আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৫৫৪
আন্তর্জতিক নং: ৫৯৭৯

পরিচ্ছেদঃ ৩১৭০. যে স্ত্রীলোকের স্বামী আছে, ঐ স্ত্রীর পক্ষে তার নিজের মায়ের সঙ্গে ভাল ব্যবহার অক্ষুণ্ন রাখা।
লাঈস (রাহঃ) ...... আসমা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ কুরাইশরা যে সময়ে নবী (ﷺ) এর সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেছিল, ঐ চুক্তিকালীন সময়ে আমার মা তাঁর পিতার সঙ্গে এলেন। আমি নবী (ﷺ) এর কাছে জিজ্ঞাসা করলামঃ আমার মা এসেছেন, তবে সে অমুসলিম। আমি কি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তোমার মায়ের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো।

৫৫৫৪। ইয়াহয়া (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, আবু সুফিয়ান (রাযিঃ) তাকে জানিয়েছেন যে, (রোমসম্রাট) হিরাক্লিয়াস তাকে ডেকে পাঠায়। তথায় আবু সুফিয়ান বললেন যে, তিনি অর্থাৎ নবী (ﷺ) আমাদের নামায আদায় করতে, যাকাত দিতে, পবিত্র থাকতে এবং রক্তের সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেন।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

হিজরী ৬ সালে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সন্ধি স্থাপিত হয়। হিজরতের পর থেকে সন্ধিস্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে। অধিকাংশ সময় নবী কারীম সাল্লা 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে চতুর্দিকে ইসলাম প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যায়নি। হিজরী ৬ষ্ঠ সালে তিনি প্রায় দেড় হাজার সাহাবীসহ উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকগণ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির ফেলতে বাধ্য হন। সেখানে অনেক আলাপ-আলোচনার পর কুরায়শদের সংগে তাঁর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থাপিত হয়। এ চুক্তির ফলে পূর্ণোদ্যমে দা'ওয়াতী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ হয়। অভ্যন্তরীণ প্রচার-প্রচারণার বাইরেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে দা'ওয়াতীপত্র প্রেরণ করতে থাকেন। এরকম একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল রোমের বাদশার কাছেও। পত্রবাহক ছিলেন হযরত দিহয়া কালবী রাযি.। তখনকার রোমের বাদশা ছিলেন হিরাল (হেরাক্লিয়াস)। উপাধি কায়সার/কাইযার। রোমের প্রত্যেক বাদশাকেই কাইযার বলা হত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি যখন তার হাতে পৌঁছায়, তখন তিনি ঈলিয়া (বায়তুল মুকাদ্দাস) অবস্থান করছিলেন। হিরাকল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। চিঠি পাওয়ার পর চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তিনি চাইলেন পত্রপ্রেরক (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। তারপর ভালোভাবে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাঁর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রদান আরবের কোনও লোকের পক্ষেই সম্ভব। সে লোক যদি মক্কার হয়, বিশেষত তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেউ হয়, তবে আরও ভালো। এমন কোনও লোক পাওয়া যায় কিনা, তিনি খোঁজ নিতে বললেন। ঘটনাক্রমে আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এ সময় ফিলিস্তীনে অবস্থান করছিল। তারাও যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত থাকায় এতদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিতে পারেনি। যাহোক হিরাকলের লোকজন আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলার সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা তাদেরকে রাজদরবারে নিয়ে হাজির করল। কাফেলার প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর জানা গেল আবূ সুফয়ানই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। উভয়ে একই কুরায়শ বংশের লোক ও মক্কার বাসিন্দা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা ভালো ধারণা তিনিই দিতে পারবেন। কাজেই কথোপকথনের জন্য কাফেলার লোকদের মধ্যে হিরাকল তাকেই নির্বাচন করলেন। রোম সম্রাটের দরবারে আবূ সুফয়ান: সম্রাটের পারিষদবর্গের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন দরবারে উপস্থিত। আবূ সুফয়ানকে তাদের সামনে বসানো হল। তার সঙ্গীদের বসানো হল তার পেছনে। এটা ছিল হিরাকলের সতর্কতা। যাতে তারা পরস্পর ইশারা-ইঙ্গিতে ভাবের লেনদেন করতে না পারে। হিরাকল তাকে নবী কারীম 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম' সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। আবূ সুফয়ান তার প্রত্যেকটির সঠিক উত্তর দান করেন। একটি প্রশ্নেরও উত্তরে কোনও অসত্যকথা বলেননি। সংক্ষিপ্ত নববী শিক্ষার ভেতর পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ছবি: যাহোক হিরাকল আবূ সুফয়ানকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলেন। আমরা তার বিস্তারিত বিবরণের দিকে যাচ্ছি না। এখানে কেবল এতটুকু উল্লেখ্য যে, হিরাকল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের কী আদেশ করেন (অর্থাৎ কী শিক্ষা দেন)? আবূ সুফয়ান উত্তর দিলেন, তিনি বলে থাকেন- তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনওকিছুকে শরীক করো না। তোমাদের বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিত্যাগ কর। আর তিনি আমাদেরকে সালাত, সিদক (সততা ও সত্যবাদিতা), আফাফ (সংযম ও শুচিতা) ও আত্মীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন। লক্ষ করলে বোঝা যায় এর ভেতর সংক্ষেপে ইসলামের মূল শিক্ষাসমূহ এসে গেছে। ইসলামের সর্বপ্রধান শিক্ষা ‘আকীদা-বিশ্বাস। আকীদা-বিশ্বাসের ভেতর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাওহীদ। অর্থাৎ আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সংগে কাউকে শরীক না করা। এ হাদীছে প্রথমে সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে এটা 'আকীদা বিষয়ক একটি শিরোনাম। আখিরাত, রিসালাত, তাকদীর প্রভৃতি বিষয়ক বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। মু'মিন হওয়ার জন্য তার সবগুলোতেই বিশ্বাস রাখা জরুরি। তবে সবার আগে যেহেতু তাওহীদ, তাই শিরোনাম হিসেবে এখানে তাওহীদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিহার করতে বলে মূলত শিরক পরিহারের কথাই বলা হয়েছে। আরবে যুগ-যুগ ধরে মূর্তিপূজা চলে আসছিল। পরের প্রজন্ম আগের প্রজন্মকে দেখে দেখে সেটাকেই সত্যধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। এর বিপরীত কোনও কথা তারা মানতে রাজি ছিল না। সাধারণভাবে সর্বত্র এটাই মানুষের চরিত্র। বাপ-দাদাদের যা করতে দেখে আসে তা করতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার বিপরীত কিছু মানতে রাজি হয় না। আরব মুশরিকগণও তা মানছিল না। তাদের বড় অভিযোগ ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আবূ সুফয়ান হয়তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষাটিকে অভিযোগ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি নিজেও বাপ-দাদার পথকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে নতুন পথে চলছেন, অন্যদেরও সে পথে চালাতে চাচ্ছেন। এভাবে বাপ-দাদাকে গোমরাহ সাব্যস্ত করা ও যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ধর্মমতকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করা কি কোনও সমর্থনযোগ্য কাজ? এটা কি চরম অন্যায় ও গর্হিত কাজ নয়? এজন্যই আমরা তার নতুন ধর্ম সমর্থন করতে পারছি না। সম্ভবত এই বলে তিনি হেরাক্লিয়াসকেও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। কারণ হেরাক্লিয়াস ও তার জাতিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া সত্যধর্মের বিপরীতে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ভ্রান্ত রীতি-নীতি অনুসরণ করছিল আর তাকেই প্রকৃত খৃষ্টধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। কিন্তু আবূ সুফয়ানের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। কেননা তার মুখ থেকে যাবতীয় তথ্য শোনার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সত্য নবী এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বর, যাঁর সম্পর্কে আগের সমস্ত নবী-রাসূল ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এ কারণে হেরাক্লিয়াস নিজেও ঈমান আনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন পারিষদবর্গ ও যাজক-পুরোহিতদের স্পষ্ট বিরোধিতা লক্ষ করলেন এবং তার পরিণতিতে সিংহাসন হারানোরও আশংকা বোধ করলেন, তখন ভ্রান্ত জানা সত্ত্বেও প্রচলিত খৃষ্ট ধর্মমতেই অবিচল থাকলেন। ক্ষমতার মোহে পড়লে মানুষ এভাবেই সত্যবিমুখ হয়ে থাকে এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার স্বার্থে আখিরাতের চিরস্থায়ী সফলতা বিসর্জন দেয়।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক নিষ্প্রয়োজন