আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫৮৮
আন্তর্জতিক নং: ৬০১৩

পরিচ্ছেদঃ ৩১৮৯. মানুষ ও পশুর প্রতি দয়া।

৫৫৮৮। উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) ......... জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (স্রষ্টার পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হবে না।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এ হাদীছ দ্বারা মানুষের প্রতি দয়া করার গুরুত্ব জানা যায়। এতে জানানো হয়েছে মানুষের প্রতি দয়া না করলে আল্লাহর দয়া পাওয়া যায় না। অথচ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে মানুষ আল্লাহ তা'আলার দয়ার মুখাপেক্ষী। আখেরাতে আল্লাহ তা'আলার রহমত ও দয়া ছাড়া কেউ নাজাত পাবে না। দুনিয়ায়ও তাঁর রহমত ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। এক তো আছে তাঁর সাধারণ রহমত, যা তিনি সবার জন্য অবারিত রেখেছেন। পাপী-তাপী, মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলেই তাঁর সে রহমত ভোগ করছে। ফলে হাজারও রকম পাপকর্ম ও অন্যায়-অনাচার করা সত্ত্বেও আমরা বেঁচে আছি। পাপকর্মের দরুন তিনি দুনিয়ায় পাপী ব্যক্তিকে ধ্বংস করছেন না। এটা তাঁর সাধারণ রহমতের প্রকাশ। আরেক হচ্ছে তাঁর খাস রহমত, যা মানুষ তার ভালো কাজের কারণে পেয়ে থাকে। নেক আমলের কারণে খুশি হয়ে আল্লাহ তা'আলা বান্দার প্রতি তা বর্ষণ করে থাকেন। আখেরাতে মুমিনদের মুক্তিও তাঁর সেই খাস রহমতের দ্বারাই লাভ হবে। এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার সেই খাস রহমত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তা'আলাও তার প্রতি দয়া করেন না। মানুষের প্রতি দয়া করার অর্থ মানুষকে ভালোবাসা ও তাদের প্রতি সদাচরণ করা। দুর্বলের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা, অন্যের আনন্দে নিজেও আনন্দ বোধ করা এবং অন্যের দুঃখ কষ্টে তার পাশে দাঁড়ানো ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তার কষ্ট লাঘবে ভূমিকা রাখা, এ সবই মানুষের প্রতি দয়া ও রহমত করার অন্তর্ভুক্ত। বিষয়টি অতি ব্যাপক। শিশুর প্রতি স্নেহ-মমতামূলক যে কোনও আচরণই তার প্রতি রহমতের শামিল। এটা কেবল শিশুর বেলায়ই নয়; বরং নিজের চেয়ে ছোট যে-কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হাদীছে ছোটকে স্নেহ করার বিশেষ তাগিদ এসেছে। ছোটকে স্নেহ করা যেমন তার প্রতি রহমত হিসেবে গণ্য, তেমনি নিজের চেয়ে বড়কে ভক্তি-শ্রদ্ধা করাও রহমতেরই আচরণ। যেমন এক হাদীছে আছেঃ- ما من ولد بار ينظر إلى والديه نظرة رحمة إلا كتبه الله له بكل نظرة حجة مبرورة 'যে-কোনও নেক সন্তান তার পিতামাতার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকায়, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকবার তাকানোর বিনিময়ে তার জন্য একটি মকবুল হজ্জের ছাওয়াব লেখেন। এমনিভাবে ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া, তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো, কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবাযত্ন করা, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, ভারবাহী ব্যক্তির মাথা থেকে ভার নামাতে সহযোগিতা করা বা তার মাথায় তা তুলতে সাহায্য করা, অন্যের ভার লাঘবে ভূমিকা রাখা, অন্ধ ব্যক্তিকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া, বেকার ও কর্মহীন ব্যক্তিকে কাজ জুটিয়ে দেওয়া, যে-কোনও দুস্থের সাহায্য করা, দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা এবং সর্বপ্রকার বিপন্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তাদের প্রতি দয়া ও রহমত করা বলে গণ্য হবে। এর বিপরীতে অন্যের আনন্দে আনন্দ বোধ করা, যেমন কেউ রোগ-ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করলে তার প্রতি খুশি প্রকাশ করা, কারও সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে মুবারকবাদ জানানো ও দু'আ করা, নতুন বিবাহিত বা বিবাহিতাকে শুভেচ্ছা জানানো ও দু'আ দেওয়া, কারও আয়-রোজগারে উন্নতি দেখলে আনন্দ প্রকাশ করা ইত্যাদি বিষয়গুলোও রহমতেরই আচরণ। এ হাদীছে সাধারণভাবে মানুষের প্রতি রহমতের আচরণ করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একজন মুমিনের কাছে রহমতের আচরণ কেবল মুমিন-মুসলিমগণ পাবে তাই-ই নয়; বরং তার পক্ষ থেকে সমস্ত মানুষের জন্যই তা অবারিত থাকবে। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের প্রতি দয়ার আচরণ করা ঈমানেরই দাবি। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- المؤمن من أمنه الناس 'মুমিন সেই ব্যক্তি, যার দিক থেকে সমস্ত মানুষ নিরাপদ থাকে। সুতরাং একজন মুমিন ও মুসলিম ব্যক্তি দুনিয়ার সমস্ত মানুষের প্রতিই সদয় আচরণ করবে। অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত, দুস্থ ও বিপন্নের সাহায্য করার ক্ষেত্রে সে মুসলিম অমুসলিম প্রভেদ করবে না। তার প্রতিবেশী যদি ইহুদী বা হিন্দুও হয়, তবুও সে তার জন্য শান্তিদায়ী হবে। কোনও অমুসলিমের প্রতি সবচে' বড় রহমতের আচরণ হল তাকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়া এবং কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে তাকে ইসলামের আলোর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। কেননা কোনও ব্যক্তির মৃত্যু যদি ঈমানের সঙ্গে না হয়, তবে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কাজেই কারও সেই অনন্ত আযাব থেকে মুক্তিলাভের ব্যবস্থা করার মত রহমতের আচরণ তার প্রতি আর কী হতে পারে? অপরাপর হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, মুসলিম ব্যক্তি কেবল মানুষই নয়; বরং সমস্ত জীবের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। হাদীছে পিঁপড়েকেও পুড়ে মারতে নিষেধ করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পশু জবাইয়ের সময় ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নিতে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে-কোনও জীবিত প্রাণীর প্রতি দয়া করলে ছাওয়াব পাওয়া যায়। এমনকি পাখিরা যদি কারও লাগানো গাছের ফল খায়, তাতেও সে সদাকার ছাওয়াব পায়। মোটকথা আল্লাহ তা'আলার রহমত লাভের প্রত্যাশীকে তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি রহমদিল হয়ে থাকতে হবে। তবেই সে দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর অফুরন্ত রহমতের পাত্র হতে পারবে। এ হাদীছ বলছে, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি রহমত করে না, আল্লাহও তার প্রতি রহমত করেন না। এটা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ‍ কেউ যদি দুনিয়ায় অন্যের প্রতি সদয় আচরণ না করে, তবে সে দুনিয়ায়ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে। তা এভাবেও হতে পারে যে, সে যেহেতু অন্যের আনন্দে নিজে আনন্দ বোধ করেনি, তাই অন্যরাও তার আনন্দে পুলক বোধ করবে না। ফলে আনন্দের মধ্যেও তাকে একরকম নিরানন্দের যাতনা ভোগ করতে হবে। এমনিভাবে অন্যের বিপদে সে যেহেতু পাশে দাঁড়ায়নি, তাই সে তার নিজের বিপদেও কাউকে পাশে পাবে না। সেইসঙ্গে ছাওয়াব থেকে মাহরূম থাকার ব্যাপার তো আছেই। যা তার পরকালীন এক অপূরণীয় ক্ষতি। এমনকি রহমতের আচরণ না করার দ্বারা যদি অন্যের প্রতি জুলুম হয়ে যায়, তবে তো জাহান্নামের শাস্তিরই ভয় রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যের প্রতি রহমত ও দয়ার আচরণ করলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে। আখেরাতে রয়েছে জান্নাতের অভাবনীয় পুরস্কার আর দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার জীবন। জীবনের সর্বাবস্থায় সে আল্লাহর রহমত লাভ করবে। অন্যের প্রতি ভালো ব্যবহার করার কারণে আল্লাহ তা'আলা ফিরিশতা তো বটেই, এমনকি মানুষকেও তার সাহায্য-সহযোগিতায় নিযুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ- إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ “নিশ্চয়ই যারা ভালো কাজ করে, আল্লাহর রহমত তাদের নিকটবর্তী। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ “উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে? অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ইহসানের আচরণ করবে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেও তারা দয়ার আচরণ লাভ করবে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. এ হাদীছ দ্বারা মানুষের প্রতি সদয় আচরণের গুরুত্ব জানা যায় যে, এটা না করলে তার পরিণাম হয় আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকা। সুতরাং আমরা সদাসর্বদা মানুষের প্রতি সদয় আচরণে বদ্ধপরিকর থাকব। খ. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামের উদারতা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। ইসলাম দয়া ও রহমতের আচরণ কেবল মুসলিমদের প্রতিই সীমাবদ্ধ রাখতে বলেনি; বরং মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের প্রতিই সদয় থাকার শিক্ষা দিয়েছে। গ. এ হাদীছ যেহেতু অন্যের প্রতি দয়া ও রহমত না করলে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় বলে সতর্ক করেছে, তাই এর দ্বারা আল্লাহর রহমত মানুষের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ তাও উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর রহমতের মধ্যে ডুবিয়ে রাখুন, আমীন।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন