ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৪২. ইহসান-আত্মশুদ্ধির অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫৭১
জাগতিক বিষয়ে এবং মানুষের বিষয়ে নির্লোভতা ও কৃচ্ছতা
(২৫৭১) সাহল ইবন সা'দ রা. বলেন, একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট আগমন করে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এমন একটি কর্মের পথ নির্দেশ করুন যে কর্ম করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষ আমাকে ভালোবাসবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তুমি দুনিয়ার বিষয়ে লোভহীন হও ও কৃচ্ছতা অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের নিকট যা আছে সে বিষয়ে তুমি লোভহীন হও ও কৃচ্ছতা অবলম্বন করো, তাহলে মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।
عن سهل بن سعد رضي الله عنه قال: أتى النبي صلى الله عليه وسلم رجل فقال: يا رسول الله دلني على عمل إذا أنا عملته أحبني الله وأحبني الناس فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ازهد في الدنيا يحبك الله وازهد فيما في أيدي الناس يحبوك.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বলা হয়েছে যে, জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন যে, এমন কী আমল আছে, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসাও পাওয়া যাবে এবং মানুষেরও ভালোবাসা পাওয়া যাবে?

আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পেয়ে যাওয়া মানবজীবনের আসল উদ্দেশ্য। কাজেই যে উপায়ে তা পাওয়া যাবে তা জানতে চাওয়ার আগ্রহ থাকাই উচিত। এমনিতে তো মানুষ মাত্রই আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসে, যদি না তার আকল-বুদ্ধি বিকৃত হয়ে গিয়ে থাকে। কাউকে ভালোবাসার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তার দিক থেকেও ভালোবাসা পাওয়া। এর জন্য কর্তব্য সে যা পসন্দ করে তা করা আর যা অপসন্দ করে তা থেকে বিরত থাকা। কাজেই কাউকে ভালোবাসলে প্রথমে জানতে হবে সে কী পসন্দ করে আর অপসন্দ করে।

ব্যক্তিবিশেষের বেলায় এটা জানা সহজ। তার সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশার দ্বারা একপর্যায়ে এটা জানা হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলার বেলায় নিজে নিজে এটা জানা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের দেখাশোনা ও ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে। তাঁর ক্ষেত্রে এটা জানা সম্ভব কেবল তাঁর পক্ষ হাতে জানানোর দ্বারাই। এজন্যই এ বিষয়ে নবী-রাসুলের দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা আল্লাহ তা'আলা তাঁর সম্পর্কিত বিষয়াবলী নবী-রাসূলের মাধ্যমেই মানুষকে জানিয়ে থাকেন। সুতরাং ওই সাহাবী এ বিষয়ে জানার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে আসলেন।

মানুষের বেলায় ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে তো তার রুচি-অভিরুচি ও তার ভালো লাগা মন্দ লাগার বিষয়টি তার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন দ্বারা জানা যায়। তার সঙ্গে মেলামেশা করার দ্বারা তা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু সমস্ত মানুষ সম্পর্কে এটা জানা কঠিন যে, কী উপায়ে তাদের সকলের ভালোবাসা পাওয়া যাবে। কেননা এর জন্য এমন কোনও উপায় দরকার, যা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, একেক জনের একেক রুচি ও একেক অভিরুচি। একেক জনের একেক মেযাজ। কোনও এক কাজ করলে একজন খুশি হয় তো আরেকজন নাখোশ হয়ে যায়। তাই নিজের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে এমন কোনও উপায় বের করা সম্ভব নয়, যা দ্বারা সকলকে খুশি করা যাবে। এটাও জানা সম্ভব কেবল আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে। তিনি মানুষের সৃষ্টিকর্তা। একইসঙ্গে সমস্ত মানুষের যা পসন্দ তা তিনিই ভালো জানেন। তাই সাহাবী এ বিষয়টাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জানতে চাইলেন।

প্রকাশ থাকে যে, স্রষ্টা ও মালিক হিসেবে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া যেমন মানুষের জন্য জরুরি, তেমনি সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের ভালোবাসা না পেলেও সমাজের একজন হয়ে বসবাস করা কঠিন। সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য সমাজের কাছে সমাদৃত হওয়ার কোনও বিকল্প নেই। এটা দরকার শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্যও।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসার উত্তরে বললেন- ازهد في الدنيا يُحِبُّكَ الله (তুমি দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ দুনিয়ার যেসব বিষয়ের প্রয়োজন নেই এবং যা না হলেও চলে তা পাশ কাটিয়ে চলো। তাহলে তুমি আল্লাহর ভালোবাসা পাবে। তুমি যদি দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়, তবে আল্লাহর ভালোবাসা পাবে না। কেননা দুনিয়ার আসক্তি সমস্ত গুনাহের মূল।

যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, সে দুনিয়া পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলে। যে-কোনও উপায়ে সে দুনিয়ার সবকিছু পেতে চায়। সম্পদের জন্য সে হারাম পন্থা অবলম্বনেও দ্বিধাবোধ করে না। ক্ষমতার জন্য মানুষ খুন করতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। দুনিয়া যত পায় ততোই অন্ধ হয়ে যায়। ফলে সে কোনও পন্থার মধ্যে দোষ দেখে না। প্রথমে মাকরূহ পন্থা অবলম্বন করে। তারপর অবৈধ পথ ধরে। শেষপর্যন্ত দুনিয়ার জন্য প্রয়োজনে ঈমানও বিক্রি করে দেয়। দুনিয়ার যত বড় বড় পাপী, তারা পাপী হয়েছে দুনিয়ার মোহে পড়েই।

কারুন মহাপাপী হয়েছিল সম্পদের মোহে। নমরূদ ও ফিরআওন নিজেদের খোদা পর্যন্ত দাবি করেছিল। সেখানেও কার্যকর ছিল ক্ষমতার আসক্তি। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নরহত্যার অপরাধ হয়েছিল দুনিয়ার আসক্তিতেই। নারীর আসক্তি। সেও দুনিয়াই বটে।

দুনিয়ার আসক্তি মানুষকে প্রকাশ্য ও গুপ্ত সর্বপ্রকার পাপে উৎসাহ যোগায়। পিছিয়ে রাখে সৎকর্ম হতে। দুনিয়াপ্রেমী মানুষ বেশি সৎকর্ম করতে পারে না। এমনকি দুনিয়াপ্রেম মানুষকে ঈমান আনা হতেও বিরত রাখে। নবী-রাসুলগণের ইতিহাসে দেখা যায় তাদের ডাকে কেবল ওইসব লোকই সাড়া দেয়নি, যারা দুনিয়া তথা অর্থ বা ক্ষমতার মোহে নিমজ্জিত ছিল। তাছাড়া দুনিয়াদার লোক কোনও ভালো কাজ করলেও তাতে থাকে মানুষকে দেখানোর মনোভাব। অন্তরে ইখলাস থাকে না। একদিকে তারা বেশি বেশি পাপ করে, অন্যদিকে থাকে সৎকর্মবিহীন। এরূপ মানুষ আল্লাহর ভালোবাসা কিভাবে পেতে পারে? আল্লাহ তা'আলা সৎকর্মশীলকে ভালোবাসেন। অসৎকর্মশীলকে ঘৃণা করেন। কুরআন মাজীদ জানাচ্ছে-
وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
এবং সৎকর্ম অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। অন্যত্র ইরশাদ-
وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ
"আর আল্লাহ এমন প্রতিটি লোককে অপসন্দ করেন যে নাশোকর, পাপিষ্ঠ।"

দ্বিতীয় জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন- وَازْهَدْ فِيمَا عِنْدَ النَّاسِ يُحِبُّكَ النَّاسُ ( মানুষের কাছে যা আছে তার প্রতিও নিরাসক্ত হও, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে)। কেউ যদি মালওয়ালার মালের দিকে তাকায় এবং তার জন্য লালায়িত হয়, তবে সেই মালওয়ালা তাকে ঘৃণা করবে। কেউ যদি ক্ষমতাসীনের ক্ষমতার লোভ করে, তাহলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববে এবং তাকে শত্রু গণ্য করবে। এটা সমস্ত মানুষের এক সাধারণ স্বভাব। অন্যসব রুচি-অভিরুচিতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও পার্থক্য নেই। কেউ তার নিজ পরিমণ্ডলে অন্যের লোভ লালসা পসন্দ করে না।

পক্ষান্তরে যারা দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করে, দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতা কোনওকিছুর প্রতি লোভ করে না, তাদেরকে কেউ নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না। বরং তাদের প্রতি সকলেরই অন্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে। এমনকি বড় বড় দুনিয়াদার, দুনিয়ার অর্থ বা ক্ষমতার নেশায় যারা বুঁদ, তারা পর্যন্ত এরকম দুনিয়াবিমুখ যাহিদদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করে থাকে।

হাসান বসরী রহ. বলেন, মানুষ অন্যদের চোখে ততোদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন থাকে, যতদিন না তারা তাদের দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসা করে। যেই না লোভে পড়ে যায়, অমনি তাদের দৃষ্টিতে মর্যাদা হারায়।

বসরার কোনও এক লোককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তোমাদের নেতা ও মান্যজন কে? সে উত্তর দিয়েছিল, হাসান বসরী। জিজ্ঞেস করা হল, কিভাবে তিনি তোমাদের নেতায় পরিণত হলেন? উত্তর দিল, আমরা তাঁর ইলমের মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি আমাদের দুনিয়াকে পাত্তা দেন না।

প্রকাশ থাকে যে, মানুষের হাতে যা আছে বলতে বিশেষভাবে তার মালিকানাধীন বিষয়ই যে বোঝানো উদ্দেশ্য তা নয়; বরং সাধারণভাবে দুনিয়াদারী বোঝানো উদ্দেশ্য। সম্পদশালীর মালিকানাধীন যে সম্পদ, ভাতে যে ব্যক্তি লোভ করে তাকে তো সে পছন্দ করেই না, এমনকি কেউ যদি ব্যবসা-বাণিজ্য করে বা অন্য কোনও সূত্রে তার মতো সম্পদশালী হতে চায়, তাকেও সে ভালোবাসে না। দুনিয়াবী যে-কোনও বিষয় কারও করায়ত্ত থাকলে সে সেই ক্ষেত্রে নিজেকে অন্যের উপরে দেখতে ভালোবাসে। যেই না অন্য কেউ তার সমপর্যায়ে পৌছানোর চেষ্টা করে, অমনি তার অন্তরে তার প্রতি এক রকম বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যায়। সুতরাং এ হাদীছের মর্ম আমরা এরকম বুঝতে পারি যে, মানুষের কাছে প্রিয় কেবল সেই ব্যক্তিই হতে পারে, যার দুনিয়ার কোনওকিছুর প্রতি লোভ-লালসা নেই। না ব্যক্তিবিশেষের হস্তগত বিষয়ের প্রতি, না সাধারণভাবে পার্থিব বস্তুরাজির প্রতি। বরং দুনিয়ার ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নির্মোহ জীবনযাপন করে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আল্লাহপ্রেমিককে দুনিয়ার প্রেম ছাড়তে হবে। তাকে দুনিয়ার প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিরাসক্ত থাকতে হবে।

খ. মানুষের ভালোবাসা পেতে চাইলে তার সম্পদ থেকে কিছু পাওয়ার লোভ করা যাবে না। তার ক্ষমতায়ও ভাগ বসানোর চেষ্টা হতে বিরত থাকতে হবে।

গ. একইসঙ্গে আল্লাহ ও মানুষের ভালোবাসা কেবল সেই পায়, যে সাধারণভাবে পুরোপুরি নির্মোহ জীবনযাপন করে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান