আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫৯৮৭
৩১৭৫. যে ব্যক্তি আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবে, আল্লাহ তার সাথে সুসম্পর্ক রাখবেন।
৫৫৬১। বিশর ইবনে মুহাম্মাদ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টিকে পয়দা করলেন। যখন তিনি সৃষ্টি কাজ শেষ করেন, তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক বলে উঠলঃ সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণকারীদের এই (উপযুক্ত) স্থান। তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে যে সুসম্পর্ক রাখবে, আমিও তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। সে (আত্মীয়তার সম্পর্ক) বললঃ হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট, হে আমার রব! আল্লাহ বললেনঃ তাহলে এ মর্যাদা তোমাকে দেওয়া হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা ইচ্ছে করলে (এ আয়াতটি) পড়ঃ যদি তোমরা কর্তৃত্ব (নেতৃত্ব) লাভ কর, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে এবং সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবে?

হাদীসের ব্যাখ্যা:

(সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত হলে)। অর্থ— যখন তিনি মাখলূকদের সৃষ্টিকর্ম হতে অবসর হলেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত করলেন। এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, প্রথমে তিনি সৃষ্টিকার্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তারপর কাজ শেষ হলে অবসর হলেন। কেননা আল্লাহ তাআলার জন্য এ অর্থ প্রযোজ্য নয় । কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ধারণা থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। কেননা কোনও কাজ করতে তাঁর চেষ্টা-পরিশ্রম করার দরকার হয় না। সেই কাজ করার জন্য তাঁর সরাসরি যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কোনও কাজ করার জন্য তাঁর হাতিয়ার ও সরঞ্জামাদি ব্যবহারেরও প্রশ্ন আসে না। এসবের প্রয়োজন হয় দুর্বল ও সীমিত শক্তির মাখলূকের। আল্লাহ তাআলার শক্তি ও ক্ষমতা অসীম। তিনি কোনওকিছু করতে চাইলে কেবল বলেন হও। অমনি তা হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ “তাঁর ব্যাপার তো এই যে, তিনি যখন কোনও কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেন, ‘হয়ে যা'। অমনি তা হয়ে যায়।

যাহোক সৃষ্টিকর্ম যখন সমাপ্ত হয়ে গেল, তখন আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে গেল এবং বলল। প্রশ্ন হয়, আত্মীয়তা তো এক বিমূর্ত বিষয়, এটা একটা আপেক্ষিক অবস্থা ও সম্পর্কের নাম, এর পক্ষে কী করে দাঁড়ানো ও কথা বলা সম্ভব? উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন।

এর এক উত্তর তো এই যে, হয়তো আল্লাহ তাআলা ক্ষণিকের জন্য আত্মীয়তাকে একটা আকৃতি দান করেছিলেন এবং সেই আকৃতিকে বাকশক্তি দিয়েছিলেন। আত্মীয়তা সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল। আল্লাহ তাআলার কুদরত ও ক্ষমতা অসীম। তিনি চাইলে এরূপ করতেই পারেন। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

কারও মতে এই দাঁড়ানো ও কথা বলার বিষয়টি রূপক। এর দ্বারা আত্মীয়তাকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে কারও পক্ষ থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আশঙ্কা বোধ করে। তাই সে তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও ক্ষমতাশালীর আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তার কাছে নিজের সেই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে, যাতে তার পক্ষ হতে এ ব্যাপারে সাহায্য লাভ হয়। তো আত্মীয়তাকে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে তার আশ্রয়গ্রহণ ও কথা বলার গুণকে তার উপর আরোপ করা হয়েছে। এটা অলংকার শাস্ত্রের একটা নিয়ম। সব ভাষাতেই এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য আত্মীয়তার মর্যাদা ও তা রক্ষা করার গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

এরকম ব্যাখ্যাও করা যায় যে, আত্মীয়তা এমন মর্যাদাপূর্ণ একটি বিষয় এবং তা ছিন্ন করা এমনই বেদনাদায়ক যে, আত্মীয়তার যদি শরীর ও বাকশক্তি থাকত, তবে সে আল্লাহ তাআলার দরবারে দাঁড়িয়ে তার ছিন্নকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাত।

যাহোক আত্মীয়তা দাঁড়িয়ে আবেদন জানাল- (এটা তার স্থান যে ছিন্ন হওয়া থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করে)। অর্থাৎ এই যে স্থানে আমি দাঁড়িয়েছি এটা এমন এক স্থান, যেখান থেকে আপনার আশ্রয়প্রার্থী সম্পর্কচ্ছেদের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তিলাভের জন্য আশ্রয় গ্রহণ করে। এর দ্বারা ঠিক কোন স্থান বোঝানো হয়েছে, এই দৃশ্যমান জগতে বসে তা বোঝা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

বাক্যটির অর্থ এরকমও হতে পারে যে, আমার এই দাঁড়ানোটা সম্পর্কচ্ছেদের বিপদ থেকে আশ্রয় গ্রহণকারীর দাঁড়ানো। অর্থাৎ এটা সুখের ও আনন্দের দাঁড়ানো নয়; বরং বিপন্নজনের সকাতর ও উদ্বেগপূর্ণ দাঁড়ানো। এ কথা বলার উদ্দেশ্য- ফরিয়াদ ও আর্জি যাতে গ্রহণ করা হয়, সে লক্ষ্যে মহাবিচারপতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও সদয়দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন- (তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে ব্যক্তি তোমাকে জুড়ে রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখব আর যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব?)। اصل ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি الصلة والوصال থেকে। এর অর্থ মেলানো ও সংযুক্ত করা। এখানে জানানো হয়েছে- বান্দা আত্মীয়তা সংলগ্ন ও সংযুক্ত রাখলে আল্লাহ তাআলা তাকে নিজের সঙ্গে মিলিত ও যুক্ত করে রাখবেন।

আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কারও স্থানগতভাবে সংযুক্ত থাকা অসম্ভব। কাজেই এর দ্বারা স্থানগত নয়; বরং মর্যাদাগত মিলন ও সংযোগ বুঝতে হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি খুশি হয়ে দুনিয়ায় তাকে ইজ্জত-সম্মান দেবেন এবং আখেরাতে তাঁর সন্তুষ্টির স্থান জান্নাতের সম্মানজনক জীবন দান করবেন।

বিজ্ঞজনদের কেউ কেউ বলেন, আত্মীয়তা রক্ষা বলতে মূলত আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ বোঝানো হয়। সে হিসেবে বাক্যটির মর্ম হচ্ছে- যে ব্যক্তি আত্মীয়ের প্রতি সদয় আচরণ করবে, আল্লাহ তাআলাও তার প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্যের আচরণ করবেন।

বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আল্লাহ তাআলাও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। অর্থাৎ তার প্রতি দয়া ও রহমতের আচরণ করা হবে না। বলাবাহুল্য বান্দা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার রহমতের মুহতাজ। আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রকাশ্য ও গুপ্ত হাজারও পেরেশানি ও বালা-মসিবতের শিকার হয়ে যায়। কাজেই আত্মীয়তা ছিন্নের পরিণামে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের যে সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তার কঠোরতা ও গভীরতা উপলব্ধি করা চাই। বিশেষত এ কারণেও যে, আখেরাতের নাজাত ও মুক্তি কেবলই আল্লাহ তাআলার রহমতের উপর নির্ভরশীল। যার সঙ্গে আল্লাহ তাআলা সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবেন, সে কী করে আখেরাতে তাঁর রহমত লাভের আশা করবে?

আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ তা স্পষ্ট করার জন্য হাদীছে কুরআন মাজীদের একটি আয়াতও উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে ইরশাদ হয়েছে فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ ‘অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা'নত করেছেন (অর্থাৎ তাঁর রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন'। অর্থাৎ জিহাদের ব্যতিব্যস্ততা ছেড়ে দিলে সমাজে অশান্তি বিস্তারে লিপ্ত হয়ে পড়ার ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার আশঙ্কা থাকে। জিহাদ করা অবস্থায় সবটা শক্তি ব্যয় হয় আল্লাহ তাআলার দুশমনদের দমন করার কাজে। মন-মস্তিষ্কও সেই ফিকিরেই রত থাকে। পক্ষান্তরে জিহাদ থেকে অবসর হয়ে কেবল দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং তার পরিণামে দেখা দেয় আত্মকলহ। তখন শারীরিক ও মানসিক সবরকম শক্তি-ক্ষমতা একে অন্যকে দমন করা ও দাবিয়ে রাখার পেছনে ব্যয় হয়। যে শক্তি ব্যয় হত দীনের শত্রুদমনে, তা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদমনে নিঃশেষ করা হয়। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকার মুসলিম জাতির আত্মকলহ ও সর্বাত্মক পশ্চাদপদতা তাদের জিহাদবিমুখতারই পরিণাম।

توليتم এর এক অর্থ হতে পারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করা। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হবে- তোমরা যদি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হও, তবে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?' অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মানুষকে আত্মকলহ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার পথে টেনে নেয়। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার লোভ এমনই সর্বনাশা ব্যাধি, যা মানুষের অন্তর থেকে মায়া-মমতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতালোভী ব্যক্তির কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য থাকে না। কেবল আত্মীয়তা ছিন্ন করাই নয়, পরমাত্মীয় রক্তের ভাইকে পর্যন্ত হত্যা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না। কেননা ক্ষমতার লোভ ও ক্ষমতার দর্পে সে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। না সে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখতে পায় আর না সত্য-ন্যায়ের বাণী শুনতে পায়। এ অবস্থায় কঠিন থেকে কঠিনতর অপরাধে লিপ্ত হতেও তার দ্বিধাবোধ হয় না। এ আয়াতে সে আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছে। এ অনর্থের কারণেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যদি ক্ষমতা এসে যায়, কেবল তখনই আল্লাহভীতির সঙ্গে তা গ্রহণ ও পরিচালনা করা চাই।


হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়তা রক্ষায় সর্বপ্রকারে যত্নবান থাকা এবং কোনও অবস্থায়ই যাতে আত্মীয়তা ছিন্ন না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সাবধান থাকা।

খ. হাদীছটি দ্বারা এ বিশ্বাস জোরদার হয় যে, বিশ্বজগৎ এমনিই সৃষ্টি হয়ে যায়নি; বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাতেই তা অস্তিত্ব লাভ করেছে।

গ. বাকশক্তি আল্লাহ তাআলার দান। তিনি চাইলে যে-কোনও বস্তু ও যে-কোনও বিষয়কে এ শক্তির অধিকারী করতে পারেন। 'আত্মীয়তা' নামক সম্পর্কটিকে এ শক্তি দান করার দ্বারা এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ঘ. জিহাদ ইসলামের এক স্থায়ী বিধান। এর থেকে বিমুখ হওয়া সামাজিক অশান্তি ও পারস্পরিক কলহ-বিবাদের একটি কারণ।

ঙ. ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া সর্বাত্মক অনিষ্টকর একটি তৎপরতা। প্রত্যেক মুসলিমের এর থেকে বিরত থাকা উচিত।

৬৮. সূরা ইয়াসীন (৩৬), আয়াত ৮২
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন