ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার
৪২. ইহসান-আত্মশুদ্ধির অধ্যায়
হাদীস নং: ২৫৫৮
মুসলিমের বেদনা দূর করা, দোষ গোপন করা, সাহায্য করা ও কষ্টগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করার মর্যাদা
(২৫৫৮) আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো মুমিনের জাগতিক দুঃখ-বেদনা দূর করে তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-বেদনা দূর করবেন। যদি কেউ কোনো কষ্টগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করে তবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার কষ্ট লাঘব করবেন । যদি কেউ কোনো মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন করে তবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন। যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে ততক্ষণ আল্লাহ তার সাহায্য করতে থাকেন।
عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعا: من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة ومن يسر على معسر يسر الله عليه في الدنيا والآخرة ومن ستر مسلما ستره الله في الدنيا والآخرة والله في عون العبد ما كان العبد في عون اخيه
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। এতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আমলের ফযীলত তুলে ধরা হয়েছে। জীবনগঠনের লক্ষ্যে এ হাদীছটি প্রত্যেক মুমিনের জন্য মাইলফলকের কাজ করতে পারে। আমাদের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এটি পড়া ও হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা। আমরা একটি একটি করে এতে বর্ণিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
মুমিন ব্যক্তির কষ্ট নিরসন করার ফযীলত
বলা হয়েছে- من نفس عن مؤمن كربة (যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের একটি কষ্ট দূর করে দেয়)। نفس শব্দটির উৎপত্তি تنفيس থেকে। এর অর্থ অপসারণ করা, শিথিল করা, ফাঁক করা ইত্যাদি। تنفيس -এর উৎপত্তি نفس থেকে, যার অর্থ নিঃশ্বাস, দম ও প্রাণ। বলা হয়, نفس الخناق (গলার বাঁধন শিথিল করল), যাতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে।
كربة অর্থ এমন দুঃখ-কষ্ট, যা মানুষের হৃদয়মন আচ্ছন্ন করে এবং তাকে এমনভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে, যদ্দরুন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট।
হাদীছে বোঝানো হচ্ছে, কোনও কোনও দুঃখ-কষ্ট এমন তীব্র হয়ে থাকে, যদ্দরুন মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। তার সে কষ্ট লাঘব করার দ্বারা যেন গলার বাঁধন শিথিল করা হয়। ফলে সে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। তো কারও এরকম দম বন্ধ করা দুঃখ-কষ্ট যে ব্যক্তি লাঘব করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি এমন খুশি হন যে, তিনি কিয়ামতের দিন তার একটি শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট দূর করে দেবেন। এ হাদীছে জানানো হয়েছে- نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة (আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন)। এর দ্বারা অন্যের কষ্ট লাঘব করা-যে কত বড় ফযীলতের কাজ তা অনুমান করা যায়। কেননা আখেরাতের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়। মান ও পরিমাণ উভয়দিক থেকেই তা তুচ্ছ। আখেরাতের তুলনায় তার স্থায়িত্বও অনেক কম। বড়জোর মৃত্যু পর্যন্ত। তো কারও এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এমন কষ্ট, যা কোনও দিক থেকেই আখেরাতের কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তা দূর করার দ্বারা পরকালীন দুর্বিষহ কোনও কষ্ট থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত বড়ই না প্রাপ্তি।
আখেরাতের এ অতুলনীয় পুরস্কার অর্জন করাও বিশেষ কঠিন কিছু নয়। দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের খানিকটা ব্যয় করেই এটা হাসিল হতে পারে। এমনিভাবে তা অর্জন হতে পারে নিজ ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ, সুপরামর্শ দান, কিছুটা শারীরিক শ্রম ব্যয়, নিজে সরাসরি বা লোকমারফত সুপারিশ করা, একটা চিঠি লিখে দেওয়া কিংবা ফোনে একটা কথা বলার দ্বারাও। অন্ততপক্ষে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও তো করা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ, তুমি অমুকের কষ্ট দূর করে দাও। এসবই আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সে মহান পুরস্কার লাভের এক কার্যকর উপায়। বিভীষিকাময় কিয়ামতের ঘোর কষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভের আশায় আমরা কি এ উপায় অবলম্বন করব না?
সুতরাং দুনিয়ায় কারও একটি বিপদ দূর করার দ্বারা যদি আখেরাতের একটি বিপদ দূরীভূত হয়, তবে সে প্রাপ্তি অনেক বড়। প্রত্যেক মুমিনের এটা কাম্যও বটে।
হাশর ময়দানের বিভীষিকা
দুনিয়ার কষ্ট-পেরেশানি অপেক্ষা আখেরাতের কষ্ট ও পেরেশানি-যে কত বেশি কঠিন, তা যথাযথভাবে অনুমান করাও সম্ভব নয়। কেননা এক তো জিজ্ঞাসাবাদ ও হিসাব-নিকাশ করার জন্য সমস্ত মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে হাজির করা হবে। ইরশাদ হয়েছেঃ- يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ‘যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়ানোটাই তো চরম কঠিন ব্যাপার।তদুপরি সেদিনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি তো হবে অত্যন্ত বিভীষিকাময়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- يجمع الله الأولين والأخرين في صعيد واحد، فيسمعهم الداعي وينفذهم البصر وتدنو الشمس منهم، فيبلغ النّاس من الغم والكرب ما لا يطيقون ولا يحتملون، فيقول الناس بعضهم لبعض : ألا ترون ما قد بلغكم؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم؟ ‘আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্র করবেন। ঘোষক তার ঘোষণা তাদের সকলকেই শুনিয়ে দেবে, দৃষ্টিশক্তি তাদের সকলকে ভেদ করবে এবং সূর্য তাদের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। ফলে মানুষের এতটা পেরেশানি ও অস্থিরতা দেখা দেবে, যা তারা সইতে পারবে না ও বরদাশত করতে সক্ষম হবে না। ফলে মানুষ একে অন্যকে বলবে, দেখছ না তোমরা কী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছ? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যে তোমাদের জন্য তোমার প্রতিপালকের কাছে সুপারিশ করবে?" হাদীছটিতে এর পরে শাফাআতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছেঃ- يحشرون حفاة عراة غرلا، قالت: فقلت: يا رسول الله! الرجال والنساء؟ ينظر بعضهم إلى بعض؟ فقال: الأمر أشد من أن يهمهم ذلك 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হাশরের ময়দানে তোমাদেরকে খালিপায়ে, বস্ত্রহীন ও নগ্ন অবস্থায় একত্র করা হবে। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নারী-পুরুষ সকলে? তাদের একজন অন্যজনকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন, সেদিনকার অবস্থা অনেক কঠিন। তাদের ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করারই অবকাশ হবে না।
সেদিনের বিভীষিকা ও ভয়াবহতার কারণে নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত অত্যন্ত ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাঁরা প্রত্যেকে বলতে থাকবেন, اللهم سلم سلم 'হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।" সেই কঠিন দুর্দিনে দুনিয়ার যেসকল আমল কাজে আসবে, তার একটি হচ্ছে অন্যের বিপদ-আপদ দূর করতে ভূমিকা রাখা, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে।
অভাবগ্রস্তের অভাবের কষ্ট লাঘব করার ফযীলত
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সৎকর্মরূপে অভাবগ্রস্তের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ- ومن يسر على معسر (যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়)। معسر এর অর্থ অভাবগ্রস্ত। শব্দটির উৎপত্তি عسر থেকে। এর অর্থ কষ্ট। অর্থাভাব দ্বারা মানুষের নানারকম কষ্ট হয়ে থাকে। তাই অভাবগ্রস্তের নামই দেওয়া হয়েছে معسر ।
অভাবগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করা যায় বিভিন্নভাবে। সে যদি কারও কাছে ঋণগ্রস্ত হয় আর সে তার ঋণ মওকুফ করে দেয়, তাতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঋণশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারাও আসানী লাভ হয়। পাওনাদারের কাছে নিজে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে পাওনা মওকুফ করা বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দ্বারাও কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করা হয়। যদি সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, সে তো অনেক ভালো। এর প্রত্যেকটিই অনেক বড় ফযীলতের কাজ।
এ হাদীছে এর ফযীলত জানানো হয়েছে এই যে يسر الله عليه فى الدنيا والا خرة (আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন)। দুনিয়ায় কষ্ট লাঘব হতে পারে অর্থসংকট দূর করার দ্বারা, বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার দ্বারা, বিভিন্ন রকম নেককাজের তাওফীক দ্বারা ইত্যাদি। আর আখেরাতের কষ্ট লাঘব হতে পারে হিসাব নিকাশ সহজ করার দ্বারা, গুনাহের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দ্বারা, হাশরের ময়দানের বিভীষিকায় নিরাপত্তাদান দ্বারা ইত্যাদি।
দুনিয়ায় মানুষের যত দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অভাব-অনটনের কষ্টই সবচে' বড়। তাই কারও এ কষ্ট লাঘবের পুরস্কারকে আল্লাহ তাআলা কেবল পরকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতেই ব্যাপক করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এটা আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী! একজনের অর্থকষ্ট দূর করার দ্বারা তাঁর অনুগ্রহে দুনিয়ারও ফায়দা হাসিল হয় এবং আখেরাতেরও।
দুনিয়ায় মানুষ তার বিভিন্ন রকম কষ্ট-ক্লেশ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম অন্যের অর্থকষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করাও কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায়। আবার এর দ্বারা আখেরাতের কষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা মুক্তি দান করেন, যা কিনা প্রত্যেক মুমিনের পরম কাম্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় কাজ নিজেও অনেক করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমাদেরকেও করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পাওনাদার ও দেনাদারের বাদানুবাদ শুনতে পান। তারা উঁচু আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছিল। একজন অন্যজনকে অনুরোধ করছিল যেন পাওনার অঙ্ক থেকে কিছুটা কমিয়ে দেয় এবং তার প্রতি একটু সদয় হয়। অন্যজন আল্লাহর নামে কসম করে বলছিল, কিছুতেই তা করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন أين المتألي على الله، لا يفعل المعروف؟ فقال: أنا يا رسول الله، وله أي ذلك أحب 'কই সে, যে সদয় আচরণ করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে? এ কথা শুনে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি। সে যা চায় তাই হবে।
এক হাদীছে ইরশাদ من سره أن ينجيه الله من كرب يوم القيامة، فلينفس عن معسر أو يضع عنه “যে ব্যক্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলা যেন কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দান করেন, সে যেন অভাবগ্রস্তকে সুযোগ দান করে অথবা তার দেনা মওকুফ করে দেয়।
এ হাদীছটি হযরত আবূ কাতাদা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি এক ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা পেতেন। সে ছিল গরীব। টাকা দিতে না পেরে তাঁকে দেখে পালাত। একবার হযরত আবূ কাতাদা রাযি. তাকে গিয়ে ধরলেন। সে তার অর্থসংকটের কথা জানাল। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে এ হাদীছটি বর্ণনা করলেন এবং তার দেনা মওকুফ করে দিলেন।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله 'যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা তার দেনা মওকুফ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে (হাশরের ময়দানে) নিজ (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন كان رجل يداين الناس، فكان يقول لفتاه إذا أتيت معسرا فتجاوز عنه، لعل الله يتجاوز عنا، فلقي الله فتجاوز عنه ‘জনৈক (ব্যবসায়ী) ব্যক্তি মানুষের কাছে বাকিতে মাল বিক্রি করত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনও অভাবগ্রস্তের কাছে মাল বিক্রি করলে তাকে ছাড় দিও, হয়তো এ অসিলায় আল্লাহ আমাদেরকেও ছাড় দেবেন। অতঃপর সে আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এ কারণে মুক্তি দিয়ে দেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে দুনিয়ায় কী কী নেক আমল করেছে তা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। বারংবার জিজ্ঞাসার পর পরিশেষে তার গরীব ভোক্তাকে ছাড় দেওয়ার কথাটি মনে পড়ল। সে এ কথাটি আল্লাহ তাআলাকে জানালে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে বান্দা! তুমি গরীবকে ছাড় দিতে! ছাড় দেওয়ার বিষয়টা তো আমাকেই বেশি সাজে। সুতরাং তিনি তাকে আযাব না দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
গরীব-দুঃখীর কষ্ট লাঘবে সহায়তা করাটা দুআ কবুলের পক্ষেও সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من أراد أن تستجاب دعوته، وأن تكشف كربته، فليفرج عن معسر “যে ব্যক্তি কামনা করে তার দুআ কবুল হোক এবং তার পেরেশানি দূর হোক, সে যেন অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের চেষ্টা করে।
মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা
এ হাদীছে বর্ণিত আরেকটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা। বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করে)। মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করার অর্থ হয়তো খোদ তাকেই শত্রু বা জালেম শাসক থেকে আড়াল করা, যাতে তারা তার কোনও ক্ষতি করতে না পারে। অথবা এর অর্থ তার দোষত্রুটি গোপন করা। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপকর্ম করে না সে যদি গোপনে এমন কোনও অপরাধ করে বসে, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তবে কেউ কোনওভাবে তা জেনে ফেললে তার উচিত নিজের মধ্যেই তা রেখে দেওয়া, অন্যের কাছে প্রকাশ না করা। অন্যের দোষ গোপন করা আল্লাহ তাআলার গুণ। তিনি সাত্তারুল উয়ুব- দোষ গোপনকারী। তাঁর আশেক বান্দার কর্তব্য এ গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাতে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন এবং তার প্রতিও তিনি অনুরূপ আচরণ করবেন।
সুতরাং এ হাদীছে জানানো হচ্ছে- ستره الله فى الدنيا والاخرة (আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে আড়াল করবেন)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও তার দোষ প্রকাশ করে মানুষের সামনে অপদস্থ করবেন না এবং আখেরাতেও তার পাপসমূহ জাহির করে কুল মাখলুকের সামনে তাকে হেয় করবেন না; বরং নিষ্পাপ ব্যক্তির মত জাহান্নাম থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়ে দেবেন।
আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া
এ হাদীছে বর্ণিত ফযীলতপূর্ণ আরেকটি আমল হল আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য সহযোগিতা করে যাওয়া। হাদীছে এ আমলটিকে সাধারণভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশেষ কোনও ক্ষেত্রের সাহায্যের কথা বলা হয়নি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- والله فى عون العبد ما كان العبد في عون أخيه (বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন)। মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় যেমন দীনী বিষয়ে, তেমনি প্রয়োজন হয় দুনিয়াবী বিষয়েও।মানুষের কখনও অর্থ-সাহায্যের প্রয়োজন হয়, কখনও অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, কখনও দরকার পড়ে চিকিৎসা-সহযোগিতার, কখনও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি দুর্যোগে উদ্ধার সহযোগিতা ও ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন হয়। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বেকার এবং এ জাতীয় অন্যান্য অসহায় লোকদের প্রয়োজন কর্মসংস্থানসহ নানামুখী সহযোগিতা। আসলে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন বিচিত্র ও বহুমুখী। একেকজনের একেকরকম ঠ্যাকা। এর তালিকা অনেক দীর্ঘ। জীবনচলার ক্ষেত্রে যার যা প্রয়োজন তা পূরণ করার সামর্থ্য যার আছে তার উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে সে প্রয়োজন পূরণে নিজের সে সামর্থ্য ব্যয় করা। যে ব্যক্তি তা করবে এবং যতদিন করবে, ততদিন সে আল্লাহর পক্ষ হতেও সাহায্য পেতে থাকবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
কারও প্রয়োজন দীনী বিষয়ে সাহায্যের। আমলোকের দরকার বিভিন্ন দীনী বিষয়ে নির্দেশনার। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না তাকে কুরআনপাঠ শেখানো, যে ব্যক্তি ওযূ-গোসল, নামায-রোয়া প্রভৃতি দীনী জরুরি মাসাইল জানে না তাকে এসব বিষয়ক মাসাইল শেখানো, যার আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত নয় তাকে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস শেখানো, যে ব্যক্তি হালাল-হারামের পার্থক্য সম্পর্কে খবর রাখে না তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদি সবই দীনী সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় মানুষ এমন জটিল মাসআলার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, যার সমাধান ছাড়া তার পার্থিব জীবন অচল হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সঠিক সমাধানদান যেমন দীনী সাহায্য, তেমনি তা দুনিয়াবী সাহায্যও বটে।
মানুষের সাহায্য করা যায় মনের শুভেচ্ছা ও নেক দুআ দ্বারা, সাহায্য করা যায় শারীরিক সক্ষমতা দ্বারা, সাহায্য করা যায় বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা এবং সাহায্য করা যায় অর্থব্যয় দ্বারাও। আবার অনেক সময় পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির বৈধ ব্যবহার দ্বারাও মানুষের অনেক বড় সাহায্য করা যায়। সুপরামর্শ ও সুপারিশও সাহায্যের এক বড় উপায়। মোটকথা যার পক্ষে যেভাবে কারও সাহায্য করা সম্ভব, তার উচিত সেভাবেই তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভার্থে তিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে তো জীবনভরই এ কাজে আন্তরিক থেকেছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিষয়ক ঘটনা আছে বহু। একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।
একটি ঘটনা
হিজরতের আগের কথা। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসা । তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাহাবীও আছেন। এ অবস্থায় 'যুবায়দ' গোত্রীয় এক ব্যক্তি এগিয়ে আসল। সে বলছিল, 'হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কিভাবে তোমাদের কাছে পণ্য নিয়ে আসা হবে? কিভাবে কোনও ব্যবসায়ী তোমাদের আঙিনায় আসবে? কেউ তোমাদের এলাকায় আসলে তোমরা তাদের প্রতি জুলুম কর'। সে এসব কথা বলছিল আর লোকজনের একেক জটলার সামনে দাঁড়াচ্ছিল। পরিশেষে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে পৌছল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমার প্রতি জুলুম করেছে?
সে জানাল যে, সে তার শ্রেষ্ঠ তিনটি উট নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু আবূ জাহল দাম-দর করতে গিয়ে উটগুলোর দাম বলল তার প্রকৃত মূল্যের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ। আবূ জাহল এ দাম বলার কারণে আর কেউ তার উপর দিয়ে দাম বলল না। তারপর সে বলল, আবূ জাহল আমার পণ্য অচল করে দিয়েছে। সে এভাবে আমার উপর জুলুম করেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার উটগুলো কোথায়?
সে জায়গার নাম বলল।
তিনি উঠে সেখানে গেলেন। সঙ্গে সাহাবীগণও। তিনি দেখলেন, খুবই উঁচু মানের উট। তারপর তিনি যুবায়দী লোকটিকে সেটির দাম বললেন। একপর্যায়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত দামে উপনীত হলেন। লোকটি উপযুক্ত দাম পেয়ে তাঁর কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিল। তিনি তা থেকে দুটি উট ওই দামেই বিক্রি করে দিলেন। একটি বিক্রি করলেন আরও বেশি দামে। তিনি সেটির মূল্য আব্দুল মুত্তালিবের আওলাদের মধ্যকার বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন।
আবূ জাহল বাজারের এক প্রান্তে বসা ছিল। সে সবকিছু দেখছিল, কিন্তু কোনও কথা বলছিল না। শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন
হে আমর্ (এটা আবূ জাহলের আসল নাম)! সাবধান, এই বেদুঈনের সঙ্গে যা আচরণ করলে ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে এমন করো না যেন। করলে কিন্তু আমার পক্ষ থেকে যে ব্যবহার পাবে তা তোমার প্রীতিকর বোধ হবে না।
উত্তরে আবূ জাহল বলছিল, হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না। হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসলেন।
ওদিকে উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং উপস্থিত অন্যান্য লোকজন অবাক বিস্ময়ে এ দৃশ্য লক্ষ করছিল। শেষে তারা আবূ জাহলকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি আজ মুহাম্মাদের হাতে বড় অপদস্থ হলেন। তবে কি আপনি তার অনুসরণ করবেন বলে মনস্থ করেছেন? নাকি কোনও কারণে তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন?
আবূ জাহল বলল, আমি জীবনেও তার অনুসরণ করব না। বাকি তোমরা যে দৃশ্য দেখেছ তার কারণ, আমার চোখ এমনকিছু দেখেছে যা তোমরা দেখনি। আমি দেখলাম, তার ডানে ও বামে বর্শাধারী কিছু লোক। তারা সেগুলো আমার দিকে তাক করে আছে। আমি তার অবাধ্য হলে সেই বর্শা দিয়ে তারা আমাকে গেঁথে ফেলত।
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধা করা
من كان في حاجة أخيه كان الله في حاجته 'যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। অর্থাৎ কোনও মুসলিম ভাইয়ের কোনওরকম প্রয়োজন দেখা দিলে যার পক্ষে সে প্রয়োজন সমাধা করা সম্ভব, তার কর্তব্য তা সমাধা করে দেওয়া। যে ব্যক্তি তা সমাধা করে দেবে, তার প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা সমাধা করে দেবেন। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ- والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ইহসানের আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও তারা দয়ার আচরণ লাভ করবে। দুনিয়ার মানুষের প্রয়োজন নানারকম।
কারও প্রয়োজন খাদ্যের, কারও কাপড়ের, কারও বাসস্থানের, কারও চিকিৎসার, কারও সুপরামর্শের, কারও ভার লাঘবের, কারও বিবাহের, এমনিভাবে পৃথিবীতে মানুষকে নানারকম প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হয়। যার পক্ষে তার মুসলিম ভাইয়ের এসব প্রয়োজনের কোনওটি পূরণ করা সম্ভব, তা পূরণ করা তার অবশ্যকর্তব্য।
এ হাদীছ দ্বারা তো জানা গেল তার সে প্রয়োজন পূরণ করলে তার নিজের প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা পূরণ করে দেবেন। এটা নিজ প্রয়োজন সমাধারও এক উত্তম ব্যবস্থা। দুনিয়ায় মানুষের কোনও না কোনও প্রয়োজন থাকেই। অনেক সময় দেখা যায় এমন কোনও প্রয়োজন সামনে এসে পড়ে, যা হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তা সমাধার একটা ভালো উপায় এইও হতে পারে যে, অন্য কোনও ব্যক্তির যে প্রয়োজন আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব আমি তা পূরণ করে দেব। অসম্ভব নয় তাতে খুশি হয়ে আল্লাহ তাআলাও আমার সে কঠিন প্রয়োজনটি অতি সহজেই পূরণ করে দেবেন। সবচে' বড় কথা এর জন্য আখেরাতের যে পুরস্কার নির্দিষ্ট আছে তা তো পাওয়া যাবেই।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما مؤمن أطعم مؤمنا على جوع أطعمه الله يوم القيامة من ثمار الجنّة، وأيما مؤمن سقى مؤمنا على ظما سقاه الله يوم القيامة من الرحيق المختوم، وأيما مؤمن کسی مؤمنا على عري كساه الله من خضر الجنة 'যে-কোনও মুমিন কোনও ক্ষুধার্ত মুমিনকে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও তৃষ্ণার্ত মুমিনকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন মোহরকৃত সুপেয় শরাব পান করাবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও বস্ত্রহীন মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ রেশমি পোশাক পরাবেন।
সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ শিক্ষার উপর আমল করতেন। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কোন্ মুসলিমের কী প্রয়োজন আছে। নিজ সাধ্য অনুযায়ী তার সে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. মহল্লার কোনও বাড়ির পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তাদের ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন। এটা সেকালের একটা প্রয়োজন ছিল। কেননা তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী মহিলাগণ দুধ দোহন করত না। ফলে বাড়িতে পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তারা সমস্যায় পড়ে যেত।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মানবসেবা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নিয়মিতই তাদের এ প্রয়োজন পূরণ করতেন। তিনি খলিফা হওয়ার পর এক নারী মন্তব্য করেছিল, এখন তো আর তিনি আমাদের ছাগলের দুধ দুইয়ে দেবেন না। এ কথা তাঁর কানে পৌঁছে গেল। তিনি বললেন, অবশ্যই, আমি আশা করি যে দায়িত্ব আমার কাঁধে চেপেছে তা আমার আগেকার অভ্যাস বদলাতে পারবে না।
হযরত উমর রাযি.-ও রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে বিধবা মহিলাদের বাড়িতে পানি পৌছিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি রাতের বেলা নিয়মিতই এক বিধবার বাড়িতে যেতেন। তাঁর এ আসা-যাওয়াটা হযরত তালহা রাযি.-এর চোখে পড়ে যায়। কী ঘটনা? তাঁর জানার কৌতূহল হল। তিনি একদিন সেই মহিলার বাড়িতে গেলেন। গিয়ে দেখেন এক অন্ধ ও অচল বৃদ্ধা। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি রাতের বেলা আপনার কাছে এসে থাকে, সে কী করে? বৃদ্ধা বলল, সে এত-এত দিন যাবৎ এসে আমার খোঁজ-খবর নেয় এবং আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে দেয়। এ কথা শুনে হযরত তালহা রাযি. স্তম্ভিত। তিনি নিজেকে তিরস্কার করে বললেন, রে তালহা! তুই মরে যা না! উমরের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াচ্ছিস?
সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, সালাফে সালিহীন ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় হাজারও ঘটনা আছে। অন্যের প্রয়োজন পূরণকে তারা অনেক বড় পুণ্যের কাজ মনে করতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দিন।
অন্যের মুখে হাসি ফোটানো
মানুষের প্রয়োজন বড় বিচিত্র। এক ব্যক্তির কোনও অভাব-অনটন নেই, কিন্তু বিশেষ কোনও কারণে সে মনোকষ্টে ভুগছে। তার মলিন মুখের দিকে তাকালে মনের কষ্ট অনুভব করা যায়। এই ব্যক্তির প্রয়োজন কষ্টের কারণটি দূর করে তার মুখে হাসি ফোটানো। নিঃসন্দেহে অন্যের মনে আনন্দদানও একটি বড় নেকীর কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن أحب الأعمال إلى الله بعد الفرائض إدخال السرور على المسلم ‘ফরয আমলসমূহের পর আল্লাহ কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিকে আনন্দ দান করা।
আরেক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن من موجبات المغفرة إدخال السرور على أخيك المسلم 'যেসকল কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত লাভ হয়, তার একটি হচ্ছে মুসলিম ভাইকে আনন্দ দান করা।
অপরকে আনন্দদানের জন্য ইসলাম পরিমিত রসিকতাকেও জায়েয করেছে। এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে পোষা পাখি মারা যাওয়ায় বিষণ্ণ বালক আবূ উমায়রকে লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হালকা রসিকতা। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বালক পুত্র আবূ উমায়রের একটি পোষা পাখি ছিল। সেটির নাম ছিল নুগায়র। আবূ উমায়র সেটি নিয়ে সময় কাটাত। অকস্মাৎ তার সে পাখিটি মারা গেল। তাতে আবূ উমায়র ভীষণ দুঃখ পেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন এবং আবূ উমায়রকে খুব আদর করতেন। আবূ উমায়রও তাঁকে পেলে বেশ আনন্দিত হত। এবার তিনি এসে দেখেন আবূ উমায়র কেমন বিষণ্ণ, মুখে হাসি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তার পাখিটি মারা গেছে। সুতরাং তিনি তার দুঃখ ভোলানোর জন্য ছড়া গেয়ে উঠলেন
يا أبا عمير
ما فعل النغير؟
“ওহে আবূ উমায়ের!
কোথা গেল নুগায়ের?
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মুমিন ব্যক্তির দুঃখ-কষ্ট নিবারণের চেষ্টা আখেরাতের কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠতম একটি উপায়। তাই এ চেষ্টায় অবহেলা করা উচিত নয়।
খ. দুনিয়া ও আখেরাতের সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় মানুষের অর্থসংকট দূর করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই এ চেষ্টা করা উচিত।
গ. দুনিয়া ও আখেরাতে আপন দোষত্রুটি প্রকাশ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আমরা যেন অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকি।
ঘ. সর্বদা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় আমাদের কর্তব্য হবে নিয়মিতভাবে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া।
মুমিন ব্যক্তির কষ্ট নিরসন করার ফযীলত
বলা হয়েছে- من نفس عن مؤمن كربة (যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের একটি কষ্ট দূর করে দেয়)। نفس শব্দটির উৎপত্তি تنفيس থেকে। এর অর্থ অপসারণ করা, শিথিল করা, ফাঁক করা ইত্যাদি। تنفيس -এর উৎপত্তি نفس থেকে, যার অর্থ নিঃশ্বাস, দম ও প্রাণ। বলা হয়, نفس الخناق (গলার বাঁধন শিথিল করল), যাতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে।
كربة অর্থ এমন দুঃখ-কষ্ট, যা মানুষের হৃদয়মন আচ্ছন্ন করে এবং তাকে এমনভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে, যদ্দরুন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট।
হাদীছে বোঝানো হচ্ছে, কোনও কোনও দুঃখ-কষ্ট এমন তীব্র হয়ে থাকে, যদ্দরুন মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। তার সে কষ্ট লাঘব করার দ্বারা যেন গলার বাঁধন শিথিল করা হয়। ফলে সে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারে। তো কারও এরকম দম বন্ধ করা দুঃখ-কষ্ট যে ব্যক্তি লাঘব করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি এমন খুশি হন যে, তিনি কিয়ামতের দিন তার একটি শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট দূর করে দেবেন। এ হাদীছে জানানো হয়েছে- نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة (আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন)। এর দ্বারা অন্যের কষ্ট লাঘব করা-যে কত বড় ফযীলতের কাজ তা অনুমান করা যায়। কেননা আখেরাতের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়। মান ও পরিমাণ উভয়দিক থেকেই তা তুচ্ছ। আখেরাতের তুলনায় তার স্থায়িত্বও অনেক কম। বড়জোর মৃত্যু পর্যন্ত। তো কারও এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের এমন কষ্ট, যা কোনও দিক থেকেই আখেরাতের কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তা দূর করার দ্বারা পরকালীন দুর্বিষহ কোনও কষ্ট থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত বড়ই না প্রাপ্তি।
আখেরাতের এ অতুলনীয় পুরস্কার অর্জন করাও বিশেষ কঠিন কিছু নয়। দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের খানিকটা ব্যয় করেই এটা হাসিল হতে পারে। এমনিভাবে তা অর্জন হতে পারে নিজ ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার, প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রয়োগ, সুপরামর্শ দান, কিছুটা শারীরিক শ্রম ব্যয়, নিজে সরাসরি বা লোকমারফত সুপারিশ করা, একটা চিঠি লিখে দেওয়া কিংবা ফোনে একটা কথা বলার দ্বারাও। অন্ততপক্ষে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও তো করা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ, তুমি অমুকের কষ্ট দূর করে দাও। এসবই আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে সে মহান পুরস্কার লাভের এক কার্যকর উপায়। বিভীষিকাময় কিয়ামতের ঘোর কষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভের আশায় আমরা কি এ উপায় অবলম্বন করব না?
সুতরাং দুনিয়ায় কারও একটি বিপদ দূর করার দ্বারা যদি আখেরাতের একটি বিপদ দূরীভূত হয়, তবে সে প্রাপ্তি অনেক বড়। প্রত্যেক মুমিনের এটা কাম্যও বটে।
হাশর ময়দানের বিভীষিকা
দুনিয়ার কষ্ট-পেরেশানি অপেক্ষা আখেরাতের কষ্ট ও পেরেশানি-যে কত বেশি কঠিন, তা যথাযথভাবে অনুমান করাও সম্ভব নয়। কেননা এক তো জিজ্ঞাসাবাদ ও হিসাব-নিকাশ করার জন্য সমস্ত মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে হাজির করা হবে। ইরশাদ হয়েছেঃ- يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ ‘যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়ানোটাই তো চরম কঠিন ব্যাপার।তদুপরি সেদিনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি তো হবে অত্যন্ত বিভীষিকাময়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- يجمع الله الأولين والأخرين في صعيد واحد، فيسمعهم الداعي وينفذهم البصر وتدنو الشمس منهم، فيبلغ النّاس من الغم والكرب ما لا يطيقون ولا يحتملون، فيقول الناس بعضهم لبعض : ألا ترون ما قد بلغكم؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم؟ ‘আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্র করবেন। ঘোষক তার ঘোষণা তাদের সকলকেই শুনিয়ে দেবে, দৃষ্টিশক্তি তাদের সকলকে ভেদ করবে এবং সূর্য তাদের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। ফলে মানুষের এতটা পেরেশানি ও অস্থিরতা দেখা দেবে, যা তারা সইতে পারবে না ও বরদাশত করতে সক্ষম হবে না। ফলে মানুষ একে অন্যকে বলবে, দেখছ না তোমরা কী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছ? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যে তোমাদের জন্য তোমার প্রতিপালকের কাছে সুপারিশ করবে?" হাদীছটিতে এর পরে শাফাআতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছেঃ- يحشرون حفاة عراة غرلا، قالت: فقلت: يا رسول الله! الرجال والنساء؟ ينظر بعضهم إلى بعض؟ فقال: الأمر أشد من أن يهمهم ذلك 'নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হাশরের ময়দানে তোমাদেরকে খালিপায়ে, বস্ত্রহীন ও নগ্ন অবস্থায় একত্র করা হবে। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নারী-পুরুষ সকলে? তাদের একজন অন্যজনকে দেখতে থাকবে? তিনি বললেন, সেদিনকার অবস্থা অনেক কঠিন। তাদের ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করারই অবকাশ হবে না।
সেদিনের বিভীষিকা ও ভয়াবহতার কারণে নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত অত্যন্ত ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাঁরা প্রত্যেকে বলতে থাকবেন, اللهم سلم سلم 'হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।" সেই কঠিন দুর্দিনে দুনিয়ার যেসকল আমল কাজে আসবে, তার একটি হচ্ছে অন্যের বিপদ-আপদ দূর করতে ভূমিকা রাখা, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে।
অভাবগ্রস্তের অভাবের কষ্ট লাঘব করার ফযীলত
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সৎকর্মরূপে অভাবগ্রস্তের সাহায্য করার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ- ومن يسر على معسر (যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তের অর্থকষ্ট লাঘব করে দেয়)। معسر এর অর্থ অভাবগ্রস্ত। শব্দটির উৎপত্তি عسر থেকে। এর অর্থ কষ্ট। অর্থাভাব দ্বারা মানুষের নানারকম কষ্ট হয়ে থাকে। তাই অভাবগ্রস্তের নামই দেওয়া হয়েছে معسر ।
অভাবগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করা যায় বিভিন্নভাবে। সে যদি কারও কাছে ঋণগ্রস্ত হয় আর সে তার ঋণ মওকুফ করে দেয়, তাতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ঋণশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারাও আসানী লাভ হয়। পাওনাদারের কাছে নিজে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে পাওনা মওকুফ করা বা পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দ্বারাও কষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করা হয়। যদি সরাসরি আর্থিক সহযোগিতা করা হয়, সে তো অনেক ভালো। এর প্রত্যেকটিই অনেক বড় ফযীলতের কাজ।
এ হাদীছে এর ফযীলত জানানো হয়েছে এই যে يسر الله عليه فى الدنيا والا خرة (আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার কষ্ট লাঘব করে দেবেন)। দুনিয়ায় কষ্ট লাঘব হতে পারে অর্থসংকট দূর করার দ্বারা, বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার দ্বারা, বিভিন্ন রকম নেককাজের তাওফীক দ্বারা ইত্যাদি। আর আখেরাতের কষ্ট লাঘব হতে পারে হিসাব নিকাশ সহজ করার দ্বারা, গুনাহের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দ্বারা, হাশরের ময়দানের বিভীষিকায় নিরাপত্তাদান দ্বারা ইত্যাদি।
দুনিয়ায় মানুষের যত দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তার মধ্যে অভাব-অনটনের কষ্টই সবচে' বড়। তাই কারও এ কষ্ট লাঘবের পুরস্কারকে আল্লাহ তাআলা কেবল পরকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ইহকাল-পরকাল উভয় জগতেই ব্যাপক করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! এটা আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী! একজনের অর্থকষ্ট দূর করার দ্বারা তাঁর অনুগ্রহে দুনিয়ারও ফায়দা হাসিল হয় এবং আখেরাতেরও।
দুনিয়ায় মানুষ তার বিভিন্ন রকম কষ্ট-ক্লেশ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম অন্যের অর্থকষ্ট লাঘবে সহযোগিতা করাও কষ্ট-ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায়। আবার এর দ্বারা আখেরাতের কষ্ট থেকেও আল্লাহ তাআলা মুক্তি দান করেন, যা কিনা প্রত্যেক মুমিনের পরম কাম্য।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ জাতীয় কাজ নিজেও অনেক করেছেন এবং বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমাদেরকেও করতে উৎসাহ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক পাওনাদার ও দেনাদারের বাদানুবাদ শুনতে পান। তারা উঁচু আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছিল। একজন অন্যজনকে অনুরোধ করছিল যেন পাওনার অঙ্ক থেকে কিছুটা কমিয়ে দেয় এবং তার প্রতি একটু সদয় হয়। অন্যজন আল্লাহর নামে কসম করে বলছিল, কিছুতেই তা করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন أين المتألي على الله، لا يفعل المعروف؟ فقال: أنا يا رسول الله، وله أي ذلك أحب 'কই সে, যে সদয় আচরণ করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে? এ কথা শুনে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি। সে যা চায় তাই হবে।
এক হাদীছে ইরশাদ من سره أن ينجيه الله من كرب يوم القيامة، فلينفس عن معسر أو يضع عنه “যে ব্যক্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলা যেন কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দান করেন, সে যেন অভাবগ্রস্তকে সুযোগ দান করে অথবা তার দেনা মওকুফ করে দেয়।
এ হাদীছটি হযরত আবূ কাতাদা রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি এক ব্যক্তির কাছে কিছু টাকা পেতেন। সে ছিল গরীব। টাকা দিতে না পেরে তাঁকে দেখে পালাত। একবার হযরত আবূ কাতাদা রাযি. তাকে গিয়ে ধরলেন। সে তার অর্থসংকটের কথা জানাল। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে এ হাদীছটি বর্ণনা করলেন এবং তার দেনা মওকুফ করে দিলেন।
অন্য এক হাদীছে ইরশাদ من أنظر معسرا أو وضع عنه، أظله الله في ظله 'যে ব্যক্তি কোনও অভাবগ্রস্তকে অবকাশ দেয় বা তার দেনা মওকুফ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে (হাশরের ময়দানে) নিজ (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন كان رجل يداين الناس، فكان يقول لفتاه إذا أتيت معسرا فتجاوز عنه، لعل الله يتجاوز عنا، فلقي الله فتجاوز عنه ‘জনৈক (ব্যবসায়ী) ব্যক্তি মানুষের কাছে বাকিতে মাল বিক্রি করত। সে তার কর্মচারীকে বলত, কোনও অভাবগ্রস্তের কাছে মাল বিক্রি করলে তাকে ছাড় দিও, হয়তো এ অসিলায় আল্লাহ আমাদেরকেও ছাড় দেবেন। অতঃপর সে আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে এ কারণে মুক্তি দিয়ে দেন।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সে দুনিয়ায় কী কী নেক আমল করেছে তা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। বারংবার জিজ্ঞাসার পর পরিশেষে তার গরীব ভোক্তাকে ছাড় দেওয়ার কথাটি মনে পড়ল। সে এ কথাটি আল্লাহ তাআলাকে জানালে আল্লাহ তাআলা বললেন, হে বান্দা! তুমি গরীবকে ছাড় দিতে! ছাড় দেওয়ার বিষয়টা তো আমাকেই বেশি সাজে। সুতরাং তিনি তাকে আযাব না দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
গরীব-দুঃখীর কষ্ট লাঘবে সহায়তা করাটা দুআ কবুলের পক্ষেও সহায়ক। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন من أراد أن تستجاب دعوته، وأن تكشف كربته، فليفرج عن معسر “যে ব্যক্তি কামনা করে তার দুআ কবুল হোক এবং তার পেরেশানি দূর হোক, সে যেন অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনের চেষ্টা করে।
মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা
এ হাদীছে বর্ণিত আরেকটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির দোষত্রুটি গোপন করা। বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করে)। মুসলিম ব্যক্তিকে আড়াল করার অর্থ হয়তো খোদ তাকেই শত্রু বা জালেম শাসক থেকে আড়াল করা, যাতে তারা তার কোনও ক্ষতি করতে না পারে। অথবা এর অর্থ তার দোষত্রুটি গোপন করা। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপকর্ম করে না সে যদি গোপনে এমন কোনও অপরাধ করে বসে, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তবে কেউ কোনওভাবে তা জেনে ফেললে তার উচিত নিজের মধ্যেই তা রেখে দেওয়া, অন্যের কাছে প্রকাশ না করা। অন্যের দোষ গোপন করা আল্লাহ তাআলার গুণ। তিনি সাত্তারুল উয়ুব- দোষ গোপনকারী। তাঁর আশেক বান্দার কর্তব্য এ গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাতে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন এবং তার প্রতিও তিনি অনুরূপ আচরণ করবেন।
সুতরাং এ হাদীছে জানানো হচ্ছে- ستره الله فى الدنيا والاخرة (আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে আড়াল করবেন)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও তার দোষ প্রকাশ করে মানুষের সামনে অপদস্থ করবেন না এবং আখেরাতেও তার পাপসমূহ জাহির করে কুল মাখলুকের সামনে তাকে হেয় করবেন না; বরং নিষ্পাপ ব্যক্তির মত জাহান্নাম থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়ে দেবেন।
আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া
এ হাদীছে বর্ণিত ফযীলতপূর্ণ আরেকটি আমল হল আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য সহযোগিতা করে যাওয়া। হাদীছে এ আমলটিকে সাধারণভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশেষ কোনও ক্ষেত্রের সাহায্যের কথা বলা হয়নি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- والله فى عون العبد ما كان العبد في عون أخيه (বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন)। মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় যেমন দীনী বিষয়ে, তেমনি প্রয়োজন হয় দুনিয়াবী বিষয়েও।মানুষের কখনও অর্থ-সাহায্যের প্রয়োজন হয়, কখনও অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, কখনও দরকার পড়ে চিকিৎসা-সহযোগিতার, কখনও বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি দুর্যোগে উদ্ধার সহযোগিতা ও ত্রাণ বিতরণের প্রয়োজন হয়। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বেকার এবং এ জাতীয় অন্যান্য অসহায় লোকদের প্রয়োজন কর্মসংস্থানসহ নানামুখী সহযোগিতা। আসলে দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন বিচিত্র ও বহুমুখী। একেকজনের একেকরকম ঠ্যাকা। এর তালিকা অনেক দীর্ঘ। জীবনচলার ক্ষেত্রে যার যা প্রয়োজন তা পূরণ করার সামর্থ্য যার আছে তার উচিত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে সে প্রয়োজন পূরণে নিজের সে সামর্থ্য ব্যয় করা। যে ব্যক্তি তা করবে এবং যতদিন করবে, ততদিন সে আল্লাহর পক্ষ হতেও সাহায্য পেতে থাকবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
কারও প্রয়োজন দীনী বিষয়ে সাহায্যের। আমলোকের দরকার বিভিন্ন দীনী বিষয়ে নির্দেশনার। যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না তাকে কুরআনপাঠ শেখানো, যে ব্যক্তি ওযূ-গোসল, নামায-রোয়া প্রভৃতি দীনী জরুরি মাসাইল জানে না তাকে এসব বিষয়ক মাসাইল শেখানো, যার আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত নয় তাকে বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস শেখানো, যে ব্যক্তি হালাল-হারামের পার্থক্য সম্পর্কে খবর রাখে না তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদি সবই দীনী সাহায্যের অন্তর্ভুক্ত। অনেক সময় মানুষ এমন জটিল মাসআলার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, যার সমাধান ছাড়া তার পার্থিব জীবন অচল হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে সঠিক সমাধানদান যেমন দীনী সাহায্য, তেমনি তা দুনিয়াবী সাহায্যও বটে।
মানুষের সাহায্য করা যায় মনের শুভেচ্ছা ও নেক দুআ দ্বারা, সাহায্য করা যায় শারীরিক সক্ষমতা দ্বারা, সাহায্য করা যায় বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা এবং সাহায্য করা যায় অর্থব্যয় দ্বারাও। আবার অনেক সময় পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদির বৈধ ব্যবহার দ্বারাও মানুষের অনেক বড় সাহায্য করা যায়। সুপরামর্শ ও সুপারিশও সাহায্যের এক বড় উপায়। মোটকথা যার পক্ষে যেভাবে কারও সাহায্য করা সম্ভব, তার উচিত সেভাবেই তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো। এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাভার্থে তিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে তো জীবনভরই এ কাজে আন্তরিক থেকেছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিষয়ক ঘটনা আছে বহু। একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।
একটি ঘটনা
হিজরতের আগের কথা। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে বসা । তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাহাবীও আছেন। এ অবস্থায় 'যুবায়দ' গোত্রীয় এক ব্যক্তি এগিয়ে আসল। সে বলছিল, 'হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কিভাবে তোমাদের কাছে পণ্য নিয়ে আসা হবে? কিভাবে কোনও ব্যবসায়ী তোমাদের আঙিনায় আসবে? কেউ তোমাদের এলাকায় আসলে তোমরা তাদের প্রতি জুলুম কর'। সে এসব কথা বলছিল আর লোকজনের একেক জটলার সামনে দাঁড়াচ্ছিল। পরিশেষে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে পৌছল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমার প্রতি জুলুম করেছে?
সে জানাল যে, সে তার শ্রেষ্ঠ তিনটি উট নিয়ে এখানে এসেছিল। কিন্তু আবূ জাহল দাম-দর করতে গিয়ে উটগুলোর দাম বলল তার প্রকৃত মূল্যের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ। আবূ জাহল এ দাম বলার কারণে আর কেউ তার উপর দিয়ে দাম বলল না। তারপর সে বলল, আবূ জাহল আমার পণ্য অচল করে দিয়েছে। সে এভাবে আমার উপর জুলুম করেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার উটগুলো কোথায়?
সে জায়গার নাম বলল।
তিনি উঠে সেখানে গেলেন। সঙ্গে সাহাবীগণও। তিনি দেখলেন, খুবই উঁচু মানের উট। তারপর তিনি যুবায়দী লোকটিকে সেটির দাম বললেন। একপর্যায়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত দামে উপনীত হলেন। লোকটি উপযুক্ত দাম পেয়ে তাঁর কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিল। তিনি তা থেকে দুটি উট ওই দামেই বিক্রি করে দিলেন। একটি বিক্রি করলেন আরও বেশি দামে। তিনি সেটির মূল্য আব্দুল মুত্তালিবের আওলাদের মধ্যকার বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন।
আবূ জাহল বাজারের এক প্রান্তে বসা ছিল। সে সবকিছু দেখছিল, কিন্তু কোনও কথা বলছিল না। শেষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন
হে আমর্ (এটা আবূ জাহলের আসল নাম)! সাবধান, এই বেদুঈনের সঙ্গে যা আচরণ করলে ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে এমন করো না যেন। করলে কিন্তু আমার পক্ষ থেকে যে ব্যবহার পাবে তা তোমার প্রীতিকর বোধ হবে না।
উত্তরে আবূ জাহল বলছিল, হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না। হে মুহাম্মাদ! আর কখনও করব না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসলেন।
ওদিকে উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং উপস্থিত অন্যান্য লোকজন অবাক বিস্ময়ে এ দৃশ্য লক্ষ করছিল। শেষে তারা আবূ জাহলকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি আজ মুহাম্মাদের হাতে বড় অপদস্থ হলেন। তবে কি আপনি তার অনুসরণ করবেন বলে মনস্থ করেছেন? নাকি কোনও কারণে তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন?
আবূ জাহল বলল, আমি জীবনেও তার অনুসরণ করব না। বাকি তোমরা যে দৃশ্য দেখেছ তার কারণ, আমার চোখ এমনকিছু দেখেছে যা তোমরা দেখনি। আমি দেখলাম, তার ডানে ও বামে বর্শাধারী কিছু লোক। তারা সেগুলো আমার দিকে তাক করে আছে। আমি তার অবাধ্য হলে সেই বর্শা দিয়ে তারা আমাকে গেঁথে ফেলত।
মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধা করা
من كان في حاجة أخيه كان الله في حاجته 'যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। অর্থাৎ কোনও মুসলিম ভাইয়ের কোনওরকম প্রয়োজন দেখা দিলে যার পক্ষে সে প্রয়োজন সমাধা করা সম্ভব, তার কর্তব্য তা সমাধা করে দেওয়া। যে ব্যক্তি তা সমাধা করে দেবে, তার প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা সমাধা করে দেবেন। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ- والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ- هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?
অর্থাৎ যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ইহসানের আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও তারা দয়ার আচরণ লাভ করবে। দুনিয়ার মানুষের প্রয়োজন নানারকম।
কারও প্রয়োজন খাদ্যের, কারও কাপড়ের, কারও বাসস্থানের, কারও চিকিৎসার, কারও সুপরামর্শের, কারও ভার লাঘবের, কারও বিবাহের, এমনিভাবে পৃথিবীতে মানুষকে নানারকম প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হয়। যার পক্ষে তার মুসলিম ভাইয়ের এসব প্রয়োজনের কোনওটি পূরণ করা সম্ভব, তা পূরণ করা তার অবশ্যকর্তব্য।
এ হাদীছ দ্বারা তো জানা গেল তার সে প্রয়োজন পূরণ করলে তার নিজের প্রয়োজনও আল্লাহ তাআলা পূরণ করে দেবেন। এটা নিজ প্রয়োজন সমাধারও এক উত্তম ব্যবস্থা। দুনিয়ায় মানুষের কোনও না কোনও প্রয়োজন থাকেই। অনেক সময় দেখা যায় এমন কোনও প্রয়োজন সামনে এসে পড়ে, যা হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তা সমাধার একটা ভালো উপায় এইও হতে পারে যে, অন্য কোনও ব্যক্তির যে প্রয়োজন আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব আমি তা পূরণ করে দেব। অসম্ভব নয় তাতে খুশি হয়ে আল্লাহ তাআলাও আমার সে কঠিন প্রয়োজনটি অতি সহজেই পূরণ করে দেবেন। সবচে' বড় কথা এর জন্য আখেরাতের যে পুরস্কার নির্দিষ্ট আছে তা তো পাওয়া যাবেই।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أيما مؤمن أطعم مؤمنا على جوع أطعمه الله يوم القيامة من ثمار الجنّة، وأيما مؤمن سقى مؤمنا على ظما سقاه الله يوم القيامة من الرحيق المختوم، وأيما مؤمن کسی مؤمنا على عري كساه الله من خضر الجنة 'যে-কোনও মুমিন কোনও ক্ষুধার্ত মুমিনকে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও তৃষ্ণার্ত মুমিনকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন মোহরকৃত সুপেয় শরাব পান করাবেন। যে-কোনও মুমিন কোনও বস্ত্রহীন মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ রেশমি পোশাক পরাবেন।
সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ শিক্ষার উপর আমল করতেন। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কোন্ মুসলিমের কী প্রয়োজন আছে। নিজ সাধ্য অনুযায়ী তার সে প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করতেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. মহল্লার কোনও বাড়ির পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তাদের ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন। এটা সেকালের একটা প্রয়োজন ছিল। কেননা তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী মহিলাগণ দুধ দোহন করত না। ফলে বাড়িতে পুরুষ লোক অনুপস্থিত থাকলে তারা সমস্যায় পড়ে যেত।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মানবসেবা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নিয়মিতই তাদের এ প্রয়োজন পূরণ করতেন। তিনি খলিফা হওয়ার পর এক নারী মন্তব্য করেছিল, এখন তো আর তিনি আমাদের ছাগলের দুধ দুইয়ে দেবেন না। এ কথা তাঁর কানে পৌঁছে গেল। তিনি বললেন, অবশ্যই, আমি আশা করি যে দায়িত্ব আমার কাঁধে চেপেছে তা আমার আগেকার অভ্যাস বদলাতে পারবে না।
হযরত উমর রাযি.-ও রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে বিধবা মহিলাদের বাড়িতে পানি পৌছিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে একটা চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি রাতের বেলা নিয়মিতই এক বিধবার বাড়িতে যেতেন। তাঁর এ আসা-যাওয়াটা হযরত তালহা রাযি.-এর চোখে পড়ে যায়। কী ঘটনা? তাঁর জানার কৌতূহল হল। তিনি একদিন সেই মহিলার বাড়িতে গেলেন। গিয়ে দেখেন এক অন্ধ ও অচল বৃদ্ধা। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি রাতের বেলা আপনার কাছে এসে থাকে, সে কী করে? বৃদ্ধা বলল, সে এত-এত দিন যাবৎ এসে আমার খোঁজ-খবর নেয় এবং আমার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে দেয়। এ কথা শুনে হযরত তালহা রাযি. স্তম্ভিত। তিনি নিজেকে তিরস্কার করে বললেন, রে তালহা! তুই মরে যা না! উমরের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াচ্ছিস?
সাহাবায়ে কেরাম, তাবি'ঈন, সালাফে সালিহীন ও বুযুর্গানে দীনের এ জাতীয় হাজারও ঘটনা আছে। অন্যের প্রয়োজন পূরণকে তারা অনেক বড় পুণ্যের কাজ মনে করতেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দিন।
অন্যের মুখে হাসি ফোটানো
মানুষের প্রয়োজন বড় বিচিত্র। এক ব্যক্তির কোনও অভাব-অনটন নেই, কিন্তু বিশেষ কোনও কারণে সে মনোকষ্টে ভুগছে। তার মলিন মুখের দিকে তাকালে মনের কষ্ট অনুভব করা যায়। এই ব্যক্তির প্রয়োজন কষ্টের কারণটি দূর করে তার মুখে হাসি ফোটানো। নিঃসন্দেহে অন্যের মনে আনন্দদানও একটি বড় নেকীর কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن أحب الأعمال إلى الله بعد الفرائض إدخال السرور على المسلم ‘ফরয আমলসমূহের পর আল্লাহ কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিকে আনন্দ দান করা।
আরেক হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ- إن من موجبات المغفرة إدخال السرور على أخيك المسلم 'যেসকল কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে মাগফিরাত লাভ হয়, তার একটি হচ্ছে মুসলিম ভাইকে আনন্দ দান করা।
অপরকে আনন্দদানের জন্য ইসলাম পরিমিত রসিকতাকেও জায়েয করেছে। এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হচ্ছে পোষা পাখি মারা যাওয়ায় বিষণ্ণ বালক আবূ উমায়রকে লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হালকা রসিকতা। হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর বালক পুত্র আবূ উমায়রের একটি পোষা পাখি ছিল। সেটির নাম ছিল নুগায়র। আবূ উমায়র সেটি নিয়ে সময় কাটাত। অকস্মাৎ তার সে পাখিটি মারা গেল। তাতে আবূ উমায়র ভীষণ দুঃখ পেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন এবং আবূ উমায়রকে খুব আদর করতেন। আবূ উমায়রও তাঁকে পেলে বেশ আনন্দিত হত। এবার তিনি এসে দেখেন আবূ উমায়র কেমন বিষণ্ণ, মুখে হাসি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তার পাখিটি মারা গেছে। সুতরাং তিনি তার দুঃখ ভোলানোর জন্য ছড়া গেয়ে উঠলেন
يا أبا عمير
ما فعل النغير؟
“ওহে আবূ উমায়ের!
কোথা গেল নুগায়ের?
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মুমিন ব্যক্তির দুঃখ-কষ্ট নিবারণের চেষ্টা আখেরাতের কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠতম একটি উপায়। তাই এ চেষ্টায় অবহেলা করা উচিত নয়।
খ. দুনিয়া ও আখেরাতের সংকট থেকে উত্তরণের একটি উপায় মানুষের অর্থসংকট দূর করার চেষ্টা। সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই এ চেষ্টা করা উচিত।
গ. দুনিয়া ও আখেরাতে আপন দোষত্রুটি প্রকাশ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আমরা যেন অন্যের দোষত্রুটি গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকি।
ঘ. সর্বদা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় আমাদের কর্তব্য হবে নিয়মিতভাবে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাওয়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
