ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩৫. বৈধ-অবৈধ বিষয়াদি ও বিভিন্ন আদব

হাদীস নং: ২৩৬৬
মুসাফাহা বা করমর্দনের মর্যাদা এবং কীভাবে তা করতে হবে
(২৩৬৬) তাবিয়ি কাতাদা বলেন, আমি আনাস রা.কে বললাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবিগণের মধ্যে কি মুসাফাহার প্রচলন ছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ ।
عن قتادة قال: قلت لأنس رضي الله عنه: أكانت المصافحة في أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم؟ قال: نعم.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

المُصافحة শব্দটির উৎপত্তি صفحة থেকে। এর অর্থ হাতের তালু। একজনের হাতের তালু আরেকজনের হাতের তালুর সঙ্গে মিশলে মুসাফাহা হয়। পরস্পর সাক্ষাৎকালে সালামের পর মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। এটা সালামের সম্পূরক। এর দ্বারা পারস্পরিক মহব্বত ও ভালোবাসা প্রকাশ পায়। ভালোবাসার এ বাহ্যিক প্রকাশ অন্তরেও প্রভাব বিস্তার করে। কাজেই পরস্পরের মধ্যে মুসাফাহা চালু থাকলে অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে তদস্থলে মহব্বত ও ভালোবাসার বীজ বপন হতে পারে। এর অনেক ফযীলত, যেমন হাদীছে আসছে।

কাতাদা রহ. একজন তাবি'ঈ। তিনি হযরত আনাস রাযি.-কে মুসাফাহা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন যে, সাহাবীদের মধ্যে এর প্রচলন ছিল কি না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনও হাদীছের উপর সাহাবায়ে কেরামের আমল থাকা এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, হাদীছটি রহিত হয়ে যায়নি; বরং এর বিধান বলবৎ আছে। এটা অনুসরণীয়। এমনিতেও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোনও কাজের রেওয়াজ থাকাটা সে কাজের বৈধতা প্রমাণ করে। কাজেই যেসকল বিষয়ে জানা যায় যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তার রেওয়াজ ছিল, আমরা নিশ্চিন্তমনে তা পালন করতে পারি।

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মুসাফাহার প্রচলন ছিল, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে। তাঁরা যখন একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হতেন, তখন সালামের পর মুসাফাহা করতেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত কা'ব ইবন মালিক রাযি.-এর তাওবার ঘটনায় আছে যে, তাওবা কবুল হওয়ার পর তিনি যখন মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন, তখন হযরত তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ রাযি., যিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত বিখ্যাত সাহাবী, উঠে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তাঁর সঙ্গে মুসাফাহা করলেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সাহাবীদের সঙ্গে মুসাফাহা করতেন। হযরত বারা' ইবন আযিব রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে মুসাফাহা করেছিলেন। (খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক : ৮৫৭)

উল্লেখ্য, মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। অপরদিকে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। তাই মুসাফাহা করার ক্ষেত্রে মুসাফাহার আদবের প্রতি লক্ষ রাখা অতীব জরুরি, যাতে মুসাফাহা করতে গিয়ে কাউকে কষ্ট দেওয়া না হয়। কষ্ট দেওয়ার বিভিন্ন ধরন আছে। যেমন মুসাফাহা করার সময় এমন জোরে ঝাঁকুনি দেওয়া, যাতে কাঁধ থেকে বাহু খুলে পড়ার উপক্রম হয়। কেউ কেউ মুসাফাহা করতে গিয়ে এমন জোরে হাতে পীড়ন করে সে, আঙ্গুল মড়মড় করে ওঠে। কেউ কেউ মুসাফাহা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, অথচ যার সঙ্গে মুসাফাহা করা হবে তার হাতে হয়তো লাঠি বা কোনও বোঝা রয়েছে। এ অবস্থায়ও মুসাফাহা করতে গেলে তাকে কষ্টই দেওয়া হবে। এমনিভাবে ভিড়ের মধ্যেও মুসাফাহা করার দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়। যার সঙ্গে মুসাফাহা করা হবে সে যদি ব্যস্ত থাকে, তখনও মুসাফাহা কষ্টদায়ক। তাই মুসাফাহা করার বেলায় খুবই সতর্ক থাকতে হবে যাতে এর দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া না হয়।

মুসাফাহা এক হাতে না দু'হাতে, এ নিয়েও তর্ক রয়েছে। এ তর্ক অর্থহীন। কেননা মুসাফাহা যেমন দু'হাতে করা যায়, তেমনি এক হাতেও করা যেতে পারে। ইমাম বুখারী باب الأخذ بالبَدَيْن (দুই হাত দিয়ে ধরা) শিরোনামের এক পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন যে, বিখ্যাত তাবে তাবি'ঈ হাম্মাদ ইবন যায়দ রহ. সুবিখ্যাত ইমাম আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক রহ.-এর সঙ্গে দু'হাতে মুসাফাহা করেছিলেন। এভাবে ইমাম বুখারী রহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মুসাফাহা দু'হাতেও চলতে পারে। তাছাড়া তিনি بابُ الْمُصَافَحَةِ অর্থাৎ মুসাফাহা শীর্ষক পরিচ্ছেদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি.-এর প্রসিদ্ধ একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তাতে আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন-
عَلَّمَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَكَفِّيْ بَيْنَ كَفَّيْهِ، التَّشَهُدَ
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এ অবস্থায় তাশাহ্হুদ শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমার এক হাত ছিল তাঁর দুই হাতের মাঝখানে’। (সহীহ বুখারী: ৬২৬৫; সহীহ মুসলিম: ৪০২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৯৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ৩৯৩৬; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৫৩৪৭; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৭৯৭: বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ : ৩৩২৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২৮২০)

এটা ছিল মুসাফাহার ভঙ্গি। এর দ্বারাও দুই হাত দ্বারা মুসাফাহা করার বৈধতা প্রমাণ হয়। কাজেই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সমীচীন নয়। ব্যস মুসাফাহা করা মুস্তাহাব, তা এক হাতেই হোক বা দু'হাতে।

কোথাও কোথাও দেখা যায় ফরয নামাযের সালাম ফেরানোর পর একে অন্যের সঙ্গে মুসাফাহা করে। তারা এটাকে একটা নিয়মই বানিয়ে নিয়েছে। কোথাও এর কোনও ভিত্তি পাওয়া যায় না। ফরয নামাযের সালাম ফেরানোর পর হাদীছে বিশেষ কিছু যিকিরের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন তার উপর আমলে মনোযোগী হওয়া। যার ভিত্তি পাওয়া যায় না এরকম এক কাজে ব্যস্ত হয়ে সুন্নতসম্মত সে আমলের ব্যাঘাত ঘটানো কিছুতেই পসন্দনীয় কাজ হতে পারে না। তাই এর থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পরস্পর সাক্ষাৎকালে মুসাফাহা করা সুন্নত। আদবের সঙ্গে এর উপর আমল করা চাই।

খ. সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোনও কাজ চালু থাকাটা সে কাজের বৈধতার দলীল। আমরা তা অনুসরণ করতে পারি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ২৩৬৬ | মুসলিম বাংলা