চিত হয়। ইহুদীরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনেনি এই ঈর্ষার কারণে যে, তাঁকে কেন আরবদের মধ্যে পাঠানো হল । কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ
‘নাকি তারা এই কারণে মানুষের প্রতি ঈর্ষা করে যে, তিনি তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ দান করেন (কেন?)। সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৪
ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তারা যে কেবল নিজেরাই ঈমান আনা থেকে বিরত থেকেছে তাই নয়; বরং তাদের একান্ত কামনা ছিল যারা ঈমান এনেছে তারাও ঈমান ত্যাগ করে কুফরীর পথে ফিরে যাক। অথচ তারা জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য নবী, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআনও সত্য এবং তিনি যে দীনের প্রতি দাওয়াত দেন তাও সত্য দীন। আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন-
وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের অনেকেই তাদের কাছে সত্য পরিস্ফুট হওয়ার পরও তাদের অন্তরের ঈর্ষাবশত কামনা করে, যদি তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে দিতে পারত! সূরা বাকারা (২), আয়াত ১০৯
হাসাদের মন্দত্ব বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা হাসাদকারীর অনিষ্ট থেকে বাচার জন্য তাঁর আশ্রয় গ্রহণের হুকুম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
এবং (আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি) হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে। সূরা ফালাক (১১৩), আয়াত ৫
কাজেই হাজারও পাপের উদ্বোধক এহেন মন্দ খাসলাত দমন ও পরিহার করা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।
হাসাদের প্রকারভেদ ও গিবতা
হাসাদ কয়েক প্রকার-
ক. অন্যের প্রাপ্তি অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি তার থেকে তা বিলুপ্ত করে নিজে হস্তগত করা বা নিজ পসন্দের কাউকে পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। এটা হাসাদের নিকৃষ্টতম প্রকার এবং অতি কঠিন পাপ ।
খ. অন্যের ভালো কিছু দেখলে ভালো না লাগা, তবে তার থেকে তা বিলুপ্তির কামনা ও চেষ্টাও না করা। এটা পাপ নয় বটে, তবে এ স্বভাবটি ভালো নয়। এর সংশোধন জরুরি। সংশোধনের চেষ্টা না করলে তা বাড়তে থাকার আশঙ্কা থাকে। একপর্যায়ে অন্যের থেকে নিআমত বিলুপ্তির চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়াও অসম্ভব নয় ।
গ. অন্যের নিআমত দেখে অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি যদি তার বিলুপ্তি কামনা করা হয় কিন্তু বিলুপ্তির চেষ্টা না করা হয়, তবে এটা প্রথম প্রকারের মত নিকৃষ্টতম না হলেও নিন্দনীয় অবশ্যই। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলুপ্তি কামনা করা অন্তরের একটি মন্দ কাজ। এটা একপর্যায়ের পাপও বটে। কাজেই অন্তর থেকে এ কামনা দূর করার সাধনা ও মুজাহাদা চালানো অতি জরুরি, নচেৎ একপর্যায়ে তা কামনার স্তর পার হয়ে বাহ্যিক কর্মে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যের যে নিআমতের কারণে হাসাদ দেখা দেয় তা যদি দীনী নিআমত হয়ে থাকে, তবে তো সে ক্ষেত্রে হাসাদ জায়েয না হলেও গিবতা জায়েয, যেমন অন্যের সুন্দর নামায দেখে নিজের জন্যও সেরকম নামাযের তাওফীক কামনা করা, কোনও বড় আলেম দেখে নিজের জন্যও তার মত ইলম কামনা করা, আল্লাহর পথে অন্যের দান-খয়রাত দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ দান-খয়রাতের আগ্রহ কামনা করা, অন্যের দীনী মেহনত-মুজাহাদা দেখে নিজের জন্যও তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করা ইত্যাদি। বরং এসকল ক্ষেত্রে গিবতা করাই কাম্য, যেমন পূর্বোক্ত হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও শহীদদের ফযীলতের কারণে নিজের জন্য শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।
বিষয়টা যদি দুনিয়াবী হয় যেমন, অন্যের ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা- পদমর্যাদা ইত্যাদি, তবে এক্ষেত্রে হাসাদ তো জয়ের নয়ই, গিবতা করাও পসন্দনীয় নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ
‘যা দ্বারা আমি তোমাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তার আকাঙ্ক্ষা করো না।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩২
ঈমানদারদের দৃষ্টি থাকবে কেবলই আখেরাতের মুক্তি ও সফলতার প্রতি দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নয়। তাদের কাম্যবস্তু তো কেবলই আখেরাতের পুরস্কার। কারুনের ঘটনায় কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80)
‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল । যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই । সূরা কাসাস (২৮), আয়াত নং ৭৯, ৮০
বস্তুত দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই। আখেরাতের শ্রেষ্ঠত্বই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব। তা অর্জনের জন্য কেবল গিবতাই নয়; অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা চাই। আল্লাহ তাআলার হুকুম হচ্ছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ
‘প্রতিযোগীদের উচিত এরই জন্য প্রতিযোগিতা করা। সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত নং ২৬
সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত হাসাদ পরিত্যাগ করা। যে ব্যক্তি হাসাদ দমন করতে পারে, সেই জান্নাতের উপযুক্ততা লাভ করে। জান্নাতবাসীর বৈশিষ্ট্য হাসাদের মলিনতা থেকে মুক্ত থাকা। ইরশাদ হয়েছে-
وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ
‘আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ অপসারণ করি। তারা ভাই-ভাইরূপে মুখোমুখি হয়ে উঁচু আসনে আসীন হবে। সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৪৭
জনৈক আনসারী সাহাবীর ঘটনা
এ প্রসঙ্গে জনৈক আনসারী সাহাবী রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বসা। তখন তিনি ইরশাদ করেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এরই মধ্যে জনৈক আনসারী ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তার দাড়ি থেকে ওযূর পানি ঝরছিল। তার জুতা বা’হাতে ধরা। এর পরের দিনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এদিনও সেই আনসারী ব্যক্তি একই অবস্থায় হাজির হলেন। পরের দিনও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই কথা বললেন এবং সেই সাহাবীও একইভাবে উপস্থিত হলেন। এদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে যাওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. ওই আনসারী সাহাবীর অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি কসম করেছি তিন রাত আমার বাবার কাছে যাব না। আপনি কি এ তিন রাত আমাকে আশ্রয় দেবেন, যাতে আমি আমার কসম পূর্ণ করে নিতে পারি? তিনি তাতে সম্মত হলেন। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. তিন রাত তাঁর কাছে থাকলেন। তিনি জানান, এ তিন রাতে তিনি তাঁকে জাগতে দেখেননি। শুধু এতটুকু হয়েছে যে, যখনই বিছানায় পাশ ফিরেছেন, আল্লাহর যিকির করেছেন ও তাকবীর বলেছেন। ফজরের সময় হলে তিনি উঠে ওযূ করেছেন (এবং ফজরের নামায আদায় করেছেন)। আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, অতিরিক্ত শুধু এতটুকুই ছিল যে, তিন দিন আমি তাঁকে ভালো ছাড়া কোনও মন্দ কথা বলতে শুনিনি। তিন রাত শেষ হলে আমার কাছে তাঁর আমল তুচ্ছ মনে হল। কাজেই আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! প্রকৃতপক্ষে আমার ও আমার পিতার মধ্যে কোনও রাগ ও মনোমালিন্যের ঘটনা ঘটেনি। আমি কেবল আপনার আমল দেখার জন্য আপনার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আপনাকে বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না। তাহলে আপনার এমন কী ব্যাপার আছে, যে কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা বললেন? তিনি বললেন, ব্যাপার কিছুই নেই, বাস তুমি যা দেখেছ তাই। আব্দুল্লাহ রাযি বলেন, আমি ফিরে চললাম। কিছুদূর আসার পর তিনি আমাকে ডাকলেন, তারপর বললেন, তুমি যা দেখলে এর বেশি কোনও ব্যাপার নেই, তবে এতটুকু কথা যে, আমি আমার অন্তরে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যা দিয়েছেন সে কারণে তার প্রতি ঈর্ষা বোধ করি না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, রহস্য এই-ই, যা আপনাকে ওই স্তরে পৌঁছিয়েছে। আর এটাই সেই গুণ, যা আমরা অর্জন করতে পারছি না।[৪]
হাসাদ দমনের উপায়
হাসাদ দমনের উপায় দু'টি। একটি জ্ঞানমূলক, অপরটি কর্মমূলক। জ্ঞানমূলক উপায় হচ্ছে হাসাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তা করা। যেমন, এটা ব্যক্তির শান্তি নষ্ট করে, পরিবারে কলহ সৃষ্টি করে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করে ইত্যাদি। এমনিভাবে এটা এক চরিত্র-বিধ্বংসী খাসলাত। এর কারণে আল্লাহর কাছে নিজ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এমনকি একজন হিংসুক হিসেবে সমাজচোখেও ঘৃণ্য সাব্যস্ত হতে হয়। তাছাড়া এ খাসলাতের কারণে আরও নানারকম বড় বড় গুনাহ হয়ে যায়। এর কারণে নিজ জবানের অপব্যবহার করা হয়, বিভিন্ন কুচিন্তা করা হয় এবং অন্যের জান-মালের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন অপতৎপরতা চালানো হয়। ফলে আমলনামায় গুনাহের তালিকা বাড়তেই থাকে। এর কারণে অন্যের উপর যে জুলুম ও অবিচার করা হয় আখেরাতে তার বিনিময়ে নিজের অর্জিত নেকী দিয়ে দিতে হবে। তাতে পুরোপুরি বদলা না হলে মজলুমের গুনাহ নিজের কাঁধে চেপে যাবে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যে স্বভাবের কারণে এতসব ক্ষতি হয় আমি কেন তা বদলাব না? নিয়মিত এ ধ্যান ও চিন্তা করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ কিছু না কিছু পরিবর্তন আসবেই।
কর্মমূলক উপায় হল, যার প্রতি হাসাদ ও ঈর্ষা দেখা দেয় মনের সঙ্গে লড়াই করে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে থাকা। কৃত্রিমভাবে হলেও তাকে দেখে মুখে হাসি ফোটানো ও তাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো। মাঝেমধ্যে তাকে হাদিয়া তোহফা দেওয়া। তাকে দাওয়াত করে খাওয়ানো ও তার দাওয়াতে অংশগ্রহণ করা। তার কল্যাণের জন্য আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা। বিশেষত তার যে নেআমতের কারণে হাসাদ হয় তা যেন তার থেকে বিলুপ্ত না হয়, বরং স্থায়ীভাবে থাকে সে দোয়াও করা। সেই সঙ্গে একান্তমনে আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা যেন তিনি অন্তর থেকে এ মন্দ খাসলাতটি দূর করে দেন। আল্লাহ তাআ'লা আমাদের অন্তর থেকে এটি দূর করেই দিন-আমীন।
পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণের অবৈধতা
এমনিভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও একটি মন্দ স্বভাব। এটাও হারাম ও কঠিন পাপ। ইসলাম যেসকল মন্দ স্বভাব পরিহারের তাগিদ করেছে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও তার একটি। যেমন আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تباغضوا 'তোমরা ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। تباغضوا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি بغض থেকে। এর অর্থ ঘৃণা করা। কাউকে ঘৃণা করা যদি আল্লাহ তাআলার জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তাআলার জন্য ঘৃণা করার অর্থ কেউ যদি আল্লাহ তাআলার দীন ও শরীআতের বিরোধিতা করে, তবে সে বিরুদ্ধাচরণের জন্য তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা। এটা ঈমানের অঙ্গ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্য দান করা হতে বিরত থাকে, সে তার ঈমান পরিপূর্ণ করল।[৭]
কিন্তু ঘৃণা করা যদি আল্লাহর জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি হল এক মুসলিম অপর মুসলিমকে ভালোবাসবে, ব্যক্তিগত কোনও কারণে বা পার্থিব কোনও স্বার্থে তাকে ঘৃণা করবে না। এমনকি দীনী বিষয়েও যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে শরীআতবিরোধিতা প্রমাণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘৃণার কোনও সুযোগ নেই। কাজেই মাযহাবী মতভেদের ভিত্তিতে কাউকে ঘৃণা করা যাবে না। কেননা বিপরীত মাযহাবও কুরআন-সুন্নাহ'র ভিত্তিতেই গঠিত। এক পক্ষের কাছে যেমন দলীল আছে, তেমনি দলীল অন্য পক্ষের কাছেও আছে। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবকে শরীআতবিরোধী ঠাওরানো আর এর ভিত্তিতে তার অনুসারীকে ঘৃণার চোখে দেখা নিতান্তই ভুল; বরং এটা নিষিদ্ধ এর অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে সকলের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। ইদানীং বিভিন্ন মহলকে এ জাতীয় ঘৃণা বিস্তারে তৎপর দেখা যায়। তাদের উচিত নিজেদের কর্মপন্থা বিচার- বিশ্লেষণ করা।
পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করা ও একের থেকে অন্যের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা
আরও একটি মন্দ স্বভাব হচ্ছে একের থেকে অন্যের বিমুখ হওয়া, পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করে দেওয়া। ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিতকারী ইসলাম এ জাতীয় আচরণ কখনও অনুমোদন করে না। ইসলামে এটা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ।
যেমন হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تدابروا ‘তোমরা একের থেকে অন্যে মুখ ফিরিয়ে নিও না'।تدابروا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি الدبر থেকে। এর অর্থ নিতম্ব ও পেছন দিক। কেউ যখন কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হয় ও তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে না চায়, তখন তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ও তার দিকে নিতম্ব বা পেছন ফিরিয়ে দেয়। কাজেই মুখ ফেরানো ও পেছন দিক ঘুরিয়ে দেওয়ার দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য দেখা-সাক্ষাত ও মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেওয়া।
দুই মুসলিম পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করা জায়েয নয়। এটা কঠিন পাপ। কোনও কারণে পরস্পর মনোমালিন্য হলে যথাসম্ভব শীঘ্র মিটমাট করে ফেলা চাই। সে মনোমালিন্যকে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। ঘটনাক্রমে অবস্থা সে পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই মিলেমিশে যেতে হবে। তিন দিনের বেশি দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা সম্পূর্ণ হারাম। হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقِ ثَلَاثٍ، يَلْتَقِيَانِ فَيَصُدُّ هَذَا وَ يَصُدُّ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِي يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
‘কোনও মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি পরিত্যাগ করা বৈধ নয় যে, পরস্পর সাক্ষাত হলে এ ওকে উপেক্ষা করবে এবং সে একে উপেক্ষা করবে। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে প্রথম সালাম দেয়।[৮]
হযরত আবূ খিরাশ সুলামী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ هَجَرَ أَخَاهُ سَنَةٌ فَهُوَ كَسَفْكِ دَمِهِ
‘কেউ তার ভাইকে এক বছর পরিত্যাগ করে রাখলে তা তাকে হত্যা করার মত (অপরাধ)।[৯]
পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ করার এ অপরাধ কেবল তখনই, যখন তা দুনিয়াবী কারণে হয়। পক্ষান্তরে তা যদি হয় দীনী কোনও কারণে, তবে তা কেবল বৈধই নয়; ক্ষেত্রবিশেষ কাম্যও। যেমন কেউ যদি আকীদাগত কোনও বিদআতে লিপ্ত থাকে এবং বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে ফিরে না আসে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই শ্রেয়। এমনিভাবে সন্তান, ছাত্র বা নিজের অধীন কাউকে সংশোধনের উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা না হয়ে যায়। কেননা তাতে আরও বেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যে-কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় আন্তরিকতার স্পর্শ থাকা দরকার।
তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও
উপরের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দান করেন- وكونوا عباد الله اخوانا ‘আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে থাকো'। অর্থাৎ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে কাজ করতে নিষেধ করা হল, এগুলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ভ্রাতৃত্বের দাবি এসব কাজে লিপ্ত না হওয়া। কাজেই তোমরা যদি ভাই ভাই হয়ে থাক, তবে কিছুতেই তোমাদের দ্বারা এগুলো সংঘটিত হবে না। অথবা এর অর্থ- তোমরা যদি এসব কাজ বর্জন কর, তবে তোমাদের মধ্যে সত্যিকার ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তোমরা এগুলো পরিহার করে চলো।
বস্তুত ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি অত্যন্ত মূল্যবান। এটা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমতও বটে। আল্লাহ তাআলা সেই নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে ইরশাদ করেন-
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ। একটা সময় ছিল, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিলেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৩
ইসলামী ভ্রাতৃত্ব যখন আল্লাহ তাআলার এক বিরাট দান ও অতি বড় নিআমত, তাই এটা রক্ষা করাও অতি জরুরি। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা এটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কারও কোনও আচরণে দু'জনের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হলে অন্যদের কর্তব্য তাদের মধ্যে মিলমিশ করে দেওয়া, যাতে অসদ্ভাব স্থায়ী হতে না পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ
‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِم : لا يَظْلِمُهُ، وَلَا يَحْقِرُهُ، وَلَا يَخْذلُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِى مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِم عَلَى الْمُسْلِم حَرَامٌ، دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ গণ্য করে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয় না। তাকওয়া এখানে- তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথাটি তিনবার বললেন। কোনও ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। এক মুসলিমের সবকিছু অপর মুসলিমের প্রতি হারাম- তার রক্ত, তার সম্পদ ও তার ইজ্জত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পরস্পর হাসাদ করা নাজায়েজ ও কঠিন পাপ। এর থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
খ. পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখাসাক্ষাত বন্ধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয়দানকারীকে এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
গ. নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরূক রাখার প্রচেষ্ট অব্যাহত রাখা চাই। এর দ্বারা হিংসা বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকা যায়।
ঘ. ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা তা ক্ষুণ্ণ হয় তা পরিহার করে চলা অবশ্য কর্তব্য।
إِنَّمَا بُعِثْتُ لأتمم صالح الأخلاق
'আমাকে পাঠানো হয়েছে ভালো চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য।[১]
আখলাক-চরিত্রের কিছু আছে ভালো দিক, যাকে 'আখলাকে হামীদাহ' বলে। কিছু আছে মন্দ দিক, যাকে 'আখলাকে যামীমাহ' বা 'রাযীলাহ' বলে। সব মানুষের মধ্যেই উভয়প্রকার চরিত্রই নিহিত আছে। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য মন্দ চরিত্র দমন ও উত্তম চরিত্রের বিকাশ সাধনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন মুজাহাদা ও সাধনা চালানো। কোন কোন চরিত্র মন্দ এবং কোনগুলো ভালো, তার অনেকটাই আল্লাহপ্রদত্ত বোধ-বুদ্ধি দ্বারা নিরূপণ করা যায়। আবার কোনও কোনওটি বোঝার জন্য আসমানী শিক্ষার প্রয়োজন হয়। তবে মহান ইসলাম বিষয়টাকে কেবল মানববৃদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়নি; বরং সুনির্দিষ্টভাবে প্রত্যেকটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। যেসব গুণ ভালো, তা অর্জনের আদেশ করেছে এবং তার ফযীলত ও মাহাত্ম্য বর্ণনাপূর্বক তা অর্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। অপরদিকে যেগুলো মন্দ, তা বর্জন ও দমনের হুকুম দিয়েছে এবং তার ক্ষতি ও কদর্যতার উল্লেখপূর্বক তা পরিহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। আলোচ্য হাদীছে বিশেষ কয়েকটি মন্দ চরিত্রের উল্লেখ আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ কেউ যাতে সেসব চরিত্রপ্রসূত আচরণ কারও সঙ্গে না করে, সে ব্যাপারে তাগিদ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে হাসাদ। তিনি বলেন-
একে অন্যকে হাসাদ না করা
لا تحاسدوا 'তোমরা একে অন্যের প্রতি হাসাদ করো না'। হাসাদ অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত যাতে তার থেকে দূর হয়ে যায় সেই কামনা করা। এর পাশাপাশি আরেকটি স্বভাবের নাম হচ্ছে 'গিবতা'। গিবতা অর্থ অন্যের প্রাপ্ত নিআমত নিজের জন্যও কামনা করা। এটা দূষণীয় নয়, যদি তার থেকে তা হাতছাড়া হওয়ার কামনা না থাকে। সেরকম কামনা থাকলে তখন আর এটা গিবতা নয়; বরং হাসাদ হয়ে যাবে। কখনও কখনও গিবতা অর্থেও হাসাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন এক হাদীছে আছে,
لاَ حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ القُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
‘হাসাদ বৈধ নয়, তবে দুই ব্যক্তি ব্যতিক্রম (অর্থাৎ, তাদের প্রতি হাসাদ করা যায়)। এক ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআন দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে তিলাওয়াত করে। দ্বিতীয়ত ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা অর্থ- সম্পদ দিয়েছেন আর সে তা দিবারাত্রির মুহূর্তগুলোতে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।[২]
হাসাদ করা অতি কঠিন পাপ। এর দ্বারা নিজের নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়। হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ ، فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
‘হাসাদ পরিহার করো। কেননা হাসাদ নেকীসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন কাষ্ঠ খেয়ে ফেলে।[৩]
হাসাদ অতি নিকৃষ্ট খাসলাত। হাসাদকারীর যেন আল্লাহর প্রতি আপত্তি— কেন তিনি অমুক ভালো জিনিসটি তাকে না দিয়ে আরেকজনকে দিলেন। সে কেবল আপত্তি করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং সে ভালো জিনিসটি তার থেকে বিলুপ্ত করার ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালায়। যার প্রতি তার হাসাদ সে তো তার মুসলিম ভাই। সে হিসেবে কর্তব্য ছিল তার প্রাপ্তিতে খুশি হওয়া এবং তার জন্য তা স্থায়ী হোক সেই কামনা করা। ঈমানের দাবি হল নিজের জন্য যা ভালোবাসা হয়ে থাকে, অন্যের জন্যও তা ভালোবাসতে হবে। কিন্তু এ কেমন লোক, যে ভালো জিনিসটি নিজের জন্য তো পসন্দ করছে, কিন্তু মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ করছে না; বরং তার তা অর্জিত হওয়ায় অন্তর্জালা বোধ করছে? এক তো সে মুসলিম ভাইয়ের জন্য তা পসন্দ না করে তার হক নষ্ট করছে, অধিকন্তু তার প্রাপ্তিতে অহেতুক অন্তর্দাহে ভুগছে। যদি তা বিলোপেরও চেষ্টা করে, তবে তা নিতান্তই পণ্ডশ্রম। এতকিছু কদর্যতা যে খাসলাতের ভেতর, তা কতইনা নিকৃষ্ট !
এ নিকৃষ্ট খাসলাত ব্যক্তির শান্তিই নষ্ট করে না; পরিবার ও সমাজকেও অশান্ত করে। এর ফলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দল হয়, পরিবারে পরিবারে কলহ দেখা দেয় এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতি হুমকিতে পড়ে যায়।
হাসাদের কদর্যতা
মূলত এটা ইবলীসের খাসলাত। হযরত আদম আলাইহি সালামের শ্রেষ্ঠত্ব দেখে তার অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। সেই হিংসার বশবর্তীতে সে আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করে। ফিরিশতাগণ সিজদা করলেন, কিন্তু সে সিজদা করল না। কেবল সিজদা না করেই ক্ষান্ত হল না; বরং সে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও সন্তানদের চিরশত্রুতে পরিণত হয়ে গেল। এমনই হয় হাসাদের কুফল। পেয়েছিল কাবীলকে। এর বশবর্তীতে সে তার ভাই হাবীলকে হত্যা করল। এভাবে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ডের পেছনে এ বদগুণটি সক্রিয় ছিল। হাসাদের কারণেই হযরত ইয়ুসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ইতিহাসে এরকম হাজারও পাপ ও বড় বড় অঘটন হাসাদের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল।
হাসাদ এমনই এক মন্দ স্বভাব, যা মানুষের জন্য সত্য গ্রহণের পক্ষে বাধা হয়। এমনকি ঈমান আনা থেকেও বঞ্চিত হয়। ইহুদীরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনেনি এই ঈর্ষার কারণে যে, তাঁকে কেন আরবদের মধ্যে পাঠানো হল । কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ
‘নাকি তারা এই কারণে মানুষের প্রতি ঈর্ষা করে যে, তিনি তাদেরকে নিজ অনুগ্রহ দান করেন (কেন?)। সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৪
ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তারা যে কেবল নিজেরাই ঈমান আনা থেকে বিরত থেকেছে তাই নয়; বরং তাদের একান্ত কামনা ছিল যারা ঈমান এনেছে তারাও ঈমান ত্যাগ করে কুফরীর পথে ফিরে যাক। অথচ তারা জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য নবী, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআনও সত্য এবং তিনি যে দীনের প্রতি দাওয়াত দেন তাও সত্য দীন। আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন-
وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের অনেকেই তাদের কাছে সত্য পরিস্ফুট হওয়ার পরও তাদের অন্তরের ঈর্ষাবশত কামনা করে, যদি তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে দিতে পারত! সূরা বাকারা (২), আয়াত ১০৯
হাসাদের মন্দত্ব বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা হাসাদকারীর অনিষ্ট থেকে বাচার জন্য তাঁর আশ্রয় গ্রহণের হুকুম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
এবং (আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি) হিংসুকের অনিষ্ট হতে, যখন সে হিংসা করে। সূরা ফালাক (১১৩), আয়াত ৫
কাজেই হাজারও পাপের উদ্বোধক এহেন মন্দ খাসলাত দমন ও পরিহার করা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।
হাসাদের প্রকারভেদ ও গিবতা
হাসাদ কয়েক প্রকার-
ক. অন্যের প্রাপ্তি অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি তার থেকে তা বিলুপ্ত করে নিজে হস্তগত করা বা নিজ পসন্দের কাউকে পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। এটা হাসাদের নিকৃষ্টতম প্রকার এবং অতি কঠিন পাপ ।
খ. অন্যের ভালো কিছু দেখলে ভালো না লাগা, তবে তার থেকে তা বিলুপ্তির কামনা ও চেষ্টাও না করা। এটা পাপ নয় বটে, তবে এ স্বভাবটি ভালো নয়। এর সংশোধন জরুরি। সংশোধনের চেষ্টা না করলে তা বাড়তে থাকার আশঙ্কা থাকে। একপর্যায়ে অন্যের থেকে নিআমত বিলুপ্তির চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়াও অসম্ভব নয় ।
গ. অন্যের নিআমত দেখে অসহ্য বোধ হওয়ার পাশাপাশি যদি তার বিলুপ্তি কামনা করা হয় কিন্তু বিলুপ্তির চেষ্টা না করা হয়, তবে এটা প্রথম প্রকারের মত নিকৃষ্টতম না হলেও নিন্দনীয় অবশ্যই। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলুপ্তি কামনা করা অন্তরের একটি মন্দ কাজ। এটা একপর্যায়ের পাপও বটে। কাজেই অন্তর থেকে এ কামনা দূর করার সাধনা ও মুজাহাদা চালানো অতি জরুরি, নচেৎ একপর্যায়ে তা কামনার স্তর পার হয়ে বাহ্যিক কর্মে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অন্যের যে নিআমতের কারণে হাসাদ দেখা দেয় তা যদি দীনী নিআমত হয়ে থাকে, তবে তো সে ক্ষেত্রে হাসাদ জায়েয না হলেও গিবতা জায়েয, যেমন অন্যের সুন্দর নামায দেখে নিজের জন্যও সেরকম নামাযের তাওফীক কামনা করা, কোনও বড় আলেম দেখে নিজের জন্যও তার মত ইলম কামনা করা, আল্লাহর পথে অন্যের দান-খয়রাত দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ দান-খয়রাতের আগ্রহ কামনা করা, অন্যের দীনী মেহনত-মুজাহাদা দেখে নিজের জন্যও তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করা ইত্যাদি। বরং এসকল ক্ষেত্রে গিবতা করাই কাম্য, যেমন পূর্বোক্ত হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও শহীদদের ফযীলতের কারণে নিজের জন্য শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।
বিষয়টা যদি দুনিয়াবী হয় যেমন, অন্যের ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা- পদমর্যাদা ইত্যাদি, তবে এক্ষেত্রে হাসাদ তো জয়ের নয়ই, গিবতা করাও পসন্দনীয় নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ
‘যা দ্বারা আমি তোমাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, তার আকাঙ্ক্ষা করো না।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩২
ঈমানদারদের দৃষ্টি থাকবে কেবলই আখেরাতের মুক্তি ও সফলতার প্রতি দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নয়। তাদের কাম্যবস্তু তো কেবলই আখেরাতের পুরস্কার। কারুনের ঘটনায় কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে-
فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ فِي زِينَتِهِ قَالَ الَّذِينَ يُرِيدُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَالَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَا أُوتِيَ قَارُونُ إِنَّهُ لَذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (79) وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللَّهِ خَيْرٌ لِمَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا وَلَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الصَّابِرُونَ (80)
‘অতঃপর (একদিন) সে তার সম্প্রদায়ের সামনে নিজ জাঁকজমকের সাথে বের হয়ে আসল । যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা (তা দেখে) বলতে লাগল, আহা! কারুনকে যা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ যদি আমাদেরও থাকত! বস্তুত সে মহা ভাগ্যবান। আর যারা (আল্লাহর পক্ষ হতে) জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! (তোমরা এরূপ কথা বলছ, অথচ) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ছাওয়াব কতইনা শ্রেয়! আর তা লাভ করে কেবল ধৈর্যশীলগণই । সূরা কাসাস (২৮), আয়াত নং ৭৯, ৮০
বস্তুত দুনিয়াবী শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই। আখেরাতের শ্রেষ্ঠত্বই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব। তা অর্জনের জন্য কেবল গিবতাই নয়; অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা চাই। আল্লাহ তাআলার হুকুম হচ্ছে-
وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ
‘প্রতিযোগীদের উচিত এরই জন্য প্রতিযোগিতা করা। সূরা মুতাফফীফীন (৮৩), আয়াত নং ২৬
সে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত হাসাদ পরিত্যাগ করা। যে ব্যক্তি হাসাদ দমন করতে পারে, সেই জান্নাতের উপযুক্ততা লাভ করে। জান্নাতবাসীর বৈশিষ্ট্য হাসাদের মলিনতা থেকে মুক্ত থাকা। ইরশাদ হয়েছে-
وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ
‘আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ অপসারণ করি। তারা ভাই-ভাইরূপে মুখোমুখি হয়ে উঁচু আসনে আসীন হবে। সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৪৭
জনৈক আনসারী সাহাবীর ঘটনা
এ প্রসঙ্গে জনৈক আনসারী সাহাবী রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বসা। তখন তিনি ইরশাদ করেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এরই মধ্যে জনৈক আনসারী ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তার দাড়ি থেকে ওযূর পানি ঝরছিল। তার জুতা বা’হাতে ধরা। এর পরের দিনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এখনই তোমাদের সামনে এক জান্নাতী ব্যক্তির আগমন হবে। এদিনও সেই আনসারী ব্যক্তি একই অবস্থায় হাজির হলেন। পরের দিনও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই কথা বললেন এবং সেই সাহাবীও একইভাবে উপস্থিত হলেন। এদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে যাওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. ওই আনসারী সাহাবীর অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি কসম করেছি তিন রাত আমার বাবার কাছে যাব না। আপনি কি এ তিন রাত আমাকে আশ্রয় দেবেন, যাতে আমি আমার কসম পূর্ণ করে নিতে পারি? তিনি তাতে সম্মত হলেন। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. তিন রাত তাঁর কাছে থাকলেন। তিনি জানান, এ তিন রাতে তিনি তাঁকে জাগতে দেখেননি। শুধু এতটুকু হয়েছে যে, যখনই বিছানায় পাশ ফিরেছেন, আল্লাহর যিকির করেছেন ও তাকবীর বলেছেন। ফজরের সময় হলে তিনি উঠে ওযূ করেছেন (এবং ফজরের নামায আদায় করেছেন)। আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, অতিরিক্ত শুধু এতটুকুই ছিল যে, তিন দিন আমি তাঁকে ভালো ছাড়া কোনও মন্দ কথা বলতে শুনিনি। তিন রাত শেষ হলে আমার কাছে তাঁর আমল তুচ্ছ মনে হল। কাজেই আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! প্রকৃতপক্ষে আমার ও আমার পিতার মধ্যে কোনও রাগ ও মনোমালিন্যের ঘটনা ঘটেনি। আমি কেবল আপনার আমল দেখার জন্য আপনার সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আপনাকে বেশি কিছু আমল করতে দেখলাম না। তাহলে আপনার এমন কী ব্যাপার আছে, যে কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা বললেন? তিনি বললেন, ব্যাপার কিছুই নেই, বাস তুমি যা দেখেছ তাই। আব্দুল্লাহ রাযি বলেন, আমি ফিরে চললাম। কিছুদূর আসার পর তিনি আমাকে ডাকলেন, তারপর বললেন, তুমি যা দেখলে এর বেশি কোনও ব্যাপার নেই, তবে এতটুকু কথা যে, আমি আমার অন্তরে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যা দিয়েছেন সে কারণে তার প্রতি ঈর্ষা বোধ করি না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. বলেন, রহস্য এই-ই, যা আপনাকে ওই স্তরে পৌঁছিয়েছে। আর এটাই সেই গুণ, যা আমরা অর্জন করতে পারছি না।[৪]
হাসাদ দমনের উপায়
হাসাদ দমনের উপায় দু'টি। একটি জ্ঞানমূলক, অপরটি কর্মমূলক। জ্ঞানমূলক উপায় হচ্ছে হাসাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তা করা। যেমন, এটা ব্যক্তির শান্তি নষ্ট করে, পরিবারে কলহ সৃষ্টি করে, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করে ইত্যাদি। এমনিভাবে এটা এক চরিত্র-বিধ্বংসী খাসলাত। এর কারণে আল্লাহর কাছে নিজ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এমনকি একজন হিংসুক হিসেবে সমাজচোখেও ঘৃণ্য সাব্যস্ত হতে হয়। তাছাড়া এ খাসলাতের কারণে আরও নানারকম বড় বড় গুনাহ হয়ে যায়। এর কারণে নিজ জবানের অপব্যবহার করা হয়, বিভিন্ন কুচিন্তা করা হয় এবং অন্যের জান-মালের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন অপতৎপরতা চালানো হয়। ফলে আমলনামায় গুনাহের তালিকা বাড়তেই থাকে। এর কারণে অন্যের উপর যে জুলুম ও অবিচার করা হয় আখেরাতে তার বিনিময়ে নিজের অর্জিত নেকী দিয়ে দিতে হবে। তাতে পুরোপুরি বদলা না হলে মজলুমের গুনাহ নিজের কাঁধে চেপে যাবে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যে স্বভাবের কারণে এতসব ক্ষতি হয় আমি কেন তা বদলাব না? নিয়মিত এ ধ্যান ও চিন্তা করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ কিছু না কিছু পরিবর্তন আসবেই।
কর্মমূলক উপায় হল, যার প্রতি হাসাদ ও ঈর্ষা দেখা দেয় মনের সঙ্গে লড়াই করে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে থাকা। কৃত্রিমভাবে হলেও তাকে দেখে মুখে হাসি ফোটানো ও তাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো। মাঝেমধ্যে তাকে হাদিয়া তোহফা দেওয়া। তাকে দাওয়াত করে খাওয়ানো ও তার দাওয়াতে অংশগ্রহণ করা। তার কল্যাণের জন্য আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা। বিশেষত তার যে নেআমতের কারণে হাসাদ হয় তা যেন তার থেকে বিলুপ্ত না হয়, বরং স্থায়ীভাবে থাকে সে দোয়াও করা। সেই সঙ্গে একান্তমনে আল্লাহ তাআ'লার কাছে দোয়া করা যেন তিনি অন্তর থেকে এ মন্দ খাসলাতটি দূর করে দেন। আল্লাহ তাআ'লা আমাদের অন্তর থেকে এটি দূর করেই দিন-আমীন।
পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণের অবৈধতা
এমনিভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও একটি মন্দ স্বভাব। এটাও হারাম ও কঠিন পাপ। ইসলাম যেসকল মন্দ স্বভাব পরিহারের তাগিদ করেছে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণও তার একটি। যেমন আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تباغضوا 'তোমরা ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। تباغضوا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি بغض থেকে। এর অর্থ ঘৃণা করা। কাউকে ঘৃণা করা যদি আল্লাহ তাআলার জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তাআলার জন্য ঘৃণা করার অর্থ কেউ যদি আল্লাহ তাআলার দীন ও শরীআতের বিরোধিতা করে, তবে সে বিরুদ্ধাচরণের জন্য তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা। এটা ঈমানের অঙ্গ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্য দান করা হতে বিরত থাকে, সে তার ঈমান পরিপূর্ণ করল।[৭]
কিন্তু ঘৃণা করা যদি আল্লাহর জন্য না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি হল এক মুসলিম অপর মুসলিমকে ভালোবাসবে, ব্যক্তিগত কোনও কারণে বা পার্থিব কোনও স্বার্থে তাকে ঘৃণা করবে না। এমনকি দীনী বিষয়েও যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে শরীআতবিরোধিতা প্রমাণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘৃণার কোনও সুযোগ নেই। কাজেই মাযহাবী মতভেদের ভিত্তিতে কাউকে ঘৃণা করা যাবে না। কেননা বিপরীত মাযহাবও কুরআন-সুন্নাহ'র ভিত্তিতেই গঠিত। এক পক্ষের কাছে যেমন দলীল আছে, তেমনি দলীল অন্য পক্ষের কাছেও আছে। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য মাযহাবকে শরীআতবিরোধী ঠাওরানো আর এর ভিত্তিতে তার অনুসারীকে ঘৃণার চোখে দেখা নিতান্তই ভুল; বরং এটা নিষিদ্ধ এর অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে সকলের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরি। ইদানীং বিভিন্ন মহলকে এ জাতীয় ঘৃণা বিস্তারে তৎপর দেখা যায়। তাদের উচিত নিজেদের কর্মপন্থা বিচার- বিশ্লেষণ করা।
পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করা ও একের থেকে অন্যের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা
আরও একটি মন্দ স্বভাব হচ্ছে একের থেকে অন্যের বিমুখ হওয়া, পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করে দেওয়া। ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিতকারী ইসলাম এ জাতীয় আচরণ কখনও অনুমোদন করে না। ইসলামে এটা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ।
যেমন হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ولا تدابروا ‘তোমরা একের থেকে অন্যে মুখ ফিরিয়ে নিও না'।تدابروا ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি الدبر থেকে। এর অর্থ নিতম্ব ও পেছন দিক। কেউ যখন কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হয় ও তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে না চায়, তখন তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ও তার দিকে নিতম্ব বা পেছন ফিরিয়ে দেয়। কাজেই মুখ ফেরানো ও পেছন দিক ঘুরিয়ে দেওয়ার দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য দেখা-সাক্ষাত ও মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেওয়া।
দুই মুসলিম পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করা জায়েয নয়। এটা কঠিন পাপ। কোনও কারণে পরস্পর মনোমালিন্য হলে যথাসম্ভব শীঘ্র মিটমাট করে ফেলা চাই। সে মনোমালিন্যকে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। ঘটনাক্রমে অবস্থা সে পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই মিলেমিশে যেতে হবে। তিন দিনের বেশি দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা সম্পূর্ণ হারাম। হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقِ ثَلَاثٍ، يَلْتَقِيَانِ فَيَصُدُّ هَذَا وَ يَصُدُّ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِي يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
‘কোনও মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি পরিত্যাগ করা বৈধ নয় যে, পরস্পর সাক্ষাত হলে এ ওকে উপেক্ষা করবে এবং সে একে উপেক্ষা করবে। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে প্রথম সালাম দেয়।[৮]
হযরত আবূ খিরাশ সুলামী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ هَجَرَ أَخَاهُ سَنَةٌ فَهُوَ كَسَفْكِ دَمِهِ
‘কেউ তার ভাইকে এক বছর পরিত্যাগ করে রাখলে তা তাকে হত্যা করার মত (অপরাধ)।[৯]
পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ করার এ অপরাধ কেবল তখনই, যখন তা দুনিয়াবী কারণে হয়। পক্ষান্তরে তা যদি হয় দীনী কোনও কারণে, তবে তা কেবল বৈধই নয়; ক্ষেত্রবিশেষ কাম্যও। যেমন কেউ যদি আকীদাগত কোনও বিদআতে লিপ্ত থাকে এবং বোঝানো সত্ত্বেও সে তা থেকে ফিরে না আসে, তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই শ্রেয়। এমনিভাবে সন্তান, ছাত্র বা নিজের অধীন কাউকে সংশোধনের উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা না হয়ে যায়। কেননা তাতে আরও বেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যে-কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় আন্তরিকতার স্পর্শ থাকা দরকার।
তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও
উপরের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দান করেন- وكونوا عباد الله اخوانا ‘আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ভাই ভাই হয়ে থাকো'। অর্থাৎ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে কাজ করতে নিষেধ করা হল, এগুলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ভ্রাতৃত্বের দাবি এসব কাজে লিপ্ত না হওয়া। কাজেই তোমরা যদি ভাই ভাই হয়ে থাক, তবে কিছুতেই তোমাদের দ্বারা এগুলো সংঘটিত হবে না। অথবা এর অর্থ- তোমরা যদি এসব কাজ বর্জন কর, তবে তোমাদের মধ্যে সত্যিকার ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তোমরা এগুলো পরিহার করে চলো।
বস্তুত ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি অত্যন্ত মূল্যবান। এটা আল্লাহ তাআলার এক বিরাট নিআমতও বটে। আল্লাহ তাআলা সেই নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে ইরশাদ করেন-
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا
‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ। একটা সময় ছিল, যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিলেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৩
ইসলামী ভ্রাতৃত্ব যখন আল্লাহ তাআলার এক বিরাট দান ও অতি বড় নিআমত, তাই এটা রক্ষা করাও অতি জরুরি। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা এটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছুতেই তাতে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কারও কোনও আচরণে দু'জনের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হলে অন্যদের কর্তব্য তাদের মধ্যে মিলমিশ করে দেওয়া, যাতে অসদ্ভাব স্থায়ী হতে না পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ
‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِم : لا يَظْلِمُهُ، وَلَا يَحْقِرُهُ، وَلَا يَخْذلُهُ، التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِى مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِم عَلَى الْمُسْلِم حَرَامٌ، دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে তুচ্ছ গণ্য করে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয় না। তাকওয়া এখানে- তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথাটি তিনবার বললেন। কোনও ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। এক মুসলিমের সবকিছু অপর মুসলিমের প্রতি হারাম- তার রক্ত, তার সম্পদ ও তার ইজ্জত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. পরস্পর হাসাদ করা নাজায়েজ ও কঠিন পাপ। এর থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
খ. পরস্পর মুখ দেখাদেখি ও দেখাসাক্ষাত বন্ধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয়দানকারীকে এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
গ. নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরূক রাখার প্রচেষ্ট অব্যাহত রাখা চাই। এর দ্বারা হিংসা বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকা যায়।
ঘ. ইসলামে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা তা ক্ষুণ্ণ হয় তা পরিহার করে চলা অবশ্য কর্তব্য।
