আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৫৯৭৫
৩১৬৮. পিতা-মাতার নাফরমানী করা কবিরা গুনাহ।
৫৫৫০। সা’দ ইবনে হাফস ......... মুগীরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন:- মা-বাবার নাফরমানী করা, প্রাপকের প্রাপ্য আটকে রাখা, যে জিনিস গ্রহণ করা তোমাদের জন্য ঠিক নয় তা তলব করা এবং কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া। আর তিনি তোমাদের জন্য অপছন্দ করেছেন:- গল্প-গুজব করা, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা ও সম্পদ নষ্ট করা।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে ছয়টি নিষিদ্ধ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম চারটির নিষিদ্ধতা শেষের দু'টি অপেক্ষা অধিকতর কঠোর। তাই প্রথম চারটির জন্য ‘হারাম' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং পরের দুটির জন্য 'কারাহাত' (অপসন্দ) শব্দ। নিচে আলাদাভাবে প্রত্যেকটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।
মায়ের অবাধ্যতা করা
عقوق الأمهات (মায়েদের অবাধ্যতা)। الأمهات শব্দটি أم -এর বহুবচন। সরাসরি এর দ্বারা জন্মদাত্রী মাকে বোঝানো হয়। ব্যাপক অর্থে দাদী ও নানীও এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে এ ব্যাপক অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং অবাধ্যতা করার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তারাও শামিল রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জন্মদাত্রী মায়ের স্থান সর্বোচ্চে। শরীআতসম্মত কাজে তার অবাধ্যতা করা কঠিনতম গুনাহ। দাদী ও নানীর আনুগত্যও জরুরি। তবে মায়ের পরে। অনুরূপ মায়ের খেদমত ও সেবাযত্ন করা যেমন কর্তব্য, তেমনি তাদের সেবাযত্নও কর্তব্য বটে। তবে অপেক্ষাকৃতভাবে মায়ের ক্ষেত্রে এ কর্তব্য পালনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্রকাশ থাকে যে, মায়ের আনুগত্য করার মত পিতার আনুগত্য করাও অবশ্যকর্তব্য। মায়ের অবাধ্যতা করা যেমন হারাম, তেমনি পিতার অবাধ্যতা করাও হারাম। কুরআন হাদীছে সাধারণত উভয়ের আনুগত্য করার আদেশ একসঙ্গেই করা হয়েছে। তবে পূর্বে উদ্ধৃত এক হাদীছে গেছে যে, মায়ের হক পিতার হকের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তাই তুলনামূলক মায়ের অবাধ্যতা করাও পিতার অবাধ্যতা অপেক্ষা কঠোরতর গুনাহ। এ কারণেই কোনও কোনও হাদীছে আলাদাভাবে মায়ের আনুগত্য ও অবাধ্যতা করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন আলোচ্য এ হাদীছে। কাজেই এর দ্বারা পিতার অবাধ্যতা করার গুনাহকে খাটো করে দেখা যাবে না।
উল্লেখ্য, শরীআত পুরুষকে পরিবারের আমীর বানিয়েছে। কাজেই কোনও ক্ষেত্রে পিতা-মাতার আদেশ যদি সাংঘর্ষিক হয় অর্থাৎ পিতা এক হুকুম করে এবং মা অন্য হুকুম, সে ক্ষেত্রে মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার বজায় রেখে পিতার হুকুম মানাই কৰ্তব্য। সাধারণভাবে মায়ের হক যে তিনগুণ, মুহাক্কিক আলেমগণ স্পষ্ট করেছেন যে, সরাসরি তার সম্পর্ক খেদমত ও সেবাযত্নের সঙ্গে। আনুগত্যের বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। মায়ের আদেশ পিতার আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে সে ক্ষেত্রে উভয়ের আদেশই পালন করা কর্তব্য। যার আদেশই অমান্য করা হবে তাতেই কঠিন গুনাহ হবে। অবশ্য মায়ের আদেশ অমান্য করার কারণে তুলনামূলকভাবে গুনাহ বেশি হবে।
কৃপণতা করা এবং অন্যের সম্পদ দাবি করা
ومنعا وهات (কৃপণতা করা এবং অন্যের সম্পদ দাবি করা)। منعا শব্দটি আলিফসহও (অর্থাৎ তানবীন ছাড়া) পড়া যায় এবং আলিফ ছাড়াও পড়া যায়। এর অর্থ অন্যের যে হক আদায় করা জরুরি তা আদায় না করে তাদেরকে বঞ্চিত করা। আর هاتঅর্থ অন্যায়ভাবে অন্যের হক দাবি করা। এ দু'টিই কঠিন পাপ। বর্তমানকালে এটা ব্যাপকভাবেই চলছে। অধিকাংশ লোকই নিজ কর্তব্য বা অন্যের পাওনা যথাযথভাবে আদায় করে না, অথচ অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য তার জন্য ঝগড়া-বিবাদ ও আন্দোলন করে। এমনকি যা প্রাপ্য নয় তাও হাতিয়ে নেওয়ার জন্য নানা তদবির করে। চাকরিজীবি নিজ দায়িত্ব পালনে গাফলাতি করে কিন্তু সময়মত বেতন দেওয়ার জন্য মালিকপক্ষকে চাপ দেয়, আবার বেতনের বাইরেও উপরি অর্জনের চেষ্টা করে। যে-কোনও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষই নিজ কর্তব্য পালনে টালবাহানা করে, কিন্তু অন্যের কাছ থেকে নিজ অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালায়, সেইসঙ্গে অধিকারের বেশি নিতেও লজ্জাবোধ করে না। ইসলামে এটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক কাজ। একে তাতফীফ (تطفيف) বলা হয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
‘বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয় আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়।১৪৫
এটা কেবল মাপের সঙ্গেই খাস নয়; যে-কোনও প্রদান ও গ্রহণের জন্যই এটা প্রযোজ্য। ইমাম মালিক রহ. বলেন- 'لكل شيء وفاء وتطفيف (যে-কোনও বিষয়েই পরিপূর্ণ প্রদান ও ঠকানোর ব্যাপার আছে)।
কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দেওয়া
وواد البنات (এবং কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দেওয়া)। জাহিলী যুগে কন্যাসন্তানের জন্মকে লজ্জাজনক মনে করা হতো। পিতা ও অভিভাবক তাকে বাড়তি বোঝা মনে করত। এ সন্তানকে লালন-পালন করতে হবে, তারপর বড় হয়ে সে না আয়-রোজগার করবে, না ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশ নিতে পারবে; বরং তাকে বিয়ে দিয়ে অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কাজেই শুধু শুধু এ বাড়তি বোঝা কেন বহন করতে যাওয়া। তাই জন্মের পরপরই তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। কুরআন মাজীদ সে সময়কার মানুষের ধ্যান-ধারণা এভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যে-
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান (জন্মগ্রহণ)-এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ-ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে মানুষ থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জেনে রেখ, তারা যে সিদ্ধান্ত স্থির করে তা অতি মন্দ!১৪৬
ইসলাম এ বর্বরতা নিষিদ্ধ করে এবং একে কঠিন পাপ বলে ঘোষণা করে। ফলে ইসলামী সমাজ থেকে এ জাহিলিয়াত নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু ইসলামের বাইরে অন্যান্য সমাজে মেয়ে শিশু আজও অবহেলিত। তথাকথিত এ সভ্য যুগেও বিভিন্ন সমাজে কন্যা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। ইসলামী শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনায় যারা পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি, এরকম কোনও কোনও মুসলিমও ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
ইসলামে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু উভয়ই আল্লাহর দান। উভয়কেই সমান যত্নে লালন-পালন করা পিতা-মাতার উপর ফরয। বরং কন্যাসন্তানকে অধিকতর যত্নের সঙ্গে লালন-পালনের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কন্যাসন্তান লালন-পালনের ছাওয়াবও বেশি বলে জানানো হয়েছে। কাজেই মুসলিম সমাজকে এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন হতে হবে। ছেলে ও মেয়ের মধ্যকার জাহিলী বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী শিক্ষা মোতাবেক তাদেরকে লালন-পালন করতে হবে এবং ছেলেকে আদর্শ ছেলে ও মেয়েকে আদর্শ মেয়েরূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
অনর্থক কথা বলা
قيل وقال (অনর্থক কথা বলা)। উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কেউ বলেন, এর অর্থ অতিরিক্ত কথা বলা। বেশি কথা বললে বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এটা নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া অহেতুক বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। সে কারণেও এটা নিষেধ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تكثروا الكلام بغير ذكر الله، فإن كثرة الكلام بغير ذكر الله قسوة للقلب، وإن أبعد الناس من الله القلب القاسي
'তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলো না। কেননা আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য কথা বেশি বললে মন শক্ত হয়ে যায়। যার মন শক্ত, সে আল্লাহর রহমত থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে থাকে।১৪৭
কারও মতে এর অর্থ অন্যের কথা বলে বেড়ানো। অর্থাৎ কারও কাছ থেকে কোনও কথা শুনেই তা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া প্রচার করতে থাকা। যেমন- শুনেছ, অমুকে এই এই কথা বলেছে। এটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা শোনা কথাটি সত্য নাও হতে পারে। এর দ্বারা অন্যের মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে সমাজে নানারকম অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাই কুরআন-হাদীছ যাচাই-বাছাই ছাড়া শোনা কথার পেছনে পড়তে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।১৪৮
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন كفى بالمرء كذبا أن يحدث بكل ما سمع “কোনও ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই বলে বেড়াবে।১৪৯
কারও মতে এর অর্থ কুরআন, হাদীছ ও দীনী বিষয়ে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া। যেমন কুরআন মাজীদের মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, তাকদীর সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করা, দীনের যে বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা ইত্যাদি। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এসে দেখেন কয়েকজন সাহাবী তাকদীর নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি তাতে খুবই নাখোশ হন। তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন-
أبهذا أمرتم، أم بهذا أرسلت إليكم؟ إنما هلك من كان قبلكم حين تنازعوا في هذا الأمر، عزمت عليكم ألا تتنازعوا فيه
'তোমাদেরকে কি এরই আদেশ করা হয়েছে, নাকি আমাকে তোমাদের কাছে এ নিয়ে পাঠানো হয়েছে? জেনে রেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের কঠোর নির্দেশ দিচ্ছি তোমরা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে না।১৫০
অনেকেরই অভ্যাস দীনী বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মত তুলে ধরা। অথচ সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা নেই। এর ফলে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। এমনকি সামাজিক কলহ-বিবাদও শুরু হয়ে যায়। এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। দীনের যে বিষয় সম্পর্কে জানা নেই, সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা গুরুতর অপরাধ। যে-কোনও অজানা বিষয়ে কথা বলাই অপরাধের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে।১৫১
অতিরিক্ত সুওয়াল করা
وكثرة السؤال (এবং অতিরিক্ত সুওয়াল করা)। সুওয়াল করা অর্থ প্রশ্ন করা, চাওয়া, যাচনা করা ইত্যাদি। অতিরিক্ত সুওয়াল করা দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য বা কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন এর অর্থ মানুষের খবরাখবর ও সময়ের অবস্থাদি সম্পর্কে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা। কেননা অনেক সময়ই এটা অহেতুক পেরেশানির কারণ হয়। তাছাড়া এ জাতীয় প্রশ্ন একটা বেহুদা কাজও বটে এবং এর ফলে অহেতুক সময় নষ্ট তো হয়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه 'কোনও ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হলো নিরর্থক সবকিছু পরিত্যাগ করা।১৫২
কারও মতে অতিরিক্ত সুওয়াল করার অর্থ বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর নেওয়া। যেমন সে কী করে, কোথায় থাকে, কত রোজগার করে, কোথায় বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে কী, ছেলে-মেয়েরা কে কী করে ইত্যাদি। এ জাতীয় খোঁজখবর নেওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। যার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয় তার পক্ষে এটা বিব্রতকর। অনেকে এটা পসন্দ করে না। অন্যকে অহেতুক বিব্রত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়। বিশেষত যদি অন্যের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা নিষিদ্ধ ছিদ্রান্বেষণের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجَسَّسُوا “তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না।১৫৩
কেউ বলেন, এর অর্থ যা ঘটা সম্ভব নয় কিংবা কদাচ ঘটে এমন বিষয় সম্পর্কে শরীআতের মাসআলা জানতে চাওয়া। কোনও কোনও হাদীছে এ জাতীয় প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, যারা দীনী বিষয়ে অহেতুক খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হয়, তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। তাঁর পরে এ শ্রেণীর লোকের উপর আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। আমি উমরকে দেখেছি এদের ব্যাপারে খুব বেশি ভয় করতেন।১৫৪
কারও মতে এর অর্থ ধাঁধা বলা ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করা। হযরত মুআবিয়া রাযি, বলেন نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الأغلوطات “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন।১৫৫
ভিক্ষা করার কদর্যতা
উলামায়ে কেরামের অনেকেই বলেন, বেশি সুওয়াল করার দ্বারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা বা পীড়াপীড়ির সাথে মানুষের কাছে অর্থসাহায্য চাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। ইসলামে এটা কঠোরভাবে নিষেধ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إن المسألة لا تحل إلا لأحد ثلاثة رجل تحمل حمالة، فحلت له المسألة حتى يصيبها، ثم يمسك، ورجل أصابته جائحة اجتاحت ماله، فحلت له المسألة حتى يصيب قواما من عيش -أو قال: سدادا من عيش - ورجل أصابته فاقة حتى يقوم ثلاثة من ذوي الحجا من قومه لقد أصابت فلانا فاقة، فحلت له المسألة حتى يصيب قواما من عيش - أو قال: سدادا من عيش ، فما سواهن من المسألة -يا قبيصة - سحتا يأكلها صاحبها سحتا
“তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও জন্য সুওয়াল করা বৈধ নয় এক. ওই ব্যক্তি, যে কারও দায় বহন করেছে (ফলে দেনাদার হয়ে গেছে)। তার জন্য সুওয়াল করা বৈধ, যাতে করে সে সেই দেনা পরিশোধ করতে পারে। তারপর (অর্থাৎ দেনা পরিশোধ হয়ে যাওয়ার পর) সে ক্ষান্ত হবে। দুই. ওই ব্যক্তি, কোনও দুর্যোগে যার সম্পদ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তার জন্যও সুওয়াল করা জায়েয, যতক্ষণ না তার জীবনধারণের কোনও ব্যবস্থা হয়ে যায়। তিন. এবং ওই ব্যক্তি, যে চরম অভাব-অনটনে পড়ে গেছে এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে তিনজন বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন লোক সাক্ষ্য দেয় যে, সে অনাহারের স্বীকার হয়েছে। তার জন্যও সুওয়াল করা জায়েয, যতক্ষণ না তার জীবনধারণের কোনও ব্যবস্থা হয়ে যায়। এছাড়া আর যে-কোনও সুওয়াল সুওয়ালকারীর পক্ষে সম্পূর্ণ হারাম। এর মাধ্যমে সুওয়ালকারী হারাম খায়।১৫৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হলো إذا سألت فاسأل الله 'যখন কোনওকিছু চাবে, আল্লাহর কাছেই চাবে।১৫৭
আল্লাহর যারা নেক বান্দা, দুনিয়ায় তারা আল্লাহ তাআলার খলীফা। কাজেই একটু প্রয়োজন হলে তাদের কাছেও চাওয়ার অবকাশ আছে। প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহ তাআলার কাছেই চাওয়া। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে وإن كنت سائلا لا بد، فاسأل الصالحين “তোমার যদি কারও কাছে চাইতেই হয়, তবে নেককারদের কাছে চাবে।১৫৮
সম্পদ নষ্ট করা
وإضاعة المال (এবং সম্পদ নষ্ট করা)। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এর অর্থ করেছেন অপচয় করা। কেউ কেউ হারাম খাতে খরচ করাও বলেছেন। এমনিভাবে যদি অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাজত না করা হয় আর এ কারণে তা চুরি হয়ে যায়। বা রোদ-বৃষ্টিতে কিংবা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাও সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বস্তুত ইচ্ছাকৃত সম্পদ নষ্ট করে ফেলা কিংবা শরীআত যে খাতে খরচ করার অনুমতি দেয়নি, তা দুনিয়াবী বিষয় হোক বা দীনী বিষয় হোক, সে খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ তাআলা অর্থ-সম্পদকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ বানিয়েছেন। অপব্যয় ও অপচয় দ্বারা প্রয়োজন মেটানো ব্যাহত হয়। যে ব্যক্তি অপব্যয় করে, তার নিজের ক্ষতি তো হয়ই, অনেক সময় তাতে অন্যেরও ক্ষতি হয়। তাই কুরআন মাজীদ পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا “এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।১৫৯
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا “(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে।১৬০
পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশদানের পাশাপাশি অপব্যয় ও অপচয়ের প্রতি সরাসরিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক আদায় করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও (তাদের হক প্রদান করো)। আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখ, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।১৬১
আখেরাতে পুরস্কার পাওয়ার আশায় যদি দীনের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয় তবে তা দূষণীয় নয়, যদি না তাতে দীনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি তিন রকম হতে পারে।
এক. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে নিন্দনীয়, সেসকল খাতে ব্যয় করা। এটা নিঃসন্দেহে নিষেধ।
দুই. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে পসন্দনীয়, সেসকল খাতে বেশি বেশি খরচ করা কাম্য বটে, তবে শর্ত হলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত না হওয়া।
তিন. মুবাহ ও জায়েয খাতে খরচ করা। অর্থাৎ এমন খাতে, মৌলিকভাবে যে খাতে খরচ করলে ছাওয়াবও নেই, গুনাহও নেই। যেমন সাধ-আস্বাদ মেটানোর পেছনে ব্যয় করা। এটা আবার দু'প্রকার হতে পারে- ক. এমন মাত্রায় খরচ করা, যা খরচকারীর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা অপব্যয় নয়। খ. এমন পরিমাণ খরচ করা, যা তার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; বরং তার বেশি। এটা যদি বর্তমান বা সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করার জন্য হয়ে থাকে, তবে তা অপব্যয় নয়। আর সেরকম না হলে অপব্যয় বলে গণ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশে যার ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে সে যদি তার সবটা মাল দীনী কাজে খরচ করে ফেলে, তবে তা দূষণীয় নয়। এটা দূষণীয় ওই ব্যক্তির পক্ষে, যার কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করার ক্ষমতা নেই।
ঘর-বাড়ির পেছনে প্রয়োজনের বেশি খরচ করা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমাদেরকে অবশ্যই পিতা-মাতার অবাধ্যতা পরিহার করতে হবে।
খ. নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করে অন্যের কাছ থেকে অধিকার আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা-তদবীর অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
গ. কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করে যত্ন সহকারে তাদের লালন পালন করা চাই।
ঘ. শোনা কথায় কান দিতে নেই এবং তা গেয়ে বেড়ানোও উচিত নয়।
ঙ. অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ। আমাদেরকে তা পরিহার করতে হবে।
চ. ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। চরম অপারগ অবস্থা না হলে অন্যের কাছে হাত পাতা উচিত নয়।
ছ. ইচ্ছাকৃত অর্থ-সম্পদ নষ্ট করা এবং অপচয় ও অপব্যয় করা জায়েয নয়।
১৪৫. সূরা মুতাফ্ফিফীন (৮৩), আয়াত ১-৩
১৪৬. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৫৮-৫৯
১৪৭. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং২৪১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩১৮৭৯; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬০০
১৪৮. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ৬
১৪৯. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৯২; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৮৮৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৫৬১৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫৫৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৪৩
১৫০. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৩৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬০৪৫
১৫১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৬
১৫২. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩১৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৩৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮৮৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৩২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৩২
১৫৩. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১২
১৫৪. সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৪০
১৫৫. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯১৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৪৩
১৫৬, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৪৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৪০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৯; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭২০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৬০১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহ, হাদীছ নং ১০৬৮৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩২৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯৪৭
১৫৭. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৬৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৪১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৩;
১৫৮. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৪৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৯৪৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২৫৮৭
১৫৯. সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৭
১৬০. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯
১৬১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৬-২৭
মায়ের অবাধ্যতা করা
عقوق الأمهات (মায়েদের অবাধ্যতা)। الأمهات শব্দটি أم -এর বহুবচন। সরাসরি এর দ্বারা জন্মদাত্রী মাকে বোঝানো হয়। ব্যাপক অর্থে দাদী ও নানীও এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে এ ব্যাপক অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং অবাধ্যতা করার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তারাও শামিল রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জন্মদাত্রী মায়ের স্থান সর্বোচ্চে। শরীআতসম্মত কাজে তার অবাধ্যতা করা কঠিনতম গুনাহ। দাদী ও নানীর আনুগত্যও জরুরি। তবে মায়ের পরে। অনুরূপ মায়ের খেদমত ও সেবাযত্ন করা যেমন কর্তব্য, তেমনি তাদের সেবাযত্নও কর্তব্য বটে। তবে অপেক্ষাকৃতভাবে মায়ের ক্ষেত্রে এ কর্তব্য পালনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্রকাশ থাকে যে, মায়ের আনুগত্য করার মত পিতার আনুগত্য করাও অবশ্যকর্তব্য। মায়ের অবাধ্যতা করা যেমন হারাম, তেমনি পিতার অবাধ্যতা করাও হারাম। কুরআন হাদীছে সাধারণত উভয়ের আনুগত্য করার আদেশ একসঙ্গেই করা হয়েছে। তবে পূর্বে উদ্ধৃত এক হাদীছে গেছে যে, মায়ের হক পিতার হকের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তাই তুলনামূলক মায়ের অবাধ্যতা করাও পিতার অবাধ্যতা অপেক্ষা কঠোরতর গুনাহ। এ কারণেই কোনও কোনও হাদীছে আলাদাভাবে মায়ের আনুগত্য ও অবাধ্যতা করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন আলোচ্য এ হাদীছে। কাজেই এর দ্বারা পিতার অবাধ্যতা করার গুনাহকে খাটো করে দেখা যাবে না।
উল্লেখ্য, শরীআত পুরুষকে পরিবারের আমীর বানিয়েছে। কাজেই কোনও ক্ষেত্রে পিতা-মাতার আদেশ যদি সাংঘর্ষিক হয় অর্থাৎ পিতা এক হুকুম করে এবং মা অন্য হুকুম, সে ক্ষেত্রে মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার বজায় রেখে পিতার হুকুম মানাই কৰ্তব্য। সাধারণভাবে মায়ের হক যে তিনগুণ, মুহাক্কিক আলেমগণ স্পষ্ট করেছেন যে, সরাসরি তার সম্পর্ক খেদমত ও সেবাযত্নের সঙ্গে। আনুগত্যের বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। মায়ের আদেশ পিতার আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে সে ক্ষেত্রে উভয়ের আদেশই পালন করা কর্তব্য। যার আদেশই অমান্য করা হবে তাতেই কঠিন গুনাহ হবে। অবশ্য মায়ের আদেশ অমান্য করার কারণে তুলনামূলকভাবে গুনাহ বেশি হবে।
কৃপণতা করা এবং অন্যের সম্পদ দাবি করা
ومنعا وهات (কৃপণতা করা এবং অন্যের সম্পদ দাবি করা)। منعا শব্দটি আলিফসহও (অর্থাৎ তানবীন ছাড়া) পড়া যায় এবং আলিফ ছাড়াও পড়া যায়। এর অর্থ অন্যের যে হক আদায় করা জরুরি তা আদায় না করে তাদেরকে বঞ্চিত করা। আর هاتঅর্থ অন্যায়ভাবে অন্যের হক দাবি করা। এ দু'টিই কঠিন পাপ। বর্তমানকালে এটা ব্যাপকভাবেই চলছে। অধিকাংশ লোকই নিজ কর্তব্য বা অন্যের পাওনা যথাযথভাবে আদায় করে না, অথচ অন্যের কাছে নিজের যা প্রাপ্য তার জন্য ঝগড়া-বিবাদ ও আন্দোলন করে। এমনকি যা প্রাপ্য নয় তাও হাতিয়ে নেওয়ার জন্য নানা তদবির করে। চাকরিজীবি নিজ দায়িত্ব পালনে গাফলাতি করে কিন্তু সময়মত বেতন দেওয়ার জন্য মালিকপক্ষকে চাপ দেয়, আবার বেতনের বাইরেও উপরি অর্জনের চেষ্টা করে। যে-কোনও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষই নিজ কর্তব্য পালনে টালবাহানা করে, কিন্তু অন্যের কাছ থেকে নিজ অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালায়, সেইসঙ্গে অধিকারের বেশি নিতেও লজ্জাবোধ করে না। ইসলামে এটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক কাজ। একে তাতফীফ (تطفيف) বলা হয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
‘বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয় আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়।১৪৫
এটা কেবল মাপের সঙ্গেই খাস নয়; যে-কোনও প্রদান ও গ্রহণের জন্যই এটা প্রযোজ্য। ইমাম মালিক রহ. বলেন- 'لكل شيء وفاء وتطفيف (যে-কোনও বিষয়েই পরিপূর্ণ প্রদান ও ঠকানোর ব্যাপার আছে)।
কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দেওয়া
وواد البنات (এবং কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত মাটিচাপা দেওয়া)। জাহিলী যুগে কন্যাসন্তানের জন্মকে লজ্জাজনক মনে করা হতো। পিতা ও অভিভাবক তাকে বাড়তি বোঝা মনে করত। এ সন্তানকে লালন-পালন করতে হবে, তারপর বড় হয়ে সে না আয়-রোজগার করবে, না ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশ নিতে পারবে; বরং তাকে বিয়ে দিয়ে অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কাজেই শুধু শুধু এ বাড়তি বোঝা কেন বহন করতে যাওয়া। তাই জন্মের পরপরই তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। কুরআন মাজীদ সে সময়কার মানুষের ধ্যান-ধারণা এভাবে ফুটিয়ে তুলেছে যে-
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান (জন্মগ্রহণ)-এর সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে মনে মনে দুঃখ-ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে মানুষ থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে), হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে, নাকি তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। জেনে রেখ, তারা যে সিদ্ধান্ত স্থির করে তা অতি মন্দ!১৪৬
ইসলাম এ বর্বরতা নিষিদ্ধ করে এবং একে কঠিন পাপ বলে ঘোষণা করে। ফলে ইসলামী সমাজ থেকে এ জাহিলিয়াত নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু ইসলামের বাইরে অন্যান্য সমাজে মেয়ে শিশু আজও অবহেলিত। তথাকথিত এ সভ্য যুগেও বিভিন্ন সমাজে কন্যা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। ইসলামী শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনায় যারা পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি, এরকম কোনও কোনও মুসলিমও ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
ইসলামে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু উভয়ই আল্লাহর দান। উভয়কেই সমান যত্নে লালন-পালন করা পিতা-মাতার উপর ফরয। বরং কন্যাসন্তানকে অধিকতর যত্নের সঙ্গে লালন-পালনের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কন্যাসন্তান লালন-পালনের ছাওয়াবও বেশি বলে জানানো হয়েছে। কাজেই মুসলিম সমাজকে এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন হতে হবে। ছেলে ও মেয়ের মধ্যকার জাহিলী বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী শিক্ষা মোতাবেক তাদেরকে লালন-পালন করতে হবে এবং ছেলেকে আদর্শ ছেলে ও মেয়েকে আদর্শ মেয়েরূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
অনর্থক কথা বলা
قيل وقال (অনর্থক কথা বলা)। উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কেউ বলেন, এর অর্থ অতিরিক্ত কথা বলা। বেশি কথা বললে বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এটা নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া অহেতুক বেশি কথা বললে মন শক্ত হয়ে যায়। সে কারণেও এটা নিষেধ। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لا تكثروا الكلام بغير ذكر الله، فإن كثرة الكلام بغير ذكر الله قسوة للقلب، وإن أبعد الناس من الله القلب القاسي
'তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলো না। কেননা আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য কথা বেশি বললে মন শক্ত হয়ে যায়। যার মন শক্ত, সে আল্লাহর রহমত থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে থাকে।১৪৭
কারও মতে এর অর্থ অন্যের কথা বলে বেড়ানো। অর্থাৎ কারও কাছ থেকে কোনও কথা শুনেই তা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া প্রচার করতে থাকা। যেমন- শুনেছ, অমুকে এই এই কথা বলেছে। এটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা শোনা কথাটি সত্য নাও হতে পারে। এর দ্বারা অন্যের মানহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে সমাজে নানারকম অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাই কুরআন-হাদীছ যাচাই-বাছাই ছাড়া শোনা কথার পেছনে পড়তে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।১৪৮
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন كفى بالمرء كذبا أن يحدث بكل ما سمع “কোনও ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই বলে বেড়াবে।১৪৯
কারও মতে এর অর্থ কুরআন, হাদীছ ও দীনী বিষয়ে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া। যেমন কুরআন মাজীদের মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, তাকদীর সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করা, দীনের যে বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। সে বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা ইত্যাদি। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এসে দেখেন কয়েকজন সাহাবী তাকদীর নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি তাতে খুবই নাখোশ হন। তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন-
أبهذا أمرتم، أم بهذا أرسلت إليكم؟ إنما هلك من كان قبلكم حين تنازعوا في هذا الأمر، عزمت عليكم ألا تتنازعوا فيه
'তোমাদেরকে কি এরই আদেশ করা হয়েছে, নাকি আমাকে তোমাদের কাছে এ নিয়ে পাঠানো হয়েছে? জেনে রেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের কঠোর নির্দেশ দিচ্ছি তোমরা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে না।১৫০
অনেকেরই অভ্যাস দীনী বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মত তুলে ধরা। অথচ সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ ধারণা নেই। এর ফলে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। এমনকি সামাজিক কলহ-বিবাদও শুরু হয়ে যায়। এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। দীনের যে বিষয় সম্পর্কে জানা নেই, সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা গুরুতর অপরাধ। যে-কোনও অজানা বিষয়ে কথা বলাই অপরাধের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখ, কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদেরকে) জিজ্ঞেস করা হবে।১৫১
অতিরিক্ত সুওয়াল করা
وكثرة السؤال (এবং অতিরিক্ত সুওয়াল করা)। সুওয়াল করা অর্থ প্রশ্ন করা, চাওয়া, যাচনা করা ইত্যাদি। অতিরিক্ত সুওয়াল করা দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য বা কী বোঝানো হয়েছে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন এর অর্থ মানুষের খবরাখবর ও সময়ের অবস্থাদি সম্পর্কে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা। কেননা অনেক সময়ই এটা অহেতুক পেরেশানির কারণ হয়। তাছাড়া এ জাতীয় প্রশ্ন একটা বেহুদা কাজও বটে এবং এর ফলে অহেতুক সময় নষ্ট তো হয়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه 'কোনও ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হলো নিরর্থক সবকিছু পরিত্যাগ করা।১৫২
কারও মতে অতিরিক্ত সুওয়াল করার অর্থ বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর নেওয়া। যেমন সে কী করে, কোথায় থাকে, কত রোজগার করে, কোথায় বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে কী, ছেলে-মেয়েরা কে কী করে ইত্যাদি। এ জাতীয় খোঁজখবর নেওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। যার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয় তার পক্ষে এটা বিব্রতকর। অনেকে এটা পসন্দ করে না। অন্যকে অহেতুক বিব্রত করা শরীআতসম্মত কাজ নয়। বিশেষত যদি অন্যের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা নিষিদ্ধ ছিদ্রান্বেষণের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجَسَّسُوا “তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না।১৫৩
কেউ বলেন, এর অর্থ যা ঘটা সম্ভব নয় কিংবা কদাচ ঘটে এমন বিষয় সম্পর্কে শরীআতের মাসআলা জানতে চাওয়া। কোনও কোনও হাদীছে এ জাতীয় প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. বলেন, যারা দীনী বিষয়ে অহেতুক খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হয়, তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। তাঁর পরে এ শ্রেণীর লোকের উপর আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর চেয়ে বেশি কঠোর আর কাউকে দেখিনি। আমি উমরকে দেখেছি এদের ব্যাপারে খুব বেশি ভয় করতেন।১৫৪
কারও মতে এর অর্থ ধাঁধা বলা ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করা। হযরত মুআবিয়া রাযি, বলেন نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الأغلوطات “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন।১৫৫
ভিক্ষা করার কদর্যতা
উলামায়ে কেরামের অনেকেই বলেন, বেশি সুওয়াল করার দ্বারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা বা পীড়াপীড়ির সাথে মানুষের কাছে অর্থসাহায্য চাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। ইসলামে এটা কঠোরভাবে নিষেধ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إن المسألة لا تحل إلا لأحد ثلاثة رجل تحمل حمالة، فحلت له المسألة حتى يصيبها، ثم يمسك، ورجل أصابته جائحة اجتاحت ماله، فحلت له المسألة حتى يصيب قواما من عيش -أو قال: سدادا من عيش - ورجل أصابته فاقة حتى يقوم ثلاثة من ذوي الحجا من قومه لقد أصابت فلانا فاقة، فحلت له المسألة حتى يصيب قواما من عيش - أو قال: سدادا من عيش ، فما سواهن من المسألة -يا قبيصة - سحتا يأكلها صاحبها سحتا
“তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও জন্য সুওয়াল করা বৈধ নয় এক. ওই ব্যক্তি, যে কারও দায় বহন করেছে (ফলে দেনাদার হয়ে গেছে)। তার জন্য সুওয়াল করা বৈধ, যাতে করে সে সেই দেনা পরিশোধ করতে পারে। তারপর (অর্থাৎ দেনা পরিশোধ হয়ে যাওয়ার পর) সে ক্ষান্ত হবে। দুই. ওই ব্যক্তি, কোনও দুর্যোগে যার সম্পদ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তার জন্যও সুওয়াল করা জায়েয, যতক্ষণ না তার জীবনধারণের কোনও ব্যবস্থা হয়ে যায়। তিন. এবং ওই ব্যক্তি, যে চরম অভাব-অনটনে পড়ে গেছে এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে তিনজন বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন লোক সাক্ষ্য দেয় যে, সে অনাহারের স্বীকার হয়েছে। তার জন্যও সুওয়াল করা জায়েয, যতক্ষণ না তার জীবনধারণের কোনও ব্যবস্থা হয়ে যায়। এছাড়া আর যে-কোনও সুওয়াল সুওয়ালকারীর পক্ষে সম্পূর্ণ হারাম। এর মাধ্যমে সুওয়ালকারী হারাম খায়।১৫৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হলো إذا سألت فاسأل الله 'যখন কোনওকিছু চাবে, আল্লাহর কাছেই চাবে।১৫৭
আল্লাহর যারা নেক বান্দা, দুনিয়ায় তারা আল্লাহ তাআলার খলীফা। কাজেই একটু প্রয়োজন হলে তাদের কাছেও চাওয়ার অবকাশ আছে। প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহ তাআলার কাছেই চাওয়া। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে وإن كنت سائلا لا بد، فاسأل الصالحين “তোমার যদি কারও কাছে চাইতেই হয়, তবে নেককারদের কাছে চাবে।১৫৮
সম্পদ নষ্ট করা
وإضاعة المال (এবং সম্পদ নষ্ট করা)। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এর অর্থ করেছেন অপচয় করা। কেউ কেউ হারাম খাতে খরচ করাও বলেছেন। এমনিভাবে যদি অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাজত না করা হয় আর এ কারণে তা চুরি হয়ে যায়। বা রোদ-বৃষ্টিতে কিংবা অন্য কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাও সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বস্তুত ইচ্ছাকৃত সম্পদ নষ্ট করে ফেলা কিংবা শরীআত যে খাতে খরচ করার অনুমতি দেয়নি, তা দুনিয়াবী বিষয় হোক বা দীনী বিষয় হোক, সে খাতে অর্থ-সম্পদ খরচ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ তাআলা অর্থ-সম্পদকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ বানিয়েছেন। অপব্যয় ও অপচয় দ্বারা প্রয়োজন মেটানো ব্যাহত হয়। যে ব্যক্তি অপব্যয় করে, তার নিজের ক্ষতি তো হয়ই, অনেক সময় তাতে অন্যেরও ক্ষতি হয়। তাই কুরআন মাজীদ পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا “এবং যারা ব্যয় করার সময় না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।১৫৯
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا “(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে।১৬০
পরিমিত ব্যয়ের নির্দেশদানের পাশাপাশি অপব্যয় ও অপচয়ের প্রতি সরাসরিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক আদায় করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও (তাদের হক প্রদান করো)। আর নিজেদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে উড়াবে না। জেনে রেখ, যারা অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ উড়ায়, তারা শয়তানের ভাই।১৬১
আখেরাতে পুরস্কার পাওয়ার আশায় যদি দীনের বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয় তবে তা দূষণীয় নয়, যদি না তাতে দীনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি তিন রকম হতে পারে।
এক. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে নিন্দনীয়, সেসকল খাতে ব্যয় করা। এটা নিঃসন্দেহে নিষেধ।
দুই. যেসকল খাতে খরচ করা শরীআতে পসন্দনীয়, সেসকল খাতে বেশি বেশি খরচ করা কাম্য বটে, তবে শর্ত হলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত না হওয়া।
তিন. মুবাহ ও জায়েয খাতে খরচ করা। অর্থাৎ এমন খাতে, মৌলিকভাবে যে খাতে খরচ করলে ছাওয়াবও নেই, গুনাহও নেই। যেমন সাধ-আস্বাদ মেটানোর পেছনে ব্যয় করা। এটা আবার দু'প্রকার হতে পারে- ক. এমন মাত্রায় খরচ করা, যা খরচকারীর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা অপব্যয় নয়। খ. এমন পরিমাণ খরচ করা, যা তার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; বরং তার বেশি। এটা যদি বর্তমান বা সম্ভাব্য ক্ষতি রোধ করার জন্য হয়ে থাকে, তবে তা অপব্যয় নয়। আর সেরকম না হলে অপব্যয় বলে গণ্য হবে।
প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশে যার ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে সে যদি তার সবটা মাল দীনী কাজে খরচ করে ফেলে, তবে তা দূষণীয় নয়। এটা দূষণীয় ওই ব্যক্তির পক্ষে, যার কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করার ক্ষমতা নেই।
ঘর-বাড়ির পেছনে প্রয়োজনের বেশি খরচ করা কিছুতেই পসন্দনীয় নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমাদেরকে অবশ্যই পিতা-মাতার অবাধ্যতা পরিহার করতে হবে।
খ. নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা করে অন্যের কাছ থেকে অধিকার আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা-তদবীর অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
গ. কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করে যত্ন সহকারে তাদের লালন পালন করা চাই।
ঘ. শোনা কথায় কান দিতে নেই এবং তা গেয়ে বেড়ানোও উচিত নয়।
ঙ. অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ। আমাদেরকে তা পরিহার করতে হবে।
চ. ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। চরম অপারগ অবস্থা না হলে অন্যের কাছে হাত পাতা উচিত নয়।
ছ. ইচ্ছাকৃত অর্থ-সম্পদ নষ্ট করা এবং অপচয় ও অপব্যয় করা জায়েয নয়।
১৪৫. সূরা মুতাফ্ফিফীন (৮৩), আয়াত ১-৩
১৪৬. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৫৮-৫৯
১৪৭. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং২৪১১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩১৮৭৯; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬০০
১৪৮. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ৬
১৪৯. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৯২; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৮৮৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৫৬১৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫৫৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৪৩
১৫০. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৩৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা, হাদীছ নং ৬০৪৫
১৫১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৬
১৫২. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩১৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৩৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮৮৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৩২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৩২
১৫৩. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১২
১৫৪. সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৪০
১৫৫. তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯১৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৪৩
১৫৬, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০৪৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৪০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৯; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৭২০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৬০১; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহ, হাদীছ নং ১০৬৮৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩২৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯৪৭
১৫৭. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৬৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৪১৭; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৪৩;
১৫৮. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৪৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৯৪৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২৫৮৭
১৫৯. সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৭
১৬০. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৯
১৬১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৬-২৭
