ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৪২. ইহসান-আত্মশুদ্ধির অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫৭৩
আল্লাহকে সংরক্ষণ করা, তাঁর নিকটে প্রার্থনা করা, আশ্রয় চাওয়া এবং তাঁর উপর নির্ভর করার মর্যাদা এবং সবকিছুই নির্ধারিত
(২৫৭৩) ইবন আব্বাস রা. বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পেছনে ছিলাম । তখন তিনি বললেন, হে কিশোর, আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দিচ্ছি: তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ করবে তাহলে তিনি তোমাকে সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহকে সংরক্ষণ করবে তাহলে তুমি তাকে তোমার সামনে পাবে। যখন তুমি প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে এবং যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন তুমি আল্লাহরই সাহায্য চাইবে । আর জেনে রাখো, যদি সকল সৃষ্টি একত্রিত হয় তোমার কল্যাণ করতে তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তার অতিরিক্ত কোনো কল্যাণ তারা তোমার জন্য করতে পারবে না এবং যদি সকল সৃষ্টি একত্রিত হয় তোমার ক্ষতি করতে তবে আল্লাহ তোমার বিরুদ্ধে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তার অতিরিক্ত কোনো ক্ষতি তারা তোমার জন্য করতে পারবে না । কলমগুলোকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং কাগজগুলো শুকিয়ে গিয়েছে।
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: كنت خلف النّبي صلى الله عليه وسلم يوما فقال: يا غلام إني أعلمك كلمات: إحفظ الله يحفظك احفظ الله تجده تجاهك إذا سألت فاسأل الله وإذا استعنت فاستعن بالله واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيء لم ينفعوك إلا بشيء قد كتبه الله لك ولو اجتمعوا على أن يضروك بشيء لم يضروك إلا بشيء قد كتبه الله عليك رفعت الأقلام وجفت الصحف.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রয়েছে মহামূল্যবান কয়েকটি উপদেশ। প্রত্যেকটি উপদেশই দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যার জন্য একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের প্রয়োজন। আমরা এখানে হাদীছটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।

আল্লাহর হেফাজতে থাকতে চাইলে
হাদীছটিতে সর্বপ্রথম বলা হয়েছে- আল্লাহকে হেফাজত করো। আল্লাহকে হেফাজত করার মানে তাঁর বিধানাবলী রক্ষা করা, তাঁর হকসমূহ পালন করা ও তাঁর আদেশ- নিষেধ মেনে চলা। এককথায় শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করা। কোনও ক্ষেত্রেই শরী'আতের গণ্ডির বাইরে না যাওয়া।
সর্বপ্রথম হেফাজত করতে হবে আল্লাহসম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাস। বিশ্বাস করতে হবে যে, বিশ্বজগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনিই আল্লাহ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনও শরীক নেই। তিনি এ জগত সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট এক কালের জন্য। তারপর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। থাকবে কেবল তাঁর পবিত্র সত্তা। তারপর আবার সকলকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। সেইকালকে আখিরাত বলে। সেখানে নেককারগণ জান্নাতে এবং পাপীগণ জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ তাআলা কোনটা নেককাজ এবং কোনটা পাপকাজ, নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখা ও তাঁদের শিক্ষা অনুযায়ী চলাও আল্লাহকে হেফাজত করার অংশ।

তারপর হেফাজত করতে হবে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী। অর্থাৎ ইবাদত করা হবে কেবল তাঁরই, অন্য কারও নয়। তাঁর ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করা হতে বিরত থাকতে হবে। তাঁর ইবাদত করতে হবে কেবল সেই পন্থায়, যা তিনি নিজ রাসূলের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। ইবাদত করতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, সুনাম-সুখ্যাতির জন্য নয় এবং নয় মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে।
নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত- এই চারটি মূল ইবাদত। এছাড়া আল্লাহ তা'আলার আরও যত হুকুম আছে, তা পালন করাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যেমন আমানতের হেফাজত করা, ন্যায়বিচার করা, বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, পিতামাতার আনুগত্য করা, হালাল উপার্জন করা, আত্মীয়তা রক্ষা করা ইত্যাদি। বস্তুত শরীআতের যাবতীয় হুকুম পালন করাই আল্লাহকে হেফাজত করার অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ তা'আলা যা-কিছু নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিজেকে হেফাজত করাও আল্লাহ তা'আলাকে হেফাজত করার মধ্যে পড়ে, যেহেতু এর দ্বারাও তাঁর প্রদত্ত শরীআতের হেফাজত হয়।
শরী'আত দুইভাগে বিভক্ত- (ক) 'আওয়ামির- আদেশসমূহঃ (খ) নাওয়াহী- নিষেধসমূহ। কেবল আদেশ পালন দ্বারা শরী'আতের অর্ধেক পালন করা হয়। পূর্ণ শরী'আত অনুসরণের জন্য এটাও জরুরি যে, আল্লাহ তাআলা যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তা'আলা নিষেধ করেছেন তাঁর সংগে কাউকে শরীক করতে, পিতামাতার অবাধ্যতা করতে, মিথ্যা বলতে, মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে, হারাম পানাহার করতে, ব্যভিচার করতে, জুলুম করতে, সুদ ঘুষের লেনদেন করতে ইত্যাদি। বস্তুত যতরকম নিষেধাজ্ঞা আছে, সেসব থেকে বিরত থাকার দ্বারা আল্লাহ তা'আলাকে হেফাজত অর্থাৎ তাঁর প্রদত্ত শরী'আতের হেফাজত করা হয়।

যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে হেফাজত করে তথা শরী'আতের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে, কুরআনের ভাষায় সে 'হাফীজ'। তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে জান্নাতের অফুরন্ত নিআমত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَأَزْ لِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ غَيْرَ بَعِيدٍ هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَابٍ حَفِيظ

"আর মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতকে নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে, কোনও দূরত্বই থাকবে না। (এবং বলা হবে,) এটাই তা যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হত প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী হেফাজতকারীর জন্য।" কাফ ৩১-৩২

আল্লাহপ্রদত্ত শরী'আতের হেফাজত করলে তার সুফল কী, সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহ তা'আলা হেফাজত করেন দু'ভাবে- (ক) দুনিয়াবী হেফাজত; (খ) দীনী হেফাজত।
যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানাবলী মেনে চলে, আল্লাহ তা'আলা তার সংগে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে।

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ الْقَوْاوَ الَّذِينَ هُمْ مُّحْسِنُونَ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই সাথী, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ইহসানের অধিকারী হয়।” নাহল ১২৮

আল্লাহ যার সাথে থাকেন তার কিসের ভয়? তিনি ফিরিশতা দ্বারা তার হেফাজত করেন। ইরশাদ হয়েছে-

لَهُ مُعَقِبَتْ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَ مِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللهِ "

“প্রত্যেকের সামনে পেছনে এমন প্রহরী (ফিরিশতা) নিযুক্ত থাকে, যারা আল্লাহর নির্দেশে পালাক্রমে তার হেফাজত করে।” রাদ ১১

যে ব্যক্তি তার যৌবনকালে শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে তার বার্ধক্যকালে হেফাজত করেন। ফলে তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি সব ঠিক থাকে। তার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায় না। এরূপ লোককে দেখা যায় আশি-নব্বই বছর বয়সেও বেশ সুস্থ-সবল দিন কাটাচ্ছে। যা খায় হজম হচ্ছে। মেধা-মস্তিষ্ক যথেষ্ট সক্রিয়। পক্ষান্তরে যৌবন বয়সে যারা পাপাচারে দিন কাটায়, বৃদ্ধকালে তারা সম্পূর্ণ অথর্ব হয়ে পড়ে। কেবল শরীরিক শক্তিই হারায় না, বুদ্ধি-বিবেকও সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যায়। যৌবনে সে শরী'আতের হেফাজত করেনি, তাই বার্ধক্যে আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন না।
যে ব্যক্তি শরী'আতের হেফাজত করে, আল্লাহ তা'আলা কেবল তাকেই নয়, তার সন্তান-সন্তুতি ও পরবর্তী প্রজন্মকেও হেফাজত করে থাকেন। সূরা কাহফে ইরশাদ হয়েছে-
এবং তাদের পিতা ছিল একজন সৎ লোক। কাহফ ৮২

অর্থাৎ পিতার সততার কারণে তার মৃত্যুর পর আল্লাহ তা'আলা হযরত খাযির আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তার ইয়াতীম দুই সন্তানের ধনসম্পদের হেফাজত করেন। ইবনুল মুনকাদির রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলা নেককার লোকের কারণে তার সন্তান-সন্তুতি ও নাতি-নাতনিদেরও হেফাজত করে থাকেন। এমনকি তার কারণে তার প্রতিবেশীদেরও হেফাজত করা হয়ে থাকে।
আল্লাহ তা'আলা নেককার লোক ও তার বংশধরকে হেফাজত করেন ফিরিশতাদের মাধ্যমে, মানুষের মাধ্যমে, এমনকি ক্ষতিকর জীবজন্তুর মাধ্যমেও। এমন ঘটনা বিস্তর পাওয়া যায় যে, নেককার ব্যক্তির হেফাজতে নিয়োজিত হয়েছে শাপ, বিচ্ছু ও বাঘ-সিংহ পর্যন্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হযরত সাফীনা রাঃ পথ হারিয়ে ফেললে বনের সিংহ তাঁকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। হযরত ইবরাহীম ইবন আদহাম রাহ. একটি বাগানের ভেতর ঘুমাচ্ছিলেন। যতক্ষণ না জেগেছেন, একটি সাপ তাকে পাহারা দিয়েছিল।

পক্ষান্তরে যারা শরী'আতের বিধান লঙ্ঘন করে, তারা ফিরিশতার সাহায্য থেকে বঞ্চিত থাকে। জিন ও ইনসান যারা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিংস্র জীবজন্তু তাদের সাহায্য করবে কি, পোষা প্রাণীও তাদের অবাধ্য হয়ে যায়।

প্রশ্ন হতে পারে, অনেক সময় নেককার লোকদের নানারকম বিপদ-আপদ ভোগ করতে দেখা যায়। আবার পাপাচারীকে দেখা যায় বেশ নিরাপদ ও সুখ-সাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে। এর উত্তর হচ্ছে, নেককার লোকদের বিপদ-আপদ তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তাতে সবরের তাওফীক দেন এবং তার ফলে তারা আল্লাহর কাছে অপরিমিত পুরস্কার লাভ করে এবং পায় উচ্চমর্যাদা। আর পাপীদের সুখ সাচ্ছন্দ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের আযাব। কারণ সেই সুখ- সাচ্ছন্দ্যে মাতোয়ারা হয়ে তারা আরও বেশি পাপাচার করতে থাকে এবং সীমালঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফলে অনেক সময় দুনিয়াতেই আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দান করেন, নয়তো পুরোপুরি পাকড়াও করেন মৃত্যুর পর কবরে, হাশরে এবং সবশেষে জাহান্নামে তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা।

দ্বিতীয় প্রকারের হেফাজত দীনী হেফাজত
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার বিধানাবলী মেনে চলে, আল্লাহ তা'আলা তার দীন ও ঈমানের হেফাজত করেন। তাকে ঈমানে অটল থাকার তাওফীক দান করেন। সবরকম সংশয়-সন্দেহ থেকে তাকে রক্ষা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঈমানে প্রতিষ্ঠিত রাখেন। মৃত্যুকালে যখন শয়তান তাকে ঈমানহারা করার সর্বশেষ চেষ্টা চালায়, তখন আল্লাহ তার পাশে থাকেন এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে তাকে রক্ষা করেন। ফলে ঈমানের সাথে তার মৃত্যুবরণের সৌভাগ্য লাভ হয়। সন্দেহ নেই এটাই শ্রেষ্ঠতম হেফাজত।

আল্লাহকে যদি সামনে পেতে চাও
দ্বিতীয় উপদেশ হচ্ছে- আল্লাহকে হেফাজত করো, তাঁকে তোমার সামনে পাবে।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানাবলী পালন করে, তাঁর হকসমূহের হেফাজত করে, সে তার সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে সংগে পাবে। আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করবেন, তাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং নেককাজের তাওফীক দেবেন। আগে বলা হয়েছিল, আল্লাহ তা'আলা তোমাকে হেফাজত করবেন। এখানে বলা হয়েছে, তিনি তোমার সামনে থাকবেন। সামনের বস্তু চোখে দেখা যায়। যেন বলা হয়েছে তুমি আল্লাহর হুকুম পালন করে চললে তোমার এমন আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হবে যে, তোমার অন্তরে আল্লাহর ধ্যান স্থায়ী হয়ে যাবে। কখনও অন্তরে গাফলাত ও উদাসীনতা দেখা দেবে না। তুমি তোমার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা তাঁকে যেন দেখতে পাবে। ফলে ইবাদত- আনুগত্যে আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ইবাদতের স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবে। গায়রুল্লাহ থেকে দৃষ্টি সরে যাবে। এভাবে ইবাদত-বন্দেগী রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকবে। অন্তরে ইখলাস ও নিষ্ঠা জন্মাবে এবং ইহসানের হালত পয়দা হবে।

মু'মিনের উচিত কেবল আল্লাহরই কাছে চাওয়া
তৃতীয় উপদেশ হচ্ছে- যখন কিছু চাবে, আল্লাহ তা'আলার কাছেই চাবে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর কাছে চাওয়া পসন্দ করেন। তিনি ইরশাদ করেন-

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ

“তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।”

আরও ইরশাদ করেন-

وَمَتَلُوا اللَّهَ مِنْ فَضْلِهِ

'তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাও।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে-

سَلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِهِ، فَإِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ يُسْأَلُ.

'তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাও। তিনি পসন্দ করেন যে, তাঁর কাছে চাওয়া হোক।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ لَمْ يَسْأَلِ اللهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِ

"যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হন।'

অপর এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لِيَسْأَلُ أَحَدُكُمْ رَبَّهُ حَاجَتَهُ كُلَّهَا، حَتَّى يَسْأَلَهُ شِسْعَ نَعْلِهِ إِذَا القطع.

"তোমাদের প্রত্যেকে তার যাবতীয় প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাবে। এমনকি তার জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে তাও আল্লাহরই কাছে চাবে।

মানুষের কাছে কোনও কিছু চাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পসন্দ করতেন না। তিনি সাহাবায়ে কিরামকে জোর নিষেধ করতেন, যাতে তাঁরা কারও কাছে কিছু না চান। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি সাহাবায়ে কিরাম থেকে শপথও নিয়েছেন। মুসলিম শরীফের এক হাদীছে আছে, সাহাবায়ে কেরাম এ শপথ এমনভাবে রক্ষা করেছিলেন যে, বাহনের পিঠে থাকা অবস্থায় যদি কারও হাত থেকে লাগাম বা লাঠি পড়ে যেত, তবে তাও তুলে দেওয়ার জন্য কাউকে বলতেন না। বস্তুত কোনও মাখলুকের কাছে চাওয়া একজন মুমিনের পক্ষে কিছুতেই শোভনীয় নয়। অন্যের কাছে চাওয়া নিজের পক্ষে অপমানকর। যার কাছে চাবে, সেও তো তারই মত একজন দুর্বল মানুষ। কারও কোনও উপকার বা ক্ষতি করার কিছুমাত্র ক্ষমতা তার নেই। তার যতটুকু ক্ষমতা ও সামর্থ্য, তাও আল্লাহরই দান। নিজস্বভাবে তার কিছুই নেই। এমনকি তার কাছে কেউ কিছু চাক, তা সে পছন্দও করে না। এরূপ দুর্বল ও সংকীর্ণমনা সৃষ্টির কাছে কিছু চাওয়া নিজেকে অপমানিত করা ছাড়া আর কী? তার কাছে চাওয়ার দ্বারা একপ্রকারে তার সক্ষমতা থাকার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। অক্ষমকে সক্ষম বলে স্বীকার করা নিতান্তই আত্মপ্রবঞ্চনা। এতে বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।

ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ রহ. এক ব্যক্তিকে দেখলেন রাজা-বাদশার কাছে আসা- যাওয়া করে। তিনি তাকে বললেন, ছিঃ, যে তোমার সামনে দরজা বন্ধ করে রাখে, তোমার সামনে নিজ দৈন্য প্রকাশ করে, তোমার কাছে নিজ ঐশ্বর্য গোপন রাখে, তার কাছে কিনা পাওয়ার আশা নিয়ে যাও। অপরদিকে বিমুখ হয়ে থাক সেই মহামালিকের দিক থেকে, যিনি তোমার জন্য দুয়ার খোলা রাখেন রাত-দিন সবসময়, যার কোনও অভাব নেই, যিনি নিজ ঐশ্বর্য তোমার সামনে খুলে রেখেছেন আর এই বলে ডাকছেন যে, আমার কাছে চাও, আমি তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করব।

হযরত তাউস রহ. হযরত আতা রহ.- কে উপদেশ দেন- যে তোমার সামনে দরজা বন্ধ রাখে এবং দরজায় পাহারাদার বসিয়ে রাখে, সাবধান তার কাছে তোমার কোনও প্রয়োজনের কথা বলবে না। তোমার হাজত পেশ করবে কেবল তাঁরই কাছে, যার দরজা উন্মুক্ত কিয়ামত পর্যন্ত, যিনি তোমাকে তাঁর কাছে চাইতে বলেছেন এবং ওয়াদা করেছেন তোমার চাওয়া পূরণ করবেন।

আবুল হাসান শাযিলী রহ. বলেন, আমি তো এই আশাও করি না যে, নিজে নিজের কোনও উপকার করতে পারব। এ অবস্থায় অন্যে আমার কোনও উপকার করতে পারবে, এ আশা কিভাবে করি? আমি অন্যের ব্যাপারে আশা করি যে, আল্লাহ তার কল্যাণ করবেন। এ অবস্থায় আমি নিজের ব্যাপারে কিভাবে তাঁর কাছে কল্যাণের আশাবাদী না হয়ে পারি?
মানুষ যে কোনও মাখলুকের দিকে ঝুঁকে ও তার কাছে আশাবাদী হয়, এটা কেবলই তার ইয়াকীনের দুর্বলতা ও বস্তুর হাকীকত সম্পর্কে গাফলাতের কারণে। যে ব্যক্তি তার মাওলা থেকে যত দূরে থাকে, সে সেই অনুপাতে মাখলুকের কাছে আশাবাদী হয়। বান্দা যখন তার গাফলাত থেকে মুক্ত হয়, তার অন্তরে সত্যিকারের চেতনা জাগ্রত হয়, তখন সমস্ত মাখলুক থেকে বিরাগী হয়ে এক আল্লাহর অভিমুখী হয়ে যায়। তখন তার অন্তরে পরিপূর্ণ ইয়াকীন জন্মায় এবং সে আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ তাওয়াক্কুল করে। আর তখনই সে সেই মহাদাতার দুয়ারে নিজের সকল হাজত ও প্রয়োজন নিয়ে ধরণা দেয়। কারণ সে জানে, যে আল্লাহর প্রতি ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। ইরশাদ হয়েছে-

وَ مَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ *

"যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। "

প্রকৃত দাতা কেবল আল্লাহ তা'আলাই । তিনিই সমস্ত উপকার ও ক্ষতির মালিক। সকলের সমস্ত মনোবাঞ্ছা কেবল তিনিই পূরণ করতে পারেন। ইরশাদ হয়েছে-

مَا يَفْتَحَ اللهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكَ فَلَا مُرْسِلَ لَهُ مِنْ بَعْدِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

অর্থ : আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত খুলে দেন, তা রোধ করার কেউ নেই, আর যা তিনি রুদ্ধ করেন, এমন কেউ নেই, যে তারপর তা উন্মুক্ত করতে পারে। তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

আরও ইরশাদ হয়েছে-

وَإِن يَمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِن يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَاد لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يشَاء مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ )

অর্থ : আল্লাহ যদি তোমাকে কোনও কষ্ট দান করেন, তবে তিনি ছাড়া এমন কেউ নেই, যে তা দূর করবে এবং তিনি যদি তোমার কোনও মঙ্গল করার ইচ্ছা করেন, তবে এমন কেউ নেই, যে তার অনুগ্রহ রদ করবে। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ দান করেন। তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
এমন সর্বশক্তিমানের সামনে নিজের অভাব ও অক্ষমতা প্রকাশ নিজের পক্ষে মর্যাদাকর। এবং এটাই প্রকৃত ইবাদত। এক হাদীছে আছে-

الدُّعَاء مع العِبَادَة

'দুআ ইবাদতের সারবস্তু।'

ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. দু'আ করতেন- হে আল্লাহ! তুমি যেমন অন্যের সামনে সিজদা করা হতে আমার চেহারা হেফাজত করেছ, তেমনি তোমার ছাড়া কারও কাছে চাওয়া হতেও আমাকে হেফাজত কর।

সাহায্যপ্রার্থনা সৃষ্টির কাছে নয়; স্রষ্টারই কাছে
চতুর্থ উপদেশ- যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তা কেবল আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। অর্থাৎ কোনও মাখলুকের কাছে কোনও ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করবে না। কেননা মানুষ অক্ষম। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার কোনও উপকার-অপকার করার ক্ষমতা নেই। মানুষের দীন ও দুনিয়ার কল্যাণ কেবল আল্লাহ তা'আলাই সাধন করতে পারেন। তিনি যাকে সাহায্য করেন, কেবল সেই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। তিনি যাকে সাহায্য করেন না, সে বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হয়। তাই সাহায্য কেবল তাঁরই কাছে চাওয়া উচিত, অন্য কারও কাছে নয়। যে ব্যক্তি অন্যের কাছে সাহায্য চায়, আল্লাহ তা'আলা তাকে তার হাতে ছেড়ে দেন। আল্লাহ যাকে ছেড়ে দেন, তাকে সাহায্য করার ক্ষমতা কার আছে? যার হাতে ছেড়ে দেন, আল্লাহর বিপরীতে তার কিইবা করার ক্ষমতা আছে? হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. যখন শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন হযরত হাসান বসরী রহ. তাঁর কাছে উপদেশ লিখে পাঠান- আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে সাহায্য চাবেন না। তা চাইলে আল্লাহ আপনাকে তার হাতে ছেড়ে দেবেন। জনৈক বুযুর্গ বলেন, ইয়া রাব্বাল আলামীন! ওই ব্যক্তিকে দেখে আশ্চর্য বোধ করি, যে তোমাকে চেনে, তা সত্ত্বেও সে তোমাকে ছাড়া অন্য কারও কাছে আশাবাদী হয়! ওই ব্যক্তিকে দেখে আশ্চর্য বোধ করি, যে তোমাকে চেনে, তা সত্ত্বেও সে কিভাবে অন্যের কাছে সাহায্য চায়।

মানুষ মূলত তার দুনিয়াবী ও দীনী সব ব্যাপারেই আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইহজীবনে যেমন তার প্রাণরক্ষা ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা সম্ভব নয়, তেমনি তাঁর সাহায্য ছাড়া নফস ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করা ও ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকাও অসম্ভব। বান্দার জন্য আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন শরীআতের যাবতীয় আদেশ পালনে ও সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় পরিহারে। তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন পার্থিব সকল বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণে ও সকল মুসিবত থেকে উদ্ধারে। তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন মৃত্যুকালে ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে। কিয়ামতের বিভীষিকা ও হাশরের কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর সাহায্য ছাড়া কোনও উপায় নেই। এ সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে, যে কারও কোনও উপকার করতে পারে? তাই তো সূরা ফাতিহায় দু'আ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে-

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

"(হে আল্লাহ) আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
অর্থাৎ সাহায্য চাই তোমার ইবাদত-বন্দেগীতে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সকল ঘাঁটিতে।

সাহায্য প্রার্থনার একটি অতি উত্তম বাক্য হল- লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বেশি বেশি পড়া। এর অর্থ- এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তনের কোনও শক্তি বান্দার নিজের নেই। সে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া না পারে কোনও গুনাহ থেকে বাঁচতে, আর না পারে কোনও নেককাজ করতে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বাক্য। হাদীছের ভাষ্যমতে এটি জান্নাতের একটি খনিস্বরূপ। বর্ণিত আছে যে, হযরত মালিক আশজা'ঈ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জানালেন আমার পুত্র আওফ শত্রুর হাতে বন্দি হয়েছে। তিনি তাকে বললেন, তুমি তার কাছে বলে পাঠাও যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে বেশি বেশি লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ পড়তে আদেশ করেছেন। মালিক আশজা'ঈ রাযি. লোক মারফত আওফকে একথা জানালেন। আওফ হুকুম মোতাবেক বেশি বেশি পড়তে থাকলেন। শত্রুরা তার গলায় বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর কুদরতে তার গলা থেকে বেড়ি খুলে পড়ে গেল। তিনি বাইরে চলে আসলেন। তিনি তাদের একটি উটনী দেখতে পেলেন। সেটিতে সওয়ার হলেন। বাইরে এসে দেখেন তাদের একপাল উট দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সেগুলোকে লক্ষ্য করে আওয়াজ দিলেন। তাতে সবগুলো উট তার উটনীর পেছনে ছুটে চলল। ভোরবেলা একটি আওয়াজ শুনে তার বাবা-মা হকচকিয়ে উঠল। দরজায় এসে দেখেন আওফ তাদের ডাকছে আর তার সংগে একপাল উট। আওফ তার পিতাকে ঘটনা খুলে বললেন। ভোরবেলা মালিক রাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আওফের ফিরে আসার সংবাদ জানালেন। উটগুলোর কথাও বললেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উটগুলো দিয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই করতে পার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়-

وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًان وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَيبُ

অর্থ যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে।'

তাকদীরের বাইরে সকল সৃষ্টি মিলেও কারও কিছু উপকার বা ক্ষতি করতে না পারা
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- জেনে রেখো, সমস্ত সৃষ্টিজীব যদি তোমার কোনও উপকার করার জন্য একত্র হয়, তবে তারা তোমার কোনও উপকার করতে পারবে না- সেইটুকু ছাড়া, যা আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ করেছেন। আর তারা যদি তোমার ক্ষতি করার জন্যও একত্র হয়, তবে তারা তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না- কেবল সেইটুকু ছাড়া, যা আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ করেছেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য, দুনিয়ায় মানুষের যখন যে কল্যাণ সাধিত হয়, তা সবই নিয়তি নির্ধারিত। অনুরূপ যার যা কিছু অনিষ্ট ও ক্ষতি হয়, তাও তাকদীরে লিপিবদ্ধ। তাকদীরে যা লেখা আছে, তার বাইরে কারও কোনও ক্ষতি বা উপকার হতে পারে না। এমনকি সমস্ত সৃষ্টি সম্মিলিত চেষ্টায় কারও কোনও উপকার বা ক্ষতি করতে চাইলে কেবল ততটুকুই করতে পারবে, যা তাকদীরে লেখা আছে। তার বেশি নয় এক কণাও। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَاقَ الفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَبٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَّبْرَاهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيان

অর্থ : পৃথিবীতে অথবা তোমাদের প্রাণের উপর যে মুসিবত দেখা দেয়, তার মধ্যে এমন কোনওটিই নেই, যা সেই সময় থেকে এক কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই, যখন আমি সেই প্রাণসমূহ সৃষ্টিও করিনি। নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষে এটা অতি সহজ। আরও ইরশাদ হয়েছে-

اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَنَا وَ عَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ قُلْ أَنْ يُصِيْبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ

অর্থ : বলে দাও, আল্লাহ আমাদের জন্য (তাকদীরে) যা লিখে রেখেছেন, তা ছাড়া অন্য কোনও কষ্ট আমাদেরকে কিছুতেই স্পর্শ করবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহরই উপর মুমিনদের ভরসা করা উচিত।

বস্তুত এই উপদেশ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের শিক্ষা দান করেছেন। ইমাম ইবন রজব হাম্বলী রহ. বলেন, এ হাদীছে যতগুলো উপদেশ আছে, এটি তার মূল ভিত্তিস্বরূপ। এর আগে ও পরে যা বলা হয়েছে, তা এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে এবং একে কেন্দ্র করেই বলা হয়েছে। বান্দা যখন জানতে পারবে আল্লাহ তা'আলা তার ভাগ্যে যা লিখেছেন তার বাইরে তার কোনও মঙ্গল-অমঙ্গল ও লাভ-ক্ষতি হতে পারে না। এবং তাকদীরের বাইরে সমগ্র সৃষ্টির সম্মিলিত প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হতে বাধ্য, তখন সে বুঝতে সক্ষম হবে আল্লাহ তা'আলা একাই সৃষ্টির লাভ-লোকসানের মালিক, কেবল তিনিই মঙ্গলকর্তা, তাঁরই হাতে সব অমঙ্গল, তিনিই প্রকৃত দাতা এবং তিনিই বঞ্চিতকারী। এ বিশ্বাসের দাবি, বান্দা এক আল্লাহরই আনুগত্য করবে, তাঁর আনুগত্যে কাউকে শরীক করবে না এবং তাঁর বিধানাবলী পালন করবে ও তার সীমারেখা সংরক্ষণ করবে। কেননা মাবুদের ইবাদত করার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তার নিকট থেকে কল্যাণ লাভ করা ও অকল্যাণ থেকে আত্মরক্ষা করা। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা ঐসকল লোকের নিন্দা করেছেন, যারা এমনসব বস্তুর উপাসনা করে, যাদের উপকার-অপকার করার কোনও ক্ষমতা নেই এবং যারা তাদের উপাসকদের কণামাত্র কাজে আসে না। যে ব্যক্তি জানতে পারে আল্লাহ ছাড়া কেউ উপকার ও অপকার করতে পারে না এবং কিছু দিতেও পারে না, না দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে না, তার জন্য অবধারিত হয়ে যায় যে, সে কেবল আল্লাহ তা'আলাকেই ভয় করবে, তাঁরই কাছে আশা করবে, তাকেই ভালোবাসবে, যা চাওয়ার তাঁর কাছেই চাবে, তাঁরই সমীপে মিনতি জানাবে এবং তাঁরই কাছে দুআ করবে। সে সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহর আনুগত্যকে প্রাধান্য দেবে, ক্রোধ ও অসন্তোষ থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে, যদিও তাতে সমস্ত সৃষ্টি তার প্রতি নাখোশ হয়ে যায়। সে কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাবে ও তাঁরই সমীপে প্রার্থনা করবে। সে সুখে-সাচ্ছন্দ্যে সর্বাবস্থায় একনিষ্ঠভাবে তাঁকেই ডাকবে।

কলম তুলে নেওয়া হয়েছে, শুকিয়ে গেছে সব লিপি
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং সব লিপি শুকিয়ে গেছে। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, তাকদীর ও ভাগ্যলিখন সমাপ্ত হয়ে গেছে। যখন কোনও কিছু লেখা সমাপ্ত হয়, তখন কলম বন্ধ করে ফেলা হয় এবং যাতে লেখা হয় তা থেকে কলম তুলে নেওয়া হয়। তারপর যা লেখা হয় তা শুকিয়ে যায়। বোঝানো হচ্ছে, তাকদীরে যা-কিছু লেখার তা লেখা শেষ হয়ে গেছে এবং ভাগ্যলিপি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন আর তাতে নতুন কিছু লেখা হবে না এবং যা লেখা হয়েছে তাতে কোনো রদবদলও করা হবে না।

আল্লাহ তাআলা আসমান-যমীন সৃষ্টির বহু আগে সকল সৃষ্টির ভাগ্য ও তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে, তাকদীর লেখা হয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। সুতরাং পৃথিবীতে যখন যেখানে যা-কিছু হচ্ছে এবং যার সাথে যা কিছু ঘটছে, তা সবই সেই লেখা অনুযায়ী হচ্ছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

ما أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا في كتبٍ مِنْ قَبْلِ أَن نَّجْرَاهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِ

অর্থ : পৃথিবীতে অথবা তোমাদের প্রাণের উপর যে মুসিবত দেখা দেয়, তার মধ্যে এমন কোনওটিই নেই, যা সেই সময় থেকে এক কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই, যখন আমি সেই প্রাণসমূহ সৃষ্টিও করিনি। নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষে এটা অতি সহজ।

সুতরাং বান্দার কর্তব্য এ বিশ্বাসের সাথে তার যাবতীয় কাজকর্ম ও চিন্তা-চেতনাকে জুড়ে দেওয়া। যখন কাজ করবে এই বিশ্বাসের সাথে করবে যে, এর ফলাফল কেবল তাই হবে, যা তাকদীরে লেখা আছে। তারপর কাজের যে ফল সে দেখতে পাবে, তাতে এই ভেবে সম্ভষ্ট থাকবে যে, তাকদীরে যা লেখা ছিল আমি তাই পেয়েছি। তার কম কিংবা বেশি পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবে চিন্তা করলে প্রত্যাশার বিপরীত ফল দেখে সে হতাশ হবে না। আবার প্রত্যাশিত ফল পেয়ে আনন্দে উল্লসিত হবে না। বরং উভয় অবস্থায় যা লাভ হয়েছে তাকে আল্লাহর দান মনে করে খুশি থাকবে এবং তাঁর শোকর আদায় করবে। পরের বর্ণনায় তাকদীরে বিশ্বাসের এ সুফলের প্রতি ইশারা করে বলা হয়েছে যে- জেনে রেখো, যা তোমার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তা তুমি কখনও পাওয়ার ছিলে না। আর যা তোমার হস্তগত হয়েছে, তা তোমার কখনও হস্তচ্যুত হওয়ার ছিল না। বস্তুত তাকদীরে বিশ্বাস মানুষকে হতাশা থেকে রক্ষা করে। তাকদীরে বিশ্বাস মানুষের মনে সাহস যোগায়। তাকদীরে বিশ্বাস মানুষের অন্তর থেকে সৃষ্টির ভয়-ভীতি দূর করে। যার অন্তরে তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস থাকে, সে অহংকার-অহমিকার শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যায়।

দুঃখের সময় আল্লাহকে সংগে পেতে হলে
দ্বিতীয় বর্ণনায় আছে, সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে আল্লাহকে স্মরণ রেখ, তিনি তোমার কষ্টকালে তোমাকে স্মরণ রাখবেন। হাদীছের শব্দ হল تعرف - অর্থ: চিনে নিও। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে আল্লাহকে চিনে নেওয়ার অর্থ আল্লাহকে স্মরণ করা এবং একথা চিন্তা করা যে, এ সুখ ও সাচ্ছন্দ্য আমি আমার বিদ্যা-বুদ্ধি ও চেষ্টা শ্রম দ্বারাই অর্জন করেছি এমন নয়। চেষ্টা করা আল্লাহর হুকুম তাই করেছি, কিন্তু এর প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা'আলাই। তিনি দান না করলে হাজার চেষ্টা করেও আমি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করতে পারতাম না। তো তিনিই যখন এর প্রকৃত দাতা, তখন আমার কর্তব্য এর জন্য তাঁর শোকর আদায় করা। সে শোকর যেমন মৌখিকভাবে আদায় করবে, তেমনি আদায় করবে কাজকর্ম দ্বারাও। অর্থাৎ যখন টাকা-পয়সা থাকে, তখন আল্লাহর পথে তা খরচ করবে, গরীব-দুঃখীকে সাহায্য করবে এবং দীনের অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যয় করবে। যখন স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তখন বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করবে, শারীরিক শক্তি দীনের কাজে লাগাবে এবং সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত থাকবে। যখন মানসিক স্বস্তি থাকে, কোনওরকম পেরেশানি থাকে না, তখন প্রাণভরে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং সর্বান্তকরণে তাঁকে সন্তষ্ট করা ও তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে। সুখ সাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি-শান্তিকে নিজ চেষ্টার ফল মনে করবে না; বরং একান্তই আল্লাহর দান মনে করে তাঁর শোকর আদায়ে লিপ্ত থাকবে। এটাই সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখার অর্থ। যে ব্যক্তি সুখের সময় এভাবে আল্লাহকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলা তার দুঃখকালে তাকে স্মরণ রাখবেন। অর্থাৎ তিনি তখন তার পাশে থাকবেন। তখন তার সাহায্য করবেন। তার সাহায্যে ফিরিশতা নিয়োজিত করবেন। অন্যান্য সৃষ্টিকেও তার সেবায় নিয়োজিত করবেন। তার অন্তরে শক্তি ও সাহস সঞ্চার করবেন। তাকে হিম্মত দেবেন। সর্বোপরি তাকে ধৈর্যের তাওফীক দান করবেন।

ধৈর্যের সংগেই আল্লাহর সাহায্য
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ধৈর্যের সংগেই আল্লাহর সাহায্য। অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য যদি পেতে চাও, তবে সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ করবে।

ইহজীবন কষ্ট-ক্লেশের জীবন। এখানে আছে রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত ও নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাক। যারা মু'মিন-মুত্তাকী, অন্যদের তুলনায় তাদের কষ্ট-ক্লেশ আরও বেশি। তাদেরকে মানুষের তৈরি রেওয়াজ ও প্রচলনের বিপরীত চলতে হয়। তা চলতে গিয়ে মানুষের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হয়। মুকাবিলা করতে হয় তাদের বিরোধিতা ও শত্রুতার। এসব তাদের জন্য বাড়তি বিপত্তি। এছাড়া আল্লাহ তাআলা নানাভাবে তাদের পরীক্ষাও করে থাকেন। তাঁর কাছে সংরক্ষিত পুরস্কার দানের জন্য তাদেরকে অতিরিক্ত বিপদ-আপদ দিয়ে থাকেন। এই যাবতীয় কষ্ট-ক্লেশে সঠিক পথে টিকে থাকতে হলে চাই আল্লাহর সাহায্য। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে এসব ক্ষেত্রে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তো কিভাবে পাওয়া যাবে আল্লাহর সাহায্য? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে আমাদের জানাচ্ছেন, সবর ও ধৈর্যধারণ করলেই আল্লাহর সাহায্য লাভ হয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ اللهَ مَعَ الطيرين

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সংগে।”

অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার ইবাদত-আনুগত্যে ধৈর্যধারণ করে, গুনাহ ব পাপাচার থেকে আত্মরক্ষায় সংযম অবলম্বন করে, বিপদ-আপদে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে, জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকে এবং নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অটল থাকে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এসকল ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। সুতরাং যে-কোনও পরিস্থিতিতে আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য ধৈর্যধারণ অবশ্যকর্তব্য। পূর্বে সবর অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

সংকটের সাথে আছে পরিত্রাণ
অর্থাৎ কোনও দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদই স্থায়ী নয়। অচিরেই তার অবসান হয়।
সুতরাং কেউ বিপদ-আপদে পড়লে এবং কোনও সংকটের সম্মুখীন হলে অস্থির হয়ে পড়া উচিত নয়। বরং এই ভেবে স্বস্তি বোধ করা উচিত যে, এই কষ্ট চিরদিন থাকবে না। এমনকি হবে না দীর্ঘস্থায়ী। হাদীছে বলা হয়েছে, পরিত্রাণ আছে সংকটের সঙ্গে, সাথে থাকার মানে খুব কাছে। অর্থাৎ কোনও সংকট দেখা দিলে তা থেকে পরিত্রাণ লাভে খুব বেশি বিলম্ব হয় না; বরং তাড়াতাড়িই তা থেকে মুক্তি লাভ হয়। তাই পেরেশান না হয়ে কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা এবং সকল সংকটের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশাবাদী হওয়া। আল্লাহ তা'আলা অশেষ দয়াময়। তাঁর প্রতি সুধারণা করা উচিত যে, এ সংকট তিনি দীর্ঘস্থায়ী করবেন না। নিজ বান্দাকে এর থেকে অতিশীঘ্র মুক্তিদান করবেন। এক হাদীছে আছে- আল্লাহ তা'আলা বলেন, বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা রাখে, আমি তার সাথে সেরকম ব্যবহার করে থাকি। এ হাদীছও তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণের উৎসাহ যোগায় এবং সংকটাপন্ন ব্যক্তিকে আস্বস্ত করে যে, তার সংকট অচিরেই মোচন হয়ে যাবে।

কষ্টেরই সাথে রয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ অসিয়তনামার শেষকথা বলেছেন- কষ্টেরই সাথে রয়েছে সাচ্ছন্দ্য। অর্থাৎ কষ্টও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারও কোনও কষ্ট দেখা দিলে শীঘ্রই তা মোচন হয়ে যায়। কষ্টের পর খুব তাড়াতাড়ি স্বাচ্ছন্দ্য চলে আসে। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে-

سَيَجْعَلُ اللهُ بَعْدَ عُسْرِ يُسْران

"অচিরেই আল্লাহ কষ্টের পর স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করে দেবেন।

আরও ইরশাদ হয়েছে-

فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْران إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْران

'প্রকৃতপক্ষে কষ্টের সাথে স্বস্তিও থাকে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তিও থাকে।

এক বর্ণনায় আছে, এ আয়াত তিলাওয়াতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لن يُغلب عسري يرين.

একটি কষ্ট দু'টি স্বস্তির উপর জয়ী হতে পারে না।
কারও মতে এটি হযরত উমর রাযি.-এর উক্তি। কারও মতে হযরত আলী রাযি. এর। এর ব্যাখ্যা এই যে, আয়াতে العسر (কষ্ট) শব্দটি নির্দিষ্টতাবাচক। আর يسر (স্বস্তি ও সাহুলত) শব্দটি অনির্দিষ্টতাবাচক।
অনির্দিষ্টতাবাচক শব্দের পুনরাবৃত্তি হলে তা দ্বারা অর্থের পুনরাবৃত্তি হয় না। বরং উভয় শব্দ আলাদা আলাদা একক বোঝায়। আর নির্দিষ্টতাবাচক শব্দের পুনরাবৃত্তি হলে তার দ্বিতীয়টি দ্বারা হুবহু প্রথমটির অর্থই বোঝানো হয়। সে হিসেবে আয়াতে উভয় العسر দ্বারা একটি কষ্টই বোঝানো হবে। আর يسر দ্বারা বোঝানো হবে পৃথক দুই সাহুলত। অর্থাৎ একটি কষ্টের সংগে দু'টি সাহুলত থাকে। এটা আল্লাহ তা'আলার কতই না মেহেরবানী যে, বান্দা একটি কষ্টের সবর করলে তার বিনিময়ে বান্দাকে নিজ সন্তুষ্টি ও ছওয়াব তো দান করেনই, সেইসংগে দান করেন দু'টি সাহুলত- সুবহানাল্লাহ! এরপরও কি কোনও কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলে অস্থির উতলা হওয়া উচিত? না উচিত কৃতজ্ঞতাবোধের সাথে ধৈর্যধারণ করা?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছও মুরাকাবার শিক্ষা দান করে। বান্দার কর্তব্য সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর প্রতি ধ্যান রাখা যে, তিনি দেখছেন।

খ. দুনিয়া ও আখিরাতের সকল সংকটে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হেফাজত ও পরিত্রাণ লাভের শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে তাঁর বিধি-নিষেধ পালনে যত্নবান থাকা।

গ. মু'মিনের পক্ষে কোনও সৃষ্টির কাছে কিছু চাওয়া বা আশা করা শোভনীয় নয়। সে তো কেবল আল্লাহরই কাছে চাবে এবং সব আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁরই সমীপে ব্যক্ত করবে।

ঘ. এ হাদীছ তাকদীরে বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলেরও শিক্ষা দান করে। তাকদীরে যা লেখা হয়েছে, তার বাইরে কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাকদীরের বাইরে না কোনও দুশমন কোনও ক্ষতি করতে পারে, না কোনও বন্ধু কিছু উপকার করতে পারে। সুতরাং মানুষকে ভয় না করে ও মানুষের কাছে আশাবাদী না হয়ে বান্দার কর্তব্য আল্লাহরই উপর নির্ভর করা ও তাকদীরে অবিচল আস্থা রাখা।

ঙ. তাকদীরের কোনও পরিবর্তন নেই। তা চূড়ান্ত হয়ে আছে। তাতে যা লেখা আছে তাই হবে। তবে বেকার না থেকে কাজকর্ম করতে হবে এবং আসবাব-উপকরণ অবলম্বন করতে হবে, যেহেতু তা করা আল্লাহর হুকুম।

চ. চেষ্টার পর কাঙ্ক্ষিত বিষয় না পেলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, যেহেতু তাকদীরে ছিল না বলে তা পাওয়া যায়নি এবং পাওয়া সম্ভবই ছিল না। এমনিভাবে আশানুরূপ ফল লাভ হলেও দর্পিত ও উল্লসিত হওয়ার সুযোগ নেই, যেহেতু তাকদীরে ছিল বলে তা পাওয়া গেছে এবং পাওয়া যেতই।

ছ. সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখলে দুঃখ-কষ্টের সময় আল্লাহ বান্দার প্রতি লক্ষ রাখেন।
জ. সকল ক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য লাভের একটি অন্যতম প্রধান উপায় ধৈর্যধারণ করা।

ঝ. কষ্ট-ক্লেশে দিশেহারা হওয়া উচিত নয়। কারণ কষ্ট-ক্লেশ, যেন বৃষ্টির আগে মেঘের গর্জন। তার আড়ালেই রয়েছে স্বস্তি ও সুখের অবস্থান। অচিরেই তা আত্মপ্রকাশ করবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান