আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫৯৭৮
৩১৬৯. মুশরিক পিতার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
৫৫৫৩। হুমায়দী (রাহঃ) ......... আবু বকর (রাযিঃ) এর কন্যা আসমা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি নবী (ﷺ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলামঃ তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব কিনা? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। ইবনে উয়াইনা (রাহঃ) বলেন, এ ঘটনা প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা নাযিল করেনঃ যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে না, তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হিজরী ৬ষ্ঠ সনে হুদায়বিয়ায় কুরায়শদের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দশ বছর মেয়াদী এক শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তি মোতাবেক উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকে। শান্তিপূর্ণ এ পরিবেশ চলাকালে হযরত আসমা রাযি.-এর মা কুতায়লা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ইবন সা'দ, আবূ দাউদ তয়ালিসী ও হাকিমের বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, তিনি মেয়েকে দেওয়ার জন্য সঙ্গে করে কিছু কিসমিস, ঘি ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু মুশরিক ছিলেন, তাই হযরত আসমা রাযি. তার সে হাদিয়া গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তাকে নিজ ঘরে প্রবেশ করতে দিতেও রাজি হচ্ছিলেন না। আবার এতদূর থেকে তাঁর মা এসেছেন, তাই তাকে কিভাবেই বা নিরাশ ফিরিয়ে দেবেন? তাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য তিনি ছোট বোন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কাছে কাউকে পাঠিয়ে বলে দেন তিনি যেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে প্রবেশ করতে দিক এবং তার হাদিয়াও গ্রহণ করুক।৯০

হাদীছে আছে- (আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম)। প্রকৃতপক্ষে জিজ্ঞেস করেছিলেন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি। তবে তাঁর সে জিজ্ঞাসা যেহেতু তাঁরই জন্য ছিল, তাই হযরত আসমা রাযি. নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেছেন আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন (আমার মা আমার কাছে এসেছে কিছু পাওয়ার আশাবাদী হয়ে)। মুহাদ্দিছগণ راغبة -এর বিভিন্ন অর্থ করেছেন। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন তিনি এসেছেন ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে। কেউ কেউ এ কারণে তাকে সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু কোনও বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে তার ইসলামগ্রহণের প্রমাণ মেলে না। তাই তাকে সাহাবী বলা মুশকিল। বস্তুত এস্থলে راغبة-এর অর্থ আগ্রহী নয়; বরং আশাবাদী। অর্থাৎ তিনি এসেছিলেন এই আশায় যে, তার মেয়ে তাকে কিছু না কিছু অবশ্যই দেবে, একদম খালি হাতে ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু তিনি যেহেতু মুশরিক ছিলেন, তাই হযরত আসমা রাযি. তাকে কিছু দেবেন কিনা সে ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি চাইলেন। যদি ইসলাম গ্রহণের আশায়ই আসতেন, তবে অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারাও এ ব্যাখ্যার সমর্থন মেলে। তাতে আছে, তিনি এসেছিলেন আশা ও ভয়ের সঙ্গে। অর্থাৎ একদিকে এই আশা ছিল যে, তার মেয়ে তাকে কিছু না কিছু অবশ্যই দেবে, অন্যদিকে তিনি যেহেতু মুশরিক ছিলেন তাই এই ভয়ও ছিল যে, হয়তো তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে।

কেউ কেউ راغبة -এর অর্থ করেছেন 'অনাগ্রহী' ও 'বিমুখ'। শব্দটি মূলত পরস্পরবিরোধী অর্থবোধক। শব্দটির পর في ও অব্যয় যুক্ত হলে তখন অর্থ হয় আগ্রহী। আর যদি عن অব্যয় যুক্ত হয়, তখন অর্থ হয় অনাগ্রহী। তাই কেউ কেউ অর্থ করেছেন যে, তিনি এসেছেন ইসলামগ্রহণে অনাগ্রহের সঙ্গে। তবে যেহেতু তিনি মা ছিলেন, তাই এই আশাও ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ না করলেও তার মেয়ে তাকে হতাশ করবে না।

সারকথা হযরত আসমা রাযি.-এর মা যেহেতু মুসলিম ছিলেন না, ইসলাম গ্রহণের কোনও আগ্রহও তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি, তাই তিনি তাকে কোনও উপহার উপঢৌকন দেবেন কি না সে ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলেন। বললেন (আমি কি আমার মায়ের প্রতি সদাচরণ করব?)। অর্থাৎ তার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করব এবং তাকে কোনও উপহার উপঢৌকন দেব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন (হাঁ, তোমার মায়ের প্রতি সদাচরণ কর)। হাদীসে আছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন-

لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ

'যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন।৯১

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন অমুসলিম হলেও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করা বাঞ্ছনীয়।

খ. পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন অমুসলিম হলে তাদের প্রতি আচার-আচরণে ঈমানী মূল্যবোধ ও ইসলামী আত্মাভিমানেরও পরিচয় দেওয়া চাই।

গ. কোনও বিষয়ে দীন ও শরীআতভিত্তিক কোনও খটকা দেখা দিলে সে বিষয়ে আলেমদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা উচিত।

৯০. ইবন সা'দ, আত্ তাবাকাতুল কুবরা, ৮ খণ্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা। মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬১১১

৯১. সূরা মুমতাহিনা (৬০), আয়াত ৮
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন