আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬০২২
৩১৯৫. প্রত্যেক সৎকাজই সাদ্কা।
৫৫৯৭। আদম (রাহঃ) ......... আবু মুসা আশআরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ প্রত্যেক মুসলমানেরই সাদ্কা করা আবশ্যক। উপস্থিত লোকজন বললঃ যদি সে সাদ্কা করার মত কিছু না পায়। তিনি বললেনঃ তাহলে সে নিজের হাতে কাজ করবে। এতে সে নিজেও উপকৃত হবে এবং সাদ্কা করবে। তারা বললঃ যদি সে এতেও সক্ষম না হয় অথবা বলেছেনঃ যদি সে না করে? তিনি বললেনঃ তাহলে সে যেন বিপদগ্রস্ত মাযলুমের সাহায্য করে। লোকেরা বললঃ সে যদি তা না করে? তিনি বললেনঃ তাহলে সে সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অথবা বলেছেন, নেকীর কাজের আদেশ দিবে। তারা বললঃ তাও যদি সে না করে? তিনি বললেনঃ তাহলে সে যেন মন্দকাজ থেকে বেঁচে থাকে। কারণ, এটাই তার জন্য সাদ্কা।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বিভিন্ন প্রকার সদাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে বান্দা যে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তা'আলার অসংখ্য নি'আমত ভোগ করছে, তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সদাকা করা কর্তব্য। পূর্বে এক হাদীছে গেছে প্রত্যেক ব্যক্তির শরীরে ৩৬০টি জোড়া আছে। সে সকল জোড়ার বিপরীতে প্রতিদিন ভোরে প্রত্যেকের উপর ৩৬০টি সদাকা জরুরি হয়। এক সাহাবী প্রশ্ন করেছিলেন, কার পক্ষে এতগুলো সদাকা করা সম্ভব? এর উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতি সহজ সহজ কিছু কাজের কথা বলেছেন, যার প্রত্যেকটি দ্বারা একেকটি সদাকা আদায় হয়ে যায়। এ হাদীছেও সংক্ষেপে সেই সদাকার আবশ্যিকতাই উল্লেখ করা হয়েছে।
আর্থিক সদাকা ও অর্থোপার্জনে উৎসাহদান
সাধারণত সদাকা বললে অর্থ-সম্পদের কথাই মনে আসে যে, সদাকা করতে টাকাপয়সার দরকার হয়। সে হিসেবেই এ হাদীছে এক সাহাবী প্রশ্ন করেছেন যে, সদাকা করার মত কোনও মাল যদি কারও কাছে না থাকে সে কী করবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেছেন, সে নিজ হাতে কাজ করবে। তাতে যা উপার্জন হয় তার একাংশ দ্বারা নিজ প্রয়োজন মেটাবে। আর বাকি অংশ সদাকা করবে।
এর দ্বারা অর্থোপার্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য নিজ পানাহার, পোশাক প্রভৃতি প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজে উপার্জনের চেষ্টা করা। ইসলাম কারও জন্য অন্যের গলগ্রহ হওয়া পছন্দ করে না। ভিক্ষাবৃত্তিরও নিন্দা করেছে। অন্যের কাছে হাত পাতাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। প্রত্যেকের কর্তব্য আপন প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা আপনিই করা। এর জন্য যার যে যোগ্যতা আছে সে যোগ্যতাকে কাজে লাগাবে। বেকার থাকাকে ইসলাম একদম পছন্দ করে না। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকর্ম, কৃষিকার্য ইত্যাদি বহু মাধ্যম আছে, যা দ্বারা অর্থোপার্জন করা যেতে পারে এবং এসব মাধ্যমে অর্থোপার্জনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে। এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছও। আলোচ্য হাদীছেও নিজ হাতে কাজ করে অর্থোপার্জনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, উপার্জিত অর্থের একাংশ আল্লাহর পথে সদাকা করবে। এর দ্বারা বোঝা গেল মু'মিনের উপার্জন কেবল নিজের জন্য নয়, এর সঙ্গে অন্যেরও সম্পর্ক আছে। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ উপার্জিত অর্থের একটা অংশ অন্যদের পেছনেও ব্যয় করা। ইসলাম সে ব্যয়কে সদাকা নামে অভিহিত করেছে। এটা করলে দুনিয়ায়ও আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায় এবং আখিরাতে মুক্তিলাভও সহজ হয়।
কায়িক শ্রমের সদাকা
অতঃপর সাহাবী প্রশ্ন করেন, যদি কারও পক্ষে কামাইরোযগার করে সদাকা করা সম্ভব না হয়, তখন সে কী করবে? অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে সদাকার ছাওয়াব অর্জনের উপায় কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অভাবগ্রস্ত ও দুস্থের সাহায্য করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোঝাচ্ছেন যে, সদাকার ছাওয়াব হাসিলের জন্য অর্থ ব্যয় করাই জরুরি নয়, এ ছাড়াও উপায় আছে। তা হচ্ছে কায়িক শ্রম বা অন্য কোনও উপায়ে মানুষের সাহায্য করা। যেমন, কাউকে তার বাহনে চড়িয়ে দেওয়া, কারও বাহনে মালপত্র তুলতে সাহায্য করা, কোনও অন্ধ ব্যক্তির হাত ধরে রাস্তা পারাপার করে দেওয়া, কারও মাথা থেকে ভার নামিয়ে দেওয়া, কোনও অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মোটকথা যে-কোনও উপায়ে মানুষের সাহায্য করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তা সদাকারূপে গণ্য হবে।
মানুষের যে-কোনওরকম সাহায্য-সহযোগিতা অভি বড় একটি নেক আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজ করতে উম্মতকে জোর উৎসাহ দিয়েছেন। আলোচ্য হাদীছটি ছাড়াও এ সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه
“আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।” সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪দ৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪২৭.
উপদেশ ও সুপরামর্শ দেওয়ার সদাকা
তৃতীয় পর্যায়ে সাহাবী প্রশ্ন করেন, যদি কায়িক শ্রম দ্বারা সদাকা দেওয়ার ক্ষমতাও কারও না থাকে, সে ক্ষেত্রে উপায় কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তখন সে সৎকাজের আদেশ করবে বা কোনও কল্যাণের পথ দেখাবে। সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। এটা ঈমানেরও এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এমনিভাবে মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানো ও ভালো কাজের পরামর্শ দেওয়া অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- الدال على الخير كفاعله “যে ব্যক্তি কাউকে কোনও ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ওই ভালো কাজটি যে করে তার সমান ছাওয়াব পাবে।" জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৩৬০: তবারানী, আল- মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯৪৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫২৯
কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহপ্রদত্ত অসংখ্য নি'আমতের শোকর আদায়ের জন্য না আর্থিক সদাকা দিতে পারে আর না শারীরিক শ্রম দ্বারা অন্যের উপকার করতে পারে, তার হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। নি'আমতের শোকর আদায়ার্থে তারও সদাকা দেওয়ার উপায় আছে। সে উপায় হচ্ছে নিজ বিদ্যাবুদ্ধির ব্যবহার। সে যেসব ভালো কথা জানে, যদি তা অন্যকে শেখায় কিংবা নিজ সুবুদ্ধি দ্বারা অন্যকে ভালো কাজের পরামর্শ দেয়, তবে তা দ্বারাও সদাকার ছাওয়াব অর্জিত হবে আর এভাবে তার দ্বারা নি'আমতের শোকর আদায় হয়ে যাবে। দীনী 'ইলমের তা'লীম, দা'ওয়াত ও তাবলীগ, ওয়াজ ও নসীহত, রচনা ও সংকলন, সুপারিশ ও সুপরামর্শ এবং দীনের শিক্ষা বিস্তার ও তা'লীম-তরবিয়াতমূলক যে-কোনও কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। এর যে-কোনওটি করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা যার আছে তার উচিত সে ক্ষমতাকে কাজে লাগানো আর এভাবে আল্লাহর অসংখ্য নি'আমতের কিছুটা হলেও শোকর আদায়ের ব্যবস্থা করা।
কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকার সদাকা
সবশেষে সাহাবী প্রশ্ন করেছেন, যদি কারও সৎকাজের আদেশ ও সুপরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতাও না থাকে, তখন সে সদাকার ছাওয়াব কিভাবে অর্জন করবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উত্তরে বলেন, অন্যের অনিষ্ট করা হতে বিরত থাকবে। এটাও সদাকারূপে গণ্য হবে। অর্থাৎ এমন কোনও কাজ করবে না, যা দ্বারা কেউ কোনও কষ্ট পায় বা কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন মু'মিনের ঈমানের দাবি হচ্ছে সে কাউকে কষ্ট দেবে না এবং তার পক্ষ হতে সবরকম অনিষ্ট থেকে সমস্ত মানুষ নিরাপদ থাকবে। হাদীছে প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় দেওয়া হয়েছেঃ-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
“মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অপরাপর মুসলিম নিরাপদ থাকে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪১। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৪৮১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬২৭: সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫১৫। বায়হাকী, হাদীছ নং ২০৭৫৫
তো অন্যকে নিরাপদ রাখা তথা কাউকে কোনওরকম কষ্টদান থেকে বিরত থাকা প্রকৃত মু'মিন ও মুসলিমের পরিচায়ক। যে ব্যক্তি এ কাজে সচেষ্ট থাকবে অর্থাৎ অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, সে কেবল এই বিরত থাকার দ্বারাই সদাকার ছাওয়াব পাবে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তা'আলার কত বড় মেহেরবানী যে, কোনওরকম অর্থব্যয় নয়, কোনও শারীরিক শ্রম নয়, কোনও রকমের কষ্ট স্বীকারই নয়, তা সত্ত্বেও সদাকা করার ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায়। শুধু অন্যকে কষ্টদান থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ব্যস এর দ্বারাই একদম মুফ্তে ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায় আর এভাবে আল্লাহ তা'আলার নি'আমত ভোগের শোকরও আদায় হয়ে যায়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারাও নেক কাজের বৈচিত্র্য জানা গেল।
খ. প্রত্যেকের উচিত নিজ প্রয়োজন মেটানোর জন্য কামাইরোযগার করা এবং কিছুতেই অন্যের উপর নির্ভরশীল না হওয়া।
গ. উপার্জিত অর্থসম্পদ কেবল নিজ ভোগের জন্য নয়। তার একটা অংশ আল্লাহর পথে খরচ করা এবং তা দ্বারা অন্যের উপকার করাও ঈমান ও ইসলামের দাবি।
ঘ. দুস্থ ও বিপন্নের সাহায্য করলে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়।
ঙ. সৎকাজের আদেশ ও কল্যাণের পথ দেখানোও সদাকা করার মত নেক কাজ। এটা করার দ্বারাও আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের শোকর আদায় হয়।
চ. অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা সর্বনিম্ন স্তরের নেক আমল। যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করে তার তো এটা অবশ্যই করা উচিত।
আর্থিক সদাকা ও অর্থোপার্জনে উৎসাহদান
সাধারণত সদাকা বললে অর্থ-সম্পদের কথাই মনে আসে যে, সদাকা করতে টাকাপয়সার দরকার হয়। সে হিসেবেই এ হাদীছে এক সাহাবী প্রশ্ন করেছেন যে, সদাকা করার মত কোনও মাল যদি কারও কাছে না থাকে সে কী করবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেছেন, সে নিজ হাতে কাজ করবে। তাতে যা উপার্জন হয় তার একাংশ দ্বারা নিজ প্রয়োজন মেটাবে। আর বাকি অংশ সদাকা করবে।
এর দ্বারা অর্থোপার্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য নিজ পানাহার, পোশাক প্রভৃতি প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজে উপার্জনের চেষ্টা করা। ইসলাম কারও জন্য অন্যের গলগ্রহ হওয়া পছন্দ করে না। ভিক্ষাবৃত্তিরও নিন্দা করেছে। অন্যের কাছে হাত পাতাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। প্রত্যেকের কর্তব্য আপন প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা আপনিই করা। এর জন্য যার যে যোগ্যতা আছে সে যোগ্যতাকে কাজে লাগাবে। বেকার থাকাকে ইসলাম একদম পছন্দ করে না। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকর্ম, কৃষিকার্য ইত্যাদি বহু মাধ্যম আছে, যা দ্বারা অর্থোপার্জন করা যেতে পারে এবং এসব মাধ্যমে অর্থোপার্জনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে। এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছও। আলোচ্য হাদীছেও নিজ হাতে কাজ করে অর্থোপার্জনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, উপার্জিত অর্থের একাংশ আল্লাহর পথে সদাকা করবে। এর দ্বারা বোঝা গেল মু'মিনের উপার্জন কেবল নিজের জন্য নয়, এর সঙ্গে অন্যেরও সম্পর্ক আছে। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ উপার্জিত অর্থের একটা অংশ অন্যদের পেছনেও ব্যয় করা। ইসলাম সে ব্যয়কে সদাকা নামে অভিহিত করেছে। এটা করলে দুনিয়ায়ও আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায় এবং আখিরাতে মুক্তিলাভও সহজ হয়।
কায়িক শ্রমের সদাকা
অতঃপর সাহাবী প্রশ্ন করেন, যদি কারও পক্ষে কামাইরোযগার করে সদাকা করা সম্ভব না হয়, তখন সে কী করবে? অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে সদাকার ছাওয়াব অর্জনের উপায় কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অভাবগ্রস্ত ও দুস্থের সাহায্য করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোঝাচ্ছেন যে, সদাকার ছাওয়াব হাসিলের জন্য অর্থ ব্যয় করাই জরুরি নয়, এ ছাড়াও উপায় আছে। তা হচ্ছে কায়িক শ্রম বা অন্য কোনও উপায়ে মানুষের সাহায্য করা। যেমন, কাউকে তার বাহনে চড়িয়ে দেওয়া, কারও বাহনে মালপত্র তুলতে সাহায্য করা, কোনও অন্ধ ব্যক্তির হাত ধরে রাস্তা পারাপার করে দেওয়া, কারও মাথা থেকে ভার নামিয়ে দেওয়া, কোনও অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মোটকথা যে-কোনও উপায়ে মানুষের সাহায্য করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে তা সদাকারূপে গণ্য হবে।
মানুষের যে-কোনওরকম সাহায্য-সহযোগিতা অভি বড় একটি নেক আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজ করতে উম্মতকে জোর উৎসাহ দিয়েছেন। আলোচ্য হাদীছটি ছাড়াও এ সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ-
والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه
“আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।” সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২২৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪দ৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৪২৭.
উপদেশ ও সুপরামর্শ দেওয়ার সদাকা
তৃতীয় পর্যায়ে সাহাবী প্রশ্ন করেন, যদি কায়িক শ্রম দ্বারা সদাকা দেওয়ার ক্ষমতাও কারও না থাকে, সে ক্ষেত্রে উপায় কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তখন সে সৎকাজের আদেশ করবে বা কোনও কল্যাণের পথ দেখাবে। সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। এটা ঈমানেরও এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এমনিভাবে মানুষকে কল্যাণের পথ দেখানো ও ভালো কাজের পরামর্শ দেওয়া অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- الدال على الخير كفاعله “যে ব্যক্তি কাউকে কোনও ভালো কাজের পথ দেখায়, সে ওই ভালো কাজটি যে করে তার সমান ছাওয়াব পাবে।" জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৩৬০: তবারানী, আল- মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯৪৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫২৯
কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহপ্রদত্ত অসংখ্য নি'আমতের শোকর আদায়ের জন্য না আর্থিক সদাকা দিতে পারে আর না শারীরিক শ্রম দ্বারা অন্যের উপকার করতে পারে, তার হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। নি'আমতের শোকর আদায়ার্থে তারও সদাকা দেওয়ার উপায় আছে। সে উপায় হচ্ছে নিজ বিদ্যাবুদ্ধির ব্যবহার। সে যেসব ভালো কথা জানে, যদি তা অন্যকে শেখায় কিংবা নিজ সুবুদ্ধি দ্বারা অন্যকে ভালো কাজের পরামর্শ দেয়, তবে তা দ্বারাও সদাকার ছাওয়াব অর্জিত হবে আর এভাবে তার দ্বারা নি'আমতের শোকর আদায় হয়ে যাবে। দীনী 'ইলমের তা'লীম, দা'ওয়াত ও তাবলীগ, ওয়াজ ও নসীহত, রচনা ও সংকলন, সুপারিশ ও সুপরামর্শ এবং দীনের শিক্ষা বিস্তার ও তা'লীম-তরবিয়াতমূলক যে-কোনও কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। এর যে-কোনওটি করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা যার আছে তার উচিত সে ক্ষমতাকে কাজে লাগানো আর এভাবে আল্লাহর অসংখ্য নি'আমতের কিছুটা হলেও শোকর আদায়ের ব্যবস্থা করা।
কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকার সদাকা
সবশেষে সাহাবী প্রশ্ন করেছেন, যদি কারও সৎকাজের আদেশ ও সুপরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতাও না থাকে, তখন সে সদাকার ছাওয়াব কিভাবে অর্জন করবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উত্তরে বলেন, অন্যের অনিষ্ট করা হতে বিরত থাকবে। এটাও সদাকারূপে গণ্য হবে। অর্থাৎ এমন কোনও কাজ করবে না, যা দ্বারা কেউ কোনও কষ্ট পায় বা কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন মু'মিনের ঈমানের দাবি হচ্ছে সে কাউকে কষ্ট দেবে না এবং তার পক্ষ হতে সবরকম অনিষ্ট থেকে সমস্ত মানুষ নিরাপদ থাকবে। হাদীছে প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় দেওয়া হয়েছেঃ-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
“মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অপরাপর মুসলিম নিরাপদ থাকে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১০; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪১। সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৪৮১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬২৭: সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫১৫। বায়হাকী, হাদীছ নং ২০৭৫৫
তো অন্যকে নিরাপদ রাখা তথা কাউকে কোনওরকম কষ্টদান থেকে বিরত থাকা প্রকৃত মু'মিন ও মুসলিমের পরিচায়ক। যে ব্যক্তি এ কাজে সচেষ্ট থাকবে অর্থাৎ অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, সে কেবল এই বিরত থাকার দ্বারাই সদাকার ছাওয়াব পাবে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তা'আলার কত বড় মেহেরবানী যে, কোনওরকম অর্থব্যয় নয়, কোনও শারীরিক শ্রম নয়, কোনও রকমের কষ্ট স্বীকারই নয়, তা সত্ত্বেও সদাকা করার ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায়। শুধু অন্যকে কষ্টদান থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ব্যস এর দ্বারাই একদম মুফ্তে ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায় আর এভাবে আল্লাহ তা'আলার নি'আমত ভোগের শোকরও আদায় হয়ে যায়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারাও নেক কাজের বৈচিত্র্য জানা গেল।
খ. প্রত্যেকের উচিত নিজ প্রয়োজন মেটানোর জন্য কামাইরোযগার করা এবং কিছুতেই অন্যের উপর নির্ভরশীল না হওয়া।
গ. উপার্জিত অর্থসম্পদ কেবল নিজ ভোগের জন্য নয়। তার একটা অংশ আল্লাহর পথে খরচ করা এবং তা দ্বারা অন্যের উপকার করাও ঈমান ও ইসলামের দাবি।
ঘ. দুস্থ ও বিপন্নের সাহায্য করলে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়।
ঙ. সৎকাজের আদেশ ও কল্যাণের পথ দেখানোও সদাকা করার মত নেক কাজ। এটা করার দ্বারাও আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতের শোকর আদায় হয়।
চ. অন্যকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা সর্বনিম্ন স্তরের নেক আমল। যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করে তার তো এটা অবশ্যই করা উচিত।


বর্ণনাকারী: